দুচাকায় দুনিয়া – ১৩

১৩

রোন নদীর ধার দিয়ে রাস্তা নেমে গিয়েছে। আমার গন্তব্যস্থান জেনেভা। এদিকের দৃশ্য অপূর্ব। সামনে মঁ ব্লাঙ্ক মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। নিচে পাহাড়ের গায়ে মন্ত্রো শহর। আরও কিছু এগোবার পর জেনেভা হ্রদের ধারে লসান শহরে পৌঁছলাম। লেকের ওপারে ফ্রান্স, দুটো ভিন্ন দেশ হলেও যাতায়াতের কোনও বাধা নেই। পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি কিছু নেই। ভদ্র দেশ, ভদ্র ব্যবহার পেলাম।

এখানে সবাই ফরাসি বলে। সুইজারল্যান্ডে ছেলেমেয়েদের ইংরিজি এবং আরও তিনটি ভাষা শিখতে হয়। উত্তরে জার্মান, জুরিখ শহরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণে ইতালিয়ান এবং পশ্চিমে ফরাসি। প্রকৃতপক্ষে ওদের তিনটে মাতৃভাষা

জেনেভাতে দ্রষ্টব্য অনেক জিনিস আছে, তার মধ্যে অন্যতম লিগ অব নেশন্সের বাড়ি। এখানেই রেডক্রসের আদি জন্মস্থান ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনেরও আস্তানা। এই শহরে ফরাসি কালচারের আধিপত্য বেশি। দৈনিক জীবনও ফরাসি ছাঁচের। ফুটপাথ জুড়ে আকাশের নিচে রেস্তোরাঁ সর্বত্র।

সুইজারল্যান্ডে যত শহর আছে তার মধ্যে জেনেভাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ট্যুরিস্টের ভিড়। সব রাস্তা হাজার হাজার ইলেক্ট্রিক আলো দিয়ে সাজানো। দিবারাত্রি যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। নানারকম ফুল দিয়ে সাজানো বাগান, কী সুন্দর ফুল দিয়ে একটি বারো ফুট ঘড়ি সাজিয়েছে। সেটি সময়ও দিচ্ছে ঠিক ঠিক।

জেনেভা শহর জগদ্বিখ্যাত ঘড়ির জন্য। সব নামকরা ঘড়ির জন্মস্থান এখানে। সব ট্যুরিস্ট ভালো ঘড়ি সস্তায় পাবে ভেবে ঘড়ি কেনে কত লক্ষ টাকার তার ইয়ত্তা নেই। সুইশ লোকেরা খুব সূক্ষ্ম কাজ ভালোভাবে করতে পারে। সুইশ ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, হোটেল-রক্ষকের জগৎজোড়া সুখ্যাতি। এই ছোট দেশটিতে সেরা গো-পালন এবং চাষবাস হয়। দেশের মাটির গুণ আছে সন্দেহ নেই।। চাষ করবার জন্য ধান ধুয়ে আকাশের দিকে বৃষ্টির আশায় এরা চেয়ে থাকে না আমার দেশের মতো, বরফে ছ মাস মাটি সরস রাখে, তারপর পাহাড়ের দেশে এখানে বৃষ্টি লেগেই আছে। তাছাড়া লোকেরা পরিশ্রমী এবং উন্নতিকামী।

এই দেশ ট্যুরিস্টদের স্বর্গ। উঁচু উঁচু পাহাড় জল গাছ মিলে সুন্দর দেখায়, চারদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তা, শহরেই হোক বা গ্রামাঞ্চলেই হোক। এই সুন্দর দেশে ছুটিতে দলে দলে ট্যুরিস্ট আসে। হোটেল ব্যবসা এত উন্নতমানের যে সব লোককে তৃপ্তি দিতে পারে। এটা এদের জাত-ব্যবসা বললে অত্যুক্তি হবে না। এদেশের সব ছেলেমেয়ে হোটেল শিক্ষানবিশি করে, তা তারা যত বড়লোকের ঘরের হোক না কেন।

জেনেভা আসবার পথে বেনিজ ওভারল্যান্ড আল্পসের বরফ ঢাকা পাহাড়ের চূড়াগুলি আমাকে হাতছানি দিচ্ছিল। ইয়ংফ্রাউ, আইগার, ভেটারহর্ন ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওই বরফের জগতে ঢুকতে খুব ইচ্ছা হয় কিন্তু মনে মনে ভয় আরোহণের পন্থা জানি না বলে।

প্রথমে বার্নার ওভারল্যান্ডের দিকে রওনা হলাম। আমার গন্তব্যস্থান ওয়েটারহর্নের নিচে মাইরিনগেন গ্রাম। এখানে আমার নিমন্ত্রণ ছিল। একজন তরুণী, নাম হানি ইমার, লন্ডনে অ্যাডভান্স কোর্স ইন ইংলিশ ক্লাসে আমার সঙ্গে পড়ত। সেখানে অল্প আলাপ হয়। তার হঠাৎ দরকার পড়ল দেশে ফিরে যাবার, বাবার মৃত্যু-সংবাদে। হানির ভাই চার্লস এল লন্ডনে বেড়াতে, উদ্দেশ্য আমার সঙ্গে আলাপ করবার। চার্লস লন্ডনে আমার ফ্ল্যাটে উঠেছিল, হ্যাম্পস্টেড হিথে, চার্লির স্বভাবটা ভালো। আমার কালো রং কাছ থেকে দেখে সে মুগ্ধ। সে সুইজারল্যান্ডে কান্টোনাল ব্যাঙ্কে চাকরি করে।

চার্লি দেশে ফিরে আমার কথা তার বিধবা মার কাছে বলেছিল। চার্লি ও হানির অনুরোধে মিসেস ইমার আমাকে নেমন্তন্ন করেন, মাইরিনগেনে একবার বেড়াতে যাবার জন্য। ইমারদের পৈতৃক ব্যবসা হচ্ছে হোটেল চালানো। হোটেল বেয়ারের মালিক তিনি। মিসেস ইমার হোটেলের একাংশে থাকেন। আমাকে থাকবার জন্য তিনতলায় একটি ঘর দিলেন।

এই অঞ্চলটাকে বার্নার ওভারল্যান্ড বলে। মাইরিনগেন গ্রামে শত শত ট্যুরিস্ট আসে রোন গ্লেসিয়ারের খুব কাছে বলে। তাছাড়া আরেস নদী পাহাড়ের বুক চিরে মাইরিনগেন গ্রামের ভেতর দিয়ে চলেছে। নদীর উৎপত্তি স্থান দেখবার সুবিধার জন্য পাহাড়ের গা কেটে রাস্তা হয়েছে, এই নদী ইন্টারলাকেনে মিলেছে।

আমি আগেই বলেছি হোটেল চালানো সুইশদের কাছে জাত-ব্যবসার মতো। পরদিন সকালে মুখ হাত ধুয়ে বাগানে একটু বেড়াতে গেলাম। হানি মস্ত ট্রে হাতে প্রাতরাশ নিয়ে উপস্থিত হল। ঠিক হল কেবল সুইশ ব্রেকফাস্ট খাব। সেইরকম রুটি, মাখন ও চেরি জ্যাম আর কোথাও খাইনি।

আমার আর কোনও কাজ নেই। খাইদাই লোকজনদের দেখি, দলে দলে আসছে যাচ্ছে বাসে চড়ে। বিকালে টেনিস খেলতে গেলাম। অনেক যুবকের সঙ্গে আলাপ হল। দুজনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য, হানস হারি একজন চিত্রকর, অন্যজনটি রবার্ট ব্রুল, ছুরি, কাঁচি তৈরি করে খুব আধুনিক ধরনের। তার দেওয়া ছুরি আজও আমার কাছে রয়ে গেছে। এক ছুরিতে কাঁচি, বোতল খোলা, নরুন, সন্না, স্ক্রু-ড্রাইভার, করাত ইত্যাদিতে ভরা নানা কাজের জিনিস। যেমন দেখতে সুন্দর তেমনই কাজের অথচ ছোট্ট।

হানি, চার্লি ও আমি প্রায়ই ওভারল্যান্ড পাহাড়ে উঠতাম। ওপর থেকে বরফ ঢাকা চুড়ো সুন্দর দেখায়।

এই গ্রামে আরও তিনটি হোটেল আছে, তারা কিছুটা ছোট। সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ি লোকেরা বছরে একদিন সারারাত ধরে নাচ গান ও পান করে। এবার হোটেল বেয়ারে বাৎসরিক সম্মেলন হবে। সবার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া মিসেস ইমারের উদ্দেশ্য ছিল নিশ্চয়। তিনি আমাকে ধরে নিয়ে মাতব্বরদের কাছে উপস্থিত করলেন। একজন জিজ্ঞাসা করল আমি yodelling করতে পারি কিনা। আমি বললাম, জানি না তবে শিখে নেব। আরেকজন বৃদ্ধ খুব খুশি মনে yodelling করে আমার হাত ধরে বলল, আমি তোমার হাতেখড়ি দিই। অন্যরা আমাকে পানীয় দিতে চাইল। আমি ধন্যবাদ দিয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম। তারপর আরম্ভ হল, রাতভর নাচ, গান, yodelling। হানি ও তার দুজন বন্ধুর সঙ্গে নাচলাম। আজ পয়লা আগস্ট, সুইশদের জাতীয় দিবস। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় আগুন জ্বালানো এদের একটা প্রথা।

মাইরিনগেন গ্রামে যে সব যুবকদের সঙ্গে ভাব হয়েছিল, তারা আমাকে নেমন্তন্ন জানাল, সন্ধ্যারাত্রে আট মাইল দূরে ইন্টারলাকেন শহরে একটা গাড়িতে যাব। তারপর বাজি, খাওয়াদাওয়া, নাচগান।

প্রায় লক্ষ টাকার বাজি পুড়ল। যখন শেষ হল তখন রাত আটটা। আমরা সাতজন একটা বড় টেবিল দখল করলাম, হানি, চার্লি, হানস, রবার্ট ও তাঁর স্ত্রী মারগ্রেট, আমি ও হানির ছোট ভাই, এরনেস্ট। ইন্টারলাকেনের সবচেয়ে বড় হলে নাচগানের ব্যবস্থা হয়েছিল। টাউন হলটা এত বড় যে অন্তত এক হাজার ছেলেমেয়ে নাচতে পারে।

রবার্ট সবার জন্য স্যাম্পেন অর্ডার দিল এবং গ্লাস উঁচু করে বলল ভারত- সুইজারল্যান্ড মৈত্রী অক্ষয় হোক। বিরাট হলের দুই দিকে দুটো ব্যান্ড একসঙ্গে বেজে উঠল। হানি আমাকে বলল যে প্রথম নাচটা আমার সঙ্গে নাচবে। আমি তথাস্তু বলে উঠলাম। তখনও ভিড় হয়নি। সবাই স্ফূর্তি করতে ব্যস্ত। আমরা দুজন হলঘরের ভেতর এক রাউন্ড নেচে এলাম। তারপর মাঝামাঝি গিয়েছি, হঠাৎ একটা কাণ্ড হল।

একজন ভদ্রলোক ভালো ইভনিং স্যুট পরা, হাতে একটা ড্রিঙ্ক নিয়ে হলে যেখানে সবাই নাচছিল সেখানে উপস্থিত। সেটা ইচ্ছাকৃত তা আমি লক্ষ করিনি। যখন হানির গায়ে ধাক্কা মারল, আমি ফরাসি ভাষায় মাপ করবেন বলে সরে গেলাম। ভদ্রলোক স্পষ্ট ইংরিজিতে বলল পার্ডন মি, মাই ফুট? আমাদের দুজনের মাঝখানে হানি দাঁড়িয়েছিল। সে যেই কিছু বলতে গিয়েছে তখনই লোকটি তার গায়ে থুতু ফেলবার চেষ্টা করল এবং বলতে লাগল তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। হানি অবাক। লজ্জার কোনও কাজ তো সে করেনি। আমি তাড়াতাড়ি তাকে সরিয়ে নিলাম।

রাগে আমি ঝুঁকে পড়ে লোকটার শার্টের কলার ধরলাম এবং বললাম মাপ চাইতে হবে। হলের সমবেত জনমণ্ডলী কাণ্ডটা দেখে ভীষণ রেগে উঠেছিল, তারা এগিয়ে এল। ততক্ষণে আমার সঙ্গে রীতিমতো হাতাহাতি শুরু হয়েছে। অন্যরা দাঁড়িয়ে দেখছিল এবং আমাকে খুব উৎসাহ দিচ্ছিল। ওই অঞ্চলে ইমার পরিবার সুপরিচিত। হানির অপমানে সুইশরা অপমানিত এবং ইংরেজ পুঙ্গবকে শিক্ষা দিতে সবাই ইচ্ছুক।

ছেলেবেলায় বলাই চ্যাটার্জির সঙ্গে বক্সিং শিখেছিলাম। তখন আমি এত উত্তেজিত যে আমরা দুজন তেড়ে যাচ্ছি পরস্পরের প্রতি কিন্তু ফসকে গিয়ে দুজনেই কাঠের ওপর গড়াগড়ি দিচ্ছি। লজ্জা করছিল এমন অবস্থায়, তখন ঠিক করলাম পাউডার দেওয়া কাঠের জমির ওপর দিয়ে আমি তেড়ে যাব না বরং লোকটিকে দিলাম আমাকে আক্রমণ করতে। যেই কাছে এসেছে আমি প্রচণ্ড জোরে মুখে ঘুসি মারলাম। দেখি লোকটি কলাগাছের মতো মাটিতে পড়ল, আমার হাতে তার দুটো দাঁত লেগে রয়েছে।

মুহূর্তের মধ্যে সমবেত লোকেরা আমাকে ঘিরে ফেলে অভিনন্দন জানাল ফরাসি প্রথায়। একজন সুইশ তরুণীকে অপমান করার শোধ নিতে পেরেছি সেজন্য সবাই করমর্দন করতে চায়। ওদিকে যে ধরাশায়ী হল সে মাটি থেকে উঠল না। তার মাথার নিচে রক্ত দেখে দু-চারজন লোক সাহায্য করতে গেল কিন্তু সে জ্ঞানশূন্য। স্ট্রেচার এল, তার ওপর শুইয়ে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হবার ইচ্ছায় দুপা এগিয়েছি, এমন সময় এক ভদ্রলোক নিজেকে প্রিফেকট অব পোলিস অর্থাৎ পুলিশের বড়কর্তা বলে পরিচয় দিলেন এবং আমার দিকে এগিয়ে বললেন যে তিনি নিজে সমস্ত ঘটনাটা দেখেছেন এবং আমার কোনও দোষ নেই সে বিষয় তিনি নিঃসন্দেহ। কিন্তু সুইশ আইন অনুসারে বললেন, যদি লোকটির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান না হয় তো আমার বিরুদ্ধে মানুষ খুনের চার্জ হবে।

আবার আমাকে ঘিরে ভিড় জমে গেল, এ কীরকম উল্টো বিচার! সমবেত লোকদের মধ্যে থেকে একজন মাঝবয়সী ইংরেজ এগিয়ে এসে তাঁর কার্ডখানা অফিসারের সামনে ধরলেন। নাম ডি ম্যাকেঞ্জি এম পি, তিনি আইনজ্ঞ। যেহেতু আমি ভারতীয় আমার প্রতি তাঁর একটা কর্তব্য আছে বলে মনে করেন। তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন যে তিনি তাঁর জায়গায় বসে সব ঘটনাটা দেখেছেন এবং তিনি নিশ্চিত বলতে পারেন যে আমার কোনও দোষ নেই।

মিঃ ম্যাকেঞ্জি আমাকে অনুরোধ করলেন যেন অন্তত তিনদিনের মধ্যে সুইজারল্যান্ড ছেড়ে অন্য দেশে চলে না যাই। আমি কথা দিলাম ও পাসপোর্ট জমা রাখতে প্রিফেকটের কাছে রাজি হলাম। সেসব দরকার হল না যখন চার্লি এগিয়ে এসে বলল যে আমি তাদের অতিথি এবং সুইজারল্যান্ড ছেড়ে এখনই কোথাও যাব না। চার্লি আমার জামিন।

মিস্টার ম্যাকেঞ্জি একজন ব্রিটিশ মেম্বার অব পার্লামেন্ট বলে তার খাতির খুব, সবাই সমীহ করে কথা বলতে আরম্ভ করল। প্রিফেকট অব পুলিশ আমার করমর্দন করে বললেন, তুমি দেশের মধ্যে যেখানে খুশি যেতে পার। তোমার কোনও দোষ নেই জানি। তুমি প্রার্থনা কর যেন লোকটির তিনদিনের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসে।

অ্যাম্বুলেন্সের দিকে স্ট্রেচারটা এগিয়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম যে লোকটার দুটো সামনের দাঁত ভেঙে গিয়েছে এবং মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ছে অঝোরে যে জন্য মনে হচ্ছিল মাথা ফেটেছে। আমার একবার মনে হল যেন চোখ চেয়ে আমাকে কিছু বলতে চায়। সে সুযোগ হল না। স্ট্রেচারে নিস্পন্দ লোকটা সামনে দিয়ে চলে গেল।

মিঃ ম্যাকেঞ্জি আমাকে বললেন তিনি গ্র্যান্ড হোটেলে থাকেন এবং সবসময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। ড্রিঙ্ক করবার নেমন্তন্ন করলেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমার সঙ্গে লোকটির কোথাও আলাপ হয়েছিল কি? অপমান করবার কারণ জিজ্ঞাসা করায় আমি বললাম কারণ, একজন ইংরেজ হয়ে লোকটি দেখতে প্রস্তুত ছিল না যে আমার মতো একজন কালা আদমির সঙ্গে সুইশ শ্বেতাঙ্গিনী তরুণী নাচছে।

মিঃ ম্যাকেঞ্জি আরেকবার করমর্দন করে বললেন, লোকেদের এমন সঙ্কীর্ণ মন! আমি আমার বন্ধুদের দলে যোগ দিলাম। কত লোক আমাকে ড্রিঙ্ক এগিয়ে দিতে এল তার ঠিক নেই, এমন সময় দুটো ব্যান্ড বেজে উঠল, সুর ধরল হি ইজ এ জলি গুড ফেলো এবং সবাই দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে গ্লাস তুলে অভিনন্দন করল। আমিও স্বীকার করলাম। সে কী হৈ হৈ চিৎকার এবং উল্লাস যে একজন সুইশ মহিলার অপমানের যথেষ্ট শোধ নেওয়া হয়েছে।

ফ্রান্সের মতো সুইজারল্যান্ডেও colour preudjice নেই। তারা পৃথিবীসুদ্ধ লোককে খাতির দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে। হানির মুখে একটা ব্যথিত দৃষ্টি। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম এবং চারটের সময় বাড়ি ফিরে শুতে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম কী চমৎকারভাবে সুইশ জাতীয় দিবস আমার কাটল। আরেকটা কথা মনে পড়ল, এ পৃথিবীতে সব দেশে ভালোমন্দ লোক পাশাপাশি রয়েছে। একজন ইংরেজ মারামারি করল আরেকজন ইংরেজ নিজে জামিন দিতে এগিয়ে এল।

কথা ছিল নটার সময় একসঙ্গে সবাই প্রাতরাশ খাব। সকালে বুঝলাম খবর কাগজের রিপোর্টাররা ছেঁকে ধরবে। আমি বন্ধুদের বললাম, চল আমরা পর্বতারোহণে বেরিয়ে পড়ি কয়েকদিনের জন্য, মেয়েরা কেউ গেল না। শেষপর্যন্ত আমরা দলে তিনজন রইলাম। চার্লি, হানস ও আমি। চার্লির মা গত রাত্রির ব্যাপারটা শুনলেন এবং আমাকে সমর্থন জানালেন। তিনি আমাকে বললেন, তাঁর স্বামী আমার মতো দেখতে ছিলেন। তাঁর অনেক পর্বতারোহণের কাপড়চোপড় ও লোহার জুতো ক্লেতারণ শ্য অর্থাৎ পাহাড়ে চড়বার জুতো ও বাকি অত্যাবশ্যকীয় জিনিস আছে যা আমি আরোহণে ব্যবহার করতে পারি।

তখনই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। বেলা দুটোর সময় আমরা রওনা হলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চারে হাত দিলাম। কোনও অভিজ্ঞতা নেই। শুধু এইটুকু বিশ্বাস ছিল যে অন্য দুজন যুবক যা করতে পারবে, আমিও তা পারব। রুকস্যাক ছাড়া আমার আর কোনও জিনিস নিজস্ব ছিল না। বাকি সব চার্লির বাবার। ট্রাউজারটা একটু ছোট হচ্ছিল। মনে মনে ভয় যে ট্রাউজারটা সম্পূর্ণ দুভাগ না হয়ে যায়। যতবার খুব উঁচুতে পা দিয়ে ওঠবার চেষ্টা করছি ততবার ভয় হচ্ছিল এবার গেল বুঝি। লাউতার ব্রুনেন সন্ধ্যার পর পৌঁছলাম।

একটা হোটেলে উঠলাম। এইসব শহর থেকে দূরে হোটেলে সমস্ত খাবার জিনিস জোগাড় করা কষ্টসাধ্য তাই আমি প্রথমেই হোটেল মালিককে বললাম যে আমাদের বেশি দামের ঘর দিও না। মালিক তখনই ছুটে ঘরের ভেতর গেল এবং তরুণী ভাষাকে নিয়ে উপস্থিত হল। আমি যা বলি তাইতেই রাজি, তাছাড়া দুজনের মুখে কেবলই হাসি, হাসি চাপতে পারছে না মনে হল। আমাদের আসলে হোটেলের সবচেয়ে বড় এবং ভালো ঘরটা যার নাম পিঙ্করুম কিংবা হনিমুন স্যুইটটা দিল। খুব আপত্তি জানালাম। মালিক হাসিমুখে বলল সব ঠিক আছে। ও নিয়ে ভাবতে হবে না।

আমরা খুব আরামে স্নান করে বারান্দায় এসে বসলাম। যখন চার্লি বলল যে তার পেটে খিল ধরেছে। হানস বলল যে তাহলে তার কালই সকালে বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। ওঠবার সময় পেটে খিল ধরে এবং সেটা আস্তে আস্তে কমে যায় যদি তখনই ওঠার কাজ আর না করে। কিন্তু কাল থেকে ওঠানামা এবং বিশেষ করে ওঠার কাজ অনেক বেশি হবে। পথে কোথাও থাকবার জায়গা নেই। তিনজনে পরামর্শ করে ঠিক হল যে চার্লি ফিরে যাবে এবং আমরা দুজনে এগিয়ে যাব।

হানস হারি একজন পাকা পর্বত আরোহক। চার্লি পাহাড়ের দেশে থাকে বটে কিন্তু কঠিন পর্বতারোহণ কখনও চেষ্টা করেনি। অথচ আমি চার্লির ভরসাতে ওয়েটার হর্ন চড়বার সাহস পেয়েছিলাম।

একটু পরে মালিক ও তার স্ত্রী আমাদের জন্য ড্রিঙ্কস দেবার হুকুম দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, রাত্রে আমরা কী খেতে চাই। আমি বললাম, খুব সাদাসিধে কম খরচায় ডিস অর্ডার দেব। হানস আমার কথার পুনরাবৃত্তি করল। কিন্তু সে কথায় কান না দিয়ে মালিকানি জিজ্ঞেস করলেন আমি শুয়োর খাই কিনা, হ্যাঁ বলাতে চলে গেলেন। পরদিন প্রাতরাশ খেয়ে চার্লি বাড়ি ফিরে যাবে আর আমাদের কঠিন পরীক্ষা আরম্ভ হবে।

রাত্রে খাবার টেবিলে গিয়ে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। এত সাজিয়েছে এবং চারদিকে আলো দিয়েছে দেখে আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। কোথাও সাদাসিধে আড়ম্বরহীন রোস্ট পর্ক ও আলু চাইলাম, আর পেলাম সম্পূর্ণ অন্য জিনিস, ভিয়েনিজ স্নিৎশেল, আলুভাজা, রোস্টেড টমাটো, ক্রিম পুডিং ইত্যাদি। আমরা না চাইলেও নেপোলিয়ান ব্র্যান্ডি গ্লাসে ঢেলে দিল। ব্যাপারটা কী বুঝতে পারছি না। চার্লিকে জিজ্ঞাসা করলাম তাদের দেশে হোটেলগুলো সব চলে কি এমনই ভাবে? বিল বাড়িয়েই চলেছে। আমরা দেখলাম যে হোটেলের মালিকদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছি না। যাহোক চর্বচোষ্য ভোজন ও পান করে, আমরা ধন্যবাদ জানালাম যে খাবার খুব স্বাদের হয়েছে।

সকাল হতেই দেখি চার্লি বাড়ি ফিরে যাবার জন্য তৈরি। হানস ও আমিও রওনা হব ওপরে বরফের দেশের দিকে। আমাদের জন্য দুটো রোস্ট চিকেন তৈরি করে হোটেল মালিকের স্ত্রী আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে।

যখন বিল চাইলাম। তখন দুজনে একগাল হেসে বলল, নো বিল, আমরা নাকি অতিথি হিসাবে ছিলাম। দুরাত আগে ইন্টারলাকেনে কুরশালে সমস্ত ব্যাপারটা ওরা দেখেছিল। এবং সুইশ মহিলার সম্মান আমি রক্ষা করতে পেরেছি বলে তারা আমার জন্য খুব গর্ববোধ করেছিল। মহিলাটি এগিয়ে এসে আমায় করমর্দন করল এবং সেইসঙ্গে হাতে স্তূপাকার খাবার ধরিয়ে দিল।

আমরা এতক্ষণে হেঁয়ালিটা বুঝলাম। হোটেলের মালিক ও তার স্ত্রীর ব্যবহারে আমরা অভিভূত। চার্লসকে ওরা চুপি চুপি সব কথা বলেছিল। আমরা বিদায় নিয়ে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে চড়াই উঠতে আরম্ভ করলাম।

দুঘণ্টা চড়াই উতরাই করবার পর আমরা গ্লেসিয়ারের সামনে পড়লাম। আমি গ্লেসিয়ারের ওপর কখনও আগে চলিনি। পা দেওয়া মাত্র আছাড় খেলাম। তখন হানস বলল, তোমার হয়তো গ্লেসিয়ারের ওপর চলার অভিজ্ঞতা নেই। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। পিক অ্যাক্সটা ঘুরিয়ে গ্লেসিয়ারের এক চাকলা বরফ উঠিয়ে দিল। তারপর সেই আঁচড় করা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আবার এক টুকরো বরফ উঠিয়ে ফেলল। এমন করে দ্বিতীয় পদক্ষেপ হল। এবং যতক্ষণ পারলাম বরফ কেটে কেটে গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে পার হয়ে গেলাম।

আমাদের দেশে গ্লেসিয়ার দেখা যায় অনেক উঁচুতে ১২,০০০-২০,০০০ ফুট ওপরে, সুইজারল্যান্ডে গ্লেসিয়ার পেলাম সী লেভেলে অর্থাৎ সমুদ্রের সঙ্গে সমতল জমিতে। যখন মাউন্টেনিয়ারিংয়ের কথা প্রথম হল, আমি খুব উৎসাহ দেখিয়ে ছিলাম। তখন আমাকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল কত উঁচুতে উঠেছি। আমি বললাম ১০,০০০ ফুট। টাইগার হিল পর্যন্ত যে গাড়িতে উঠেছি সে কথা ঊহ্য রয়ে গেল। ইউরোপের সব শৃঙ্গ ১২,০০০-১৬,০০০ ফুটের মধ্যে, তার মধ্যে পর্বতারোহণের সব উদ্দীপনা, উৎসাহ, দুরূহতা— সবই টের পাওয়া যায়।

আমি তখনও ভাবছি যে আমি সবরকম বিপদের সম্মুখীন হতে পারব আরোহণ করবার সময়। বাস্তবিক পক্ষে আমার কোনও ধারণা ছিল না যে কঠিন পর্বতে আরোহণ করতে হলে কী কী বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হতে হয়। হানস হারি ছেলে বয়স থেকে একটা বরফঢাকা শৃঙ্গ থেকে আরেকটায় আরোহণ করেছে। হানস ছাগলের মতো নিশ্চিত পদক্ষেপে উঁচু পাহাড়ে যেখানে কোনও পথ নেই তাতে চলে বেড়াতে পারে। হানসের বিপদের কথায় ভ্রূক্ষেপ নেই। হয় পাথরের ওপর নয়তো বরফের ওপর চলতে হবে, দুটোতে সে সিদ্ধহস্ত।

আমি চলেছি কোনও মতে। প্রাণপণ চেষ্টা করছি হানস না ধরে ফেলে যে আমি আনাড়ির মতো টলমল করতে করতে চলেছি। আমার সব কাজই গায়ের জোরে সারছিলাম। সী লেভেল থেকে ১০,০০০ ফুট উঁচুতে উঠেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল হাট বা কুটির। সেটা একটা পাহাড়ের মাথার ওপরে অবস্থিত। সন্ধ্যার দিকে মনে হচ্ছিল বাতাসে যেন অক্সিজেনের অভাব। খানিকক্ষণ ছোট সিঁড়িতে চুপচাপ বসে অস্তগামী সূর্য দেখলাম। বরফের ওপর লাল ও হলদে রঙের খেলা মনের ওপর দাগ কেটেছিল।

কুটির সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। পর্বতারোহণে যাতে অনেক লোক উৎসাহী বোধ করে, সেজন্য একটা বেসক্যাম্প ১০,০০০ ফুট উঁচুতে তৈরি করার কল্পনা হয়। সেটাতে বাস্তবিক রূপ দিতে তিলে তিলে কাঠকুটো নিয়ে কাঠবেড়ালির মতো আরোহীরা দশ হাজার ফুট উঁচুতে একটা কুটিরের বুনিয়াদ তৈরির মালমশলা জড়ো করেছিল। তারপর একদল উৎসাহী তরুণ-তরুণী একটা ঘর তৈরি করে। ঘরটা লম্বা ধরনের একফালি। আসবাবের মধ্যে কয়েক আঁটি পুরু খড় বিছানো রয়েছে। ঘরের দুধারে লম্বা সেলফ লাগানো যাতে ভবিষ্যতের আরোহীরা তাদের উদ্বৃত্ত খাবারদাবার জিনিসপত্র সাজিয়ে রেখে যেতে পারে, যাতে তারও পরের আরোহীরা দরকার পড়লে সেসব ব্যবহার করতে পারে। কুটির বলতে এইরকম একটা নিঃস্বার্থভাবে গড়ে তোলা আশ্রয় সব পর্বতারোহীদের জন্য।

আমাদের সঙ্গে টিনের খাবার যথেষ্ট ছিল। কিছু রেখে যাব স্থির করলাম। একটা স্টোভ আছে বরফ গলিয়ে চা স্যুপ ইত্যাদি করবার জন্য।

ঘরের এক পাশে একটা বড় খাতা ছিল যেখানে সব আরোহীদের নাম ঠিকানার পর সই করতে হল এবং সেইসঙ্গে লিখতে হল কোথা থেকে আসা এবং গন্তব্য কোথায়। এই পথে ফিরলে নামের পাশে পাহাড়ের শৃঙ্গের নাম ও উচ্চতা এবং আরোহণ করার তারিখ ও মন্তব্য লিখতে হয়। আমি যদি ভেতার হর্নে উঠতে সক্ষম হই তো এই খাতায় রেকর্ড থাকবে।

সবাই যে এই পথে ফিরবে তার কোনও স্থিরতা নেই। অনেক বিপদ বা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কিছু আরোহীর মৃত্যু হয়েছে। একজন ইংরেজ কুটির পর্যন্ত ওঠার পর শ্বাসকষ্টে দেহরক্ষা করেছে।

হোটেল থেকে খাবার অনেক দিয়েছিল, সন্ধ্যার মধ্যে খেয়ে শুতে গেলাম। ধড়াচূড়া জুতো সবই পরে খড়ের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। হানস হারি রাত দুটোর সময় ঘুম ভাঙিয়ে দিল। বলল, এক ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। পাহাড়ে উঁচু জায়গায় অনেক আগে দিনের আলো দেখতে পাওয়া যায়। তিনটেয় রওনা দিলাম।

দি হাট বা কুটির থেকে বেরিয়ে মচমচে বরফের ওপর পা ফেললাম। হানস বলল, আজ খুব সম্ভবত ভালো দিন পাব। আমার বুট জুতোর ওপর ক্লেতারণ শ্য অর্থাৎ আরোহণ করবার লোহার জুতো— চারদিকে লোহার খোঁচা খোঁচা কাঁটা, বা স্পাইক দেওয়া— পরে নিলাম। পায়ের নিচে এবং পাশে বড় বড় লোহার কাঁটা বরফের ওপর চলতে সাহায্য করে। একেই তো লোহার জুতো ভারি তার সঙ্গে ডেলা বরফ জমে আরও ভারি করেছিল। পা দুটো যেন জগদ্দল পাথর

এখনও সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে না কিন্তু সাদা বরফের জন্য সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। অনেক গর্তের ওপর বরফ পড়ে আস্তরণের মতো ঢেকে রাখে। ভুলে তার ওপর পা পড়লে গর্তের মধ্যে পড়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। অনেক গর্ত খুব গভীর তাদের ওপর পিক অ্যাক্স দিয়ে ঠুকে ঠুকে এগোতে হয়। গর্তের মধ্যে পড়লে মৃত্যুর সম্ভাবনা।

হানস আমার কোমরে শক্ত করে দড়ি বাঁধল, চল্লিশ হাতের মতো ব্যবধানে দড়ির অন্য অংশ নিজের কোমরে বাঁধল। একজনের পা ফসকে গেলে অন্যজন কী করবে তৎক্ষণাৎ তাও দেখিয়ে দিল। দড়িতে হঠাৎ টান পড়লেই বরফের ওপর পিক অ্যাক্সটা গেঁথে দড়ি জড়াতে আরম্ভ করতে হবে। এই রকম করে খুব সহজেই যে লোক পড়ে যাচ্ছে তাকে ধরে ফেলা যায়। দল যদি বড় হয় তো প্রত্যেকের কোমরে দড়ি বাঁধতে হয়।

পর্বতারোহণ এক বিপজ্জনক স্পোর্টস। পর্বতারোহণ স্কুলে বা ক্লাবে প্ৰশিক্ষণ নিতে হয়, বিপদ থেকে কেমন করে নিজেকে বাঁচাতে হয় এবং সঙ্গীদের রক্ষা করতে হয়। আরোহণ নানা প্রকারের হলেও মোটামুটি দুই রকম বলা যেতে পারে, পাথরে চড়া ও পিচ্ছিল বরফের ওপর চড়া।

সামনে দূর বিস্তৃত বরফের স্তূপ। ধীর সুনিশ্চিত পদক্ষেপে এগোতে লাগলাম। কতবার নামলাম ও উঠলাম তার ইয়ত্তা নেই।

হানস বলল যে এই পাহাড়টা পাশের পাহাড়ের গায়ে যদি যুক্ত হয় বরফের ব্রিজ দিয়ে,তাহলে আমরা তিন মাইল হাঁটা থেকে বেঁচে যাব এবং ভেতার হর্ন সোজা হবে।

বরফের ব্রিজ কী তা না জেনে আমি বললাম, এস চেষ্টা করা যাক।

অল্পক্ষণের মধ্যে বরফের ব্রিজের সামনে উপস্থিত হলাম। একে বরফের ব্রিজ না বলে মরবার ফাঁদ বললে ভালো হয়। দুই পাহাড় থেকে বরফের আইসিকল একদিকের সঙ্গে অন্যদিকের হাত মিলিয়েছে। ফলে একটা সরু বরফের সংযোগ হয়েছে— তারই নাম ব্রিজ।

যখন হানস বলল, এস আমরা ওপারে যাই বলে সন্তর্পণে ব্রিজের ওপর দিয়ে চলতে আরম্ভ করল, আমাকে বলল পিক অ্যাক্স গেঁথে দড়িটা শক্ত করে জড়িয়ে দেহের চাপ দিয়ে পিক অ্যাক্স ধরে থাকতে হবে।

বরফের ব্রিজের মুখের কাছে এসে আমি পিক অ্যাক্স গেঁথে বসলাম।

হানস হারি চলতে আরম্ভ করল। বরফের সরু একফালি ব্রিজের থেকে জমি ৫,০০০-৬,০০০ ফুট নিচে। পা ফসকালে কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না।

নিচের দৃশ্য দেখে আমার মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম। এবার আমার পালা ওপারে যেতে হবে। কিন্তু রীতিমতো দ্বিধা ও চিন্তা এসেছে, ভাববার জন্য বুট জুতোর ফিতা খুললাম, বাঁধলাম বারবার। কী চিন্তা তখন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল সেই কথা লিখছি। অ্যাডভেঞ্চার করতে এসে যখন জীবনমরণ সমস্যার সম্মুখীন হতে চলেছি। কত আর জুতোর ফিতে বাঁধি! মনে মনে ঠিক করলাম ওপারে যেতেই হবে। হানস কী ভাবছে? হিমালয়ের হিরো এখন আল্পসের হিরোর কাছে হারতে বসেছে। মনে মনে ঠিক করলাম যে বরফের ব্রিজের ওপর দিয়ে যাবার সময় কোনও দিকে চাইব না পথটুকু ছাড়া, অথচ পথের দিকে চাইলেই তো যত গোলমাল! নিচের গ্রামটার আবছা ছবি তখনই হাতছানি দেবে।

মনস্থির করে প্রথম পদক্ষেপ ফেললাম বরফের ব্রিজের ওপর। হঠাৎ পাহাড়ের মেঘ নিচু থেকে ওপরে উঠে আমাকে ঘিরে ফেলল। হানসকে দেখতে পেলাম না। ব্রিজের নিচে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি আর এদিক ওদিক না চেয়ে সোজা দৃঢ় পদক্ষেপে ব্রিজের অন্য দিকে যেখানে হানস অপেক্ষা করছিল তার সামনে উপস্থিত হলাম। মনের গভীরে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম, সেদিন পাহাড়ে মেঘ ঠিক সময়ে উপস্থিত না হলে কী করতাম ভেবে পেলাম না। হয়তো পার হয়ে যেতাম, সেই সম্ভাবনাই বেশি ছিল। ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার সঙ্গে নাড়ির যোগ রয়েছে হানসের দড়ি দিয়ে। সে পিক অ্যাক্সে দড়ি পাকিয়ে চেপে ধরে বসে আছে যদি আমি পা ফসকাই।

চড়াই-উতরাই করতে করতে আমরা ভেতার হর্ন শৃঙ্গের পাদদেশে পৌঁছেছি। এক হাজার ফুট বরফের উঁচু থাম সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হানস একটা প্ল্যান করে ফেলল। সে এগিয়ে যাবে আমি দড়ি ধরে বসে থাকব। তারপর আমার পালা। এই রকমভাবে ৪০ ফুট একেক বারে এগোতে লাগলাম।

কী ভীষণ রকম পিছল পাহাড়ের চিরতুষারাবৃত গা। প্রত্যেক পদক্ষেপ করা সম্ভব হচ্ছিল, বুট জুতোর মাথায় দুটো কাঁটা দিয়ে বরফের গায়ে ঠুকরে এবং সেইসঙ্গে পিক অ্যাক্স দিয়ে ওপরে একটা গর্তে শক্ত করে ধরে নিজেকে টেনে তুলে। ৪০ ফুট ওঠবার পর বিশ্রাম এবং অন্য আরোহীর জন্য পিক অ্যাক্স গেঁথে বসে থাকা। এই এক হাজার ফুট বরফের থামকে বিপজ্জনক বলা হয়। তার মানে আরোহী বিপদের সম্মুখীন হয়েছে এবং খুব সাবধানে এগোবে। থামের অন্য দিকে পা ফসকালে ৮,০০০- ১০,০০০ ফুট নিচে পতন। আজ কিছু আগে ভাবছিলাম বরফের ব্রিজ পার হব। এখন দেখছি বরফের থামের গা বেয়ে ওঠা তার চেয়ে অনেক কঠিন। ভয় ও বিপদের আশঙ্কা আপেক্ষিক মনে হয়। কাল যা অসম্ভব আমার মনে হয়েছিল, আজ তার চেয়ে অনেক কঠিন কাজ করতে পারছি।

দুজনে প্রাণপণে চেষ্টা করে ভেতার হর্ন চূড়ায় উঠলাম। ১৪,০০০ ফুট উঁচু, কী অপূর্ব দৃশ্য। দুজনে দুজনের করমর্দন করলাম। আমি হানসের একটা ছবি তুললাম। হানস আমার একটি ছবি তুলল, শৃঙ্গের ওপর বিজয়ী বীরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছি। অন্যান্য শৃঙ্গের ও পর্বতমালার ছবিও তুললাম। যেদিকে চাই দূর, বহুদূর দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। এদিকে ফ্রান্স, অন্যদিকে জার্মানি। দক্ষিণে ইতালি ছবির মতো ভাসছে। বেশিক্ষণ যে বসে বসে সৌন্দর্য উপভোগ করব সে উপায় নেই, কনকনে ঠান্ডা হাওয়া অস্বস্তির সৃষ্টি করছিল।

এবার নামবার পালা। আমি প্রথম বরফে পা দিয়ে খোঁচা মেরে এক ধাপ নামলাম হানস পিক অ্যাক্স চেপে বসে রইল। এমনিভাবে দুজনে পালা করে খুব সাবধানে নামতে নামতে ভেতার হর্ন শৃঙ্গের পাদদেশে এসে পৌঁছে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম।

খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুকাপ কফি ও সেদ্ধ ডিম খেলাম। তারপর দুজনে পরামর্শ করলাম যে আরও দুটো শৃঙ্গ চড়তে হবে। রোদ উঠে গেছে। অল্পদূর নামবার পর পায়ের নিচে বরফ তখন আইসক্রিমের মতো নরম হয়ে গেছে। হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছিল বরফের মধ্যে। এ আরেক মুশকিল। অনেক চেষ্টার ফলে অল্প অগ্রগতি হচ্ছিল। আইসক্রিমের ওপর বসা যায় না। বিশ্রামের কোনও প্রশ্নই নেই। বিকালের দিকে পাহাড়ের আড়ালে বরফ শক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমরা তার ওপর অপেক্ষাকৃত অনায়াসে চলতে লাগলাম। ক্রমে ক্রমে অন্ধকার নেমে এল। কাছেই একটা গুহা দেখে হানস বলল, আমরা গুহাতে রাত কাটাব। তথাস্তু বলে আমি হ্যাভারস্যাক নামালাম।

কাল রাত তিনটে থেকে বেশিরভাগ সময় এই ভারি বোঝাটা সারাদিন বয়েছি। ক্লান্তি লাগছিল। গুহার ভেতর ঢুকলাম। বরফ পড়ে যদি গুহার মুখ বন্ধ না হয়ে যায় তো রাত্রিযাপন বেশ চলবে। গুহাটা পাহাড়ের গায়ে অল্প ঢালু। মাঝে মাঝে মেঘ ডাকার মতো শব্দ হচ্ছে, তখন বরফের অ্যাভালাঞ্চ দেখি দূরে দূরে।

হানস তার ঝুলি থেকে একটা ছোট ফ্লাক্স বের করে বলল এই নাও, এস এবার আমরা আনন্দ করি। ব্র্যান্ডি একটু খেলাম। শরীরটা গরম লাগল। হানস বলল, এবার তুমি একজন মাউন্টেনিয়ার বলে স্বীকৃত হলে। পরের যে দুটো শৃঙ্গ আরোহণ করব, সেগুলোয় পাথরের গায়ে বরফ জড়িয়ে নেই। সাবধান হলে পড়বার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম।

দেখতে দেখতে সামনের পাহাড়টার আড়ালে দিনের আলো নিভে এল। রোস্ট মুরগি, রুটি, মাখন ও আলুসেদ্ধ পেট ভরে খেলাম। বরফ গলিয়ে জল গরম করলাম এবং দুজনে দুকাপ কোকো খেলাম অনেকগুলো চিনির ডেলা দিয়ে।

আমার মতো পেটুক ছেলের সেদিন খাবারের কোনও লোভ ছিল না। কেবলই উপভোগ করছিলাম শৃঙ্গে উঠতে পারার উচ্ছ্বাস ও আনন্দ, আমার জীবন যেন সার্থক হয়েছে। আর কখনও এই কথাটি মনে হয়নি আজ সকালে শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে যেমন বারবার মনে হচ্ছিল যে ওই দূরে পৃথিবী পায়ের নিচে দুঃখ কষ্ট আনন্দ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আজ আমি আকাশের অনেক কাছে পৌঁছেছি। আমাদের মধ্যে শ্বেতশুভ্র ও পবিত্র বরফের ব্যবধান।

এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসছিল না। দুজনে গল্প করছিলাম যতক্ষণ না চাঁদের আলো আবার আলোকিত করল। আলোর এত জোর যে ভুল হয় দিনের আলো বুঝি চারদিক নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে দূর আকাশে গুড়গুড় শব্দ জানিয়ে দিচ্ছে যে অ্যাভালাঞ্চ হচ্ছে। রাত্রে অ্যাভালাঞ্চ হয় যদি খুব বেশি বরফ পড়ে এবং পাহাড়ের জায়গা বিশেষে যদি এক জায়গায় খুব বেশি বরফ জমে যায়। দিনেরবেলায় হয় অন্য কারণে। কড়া রোদ্দুর হলে বরফের চাঁই সরতে আরম্ভ করে এবং স্থানচ্যুত হওয়া খুব স্বাভাবিক। অ্যাভালাঞ্চের সময় এত শব্দ করে বরফ গুঁড়িয়ে পড়ে যে মনে হয় বজ্রপাত হচ্ছে বুঝি। অ্যাভালাঞ্চে যদি মানুষ পড়ে তো মৃত্যু অনিবার্য।

এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি এই প্রার্থনা করে যে আমাদের গুহার মুখে বড় রকমের অ্যাভালাঞ্চ যেন না হয়।

রাত আড়াইটার সময় ঘুম ভেঙে গেল। তখনও স্ফূর্তি স্ফূর্তি ভাব, কারণ পর্বতারোহণের এক কঠিন অধ্যায় প্রথমেই সাফল্যের সঙ্গে পার হয়েছি। হানস সারা জীবন চেষ্টা করেও আগে ভেতার হর্ন উঠতে সক্ষম হয়নি নানা কারণে। পরের দুটি শৃঙ্গ চড়েছে। তার অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক। বরফের ওপর দিয়ে আমি চলেছি এই প্রথমবার।

ভোর রাত তিনটেয় রওনা হলাম। ধীরে ধীরে উঠছি। বরফ পার হয়ে পাথরের ওপর দিয়ে চলছি। স্রেক হর্নের শৃঙ্গে উঠলাম (১৩,০০০ ফুট), বেলা নটার সময় নেমেই বিশ্রাম না করে অ্যাঙ্গেল হর্নে উঠতে চললাম। স্রেক হর্নের শৃঙ্গে কখন উঠলাম টের পাইনি, অ্যাঙ্গেল হর্ন তেমন নয়। পাথরের থাম পাহাড়ের গা থেকে সোজা উঠে গিয়েছে।

দুজনের গাঁটছড়া ভালো করে বেঁধে এক পা, এক পা করে এগোচ্ছি। বেলা বারোটার সময় অ্যাঙ্গেল হর্নের (১২,০০০ ফুট) শৃঙ্গে উঠলাম। বেশি সময় নষ্ট না করে আমরা নামতে শুরু করলাম বার্নার ওভারল্যান্ডের দিকে। ৪,০০০ ফুট নামবার পর পাহাড়ে সরু পথ পেলাম।

আমি সাহস করে কালো ঠুলির চশমা সব সময় ব্যবহার করিনি যার ফলে আমার দৃষ্টিশক্তিতে গোলমাল দেখা দিল। খুব তাড়াতাড়ি করে দুজনে মাইরিনগেনের পথে নামছিলাম। ৬,৫০০ ফুট উঁচু থেকে অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তা পেলাম। গাড়ি, ঘোড়া বা লোকজন যাতায়াত করে না। রাস্তায় তাই আলগা পাথর সর্বত্র পড়ে রয়েছে। রাখাল ছেলেরা এত উঁচুতেও গরু ভেড়া চরাতে নিয়ে যায়।

অন্ধকার হবার অনেক আগেই আমি দুই চোখে অন্ধকার দেখতে আরম্ভ করলাম। কেবলই মনে হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খাব কিংবা নিচে পড়ে যাব

চারদিকে সন্ধ্যার আলো জ্বলবার আগেই মাইরিনগেন পৌঁছে গেলাম। হানি ও চার্লস এবং তাদের মা, রবার্ট ও তার স্ত্রী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

আমরা দুজনে ভেতার হর্নের চূড়ায় যখন উঠছিলাম তখন মাইরিনগেন থেকে টেলিস্কোপে অনেকে দেখেছ এবং আমরা নামবার পর আনন্দ করছে। হানির মার এত স্ফূর্তি যে বলবার নয়। তাঁর স্বামীর বুট জুতো এবং আরোহণের সব জিনিস পরেছিলাম বলেই যেন আমরা সফলকাম হলাম। হানি আমাদের সুখবরটা দিল যে মিস্টার রিচার্ডসন হাসপাতালে ভালো আছে। আমি বুঝতেই পারছিলাম না রিচার্ডসন আবার কে? আমি একেবারে অন্য জগতে গিয়েছিলাম। মনে পড়ল মারামারির কথা, মনে পড়ল আমার হাতে দুটো দাঁত আটকে থাকার কথা। শুনে আশ্বস্ত হলাম যে মিঃ ম্যাকেঞ্জি টেলিফোনে হানিকে বলেছেন যে দুষ্কৃতকারীর নাম রিচার্ডসন, তার মাথায় সেলাই দেবার পর সে সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ। আমার সঙ্গে যথাশীঘ্র দেখা করতে চায়।

রাত্রে হানির মা আমাদের দুজনের জন্য মস্ত পার্টি দিলেন। আমি হানস হারির খুব প্রশংসা করে বললাম যে সে আমার সঙ্গে প্রাণপণ সহযোগিতা না করলে আমি আজ ভেতার হর্ন চড়ার গর্ব করতে পারতাম না। ওদিকে হানস হারি বিনয় করে উল্টো গাইল। বলল যে আমার জন্য পথে রাজার হালে ছিল এবং খাবারের স্তূপ উপহার পেয়েছিল। কষ্ট পাওয়া তো দূরের কথা, সে আমাকে সঙ্গী পেয়ে খুবই আনন্দিত। আমার মনে পড়ল বরফের ব্রিজ পার হবার বিড়ম্বনা।

আমার আংশিক স্নো ব্লাইন্ডনেস হয়েছে। চোখের ওপর কাঁচা দুধ ঢেলে দেওয়ার ফলে অনেক আরাম বোধ করছিলাম। মাঝে মাঝে চায়ের জল ঠান্ডা বা অল্প গরম, চোখে দিতে হল।

পরদিন রবার্টের গাড়ি চড়ে ইন্টারলোকেন হাসপাতালে গেলাম। তার আগে গ্র্যান্ড হোটেল থেকে মিঃ ম্যাকেঞ্জির সঙ্গে দেখা করে তাঁকেও সঙ্গে নিলাম। ম্যাকেঞ্জি আসল কথাটা আমাকে জানালেন। আততায়ীর নাম রিচার্ডসন, সেদিন সন্ধ্যায় পানে বেশ মাত্রাধিক্য হয়েছিল। এমন সময় কালা আদমিকে ধলা মেয়ের হাত ধরে নাচতে দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষে সে বিশ বছর কাটিয়েছে কিন্তু কখনও এমন ব্যাপার কোথাও দেখেনি। তাই ঠিক করল হানিকে অপমান করবেই, শেম অন ইউ বলবেই।

তারপর বাকি সব আমার অজানা নেই। বরং যা জানি না সেটা হচ্ছে এই রিচার্ডসন সত্যিই অনুতপ্ত এবং আমার কাছে মাপ চাইবে।

বেশ মজার ব্যাপার। আমি ভাবছিলাম বলব, আমি দুঃখিত আর ওদিকে রিচার্ডসন আশা করে আছে যে সে ক্ষমা চাইবে এবং আমি ক্ষমা করব। রিচার্ডসনের এইরকম মনোভাবের কারণ হচ্ছে যে সব সুইশরাই এইরকম ব্যবহারের নিন্দা করেছে, বিশেষত মিঃ ম্যাকেঞ্জিও তাতে যোগ দিয়েছেন।

সদলবলে হাসপাতালে গেলাম। আমার কফি রং দেখে রিচার্ডসন চিনতে পেরেছিল কিন্তু আমি মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হাসপাতালের জামাকাপড় পরা লোকটিকে চিনতে পারিনি। সে প্রথমেই বলল, সেদিন আমার মাথায় গণ্ডগোল হয়েছিল। যাক আমার খুব শিক্ষা হয়েছে। আমি ক্ষমা চাইছি। অন্যপক্ষে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যখন শুনলাম যে আমার বিরুদ্ধে পুলিশের কোনও অভিযোগ নেই। বরং রিচার্ডসনের নামে চার্জ এসেছে যে সে সবার সামনে এক সুইশ ভদ্রমহিলাকে অকারণে অপমানিত করেছে।

অল্পক্ষণের মধ্যে পুলিশের কর্তা এলেন। তাঁর সামনে আমার কাছে রিচার্ডসন মাপ চাইল। আমি বললাম মিস হানি ইমারের কোনও ইচ্ছা নেই রিচার্ডসনের বিরুদ্ধে কেস করার। তিনি ক্ষমা করেছেন। তারপর দুই পার্টির করমর্দন ও মিটমাট পর্ব।

এই ঘটনাটা আমরা কয়েকজন কখনও ভুলব না। আঠারো বছর পরে আমি সপুত্র পরিবার আবার মাইরিনগেনে গিয়েছিলাম। দু-চার কথা বলার পরেই চার্লস বলল, বিমল, মনে আছে ইন্টারলাকেন কুরশালে মারামারির কথা? হানি বার্ন শহরের ডাক্তার লুইথিকে বিয়ে করেছে। সেও প্রথমেই বলল সুইশ জাতীয় উৎসবে সে রাত্রের কথা মনে আছে?

মারামারির মধ্যে সূত্রপাত হলেও তার মধ্যে একটা ভালো জিনিসের ইঙ্গিত নিহিত ছিল। পর্বতারোহণে যেতেই হবে, অল্প সময়ের নোটিশে এটা সম্ভব হত না। মানুষ খুনের চার্জে পড়ে মাউন্টেনিয়ার তৈরি হলাম। আমি বোধহয় প্রথম ভারতীয় বিদেশে কিংবা স্বদেশে পর্বতচূড়ায় আরোহণ করলাম। মনে মনে সংকল্প করলাম যে দেশে ফিরে আরও অনেক অনুশীলন করব যাতে মাউন্ট এভারেস্ট চড়বার উপযুক্ত হই।

পর্বতশৃঙ্গে চড়লে মনটা একটা আনন্দময় অনুভূতিতে ভরে যায়। সে অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ধরে থাকতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু যেমন সব ভালো জিনিস মাত্রার চাইতে বেশি নেওয়ার চেষ্টা উচিত নয়, এখানেও তাই। ভালো লাগছে বলে একটু বেশিক্ষণ বসে থাকলে কনকনে হাওয়া এবং শীতে জমে যেতে হবে।

যা হোক অভিজ্ঞতা হল এবং পরে এভারেস্ট চড়তে যাব, এ হল কল্পনার প্রথম ধাপ। সেটা ছিল ১৯২৯ সাল।

ইমার পরিবারের কাছে বিদায় নিলাম।

আমি বার্নার ওভারল্যান্ডে বরফ ঢাকা পাহাড়ের চূড়াগুলো দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আইগার, ময়েনখ, ইউংফ্ৰাউ পিছন দিক থেকে দেখেছিলাম। এবার মতলব করলাম সামনের দিক থেকে উপত্যকার ওপারে দাঁড়িয়ে দেখব। উপত্যকা অপরিসর বলে মনে হয় হাত বাড়ালে চূড়াগুলির বরফে হাত দিতে পারব।

পাহাড়ের গায়ে চেন টানা ট্রেন চড়ে ম্যুরেন পৌঁছলাম। ৭,০০০ ফুট উঁচু। মিসেস ইমারের এক বোন সেখানে একটা হোটেলের মালিক। তাঁর নাম আন্ট বেচলি। বয়স অনেক হয়েছে। মাথার চুল সব সাদা। তিনি অবিবাহিতা, হোটেলের নাম শলে আপ্লেনরুহে। একেবারে পাহাড়ের ধারে বলে মনে হয় যেন হোটেলটা গলার হারের মতো ঝুলছে। ম্যুরেন বিখ্যাত শীতের বরফে স্কেটিং করবার জন্য। স্কিয়িংয়ের একটা মস্ত ঘাঁটি। আপ্লেনরুহের সব ঘরের জানলার বাইরে চাইলে মনে হয় এক অবাস্তব জগতের অপরূপ ছবি সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য।

হিমালয়ের তুষারাবৃত সব শৃঙ্গ দেখা যায় ৩০০ মাইল দূর থেকে। এখানে এক মাইল মাত্র দূরে। ভীষণ বড় বড় দেখায়। হিমালয়ের তুষারশৃঙ্গরাশি দেখলে যেমন দূরত্ব বোধ হয় এখানে তার বিপরীত। দুটো দৃশ্যের সৌন্দর্য দুরকম।

আন্ট বেচর্লির সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেল। তিনি একজন মস্ত বড় স্পোর্টস উওম্যান। বরফের ওপর দিয়ে স্কি করে যখন আন্ট চলে যান, তাঁর দীর্ঘ ঋজু দেহ সহজ আয়াসে ভেসে বেড়ায়। বার্ধক্যের কোনও চিহ্ন দেখা যায় না, যদি মাথায় টুপি পরা থাকে।

ম্যুরেন থেকে আরও উঁচুতে ওঠবার জন্য রোপওয়ে আছে। মেয়েরা একজোড়া স্কি হাতে নিয়ে ওপরে উঠে যায়। তারপর বরফের ওপর স্কি পেতে তাড়াতাড়ি নিচে চলে যায়।

ম্যুরেন থেকে নেমে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন শহরে গেলাম। পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত। নিচে নদী বয়ে যাচ্ছে। সুন্দর শহরের দৃশ্য। রাজধানীতে দেশের প্রেসিডেন্ট থাকেন। সুইজারল্যান্ড দেশ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। একজন প্রেসিডেন্ট ও একজন প্রধানমন্ত্রী আছে। কিন্তু কোনও লোক তার ধার ধারে না। এমনকী কী নাম তাও কারও খেয়াল নেই।

বার্ন শহর ছেড়ে জুরিখ শহরের দিকে রওনা হলাম। উঁচু নিচু রাস্তা কিন্তু রাস্তার অবস্থা খুব ভালো।

লন্ডনে যখন আমি ব্যাঙ্কিং পড়তাম তখন আমার সঙ্গে একটি সুইশ ছেলে (নাম এরনেস্ট ইরনিগার) পড়ত। সে ও তার স্ত্রী এলিসের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। তাদের নিমন্ত্রণে জুরিখ বেড়াতে যাচ্ছি।

এরনেস্টকে টেলিফোনে আমার আসার খবরটা দিয়েছিলাম। দুজনে দেখা হল এবং এরনেস্ট আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। এরনেস্টের মা ও বাবা ছেলের ভারতীয় বন্ধুকে নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। আমাকে দুজন সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। আমার বুঝতে দেরি হল না যে ইরনিগাররা ভীষণ বড়লোক। এরনেস্টের বাবা ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব সুইজারল্যান্ডের কর্ণধার।

আমাকে বড় এবং ভালো গেস্টরুম দিলেন। আমার ঘর থেকে জুরিখ লেক খুব কাছেই। দৃশ্যও তেমনই মনোরম। চারদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা, নিচে কাচের মতো পরিষ্কার হ্রদের জল। কিনারে ছেলেমেয়েরা স্নান করতে বা সান বেদিং করতে ব্যস্ত।

এক সপ্তাহ আমি এরনেস্টের আতিথ্যে বন্দী। ক্লিম বলে একটা ছোট পাহাড়ের ওপর এরনেস্টের একটা কটেজ ছিল। নিয়ে গেল সেখানে। তারপর সুইজারল্যান্ড তোলপাড় করে ঘুরলাম এরনেস্ট ও এলিসের সঙ্গে। লুসার্ন শহরটা খুব সুন্দর লাগল। লেক লুসার্ন আরও সুন্দর।

জুরিখে ফিরলাম।

এরনেস্টদের কাছে বিদায় নিয়ে বাল-এর পথ ধরলাম। এই বাল বা বাসল শহরে ভারতীয় মিনিয়েচারের প্রদর্শনী দেখলাম। সহজেই বোঝা যায় কী বিচক্ষণ দৃষ্টি দিয়ে ভালো ভালো মিনিয়েচারগুলি সংগৃহীত হয়েছে। সংগ্রহকারী এলিশ বোনার। প্রদর্শনী দেখে খুব ভালো লাগল।

বাল শহর ছেড়েই রাইন নদীর ওপারে আমি ব্ল্যাক ফরেস্ট দেখতে গেলাম। এরকম সুন্দর অরণ্য পৃথিবীতে কমই আছে।

আমি গতি ফিরিয়ে দক্ষিণ মুখে নয়সাতেল হয়ে জেনেভার দিকে চলতে আরম্ভ করলাম।

জেনেভাতে একরাত কাটিয়ে পরদিন সুইজারল্যান্ড ছেড়ে ফরাসি দেশে রোন নদীর উপত্যকা ধরলাম। রোন নদী পাহাড়ি পথে নেমে গিয়েছে সমুদ্রের দিকে। সেই জল থেকে বারবার বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার ব্যবস্থা হয়েছে। ফলে সস্তায় সর্বত্র বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। ছোট বড় গ্রামে অপর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক শক্তি দিয়ে নানারকম কারখানা চালায়।

লোকেরা অবস্থাপন্ন এবং আমার প্রতি খুব ভালো ব্যবহার করত।

ঢালু পাহাড় ধরে চারদিন পর লিঁয় শহরে পৌঁছলাম। লিঁয় শহর তাঁতশিল্পের মস্ত ঘাঁটি। যাকে বলে ফ্রান্সের ম্যানচেস্টার। আমি একটা সুতোর কারখানা দেখতে গেলাম। তিন হাজার লোক কাজ করে। ছেলে ও মেয়ে কর্মীরা কারখানা চালায়। একজন মেয়ে গাইড আমাকে নিয়ে তাঁতের সাহায্যে তারা কেমন ভাবে সূক্ষ্ম কাজ করে দেখাল।

লিঁয় শহরে চার্লস ইমারের এক মাসি, মিসেস মাসারের বাড়িতে আমার যাবার নেমন্তন্ন ছিল। সেখানে উঠলাম। এই ভদ্রমহিলাকে আগে আমি আন্ট বেটা বলে ডেকেছি যখন তিনি মাইরিনগেন, সুইজারল্যান্ডে তাঁর দিদির বাড়িতে আমার থাকার সময়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তিনি ও তাঁর দুই ছেলে আমাকে পেয়ে খুব খুশি। দুদিন এই পরিবারে কাটিয়ে দক্ষিণে মার্সেলসের পথে রওনা হলাম।

শীতের প্রচণ্ডতা অনেক কমে গিয়েছে। মার্সেলস বিরাট বন্দর ও বড় শহর। প্রথম দিনেই দেখা হল হারীন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। লন্ডনে এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। খুব বুদ্ধিমান ও আমুদে লোক। আমাকে দেখে আনন্দ প্রকাশ করবার পরমুহূর্তেই বলল যে তার স্ত্রী কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। হারীনের চোখে জল। আমাকে টানতে টানতে একটা বারে নিয়ে গেল। দুজনে অনেক বিয়ার খেলাম। হারীন বিয়ার দিয়ে নিজের দুঃখ ঢাকবার চেষ্টা করছিল। কী আর করি, একটু সহানুভূতি দেখালাম।

আমাকে আশ্চর্য আধুনিক স্থাপত্য দেখাবার জন্য করবুসিয়েরের তৈরি দি মার্কেট দেখাতে নিয়ে গেল। একটা প্রকাণ্ড বাড়ি। সব জিনিস পাওয়া যায় তার মধ্যে— সিনেমা, ডাক্তারখানা, হোটেল, বাজার ইত্যাদি। এই স্থাপত্যবিদ পরে চণ্ডিগড় শহর তৈরিতে সহায়তা করার ফলে আমাদের দেশেও তিনি কীর্তি অর্জন করেছেন।

ইউরোপের মধ্যে ফরাসি খাবার আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। বুইয়াবেশ নামে একটি অতি মুখরোচক খাবার খেলাম। এই ডিশ তৈরি হয় নানা রকম চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক ইত্যাদি মিলিয়ে। জাফরান ব্যবহার করা হয় বলে আমার মতো ভারতীয়দের খুব ভালো লাগে। ফরাসিরাও বুইয়াবেশ খুব আগ্রহের সঙ্গে খায়।

এখানে অনেক উত্তর আফ্রিকার অধিবাসী যেমন মরোক্কান, আলজিরিয়ান ও টিউনিসিয়ান লোক সর্বত্র দেখলাম। ভূমধ্যসাগরের ওপারে উত্তর আফ্রিকা এপারে ফ্রান্স।

হঠাৎ আমার বন্ধু রঞ্জিত সেনের সঙ্গে আবার দেখা হল ওখানে। টুলু মার্সেলস থেকে জাহাজ নিয়ে বার্সিলোনা বেড়াতে যাচ্ছে। আমাকে খুব লোভ দেখাল স্পেনে যাবার জন্য। শেষ পর্যন্ত জাহাজে উঠলাম বিকালে। পরদিন সকালে বার্সিলোনা বন্দরে পৌঁছলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *