১
আজ থেকে ঠিক বাহান্ন বছর আগে মা বাবা ভাই বোন আত্মীয়-বন্ধু ও ঘর-বাড়ি ছেড়ে আরামহীন অনিশ্চিতের পথে বেরিয়ে পড়েছিলাম অজানাকে জানার ও অচেনাকে চেনার জন্য। সারা পৃথিবী ঘোরবার স্বপ্ন যা ছেলেবেলায় ভূগোল পড়বার সঙ্গে সঙ্গে নেশার মতো আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল, ১৯২৬ সালের ১২ ডিসেম্বর, তার বাস্তব রূপ নেবার পথের প্রথম পদক্ষেপ শুরু হল। আমার বয়স তখন তেইশ, সঙ্গে তিন বন্ধু— অশোক মুখার্জি, আনন্দ মুখার্জি ও মণীন্দ্র ঘোষ। অশোক মুখার্জি আমাদের দলের নেতা। সাইকেল চারখানা আমাদের বাহন।
যাত্রা শুরু হল কলকাতার টাউন হল থেকে। মহা আড়ম্বরে বিরাট এক জনসভার ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রথম ভারতীয় দল ভূপর্যটক হয়ে পথে বেরবে, এই খবরটা বাঙালির মনে সেদিন এক বিপুল উদ্দীপনা ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছিল। যে যেখানে ছিল রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। ইচ্ছা ছিল বোধহয় পর্যটকদের একবার নিজের চোখে দেখা এবং সম্ভব হলে করমর্দন করে তাদের উৎসাহিত করা। বাঙালি ভীতু, কুনো এবং ঘরমুখো এই দুর্নাম ঘোচাবার জন্য চারজন যুবক প্রাণের মায়া সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে সাহসে ভর করে গৃহছাড়া হল, এই কথা সবার প্রাণে আশার বাণী এনেছিল। চিরকাল বিদেশিদের এইরকম সাহসের পরিচয় দিতে দেখে আমরা সবাই তারিফ করে এসেছি— ধন্য ধন্য বলেছি। কিন্তু এ যে বাঙালি তথা প্রথম ভারতীয় দল, এই চিন্তা সবাইকে সেদিন উদ্বুদ্ধ করেছিল একান্তভাবেই।
টাউন হলের বাইরে এসে দেখি সামনে বিরাট জনসমুদ্র।
এসময়টা মনের মধ্যে কয়েকটি কথা বারবার আমাকে উতলা করেছিল। মাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। বিদায়ক্ষণে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। সেই অবস্থায় তাঁকে ছেড়ে চলে এলাম। আমার অতি প্রিয় এবং সাধের কলকাতা ছাড়তেও খুব খারাপ লাগছিল। হাওড়ার দিকে এগোলাম। শত শত সাইকেল এবং মোটরগাড়ি আমাদের আশপাশে পথ করে চলল। গঙ্গার ওপর তখন কাঠের পুলটা পার হবার সময়ে বারবার পিছন ফিরে কলকাতা শহরের দিকে দেখছিলাম, জানি না আবার কখনও দেখা হবে কিনা। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে চলেছি। সূর্য প্রায় অস্তাচলে। অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলে যেতে যেমন অসুবিধা তেমনই সময়ও নষ্ট হচ্ছিল। কথাও ছিল বর্ধমানে প্রথম রাত্রি কাটাবার, যেমন প্রত্যেকবার উত্তর-পশ্চিম ভারত ভ্রমণের সময়ে করেছি।
বালিতে বিবেকানন্দ ব্রিজের ওপর দিয়ে একজন প্রফেসর সাইকেলে আসছিলেন দুপুরবেলায় আমাদের জি টি রোডে অভিনন্দন জানাতে। সেদিন এত বেশি গাড়ি, সাইকেল এবং মানুষের ভিড়ে পড়ে তাঁর পথেই মৃত্যু ঘটল— একটা লরি তাঁকে চাপা দিল।
রাত ৯টার সময় পৌঁছলাম চন্দননগরে। দেহে ক্লান্ত ও মনে অবসন্ন বোধ করছিলাম। পথে বালি, উত্তরপাড়া, কোতরং ইত্যাদি জনপদের ভেতর দিয়ে আসবার সময় অনেক অভ্যর্থনা ও ভোজন এবং আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়েছিল মনে পড়ে। চন্দননগরে পৌঁছে আমার এক পূর্ব-পরিচিত বন্ধুর সাদর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। পরদিন বর্ধমান যাবার কথা ঠিক হল।
অপরিচিত জায়গায় শুয়েছিলাম বলে খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। তখন দেখি বাড়ির চারপাশে ছেলে-মেয়েরা ঘুরছে আমাদের দেখা পাবার আশায়।
প্রথমদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম যে মাল বহন করবার ক্ষমতা অতিক্রম করে আমরা সবাই ভুল করেছি। বসবার সিটের পিছনে প্রত্যেকে একটা করে মজবুত স্টিল ট্রাঙ্ক নিয়েছিলাম— সাইকেলের পিছনে সাঁটা। সেটা চাবি বন্ধ করবার ব্যবস্থা ছিল। স্টিল ট্রাঙ্কের ওপর কম্বল ও কাপড়-চোপড় বাঁধা ছিল। কাঁধের ওপর হ্যাভারস্যাকে ভর্তি অফুরন্ত মাল। তাছাড়া বন্দুক-পিস্তলের ওজন তো ছিলই। সাইকেলের ফ্রেমের মধ্যে এক মস্ত ব্যাগ ভর্তি সংসারযাত্রার সব জিনিস— ক্যামেরা, ওষুধপত্র, গুলি, কার্তুজ, জুতোর বুরুশ কী না ছিল! পথেও একদিনেই কত জিনিস উপহার পেলাম তার হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়। মহেন্দ্রলাল দত্তর ছাতার দোকানের মালিক ভবানী দত্ত আমার বিশেষ বন্ধু। তার ধারণা হয়েছিল একটা ছাতা থাকলে মরুভূমির দারুণ গরম কম লাগবে। একটা ছাতার ওজনও তখন দুঃসহ লাগছিল।
চা খেয়ে আমরা প্রথমেই ঠিক করলাম যেমন করে সম্ভব বোঝা কমাতে হবে। সব জিনিস একত্র করে দেখলাম জুতোর একটা বুরুশ ও একটা কালির কৌটো চারজনের পক্ষে যথেষ্ট। দাঁত মাজার বুরুশ অবিশ্যি প্রত্যেককে একটা করে রাখতে দেওয়া হল। এমনই ছাঁটাই করতে করতে স্তূপাকার জিনিস ফালতু হয়ে গেল— চারটে স্টিল ট্রাঙ্ক মাল বোঝাই করে চন্দননগরের বাড়িতে ফেলে রেখে বিদায় নিলাম আমরা।
বারোটার সময় আবার শুরু হল জি টি রোড ধরে বর্ধমানের দিকে এগনো। আগের চেয়ে বোঝা অনেক কমলেও তখনও ভারবাহী গাধার অবস্থা। এই অবস্থা থেকে কোনওদিন রেহাই পাইনি। স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাবলম্বী হওয়ার যতই চেষ্টা করেছি ততই বোঝা বেড়েছে বই কমেনি।
চন্দননগর থেকে যারা আমাদের সঙ্গে যাচ্ছিল, ৫০ মাইল পথ অতিক্রান্ত হলে তারা সবাই বিদায় নিল একে একে। সবার আগে একজন একটা জরুরি জিনিস আমায় উপহার দিয়েছিল। কয়েকটা ছুঁচ ও নানা রঙের সুতো। এত দরকারি জিনিস কিন্তু আমরা কেউই আগে সঙ্গে নিইনি।
১৯২৬ সালে জি টি রোড অনেক চওড়া ছিল। মোরাম দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। দুধারে বড় বড় গাছের ছায়া সারাদিন থাকত। গাছের নিচ দিয়ে গরুর গাড়ির সার দুদিকে চলত। ক্বচিৎ কখনও একটা মোটরগাড়ি দেখেছি। ট্রাকে মাল বহনের রীতি তখনও হয়নি।
বর্ধমানে আমরা ডাঃ গণেশচন্দ্র সরকারের আতিথ্য স্বীকার করলাম।
পরদিন বর্ধমান ছেড়ে কাট্রাসগড়ের দিকে এগোতে লাগলাম। একজন কয়লার খনির বাঙালি মালিক আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। ক্লান্ত হয়ে যখন আমরা বটকৃষ্ট রায়ের বাড়ি পৌঁছলাম, মনে হল যেন সেখানে মেলা বসেছে। লোকের বিরাট ভিড়। গানবাজনার ব্যবস্থাও আমাদের আনন্দবর্ধনের জন্য। গায়িকা তরুণী কমলা ঝরিয়া। সেই সভায় গান করেছিলেন ‘মিছে মালা গাঁথিয়া আশে বসে থাকা।’ সুরেলা গান। বেশ মিষ্টি লাগল। কিন্তু রাত জেগে গান শোনার আর উৎসাহ ছিল না। বারোটার সময় ভূরিভোজ তখনকার দিনে রেওয়াজ ছিল। আমরা সবার কাছে বিদায় নিয়ে রাত দেড়টার সময় শুতে গেলাম।
এমনিভাবে সর্বত্র আদর-আপ্যায়নের ভেতর দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। মোগল সাম্রাজ্য কায়েমি হবার আগে পাঠান বীর শেরশাহ কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত ১৫০০ মাইল লম্বা এক চওড়া রাস্তা— গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড তৈরি করেছিলেন। অফুরন্ত ফলের গাছ তার দুধারে লাগানো। প্রত্যেক দশ মাইল অন্তর একটা পাকা কুয়ো বা ইঁদারা সংলগ্ন পান্থশালা। পঞ্চাশ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের জি টি রোডের পাশে যে কুয়ো ছিল আমরা তার সুগভীর ঠান্ডা জল খেয়ে আনন্দ লাভ করেছি। এখন লোকেরা সামান্য জমির আশায় বেশিরভাগ কুয়ো বুজিয়ে তার ওপর চাষবাস করেছে। আজকাল ক্বচিৎ এক-আধটা অবহেলিত কুয়ো জীর্ণ অবস্থায় দেখা যায়। কিন্তু বিহার, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষে (এখন পাকিস্তানে) বেশিরভাগ কুয়ো সযত্নে ব্যবহৃত হচ্ছে আজও।
আমরা জি টি রোড ছেড়ে রাঁচির পথ ধরলাম। অশোক ও আনন্দ সম্পর্কে জ্যেঠতুতো-খুড়তুতো ভাই। ওদের আত্মীয়স্বজনের কাছে বিদায় নেওয়া উদ্দেশ্য ছিল। রাঁচি খুব ফাঁকা, অল্প লোকের বাস ছিল তখনকার দিনে। আমরা হিনুতে এক ক্লাববাড়িতে উঠলাম। অশোকদের মা-বাবার সঙ্গে আলাপ হল। তাঁরা অত্যন্ত ভদ্র কিন্তু প্রিয়জনকে হারাবার ভয়ে একেবারে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন। অশোকের মা জানতে চাইলেন, আমার মা-বাবা আছেন কি না— তাঁরা কেমন করে আমার এই দুরন্ত আশায় মত দিয়েছেন। আমার মা-বাবা আমাকে নিরস্ত করার কথা বারবার বলে যখন ফল পেলেন না, তখন মা মনকে প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন। এমনকী আমার শুভ কামনা করে উৎসাহ দেবার চেষ্টায় একটা কবিতাও লিখেছিলেন। সে কবিতা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, কোথাও খুঁজে পাই না।
যখন যাত্রার ক্ষণে বিদায় নিতে গেলাম, মা আমার বন্দুক এবং বেশভূষা দেখে বুঝলেন আমি বিরাট বিশ্বে কোথায় যে হারিয়ে যাব তার ঠিকানা নেই। আমাকে জড়িয়ে কী বলবার চেষ্টা করলেন— তারপর সংজ্ঞা হারালেন। সেদিন আমি নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি। একবার ইচ্ছা হয়েছিল আমার সমস্ত অ্যাডভেঞ্চার, দেশ দেখার কামনা জলাঞ্জলি দিয়ে মাকে আশ্বাস দিয়ে বলি যে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে বাড়িতে রইলাম- কিন্তু পরমুহূর্তেই আমি নেশাগ্রস্ত হয়ে যে ভূতের পিছনে ছুটেছি সে আমার হুঁশ ফিরিয়ে দিল। ফেরা কিছুতেই হবে না।
আমার সব কথা শুনে অশোকের মা হতাশার সুরে বললেন, মায়ের কষ্ট ছেলেরা বোঝে না, আমাদের কত বড় যাতনা।
রাঁচি ছেড়ে আমরা আবার জি টি রোডের দিকে এগোলাম, পালামৌ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। এদিকে কম লোক চলে— গাড়ি তো নেই। খয়ের গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমন কোনও ছোট-বড় জন্তু-জানোয়ার ছিল না যাদের এই জঙ্গলে দেখা যেত না। বাঘ, হরিণ, নীলগাই আশপাশেই ঘুরত। সব মিলে জঙ্গলটা অপূর্ব সুন্দর দেখাত। রাত্রে ক্লান্ত হয়ে একটা ইনস্পেকশন বাংলোতে উঠলাম। সন্ধ্যা হবার আগেই চৌকিদার তার বাড়িতে চলে গিয়েছিল। দোর খুলে ভেতরে ঢুকতে খুব বেগ পেতে হয়নি। আমাদের সঙ্গে এসেটিলিন আলো ছিল। তার সাহায্যে একটা ঘর সাফ করে নিয়ে আমাদের সঙ্গে যা খাবার ছিল তা শেষ করে শুয়ে পড়লাম।
ঘরের সামনে যে উঠোন ছিল গভীর রাত্রে সেখানে এক ব্যাঘ্র মহাশয় আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিলেন। আমরা দরজা ও জানলা একটু মজবুত করে আটকে চারজন চারদিকে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাঘ বাড়িটা প্রদক্ষিণ করল, কখনও কখনও দেওয়ালের ওপারে জানোয়ার এপারে আমরা। জানলার মধ্যে কোথাও ফাঁক খুঁজছিল বোধ হয়, আঁচড়ের শব্দে তাই মনে হল। একটু জোরে ধাক্কা মারলেই জানলার খিলসুদ্ধ উড়ে যেত। সৌভাগ্যক্রমে বাঘের সেরকম মতিগতি ছিল না, তবু একবার জানলার কাছে বাঘ আসা মাত্র অশোক ০.৪৫ পিস্তল থেকে একটা গুলি ছুড়ল, কী সাংঘাতিক আওয়াজ। বাঘের কানে তালা লাগাবার মতো শব্দ। বাকি রাতটুকু আর আমাদের জ্বালাতন না করে বাঘ উঠোন দিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। চাঁদনি রাতের আলোতে দেখলাম বাঘের পুরুষ্ট দেহটা। আওয়াজে ভয় পেয়ে সেখান থেকে সরে পড়াই শ্রেয় মনে করেছিল। তবু আমাদের কারও ঘুম হল না। ভোরবেলায় চৌকিদার এসে হাজির। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল বাঘটার গুলি লেগেছে কিনা। আমরা ভয় পাওয়াবার জন্য আওয়াজ করেছিলাম শুনে বলল বাঘটা নাকি রোজ রাতে বাংলোয় বেড়াতে আসে। দিনেরবেলায় যখন সে দেখেছে তার কাছে তখন সম্বল মাত্র একটা লাঠি। মানুষখেকো নয় বোধহয়। খাবারের খোঁজেই টহল দিয়ে যায়।
আমরা চা খেয়ে রওনা হলাম জঙ্গলের পথ ধরে যতক্ষণ না আবার জি টি রোডে এসে পড়লাম।
শোন নদীতে রেললাইন ধরে ব্রিজের ওপর দিয়ে পার হলাম। সামনেই সাসারাম, ছোটখাটো শহর। বাঁদিকে জি টি রোডের সৃষ্টিকর্তা এবং পাঠান সম্রাট শেরশাহের স্মৃতিসৌধ। তার মধ্যে কবর রয়েছে অত্যন্ত অনাড়ম্বরে। এই সৌধটি একেবারে খাঁটি পাঠান রীতিতে গড়া এবং সেজন্য উত্তর ভারতের অন্যান্য স্মৃতিস্তম্ভের থেকে স্বতন্ত্র তার স্থাপত্য। সৌন্দর্যের চেয়ে গাম্ভীর্যের দিকে নজর বেশি।
বিহারের চওড়া রাস্তার দুপাশে ধান ও গম কাটা তখন হয়ে গিয়েছে। এই সময় কী পরিমাণ ব্ল্যাক বাক ও স্পটেড ডিয়ার দলে দলে দুধারে দেখা যেত, আজকের দিনে তা গল্পকথা বলে মনে হবে। সারস পাখিরা মাঠের ওপর খাবার খুঁজে খেত। একেকটা গাছভর্তি ফ্লেমিঙ্গো— কখনও কখনও হেরন পাখিও দেখা যেত। সারাটা রাস্তা জুড়ে অগণিত ঘুঘু দেখা যেত। তার কারণ গরুর গাড়ি ভর্তি চাল-ডাল-গম নিয়ে যাবার সময় ফুটো থলে দিয়ে বাইরে কিছু পড়ত। এখন ট্রাক যায় ভীষণ জোরে, তাছাড়া ট্রাকের কী ভিড়! এইরকম পশুপাখি সারা জি টি রোডে দেখতাম। উত্তরপ্রদেশে ময়ূর দেখেছি যেখানে সেখানে। কেউ তাদের মারত না— এত সুন্দর জীব বলে। আখের খেতের আশপাশে মস্ত বড় নীলগাই ও ময়ূর, হরিণও অনেক দেখেছি।
প্রতিপত্তিশালী অনেক বাঙালি তখন উত্তর ভারতবর্ষের সর্বত্র বসবাস করতেন। তাঁরা আমাদের খুব সমাদর করতেন। অবাঙালিদেরও উৎসাহ কম ছিল না। সবাই প্রশ্ন করতেন নানা ধরনের। একটি প্রশ্নের জবাবে বেশ বেগ পেতাম, সেটা হচ্ছে ‘অ্যাডভেঞ্চার’ করে, অনিশ্চয়তার মধ্যে দীর্ঘদিন কাটিয়ে যদি বা আমরা একযুগ পরে দেশে ফিরতে পারি তাহলে কী লাভ হবে? লাভের জন্য অ্যাডভেঞ্চার খুব কম লোকেই করে। খানিকটা আত্মপ্রসাদ লাভ বরঞ্চ বলা যেতে পারে। তাছাড়া আমাদের দুটো উদ্দেশ্য ছিল: ১) বাঙালি ভীতু নয় প্রমাণ করা, ২) যদি আমরা সফলকাম হই, তাহলে অসংখ্য তরুণ-তরুণী বিশ্বাস করবে যে কোনও কঠিন কাজই অসাধ্য নয়, দুঃসাধ্য হলেও। আমরা পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় নেমেছি যাতে আমাদের পরবর্তীরা অ্যাডভেঞ্চারের নামে আঁতকে না ওঠে, বরং আগ্রহান্বিত হয়ে এ-পথে পা বাড়ায়।
পৃথিবী ভ্রমণে বেরবার দুবছর আগে আমি হিমালয়ান এক্সপিডিশন, যেটা ১৯২৪ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ব্রুশ-এর নেতৃত্বে এভারেস্ট আরোহণ করতে চেষ্টা করেছিল, তাদের দলে ভিড়বার ইচ্ছা প্রকাশ করি। জেনারেল ব্রুশের কাছে চিঠিতে মনের কথাও লিখেছিলাম— তিনিও খুব সহানুভূতিশীল ছিলেন।
দুই বছর পরে ১৯২৮ সালে যখন বিলাত পৌঁছলাম জেনারেল ব্রুশ এবং রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি স্যার ফ্রান্সিস ইয়ংহাসবান্ড আমাকে নিমন্ত্রণ জানান আমার ভ্রমণকাহিনী বলবার জন্য। সেই সভায় অনেক বিখ্যাত পর্যটক ও এক্সপ্লোরারের সঙ্গে আলাপ হয়। পরে ফ্রান্সিস আমাকে ফেলোশিপ দেবার কথা ঘোষণা করলেন। সে অবশ্য অনেক পরের কথা।
আমরা জি টি রোড ধরে বেনারস পৌঁছবার সময় দেখলাম পণ্ডিত মালব্যের চেষ্টায় কী বিরাট ইউনিভার্সিটি গড়ে উঠেছে।
বেনারসের পর চুনার দুর্গ দেখলাম। শুনেছি এটিও শেরশাহর তৈরি। এলাহাবাদে অনেকবার গিয়েছি তবু গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলটি মনোরম লাগে। যেমন বহুবার কাশী গিয়েছি, হাজার হাজার বছরের পুরনো অলিগলি-সম্বলিত শহরটি আমার কাছে চিরনতুন মনে হয়। এলাহাবাদ পার হয়ে দিল্লির পথ ধরলাম। রাস্তায় খুব ধুলো। বাঁদর এবং হনুমানের উপদ্রব ভীষণ। সাইকেল ও বন্দুক গাছে ঠেস দিয়ে একটু হয়তো বিশ্রাম করতে বসেছি— হঠাৎ বন্দুক ধরে টানতে টানতে একটা বাঁদর গাছে ওঠবার চেষ্টা করল, যথাসময়ে আমাদের দৃষ্টি পড়াতে আমরা সবাই মিলে তাড়া করলাম, ভয়ে তখন বন্দুক ফেলে চম্পট। আরও ভয় পাওয়াবার জন্য বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করলাম। তখন মনে হল বানরকুল সবংশে সবাই যতদূর পারে পালাল।
এর আগে যখন সাইকেলে ভ্রমণ করতে এসেছি, তখন দিল্লিতে চাঁদনি চকের ওপর কোহিনূর হোটেলে উঠতাম। হোটেলটা ছিল মস্ত বড়। সেখানে একটা বড় ঘরের ভাড়া ছিল দৈনিক মাত্র এক টাকা। যতজন লোক থাকবে তাদের প্রত্যেককে একটা দড়ির চার-পাই দিত। খাওয়া-দাওয়া তেমনই সস্তা। আটআনা পয়সা দিয়ে হাতরুটি বা পরোটার সঙ্গে মাংস পেতাম যথেষ্ট।
দিল্লি বলতে তখন বোঝাত পুরনো দিল্লিই। নতুন দিল্লিতে তখন মাত্র কয়েকটা বাড়ি তৈরি হয়েছিল। চারদিকে তখন চলেছে গড়ার পর্ব। স্যার এডুইন লুটিএনের বিরাট কীর্তি তখন নির্ণায়মান। দিল্লির সঙ্গে নতুন দিল্লির যোগসূত্রের জন্য মাত্র দুটো রাস্তা দেখেছি। পাঁচ মাইল পথ— লোকজন নেই, বাড়ি নেই, সন্ধ্যার পর শিয়ালের ঐকতান এবং ঝিঁঝি পোকার ডাক। কেউ সূর্যাস্তের পর সাহস করে ওই পথে চলাফেরা করত না।
আমাদের গন্তব্যস্থল ছিল আইনের বড়কর্তা এস আর দাশের বাড়ি। তাঁর বড় ছেলে ধ্রুব আমার সমবয়সী বন্ধু ছিল। দুজনেই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। দিল্লিতে আমরা যাব এই কথা জানাতেই তাঁদের কাছে থাকবার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম।
আলিগড়ের কাছাকাছি এসেছি, জি টি রোডের ধারে প্রায় দুশো গজ দূরে ১৪- ১৫টা ব্ল্যাকবাক হরিণ মাঠের ওপর দাঁড়িয়েছিল। বন্দুক পাওয়ার পর থেকে তাদের ব্যবহার করবার জন্য হাত নিশপিশ করছিল। আনন্দ মুখার্জি অল্প সময়ের মধ্যে বন্দুকে কার্তুজ ভরে একটা হরিণ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। সেই হরিণ ছাড়া অন্যরা ভীষণ শব্দের চোটে লাফাতে লাফাতে পালিয়ে গেল। আমরা মাঠের ওপর দিয়ে দৌড়ে গেলাম হরিণ ধরবার জন্য। কিন্তু আমিই প্রথমে তার সামনে উপস্থিত হয়ে যা দেখলাম সে দৃশ্য মর্মন্তুদ। বন্দুকের গুলি হরিণের দুপাশ ভেদ করে মাটিতে পড়েছে। তখনও হরিণ চার পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মাথাটা কষ্টের সঙ্গে তুলে আমার দিকে দু- তিনবার তাকাল। বড় বড় সুন্দর সেই চোখে স্পষ্টই যেন বলল, আমাকে কেন মারলে? আমি তো তোমার কোনও ক্ষতি করিনি। ইতিমধ্যে আমার অন্য বন্ধুরা সেখানে এসে পড়ল এবং হরিণের প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়বার আগে ধরে ফেলল। আমার আর কোনও উৎসাহ রইল না হরিণ ধরবার, সেই অনর্থক হত্যার কথা ভাবলে আজও কষ্ট হয়। রাত্রে মণীন্দ্র হরিণের মাংস রাঁধল, কিন্তু খাবার প্রবৃত্তি আমার রইল না, শরীর ভালো নেই অজুহাতে সারারাত কিছু খেলাম না। ঘুমোবার জন্য চোখ বুজতেই হরিণের বড় বড় এক জোড়া কালো চোখ আমাকে যেন বলতে লাগল— তুমি অপরাধী, তুমি খুনি।
সেই একদিনের ঘটনা থেকে আমার সারাজীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। প্রকৃতির মধ্যে পশুপাখি যে কত সুন্দর তা বুঝতে শিখলাম। অনর্থক তাদের হত্যা করে লাভ কিছুই হয় না বরং মানসিক অবনতি ঘটে। ১৯২৬ সাল থেকে দীর্ঘকাল কেটে গেছে কিন্তু আর কোনও জানোয়ার কিংবা পাখির দিকে আমার বন্দুক তুলিনি। ছেলেবেলায় শিকারের গল্প ও জন্তুজগতের কথা পড়তে এবং শুনতে খুব আগ্রহ বোধ করতাম। কল্পনা করতাম একজন বিখ্যাত শিকারি হব— যেমন শখ ছিল আর্মিতে যোগ দিয়ে ক্যাপ্টেন হব। দুটো ভূতই আমার মাথা থেকে জন্মের মতো বিদায় নিয়েছিল পরে।
পরদিন আমরা নয়াদিল্লির রাজপথ ধরে সত্যরঞ্জন দাশ মহাশয়ের বাড়ি পৌঁছলাম। আমাদের অভ্যর্থনার বহর দেখে বেশ কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এস আর দাশ মহাশয় এত বেশি উৎসাহিত বোধ করছিলেন, আমাদের সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলেই টেলিফোন ধরলেন এবং ঘরোয়া নামে ভাইসরয় আরউইনকে ডেকে আমাদের সাহসের অনেক গুণগান করলেন, অগত্যা ভাইসরয় আমাদের নিমন্ত্রণ জানালেন দেখা করবার জন্য। ভারতবর্ষের সৈনিক শ্রেষ্ঠ স্যার উইলিয়াম বার্ডউডকেও দাশসাহেব আমাদের কথা বললেন। সোজা কথা— ‘বিল, তুমি এই ছেলেদের নিমন্ত্রণ করে সমাদর ও উৎসাহ দেবে’। একেবারে হুকুম করার মতো— এমনই দাশ মহাশয়ের প্রতিপত্তি। আমাদের কাছে ফলং লাভং হল বলা চলে।
দাশ মহাশয় পরদিনই আমাদের সঙ্গে নিয়ে ফরেন সেক্রেটারি স্যার জন হেস-এর কাছে গেলেন এবং পথে যাতে আমাদের নিগ্রহ না হয় বিদেশি গভর্নমেন্টের হাতে, সেজন্য সবরকম কাগজপত্র আমাদের দিতে বললেন। কপালে নিগ্রহ থাকলে কিন্তু এড়ানো যায় না যদিও সবকিছু ছাড়পত্রই সঙ্গে ছিল। সে পরের কথা। ফরেন সেক্রেটারি আমাদের খুব সাহায্য করলেন। কনস্তান্তিনোপল পর্যন্ত সব গভর্নমেন্টের কাছে এবং ব্রিটিশ রাজদূতের কাছেও চিঠি লিখে আমাদের কথা জানালেন যাতে আমরা পথে বাধা না পাই।
দিল্লি ছেড়ে আমরা আলোয়ারের পথ ধরলাম। আলোয়ারের রাজার খুব পশুপাখির শখ। পায়ে শিকল দিয়ে তিনি তাদের দেখতে চাননি। বন-জঙ্গলে, মাঠে- দিঘিতে এবং খোলা আকাশের নিচে তিনি তাদের বসবাস করবার সুযোগ দেন। আফ্রিকা থেকে বড় সিংহ এনে কয়েকটা নিজের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমাদের কেউ সাবধান করে দেয়নি। একটা নদী পার হয়ে আলোয়ার ‘স্টেট’-এ ঢোকবার মুখেই হঠাৎ নজরে পড়ল অদূরে এক সিংহ ও সিংহী পাশাপাশি বসে। ভাগ্যে আমাদের উল্টোদিকে তাদের মুখ ছিল। আমরা পিস্তল খুলে একটা ভাঙা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। অনেকক্ষণ পরে আমরা বেরতে পারলাম। সাইকেল চড়ে প্রাসাদের দিকে এগোতে আরম্ভ করলাম। মুগ্ধ হলাম পথে নানারকমের এত পাখি দেখে।
রাত্রে বিরাট ভোজ। রাজা জানালেন যে, দিগ-এর রাজা আমাদের নিমন্ত্রণ করেছেন পরদিন। এইরকমভাবে আমরা কত ভারতীয় রাজন্যবর্গের সাদর নিমন্ত্রণ পেয়েছি এবং অনেক ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য দেখেছি, তার হিসাব মস্ত বড় হয়ে যাবে। অনেকে নাচ ও উচ্চ ধরনের গানের মজলিশ করে, ভোজ দিয়ে আমাদের আপ্যায়িত করেছেন। রাজাদের ওপর খবরদারি করবার জন্য দিল্লিতে এক অধিকর্তা সাহেব আছেন তিনি এক সার্কুলার করে জানিয়ে দিয়েছিলেন রাজপুতানা এবং মধ্য ভারতের রাজাদের আমাদের আগমনবার্তা। রাজারা খুব খুশি হয়ে তাতে সাড়া দিয়েছিলেন। সবই ছিল দাশ মহাশয়ের কীর্তি।
জয়পুর শহর খুব সুন্দর লাগল। জয়পুর অম্বর অতুলনীয়। রাজা তখন নাবালক, মাত্র চোদ্দ বছর বয়স। যোধপুরের রাজকুমারীর সঙ্গে তিনি বাগদত্ত ছিলেন। খুব সম্ভব জন্মাবার আগেই জয়পুরের রাজার বিবাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল— স্ত্রী চোদ্দ বছরের বড়। এক বাঙালি ভদ্রলোক এস এম ব্যানার্জি আই সি এস জয়পুরের রাজার লেখাপড়া, খেলাধুলা এবং স্বাস্থ্যের জন্য অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিকালে রাজার সঙ্গে পরিচয় হল। ব্যানার্জিসাহেব আমাদের নিয়ে খেলার মাঠে চললেন ক্রিকেট খেলা শেখাবার জন্য। ক্রিকেট খেলা শেষ হবার পরই দুটো বড় বড় ঘোড়াকে আসতে দেখলাম মাঠের ধারে। রাজা ও তাঁর অভিভাবক ব্যানার্জিসাহেব ঘোড়ায় উঠলেন— উদ্দেশ্য রাজাকে একজন পাকা ঘোড়সওয়ার তৈরি করা। এই সম্বন্ধে বলা যেতে পারে যে, জয়পুরের রাজা পরে পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ পোলো খেলোয়াড় বলে পরিগণিত হয়েছিলেন। উত্তরকালে তিনি তাঁর ঘোড়া ও খেলোয়াড়ের দল নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খেলায় ইংল্যান্ডে র্যানেলা মাঠে সব জাতিকে পরাস্ত করে খুব প্রশংসিত হন। তিনি দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনায় পোলোর দল নিয়ে সবাইকে হারিয়ে দেন। তিনি আমৃত্যু ঘোড়সওয়ারশ্রেষ্ঠ নামে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। খুব স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ছিলেন, পুরোদস্তর স্পোর্টসম্যান। অনেক বছর পরে আমি বহুবার পোলো খেলার কৃতিত্বের জন্য জয়পুরের রাজাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। পৃথিবীর নানা জায়গায় হঠাৎ দেখা হয়েছে কিন্তু সেই ছেলেবেলার প্রথম পরিচয় ভোলেননি। গায়ত্রী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হবার পর রাজার সঙ্গে আর দেখা করিনি যদিও প্রতিবছর শীতকালে গড়ের মাঠে তাঁর পোলো খেলা দেখবার উৎসাহ কোনওদিন কমেনি। কলকাতায় এজরা কাপ বহুবার তিনি জয় করেছেন।
আগেই বলেছি যে বাঙালি উচ্চশিক্ষিত ও বুদ্ধিমান বলে ওই সময়ে নেটিভ স্টেট তথা সারা ভারতবর্ষে সম্মানিত ও আদৃত হত। অনেক দেওয়ান এবং মন্ত্রী বাঙালি ছিলেন। জয়পুরের রাজার অর্থমন্ত্রী ছিলেন সুবিখ্যাত পণ্ডিত এবং আমার পাড়ার সহবাসী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের এক পুত্র। তিনি আমাদের খুব সমাদর করলেন এবং জয়পুরের দ্রষ্টব্যস্থানে নিয়ে গেলেন।
প্রসঙ্গত, পটলডাঙা স্ট্রিটে আমাদের বাড়ির খুব কাছে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের বাড়ি ছিল। চিৎপুর থেকে হেঁটে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ করে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও শাস্ত্রী মহাশয়ের বাড়িতে আসতেন আলোচনা করতে। রবীন্দ্রনাথের মতো রূপবান একজন পুরুষ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কয়েকমাস পরেই দেখলাম কবিকে ‘বিসর্জন’-এ জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করতে। ভালো করে দেখার সুযোগ হল— যেমন সুপুরুষ তেমনই সু-অভিনেতা।
রাজাদের মধ্যে অনেক খামখেয়ালি লোক দেখেছি। গোয়ালিয়রের রাজাও তখন নাবালক। তিনি এবং তাঁর বোনের (বয়স ১৪) মত হল, সাইকেল চড়া শিখে আমাদের সঙ্গে পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া। যে কথা সেই কাজ। আমাদের দুখানা সাইকেল কতবার পড়ল আর উঠল তার ঠিক নেই, সাইকেলের দুর্দশা দেখে আমাদের কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ একবার সাইকেল থেকে বে-কায়দায় পড়ে গিয়ে রাজার পায়ে আঘাত লাগল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমাদের কাছে এসে বলল, আমরা যদি একমাস গোয়ালিয়রের রাজঅতিথি হয়ে থাকি তবে সাইকেল চড়া রপ্ত করে আমাদের সঙ্গ নিতে পারবে। আমরা গলদঘর্ম হয়ে গেলাম বোঝাতে যে ভূপর্যটন খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। রাজারও তেমনি জিদ। কতরকম কষ্টের সম্মুখীন আমরা হতে পারি তার একটা যথাযথ হিসেব চাই। এইরকম প্রশ্নের উত্তর কেউই দিতে পারে না। ভাগ্য ভালো, এমন সময় একজন লোক এল মনে করিয়ে দিতে যে রাজার অভিভাবক এবং দেওয়ান মিস্টার এইচ এন হাকসারের বাড়ি যেতে হবে, চায়ের নিমন্ত্রণ আছে। আমরাও রেহাই পেলাম। সাইকেলে মিস্টার হাকসারের বাড়ি গেলাম। ইনি একজন উচ্চশিক্ষিত কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ। বাড়ির মেয়েদের সবাইকে ডাকলেন আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে। এঁদের মধ্যে পর্দার বালাই নেই। চায়ের পালা শেষ হলে আমাদের ভ্রমণকাহিনী শুরু হল। তারপর আলোচনা চলল এবং শেষপর্যন্ত মিস্টার হাকসার বললেন যে আমরা রাত্রের ভোজন সেরে যেন আরেকটু বেশি সময় তাঁদের সঙ্গে কাটাই। একেবারে ঘরোয়া আত্মীয়ভাবে আমাদের অনেক গল্প হল। আমরাও দেশটাকে জানবার জন্য কত জিনিস জানতে চাইলাম। মিঃ হাকসার কখনও পুত্রবধূকে কখনও মেয়েদের প্রশ্ন করে কখনও বা নিজে সব জবাব দিলেন।
আমরা অনুরোধ জানালাম কাশ্মীরি গান শোনাবার জন্য। মেয়েরা চমৎকার গাইলেন। মিষ্টি গলায় মনে হচ্ছিল বাংলা গান শুনছি। এক মেয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন কিন্তু আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদের শোনাবার সাহস তখনও হয়নি। সর্বশেষে আমরা মিঃ হাকসারকে রাজার সাইকেল চড়া শেখা ও আমাদের সঙ্গে ভ্রমণে যাবার মতলব জানিয়ে তাঁকে নিরস্ত করবার অনুরোধ জানালাম।
পরদিন রাজা আমাদের একটা সাইকেল নিয়ে টানাটানি করে আবার আছাড় খেলেন। উঠে দেখলেন সামনে মিঃ হাকসার দাঁড়িয়ে। ব্যস ওইখানেই বেচারির সব জিদ থমকে দাঁড়াল। রাজাকে ঘরে নিয়ে যাবার সময় আমরা জানালাম যে পরদিন ভোরে রওনা হব। অনেক সকালেই রাজা এসে হাজির— সঙ্গে অনেক ফল ও খাবার পথের জন্য দুহাতে নিয়ে আমাদের দিল। আমরা অনেক শুভেচ্ছা নিয়ে সাইকেলে ওঠবার আগে করমর্দন করতে গিয়ে দেখি রাজার মুখ ভারাক্রান্ত। রাজার বোন কমলা দেবীও সাইকেল চড়া শিখছিলেন। তিনিও আমাদের ফল খেতে দিলেন।
প্রথমেই আমরা গোয়ালিয়র ফোর্ট দেখতে গিয়েছিলাম। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ওই দুর্গ অনেকবার সিন্ধিয়ার নাম রেখেছে।
ঝাঁসির রানির বীরত্বের জন্য আমরা তাঁর প্রতি খুবই সশ্রদ্ধ ছিলাম। ঝাঁসিতে যাওয়া ঠিক হল, যখন অত কাছেই এসে পড়েছি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে এই বীর নারীর স্থান খুবই উঁচুতে। এখানেও দুর্গ দেখতে বেরোলাম। উঠেছিলাম ডাকবাংলোয়।
দুর্গ আর অন্যান্য স্থান দেখে পায়ে হেঁটে দুপুরে আমরা ডাকবাংলোয় পৌঁছলাম। প্রথমেই নজরে পড়ল এক স্বাস্থ্যবতী তরুণী আমাদের সাইকেলগুলো মুগ্ধ হয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। তার নিজের হাতেও সাইকেল ছিল (পুরুষদের চড়বার উপযুক্ত)। আমাদের দেখে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলেন। করাচি থেকে দিল্লি হয়ে আমাদের ধাওয়া করে এসেছে। শেষকালে ঝাঁসিতে দেখা হল। ভদ্রমহিলার সঙ্গে ছোট্ট একটা বাক্স ও কিছু জামাকাপড়। পরনে শর্টস ও ব্লাউজ। দেখতে সুশ্রী ও যথার্থ স্পোর্টস উওম্যান।
আমাদের সঙ্গে দেখা করবার এত আগ্রহের কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। স্পষ্ট জবাব পেলাম— তোমাদের সঙ্গে পৃথিবী ভ্রমণে যাব। পাসপোর্ট পর্যন্ত তৈরি, বীর রমণী সন্দেহ নেই, কিন্তু আমরা মোলায়েম অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে জানালাম যে সেটা মোটেই সম্ভব নয়। তখন মিস পিন্টোর বয়স ২১-এর বেশি নয়। আমাদের চেয়ে দুয়েক বছরের ছোট। সে বোঝাল আমাদের সে কত কষ্ট করে দিল্লি থেকে খোঁজ নিতে নিতে অবশেষে এখানে দেখা পেয়েছে। এটা তার মনের দৃঢ়তার ও শারীরিক শক্তির পরিচয় নয় কি?
অনেক খাবার ছিল সঙ্গে। দুপুরে তাকে খাবার নিমন্ত্রণ করলাম। মিস পিন্টোর আবার সেই অনুরোধ যে আমাদের সঙ্গ নেবে। সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। ভালো করে বোঝালাম কিন্তু সে কথা কে শোনে! অবশেষে বলতে বাধ্য হলাম যে একজন সুন্দরী তরুণী নিয়ে আমরা পৃথিবী ভ্রমণে নারাজ। অনেক তর্ক-বিতর্ক হল কিন্তু তাতে ফললাভ হল না। একটু কম ভালো দেখতে হলেও বা চিন্তা করা যেত। এমন দীর্ঘাঙ্গী স্বল্পবসনা সুন্দরীকে সামলাবে কে? শেষকালে আমাদের মধ্যেই বন্ধু-বিচ্ছেদের কারণ হবে, এবিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম।
দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা একটু বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ মিস পিন্টো তার সাইকেলটায় চড়ে বলল ‘তোমাদের সঙ্গ ছাড়াই আমি একদিন পৃথিবী ভ্রমণে যাবই। তোমাদের সাহসের অভাব দেখে আমি অবাক! তবু আমার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। গুড বাই অ্যান্ড গুড লাক।’
সারা দুপুরবেলা সাইকেল চালিয়ে সন্ধ্যারাত্রে ‘দিগ’-এর রাজার এলাকায় পৌঁছলাম। একদিন এখানে থাকবার আমন্ত্রণ ছিল। দুদিন পরে ভরতপুরে যাবার কথা, ভরতপুরে খুব ঘটা হয় শ্রীপঞ্চমীর দিনে। আমরা ছাড়া বিরাট জনসমাবেশ হলুদ রঙে ছাপানো চোগা চাপকান, চুড়িদার, শাড়ি, ধুতি ইত্যাদি পরে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল। ভরতপুরের রাজা আমাদের চারজনকে দুপাশে নিয়ে সভায় উপস্থিত হলেন। স্ত্রীলোকের সংখ্যা খুব কম ছিল যদিও এই দেশে পর্দানশীন নন মেয়েরা।
এইদিনে প্রজারা বিশেষ করে আনুগত্য স্বীকার করতে আসে এবং রাজাকে অনেক নজরানা দেয়। দুপুরে ভূরিভোজ। বিকাল চারটের সময় রাজার সঙ্গে শিকারে যাবার কথা দিয়েছি। রাত্রের ভোজন নাকি জঙ্গলের মধ্যে অদ্ভুত পরিবেশে হবে। ভরতপুর শহর ছেড়ে ছ-টা মোটরগাড়ি ভর্তি শিকারিদের সঙ্গে আমরা রওনা হলাম। জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি চলেছে। অনেক গাছ কেটে পরিষ্কার পথ তৈরি হয়েছে যাতে মোটরগাড়ি চড়ে রাজা ৩৩ মাইল দূরে শিকার করবার বাড়িতে উপস্থিত হতে পারেন। শিকারে আবার বাড়ির কী দরকার এই কথা মনে মনে ভাবছি, এমন সময় দেখি জঙ্গলের একদিক হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত। ছোট-বড় তাঁবু দিয়ে একটা গোটা গ্রাম তৈরি। বিরাট একটা তাঁবুর ভেতরে গেলাম। শিকার উৎসবে শ্রীপঞ্চমীর দিন রাত্রে বহুলোক এই জঙ্গলের ভেতর গাড়ি কিংবা ঘোড়া কিংবা উটের ওপর চড়ে আসে। রাজা ও অমাত্যগণ এবং আমরা যথাস্থানে বসলাম। রাজা হুকুম দিলেন নাচ- গান শুরু হোক। সুরা ভরা পাত্র সভাস্থ সবাইকে বিতরণ করা হল।
একজন সুন্দরী নৃত্যতারকা সভার মাঝখানে এসে রাজাকে অভিবাদন করে নাচ শুরু করল। তখনকার দিনে রাজাদের চিত্তবিনোদনের জন্য বাঈজী ও অনেক সঙ্গীতজ্ঞ এবং সুবাদক রাখা হত। গানের সঙ্গে বাঈজী ঘাগরা উড়িয়ে নাচ শুরু করলে সবাই ‘আহা’ ‘আহা’ রবে উল্লাস প্রকাশ করলেন।
আমরা ভাবছিলাম এ আবার কীরকম শিকার!
রাত এগারোটার সময় অভাবনীয় ভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল। বুনো শুয়োরের মাংস ঝলসে খাওয়া রাজপুতদের মধ্যে খুব প্রচলিত। আমাদের কাছেও তা খুব মুখরোচক মনে হল। খাওয়া শেষ হলে মধ্যরাত্রে রাজা কয়েকজন শিকারি ও আমাদের নিয়ে একটা বাড়িতে গেলেন। বাড়ির ভেতর ঢোকার পর সুড়ঙ্গপথ ধরে একটা উপত্যকার দিকে নামতে আরম্ভ করলাম। সুড়ঙ্গের শেষে একটা গুপ্তঘর। সেখান থেকে দেখলাম একটা জংলী পথের ধারে ছোট একটা কুঁড়েঘর। তার সামনে একটা মাঝারি বয়সের মোষ শক্ত করে বাঁধা একটা খোঁটার সঙ্গে। কুঁড়েঘরের সামনে জ্বলছে একটা লণ্ঠন। ঘণ্টাখানেক নিঃশব্দে অপেক্ষা করার পর, সেই স্বল্পালোকে দেখলাম একটা প্রকাণ্ড বাঘ উপস্থিত হয়েছে। মোষ বুঝতে পেরেছে সামনে কালান্তক যম এসেছে। সে দড়ি ছিঁড়ে পালাবার কত চেষ্টা করল— কতবার উঠল ও পড়ল তার ইয়ত্তা নেই, কিন্তু দড়ি ছিঁড়ল না। বাঘ বসে মজা দেখছিল। এমন সময় রাজা ও তাঁর মন্ত্রী দুজনেই বন্দুক উঠিয়ে গুলি করলেন। বাঘের মোক্ষম লেগেছিল, সে ১০ ফুট উঁচুতে লাফিয়ে মাটিতে পড়ল। মন্ত্রীমশায় বাঙালি এবং ভালো শিকারি। গুলি ছুড়েই তিনি রাজাকে অভিনন্দন জানালেন যে তাঁর কার্তুজ অব্যর্থ-সন্ধানী ছিল। এই বাঘ রাজা শিকার করেছেন— মন্ত্রীমশায় জোর গলায় সমবেত জনগণকে জানালেন। সবাই বলল, রাজাসাহেব বীরপুরুষ। কার গুলিতে বাঘ মরল আর কে বাহাদুরি পেল, সে কথা ভালোই বুঝলাম।
পরদিন মন্ত্রীমশায়ের সঙ্গে প্রাসাদে ফিরলাম। ভদ্রলোক নিজের নামটা ছোট করে ওই দেশের উপযুক্ত করে নিয়েছিলেন ‘তারাচাঁদ’। আসলে তারকচন্দ্র চৌধুরী। বহু শিকারের গল্প বলে তিনি আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন— অদ্ভুত সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেলাম। সব দেশীয় রাজন্যবর্গ চাইতেন শিকারের সময় যেন তারাচাঁদজি পাশে থাকেন। ‘তারাচাঁদ’ রাজার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক সঙ্গে গুলি ছুড়তেন এবং তার পরই ঘোষণা করতেন ‘রাজার গুলি একেবারে অব্যর্থ-সন্ধান’। রাজারা নিশ্চয় বুঝতেন তারাচাঁদ কত উঁচুদরের শিকারি। তিনি বাহ্বা দেন অন্যদের আসলে যেটা তাঁরই প্রাপ্য।
তারপর আরও দুজন রাজার আমন্ত্রণ রাখতে দুঙ্গারগড় ও প্রতাপগড়ে গেলাম। অত আরামের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল আমাদের— আমরা তো এরকম জীবন কাটানোর জন্য পৃথিবী ভ্রমণে বেরোইনি! তাই ঠিক করলাম যে আমরা ‘থর ও পার্কার’ মরুভূমিতে বালির দেশে চলার হাতেখড়ি নেব। ইন্দোরের রাজা হোলকার একজন বড় স্পোর্টসম্যান। তিনি তাঁর কাছে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন কিন্তু আমরা আরও দক্ষিণে যেতে অনিচ্ছুক। ধন্যবাদ জানিয়ে তাই রওনা হলাম যোধপুরের দিকে। পথে কত ময়ূর দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। ময়ূর মারা নিষিদ্ধ বলে এরা নির্ভয়ে চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। খুব সুন্দর পাখি, যেখানেই থাকুক সব জায়গাটা আলোকিত করে রাখে।
আজমিরের পথে চলেছি। আজমিরে অবস্থিত এক ইংরেজ রেসিডেন্ট, কর্নেল ডসন-এর ওপর তখন এদিকের রাজপুত রাজাদের ওপর খবরদারি বা সদারির ভার। সবাই চায় কর্নেলকে খুশি করতে। ভূরি ভূরি উপহার ও ভেট তাঁর বাড়ি নিত্য পৌঁছয়। এহেন কর্নেলের কাছ থেকে ডাক এল চায়ের আসরে যোগ দেওয়ার। রেসিডেন্টের বাড়িটা একটা টিলার ওপর— একেবারে আনাসাগর হ্রদের গায়ে লাগোয়া। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালেই নিচে লেকের জল বহুদূর দেখা যেত। অদূরে পাহাড় এবং সামনের দিকের পথটা পুষ্কর তীর্থের পাঁচ মাইল দূরে অদৃশ্য।
কর্নেল ডসন আমাদের প্রতি খুব সৌজন্যপূর্ণ ভদ্র ব্যবহার করলেন। ফরেন অফিস থেকে নাকি কর্নেলের ওপর নির্দেশ এসেছে আমাদের খবরাখবর নেওয়ার এবং যাতে সর্বত্র বিনা বাধায় যেতে পারি তার ব্যবস্থা করার। আমাদের এপর্যন্ত কোনও অসুবিধা হয়নি ‘তাই কর্নেলকে ধন্যবাদ দিয়ে রওনা হলাম। তবু কর্নেল যোধপুরের রাজাকে টেলিফোনে নির্দেশ দিলেন যাতে তাঁর রাজ্যে আমাদের যথেষ্ট সমাদর হয়। আজমিরে দুটো সবচেয়ে বড় দ্রষ্টব্যস্থান— হিন্দুদের পুষ্করতীর্থ এবং মুসলমানদের চিস্তির দরগা। ভারতবর্ষে ধর্মের জন্য যেখানে যত তীর্থস্থান আছে তার বেশিরভাগ জায়গায় ভিড় ও নোংরামি দেখা যায়। তা সত্ত্বেও দূর থেকে পুষ্কর-হ্রদটি পোস্টকার্ডের ছবির মতো সুন্দর দেখায়। লেকের সমচতুষ্কোণ জলের পাড়। তার ওপরেই সারি সারি পাকাবাড়ি। জলের মাঝখানে একটা ছোট্ট মন্দির। তার ওপরে এবং আশপাশে কুমির শুয়ে আছে। লেকের পূতিগন্ধময় জলে সবাই স্নান করে অক্ষয় স্বর্গলাভের রাস্তা পরিষ্কার করে। হ্রদের জল বেরোবার কোনও পথ নেই, শুধু বৃষ্টির জল যেটুকু তাতে ধরে। সর্বত্র চারদিকের বাড়ি থেকেও ময়লা জল লেকে পড়ে। জলের রং ঘন সবুজ বিষের মতো।
দরগায় গেলাম। এখানে বিশেষ বিশেষ দিনে হাজার হাজার লোককে খাওয়ানো হয়। রাঁধবার বন্দোবস্ত দেখলে মনে হয় এক কড়া ঘি-ভাত দিয়ে পাঁচশো লোক খাওয়ানো যায়। এইরকম কয়েকটি ৭-৮ ফুট উঁচু কড়া এবং রাঁধবার বন্দোবস্ত দরগার মধ্যেই রয়েছে।
এখানেও দরগার বাইরে দেখলাম চারপাশে ভিখারি, দোকান, সরু-সরু রাস্তায় লোকের ভিড় ও যথেষ্ট নোংরা।
এরপর উদয়পুর। খুব সুন্দর শহর। বড় বড় লেক, অদূরে পাহাড় একটি মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। উদয়পুর ঐতিহাসিক শহর। লেকের মাঝখানে একটি দ্বীপ আছে, তার ওপর একটি একতলা প্রাসাদ। বোটে চড়ে সেখানে বেড়াতে গেলাম। গরমের দিনে বেশ আরামের জায়গা— অবশ্য সাধারণের জন্য নয়। উদয়পুরের রানারা অর্থাৎ রাজারা রাজপুতদের মধ্যে আভিজাত্যে সবচেয়ে বড়।
তারপর আমরা বহু ঈপ্সিত চিতোরগড় দুর্গ দেখতে গেলাম। এরকম দুর্গ বিস্ময়কর মনে হয়, যেমন বড় তেমনই সুদৃঢ় তার গাঁথনি। বড় বড় যুদ্ধের বেশিরভাগ নিষ্পত্তি হয়েছে এখানেই।
পলাশীর মিরজাফর অন্যত্রও আত্মপ্রকাশ করেছিল অন্য নামে। চিতোরের দুর্গও এক বিশ্বাসঘাতকের প্ররোচনায় ধ্বংস হয়েছিল। এই দুর্গের ভেতর আজও পদ্মিনীকে আলাউদ্দিন খিলজি যেখানে দেখেছিলেন, সেই জায়গাটি সাধারণকে দেখানো হয় সত্য-মিথ্যা কিছুই বলতে পারব না।
চিতোরগড়ের প্রকাণ্ড উঁচু বিজয়স্তম্ভ সগৌরবে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। কুতুবমিনারের মতো এটি একটি আদিম স্কাইস্ক্র্যাপার।
চিতোর ছেড়ে যোধপুরের পথ ধরলাম। যোধপুরের পর থেকেই মরুভূমি রীতিমতো আরম্ভ হয়েছে। যোধপুর জয়পুরের রাজার শ্বশুরবাড়ি। অভিভাবক ও প্রধানমন্ত্রী মিঃ এস এন ব্যানার্জি আই সি এস আগে থেকেই যোধপুরের রাজাকে আমাদের কথা লিখেছিলেন। কাজেই আমরা রাজঅতিথি হয়ে থাকলাম। তখন ইংরেজ পাইলটদের তালিম দেওয়া হত। তারা রাজার ‘গেস্টহাউস’ অধিকার করেছিল। রাজা আমাদের নিয়ে পাইলটদের সঙ্গে আলাপ করাতে গেলেন। বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন যে এই চারজন ভারতীয় সাইকেলে বিলাত যাবে, এমনকী পৃথিবী ভ্রমণও করবে। পাইলটরা সবাই ভদ্র এবং রাজার প্রতি খুবই সশ্রদ্ধ। দেখলেই মনে হত যে তাঁরা ভদ্রসন্তান। খুব উৎসাহ করে আমাদের সঙ্গে আলাপ করল। অনেকে বলল যে বিলাতে তাঁদের বাড়িতে চিঠি নিয়ে যেতে। যখন শুনল যে বিলাত পৌঁছতে আমাদের কমপক্ষে দুই বছর লাগবে তখন নিরস্ত হল।
পরদিন যোধপুর ছেড়ে আধ মাইল যাবার পর লুনির দিকে চললাম। তখন সাইকেল চড়া সম্ভব ছিল না। বালি আর বালির পাহাড়। অতি কষ্টে সেই পাহাড়ে ওঠবার ঠিক শেষ মুহূর্তে পায়ের নিচ থেকে বালি সরে যেত— আমরা যেখান থেকে চড়তে আরম্ভ করেছিলাম আবার সেখানেই নেমে যেতাম। এইরকম ভাবে বৃথা পরিশ্রমে শারীরিক ক্লেশ যেমন বাড়ত তেমনই সময়ও নষ্ট হত!
শুনেছি থর মরুভূমি পৃথিবীর আর দুটি মরুভূমির সমান কষ্টকর— সাহারা ও কালাহারি (আফ্রিকায়)। তাছাড়া আরও কত ছোট-বড় মরুভূমি আমাদের পার হতে হবে, তার জন্য স্বদেশেই অভিজ্ঞতা আহরণ আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। বালির ওপর দিয়ে হাতে সাইকেল টানতে টানতে চলতে খুবই ক্লান্তি বোধ করতাম— অথচ এগোতে পারতাম সারাদিনে বড়জোর ৭-৮ মাইল। শীতকাল বলে সেরকম জল পিপাসা বোধ করতাম না যেমন গরমের দিনে সবাই করে। এই মরুভূমির ওপর দিয়ে সিন্ধুদেশের হায়দ্রাবাদ পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন গেছে। বালিতে প্রায়ই রেললাইন ঢাকা পড়ে যায়। বালির ঝড়ের মুখে পড়লে ট্রেন পর্যন্ত বালিতে ভরে যায়। বালি সাফ করবার আলাদা ইঞ্জিন। তারা লাইন পরিষ্কার করে দিলে তবেই ট্রেন আবার চলতে পারে। যেমন বরফের জন্য পথঘাট রেললাইন পশ্চিমদেশে যখন ভরে যায়। তখন বরফকাটা ইঞ্জিন রাস্তা ও রেললাইন পরিষ্কার করে দিলে তবে যানবাহন চলাচলের উপযুক্ত হয়।
দিক ঠিক রাখার জন্য এবং জল ও খাবার সরবরাহ ঠিক রাখতে আমরা রেললাইন যতদূর সম্ভব দূর থেকে অথচ দৃষ্টির মধ্যে রেখেই এগোতাম। স্টেশনে পুরি এবং আলু-শাক পেতাম। কখনও কখনও বালির মধ্যে বুনো তরমুজ পেয়েছি। তা দিয়ে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার নিবৃত্তি করেছি। পথে বারমের এবং মিরপুরখাস পড়ল।
যখন মনে মনে ভাবছি যে মরুভূমি কী ভীষণ কষ্টকর জায়গা; আস্তে আস্তে এগিয়েছি এবং যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে বোধ করছি, এমন সময় দুমাস পরে একদিন দেখলাম পশ্চিম দিগন্তে দুয়েকটা গাছ দেখা গেল। এই জায়গাটার নাম ‘ছোড়’ অর্থাৎ বালির কবল থেকে মুক্ত। তারপর হায়দ্রাবাদ (সিন্ধু) শহরে পৌঁছলাম। এখানে সব বাড়ির ওপর বাতাস ধরার ব্যবস্থা আছে। এইরকমটা আর কোথাও দেখিনি। অনেকদিন পরে ভালো করে স্নান করে তৃপ্তি বোধ করলাম।
মরুভূমির বিশেষত্ব হল যে দিনেরবেলায় যেমন গরম রাত্রে তেমনই ঠান্ডা, কম্বল জড়িয়ে বালির গরমের মধ্যে কিছুটা আরাম পেতাম রাত দশটা পর্যন্ত, তারপর গরম জামা-কাপড় পরে শুতে হত।