দুচাকায় দুনিয়া – ৭

স্কটল্যান্ডের প্রথম শহর গ্লাসগোতে পৌঁছলাম বৃষ্টির মধ্যে। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, নিশীথরঞ্জন দাস আমাকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল তার কাছে থাকবার জন্য। নিশীথের সঙ্গে আমি বঙ্গবাসী কলেজে পড়েছিলাম। তার কাছে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের গল্প শুনতে ভালোবাসতাম। নিশীথের দাদা, সুধীরঞ্জন শান্তিনিকেতনের একজন কৃতী ছাত্র। তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম ছাত্রদলের অন্যতম ছিলেন। আমাকে ছোট ভাইয়ের বন্ধু হিসাবে স্নেহ করতেন এবং পরে শুভানুধ্যায়ী আত্মীয়ের মতো হয়েছিলেন।

নিশীথের সঙ্গে আরও তিনটি ছেলে তাদের কাছে থাকবার জন্য নেমন্তন্ন জানাল, বীরেন রায়, শর্মা ও সলিল সেন (যিনি পরে দিল্লি পলিটেকনিকের প্রিন্সিপ্যাল হয়েছিলেন)। ইতিমধ্যে লর্ড প্রোভোস্ট অব গ্লাসগোর কাছ থেকে নেমন্তন্ন পেলাম দেখা করবার এবং কোবার্ন হোটেলে তিনদিন থাকবার— গ্লাসগো শহরের অতিথি হিসাবে। বিকালে প্রোভোস্ট এক সভা করে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন।

গ্লাসগো ছেড়ে স্কটিশ লেক ডিস্ট্রিক্ট দেখতে গেলাম। সুন্দর গাছপালা, কাচের মতো লেক ও হেদার ফুলে ভরা পাহাড়ের সমাবেশ, ভাষায় বলবার নয়। এডিনবরা আমার গন্তব্য স্থান ছিল। পথে লিনলিথগো ক্যাসল দেখতে গেলাম। লর্ড লিনলিথগো প্রথমবার যখন ভারতবর্ষে গিয়েছিলেন তখন আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়। আমরা কলকাতায় স্টার থিয়েটারে চিরকুমার সভা অভিনয় দেখাই। লিনলিথগো পরে ভারতবর্ষে ভাইসরয় হন। আমি কার্ড পাঠাবার পরেই তিনি বেরিয়ে এলেন এবং সাদরে গ্রহণ করলেন। তখন মস্ত বড় পার্টি চলছিল। আমাকে সবার সামনে উপস্থিত করে পরিচয় দিলেন। সবাই দামি ড্রেস পরে এসেছে, আমি ধুলায় ধূসরিত বেশভূষা পরে তাদের মধ্যে উপস্থিত। সবাই ড্রিঙ্ক অফার করল এবং আমাকে কিছু বলবার জন্য অনুরোধ করল। লর্ড লিনলিথগোর সঙ্গে আলাপ হওয়া থেকে স্কটল্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছনোর ছোট্ট বিবরণ দিলাম। আমার জন্য ডাইনিং রুমে খাবার তৈরি ছিল। খেয়ে এসে আবার পার্টিতে যোগ দিলাম। পরদিন সকালে এডিনবরার পথ ধরলাম।

এডিনবরা শহরটা খুব সুন্দর। শহরের একদিকে পাহাড়। উপত্যকার ভেতর দিয়ে ট্রেন যাতায়াত করে। পাহাড়ের ওপর অনেক উঁচুতে একটা সুন্দর কাসল আছে নাম হলিরুড।

ভারতবর্ষে থাকতে ইংরেজ, স্কটিশ, আইরিশ ইত্যাদির বিশেষত্ব কী এবং কোনও পার্থক্য আছে কিনা বুঝতাম না। স্কটিশ জাতির লোকেরা আমাদের মতো স্বাধীনতাকামী এবং সেইজন্যই ভারতীয়দের স্বগোত্র বলে মনে করত এবং সর্বত্র সহৃদয় ব্যবহার জানাত আমাকে। এমনকী যে সব স্কটম্যান আমাদের দেশে বড় বড় কাজ করেছেন, কিংবা যে সব আই সি এস ছুটিতে দেশে ফিরেছেন তাঁদেরও আমার প্রতি ব্যবহার আশ্চর্যজনক ভালো দেখেছি। নিজ পরিবারের মধ্যে নিমন্ত্রণ করে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং তারপর গান-বাজনা, গল্প-গুজব বা তাসখেলা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার মতো। আমি যেন কত কালের চেনা। সুয়েজ খাল পার হলেই এইসব পুরুষ পুঙ্গব ব্রিটিশ ইম্পিরিয়াল ফোর্সের একজন কেউকেটা, সে কথা যেন তাদের মনে পড়ে যেত। তখন ভারতীয়কে খাতির করা তো দূরের কথা বরং হরিজনের পর্যায়ে ফেলে দূরত্ব বজায় রাখতে ব্যস্ত থাকত।

এডিনবরার প্রোভোস্ট (লর্ড মেয়র) আমার কাছে নেমন্তন্ন পাঠালেন শহরের অতিথি হয়ে দুদিন থাকবার জন্য। ভারতীয় ছাত্রগণ বিশেষ করে ডাক্তারি পড়ছিলেন যাঁরা, তাঁরা আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।

বুড়ো মিত্র নামে এক ডাক্তার আমাকে তাঁর কাছে থাকবার নেমন্তন্ন করলেন। বুড়ো মিত্রর মনটা খুব ভালো। কত ছেলে পড়িয়ে পাশ করিয়ে দিয়েছে তার ঠিক নেই। পরীক্ষার দিন নিজে কিছুতেই মন প্রস্তুত করে পরীক্ষার হলে বসতে পারত না। ফলে জ্ঞান ও বয়স দুই বাড়ছিল। সন্ধ্যা হলে স্কটল্যান্ডের সেরা বোতলের আরাধনা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। যাহোক কয়েক বছর পর মিত্র ভালোভাবে পাশ করল এবং আলজিরিয়াতে (আফ্রিকায়) চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল বলে শুনেছি।

একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে, কলকাতা থেকে আমার এক ছোট বন্ধু একটা চিঠি লিখে আমাকে উৎসাহ দিয়েছিল, তার নাম ধীরেন বসু। আমার নাম লিখেছে খামের ওপর। তারপর ইন্ডিয়ান গ্লোব ট্রটার অন বাইসাইকেল লেখা। ঠিকানা জানত না বলে লিখেছিল, হোয়েরেভার হি মে বি ইন ইংল্যান্ড। প্রথমে লন্ডনে যেখানে ভারতীয়রা একত্র মিলিত হয় সেইসব জায়গায় খোঁজ করে চিঠিটা স্কটল্যান্ডের এডিনবরা শহরে আমার পিছনে ধাওয়া করে ঠিক পৌঁছেছিল।

ট্রসাক্স আমার গন্তব্যস্থান। তারপর ফিরতি পথে ইংল্যান্ডের কোনও একটা পুবদিকের বন্দর থেকে জাহাজ নিয়ে নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড প্রভৃতি উত্তর প্রধান দেশে ভ্রমণে যাবার ইচ্ছা। উত্তর স্কটল্যান্ড বেড়াবার সময় ঘন পাইন দিয়ে ঘেরা একটা খুব সুন্দর জায়গায় পৌঁছলাম। তারই নাম ট্রসাক্স। এই অঞ্চলে অনেক কাগজে আমার কথা লেখা হয়েছিল বলে, আমার পক্ষে পরিচয় দেওয়া সহজ হয়ে গিয়েছিল।

এবারডিন শহরে পৌঁছলাম। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর যেজন্য সবাই একে ‘সিলভার সিটি অব দি নর্থ’ বলে। এবারডিন শহরের মেয়রের কাছ থেকে আহ্বান এল পরদিন দুপুরে শহরের বড় বড় লোকদের সঙ্গে দেখা করবার এবং মধ্যাহ্নভোজের। যাঁরা ভোজনে উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে দুয়েকজন কলকাতায় থেকেছেন।

মেয়র বললেন যে আমি একজন অদ্ভুত ভাগ্যবান পুরুষ। দারুণ গরম থেকে এসে সামান্য গরম জামার ওপর নির্ভর করে, বুভুক্ষু অবস্থায় ইউরোপের দারুণ শীত কাটিয়েছি বললে কম বলা হয়, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এবং মরিনি— এ কী আশ্চর্যের কথা! সকলেই খুব তারিফ করলেন। এমন সময় মেয়র বললেন যে একদিন পরে স্কটল্যান্ডের নিজস্ব মাছের ট্রলার জাহাজ আইসল্যান্ড অঞ্চলে মাছ ধরতে রওনা হবে। যেহেতু আমি ভাগ্যবান পুরুষ বলে তিনি মনে করেন, তাই তাঁর বদলে আমি যেন জাহাজের নামকরণ করি।

এবারডিনে সিটি ফাদার্সদের বাড়ি দুদিন নেমন্তন্ন খেলাম। তারপর এল জাহাজ নামকরণের পালা। সেদিন সমস্ত এবারডিন শহরের লোক বন্দরে ভেঙে পড়েছিল। তারা অনেকেই জাহাজের মেডেন ভয়েজ, অর্থাৎ প্রথম সমুদ্রযাত্রা দেখার জন্য আমন্ত্রিত। মহা উল্লাসের মধ্যে জাহাজের নামকরণ হল ‘মার্গারেট ক্লার্ক’ একটি ছোট নয় বছরের মেয়ে, বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান, তার নামে। বাবা রোনাল্ড ক্লার্ক একজন মোটাসোটা মাঝবয়সী লোক। ব্যবসায় অনেক টাকা করেছে, এবার ট্রলারের ব্যবসা ধরল।

আমি এক বোতল শ্যাম্পেন ভাঙলাম জাহাজের গায়ে। তারপর জাহাজটা নড়ে চড়ে উঠে জানিয়ে দিল সে যাবার জন্য প্রস্তুত। জাহাজে ওঠবার জন্য মিঃ ক্লার্ক আমাকে অনুরোধ করল। জাহাজে উঠে দেখি তিল ধরবার জায়গা নেই। ডেকের ওপর খাবারের পাহাড় জমে রয়েছে। যত স্যান্ডউইচ ছিল একটা রেজিমেন্ট খাওয়ানো যায়। কত বোতল বিয়ার ছিল গুনে শেষ করতে পারলাম না। জাহাজটা সারাদিন নর্থ সীতে পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যায় এবারডিনে ফিরবে। জাহাজে উঠে নানারকম ও স্তরের লোকদের দেখলাম। মেয়রের কাছেই মিঃ ক্লার্ক, তাঁর কন্যা ও আমি ছিলাম।

স্কটল্যান্ডের লোকেরা কী পরিমাণ মদ খায়, বিশেষ করে যদি বিনামূল্যে হয়, তার প্রমাণ সেদিন পেলাম। দুপুরবেলায়ই বেশিরভাগ যাত্রী বেতালা। এই সময় জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলাপ হল। একদিন পরেই জাহাজ অর্কনি ও শেটল্যান্ড দ্বীপ হয়ে আইসল্যান্ড যাত্রা করবে। তখনও একজন নাবিকের কাজ খালি ছিল। আমি ইচ্ছা প্রকাশ করলাম আইসল্যান্ড যাত্রী-জাহাজে চাকরি নেবার। ক্যাপ্টেন আমাকে কাগজপত্রে সই করতে দিল। আমি মহাখুশি যে আইসল্যান্ড যেতে পারব। ক্যাপ্টেন আমাকে সাবধান করে দিল যে ট্রলারে কাজ নিয়ে আইসল্যান্ডের জলপথে দিনের পর দিন মাছ ধরা, কড লিভার অয়েল তৈরি করার কাজে সময় কাটাতে হবে, এককথায় জলের মধ্যে বাস করতে হবে। তাছাড়া জাহাজের কাজও বেশ কঠিন। শীত সাংঘাতিক, মাইনেও যথেষ্ট। জাহাজের মালিক যখন শুনলেন আমি নাবিক হিসাবে নাম লিখিয়েছি, তিনিও খুশি হলেন।

জাহাজের ওপর ব্যান্ডপার্টি ছিল। তারা সমানে উৎসাহ দিচ্ছিল স্ত্রী-পুরুষদের নাচবার জন্য কিন্তু তখন খুব কম লোকই নাচবার অবস্থায় ছিল বা নাচতে উৎসুক ছিল। এমনিভাবে ট্রলারের প্রথম সমুদ্রযাত্রা শুরু হল।

পরদিন আইসল্যান্ড যাবার উৎসাহে কয়েকটা গরম জামাকাপড় কিনলাম। কিন্তু অয়েল ক্লথের টুপি ও ওভার-অল যা ছাড়া জাহাজে একদিনও চলে না, তা কিনবার কথা আমাকে কেউ মনে করিয়ে দেয়নি।

বন্দর লোকে লোকারণ্য। একজন আমাকে বললেন যে জাহাজে কাজ করবার জন্য নাম তো লিখিয়েছি কিন্তু আমার ধারণাই নেই আর্কটিক সমুদ্রে, আইসল্যান্ডে ট্রলার চালানো কী কঠিন জীবন। তিনি খুব সন্দেহ প্রকাশ করলেন যে বাংলাদেশে অর্থাৎ গ্রীষ্মপ্রধান দেশে মানুষ হয়ে আমার পক্ষে শীত ও জলের সঙ্গে যুদ্ধ করে ট্রলারে কাজ করা সম্ভব হবে কিনা। শেষে যখন দেখলেন আমি অবিচল, তখন বললেন, আই উইশ ইউ ভেরি গুড লাক

রওনা হলাম। দশ মিনিটের মধ্যে ক্যাপ্টেন সবাইকে ডেকের ওপর একত্রিত করে কার কী কাজ বুঝিয়ে দিল। প্রত্যেক মাসে কাজ বদলে যাবে। তাছাড়া মাছ ধরা বা ট্রলিং ও মাছ কিওরিং শিখে নিতে হবে। যারা কাজ জানে আর যারা জানে না দুভাগ হল। জানার সঙ্গে অজানা লোক মিলে দল গঠন হল। মোট ১৩ জন নাবিক, ক্যাপ্টেনকে নিয়ে ১৪ জন। আমি ক্যাপ্টেনের সাগরেদ হলাম।

আমার প্রথমদিনের কাজ হল স্টিয়ারিং হুইল চালানো কম্পাসের নির্দেশমতো। সোজা কাজ। শান্ত সমুদ্র, রোদমাখা দিন, যেন দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছি। বিকালে শেটল্যান্ডের উপকূলে জাহাজ পৌঁছল। অনেক ভালো ভালো স্যান্ডউইচ ও সামন মাছ বেঁচেছিল। যার যত খুশি খেলাম। তখনও বুঝিনি জাহাজের নিত্যনৈমিত্তিক আহার কত খারাপ হতে পারে। আমার আটঘণ্টা ডিউটি দুভাগে, আরেকটি যুবকের সঙ্গে। দুদিন পরে আমরা আইসল্যান্ডের দক্ষিণে পৌঁছলাম।

দিনেরবেলায় ট্রলার থেকে আগ্নেয়গিরি হেকলা দেখা যায়। হেকলার কাছাকাছি অনেক ট্রলার ঘোরাফেরা করছিল। রাতের অন্ধকারে ট্রলারের আলোগুলি মনে হয় জোনাকির মতো। এইসব ট্রলার দূর দূর দেশ, এমনকী রাশিয়া, গ্রিস, জার্মানি থেকে দলে দলে আসে আইসল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে মাছ ধরতে। মাছ বলতে বেশিরভাগ কড় ধরে। জলপথে সীমিত জায়গার মধ্যে এত জাহাজ ট্রলিং করতে কেন আসে, তার একটা বিশেষ কারণ আছে। হেকলা আগ্নেয়গিরি থেকে যে লাভা উদগীর্ণ হয় তা সমুদ্রের নিচে চলে যায়। সেখানে বেশ সমতল একটা বেড তৈরি হয়েছে। লাভাতে খুব মিনারেল বা খনিজ পদার্থ থাকে যা মাছের প্রিয় এবং তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। যুগ যুগ ধরে শত শত ট্রলার প্রতিনিয়ত কড মাছ ধরছে কিন্তু মাছের শেষ নেই।

এখন মার্গারেট ক্লার্কের সারথি আমি। ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে সংকেত এল, জাহাজের গতি মন্থর করে দেবার। ট্রলিং বোর্ডস লোহার তারে বাঁধা জলের নিচে একেবারে বেড পর্যন্ত নামিয়ে দেওয়া হল। তারপর জাহাজ চলতে শুরু করল বৃত্তাকারে। তিনঘণ্টা পরে জাল লাগানো ট্রলিং বোর্ড সমুদ্রের নিচ থেকে উঠল বিরাট জালভর্তি এক টনের ওপর মাছ নিয়ে। মাছের চাপে সব মাছ মরে যায় ওপরে ওঠার আগে। সামান্য কিছু বেঁচে থাকে যারা জালের মধ্যে ধরা মাছের তালের ওপরে থাকে।

জাহাজের ডেকের ওপর কাঠের তক্তা দিয়ে চারদিকে দু-তিন হাত উঁচু বেড়া দিয়ে চারভাগ করা ছিল। ক্রেন দিয়ে জালটা ডেকের ওপর আনা হল, তারপর জালের মুখ খুলে মৎস্য বৃষ্টি হল। চারটে কম্পার্টমেন্ট মাছে ভরে গেল। শুধু কি কড মাছ, তাদের সঙ্গে হ্যাডক, প্লেশ, হ্যালিবাট, ক্যাটফিস, সময়ে সময়ে ছোট অক্টোপাসও উঠত। আরও কত কী।

ক্রেন খালি জালটাকে টেনে নিয়ে ট্রলিং বোর্ডসুদ্ধ জলে ফেলে দিল। আবার ট্রলিং শুরু হল তিনঘণ্টার মতো। জাহাজের নাবিকরা মহাখুশি যে প্রথম ট্রলিংয়ে এক বড় ব্যাগ (মাছসুদ্ধ নেটকে ব্যাগ বলে) উঠেছে। পরেরবার মাছ উঠতে যে তিনঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে, তার মধ্যে ডেকের ওপরের সব মাছ কেটে সাফ করে ধুয়ে বরফ-ঠান্ডা ঘরে পাঠাতে হবে। পৃথিবীর এই অঞ্চলে জল এত ঠান্ডা যে জাহাজের নিচের তলা, যাকে হোল্ড বলা হয়, সেটা ফ্রিজিং ঠান্ডা। ডেক থেকে সুড়ঙ্গপথে মাছ নিচে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে একজন নাবিক মাছটা নিয়ে সাজিয়ে রাখে যতদিনে না ১,০০০ টন হয়। জাহাজ অর্থাৎ ট্রলারটার মোট ক্ষমতা ১,০০০ টন মাল বইবার। তারপর কোনও বন্দরে গিয়ে সব মাছ বেচে দেয়। বেচার পর আবার ট্রলিং।

এতদিনেও মাছ নষ্ট হয় না তার প্রধান কারণ যে মাছ ধরেই তার পেট কেটে ফেলা হয়। কেবলমাত্র লিভারটুকু রাখা হয়, বাকি অন্ত্র সব ফেলে দেয়। আরেকজন লোক, সমুদ্রের লোনা জল হোসে করে জোরে মাছের ভেতরটা ধুয়ে নিচে পাঠিয়ে দেয়। এমনিভাবে বোটে অনেকদিন ভালো অবস্থায় মাছ থাকে। কড় ছাড়া অন্য মাছ নিজেদের খাবার জন্য যতটুকু দরকার তা রেখে বাকি সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া রীতি।

জাহাজের ট্রলিং শেষ হলে, যেই মাছের ব্যাগ উঠত, কোথা থেকে দু-তিনশো সী- গাল, আলবাট্রশ জাতীয় নানারকম পাখি জাহাজের ওপর এসে বসত, কেউ সারাক্ষণ কিচিরমিচির করে মাছের ভেতরের জিনিসগুলো সমুদ্র থেকে কুড়িয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। মোটকথা পাখিগুলো শীত, জল, ঝড়ে আমাদের সঙ্গী হয়ে জাহাজে আশ্রয় নিত। আমার কত সময় কেটেছে এইসব পাখিদের ঝগড়া, ভালোবাসা, রেষারেষি, খাওয়া ইত্যাদি মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে, দিনের পর দিন। সমুদ্রের ভীষণ আকর্ষণ আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমার কানে সী-গালের ডাক ভেসে আসে আজও মাঝে মাঝে, ইচ্ছা করে একবার ফিরে যাই তাদের মধ্যে।

সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করত আলবাট্রশ বা আম্ব্রেলা বার্ড। এরা মরা মাছ খেতে চায় না। জাল তোলবার পর অনেক মাছ জাল ছাপিয়ে লাফিয়ে জলে চলে যেত। আম্ব্রেলা বার্ড সেইসব মাছ ধরবার জন্য মুহূর্তে দুটো ডানা গুটিয়ে সমস্ত শরীরকে লাঠির মতো বা ছাতার মতো সরু করে জলে ঝাঁপ দেয়। তারপর সাপের মতো মাছের পিছনে তাড়া দিয়ে জলের গভীরে চলে যায়। শেষকালে মাছের চেয়ে দ্রুত গিয়ে সুস্বাদু মাছ ধরে ফেলে। মুখে মাছ ধরেই জলের ওপরে উঠতে আরম্ভ করে। এবং পরের দৃশ্যটি খুব সুন্দর, জল থেকে ওঠবার আগে ছাতা খোলার মতো জোরে দুটো ডানা খুলে যায়, তখন সে আবার পাখি। আলবাট্রশ পাখি মস্ত বড়। ডানার একপ্রান্ত থেকে অন্যদিক পর্যন্ত প্রায় আট-দশ হাত হবে। এত বড় ছাতা মুহূর্তে খোলার দৃশ্য খুব সুন্দর। মাছটা যতক্ষণ সম্পূর্ণ গলাধঃকরণ না করে ততক্ষণ আলবাট্রশ আকাশে উড়ে বেড়ায়। শেষ হলেই আবার জলে ঝাঁপ, আবার সমস্ত দেহটাকে সঙ্কুচিত করে ছাতার বাঁটের মতো মাছের পিছনে তাড়া।

আমি লক্ষ করেছি একটা আলবাট্টশ পাখি সারাদিন ধরে মাছ ধরল এবং খেল। রাত্রে দেখতে পায় না বলে বিশ্রাম।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য পাখি মাঝে মাঝে দেখতাম, নাম Shit hawk. এদের দেখলে সব সী-গাল ভয়ে সচকিত হয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে যেত। হকের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে, যে সী-গাল আকণ্ঠ মাছ খেয়েছে তাকে ধাওয়া করা। অনেকদূর পালিয়ে যাবার পর সী-গাল ক্লান্ত হয়ে সব মাছ বমি করে ফেলে; হক এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে। সী-গাল ছেড়ে দিয়ে তখন সেই বমি করা মাছ খায়। হক নিজে মাছ ধরবে না বা ধরবার চেষ্টা করবে না। সে বমির মাছ খায়। পৃথিবীতে কতরকম জীবই যে আছে তার ঠিক নেই!

আলবাট্রশের মতো সী-গালও অনবরত মাছ খেতে পারে এবং হজমও করে নিশ্চয়ই।

তিনঘণ্টায় এক টন মাছ কেটে ধুয়ে সাফ করে, উঠতে না উঠতে জাহাজের ঘণ্টা বেজে জানিয়ে দিল যে আরেক ব্যাগ মাছ উঠেছে এবং তখনই ডেকের ওপর ধীরে ধীরে ক্রেন নিয়ে আসছে সেটাকে। আবার বিরাট মাছের তাল ডেকের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। কাঠের পাটাতন দিয়ে উঁচু বাক্সের মতো কম্পার্টমেন্ট করা না থাকলে সব মাছ জলে আবার চলে যেত। এবারের ব্যাগে মাছের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি মনে হল।

ক্রেন ডেকের ওপর মাছ নামিয়ে ট্রলিং বোর্ডস ও জাল আবার সমুদ্রে ফেলল। আবার ট্রলিং শুরু হয়ে গেল। অন্যদিকে ডেক হ্যান্ডস সবাই পুনরুদ্যমে মাছ কাটা ও সাফ করার কাজে মন দিলাম। এই অঞ্চলে যখন মাছ দুবার উঠল তখন ট্রলারের আর বিরাম নেই, লোকেদেরও বিশ্রাম নেই। কখনও কখনও একটানা ৭২ ঘণ্টা দিবারাত্র এই রকম মাছ ধরা, মাছ কাটা এবং স্টক করার কাজ চলতে থাকে। অর্থাৎ যতক্ষণ মাছ জালে উঠছে কারও বিশ্রাম নেই। যার যখন সুবিধা হচ্ছে সে নিচে গিয়ে

খেয়ে আসে।

একবার কোনও মাছ ট্রলিংয়ে উঠল না। ব্যস তিনঘণ্টা ছুটি। তখন নাবিকরা ছুটে যায় বাঙ্কে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে।। হাত ধোওয়ার নাম নেই। সেজন্য সমুদ্রের মাছের আঁশটে গন্ধ, সারাক্ষণ সর্বত্র অঙ্গের ভূষণ হয়ে যায়।

ট্রলারের ক্রুদের মতো এত খাটতে পৃথিবীতে খুব কম মানুষই পারে। জাহাজের লোকেরা প্রায়ই রাম খেত ক্লান্তি ভুলে থাকবার জন্য। জাহাজের কর্তৃপক্ষ যেমন দুবেলা পেট ভরে খাবার জোগাড় দেয় তেমনই রামও দিত বিনামূল্যে।

· এখন শরৎকালের শেষ। দিন ছোট হচ্ছে। মাঝে মাঝে তবু সূর্যের উত্তাপ অনুভব করতাম। নভেম্বর মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া ও বরফ দেখা দিল। সমুদ্র উত্তাল। ঢেউ ট্রলারের ওপর আছড়ে পড়তে লাগল। কাজে একটু অসাবধান হলে ঢেউ টেনে নিয়ে চলে যাবে ভেলার মতো জাহাজের ওপর থেকে। জাহাজ আর তখন জাহাজ-পদবাচ্য নয়। একটা ক্ষ্যাপা সমুদ্রের ওপর বালতির মতো একবার ডুবছে, একবার উঠছে, অথচ ট্রলিং সমানে হয়ে যাচ্ছে। নাবিকরা সেই জলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সব কাজ করছে। ট্রলারের ধার থেকে সমুদ্রের জল মাত্র পাঁচ-ছয় হাত নিচে। তখন সামান্য ঢেউও ট্রলারের ওপর দিয়ে চলে যায়। সমুদ্রে জলের ভীষণ স্রোত। গালফ স্ট্রিমের জন্য জল কখনও শান্ত নয়। একবার ট্রলার থেকে পা ফসকে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। ট্রলারের ডেকের ওপর চারদিকে আষ্টেপৃষ্ঠে লোহার মোটা তার বাঁধা থাকে, ধরে ধরে চলাফেরা করবার জন্য। জলে একবার টেনে নিয়ে গেলে তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। জলের স্রোত কোথায় টেনে নিয়ে যায় তার ঠিকানা নেই। আমি যখন মেছো জাহাজে চাকরি নিই তখন মনে মনে বিশ্বাস ছিল ভালো ভালো মাছ অনেক খেতে পাব। লোভী বাঙালি ছেলের কাছে এটা ছিল মস্ত বড় প্রলোভন। তারপর ‘হা হতোস্মি’! মাছ আছে পর্বতপ্রমাণ কিন্তু রাঁধে কে? তাই, দুবেলা আলুসিদ্ধই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সমুদ্রের মাছ ভালো করে ধুয়ে সেদ্ধ করে দিলে আঁশটে দুর্গন্ধ থাকে। গোলমরিচ গুঁড়ো খুব করে দিয়ে তারপর নাক বন্ধ করে খাওয়া। একদিন খেয়েই মাছ খাবার সব শখ উবে গেল। বেশিরভাগ সময় পাঁউরুটি, মোটা চিনির সিরাপ ও কফি খেয়েই দিন কাটাতাম। সব্জি নেই, মুখরোচক কিছু নেই, খাওয়ার ব্যাপারটা দিনগত পাপক্ষয়ের মতো।

নাবিকদের মধ্যে নানা জাতীয় লোক ছিল। নরওয়েজিয়ান দুজন, কিছু আইসল্যান্ডিক ও বেশিরভাগ স্কটিশ। একটি নরওয়েজিয়ান যুবক, তার বয়স কুড়ি ও আমি ভারতীয়, আমরা ট্রলিংয়ে অনভিজ্ঞ। অন্যরা বহু বছর সমুদ্রে কাটিয়েছে। খাটুনি অত্যধিক বেশি হলেও বেশি টাকার লোভ এবং অপর্যাপ্ত রাম খাবার আকর্ষণ এদের বারবার ট্রলারে টেনে আনে। জাহাজের লোকেরা পরস্পরের সঙ্গে গালাগালি ছাড়া কথা বলতে পারে না। আমি জিজ্ঞাসা করতাম বাড়িতে স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের কাছে যখন ফিরে যাবে তখন মুখ সামলাবে কী করে। ওরা সবাই বলত ডাঙায় নামলে আমরা ভদ্র হয়ে যাই। এটা যে অসভ্য ভাষা শুনছ তা একেবারে সামুদ্রিক। এখানে কেবল আমরা— পৃথিবী থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। এখানে যা খুশি বলতে পারি আর এমনিভাবে খাটুনির বোঝা লাঘব করি।

শ্রমিকদের মধ্যে আমি সবসময় সহৃদয় ব্যবহার পেয়েছি। তাদের ধারণা যে যেহেতু আমি অনেক দেশ ঘুরেছি, সেজন্য আমার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা তাদের চেয়ে অনেক বেশি। এ ধারণা ভুল হলেও, তাদের মধ্যে বদ্ধমূল ছিল। গল্পগুজবের সময় খুব কম পেয়েছি, তবু মুখোমুখি দুজন কাজ করতে আরম্ভ করলেই কেবলই আমাকে ছোট ছেলেমেয়ের মতো বলত, গল্প বল।

সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে আমার জামাকাপড় ভিজে যেত দেখে একজন আমাকে একটা অয়েল স্কিনের টুপি ও ওভার-অল দিল। শীতের দিনে সবাই ৫-৭টা গরম, বাড়িতে বোনা মোটা মোজা পরে থাকত। আমাকে দুটো মোজা দিল যা পরে আমার মনে হল পায়ের আঙুলের সাড় ফিরে এল। ক্যাপ্টেনের অনেকগুলো রবারের বুট ছিল, আমাকে একজোড়া দিল। তবু জাহাজের সব লোকের তুলনায় আমার গরম জামাকাপড় খুবই কম ছিল।

আগেই বলেছি জাহাজটার ডেকের সর্বত্র মোটা লোহার তার, ধরে ধরে চলাফেরা করবার জন্য, জাহাজ থেকে যাতে কেউ জলে না পড়ে যায়। এই লোহার তারে বেশ ধার থাকত, তাছাড়া মাছের গা থেকে কাঁটা বিঁধে হাত ক্ষতবিক্ষত হত। সেজন্য মোটা সুতির দস্তানা ব্যবহার করবার রীতি ছিল। দস্তানা সর্বসময় জলে ভিজে থাকত। দিনের কাজ আরম্ভ করবার আগে দুই হাতে একটা প্রলেপ লাগাতাম যাতে সারাক্ষণ লোনা জলে হাত ফুলে না যায়। তারপর ভিজে দস্তানা পরতে কী কষ্ট হত। হাত যেন ঠান্ডায় অসাড় মনে হত।

এক সপ্তাহ পর আমার ডিউটি বদলে গেল। যত কড মাছের (সেইসঙ্গে অন্য মাছেরও) লিভার জমেছিল সেগুলো থেকে তেল বার করতে হবে। ক্যাপ্টেন আমাকে বুঝিয়ে দিল কেমন করে তেল বের করতে হয়। আমিও লেগে গেলাম। ফলে ট্যাঙ্ক ভর্তি (৪০০ গ্যালন) তেল জমা হল। তেলের রং পাতলা আলকাতরার মতো। বিকট দুর্গন্ধ। আমার সর্বাঙ্গে একেই মৎস্যগন্ধ, তার ওপর কড লিভার অয়েলের গন্ধ মিলে আমাকে একেবারে গন্ধরাজ করে তুলেছিল!

এক সপ্তাহ পর আবার ডিউটি বদলে গেল, এবার রান্নার কাজ। সবাই বলল যে সবচেয়ে সোজা কাজ এটি। দুটো জিনিস সিদ্ধ করা ছাড়া আর কোনও রান্নার কাজ নেই। মাছ ভাজবার শখ হল, কিন্তু তেল নেই, হলুদ নেই! আশা ছাড়লাম।

এই রকম সপ্তাহে সপ্তাহে ডিউটি বদলাতে লাগল সবার। জাহাজের বয়লারে কয়লা ঢালতে হবে, আমার এই কাজ হল। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হল নরওয়েজিয়ান ছেলেটি। যে রকম শীত, জল ঝড় বরফ পড়ছিল তখন এই কাজটা আরামের মনে হল। যদিও মাত্র দুসপ্তাহের মতো।

মাঝে মাঝে যখন আগুনে কয়লা ঠেলতাম, মাথার ওপর ফানেল দিয়ে তখন ঠান্ডা কনকনে বাতাস আসত। একজন লোক ওপর থেকে দড়িতে ঝুলিয়ে খাবার ও কফি দিত। আর আমাদের কোনও প্রয়োজন ছিল না বয়লার ঘর ছেড়ে যাবার। বড় বড় কয়লার চাইয়ের ওপর ঘুমিয়ে রাত কাটাতাম। সকালে প্রাতঃকৃত্য সারতাম কয়লার ওপর যা সর্বংসহা আগুনের ওপর নিবেদন করতাম।

ডিউটি বদলাতে বদলাতে নিচের বরফ ঘরে কাজ পড়ল। বয়লার ঘর শীতপ্রধান দেশে, বিশেষ করে উত্তরমেরু অঞ্চলে যেমন আরামের, বরফ ঘরের কাজ তেমনই কষ্টসাধ্য। আমার কাজ ছিল সাইজমাফিক শেলফের ওপর মাছ সাজিয়ে রাখা।

আবার স্টিয়ারিং রুমের কাজ পেলাম। একদিন একটা সবচেয়ে বড় ব্যাগ (প্রায় তিন টন) মাছ উঠেছিল। দুঃখের বিষয় লোহার তারের একাংশ কমজোরি ছিল। ক্রেন জালটাকে টেনে ডেকের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় তারটা ছিঁড়ে গেল এবং সমস্ত মাছ জলে পড়ল। জাহাজ তখন থেমে ছিল। যে হুকে ব্যাগটা ঝুলছিল সেই হুক এক তাল লোহাসুদ্ধ (ডাভিট) নিমেষে জাহাজের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বিদ্যুৎ বেগে চলে গেল। জাহাজ চালানো বন্ধ করে আমি নরওয়েজিয়ান ছেলেটির সঙ্গে গল্প করছিলাম। সে ছিল ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে। আমি তার দিকে মুখ করে স্টিয়ারিং রুমের জানলার দিকে চেয়েছিলাম। হুকটা আমাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে চলে গেল। পরমুহূর্তে দেখি নরওয়েজিয়ান ছেলে ইয়রগেনের মুখ দিয়ে ভীষণ রক্ত পড়ছে, তার চোয়াল ভাঙা।

ক্যাপ্টেনকে ডাকলাম। ওদিকে সবচেয়ে বড় মাছের ক্যাচ জলে গেল। তার ওপর বিপদ। ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য লোকেরা ইয়রগেনকে নিয়ে হাসপাতাল (নামমাত্র) ঘরে টেবিলের ওপর রাখল। এত বড় আঘাতে ইয়রগেন টের পায়নি যে তার চোয়াল ভেঙে গিয়েছে। ক্যাপ্টেন দেখলাম, খুব ধীর স্থির লোক। সেলাইয়ের তোড়জোড় করে হুকুম দিল রাইকাভিক বন্দরে নিয়ে যাবার। রাইকাভিক হচ্ছে আইসল্যান্ডের রাজধানী। দুদিন থাকতে হবে।

সব মাছ বিক্রি হয়ে গেল। ইয়রগেন হাসপাতালে ভর্তি হল। একজন ডেনিশ সার্জেন বললেন যে খুব বড় ক্ষতি হয়নি। ক্যাপ্টেন ঠিক সময়ে সেলাই করে দেবার ফলে বিপদ বাড়েনি। যতদিন না তার ক্ষত শুকিয়ে যায় ইয়রগেন আর জাহাজে ফিরবে না। সমুদ্রের লোনা জোলো হাওয়ায় ঘা শুকোতে চায় না।

আমরা পাঁচজন শহর দেখতে বেরলাম। প্রথমেই দেখি শহরের এখানে ওখানে গরম জলের প্রস্রবণ। সেই জল পাইপের ভেতর দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে, ঘর গরম রাখার জন্য। ছোট শহর। টিং টিং করে ট্রাম গাড়ি যাচ্ছে। বরফের দেশ নাম হলেও, গরমের দিনে বরফ থাকে না। বরং পাহাড়ের গায়ে সবুজ ঘাস বা মস দেখা যায়। বেশিরভাগ লোকেরা ডেনিশ ভাষায় কথা বলে। ডেনমার্ক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব না করলেও, সাংস্কৃতিক যোগ রাখে এবং আইসল্যান্ডবাসীরা খুশি হয়ে মেনে নেয়। এমনকী নিজেদের স্ক্যানডিনেভিয়ান বলে পরিচয় দিয়ে গর্ব বোধ করে।

ইয়রগেনকে রাইকাভিকে রেখে আমরা মার্গারেট ক্লার্কে ফেরত এলাম। বরফ পড়ছে। দেখতে দেখতে বরফের ঘূর্ণিঝড় বইতে আরম্ভ করল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম মার্গারেট ক্লার্কের চারদিকে সমুদ্রে বরফ জমে গেল। জাহাজ চলা অসম্ভব। দুদিন পর সমুদ্রের ঢেউ আবার তরল ও সচল হল। জাহাজ দুলতে লাগল, আমরা নোঙর তুলে জাহাজ ছাড়লাম।

আমরা ক্রমাগত বরফের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এগোচ্ছি উত্তর দিকে। সমুদ্র উত্তাল। আমাদের ছোট ট্রলার ঢেউয়ের তাণ্ডবনৃত্যে দুলছে, কাঁপছে, উঠছে ও আছাড় খেয়ে জলের ওপর পড়ছে।

জাহাজটা নতুন ছিল বলে আমরা টের পাইনি। দিনকতক জলে ভাসবার পর দেখা গেল মার্গারেট ক্লার্কের চারদিকে ফুটো। সর্বত্র টুপটাপ বৃষ্টির মতো জল জাহাজের ভেতর ও ঘরে ঘরে পড়ছে। বাঙ্কে শোবার সময় অয়েল স্কিন ঢাকা দিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়েছে সবাই। বাঙ্ক থেকে নামলে জলে পা দিতে হয়। আমাদের জুতোগুলো ছোট ছোট নৌকোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। বাইরে জলের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে, ভেতরে জল থৈ থৈ। এই অবস্থার মধ্যে দিবারাত্র মাছ ধরা চলছে।

অসংখ্য ট্রলার জল, ঝড়, বরফ ও কনকনে শীতের মধ্যে জাল ফেলছে, মাল তুলছে। কখনও মাছ উঠছে, কখনও ব্যাগ খালি।

জাল টানার পর মাছ উঠছিল বলে বাহাত্তর ঘণ্টা সমানে জাহাজসুদ্ধ লোক কাজ করেছে, কারও ঘুমোবার অবসর নেই। একবার খাবার ঘরে কোনওমতে কাজের ফাঁকে আমার মতো জেলেরা গিয়ে কিছু খেয়ে আসছে। টেবিলের ওপর প্লেট রাখা যায় না। শক্ত করে এক হাত দিয়ে ধরে রাখতে হয়। না হলে প্লেটসুদ্ধ খাবার কোলের ওপর এসে পড়বে। খাবার বলতে আলুসেদ্ধ, মাছসেদ্ধ, সিরাপ, পাঁউরুটি ও মাখন এর কোনও ব্যতিক্রম নেই।

সূর্য কখন ওঠে কখন পাটে যায় তার ঠিক-ঠিকানা নেই। যতই শীতের দিন এগোতে লাগল ততই বেশিরভাগ সময় অন্ধকার। ক্বচিৎ কখনও যদি সমুদ্র শান্ত থাকত তাহলে বেলা দুটো-তিনটের সময় অপূর্ব সুন্দর সূর্যাস্ত দেখেছি। পশ্চিমের আকাশে যেন আবীরের রং ছড়িয়েছে। দুঃখের বিষয় এত ভীষণ শীত যে প্ৰাকৃতিক শোভা দেখবার মতো শারীরিক বা মানসিক অবস্থা ছিল না আমাদের। কাজ থেকে বিরাম পাওয়া মাত্র একমাত্র চিন্তা ঘুমের। কারও চাঁদ বা সূর্য দেখবার অবকাশ নেই। এমনিভাবে চার মাস কাটল। একদিন জলের ভীষণ উঁচু ঢেউ ট্রলারের ওপর বার বার আছড়ে পড়তে লাগল। আমরা তারই মধ্যে এক হাতে লোহার তার ধরে অন্য হাতে যে যার কাজে ব্যস্ত। অন্ধকার রাতে জাহাজের অস্পষ্ট আলোয় কিছুই ভালো দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ একজন চিৎকার করে উঠল অ্যালেক ইজ গন। ট্রলারের ঘণ্টা বাজতে লাগল। ক্যাপ্টেন ট্রলিং বন্ধ করে জাহাজের দুধার থেকে কাছিম বাঁধা লাইফ বয় দুটো ফেলে দিল। কিন্তু অ্যালেক কোথায়! হয়তো সমুদ্রের টানে ও ঢেউয়ে পড়ে আমাদের মধ্যে আধ মাইলেরও বেশি দূরত্ব হয়ে গিয়েছিল। সবাই সমুদ্রের ফেনার মধ্যে অ্যালেককে দেখতে পাবে আশা করে জলের দিকে উৎকীর্ণ হয়ে চেয়ে রইল। রাত তখন দুটো হবে। অ্যালেককে কোথাও দেখা গেল না।

মার্গারেট ক্লার্ক ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে গেল। যত সময় যেতে লাগল ততই কঠিন সত্য আরও স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল সবার। অ্যালেকের স্ত্রী ও একটি ছোট ছেলে জাহাজ ছাড়বার সময় বন্দরে এসেছিল। তাদের কথা মনে পড়ল।

কাছে-দূরে যত ট্রলার ছিল সবাইকে জানানো হল একজন নাবিক ভেসে গিয়েছে। একটু নজর রাখতে।

আর্কটিক সী-র কনকনে ঠান্ডা জলে বেশিক্ষণ মানুষের হাত-পা চলতে পারে না। নিশ্চয় অবশ হয়ে যাবে। ট্রলিংয়ের কাজ বন্ধ হল। দিনের আলোয় নতুন উদ্যমে অ্যালেককে খুঁজতে আরম্ভ করা হল। অন্তত তার মরদেহটা সমুদ্রের আলিঙ্গন থেকে তুলে আনবার চেষ্টা যদি সফল হয়।

দুপুরবেলায় ঘণ্টা বাজিয়ে সবাইকে একত্র হতে ডাকা হল। অ্যালেকের জন্য শোক প্রকাশ করল। সবাইকে বলা হল আরও সাবধানে শক্ত করে তার ধরে চলাফেরা ও কাজ করতে। তা না হলে আরও দুর্ঘটনা হতে পারে।

কারও মুখে কথা নেই। চোখের সামনে এতবড় মর্মন্তুদ ঘটনা হয়ে গেল। কারও ক্ষমতা হল না সমুদ্রের কবল থেকে অ্যালেককে ছিনিয়ে আনে।

খাবার ঘরে আবার সবাই মিলিত হলাম। যথারীতি গরম স্যুপ ও মাছসেদ্ধ দিয়ে গেল। কারও খাবার ইচ্ছা ছিল না। অনেকে রাম খেয়ে শুতে চলে গেল।

আমার মনে হচ্ছিল যে সমুদ্র যখন শান্ত তখন মানুষ অবলীলাক্রমে জলের ওপর দিয়ে যেখানে খুশি যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির যখন রুদ্রমূর্তি, যখন সমুদ্র উত্তাল, ঝড় ও ঢেউয়ের জন্য জাহাজ বেসামাল তখন মানুষ অসহায়।

আমার দ্বিতীয় চিন্তা হল যে মার্গারেট ক্লার্কের লোকেরা মনে করেছিল আমি সৌভাগ্যবান। বিপদের মধ্যে পড়ব ঠিকই এবং বিপদের থেকে উদ্ধার পাব, এমনই নাকি আমার সুকৃতি। তা তো হল না, ইয়রগেনের থেকে আমি অল্প ব্যবধানে লোহার তারের প্রচণ্ড ধাক্কা থেকে প্রাণে বাঁচলাম। কিন্তু ইয়রগেনের চোয়াল ভেঙে গেল। আশা করি সে সম্পূর্ণ সেরে উঠবে। অ্যালেক তো প্রাণ দিল। এই কথাগুলি ক্যাপ্টেনকে বললাম। ক্যাপ্টেন বলল পৃথিবীতে জীবিকা উপার্জনের যত পথ আছে তাদের মধ্যে আর্কটিক সমুদ্রে ট্রলিং করা সবচেয়ে কঠিন। কয়লার খনিতে আমি কাজ করেছিলাম অল্পকাল। সেও অতি কঠিন, অন্ধকারে থাকতে হয় বলে আরও কষ্টকর। ক্যাপ্টেন বলল এ রকম দুর্ঘটনা ট্রলারে প্রায়ই হয় পরদিন সকাল থেকে পুরোদমে ট্রলিংয়ের কাজ আরম্ভ হল। বিষণ্ন মনে সবাই যে যার ডিউটি করছে। সুবিধা পেলে মাঝে মাঝে জলের দিকে চেয়ে দেখি যদি অ্যালেকের দেহাবশিষ্ট পাওয়া যায়।

আরও দুমাস কেটে গেল। শীত যেন ছাড়বে না। সর্বাঙ্গে ব্যথা অনুভব করেছিলাম। ভিজে কাপড়চোপড় পরে ভিজে বিছানায় শুয়ে থাকার ফল।

ট্রলিং করে একদিন দুটো প্রকাণ্ড সামুদ্রিক কাঁকড়া উঠল। একেকটার ওজন হবে ২-৩ সের। কাঁকড়া দেখে আমার যত উৎসাহ তেমন আর কারও নেই। সবার মত, কাঁকড়াসেদ্ধ মোটেই ভালো খেতে নয়। জাহাজে সেদ্ধ ছাড়া আর কিছু হবে না, এ কথা মনে ছিল না। অনিচ্ছাসত্ত্বে কাঁকড়া দুটো জলে ফেলে দিলাম। যেদিন একটা অক্টোপাস ধরা পড়ল সেদিন সবাই খুশি। অক্টোপাসের মাংস (মাথাটার দুপাশের নরম জায়গা) খাবার লোভে সবাই এগিয়ে এল। সেই অতীব কদাকার জীবটাকে পিটিয়ে মারল। স্বীকার করি অক্টোপাসের মাংস সুস্বাদু।

মার্চ মাসের ভীষণ ঝোড়ো হাওয়ায় জাহাজটা রীতিমতো কেঁপে উঠছিল। আমার ডিউটি তখন নিচে ইঞ্জিনঘরে। হঠাৎ ঝড়ে বয়লারের ওপরের চিমনি ঘাড় ভেঙে পড়ল। পাছে সমুদ্রে চলে যায়, তাড়াতাড়ি চিমনিটাকে বেঁধে ট্রলার চলল ইসাফিওর্ড বন্দরের দিকে, আইসল্যান্ডের উত্তরে এটা ছোট এক বন্দর। আরেকটা স্পেনদেশীয় মালবাহী জাহাজ পাশেই নোঙর ফেলেছিল। আমাদের সঙ্গে তার লোকেদের ভাব হয়ে গেল। আমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করে একদিন স্প্যানিশ জাহাজ ইসাবেলাতে খাওয়াল। ট্রলারের সঙ্গে কার্গো জাহাজের কোনও তুলনা হয় না। ভালো ভালো রান্না জিনিস ও মাদেরা মদ খেলাম। ইসাবেলা চলেছে গ্রিনল্যান্ডের বন্দর গটহবের দিকে।

ইসাবেলার ক্যাপ্টেন আমাদের ট্রলারে এসে কিছু পছন্দমতো মাছ নিয়ে গেল। পরিষ্কার ইংরিজি বলে। নাম স্টেফান। আমি গ্রিনল্যান্ডে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। বললাম, আর্কটিক সমুদ্রে ট্রলিংয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে। জল দেখে দেখে চিত্ত হয়েছে বিকল। স্টেফান রাজি হল এবং স্বীকার করল যে এক এস্কিমো পরিবারে ইগলুতে আমার থাকবার ব্যবস্থা করতে পারবে।

আমি মার্গারেট ক্লার্কের ক্যাপ্টেনের কাছে ছাড়পত্র ও টাকাকড়ি চাইলাম। প্রচুর টাকা পেয়ে, বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে ইসাবেলা জাহাজে এলাম। আমার ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দুজনের মতো ওপর নিচে বাঙ্ক আছে। আগে যেখানে জলে জুতো ভাসত সেখানে এ জাহাজে কার্পেট পাতা। আমার সঙ্গী ইংরিজি জানে না। আমি স্প্যানিশ ভাষা শিখতে হাতেখড়ি নিলাম সঙ্গী আমাডোর কাছে। মার্গারেট ক্লার্ক ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। কৃচ্ছ্রসাধনের ভেতর দিয়ে সবার সঙ্গে বেশ একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম।

খাবার ঘণ্টা বাজল ঠিক রাত আটটায়। খাবার ও বসবার ঘর বেশ বড় এবং সুসজ্জিত।

খাবার এল পর পর তিনটে ডিস, মনে হল যেন রাজসূয় যজ্ঞের ব্যবস্থা।

ক্যাপ্টেনের বড় বসবার কামরা ছিল। আমার ডাক পড়ল। স্টেফান বলল, ইঞ্জিন ঘরে সাহায্য করতে হবে। মার্গারেট ক্লার্কে আমার কীরকম ডিউটি ছিল সব মন দিয়ে শুনল এবং মন্তব্য করল, তোমার খুব সাহস আছে। তুমি একাজ করতে পারবে। অবসর মতো আমাকে ডেকে ক্যাপ্টেন আমার দেশের সম্বন্ধে নানা রকম প্রশ্ন করত। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে মার্চ মাসের শেষে কতখানি গরম পড়ে শুনে একদিন বলল, দ্যাটস দি কান্ট্রি ফর মি। আই কান্ট স্ট্যান্ড আইস, স্নো, ফ্রস্ট, এটসেটরা অ্যান্ড ইয়েট আই ক্যাপ্টেন দিস শিপ বিটুইন আইসল্যান্ড অ্যান্ড গ্রিনল্যান্ড, দো মাই কান্ট্রি ইজ সানি স্পেন। স্টেফানের বার্সিলোনাতে বাড়ি। খুব গর্ব করে বলল বার্সিলোনা ইজ ভেরি বিউটিফুল। মাই হোল কান্ট্রি ইজ বিউটিফুল। ইউ মাস্ট পে এ ভিজিট দেয়ার।

অনেকদিন পরে আরাম করে বাঙ্কে বিছানায় শুয়ে ঘুমোলাম। সারারাত ঢং ঢং শব্দ নেই, জল পড়ার শব্দের অস্বস্তি নেই। উইনচ ঘোরার হাড় ভাঙা শব্দও নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *