দুচাকায় দুনিয়া – ২০

২০

চারদিন পর কলম্বো পৌঁছলাম। আমি ভারতবাসী বলে পুলিশ প্রথমেই আমার কাছ থেকে বন্দুক ও রিভলবার একরকম কেড়ে নিয়ে বলল যে সে সব জমা থাকবে এবং পরে কলকাতায় পুলিশের কাছে পাঠানো হবে। এটা সর্বৈব মিথ্যা। আমি অনেক তদ্বির করেও বন্দুক ও রিভলবার ফেরৎ পাইনি। তারিখটা ২৩ মার্চ ১৯৩৭ সাল। কলম্বোতে রীতিমতো গরম। বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সিংহলের দক্ষিণে কালুতারা গ্রাম আছে। এক সিংহলি লেখক বন্ধু ও তার ইংরেজ স্ত্রী আমাকে বহু বছর আগে নিমন্ত্রণ করেছিল তাদের কাছে থাকবার জন্য, যদি কখনও সিংহলে যাই। বন্ধুর নাম ডি সিলভা।

বন্ধুর বাড়িতে তালাচাবি দেওয়া, কলম্বোতে চাকরি করে। জায়গাটা মনে হয় নারকোল গাছের দেশ। এত সুন্দর যে চোখ জুড়ায়। সেখান থেকে কলম্বোতে ফিরে গেলাম। একদিন বিশ্রাম করে কান্ডিতে বৌদ্ধ মন্দির দেখতে গেলাম। কথিত আছে, এই মন্দিরে তথাগত বুদ্ধের একটি দাঁত সযত্নে রাখা আছে। বৌদ্ধরা দলে দলে কান্ডির মন্দিরে যায় এবং ভক্তি সহকারে প্রণাম জানায়।

কান্ডি পাহাড়ের দেশ। চা-বাগান পথে দেখলাম। অনুরাধাপুরে জগৎপ্রসিদ্ধ স্তূপ দেখতে যাবার ইচ্ছায় উত্তর দিকে রওনা হলাম।

অনুরাধাপুর পুরনো দিনের রাজধানী। বৌদ্ধবিহার ও পৃথিবীর বৃহত্তম স্তূপ দেখে আমি মুগ্ধ। সিংহল দ্বীপ সত্যিই সুন্দর। এমন গাছের শোভা কমই দেখা যায়।

উত্তর দিকে সাইকেল চালাতে চালাতে তিনদিন পরে তালাইমানদের পর পাক পয়ঃপ্রণালী আর তার ওপারেই দেশ ভারতবর্ষ। দেশে পৌঁছে যাব সুস্থ দেহে ভেবেও আনন্দ হচ্ছিল। এক যুগ পরে দেশে ফিরছি। কত কথা মনে পড়ছে, বিশেষ করে তিন বন্ধুর কথা।

জাহাজ নিয়ে ওপারে ধনুষ্কোটি যাচ্ছি। কিন্তু রওনা হবার আগে যথেষ্ট নাস্তানাবুদ হলাম। সব লোককে ছেড়ে পুলিশ আমাকে নিয়ে পড়ল। প্রথম প্রশ্ন, আর ইউ এ বেঙ্গলি? দ্বিতীয় প্রশ্ন, হোয়াই ডিড ইউ ক্যারি এ সার্ভিস পিস্তল? যদিও বন্দুক জমা নিয়েছে বললেই ভালো হয়।

এইসব প্রশ্নের অর্থ হল যে আমি বাঙালি এবং সেজন্য পুলিশ আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে। জাহাজ ছাড়বার নাম নেই। আমার সাইকেল, হ্যাভারস্যাক, ক্যামেরা ফিল্ম তন্ন তন্ন করে পুলিশ সার্চ করল। কিছুই না পেয়ে আড়াই ঘণ্টা পরে আমাকে ভারতগামী জাহাজে উঠতে দিল, যত দেরি হচ্ছিল ততই আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। কেবল দেশে ফেরার আনন্দ আমার উৎসাহ জাগিয়ে রেখেছিল, মনে মনে রাগ হচ্ছিল যদিও। ধনুষ্কোটিতে জাহাজ থামবার পরেই ভারতবর্ষের মাটিতে পা দিলাম। কী অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতি। ভাবিনি এই দিনটা সত্যিই আমার জীবনে একদিন দেখা দেবে। প্রথমেই হাঁটু গেড়ে বসে ভারতমাতাকে চুমু খেলাম, তার পর গাইলাম ‘সার্থক জনম আমার …..’।

পরে রামেশ্বরম মন্দির দেখতে গেলাম। একটা চৌলট্টি অর্থাৎ ছোট ধর্মশালায় উঠলাম। জাহাজে একটি যুবকের সঙ্গে ভাব হয়েছিল, সে সব বন্দোবস্ত করে দিল।

দক্ষিণ ভারতবর্ষের অপূর্ব স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে মণ্ডিত সব মন্দির দেখতে দেখতে উত্তর দিকে চলেছি। মাদুরার মন্দিরের ভেতর পার্বতীর পাথরে খোদাই করা মূর্তি দেখে জীবন্ত মনে হচ্ছিল, এমনই নৈপুণ্যে সেটি তৈরি। ত্রিচিনাপল্লি, মহাবলীপুরম পার হয়ে মাদ্রাজ পৌঁছলাম। সেখানে ওয়াই এম সি এতে উঠলাম। ম্যানেজার, নারায়ণম মাকে কলকাতায় চিনতেন। তিনি এমনই হৈ হল্লা শুরু করে দিলেন যে আমি অপ্রস্তুত। সত্যমূর্তি তখন মাদ্রাজের মেয়র। তিনি খবর পেয়ে সেইদিনই বিকালে ওয়াই এম সি এর হলে এক বিপুল সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করলেন।

সত্যমূর্তি তখনকার দিনে একজন মস্ত বক্তা ছিলেন। বললেন, আমি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে (বহরমপুর-গঞ্জাম) জন্মেছি, সেজন্য আমার কৃতিত্বে মাদ্রাজবাসীরা গর্বিত। তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন যে আমিই প্রথম ভারতীয় ভূপর্যটক।

তিনদিন মাদ্রাজে বাস করবার পর আমি যে আমার অগোচরে সাহেবিপনা আয়ত্ত করেছিলাম তা জলাঞ্জলি দিলাম। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেবলই নিমন্ত্রণ খাচ্ছি। কয়েক ঘর বাঙালি বাসিন্দার বাড়িতে তো রীতিমতো ভূরিভোজ খেলাম। অনেকদিন মুখরোচক রান্না খাইনি।

পরদিন আমার ভ্রমণকাহিনী বললাম।

মাদ্রাজ ছেড়ে উত্তরে রাজামুন্দ্রি শহরের দিকে রওনা হলাম। এখানে একজন ইংরেজের সঙ্গে দেখা করবার কথা। সে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। মাদ্রাজে সেই খবর পেয়েছিলাম। রাজামুন্দ্রির ব্যাঙ্কে পৌঁছে আমি সোজা এজেন্টের ঘরে গেলাম। আমার ধড়াচূড়া হ্যাভারস্যাক পিঠে দেখে এফ জি হোয়াইট প্রথমটা চমকে উঠেছিল। ভালো করে মুখের দিকে চেয়ে দেখল, আমিও টুপি খুললাম, তারপর সে কী আনন্দ! হোয়াইট আমার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকল এবং চকিতের মধ্যে উধাও হল মিসেস হোয়াইটকে খবরটা দিতে।

লন্ডনে থাকতে একদিন এপসমে ঘোড়ার ডার্বি রেস দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে হোয়াইটের সঙ্গে দেখা হয়, সেই সময়ই ভবিষ্যতের মিসেস হোয়াইটের সঙ্গেও আলাপ হয়। কলকাতার স্ট্র্যান্ড রোডে আমি যখন ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কে কাজ করতাম হোয়াইট তখন ছিল আমার ঊর্ধ্বতন অফিসার। কিন্তু লোকটার মন ছিল উদার। আমাকে কতদিন ট্রেনিং দিয়েছে তার ফোর্ড গাড়ির পিছন পিছন অনুসরণ করতে দিয়ে।

উইম্বলডনে হোয়াইটের বাড়িতে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল এবং আমরা তিনজনে অনেক গল্প ও আনন্দ করেছি তিনদিন।

তখন বিদায় নেবার দিন হোয়াইট বলেছিল, দেশে ফিরলে তার খোঁজ করতে। তারপর প্রায় একযুগ কেটে গেছে। আমি ঘুরতে ঘুরতে কত দেশ দেখলাম, হোয়াইটরা বিয়ে করে প্রথমে মাদ্রাজে, তারপর বেজওয়াদা এবং শেষকালে রাজামুন্দ্রি ব্রাঞ্চে এজেন্টের কাজে বহাল আছে। ইতিমধ্যে দুটি সন্তান জন্মেছে। তারা বড় হচ্ছে বিলেতে।

ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক রাজামুন্দ্রি ব্রাঞ্চে সেদিন এক অভাবনীয় ঘটনা সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। এজেন্ট একজন ভারতীয়ের হাতের ভেতর হাত গলিয়ে তার হ্যাভারস্যাক কাঁধে উঠিয়ে মহা উৎসাহে আগন্তুককে টানতে টানতে দোতলায় নিয়ে গেল। গৃহিণী আমাকে ভোলেননি। হাসি মুখে আদর অভ্যর্থনা জানালেন। তাড়াতাড়ি এক বোতল বিয়ার ফ্রিজিডিয়ার থেকে বের করে তিনটি গ্লাসে ঢাললেন এবং চিয়ার্স বলে আমার দিকে তার গ্লাস তুলে ধরলেন। হোয়াইট এক নিশ্বাসে বিয়ার শেষ করে বলল যে আধঘণ্টা পরে সে ব্যাঙ্কের কাজ গুছিয়ে নিয়ে ফিরবে।

আমি আরাম করে স্নান করলাম।

বিকালে হোয়াইট পরিবারের সঙ্গে টেনিস খেলতে গেলাম। ওরা দুজনেই বলতে লাগল যে অন্তত এক সপ্তাহ ওদের কাছে থেকে আমার দেশবিদেশের অভিজ্ঞতা বলতে হবে। আমি অনেক কষ্টে বোঝালাম যে বহুকাল বাড়িছাড়া, এত কাছে এসেছি যে আর দেরি সয় না। অবশেষে ঠিক হল যে তিনদিন থাকব।

ইংরেজ সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের সব রকম ছবি আমার পরিচিত, ভালো মন্দ দুইই দেখেছি। এই কারণে বোধহয় হোয়াইটরা আমাকে তাদের আপনার লোক বলে মনে করেছিল।

আরও উত্তর-পূর্বে সাইকেল চালাতে আরম্ভ করলাম। বেজওয়াদা পার হয়ে ওয়ালটেয়ারে পৌঁছলাম। ওয়ালটেয়ারে সমুদ্রের ধারে একটা হোটেলে উঠলাম। আমাদের দেশের লোকেদের এমনই বদ অভ্যাস যে তীরে বেড়ানো যায় না দুর্গন্ধের চোটে। মেজাজ খারাপ করে বসবার ঘরে গেলাম। দেখা হল পঙ্কজ গুপ্ত ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। তাঁরা নির্জনে দুজনে সমুদ্রের ধারে হাওয়া খেতে গিয়েছিলেন। এখন পুরীতে ফিরে যেতে চান। সেখানে সমুদ্রের ধারটা ভদ্র ধরনের।

আমি যখন ১৯২৬ সালে ভ্রমণ শুরু করি তখন বিদায় শুভেচ্ছা যাঁরা জানাতে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে পঙ্কজবাবু অন্যতম। সেজন্য দেখা হওয়াতে খুব আনন্দিত হলাম। সেদিনের স্বল্প পরিচিত পঙ্কজ গুপ্তের আজ ভারতবর্ষ জোড়া সুনাম। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি সাহসী ও কৃতী লোক

সন্ধেবেলায় ডিনার খাবার পর আমাকে নিয়ে পড়লেন, কলকাতায় ফেরার পর একটা মস্ত অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করতে চান। সেজন্য কবে, কখন কলকাতায় পৌঁছব তার প্রোগ্রাম কষতে শুরু করলেন। একমাত্র অনুরোধ যে বালি, উত্তরপাড়া হয়ে জি টি রোড ধরে কলকাতায় পৌঁছতে হবে, তারপর সব ব্যবস্থা পঙ্কজবাবুর। তাঁর স্ত্রী নেমন্তন্ন করলেন কলকাতায় গুপ্তদের বাড়িতে ডিনার খাবার

পথে গঞ্জাম বহরমপুরে পৌঁছলাম। এই শহরে আমার দাদামহাশয়রা ছিলেন খুব প্রতিপত্তিশীল বাঙালি। অর্থাৎ এককথায় বহরমপুরে আমার মামার বাড়ি এবং সেখানেই ১৯০৩ সালে আমার জন্ম। এখানে ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি, বিশেষ করে আমার চেয়ে চোদ্দ দিনের বড়, মামাতো ভাই শোভন চ্যাটার্জিকে ঘিরে। পরে বড় হবার পর আমার সঙ্গী সাথী হয়ে সাইকেলে সে ভারতবর্ষের বিভিন্ন দিকে পাড়ি দিয়েছে। সেটা ছিল পৃথিবী ভ্রমণের গোড়াপত্তন। ছেলেবেলার সেই আন্তরিক টান আজও অটুট।

বহরমপুরের নবনির্মিত মেয়েদের কলেজে ডাক এল। নানা বিষয় আলোচনা, প্রশ্নোত্তর হল। মেয়েদের উৎসাহ প্রচুর।

গরমে বেশ কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু সেদিকে আমার আর তেমন ভ্রূক্ষেপ নেই

রাস্তা মোরামের, বৃষ্টির পর কোথাও জল জমেছে। কটক পৌঁছতে তিনদিন লেগে গেল। কটকে ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি জমে আছে। স্কুলের লম্বা ছুটি এলেই আমার মন উতলা হত কাটজুড়ি নদীর বালির ওপর খেলাধুলোর কথা ভেবে। মামার বাড়ি ছিল ওড়িয়া বাজারের ব্রাহ্ম সমাজের খুব কাছে। বাড়িটা মস্ত বড়, মালিক ছিলেন জানকীনাথ বসু— সুভাষচন্দ্র বসুর পিতা। রাস্তার ওপারে বিখ্যাত প্রফেসর গোপাল গাঙ্গুলির বাড়ি। তাঁর ছেলেরা আমার সমবয়সী ছিল। আমাদের মধ্যে কয়েকঘর বাঙালিদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেশ ভাব ছিল। প্রত্যেক দিন বিকালে কাটজুড়ি নদীর বালির ওপর খুব ছোটাছুটি খেলা হত। মাথার চুলে বালি ভরে যেত। তখন কটকে ইলেক্ট্রিক আলো আসেনি। বড় বড় কেরোসিন তেলের আলোর নিচে বই নিয়ে পড়তে বসতাম, পড়ার চেয়ে মুখ্য কর্ম তখন ছিল মাথা আঁচড়ে বালি বের করা।

এবার তেলেঙ্গাবাজারের বাসিন্দা শরৎ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে উঠেছিলাম। ইনি আমার মেসোমহাশয়। তাঁর একমাত্র পুত্র, সুধাংশু আমার সমবয়সী ছিল। তার উৎসাহের সীমা ছিল না। একদিন সন্ধ্যায় কটক ক্লাবে ও আরেকদিন দুপুরে ভিক্টোরিয়া স্কুলে আমার অভিজ্ঞতা বলবার আহ্বান পেলাম, র‍্যাভেনস কলেজও সাদর অভ্যর্থনা জানাল।

ছেলেবেলার বন্ধু অনেক ছিল। কে যে কোথায় গেছে তার ঠিক নেই। সংসারের নিয়মই এই।

খুব গরমের মধ্যে বৃষ্টি হল খুব। পৃথিবীটা যেন ঠান্ডা হল। বৃষ্টি দেখে ভীষণ ভালো লাগল। ভিজে মাটির গন্ধ মনটাকে খুশিতে ভরল।

কটক ছেড়ে কেওনঝাড়ের দারুণ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলেছি। রাস্তা বিশেষ ভালো নয়। কিন্তু চারদিকের দৃশ্য খুব মনোরম। বুনো জন্তু অপর্যাপ্ত পাওয়া যায়

তিনদিন পর বালাসোরে পৌঁছলাম। এখানে অনেক বাঙালির বাস। সবাই মিলে হৈ চৈ করল অনেক। খড়্গপুরে পৌঁছবার আগেই বাঁদিকে রাস্তা ধরলাম জি টি রোড ধরে আসানসোল যাবার জন্য। এই ট্যুরে আমার দুদিন বেশি লাগল। জুন মাস, বৃষ্টি না হলে খুবই গরম। আমার সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি ছিল না। আমার অবস্থা তখন ‘এলেম নতুন দেশে’র মতো। সব চমৎকার, সব ভালো লাগছে

রাজবাঁধে রাত কাটালাম ডাকবাংলোয়। পরদিন ভোরে রওনা হলাম বর্ধমানের দিকে। দিনের শেষে বর্ধমান পৌঁছলাম। একদল মেডিক্যাল ছাত্র আমার অপেক্ষায় বিকাল থেকে কার্জন গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা আমাকে ফ্রেশার হাসপাতাল প্রাঙ্গণে নিয়ে গেল। সেখানে চিফ মেডিক্যাল অফিসার, গণেশ সরকারের সঙ্গে দেখা হল। আমার এক বন্ধুর দাদা বলে তিনি আমারও দাদার মতো। গণেশদা খুব ঘটা করে অভ্যর্থনা জানালেন। আমি ধন্যবাদ জানালাম। তারপর শুরু হল ভূরিভোজের পালা।

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট খাবার পর গণেশদা নানা রকম প্রশ্ন করে গল্প জুড়ে দিলেন। সকাল দশটার সময় বর্ধমান ছাড়লাম। সোজা জি টি রোড ধরে চন্দননগরে পৌঁছলাম এবং ডাঃ কৃষ্ণলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে উঠলাম। ডাক্তারের দাদা শৈলেনবাবু আমার ভ্রমণের কথা সবাইকে জানালেন। ভদ্রলোকের দেখলাম খুব উৎসাহ।

তিনি আমাকে খবর দিলেন যে পরশু ১১ জুন আমাকে কলকাতায় পৌঁছতে হবে এবং মেয়র সনৎ রায়চৌধুরী আমাকে নাগরিক সংবর্ধনা জানাবেন। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলেও লোক জমায়েত হবে। আরও খবর পেলাম যে আমার সঙ্গে পথে অন্তত একদিন আগে দেখা করবার জন্য মা, বাবা, ভায়েরা এবং বোন বালিতে বাড়ি ভাড়া করে আছেন।

শৈলেনবাবুর বাড়ি ছেড়ে জি টি রোডে পৌঁছলাম। কলকাতা থেকে মোটর গাড়িতে আমার দুই ভাই ও তাদের বন্ধুরা আমার খোঁজ করতে করতে হঠাৎ আমার দেখা পেল। তারপর সে কী হৈ চৈ হুল্লোড়। সেই দলে একটি সুদর্শন যুবক আমাকে দেখে বিশেষ করে আমার ধড়াচূড়া দেখে মুচকে মুচকে লাজুকের মতো হাসছিল। আমার ভাই নির্মল মুখার্জি আলাপ করিয়ে দিল আমার বন্ধু কল্যাণরঞ্জন দাস, বেণু বলে ডাকি। তার সঙ্গে হাত মেলালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেণুর সব লজ্জা চলে গেল। অন্যদের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে সর্বপ্রথম গাড়ি নিয়ে রাস্তা ফাঁক করতে করতে চলল।

পথে অভূতপূর্ব ব্যাপার। রাস্তার দুধারে ছোট ছোট শহরে বাড়ি বাড়ি থেকে ডাক এল তাদের অভ্যর্থনায় যোগ দেবার জন্য। শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে, গান গেয়ে সবাই যেন উৎসব করছিল। সব জায়গায় আমি দুকথায় ধন্যবাদ জানালাম। এতবার এত জায়গায় গেলাম যে দিন ফুরিয়ে এল। দিনের আলোয় মা-বাবার কাছে পৌঁছতে পারলাম না। তাঁরা বালির বাড়িটা নিয়েছিলেন একেবারে রাস্তার ওপর। সেখানেও অনেক লোক জমা হয়েছিল।

সন্ধ্যা সাতটার পর দীর্ঘ একযুগ পরে অবশেষে মা, বাবার সঙ্গে দেখা। আমার হৃদযন্ত্রটা মনে হচ্ছিল দ্বিগুণ জোরে চলেছে। সবাইকে যেন হঠাৎ অনেক বড় এবং বুড়ো দেখাচ্ছিল। সে হিসাবে আমিই যেন ইয়ং ম্যান। ছ ফুট লম্বা একটা রোদে পোড়া কাঠের মতো। মনে ভীষণ আনন্দ। এতদিনে যে ভূত আমার মাথায় এগারো বছর জুড়ে বসেছিল আজ সে নামল। পৃথিবী ভ্রমণ শেষ করবই এমন প্রতিজ্ঞা কতবার করেছি। কতদিন মনে হয়েছে আশা নেই, কত সন্দেহ জেগেছে, তবু বিশ্বাস হারাইনি শেষ অবধি।

আর মাত্র কয়েকঘণ্টার পথ কলকাতা পৌঁছতে। আসছে কাল সকালেই যাত্রা শুরু করব। লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা আলোচনার পর খেতে বসলাম। আমার বাবা ভোজনবিলাসী ছিলেন। ভূরিভোজে আয়োজনের ত্রুটি করেননি।

আমি যখন ১৯২৬ সালে রওনা হই, মা তখন অচৈতন্য। আজ মার হাসি ধরে না। আমার জন্য কী করবেন ঠাউরে উঠতে পাচ্ছিলেন না। অতিথি আগন্তুকরা বিদায় নেবার পর দীর্ঘরাত্রি মার সঙ্গে গল্প করে কাটালাম। এই দিনটির কথা ভেবে নিজেকে কতদিন কত উৎসাহ দিয়েছি। আর আজ সেই চিন্তা বাস্তবের রূপ নিয়েছে।

১১ জুন ভোরে উঠে শেষবারের মতো ধড়াচূড়া পরলাম। সকালবেলায় ১১টার সময় কলকাতার মেয়র সনৎকুমার রায়চৌধুরীর অফিস, পৌর প্রতিষ্ঠানে যাবার কথা। ইতিমধ্যে মা এক রেকাব ফল ও মিষ্টি নিয়ে আমার পিছন পিছন ঘুরছেন আর বলছেন, ওকে আজ ছুটি দাও। কিন্তু কেউ সে কথায় কান দিচ্ছে না। প্রাতরাশ সেরে সবাই কলকাতার বাস ধরল। আমিও বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই দৃষ্টি পড়ল কালকের সেই ছেলেটি, বেণুর ওপর। সে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। এসকর্ট করে কলকাতায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব সে নিজেই নিয়েছিল।

কলকাতার যত কাছে আসছি, মনে হচ্ছে আমার রক্তের চাপ বেড়ে যাচ্ছে। হাওড়ার কাঠের পুল পার হবার সময় মনে হল এবার সত্যিই আমার ডার্টি, ডিয়ার ওল্ড ক্যালকাটায় পৌঁছে গিয়েছি।

এগারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি পৌর প্রতিষ্ঠানে পৌঁছলাম। অল্প লোকের ভিড়। একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান হল।

পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুসারে বেলা বারোটার মধ্যে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে পৌঁছলাম। এখানে অনেক লোকের ভিড়। পঙ্কজ গুপ্তর সংগঠন শক্তি ছিল অদ্ভুত। অল্প সময়ের মধ্যে খেলাধুলার জগতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করবার সহজ পথ তিনি জানতেন।

এখানেও মেয়র পৌরোহিত্য করলেন। তিনি বললেন যে আমিই প্রথম ভারতীয় পদব্রজে ও দ্বিচক্রে সমস্ত পৃথিবী এক যুগ ধরে ভ্রমণ করেছি। লেডি অবলা বসু বললেন যে পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে লোক এমন করেছে বলে আমরা শুনিনি বা পড়িনি, তিনি আনন্দে ও গর্বে উচ্ছ্বসিত বোধ করছিলেন। সবার বলা যখন শেষ হল লেডি বসু দাঁড়িয়ে উঠে সবাইকে বললেন বল ‘জয়, বিমল মুখার্জির জয়’। আমার লজ্জা লাগছিল ভীষণ।

পরে লেডি বসু দুবার আমাকে ভ্রমণকাহিনী বলাবার জন্য ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে ডাকেন। সেখানেও আমার বলা শেষ হলে লেডি বসু চেঁচিয়ে ‘জয়, বিমল মুখার্জির জয়’ বলে ছাত্রী ও শিক্ষিকা ও আমাকে বিব্রত করেন। তিনি কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করেননি তিলমাত্রও।

মেয়র খুব উৎসাহিত হয়ে বলেছিলেন যে বাঙালি যে ঘরমুখো, কুনো ও ভীতু নয়, তা প্রমাণ মিলেছে। যে কাজ পৃথিবীর অন্য যে কোনও লোক করতে পারে, সুযোগ ও সুবিধা পেলে বাঙালিও তা করতে সক্ষম। এই রকম ধরনের কথা অন্যরাও বললেন।

মিটিং শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের বাড়ি ভ্রমণকাহিনী বলবার ও খাবার নেমন্তন্ন পেলাম। এরকম ম্যারাথন নেমন্তন্ন খুব কম লোকের ভাগ্যে জুটেছে। প্রথম রাত্রি আরম্ভ করলাম ১২ নম্বর গভর্নমেন্ট প্লেস ইস্টের শ্রীচণ্ডীচরণ নন্দী মহাশয়ের বাড়িতে। চণ্ডীবাবুর সঙ্গে বার্লিনে এক শীতের রাত্রে বরফের ঝড়ের মধ্যে আলাপ ও পরে বন্ধুত্ব হয়।

ইনস্টিটিউটের কাছেই আমার পুরনো পৈত্রিক বাড়ি। সেখানে অর্থাৎ পটলডাঙা স্ট্রীটের ইয়ংমেনরা এই পাড়া ছেড়ে বেশিরভাগ দক্ষিণ কলকাতায় চলে গিয়েছে। আমার ভায়েরাও বালিগঞ্জ প্লেসে উঠে গিয়েছে। ভারতবর্ষের বিখ্যাত মহিলা প্রেস বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

তবে আমি কেন আর পটলডাঙার মায়া করি। চললাম সাইকেলের মোড় ঘুরিয়ে বালিগঞ্জের খোলামেলা দক্ষিণে।

বালিগঞ্জ প্লেসের যুবকরা একটা অভিনন্দনের ব্যবস্থা করেছিল। কে সি নাগ মহাশয় পৌরোহিত্য করলেন। তাঁর বাড়ির পাশেই বেণুদের বাড়ি। সে টেনে নিয়ে গেল অতি পরিচিতের মতো তাদের বাড়িতে। স্লাইড দিয়ে নানা দেশের নানা বিষয় বলবার জন্য সেখানে আহ্বান পেলাম। আমার ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্না। সেই বাড়িতে অচিরে আমার জীবনসঙ্গিনীর দেখা পেলাম। আমার ভবঘুরে জীবনের ধারা বদলে গেল। এবার শুরু হল নতুন অধ্যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *