দুচাকায় দুনিয়া – ১৬

১৬

পরদিন সকালে জার্মানিতে ল্যুবেক বন্দরে পৌঁছলাম। এখান থেকে হামবুর্গ আমার পরিচিত পথ। হামবুর্গে খবর পেলাম যে ইউ এস লাইনারে একদল লোক স্ট্রাইক করেছে। তাদের সবচেয়ে বড় জাহাজ ম্যানহ্যাটান ফ্রান্সের ল্য হ্যাভর বন্দর রওনা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমি বিলম্ব না করে ব্রেমেন শহর দিয়ে হল্যান্ড অভিমুখে যাত্রা করলাম। তিনদিন পর ফ্রান্সের ল্য হ্যাভর বন্দরে পৌঁছে প্রথমে ইউ এস লাইনার অফিসে গিয়ে একটা কাজ জোগাড় করলাম পার্সারের। আমি ব্যাঙ্কে কাজ করেছি সার্টিফিকেট দেখাতেই চাকরি পেলাম ম্যানহাটন জাহাজে। জাহাজে প্রায় দুহাজার যাত্রী উঠেছে। খ্রিস্টমাসের আগে নিউইয়র্ক পৌঁছবার আশায়।

কয়েকশো ছাত্রও কাজ নিয়েছিল ওই জাহাজে। তারা সব কলেজের ছাত্র। অনেকে স্টুয়ার্ড হল, অনেকে ইঞ্জিন রুমে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইত্যাদি।

আমার কাজটা মোটেই শক্ত নয়। প্যাসেঞ্জারদের মূল্যবান সব জিনিস পার্সারের কাছে জমা দেয়। যাত্রা শেষে আবার ফেরত পায়। আমার আরেকটা কাজ হল গেম মাস্টার। এটাও আমার মনের মতো কাজ। যাত্রীদের নানারকম খেলাতে আকৃষ্ট করা এবং প্রতিযোগিতা শুরু করা। টেবিল টেনিস, সাফল বোর্ড, টেনিকয়েট ইত্যাদি খেলা সবার প্রিয়। গরমের দিনে সাঁতার ও সান বেদিংয়ের ভালো ব্যবস্থা আছে। রাত্রে সিনেমা দেখাতে অপারেটরের দায়িত্ব নিতাম।

প্রথম দুদিন সেই রাজপ্রাসাদের মতো জাহাজে সবাই হাসিখুশি। নাচ গান ভোজন ও মদ্যপান পুরোদমে চলেছে। তারপর হঠাৎ বড় বড় ঢেউ আছাড় খেয়ে ম্যানহ্যাটানের গায়ে পড়তে লাগল। জাহাজ কেঁপে কেঁপে উঠে কাত হচ্ছিল। ক্রমে ক্রমে আটলান্টিক মহাসাগর উত্তাল হয়ে সব তোলপাড় করা শুরু করল। জাহাজের দরজা জানলায় সব শক্ত দড়ি বাঁধা হল যাতে কোনও যাত্রী ছিটকে সমুদ্রে না পড়ে। জাহাজের অবস্থা বেশ সঙ্কটজনক। সারাদিনের পর একদিন মধ্যরাত্রে প্রায় আমরা যখন মহাসমুদ্রের মাঝামাঝি পৌঁছেছি, তখন জাহাজ থেকে বিপদ সিগন্যাল দিতে লাগল। জাহাজ কখনও বিরাট ঢেউয়ের মাথায় উঁচুতে উঠছে আবার পর মুহূর্তে কাত হয়ে জলের গভীরে আছাড় খেয়ে পড়ছে।

যাত্রীদের বেশিরভাগ ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে বা বমি করছে। খাবার ঘরে ডিনার খাবার সময় মাত্র কয়েকজন যাত্রী খেতে যেত। আইসল্যান্ড ট্রলারে কাজ করে আমি উত্তাল সমুদ্রে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সী-সিকনেস আমাকে কাবু করতে পারত না। খুব খারাপ অবস্থায় অনেক নাবিকও অসুস্থ হয়ে পড়ে।

জাহাজ থেকে অনবরত জলে তেল ঢালা চলছে সমুদ্রকে শান্ত করবার চেষ্টায়। বেশি দূর দেখা যায় না এমন কুয়াশা আমাদের ঘিরে ধরেছে। উৎকণ্ঠার সঙ্গে রাতদুপুরে ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা দেখছিলাম। হঠাৎ নজরে পড়ল আরও দুখানা বড় জাহাজ অনতিদূরে অসহায়ভাবে ঘুরছে। তার একটার নাম বেরেঙ্গারিয়া অন্যটির নাম ইল দ্য ফ্রান্স। সবারই এক অবস্থা। ইঞ্জিন বন্ধ করে ভাসছে, ঘণ্টা বাজিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছে অন্য জাহাজকে, পাছে ধাক্কা লাগে।

দুদিন আগে ম্যানহ্যাটন জাহাজ বীরদর্পে সমুদ্রের বুক চিরে পতাকা উড়িয়ে চলছিল, এখন তার কী দুর্দশা! পর্বতপ্রমাণ ঢেউ তাকে আছড়ে প্রায় উল্টে অস্থির করে তুলেছে। রাত কাটে কিনা সন্দেহ। তিনখানা জাহাজের একই অবস্থা।

এর মধ্যে সঙ্কেত হল যাত্রীদের লাইফ বেল্ট পরিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। ডিসেম্বর মাসের শীতে মাত্র কয়েকজন লোক ভেতরের ডেকে উপস্থিত হল। সকলের মুখে আতঙ্কের চিহ্ন। রাত তখন দুটো। যাত্রীদের ধরে ধরে লাইফ বেল্ট পরিয়ে দিলাম এবং লাইফ বোটে কেমন করে উঠতে হবে বুঝিয়ে দিলাম। রাত এমনভাবে শঙ্কার মধ্যে কাটল।

দিনের আলোয় ক্লান্ত যাত্রীদের কফি খেতে দেওয়া হল। বিপদ কেটে গেছে বুঝতে পেরে তিনখানা জাহাজ আবার যাত্রা শুরু করল। বেরেঙ্গারিয়া ভাসতে ভাসতে একেবারে পাশে চলে এসেছিল।

ডাইনিং হলে যে নামমাত্র কটি লোক খেতে যেত আমি তাদের একজন। বেশ ভালো করেই খেতাম। সময় মতো ডেকের ওপর ছোটাছুটিও করতাম। যারা অসুস্থ তারা আমার উৎসাহপূর্ণ কর্মোদ্যম দেখে হিংসা করত। আমাকে উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করত ইয়ং ম্যান, হাউ ডু ইউ ডু ইট, আমি বলতাম খুব সোজা, পেট ভরে খাও আর খেলাধুলা কর। কিন্তু বেচারিরা খেতেও পারত না, নড়াচড়া করা তো দূরের কথা।

ষষ্ঠদিনে নোটিস দেখলাম, সে রাত্রেই বা রাত্রি শেষে নিউইয়র্ক পৌঁছবার কথা। যারা স্কাইলাইন দেখতে চায় তাদের জন্য কফি স্যান্ডউইচের ব্যবস্থা থাকবে। অন্যদের কথায় বুঝলাম স্কাইলাইন মানে সমুদ্র থেকে নিউইয়র্ক শহরের সামনের দৃশ্য। রাত্রে সেটা খুবই মনোরম হয়। সমুদ্রের ধারের বাড়িগুলিতে সারারাত আলো জ্বলে দেওয়ালির মতো। সত্যি সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আকাশচুম্বী বাড়িগুলির ঘরে ঘরে আলো দূর থেকে তারার মতো দেখায়।

নিউইয়র্ক বন্দরের দিকে এগোচ্ছি। হঠাৎ আলো অন্ধকারের মধ্যে এক বিরাট মূর্তি সমুদ্র থেকে উঠেছে মনে হল। নিচে একটা ছোট্ট দ্বীপ, যার ওপরে সুবিশাল লিবার্টি মূর্তি দাঁড়িয়ে।

জাহাজসুদ্ধ লোক স্কাইলাইন দেখবার জন্য একদিকে ঝুঁকেছে। তখন ভোর রাত, চারদিকে অন্ধকার। তার মধ্যে আমাদের বিপুলায়তন ম্যানহাটান জাহাজ (৫০,০০০ টন) হেলে দুলে চলেছে আস্তে আস্তে।

হঠাৎ কানে এল কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে সেই ছোট্ট দ্বীপ থেকে। ক্ষীণ বামাকণ্ঠ। আমি সবাইকে ঠেলে ঠুলে জায়গা করে নিতে দেখলাম একটা পরিচিত মুখ হেলেন প্রাইগের। একে আমি সাহায্য করেছিলাম লন্ডনে থাকবার সময়, বাড়ি অর্থাৎ আমেরিকায় ফিরতে, সে কথা তো আগেই লিখেছি। গরম কাপড়চোপড় মুড়ি দিয়ে অপেক্ষা করছিল আমাকে স্বাগত জানাবার জন্য। জাহাজের ডেক থেকে জলের ধার অনেক অনেক নিচে। মানুষকে ছোট পিঁপড়ের মতো দেখায়।

ফ্রান্সে ল্য হ্যাভর বন্দর থেকে হেলেনকে জানিয়েছিলাম যে ম্যানহ্যাটান জাহাজে রওনা হচ্ছি। তাই হেলেন অনেক কষ্ট করে দ্বীপে এসে দাঁড়িয়ে ছিল আমাকে সেখান থেকে ডেকে চমকে দেবার জন্য। সে আসতে আমার খুব উপকার হল। হাতে পাঁচশো ডলার না থাকলে যাত্রীকে এলিস দ্বীপে আটক রাখা হয়। হেলেন আমার টাকার জন্য জিম্মাদার হয়ে আমাকে রেহাই পাইয়ে দিল। তার ফ্ল্যাটে থাকবার নেমন্তন্ন অস্বীকার করে আমি ধন্যবাদ জানালাম। আমার গন্তব্য ছিল রিভর সাইড ড্রাইভ ধরে হাডসন নদীর ধারে ইন্টারন্যাশনাল হাউসে।

এটি একটি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিরাট বাড়ি। পাঁচশো ছাত্রছাত্রী এখানে থাকে। একটি নরওয়েজিয়ান ছাত্রী ইন্টারন্যাশনাল হাউসের অফিসে কাজ করে। তার নাম নরমা আরলিকসেন। নরমা আমার সঙ্গে এক জাহাজে এসেছিল। আমার সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছিল। নরমাকে খুঁজে বের করে বললাম যে আমার ঘর চাই। ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত নরমার কাছে শুনে আগ্রহ দেখালেন এবং একদিন লেকচার দেবার কথা বললেন।

আঠারো তলায় বাড়ির সামনের দিকে একটা ভালো ঘর পেলাম। জানলাটা খুলতেই এক বিরাট ট্রাফিকের শব্দ শুনতে পেলাম। একটু পরেই রাস্তার ওপারে মিলিয়ন ডলার চার্চে ঘণ্টা বেজে উঠল।

ডানদিকে হাডসন নদীর খুব চওড়া নীল জলরাশি বয়ে চলেছে। অদূরে হাডসন ব্রিজ। ওপারে নিউজার্সির রেলওয়ে ইয়ার্ড অস্পষ্ট দেখা যায়।

হাডসন নদীর নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে ওপারে যাতায়াত করে অসংখ্য গাড়ি। ছেলেবেলায় পড়েছিলাম ওপরে জাহাজ চলে নিচে চলে নর— সেটা আজ চাক্ষুস দেখলাম।

ইন্টারন্যাশনাল হাউসে আসবার সময় পথে সব গাড়ি প্রায় একই গতিতে প্রাণপণ ছুটছে। রিকশা নেই, ঠেলাগাড়ি নেই, গরুর গাড়ি নেই। সেজন্য মোটর বা বাস জোরে যেতে পারে। একজন লোককেও সাইকেল চালাতে দেখিনি। বরং আমাকে দেখতে রাস্তায় ভিড় জমে যেত গাড়ি ও মানুষের। তাদের মুখ দেখলে মনে হয় ওরা পরস্পরকে জিজ্ঞেস করে জানতে চায়, এমন আজগুবি জীব, কোথা থেকে এল। আজকালকার দিনে কে পিঠে এবং সাইকেলে বোঝা চাপিয়ে চলে?

আরেকটা জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, সারবন্দী উঁচু বাড়ি। তাদের মধ্যে সেরা যেটি, সেটি ১২০ তলা উঁচু। নাম এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। যেদিন শহর দেখতে বেরলাম সেদিন এই বাড়ির ছাদের ওপর থেকে চারদিকের দৃশ্য দেখলাম অবাক হয়ে। নিচে রাস্তায় গাড়িগুলি পিঁপড়ের মতো ছোট দেখা যাচ্ছে। এইরকম উঁচু ১,০০০ ফুটের ওপর, সেজন্য এখানে অপেক্ষকৃত ঠান্ডা। এই রকম উঁচু বাড়ির ছাদের ওপরে খুব সুন্দর কাচ দিয়ে ঘেরা ফ্ল্যাট আছে। খুব বড়লোকেরা থাকে। পেন্ট হাউস বলা হয়। মেঘের মধ্যে বাস করার মতো।

অসংখ্য লিফট আছে এইসব উঁচু বাড়িতে। এক্সপ্রেস লিফটে চড়লে তারা দশ, বিশ, ত্রিশ তলায় থামে এবং ভীষণ জোরে যায়।

রকেফেলার সেন্টার সবে তৈরি হয়েছে। দুটো বাড়ি জুড়ে এই সংস্থা। এত বড় যে বাড়ির মধ্যে প্রকাণ্ড থিয়েটার, একটা সিনেমা, যাবতীয় দোকান, পোস্ট অফিস, থাকার ফ্ল্যাট ও অফিস ঘর ইত্যাদি রয়েছে। এই সেন্টারে দিনে এক লক্ষ লোক বাস করতে পারে। উঁচু বাড়িগুলিকে স্কাইস্ক্রেপার বলা হয়। বন্দরের কাছের জায়গাটায় অফিসপাড়াকে ব্যাটারি বা ডাউন টাউন বলে।

নিউইয়র্ক শহর অল্প জায়গার মধ্যে গড়ে উঠেছে। যখন বাড়তে লাগল তখন উঁচু বাড়ি ছাড়া আর গতি ছিল না। আমেরিকানদের কাছে স্কাইস্ক্রেপার এক গর্বের জিনিস।

আমেরিকান সভ্যতা মাত্র দুশো বছরের একটু বেশি দিনের।

আমেরিকা এক আশ্চর্য দেশ, যেমন বিরাট তেমনই খনিজ ধন-সম্পদে ভরপুর। চাষবাষের পক্ষেও খুবই ভালো। কর্মঠ ইউরোপিয়ানরা মাঠে, খনিতে, কলকারখানায় অদ্ভুত অগ্রগতি ঘটাল। অল্পদিনের মধ্যে আমেরিকা শ্রেষ্ঠ ধনী দেশ বলে স্বীকৃত হল সারা পৃথিবীতে। এখন তার রাজনৈতিক ক্ষমতাও সবার চেয়ে বেশি।

আমেরিকানদের সভ্যতা পুরনো নয় বলে বোধ হয় এদের খুব মনখোলা ব্যবহার, সবাই পরিশ্রম করে চটপট নিজের উন্নতির পথ দেখে।

এখন শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চায় আমেরিকা ভীষণ উন্নতি করেছে। পৃথিবীর সব দেশ থেকে স্ত্রী-পুরুষ যায় আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে পড়তে। আমেরিকায় চাকরি করতে যাওয়া মানে অল্পদিনে বড়লোক হওয়া।

খ্রিস্টমাসের আর সাতদিন বাকি। চারদিকে খুব আলোকসজ্জা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল হাউসে একদিন সন্ধ্যায় ছাত্রছাত্রীদের কাছে আমার ভ্রমণকাহিনী বললাম। তখন পাঁচশো তরুণ-তরুণীর কাছে আমার খুব কদর বেড়ে গেল। আবার একদিন বলবার আমন্ত্রণ পেলাম। ভারতের স্বাধীনতা সম্বন্ধে যে আন্দোলন চলেছে সে বিষয় অনেকে জানতে চাইত আমরা কীরকমভাবে স্বাধীনতা অর্জন করব। আমেরিকানদের মতো ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, না শান্তিপূর্ণ উপায়ে। তখন গান্ধীজির ডাকে দেশ সাড়া দিয়েছে তাই মনে হত এঁর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন হব তবে কেমন করে তা জানতাম না। সবার খুব উৎসাহ দেখেছি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন সম্বন্ধে জানবার, বেশিরভাগ শ্রোতাদের বিশ্বাস এই রকম আন্দোলন একটা ইউটোপিয়া বা কল্পনার জগতের জিনিস।

একদিন রেডিও সিটিতে একটা কিউবান নাচ দেখতে গেলাম। ফেরবার সময় দেখলাম নোটিস রয়েছে এক জায়গায় যে উদয়শঙ্করের নাচের দল শীঘ্রই নিউইয়র্কে আসছে। ব্যবস্থাপক ছিলেন শ্যাম হুরক।

আমি হুরকের সঙ্গে পরদিন দেখা করে বললাম যে আমার কাছে উদয়শঙ্করের নাচের দুই হাজার ছবি বা নেগেটিভ আছে যা তার বিজ্ঞাপনে সাহায্য করবে। ছবি দেখে হুরকের খুব আনন্দ হল। তিনি চারশো ডলার দিয়ে কুড়ি খানা নেগেটিভ খরিদ করলেন। আমার হাতে কিছু টাকা এল।

দুদিন পরে রকেফেলার সেন্টারে এক বিজ্ঞাপন দেখলাম। উদয়শঙ্করের বড় বড় ছবি তৈরি করে তাদের যন্ত্রচালিত করেছে। খুবই আকর্ষণীয় হয়েছিল। আমি হুরকে অফিসে গিয়ে তাদের কাজের তারিফ জানালাম। হুরক জানালেন যে তিনি আমাকে কাজে লাগাতে পারেন। তাতে আমারও সুবিধা ও সাহায্য হবে।

দেখতে দেখতে খ্রিস্টমাস এসে গেল। ইন্টারন্যাশনাল হাউসে পাঁচশো ছাত্রছাত্রীদের এক বিরাট ভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল। ম্যানেজার খ্রিস্টমাসের তাৎপর্য বুঝিয়ে একটা খুব সুন্দর বক্তৃতা দিলেন।

ম্যানেজার আমাকে অনুরোধ করলেন যে হাউসে আমার একশো ছবির প্রদর্শনী করতে। একটি আমেরিকান যুবক ব্যাঙ্কস ও তার বান্ধবী সিন্থিয়া এগিয়ে এল আমাকে সাহায্য করতে। আমি হেলেনকেও ডাকলাম। এরা তিনজন সব ছবির ঠিকমতো ক্যাটালগ তৈরি করল এবং আলোর ব্যবস্থা হল।

প্রদর্শনী চলল এক সপ্তাহ ধরে। বহুলোক দেখল এবং খুব প্রশংসা পেলাম ক্যামেরা আর্টিস্ট নামে।

হেলেনের মা আমাকে ডিনারে নেমন্তন্ন করেছিলেন। সেদিন হেলেনের ছোট বোনের সঙ্গে আলাপ হল। তার খুব ইচ্ছা আমার সঙ্গে ভাব করবার। ছবির প্রদর্শনী দেখে তার খুব ভালো লেগেছে।।

হেলেনের মা বয়োবৃদ্ধা খুব শান্ত প্রকৃতির। ডিনার টেবিলে সমাগত নিমন্ত্রিতদের কাছে তিনি আমার পরিচয় দিয়ে বললেন যে পৃথিবীতে এমন লোকও আছে, আমার মেয়ে হেলেনের বিপদের দিনে যে বিনা শর্তে টাকা দিয়ে হেলেনকে বাড়ি ফিরে আসতে সাহায্য করেছিল। আজ আমার অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার দিন। আমি বিমলের মায়ের বয়সী। সর্বান্তকরণে তার শুভকামনা করি। পৃথিবী ভ্ৰমণ সম্পূর্ণ করে সে যেন জীবনে সার্থকতা লাভ করতে পারে। আমি তার দীর্ঘজীবন কামনা করি।

সামান্য দুচার কথায় আমিও ধন্যবাদ জানালাম।

হুরকের সঙ্গে দেখা করে একটা ভালো কাজ জোগাড় করলাম। সর্বসমেত কুড়িটা কলেজে আমার ল্যান্টার্ন স্লাইড দিয়ে ছবি দেখাব এবং লেকচার দেব। আমার অফুরন্ত ছবি থেকে ফিল্ম স্লাইড করেছিলাম তাদের মধ্যে বিষয়বস্তু বেছে নিয়ে চল্লিশটা ল্যান্টার্ন লেকচারের ব্যবস্থা হয়েছিল। এর জন্য প্রত্যেক কলেজ থেকে পাঁচশো ডলার পাব। যেদিন পৌঁছব তার দুদিন আগে খবর দিতে হবে।

সব কলেজে খবর দিয়ে টাকাকড়ির ব্যবস্থা সব ঠিক করবার জন্য হুরক এক সপ্তাহ সময় চাইল।

ইতিমধ্যে উদয়শঙ্করের দল নিউইয়র্ক পৌঁছল, নাচের প্রোগ্রামও শুরু হল। দলের সবাই আমাকে এত চাইত এবং ভালোবাসত যে মনে হত আমি যেন দলের একজন। সবাই দামি দামি ক্যামেরা কিনেছিল। তারা ছবি তোলার তালিম নিত আমার কাছে। নিউইয়র্কে উদয়শঙ্করের খুব নাম হল, এমন নাচ এখানে কেউ দেখেনি

কিছুদিন পর আমি নিউইয়র্ক ছেড়ে বোস্টন শহরে গেলাম। সেখানে উঠলাম মিউজিয়ামের কিউরেটর, আনন্দ কুমারস্বামীর বাড়িতে। এঁর মতো প্রগাঢ় পণ্ডিত ও জ্ঞানী লোক আমি কম দেখেছি। ভারতীয় শিল্পকলা ও সংস্কৃতি তাঁর নখদর্পণে। কুমারস্বামীর পরিচালনাধীন মিউজিয়াম একটি অফুরন্ত জ্ঞান ভাণ্ডার।

বোস্টন ছেড়ে গেলাম বাফেলো শহরে। ফোর্ড কোম্পানির বিরাট কারখানা দেখতে গেলাম। বাফেলো থেকে উত্তর দিকে কাছেই বিশ্ববিশ্রুত নায়গ্রা ফলস দেখে মুগ্ধ হলাম। ফলসের নিচে সুড়ঙ্গপথে ঢুকলাম, অয়েল ক্লথ ঢাকা থাকা সত্ত্বেও ভিজে গেলাম। ছবি তোলার উদ্দেশ্য কিন্তু ব্যৰ্থ হল।

ফলসের ওপর রোপওয়ে। চেয়ারে বসে ওপারে কানাডায় পৌঁছলাম। এই দিকটা বেশি সুন্দর। নায়গ্রা থেকে কানাডার টরোন্টো শহরে গেলাম। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চারদিক। চওড়া রাস্তা ও বড় বড় বাড়ি। টরোন্টোয় দুদিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে পৌঁছলাম। নিউইয়র্কের পরেই বড় শহর হচ্ছে শিকাগো। এখানে স্কাইস্ক্রেপারের ছড়াছড়ি।

রাস্তায় অনেক নিগ্রো স্ত্রী-পুরুষ দেখলাম যারা এদেশেই জন্মেছে এবং বড় হয়েছে। সাধারণত শ্বেতকায় আমেরিকানরা নিগ্রোদের স্নেহের চোখে দেখে না। দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্রে তো নিগ্রোদের রীতিমতো ঘৃণা করে। যত দেশের উত্তর যাওয়া যায় ততই মনে হয় নিগ্রোদের অবস্থা কিছুটা ক্রমোন্নতির দিকে। আইনের চোখে আমেরিকায় নিগ্রোর পূর্ণ নাগরিকত্ব স্বীকৃত।

এখানেও উদয়শঙ্করের দল এল নাচ দেখাতে। দেখা করার সঙ্গেই তাদের কাছে থাকবার নেমন্তন্ন জানাল। দুদিন উদয়ের কাছে থেকে আমি দক্ষিণে পাড়ি দিলাম। দুটো কলেজে ল্যান্টার্ন লেকচার দিতে গিয়েছিলাম। খুব লোকের ভিড় সেখানে।

শিকাগো ছেড়ে কলোম্বাস, ফিলাডেলফিয়া, বল্টিমোর হয়ে অবশেষে ওয়াশিংটন পৌঁছলাম। এখানে অনেক কিছু দ্রষ্টব্য আছে। রুসভেল্ট প্রহিবিশন উঠিয়ে দিয়েছেন, তাই যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে দেশে। চোরাই মদের কারবার বন্ধ। লোকেরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। প্রহিবিশন দেশে কত বড় ক্ষতি করেছে বলা যায় না। অল্পদিনে রুসভেল্ট খুব জনপ্রিয় হয়ে পড়লেন।

চলতে চলতে দক্ষিণে ফ্লোরিডার মায়ামী শহরে পৌঁছলাম। এখানে মনে হয় খুব বড়লোকেরা বাস করে। অফুরন্ত হোটেল রয়েছে। ভালো হোটেলে এক সপ্তাহ থাকার খরচে আমি অর্ধেক পৃথিবী ঘুরতে পারতাম।

এখানে শীতকালেও যথেষ্ট গরম। সমুদ্রসৈকতে হাজার হাজার স্ত্রী-পুরুষ রৌদ্রস্নান করছে, নিউইয়র্কে হয়তো এই সময় বরফ পড়ছে।

মায়ামীর মায়া কাটিয়ে জাহাজ ধরলাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিউবা দ্বীপে যাবার জন্য। জাহাজে একটি তরুণী আমার সঙ্গে কথা বলল। তার নাম লোলিতা। নাম শুনে মনে হল কোথায় যেন দেখেছি। নিউইয়র্কে রেডিও সিটিতে কিউবান নাচ দেখতে গিয়েছিলাম! এই সেই লোলিতা। দলের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। নাচ আমার ভালো লেগেছে শুনে সকলে খুব খুশি।

ডেকের ওপরেই নাচ গান আরম্ভ করে দিল। খুব আমুদে সবাই। আমার মতো ওরা সকলেই হাভানা যাচ্ছে। তারপর কিউবা দ্বীপের নানা জায়গায় ঘুরে বাড়িতে চলে যাবে। আমার অনেক নেমন্তন্ন হল।

হাভানা মস্ত শহর। বড় শহরের আনুষঙ্গিক সব কিছুই আছে, যেমন অপেরা হাউস, বড় বড় হোটেল, গাড়ি, বাড়ি, দোকান। খুব কড়া রোদ। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। রাস্তার ধারে একজন লোক কী একটা পানীয় তৈরি করে বিক্রি করছে। খুব ভিড়, কাছে গিয়ে দেখলাম রামের মধ্যে বরফ গুঁড়িয়ে একটু সিরাপ দিয়ে বেচছে। পানীয়র নাম ডায়কুড়ি। আমি এক গ্লাস কিনলাম। খেতে খুব মুখরোচক, বেশি খেলে নিশ্চয় নেশা হয়।

কিউবার প্রধান রপ্তানি পণ্য হল চিনি। আখের চাষ প্রচুর। গুড় থেকে রাম হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের রাম জগদ্বিখ্যাত। আমাদের দেশের রামের সমকক্ষ।

আরেকটি জিনিসের যথেষ্ট চাষ ও রপ্তানি হয়— টোবাকো। হাভানা সিগার পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

এ দেশে স্প্যানিশ সভ্যতার স্পষ্ট ছাপ সর্বত্র। অনেক লোক নিগ্রো ক্রীতদাসের বংশধর।

কিউবা দেশটা ভারি সুন্দর। গ্রামের পথে সাইকেলে চলেছি। যত দূর দেখা যায় বুগেনভিলিয়া গাছ ও ফুল। বুগেনভিলিয়া নামে এক ফরাসি নাকি এই গাছ তুলে নিয়ে দক্ষিণ ইউরোপে রোপণ করে। অবশেষে ফুলের পরিচয় আজ সেই ফরাসির নামে। পৃথিবীর সর্বত্র এ ফুল এখন ছড়িয়ে পড়েছে।

লোলিতার গ্রাম সামনে। পৌঁছে একটা টেলিফোন করলাম। লোলিতা টেলিফোন ধরেই আমার গলা শুনে বলল তার বাড়িতে যেতে। ইতিমধ্যে পাড়ার ছেলেদের খবর দিয়েছে আমাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। তরুণ-তরুণীরা দলে দলে লোলিতার বাড়ির সামনে হাজির। আমাকে দেখে হই হই করে উঠল। সবাই মিলে গান ধরল গিটারের সঙ্গে। একজন একটা বিস্কুটের টিন এনে নিখুঁতভাবে বাজাতে আরম্ভ করল যেন তবলা বাজাচ্ছে। গানটা স্প্যানিস ভাষায়। ওই ভাষায়ই সবাই কথা বলে। কয়েকজন ভালো ইংরিজিও বলতে পারে।

লোলিতাদের অবস্থা ভালো। রাম তৈরি করে পৃথিবীর নানান জায়গায় চালান দেয়। সে বাবা মার একমাত্র মেয়ে। লোলিতা হুকুম দিল সবাইকে রাম দেওয়া হোক। আমাকেও দিল। তারপর টোস্ট করে আবার গান ধরল। সবার মনে খুব স্ফূর্তি। আমেরিকা সফর করে তারা প্রায় ত্রিশ হাজার ডলার লাভ করেছে।

অনেক লোকের মধ্যে সেখানে আমিই একমাত্র, যে রেডিও সিটি স্টেজে লোলিতা ও তার দলকে কিউবান ড্যান্স করতে দেখেছি। সবাই আমার মুখে শুনতে চায় কিউবান নাচ গান কেমন লাগল। আমি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলাম। তখন সবাই মিলে গান ধরল। ওয়েলকাম টু বিউটিফুল কিউবা

কিউবা দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, আদান-প্রদান দুই দেশের মধ্যে রীতিমতো জোর। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কিউবার নির্ভরতা খুব বেশি। ফলে সে তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। মনে হয় যেন কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের অধীন এক দেশ। কিউবান বিত্তশালী যারা, তারা চায় আমেরিকার সঙ্গে মিশে যেতে। এই রকম স্বার্থান্বেষী লোক পৃথিবীর সব দেশেই দেখা যায়।

তিনদিন পরে লোলিতা, তার মা বাবা ও বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে হাভানার দিকে রওনা হলাম।

হাভানা বন্দরে পৌঁছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিয়ান্স শহরে যাত্রীবাহী একটা জাহাজে উঠলাম। আমার হলিউড দেখার খুবই শখ ছিল। সেজন্য পথ ধরলাম লস অ্যাঞ্জেলেসের। এই পথ খুব কঠিন। মরুভূমি পার হতে ও পাহাড় পেরোতে হবে।

শহরে পৌঁছে একটা রেস্তোরাঁতে খেতে গেলাম। খুব খিদে পেয়েছিল। আমেরিকায় এক ধরনের রেস্তোরাঁ সব শহরেই দেখা যায়। খাবার প্লেট সঙ্গে নিয়ে কাউন্টারে দাঁড়ালে যা খেতে চাই আমার প্লেটে তুলে দেবে। খাওয়া শেষ হলে প্লেটটা যথাস্থানে রাখা এবং দাম দিয়ে যাওয়া। এই ধরনের রেস্তোরাঁতে সস্তায় ভালো খাবার পাওয়া যায়। এর নাম হেলপ ইওরসেলফ সার্ভিস বা কাফেটেরিয়া। সব স্কুল ও কলেজে যেখানে অনেক ছাত্রছাত্রীরা খায় সেখানে সব কাফেটেরিয়ার নিয়মে চলে। আরেক উপায়ে ভালো খাবার পাওয়া যায়। স্লট সিস্টেম বলে। পয়সা ফেলে স্লট টানলেই এক প্লেট পছন্দমতো খাবার বেরিয়ে আসে। কাচের জানলা দিয়ে দেখা যায় নানা রকম খাবারের ব্যবস্থা।

স্লট সিস্টেমে এদেশে অনেক জিনিস পাওয়া যায় যেমন, চকলেট, স্ট্যাম্প, দেশলাই ইত্যাদি। এখানে বেশ গরম, যদিও উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র বরফ পড়ছে।

ইউরোপে থাকতে বিশেষ করে স্ট্রয়েডামে প্রায়ই রাত্রে ডিনারের আগে এক ডিস অয়স্টার খেতে দিত। প্রথম দিকে আমার ভালো লাগত না, কাঁচা ডিম খাওয়ার মতো। ঝিনুক খুলে একটু লেবু দিয়ে অয়স্টার খায়। সেইসঙ্গে মদ বা বিয়ার। পরে খুব ভালো লাগত, চেয়ে খেতাম।

নিউ অরলিয়ান্স শহর মিসিসিপি নদীর মোহনায় অবস্থিত। সামনেই গালফ অব মেস্কিকো। গালফে অনেক অয়স্টার পাওয়া যায়।

নদীর ধারে বেড়াতে গেলাম। এখানে মিসিসিপি ও মিশরি নদীর যুক্ত মোহনা। এত চওড়া যে সমুদ্র মনে হয়।

হুরকের সঙ্গে শর্তানুযায়ী আমি কলেজে ল্যান্টার্ন লেকচার দিলাম। আরও দুটো শহরে লেকচার দিলে আমার শর্ত পূরণ হবে। লস অ্যাঞ্জেলস শহরে পৌঁছলে আমি আমার পারিশ্রমিক পুরো পাব।

নিউ অরলিয়ান্স ছেড়ে হুস্টন শহরে গেলাম। এই দেশে গ্রাম যাকে বলে তা খুঁজে পেলাম না। হয় ছোট শহর, আরও ছোট শহর, নয় বড় শহর, আরও বড় শহর। শহরের সব সুবিধা সর্বত্র। যেখানে মানুষ থাকে সেখানেই সিনেমা, ড্রাগস্টোর, দোকান, ডাক্তার ও নাচঘর আছে।

হুস্টন পৌঁছতে চারদিন লাগল। অনেকটা ঘুরে যেতে হয় বলে লুইসিয়ানো শহরে যাওয়া হল না। হুস্টনে দুদিন বিশ্রাম করে গ্যালভেস্টন শহরে গেলাম। দক্ষিণ আমেরিকার যাবতীয় আমদানি ও রপ্তানি হয় দক্ষিণের এই দুটি বন্দরে, নিউ অরলিয়ান্স ও গ্যালভেস্টন। শেষোক্ত শহরটি কলোরাডো নদীর মোহনায়।

আমেরিকায় এত বড় বড় নদী আছে যে স্টিমারে দূর দূর জায়গায় যাওয়া যায়। গ্যালভেস্টন ছেড়ে পশ্চিম টেকসাসে চলেছি। এটা একটা মস্ত বড় স্টেট। এই স্টেটে অপর্যাপ্ত পেট্রোলের খনি আছে। আমেরিকায় পেট্রোল খুব সস্তা। সবাই বড় বড় গাড়ি চালায়। ক্রমে পথ মরুভূমির ভেতর চলে গেল। নিজেকে তখন খুব একা মনে হয়। চারদিকে বিরাট শূন্যতা। রাস্তা দিগন্তে মিশেছে, ক্যাকটাস গাছ বড় বড় মানুষের মতো এখান সেখানে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে দেখতাম সেই ক্যাকটাসে অপরূপ ফুল ধরেছে।

সান এনটোনিওতে পৌঁছলাম রাতে। ভীষণ গরম। ভারতবর্ষের কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে দুদিন থাকতে হল। তারপর লুজন দিয়ে এগোবার সময় সামনে পাহাড় পেলাম। এল পাশোতে কাটালাম একরাত। সিয়েরাবিয়েঙ্কা পৌঁছতে তিনদিন কাটল।

সামনে নিউ মেক্সিকোর পাহাড়ের পর পাহাড় পার হয়ে এরিজোনা স্টেটের টাকশান শহরে পৌঁছলাম। এরিজোনার বেশিরভাগ মরুভূমির নাম গিলা। এরিজোনার গায়ে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট। সামনে বেশ উঁচু পাহাড়। এক হাজার থেকে তিন হাজার ফুট উঁচু পথে সাইকেল ও বোঝা নিয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল। আনন্দের মধ্যে এই যে লস অ্যাঞ্জেলেস বা হলিউড সন্নিকট। পাহাড়ি পথে বেশ শীত। রাস্তা ঘুরে ঘুরে ওপারে প্যাসিফিক মহাসাগরের দিকে চলেছে। চারদিন পর হঠাৎ নিচে এক প্রকাণ্ড শহর, লোকজন ও গাড়ির প্রাচুর্য দেখলাম।

শ্যাম হুরকের সঙ্গে কথা ছিল বিল্টমোর হোটেলে তার চিঠি পাব। বিল্টমোর এক বিরাট, দামি হোটেল। হোটেল ভর্তি ফিল্মস্টার। রিসেপশনে গিয়ে কয়েকটা চিঠি পেলাম, তার মধ্যে হুরকেরটা উল্লেখযোগ্য।

আমি হ্যাভারস্যাক নিয়ে লিফটে উঠতে যাব, একজন স্টুয়ার্ড এগিয়ে এসে আমার কাঁধ থেকে সেটি নিয়ে নিল এবং বিশতলা উঁচুতে আমার ঘরে পৌঁছে দিল।

আমি ঠিক করেছিলাম তিনদিন বিল্টমোরে থেকে আরাম করে নেব, তারপর আবার চলব। ড্রাফট ভাঙাবার জন্য পাসপোর্ট ও একটা ভালো ঠিকানার হোটেলের প্রয়োজন ছিল।

পরদিন প্রাতরাশ খেয়ে বেরোলাম ব্যাঙ্কের সন্ধানে।

প্রথমেই গেলাম হলিউডে। ইউনিভার্সালের স্টুডিওতে ফিল্ম তোলা দেখা গেল। একটা ফোর্টের দৃশ্য দেখলাম যেটা রোনাল্ড কোলম্যান অভিনীত এ টেল অব টু সিটিস-এ ব্যবহৃত হয়। প্রকাণ্ড দুর্গটা যে একেবারে ফাঁকি তা ফিল্ম দেখবার সময় ভাবতে পারিনি। ফোর্টটি, কাঠ, কাগজ, চট ইত্যাদি রং-করা ভুয়ো সাজানো তাসের ঘর।

গুড আর্থ তৈরি হয়েছে অল্পদিন আগে। একটা পার্কের একাংশ কার্ডবোর্ড দিয়ে চিনে পাড়ায় পরিণত হয়েছে।

ঘুরতে ঘুরতে অনেক বেলা হয়ে গেল। লাঞ্চ খেতে গেলাম স্টুডিওর মধ্যে ডাইনিং রুমে। শিল্পীরা মেক আপ ও আজগুবি বেশভূষা করে সেট থেকে খেতে এসেছে। তখন কত হিরো হিরোইনকে একত্রে দেখলাম তার ঠিক নেই। কেবলমাত্র ক্লার্ক গেবলকে চিনতে পারলাম। বিল্টমোর হোটেলের লিফটে দুবার দেখেছি তাকে।

লস অ্যাঞ্জেলেস চির বসন্তের দেশ। ইচ্ছা করলে সুতির কাপড়, নয়তো পশম পরলেও আরাম পাওয়া যায়। শহরের বড় লোকেরা অদূরে পাহাড়ের সব জায়গায় থাকে। যেমন বেভারলি হিলস ও সানসেট বুলেভার্ড ইত্যাদি।

শাকসব্জি ও ফলের বাজার সম্পূর্ণ জাপানিদের হাতে। তারা এত সুন্দর করে সব সাজিয়ে রাখে যে দেখলে আনন্দ হয়। অনেক জাপানি ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করছে। আমেরিকার প্রায় সব স্টেটের বড় শহরে লন্ড্রির কাজ করে চিনারা। চওড়া রাস্তা ও দামি ল্যাম্পপোস্ট দেখবার মতো

ক্যালিফোর্নিয়াতে আভোকাডো নামে এক রকম পেয়ারার মতো ফল হয় যা ওরা সব্জি হিসাবে ব্যবহার করে। অনেক জায়গায় ফ্রুট সালাডের সঙ্গেও খায়। আভোকাডো সুস্বাদু নয়, তবে খাদ্যের দ্রব্যগুণ হিসাব করলে খুবই উঁচু দরের। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে জাহাজ নিয়ে পানামা যাব ঠিক করেছিলাম কিন্তু এক আমেরিকান বন্ধু বলল, সানফ্রান্সিস্কো গোল্ডেন গেট ব্রিজ না দেখে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ঠিক হবে না। অগত্যা তাই ঠিক করলাম। ছবির মতো ক্যালিফোর্নিয়া দেশের উত্তর দিকে রওনা হলাম। আমাকে ছেলেবেলায় পৃথিবী ভ্রমণে অনুপ্রাণিত করেছিল হেনরি মার্টিনেট, তার বাড়ি ছিল ক্যালিফোর্নিয়া কিন্তু ঠিকানা জানি না বলে কিছু করতে পারলাম না।

ছেলেবেলায় আমি যখন হেনরি মার্টিনেটের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ছিলাম, তখন একবারও মনে হয়নি তার ঠিকানাটা জেনে নেওয়ার কথা। আমেরিকা একদিন আমার নিজের চেষ্টায় ঘুরতে ও দেখতে পাব, সেকথা তখন কল্পনার বাইরে ছিল।

যা হোক সানফ্রান্সিস্কোতে যাওয়া সার্থক হল। প্রশান্ত মহাসমুদ্রের ওপর পাহাড়ি জায়গায় শহরটা। সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠলে জলে ঝিকিমিকি করে এবং অপূর্ব সুন্দর দেখায়। একটা দ্বীপের ওপর ওকল্যান্ড শহর। তাকে যুক্তরাষ্ট্রের মেনল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করবার উদ্দেশ্যে সমুদ্রের ওপর এক বিরাট সেতু তৈরি হচ্ছিল। এরই নাম গোল্ডেন গেট।

সানফ্রান্সিস্কো শহরে খুব ভালো চিনা খাবারের রেস্তোরাঁ আছে। চিনাপাড়ায় একটা রেস্তোরাঁতে খেলাম খুব তৃপ্তি করে। পৃথিবীর সব বড় শহরে যে চিনা খাবারের প্রচলন শুরু হল, তা বোধহয় সানফ্রান্সিস্কো শহরে আমেরিকান চাইনিজ উদাহরণ থেকে।

মস্ত বড় বন্দরে অনেক জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঠিক করলাম তিনদিন পরে একটা জাহাজে পানামা দেশের বালবোয়া শহরে যাব। পথে মেক্সিকোর আকাপুলকো বন্দরে থামবে সাত দিনের মতো মালপত্র দিতে নিতে। ভালোই হল। আমি আকাপুলকো বন্দরে নেমে পড়লাম এবং পাঁচদিন দেশ ভ্রমণে যাব ঠিক করলাম। বন্দর থেকে সাইকেল ঠেলে ওপরে শহরে পৌঁছতে রীতিমতো কঠিন পরিশ্রম করতে হল।

প্রথমে দেখতে গেলাম এক গির্জা। এটি স্প্যানিশদের যুগে তৈরি হয়েছিল অনেক আড়ম্বর করে। বহু রেড ইন্ডিয়ান দেখলাম, গাধার পিঠে মাল চাপিয়ে কাঁধের ওপর কম্বল ভাঁজ করে রেখে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকগুলির বেশভূষা দেখলে মনে হয় খুব সামান্যই রোজগার করে।

স্পেন এককালে দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকো পর্যন্ত রাজত্ব করেছে। আজও তার নিদর্শন দেশময় বিস্তৃত। এমনকী দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িগুলি স্প্যানিশ ধাঁচে তৈরি। তারও আগে এই দেশগুলির বাসিন্দা ছিল রেড ইন্ডিয়ানরা। স্পেনের লোকেদের সঙ্গে এদের সংমিশ্রণ হয় ব্যাপকভাবে। যার ফলে অনেক স্প্যানিশ ইন্ডিয়ান দেখা যায়, আমাদের দেশে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের মতো।

আকাপুলকো শহর ছেড়ে মেক্সিকো শহরের পথ ধরলাম। কিন্তু সিয়েরা মাদ্রে পর্বতশ্রেণী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রায় ছয় হাজার ফুট অতিক্রম করার পর পাহাড়ের ওপর সমতল রাস্তা পেলাম। অল্প পরিশ্রমে মনে হয় শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। একদিন পরে বুঝলাম উচ্চতার জন্য এই অবস্থা, দুদিন পরে ক্লান্ত ভাব কেটে গেল।

মেক্সিকোর রাজধানী। মস্ত বড় পাহাড়ি দেশটা এখান থেকেই সরকারি নির্দেশনায় চলে। গভর্নমেন্ট বামপন্থী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে বিশেষ ইচ্ছুক নয়। খেলাধুলার বেশ চর্চা আছে দেখলাম। অল্প স্প্যানিশ ভাষা শিখেছিলাম ইউরোপে থাকতে। সেটা এখানে খুব সাহায্য করছে।

ঠিক সাত দিন পরে আমি আকাপুলকো শহরের বন্দরে ফিরে এলাম। জাহাজ ছাড়তে আরও তিন দিন দেরি। অনেক দূর থেকে পশম আসছে। সেগুলি নিয়ে যেতে হবে উত্তর আমেরিকায়। পাহাড় থেকে নেমে এখানে বেশ গরম পাচ্ছি। ট্রপিক অব ক্যানসার বেশি দূরে নয়। জায়গাটি মনোরম। পরে শুনেছি আমেরিকানরা কোটি কোটি ডলার খরচ করে আকাপুলকোকে ট্যুরিস্টের স্বর্গ বানিয়েছে।

জাহাজ নোঙর তুলে দক্ষিণে রওনা হল। পথে গোটেমালা, সান সালভাডর নিকারাগুয়া ও কোস্টারিকা পার হয়ে পানামায় বালবোয়া শহরে পৌঁছলাম। এখান থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় যাবার কথা। ক্যাপ্টেন অনুরোধ করল পানামা ক্যানেল সবটা জাহাজে পার হয়ে কোলোন শহর পর্যন্ত যেতে। বলল যে প্যাসিফিক থেকে আটলান্টিক ক্যানালের ভেতর দিয়ে যাবার অভিজ্ঞতা অসাধারণ।

ক্যানেলের মুখে বালবোয়া শহরে জাহাজ থামল। অপেক্ষা করছিল কখন তার পালা হবে ক্যানেলে ঢুকতে। এই অঞ্চলে আমার খুব গরম লাগছিল। ঘাম হচ্ছিল প্রচুর। জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একটা খুব সুন্দর গার্ডেন রেস্তোরাঁয় বিয়ার খেতে গেলাম। প্রায় সব লোকই আমেরিকান।

পানামা ক্যানেল যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে।

ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার ফার্দিনান্দ দ্য লেসেন্স সুয়েজ ক্যানেল করবার পর পানামা ক্যানেলে হাত দেন। তখন ম্যালেরিয়ায় ভীষণ লোকক্ষয় হওয়ায় তিনি কাজ বন্ধ রাখেন। তখন যুক্তরাষ্ট্র ক্যানেলের গুরুত্ব বুঝে সমস্ত দায়িত্ব নিজেরাই নেয় এবং সেই অবধি ক্যানেল যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে। দেশ দখল করে রাখার জন্য পানামাকে খেসারৎ দিতে হয় প্রতি বছর।

ভোর রাতে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে ডেকে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু পরেই আমাদের জাহাজ ক্যানেলে প্রবেশ করবে। অনেকদিন বড় পাখি আকাশে উড়তে দেখিনি। চিলের মতো বড় কালো পাখি বাতাসে ভেসে আসছে দেখে আমার মনে হল সুদূর কলকাতার কথা।

অদ্ভুত কৌশলে ক্যানেলের মধ্য দিয়ে জাহাজ আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। সামনে আরও তিনখানা জাহাজ আছে। জাহাজ ক্যানেলে ঢোকবার পর পিছনে বড় গেট বন্ধ হয়ে গেল। সামনে আরেকটা গেট, আস্তে আস্তে খুলে যেতে জল ঢুকতে আরম্ভ করল প্রথম খোপে। তারপর যখন জলের লেভেল এক হয়ে গেল, জাহাজ দ্বিতীয় পদক্ষেপ করল। এমনইভাবে আঠাশবার জল উঁচু এবং জল নিচুর মধ্য দিয়ে জাহাজ সমস্ত ক্যানেল পার হল।

সমুদ্রের জলের লেভেল বা সমতা পৃথিবীর সব জায়গায় সমান কিন্তু এই ক্যানেলের দুই মুখে দুই রকম উচ্চতা। আটলান্টিক প্যাসিফিকের চেয়ে শুনেছি চার ফুট উঁচু। সেই জন্য ক্যানেলের মধ্যে জলের সমতা বজায় রেখে জাহাজ চলে। দুপুরবেলার একটু আগে আমার জাহাজ আটলান্টিকের ধারে কোলোন শহরে পৌঁছল। আমি ক্যাপ্টেনকে বিদায় দিয়ে ডাঙায় নামলাম। এক রাত কোলোন শহরে থেকে পরদিন শহর দেখতে গেলাম। অনেক বড় বড় দোকান আছে। ডিউটি বা শুল্ক না দিয়ে জিনিস বিক্রি হয়। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় একজন দোকানের মালিক সোজা বাংলায় আমাকে বলল, তার দোকান দেখবার জন্য। আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞাসা করলাম তুমি কেমন করে জানলে আমি বাঙালি। সে বলল, তার নাম মোক্তার এবং চাটগাঁতে তার বাড়ি। কেমন করে জানি না মোক্তারের মনে হয়েছিল আমি বাঙালি। সে একটা সুযোগ নিয়ে বাংলায় কথা বলে দেখল কী ফল হয়। যদি আমি সাড়া দিই তবে বাঙালি না হলেই নয়। আমি মোক্তারের সঙ্গে করমর্দন করে আমার নাম বললাম। আমি কে, কী করছি শুনে মোক্তারের উৎসাহ খুব বেড়ে গেল। আমাকে নিয়ে তার দোকান দেখাল। ক্যামেরা পারফিউম ইত্যাদি জিনিসে ঠাসা। আমাকে একটা আফটার শেভ লোশন উপহার দিল। তারপর বলল, আমার স্ত্রী কতদিন দেশের লোক দেখেনি তার ঠিক নেই। চলেন আমার বাড়িতে খানাপিনা করবেন।

একরকম আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল। আমিও অবিশ্যি অনিচ্ছুক ছিলাম না। থানায় আমার সাইকেল জমা রেখে শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম। সেখান থেকে সাইকেল নিয়ে দুজনে চলতে চলতে একটা দোতলা বাড়ির সামনে থামলাম। দোতলায় মোক্তাররা থাকে। তাদের একটি ছেলে আছে। মোক্তার লাফাতে লাফাতে দোতলায় গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এল। গৃহিণী বেশ সপ্রতিভ, বিদেশে একা থাকার ফলে বোরখা ত্যাগ করেছেন। সলজ্জভাবে আমাকে সালাম জানালেন।

মোক্তার কেমন করে চাটগাঁ ছেড়ে সুদূর পানামার বাসিন্দা হল জানতে ইচ্ছা হল। সে বলল, একটা জাহাজে খালাসির কাজ করতাম, জাহাজের কাজে ইস্তফা দিয়ে বারো বছর আগে এইখানে নেমে পড়লাম। জাহাজ চলে গেল। আমার জমানো সব টাকা দিয়ে এই দোকানটা কিনলাম। আগে ছোট ছিল। পরে ব্যবসা ভালো চলতে বড় ও আধুনিক করলাম। একবার চাটগাঁয় যাই এবং বিবি নিয়ে ফিরি।

ওদিকে গৃহিণী মোক্তারকে ডেকে বললেন, ঘরে কিছু নেই যে মেহমানের সম্মান রাখি। মোক্তার হাসিমুখে বলল, আরে বাঙালির ছেলে ভাত ডাল পেয়ে খুশি হবে না! তার সঙ্গে আবার মাছ। বিবিজান তুমি তোমার রান্নার কেরামতি রাত্রের খানায় দেখিও। আমি মুখার্জিবাবুকে আজ ছাড়ছি না। বিবি খুশি হয়ে বললেন, তুমি ভালো মাংস এনে দাও আমি বিরিয়ানি পাকাব।

যথাসময়ে ভাত ডাল একটা তরকারি এবং মাছের ঝোল রান্না খেলাম। আমার বেশ ঝাল লাগল। খেয়ে উঠেই রওনা হবার কথা বললাম। মোক্তার সস্ত্রীক একসঙ্গে বললেন যে তা হবে না। একদিন অন্তত থাকতেই হবে, তার আগে বালবোয়া ফেরবার কোনও জাহাজও নেই। তখন আমি খুশি মনে রাজি হলাম। খেয়ে-দেয়ে ফরাসের ওপর নিদ্রা দিলাম। বহুকাল পরে ভাত খেয়েছি তার ফল পেতেই হবে।

বিকালে দেখি ঘরের ভেতর একটি ছোট ছেলে কী একটা করছে আমার হ্যাভারস্যাকের সামনে এবং আড় চোখে আমার দিকে দেখছে।

মোক্তার দোকানের ভার আরেকজন কর্মচারীর হাতে দিয়ে বাড়ি ফিরেছে। ছেলেটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এরই নাম তো মনুয়া, একমাত্র ছেলে! মোক্তার হ্যাঁ বলে ছেলেকে আমার সামনে ডাকল এবং আমার পৃথিবী ভ্রমণ সম্বন্ধে বলতে লাগল। আমাদের পরিচয় হল। মোক্তার গৃহিণীকে চা দিতে বলল। অনেকদিন পরে ভালো চা খেয়ে খুব ভালো লাগল।

মনুয়া এবার অসংখ্য প্রশ্ন করে গেল। তার বয়স আট। সব জিনিস অস্পষ্ট বোঝে। তাকে সাইকেলটা দেখাতে অবাক হয়ে গেল। কোলোনে সাইকেল বোধহয় এই প্রথম। মনুয়াকে নিয়ে একটু বেড়াতে বেরোলাম। ক্যানেলের ধারে একটা সুন্দর বাগান আছে। সেখানে বেঞ্চে বসে গল্প শুরু করলাম।

সন্ধ্যার সময় গরম লাগছিল। মনুয়াকে সঙ্গে নিয়ে একটা আমেরিকান জাহাজ এম ভি ক্যালিফোর্নিয়া খুঁজে বের করলাম। আগামীকাল বেলা বারোটার সময় জাহাজ ক্যানেলে প্রবেশ করবে। তার আগে জাহাজে উঠতে হবে।

এখানে সব বাড়ির টিনের চাল। সেজন্য বোধহয় গরম একটু বেশি।

সন্ধ্যার পর মনুয়াদের বাড়ি ফিরলাম। গৃহিণী রান্না নিয়ে ব্যস্ত। মোক্তারের দোকানে অনেক খরিদ্দার এসেছে। ক্যালিফোর্নিয়া জাহাজের যাত্রীরা কোলোন শহর ভরে ফেলেছে। তারা সস্তায় নানা রকম ব্যবহারের জিনিস কিনছে। রাত নটায় দোকান বন্ধ করে মোক্তার বাড়ি ফিরল। তার প্রথম কথা যে আমি তার জন্য সৌভাগ্য এনেছি সেদিন। অনেক মাল বিক্রি হয়েছে। একটা বোতল বিয়ার খুলে দুভাগ করে দিল।

অল্পক্ষণ পরে দেখি ঘরের মাঝখানে ফরাসের ওপর গৃহিণী সাদা চাদর পেতে দিয়ে আমাদের খেতে ডাকলেন। রান্না খুবই মুখরোচক হয়েছিল। আমার জন্য ঝাল দেননি। বিরিয়ানির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে মিসেস মোক্তার বললেন, আপনি অনেকদিন ঘরছাড়া, তাই বেশি ভালো লাগছে। আরও দু-চারদিন যদি থেকে যাই তো নানা রকম রেঁধে খাওয়াবেন।

দুঃখের বিষয় পরদিন সকালে আমাকে জাহাজ ধরতে হবে। বেলা দশটার সময় মোক্তারদের কাছে বিদায় নিয়ে আমি এম ভি ক্যালিফোর্নিয়া জাহাজে উঠতে গেলাম। আমি একমাত্র প্যাসেঞ্জার তাই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। আরোহীদের মধ্যে আমিই পানামা ক্যানেল আগে দেখেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *