১০
কারেলিয়া ছেড়ে লেনিনগ্রাদের পথ ধরলাম। রুশ সীমান্তে নতুন ইনল্যান্ড পাসপোর্ট দিল। তারপর দেশে প্রবেশ করলাম। লেনিনগ্রাদ আগে সেন্ট পিটার্সবুর্গ নামে পরিচিত ছিল। এইখানেই লেনিন প্রথম কমিউনিস্ট গভর্নমেন্ট স্থাপন করেন। সেসব জায়গায় ছবি তুললাম। আমি প্রথম থেকে ঠিক করেছিলাম যে বিশেষ দ্রষ্টব্য জিনিসের দুখানা করে নেগেটিভ রাখব, একখানা নিজের জন্য, অন্যটা রুশ গভর্নমেন্টকে দিয়ে পয়সা রোজগার করব।
লেনিনগ্রাদ ভারি সুন্দর পরিষ্কার শহর। আমস্টার্ডাম শহরের মতো, এখানে চারদিকে জলপথ। রানি ক্যাথারিন দি গ্রেট-এর বাড়িটার নাম এরমিতাজ (Hermitage)। প্রকাণ্ড বড় ক্যানেলের ওপর রাজপ্রাসাদ। এখন ইউরোপের একটি শ্রেষ্ঠ আর্ট গ্যালারি বা চিত্রশালা হয়েছে। দুদিন লাগল ঘুরে ঘুরে অমূল্য ছবিগুলো দেখতে।
রাশিয়া এখন আর কোনও ধর্মের ধার ধারে না। কোনও দেবদেবী নেই, মানুষের সেবাই একমাত্র ধর্ম। কিন্তু আজও অনেক সুন্দর সুন্দর গির্জা রয়ে গিয়েছে। যারা সে যুগের লোক, ধর্ম ছাড়তে বা ভুলতে পারেনি, তারা উপাসনা করতে যায়।
আমি সারাদিন সাইকেলে চড়ে শহরময় ঘুরে বেড়াই। ১৯১৭ সালে যেখানে দশদিন ভীষণ সংগ্রামের পর কমিউনিজমের গোড়াপত্তন হল, সে সব জায়গাগুলির ছবি তুললাম। রাশিয়ানরা আজকাল সেখানে যায় তীর্থযাত্রীর মতো। সাম্যবাদ পৃথিবীতে নতুন যুগের সৃষ্টি করেছে। রাশিয়াতে অতীতে কোটি কোটি লোক দুঃখে কষ্টে পদদলিত অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করেছে, আজ তারা স্বাধীনভাবে খেয়ে পরে বাঁচবার অধিকার পেয়েছে। মনে হয় এদের অনেক উন্নতি হবে একদিন। এদের ভবিষ্যৎ আছে— কেউ ঠেকাতে পারবে না।
নেভস্কি প্রসপেক্ট নামক সড়ক ধরে নেভা নদীর ধারে বেড়াতে গেলাম। ব্রিটিশ রাজদূতের বাড়ি ছিল এখানে। নদীতে একটা বাঁধানো ঘাট আছে, সিঁড়ি আছে এবং দুটি পাথরের ব্রিটিশ সিংহমূর্তি আজও সেখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।
আমি অন্য দেশের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাব না। জ্ঞানের জন্য যতটুকু জানা দরকার সেইটুকুই জানব। কমিউনিজম ভালো কি মন্দ তাই নিয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে। তবু আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’র তুলনা নেই।
আমি যখন পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছি তখন কমিউনিজমের বিরুদ্ধাচরণ করে এমন কয়েকটি দেশেও আমি যাব। পাসপোর্টের ওপর রাশিয়া ভ্রমণের ছাপ থাকলে সেটা অন্তরায় হবে, তাই রুশ সরকার আমার পাসপোর্টে কিছু না লিখে অন্য পাসপোর্টে সব রেকর্ড রাখল। রাশিয়া ভ্রমণ করে আমি সেই ‘ইন্টারনাল পাসপোর্ট’ বহু বছর কাছে রেখেছিলাম। অর্ধ-শতাব্দী পরে সেটা আজ কোথায় গিয়েছে তার হিসাব নেই। পাসপোর্টগুলো সব আছে।
একদিন বিকালে লেনিনগ্রাদের সবচেয়ে বড় গির্জার ছবি তোলবার ইচ্ছায় সুবিধামতো জায়গা খুঁজছিলাম। যেখানে এসে থামলাম সেখানে দেখলাম এক ভদ্রলোক টুপি মাথায় দিয়ে বেঞ্চিতে বসে রোদ পোয়াচ্ছে। বেঞ্চির ওপর উঠলে আমার মনোমত বা পছন্দসই জায়গা পাই ছবি তোলবার পক্ষে। তাই একটু ইতস্তত করে ভদ্রলোককে ছবি তোলবার কথা বললাম। আমার মুখের দিকে চেয়ে একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, নিশ্চয়ই ছবি তুলবে। বেঞ্চের একপাশে সরে বসল। আমি ছবি তুলে নামবার পর ভদ্রলোক বলল, আচ্ছা তুমি কি ভারতীয়? আমি হ্যাঁ বলাতে ভদ্রলোক পাশে বসতে বলল এবং বাঙালি শুনে খুশি হয়ে বাংলায় কথা বলতে আরম্ভ করল। পরিচয় দিল তার নাম— দাউদ আলি দত্ত। বাঙালি সন্ত্রাসবাদী দলের একজন ফেরার। রুশ দেশে জীবনযাপন করছে। রুশ ভদ্রমহিলাকে বিবাহ করেছে এবং তাদের একটি সন্তান আছে। শীতের দেশে থেকে রংটা আরও ফর্সা হয়ে গেছে। মনে হয় যুগোস্লাভিয়ান কিংবা ইতালিয়ান। বহুকাল বিদেশবাসী।
আমি যখন বললাম যে কলকাতায় আমার বাড়ি, দত্ত মশায় বাংলায় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন লেনিনগ্রাদে কবে এসেছি এবং কী করছি। আমার পরিচয় দিলাম ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে আমার দুহাত ধরলেন। বললেন, কয়েকদিন আগে ‘প্রবাসী’ মাসিক পত্রিকা এসেছে তার বাড়িতে। সে তার স্ত্রীকে আমার কথা পড়ে শুনিয়েছিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমার তখন কী কাজ আছে। যদি জরুরি কাজ না থাকে তো তার বাড়ি যেতে। আমরা তার বাড়ি গেলাম। স্ত্রী বাজারে জিনিসপত্র কিনতে বেরিয়েছিলেন। একটু পরে বাড়ি ফিরলেন। আমি দাঁড়িয়ে ভারতীয় প্রথায় দুহাত জুড়ে ‘নমস্কার’ বললাম। তিনি না বুঝে বললেন, ‘নমস্কার’। স্বামীর মুখের দিকে চাইলেন। গোস্পোদিন (অর্থাৎ মিঃ) দত্ত বললেন, এই সেই গ্লোব ট্রটারদের একজন। অন্যদের কথা জিজ্ঞেস করবার অবকাশ হয়নি।
লন্ডনের বন্ধু নীনার মা-বাবার কাছে সারাক্ষণ রাশিয়ান ভাষা শুনে শুনে আমার কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কাজ চলা কিছু কিছু বলতেও আরম্ভ করেছি। অক্ষরগুলো উল্টোপাল্টা বলে শিখতে দেরি হচ্ছিল। রাশিয়ান ভাষার হরফ কিছুটা গ্রিক থেকে নেওয়া।
ফ্ল্যাটটা ছোট। তিনখানা ঘর— স্বামী-স্ত্রীর একটা, ছেলের একটা ও অন্যটি রান্নার ও বসবার ঘর এবং খাবার ঘর। আগেকার দিনের বড়লোকের বাড়ি বলে ঘরগুলো খুব বড়। সাধারণত এত বড় ঘর ভাগ করে দেওয়া হয় কিন্তু ভারতীয় এবং রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বলে এই পরিবারের প্রতি বিশেষ বিবেচনা দেখানো হয়েছে। মিঃ দত্ত বহু বছর আগে রাশিয়ান নাগরিক হয়ে গেছে। তার একমাত্র ছেলে ভালো আয় করে। কর্তার পেনশন ও ছেলের আয় থেকে সংসার চলে যায়। স্ত্রী ভালো জার্মান শিখেছেন। তিনি একটা ছেলেদের ক্লাবে সপ্তাহে দুদিন করে শ্রমদান করেন— বিনামূল্যে তাদের ভাষা শেখান
গল্প করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেল। আমাকে মধ্যাহ্নভোজ করতে বললেন। ম্যাকারোনি অনেক সেদ্ধ হয়েছিল, টমাটোর রস ও আলুভাজা দিয়ে তাই খেলাম। আড়ম্বর নেই, কিন্তু পেটভরা খাবার সবার জন্যই ছিল। ছেলে দুপুরে বাড়ি আসতে পারে না। যেখানে কাজ করে সেখানেই খেতে দেয়।
আর খানিকক্ষণ গল্প করে আমি হোটেলে ফিরলাম। রাস্তার ধারে বড় বড় দোকান আছে। ছিল বললে ভালো হয়, কেননা আগে তারা ভোগ্যবস্তুতে ভর্তি ছিল, আজ বেশিরভাগ খালি পড়ে আছে।
লেনিনগ্রাদ ছেড়ে মস্কো অভিমুখে রওনা হলাম। রাস্তা খুব ভালো। চারদিন পর মস্কো পৌঁছলাম। শহরের চেয়ে গ্রামের অবস্থা সচ্ছল। চাষবাস করে বেশিরভাগ লোক ভালোভাবে জীবিকা নির্বাহ করে।
মস্কো বিরাট শহর। এখনকার রাজধানী। দেশের এক প্রান্তে বিশেষ করে সমুদ্রের ধারে অবস্থিত বলে লেনিনগ্রাদ পরিত্যাগ করে মস্কোতে রাজধানী সরানো হয়েছে। ঠিক এই কারণে ইস্তাম্বুল থেকে রাজধানী সরিয়ে কামাল পাশা সেটা তুর্ক দেশের মাঝখানে আঙ্কারাতে নিয়ে যান। যেসব জাতির নৌবাহিনী বড় এবং ক্ষমতাপন্ন তারা সমুদ্র থেকে গুলিগোলা বর্ষণ করে রাজধানী বিপন্ন করতে পারে। দুই হাজার বছরের ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়।
মস্কো নদী শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। শহরের ও নদীর নাম এক।
আমি উঠলাম পিস হোটেলে। তিন তলার ওপরের ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে মস্কো নদী দেখতে পাই। নদীর ওপরে বিখ্যাত ‘রেড স্কোয়্যার’, আরেক দিকটায় উঁচু একটা টিলার ওপর ক্রেমলিন দুর্গ। এখন সেটা সরকারি দপ্তর। যদিও শহরের মাঝখানে, তবু ক্রেমলিন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আশপাশ থেকে।
এই হোটেলের খাবার খুব ভালো। সকালে প্রাতরাশের জন্য টোস্টের সঙ্গে কাঁচা মাছের ডিম দিত। স্টার্জন মাছ একমাত্র বলটিক সমুদ্রে জন্মায়। ওই মাছের ডিম কাভিয়ার নামে সবার প্রিয়। রুশ দেশের বাইরে কাভিয়ার রীতিমতো বড়লোক ছাড়া কেউ খায় না। তবে এদেশের দরজায় জন্মায় বলে রাশিয়াতে সবাই খায়। রুশ দেশে বড়লোক, গরিব লোক শ্রেণীগতভাবে নেই। যে যেমন কাজ করে তার মাইনে তেমন, ভালো কাজ করলে প্রমোশন চটপট হয়। সেই সঙ্গে সব রকম সুবিধা সে এবং তার পরিবার উপভোগ করে। এ আরেক ধরনের শ্রেণী বলা চলে।
ক্রেমলিনের ভেতরে ঢোকবার পাস নিলাম। সবদিক ঘুরে ঘুরে ছবি তুললাম। বিকালে কিছু দূরে স্পোর্টস পার্কে বেড়াতে গেলাম। এখানে তরুণ-তরুণীরা নানা রকম শারীরিক পরিশ্রমের খেলায় ব্যস্ত। অফিস, কারখানা থেকে সোজা খেলার মাঠে আসে বলে অনেকের বেশভূষা খেলার উপযুক্ত নয়, কিন্তু তাতে কী আসে যায়! কালো কি ছাই রংয়ের ট্রাউজার পরে কি আর ক্রিকেট খেলা যায় না?
পরদিন ‘বলশয়’ থিয়েটারে— ‘সোয়ান লেক’ ব্যালে দেখতে গেলাম। কমিউনিজম আমদানি হবার আগে ‘বলশয়’ ছিল রীতিমতো বড়লোকদের আনন্দ উপভোগের স্থান। আজ আমার পাশে বসে আছে যারা তারা চাষী পরিবারভুক্ত মনে হয়। আগেকার দিনে তারা এই থিয়েটারে ঢুকতে পেত না। আগে আর্ট ছিল বড়লোকদের কুক্ষিগত
শহরের চারদিকে রাস্তা তৈরি ও বাড়ি তৈরির ব্যস্ততা দেখলাম। মেয়েরা সব কাজে অগ্রণী। তারা ট্রাম, ট্রেন চালাচ্ছে, এমনকী জাহাজের কাপ্তেনও হয়েছে। অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে মেয়েদেরও দেখেছি। রাস্তায় স্টিম রোলার চালানো থেকে পিচ ঢালার কাজ মেয়েরা খুব সুষ্ঠুভাবে করছে। বুঝলাম এদেশের কর্মের ক্ষেত্রে স্ত্রী- পুরুষের কোনও পার্থক্য নেই। যে কাজ পুরুষের তা মেয়েদেরও। লোকেদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছে। মেয়ে ভারি ট্রাক চালাচ্ছে দেখলে হাঁ করে না দেখে লোকে ড্রাইভিংয়ের তারিফ করতে শিখেছে। তখন কে ভেবেছিল যে একদিন এক রুশ মহিলা মহাকাশ যাত্রা করবে এবং সারা পৃথিবীতে সর্বাগ্রগণ্যা হবে।
মস্কোর দুটো বড় বড় চিত্রশালা দেখলাম। একটি রুশ যুবক আমার সঙ্গে ভাব করল। খুব আগ্রহ ভারতবর্ষ সম্বন্ধে জানবার। তার নাম ইভান। একটা ছোট্ট এক ঘরওয়ালা ফ্ল্যাটে সে থাকত। তার মেয়াদ আরও দুবছর। তারপর দুই ঘর ফ্ল্যাট পাবে। দেশসুদ্ধ লোককে থাকবার উপযুক্ত বাড়ি দেবে এই প্রতিশ্রুতি রুশ গভর্নমেন্ট অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।
আমাদের দেশে আজও কুকুর বেড়ালের মতো লোকেরা ফুটপাথে শুয়ে জীবন কাটায়। অথচ আমরা প্রগতির বড়াই করি। রুশ দেশে কী পরিমাণ প্রগতি হয়েছে তা আমাদের কল্পনাতীত। ওদের তুলনায় আমরা এখনও পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাস করছি।
পাঁচদিন পরে ইভানের সঙ্গে দেখা হল। সে খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল যে শীঘ্রই সে সাইবেরিয়াতে চলে যাবে, একটা নতুন শহরের পত্তন করতে। সাইবেরিয়ার নামে আতঙ্ক জাগে মনে। প্রথমেই মনে হয় নিঃসঙ্গ দেশ আর হাড়ভাঙা শীতের কথা। ইভান বলল যে সে একদল লোকের সঙ্গে ছুটিতে সাইবেরিয়া বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে এক জায়গায় লোকের বসবাস হলেই গভর্নমেন্ট বাড়ি, স্কুল, সিনেমা, নাচঘরের ব্যবস্থা করে দেবে। তখন আর নিঃসঙ্গ নির্বান্ধবপুরী মনে হবে না। তাছাড়া কাজে চটপট প্রমোশন ও প্রতিপত্তি লাভ করাও সেখানে অনেক সোজা।
ইভানের ইচ্ছা দশ-বিশ বছর সাইবেরিয়ার একটা খনিতে কাজ করে নিজের উন্নতি সাধন করবে, তারপর উরাল পর্বতের এপারে আসার কথা ভাববে। যদি কাউকে ভালো লাগে তো সেখানেই বিয়ে করবে। ইভান খনিজ পদার্থবিদ্যা শিক্ষা করেছে। সে খনির কাছে থাকতে চায়— তবেই তার উন্নতি হবে।
রাশিয়াতে হাজার হাজার যুবক আছে যারা দেশ গড়তে রাশিয়ার উত্তরে বরফের দেশে কিংবা সাইবেরিয়াতে যেতে প্রস্তুত। তাদের ধারণা আজ যে গ্রাম আছে কাল সেটা ছোট শহর হবে। সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার নানা রকম পথ উন্মুক্ত হবে এবং সব রকম জিনিসপত্র ও আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা হবে।
দেশে এখন চারদিকে ভাঙা গড়ার কাজ চলছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে মস্কোতে পাতাল রেলওয়ে হয়েছে যা দেখবার মতো। আগে ও পরে যত আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে দেখেছি তাদের মধ্যে মস্কোর স্থান সর্বাগ্রে। প্রত্যেকটি স্টেশন দেখবার মতো। চারদিকে দামি পাথর দিয়ে গড়া থাম ও দেওয়াল। আলোর সুবন্দোবস্ত চোখে পড়ে। পাছে একঘেয়ে হয়, সেজন্য কর্তারা তরুণ স্থপতিবিদদের ডেকে বলল, তোমরা ইচ্ছামতো স্টেশন বাড়ি তৈরির প্ল্যান দাও। যুবকরা উৎসাহী হয়ে ডিজাইন দিল এবং তাদের বেশিরভাগ সাদরে গ্রহণ করে নতুন নতুন বাড়ি ও স্টেশন গড়বার কাজ চলল।
অত খরচ করে দামি দামি মার্বেল, মালাকাইট ইত্যাদি পাথর দিয়ে স্টেশন তৈরি করার সার্থকতা কী জিজ্ঞেস করে জানলাম যে বর্তমানপন্থীরা বলে একজন বড়লোকের বাড়িতে কারুকার্য করে সাজিয়ে মুষ্টিমেয় লোকের আনন্দ দেবার চেষ্টা না করে, আমরা সাধারণের ব্যবহারের সব জায়গা সুন্দর করে সুরুচিপূর্ণভাবে সাজিয়ে সবাইকে ব্যবহার করতে ডাকছি। লোকেরা যে যত্ন করে ব্যবহার করে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কোনও স্টেশনে একটু ধুলো নেই। পাথর সব চিক চিক করছে এমন পরিষ্কার।
যখন আমি বললাম যে এত স্টেশন, ঘরের মতো সাজিয়ে পরিষ্কার রাখা এক দুরূহ ব্যাপার নয় কি? তখন এক মহিলা বললেন যে এত বড় কাজ এক রকম বিনামূল্যে হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের দিন ধার্য আছে যাতে তাদের নিজস্ব মেট্রো চকচকে ঝকঝকে রাখবার জন্য তারা শ্রমদান করে। সৈন্যবাহিনীও চুপচাপ বসে না থেকে কখনও কখনও এইসব পরিষ্কার করার কাজে হাত দেয়।
ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে যাবার সময় দেখেছি নবীন সৈনিকদের দিয়ে চাষবাসের কাজ করানো হচ্ছে। তারাও হাসিমুখে মাঠে হাল দিচ্ছে, গম কাটছে, গো-পালন করছে দেখা যায়। সবার সব কাজে প্রচণ্ড উৎসাহ। আমাদের দেশে এ রকম ভূতের ব্যাগার খাটার লোক পাওয়া যায় না। রাশিয়াতে সম্ভব হয়েছে এই জন্য যে সাম্যবাদ চালু হবার পর থেকে সবার মনে দেশপ্রেমের বন্যা বইছে। ‘আমার দেশ এবং আমার দেশের সব জিনিস পবিত্র, তাকে নষ্ট করবার, ভাঙবার কথা মনে আসে না’— এই ভাব সর্বত্র।
আমাদের দেশে যেমন ট্রেনের আলো, বসবার গদি ইত্যাদি চুরি করে কেটে ছিঁড়ে নষ্ট করে, সে রকম এদেশে কল্পনাতীত। দেশপ্রেমের প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় যখন আবালবৃদ্ধবনিতা দেশের সব জিনিসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নবান হয়।
অক্টোবর রেভোলিউশনের দিনে প্যারেড কুচকাওয়াজ ইত্যাদি ঘটা করে হয়। জনসাধারণ এইসব প্যারেডে যোগ দেয়, একেকটি দল করে। আবার ইচ্ছা করলে দাঁড়িয়ে থেকে ধুমধামও দেখতে পারবে। আমাদের হোটেলে একটি তরুণী এসে বলল, রেভোলিউশন অ্যানিভার্সারিতে যারা যোগ দিতে চায় তারা যেন নাম দেয়। আমি নাম লেখালাম। আমাকে বলা হল যে ইংরিজি ভাষা-ভাষীদের দলের পুরোভাগে যেন আমি থাকি। প্রায় ১০০ জন (পুরুষ) ইংরেজ ও অন্যদের নিয়ে একটা দল হল। আমাকে বেশি কিছু খাটতে হয়নি। সবাই নিয়মে চলে, তাই নিয়ম মানলেই সব কাজ সুষ্ঠুভাবে হয়।
১০ অক্টোবর ভোরে উঠে যথাস্থানে হাজির হলাম। আমাদের দলকে লাইনবন্দী করে একটু ঘোরাফেরা করে তৈরি থাকলাম যে যখন ডাক আসবে সঙ্গে সঙ্গে ক্রেমলিনের পাশে রেড স্কোয়্যারে যাব। যখন সময় হল, আমাদের দল মস্কো নদীর ওপর চওড়া সেতুর মুখে গিয়ে দাঁড়াল, নদী পার হলেই, বিরাট রেড স্কোয়্যার।
চারদিকে বাজনা বাজছে, পতাকা উড়ছে, লোকে লোকারণ্য। আমরা দেখতে লাগলাম। আগের দল চলে গেলে আমরা এগোতে পারব।
এমন সময় একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল। লন্ডনে থাকতে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবে একটি তরুণীর সঙ্গে ভাব হয়। তার নাম মিস এঞ্জেলা গেস্ট। এঞ্জেলার বাবা একজন মেম্বার অব পার্লামেন্ট। এঞ্জেলা লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে গবেষণা করত প্রফেসর ল্যাস্কির অধীনে। ভালো ছাত্রী কিন্তু তার মাথায় তখন কমিউনিজমের চিন্তা। কমিউনিজমের ফলে পৃথিবীর অশেষ কল্যাণ সাধিত হবে এই তার বিশ্বাস। বিশ্বাসের মাত্রা খুব বেশি ছিল, সেইজন্য কথায় কথায় তার সঙ্গে তর্ক শুরু হয়ে যেত। এঞ্জেলার মনটা খুব দরদী তাই ঝগড়া সহজেই ভুলে যেত।
এঞ্জেলার গায়ে জোর ছিল অমানুষিক। সে যে কোনও ছেলের সঙ্গে লড়তে পারত।
রেড স্কোয়্যারের ঘটা দেখে মনে পড়ল এঞ্জেলার কথা। সে এই আয়োজন ও আনন্দ সমাবেশ দেখলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হত।
মস্কো নদীর ওপর সেতুর প্রায় মাঝখানে পৌঁছেছি তখন রেড স্কোয়্যার থেকে ফিরতি একটা মহিলার দল উল্টোদিক থেকে আসছিল। অবাক হয়ে দেখলাম সেই দলের প্রথমেই এঞ্জেলা গেস্ট। আমরা দুজনেই পরস্পরকে দেখে নাম ধরে ডাকলাম চিৎকার করে, তারপর বললাম যে কোন হোটেলে আছি। এরকম হঠাৎ দেখা হওয়ায় দুজনেই খুব খুশি।
তারপর এগিয়ে চললাম, থামবার ফুরসৎ নেই। রেড স্কোয়্যারে সব দলকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল সমবেত জনমণ্ডলী হাততালি দিয়ে। লেনিনের মরদেহ যেখানে রাখা আছে সেখানে আমার দল নিয়ে এক মিনিট দাঁড়ালাম এবং মনে মনে মহাত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম।
বিকালটা কাটল অ্যামুজমেন্ট পার্কে বাইচ খেলা দেখতে। তারপর ফায়ার ওয়ার্কস দেখে রাত্রে হোটেলে ফিরলাম। শোবার সময় মনে হল এমন দিনে মস্কোতে না কাটালে রাশিয়ায় আসা বৃথা।
পরদিন সকালে প্রাতরাশ খেয়ে একটা ইংরিজি খবরের কাগজ খুঁজছি, ওদিকে অফিসে আমার খোঁজ পড়েছে। এঞ্জেলা এসে হাজির। সে সবেমাত্র একদিন আগে মস্কো পৌঁছেছে। শহরের সে কিছুই দেখেনি তখনও।
সকালবেলায় দলের মাথায় আমাকে খাড়া করে দিয়েছিল বলে পরে অনেকে আমার সঙ্গে নিজে থেকে এসে আলাপ করল, ভাব জমল একজনের সঙ্গে— প্রফেসর ব্রাউন। সে আমারই সমবয়সী, আমেরিকান প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। ব্রাউন যখন শুনল যে আমি সাইকেলে পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছি এবং রাশিয়া দেশটি কেমন আবিষ্কার করা আমার উদ্দেশ্য, তখন সে আমার সঙ্গে সব জায়গায় যেতে চাইল। এঞ্জেলারও তাই মতলব। তার এক বন্ধু, প্রফেসর উইলিয়ামস কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে গণিতশাস্ত্র পড়ায়। আমরা সবাই সমবয়সী। সহজেই ভাব হল। এরা সবাই মিলে দল করে বলল, এস দেশটাকে আবিষ্কার করা যাক। কেন জানি না আমাকে তাদের দলের নেতা বানিয়ে দিল। দলে আরেকজন জুটল, তার নাম সুশান। তার জীবন সম্বন্ধে দু-চার কথা বলছি। সুশান বাবা-মার একমাত্র কন্যা। বয়স ২৩, সুশানের বয়স যখন পাঁচ, তখন রাশিয়া থেকে বিদ্রোহের সময় তার মা-বাবা লন্ডনে চলে যায়। দেশের অনেক কথা শুনেছে মা বাবার কাছে। কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের কথাও শুনেছে বড় হয়ে স্কুল-কলেজে পড়ে। সব জায়গায়ই সে ইংল্যান্ডের লোকেদের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি ঘৃণা লক্ষ করেছে। তার ফলে সে ঠিক করল যে রাশিয়া, তার মাতৃভূমিকে দেখতে হবে, ইনট্যুরিস্টের সাহায্যে। মস্কো পৌঁছেছে সবেমাত্র। সে আমাদের দলে ভিড়ল। তার মা-বাবা ভয় দেখিয়েছিল যে রাশিয়ায় তাকে বন্দী করে রাখবে। এ পর্যন্ত আটক হওয়া তো দূরের কথা বরং সব দেখে শুনে সে উচ্ছ্বসিত।
আমাদের কাউন্সিল বসল, কে কী দেখতে চায় সে সম্বন্ধে ঠিক করে মস্ত বড় লিস্ট হয়ে গেল। প্রথমেই পাড়ার কাছে হাই স্কুলে যাওয়া এবং ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বসে তাদের পড়াশোনার মাপকাঠি ঠিক করা। আমরা পাঁচজন স্কুলে ঢুকে প্রথমেই হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করলাম এবং মতলব জানালাম। তিনি খুব খুশি হয়ে বললেন, যে কোনও ক্লাসে গিয়ে বসতে পারি, বাড়িটা চারতলা।
আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স বুঝে একটা বড়দের ক্লাসে ঢুকলাম। হেডমাস্টার সেখানে টিচারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্কের প্রশ্ন ছিল, সেটা ছেলেমেয়েরা খাতায় লিখে কষছিল। ব্রাউন ও উইলিয়ামস দুজনেই বিভিন্ন জায়গায় খাতার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল। বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে সহজেই কষে ফেলল। তখন দুজনেই বিচার করতে আরম্ভ করল, এই ধরনের অঙ্ক আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের কোন বয়সের ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে উপযুক্ত। দেখা গেল বয়স ও ক্লাস ইংল্যান্ডের মতোই। তবে ছেলেমেয়েরা মেধাবী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
আরও একটা ক্লাসে গেলাম এবং সেখানের ছাত্র-ছাত্রীরা অপেক্ষাকৃত কমবয়সের বলে আমরা তাদের মধ্যে গিয়ে বসলাম। ক্লাসের পড়া শেষ হবার পর আমরা উঠলাম। তখন একটি ছাত্রী বলল যে আমরা কে কোন দেশের লোক সে সম্বন্ধে কিছু বলতে। মেয়েটি খুব সপ্রতিভ। অধ্যাপক ব্রাউন বেশ গুছিয়ে ছোট্ট অল্প কথায় আমেরিকান স্কুলের ছেলেমেয়েদের কথা বলল। তারপর মস্ত প্রশংসা করে বলল যে রুশীয় স্কুলের ছেলেমেয়েরা বরং এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। সুশান তর্জমা করে দিল।
স্কুল পরীক্ষা করতে গিয়ে সারা সকাল কাটল। বিকালে একটা ক্ৰেশ দেখতে গেলাম শহরের বাইরে একটা নগণ্য গ্রামে। ছোট ছোট গুড়গুড়ে ছেলেমেয়েরা একটা কাঠের ঘরের চারদিকে আপনমনে বসে রয়েছে। একটি তরুণীর ওপর তাদের দেখাশোনার ভার। মনে হল সে একটা গল্প বলছিল বাচ্চাদের। তাদের জন্য একটা ঘরভর্তি ছোট ছোট খাট আছে। খাওয়া, খেলা এবং তার মধ্যে যাতে বুদ্ধির বিকাশ হয় সে বিষয়ে চেষ্টা আছে। তরুণীর সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করে আমরা সেই গ্রামের একটা মিডল স্কুল দেখতে গেলাম।
তখন সেখানে ড্রিল হচ্ছিল। এই স্কুল বাড়িটা কাঠের কিন্তু মস্ত বড়। বেশ সুষ্ঠুভাবে ড্রিল করছিল ছেলেমেয়েরা, তাদের কোনও ইউনিফর্ম ছিল না কিন্তু সবাই বেশ পরিপাটি। ড্রিল মাস্টার একজন ভদ্রমহিলা, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কে। আমাদের মধ্যে দুই প্রফেসর দেখে, ভদ্রমহিলা আগ্রহ করে আমাদের ডাকলেন। এদেশে স্কুল-কলেজে পড়তে কোনও খরচ লাগে না, তাই শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি এবং ব্যাপকভাবে।
সন্ধ্যা হয়ে এল। আমরা গ্রামের কাঁচারাস্তা ধরে যেখানে পড়বার জন্য ছেলেমেয়েরা একত্র হয় সেই ওপেন এয়ার লাইব্রেরি দেখতে গেলাম। মনে হল গ্রামের সবাই সেখানে উপস্থিত। কাগজ, ম্যাগাজিন, বই— অবিশ্যি রুশ ভাষায় লেখা, সবার কাছে। সবাই আগ্রহ ভরে পড়ছে।
গ্রামে এখনও সেই আগের আমলের কাঠের ছোট ছোট বাড়ি আর কাঁচা রাস্তা দেখা যায়। জল সরবরাহ করছে ভারী দিয়ে জল বয়ে এনে। এখানেও ভাঙা গড়ার কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। নদী থেকে শোধিত জল দুমাসের মধ্যে গ্রামের সব অঞ্চলে পাবে, তার বিরাট আয়োজন চলছে।
আসল লাইব্রেরি দেখতে গেলাম একটা পুরনো বাড়িতে। সেখানে ছেলেমেয়েরা ভিড় করে বই নিচ্ছে, দিচ্ছে অথবা পড়ছে। এত বই পড়ার আগ্রহ আমি আগে কোথাও কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অধ্যাপক ব্রাউন বলল, এ একটা আশ্চর্য ঘটনা, এরকম অনুসন্ধিৎসা সাধারণ লোকেদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না, বিশেষ করে একটা নগণ্য গ্রামে।
লাইব্রেরিয়ান আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোন দেশের লোক। আমি ভারতীয় এবং বাঙালি শুনে বললেন যে রবীন্দ্রনাথের তিনখানা বই ইংরিজি থেকে রুশ করে তর্জমা করা হয়েছে। তাদের চাহিদা এত দেখা গিয়েছে যে রুশ গভর্নমেন্ট নির্দেশ দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের সব বই তর্জমা করা হবে বাংলা থেকে। সুবিধা হলেই উৎসাহী মহিলা কিংবা পুরুষকে পাঠানো হবে কলকাতায়। তারা ভালোভাবে শিখে মূল বাংলা থেকে রুশ ভাষায় তর্জমা করবে।
সুষ্ঠুভাবে এই কাজ শুরু করবার আগেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ লেগে গেল এবং রাশিয়ার ঘোর বিপর্যয়ের সময় এল। সামলে উঠে রুশীরা পূর্ব পরিকল্পিত কাজ সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। এক ভদ্রমহিলা আমাদের দেশে আসেন রবীন্দ্রসাহিত্য অনুধাবনের জন্য এবং কিছুকাল এখানে থেকে তর্জমা করতে আরম্ভ করেন। মৈত্রেয়ী দেবী তাঁকে খুব সাহায্য করেন। তার ফলে আজ রাশিয়ায় সর্বত্র লক্ষ লক্ষ রবীন্দ্রসাহিত্যের বই ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছে। খুব কম বিদেশি লেখকেরই এত বই রুশ ভাষায় ছাপা হয়েছে বলে শুনেছি।
এ পর্যন্ত আমরা যতটুকু দেখেছি তা আমাদের মুগ্ধ করেছে। এঞ্জেলা ও সুশান খুবই গর্ববোধ করছিল। দুই প্রফেসর লোক ভালো, তাই উৎসাহের সঙ্গে সব গ্রহণ করতে পারছিল। আমি ছবি তুলতে ব্যস্ত।
রাশিয়াতে আমরা অনেক কলকারখানা দেখলাম। অনেক জিনিস নজরে পড়ল, যেমন ক্যামেরা, ক্যাপস্টান, লেদ ইত্যাদি যা জার্মান লাইকা ক্যামেরার ও বিলেতি লেদের হুবহু অনুকরণ। একজন রুশ যুবক আমাকে জানাল যে এ সব নকল। রাশিয়া কপিরাইট মানবে না বলল। আরও বলল যে কপিরাইটের দোহাই দিয়ে কেউ রাশিয়ার অগ্রগতি ব্যাহত করতে পারবে না।
রাশিয়ান ক্যামেরা দিয়ে আমি ছবি তুলে দেখেছি তারা জার্মান ক্যামেরার চেয়ে কোনও অংশে নিকৃষ্ট নয়। কপিরাইটের দোহাই দিয়ে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনী শক্তিকে খর্ব করা হয়েছে এবং এর ফলে পৃথিবীর প্রগতি ব্যাহত হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সারাদিন ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে মস্কোতে ফিরলাম সন্ধে সাতটায়। খুব তেষ্টা পেয়েছিল বলে একটা রেস্তোরাঁতে ঢুকলাম। আমরা বিদেশি দেখে ম্যানেজার নিজেই এগিয়ে এল এবং আমাদের সবচেয়ে ভালো জায়গায় বসতে দিল। আমরা সবাই মদ অর্ডার দিলাম। বছরের এই সময়টায় টাটকা আঙুরের রস পাওয়া যায়। বেশি অ্যালকোহল থাকে না বলে রস কয়েকদিনের বেশি ভালো থাকে না।
রেস্তোরাঁর একপাশে ছোট্ট একটা স্টেজ ছিল। একটা কসাক বেশভূষা পরা ছেলে ও একটি তরুণী নাচছে। রীতিমতো কসরৎ করছে, দেখতে ভালো লাগল। অল্প সময়ের মধ্যে রেস্তোরাঁ স্ত্রী-পুরুষে ভরে গেল।
একটা নাচুনে সুরের মিউজিক হচ্ছিল। সবাই এক সুরে গান ধরল।
হোটেলে ফিরে ঠিক করলাম পরদিন শহর থেকে দূরে একটা কাপড়ের কল দেখতে যাব।
কালিনিন গ্রামের কাছে কারখানা, বেশ বড়, দিবারাত্র কাজ হচ্ছে। ২,৫০০ লোক কাজ করছে। মেয়েরাই বেশি। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে সমস্ত যন্ত্র চাকার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কারণ জিজ্ঞেস করে জানলাম যে রুশীরা মনে মনে জানে পশ্চিমদিক থেকে একদিন না একদিন জার্মানি তাকে আক্রমণ করবে, তখন সব মেশিন তুলে নিয়ে উরাল পাহাড়ের ওপরে চলে যাবে এবং সেখান থেকে যুদ্ধ চালাতে হবে।
এই কারণে নিজেকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য রুশ অসংখ্য ট্যাঙ্ক তৈরি করেছে। আমি অল্পদিন রাশিয়াতে থেকেছি কিন্তু আমার চোখে এটি স্পষ্ট, রাশিয়াকে যে আক্রমণ করবে সে ভুল করবে।
এঞ্জেলা ও সুশানকে ওরা দুটো বড় রুমাল উপহার দিল।
দুপুরবেলায় লাঞ্চ খাবার সময় কর্মীরা আমাদের নেমন্তন্ন করল তাদের ক্যান্টিনে খাবার জন্য। সারি সারি মেয়েদের মধ্যে আমাদের বসবার স্থান হল।
খাবার খুব আড়ম্বরবিহীন। আলুসেদ্ধ, এক টুকরো মাংস এবং কালো রুটি, বাঁধাকপি নুনে জারানো। সবাই ভালোবেসে খেল।
সুশানের খুব সুবিধা। সে রুশ ভাষায় অনবরত বক বক করছিল শ্রমিকদের সঙ্গে। সাত ঘণ্টা ডিউটি হয়ে গেলে কর্মীরা নানা কাজে চলে যায়। অনেকে পড়াশোনা করে। এ যেন একটা নতুন দেশ, সমুদ্রমন্থন করে চলেছে। সপ্তাহে দুদিন ছুটি সবাই পাবে। রবিবার একটি নির্দিষ্ট দিনে সবার ছুটি হয় না। সারা সপ্তাহ কারখানা চলে, তার মধ্যে কর্মীরা প্রত্যেকে বিভিন্ন দিনে দুদিন করে ছুটি উপভোগ করছে।
ক্লান্ত হয়ে রাত্রে হোটেলে ফিরলাম। ঠিক হল পরদিন কোনও প্রোগ্রাম না করে যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাব। শহরের বাইরে, তারপর যা মন চায় দেখব।
প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে একটা মেঠো পথ ধরে চলেছি। দুধারে গমের খেত। তার মাঝখানে একটা ছোট্ট ঝুপড়ির মধ্যে এক বৃদ্ধ বসে বসে ফসল পাহারা দিচ্ছিল, যাতে পাখিরা সব না খেয়ে যায়। আমরা মাঠের রাস্তা ছেড়ে খেতের ওপর দিয়ে সেই বৃদ্ধের কাছে পৌঁছলাম। লোকটি বেশ শান্ত প্রকৃতির। আমরা পাঁচজন বিদেশি রাশিয়া দেখতে এসেছি শুনে খুব আনন্দিত হল। বার বার বলল, আমার দেশটা মস্ত বড়। একেক দিক একেকরকম। সুশান তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। আমরা জমির মালিকানা নিয়ে অনেক প্রশ্ন করলাম। সে বলল যে সামনের দুটো খেত ছোট ছোট এবং মেশিনে চাষবাসের উপযুক্ত নয়। সেজন্য সেই জমির স্বত্ব মালিকের। ফসল কো-অপারেটিভে জমা দেয়। ইচ্ছে করলে একই দরে সে অন্যদের কাছে বেচতে পারে।
পাশের গ্রামে কোলখজ বা জাতীয়করণ করা হয়েছে চাষবাসের জমি। আমরা দেখতে গেলাম কীরকম বিরাটভাবে চাষের কাজ চলছে। পাশাপাশি গো-পালন আছে, মেশিনারির সাহায্যে সব কাজ হচ্ছে।
এখানে আমাদের কমিউনিটি কিচেন দেখবার সুযোগ হল। সবার জন্য কিচেনে রান্না হয়েছে। ভালো স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাওয়া যায়। এখানে কাউকে বাড়িতে রাঁধতে হয় না। আমাদের দেশে রোজ উনুন ধরাতে, বাজার করতে, কুটনো কুটতে এবং রাঁধতে যে অফুরন্ত সময় চলে যায়, সেটা থেকে বাঁচবার একটা পথ বের করেছে এদেশে। লোকেদের স্বাস্থ্য ভালো। এদিকে কর্তৃপক্ষের খুব সতর্ক দৃষ্টি। লক্ষ করেছি যে খাবার টেবিলে শাকসব্জি, মাংস, দুধ, ফল ইত্যাদির দ্রব্যগুণ হিসেব করে ছোট ছোট লিস্ট দিয়েছে, প্রত্যেক লোককে ডাক্তার পরীক্ষা করে বলে দেয় তার শরীরে কোনও ভিটামিনের অভাব আছে কিনা। সেইমতো খাবার পছন্দ করে খেলে অর্থাৎ ভিটামিনের অভাব অনুসারে সেটা পুরোমাত্রায় খেলে স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে। ডাক্তারের খরচ লাগে না। বৃদ্ধ বয়সে কাজ থেকে বিশ্রাম নিলে কিংবা কাজে অপারগ হলে বৃদ্ধদের আবাসে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
এই রকম হোম খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একটা বাড়িতে গিয়ে দেখলাম বাগানে ডেক চেয়ারে সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বসে রয়েছে। প্রয়োজন হলে নার্স এসে সাহায্য করবে। মোটামুটি দেখলাম এদেশে পড়তে খরচ লাগে না, অসুখে খরচ নেই, বুড়ো বয়সে হোমে থাকবে বিনা খরচায়।
লোকেদের ভবিষ্যতের জন্য দুর্দিনের জন্য সংস্থান করবার কথা ভাবতে হয় না। তাই রোজগারের সবটাই খরচ করতে কোনও বাধা নেই। যে দেশে সাধারণের মঙ্গলের জন্য কর্তৃপক্ষ এতদিকে দৃষ্টি রাখে সে দেশ পৃথিবীতে ধন্য। তার স্থান সবার ওপরে। শেখবার জন্য, আবিষ্কার করবার জন্য স্কুল-কলেজ ও কারখানার দ্বার সব সময় উন্মুক্ত।
রাশিয়ানদের মনে হয়েছে যে দেশ তাদের জন্য এত করে, প্রতিদানে তারা তার দেশের জন্য কী করতে পারে? অনেকে ছুটির সময় শ্রমদান করে। তাদের যাতায়াতের রেল বাসের টিকিট লাগে না। বিনামূল্যে পাস দেখিয়ে চলতে পারে।
যৌথ খামারে সুশান ও এঞ্জেলা অফুরন্ত প্রশ্ন করে গেল, লোকেরা হাসিমুখে উত্তর দিল। সুশান বলল যে এতদিন সে তার বাবা মার কাছে যা শুনেছে রাশিয়ান শ্রমিক সম্বন্ধে, সেসব ভুল। এখন সে রাশিয়াতে বরাবরের জন্য থাকতে চায়।
সন্ধ্যাবেলায় মস্কো রেডিওতে আমার ভ্রমণ সম্পর্কে ইন্টারভিউ হল। সবার শেষে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমার রুশ দেশ কেমন লাগছে।
শুনলাম সাক্ষাৎকার খুব ভালো হয়েছে।
একদিন পরে আবার আমার নিমন্ত্রণ হল রেডিওতে বলবার জন্য। বিষয় হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা ভাষা। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাংলা ভাষার জন্মদাতা, সেজন্য আমি রবীন্দ্রনাথের জীবনের ওপর কিছু বললাম। পরে হৃদয় আমার নাচেরে’ কবিতাটি আবৃত্তি করলাম এবং শেষে একটা গানও গাইলাম। দুদিনে ১,০০০ রুবল লাভ হল।
আমার কাজ ছবি তোলা। যা ভালো দেখি, যা লোককে দেখাবার উপযুক্ত, সে সবের ছবি তুলছি। আরেকদিন বলশয় থিয়েটারে গেলাম।
আরও দুদিন মস্কো শহরে কাটালাম। তারপর যে যার দেশে চলে যাবার পালা। কার ওপর কীরকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে বেশ বোঝা গেল। প্রফেসর ব্রাউন ও এঞ্জেলা একেবারে উচ্ছ্বসিত। তারা চায় সমস্ত পৃথিবী রাশিয়ার অনুকরণ করুক। অধ্যাপক উইলিয়ামস ও আমি সব জিনিস দেখলাম, শুনলাম এবং মনে মনে তারিফ করলাম। সুশানের তো কথাই নেই। সে মনে করছে যে নিজের দেশে ফিরে এসেছে। তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা মাটির টান বলে বোধ হল।
পরিণত বয়সে আমাদের পাঁচজনের কার কী হল মাঝে মাঝে ভাবি। আমরা ছাড়াছাড়ি হবার এক বছর পরে, আমি যখন ডেনমার্কে তখন আমার একটি লন্ডনের বন্ধু রঞ্জিতকুমার সেনের (টুলু) কাছ থেকে একদিন চিঠিতে জানলাম, এঞ্জেলা আর ইহজগতে নেই। সে স্পেনে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডের হয়ে জেনারেল ফ্রাঙ্কের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েছিল, সেখানেই মারা গেছে লড়াইয়ে। ব্রিগেড ছিল, যাদের কমিউনিজমের প্রতি সহানুভূতি আছে তাদের নিয়ে গড়া। বলা বাহুল্য যে এরা বেশিরভাগই মারা পড়েছিল ফ্রাঙ্কোর সৈন্য ও গোলাগুলির আঘাতে। এঞ্জেলার কথা চিরদিন মনে থাকবে। আদর্শবাদী মেয়ে ছিল, আদর্শের জন্য সে প্রাণ দিল।
আমি দক্ষিণে কিয়েভের পথ ধরলাম। ইউক্রেন সমতল দেশ। রাস্তার অবস্থা যুদ্ধের ফলে খারাপ হয়ে গিয়েছে। তবু সাইকেল চালানোর পক্ষে খুব অসুবিধা ছিল না। পথে পাঁচদিন লাগল। ছেলেদের ক্লাবে বেশিরভাগ রাত্রে আশ্রয় নিয়েছি। একদিন এক চাষীর বাড়ি উঠলাম। চাষবাস জাতীয়করণ হয়েছে কিন্তু মাঝে মাঝে ব্যতিক্রমও রয়েছে। এই চাষীকে তার ব্যক্তিগত চাষের জমিতে ফসল ফলাবার হুকুম দেওয়া হয়েছে। কো-অপারেটিভের কাছে তার সমস্ত গম বিক্রি করতে হয়। চাষীটি খুব ভালো মানুষ। জার-এর যুগেও সে চাষ করেছে। বলল যে আগে চাষ করত সে এবং ফল ভোগ করত জমিদাররা। এখন সেই অবস্থা ঘুচেছে। চাষীর বাড়িতে পিয়ানো, রেডিও, ট্রাক্টর ইত্যাদি রয়েছে।
একেবারে দক্ষিণে, ব্ল্যাক সীর ধারে ওডেসা শহর। গ্রিক যুগ থেকে এই শহরটি দাঁড়িয়ে আছে। এখনও গ্রিক আমলের সাক্ষ্য দেয় বিবলিওয়েট অর্থাৎ লাইব্রেরি। ওডেসা শহরের মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা খোলা চত্বর আছে। সেখানে হাটবারে হাজার হাজার গরু হাত বদল হয়।
রাশিয়া যুদ্ধের পর বিরাট দেশটার সর্বত্র ভালো করে উঠতে পারেনি। সবদিকে চওড়া পাকা রাস্তা তৈরি আরম্ভ হয়েছিল। ইতিমধ্যে ব্যবস্থা হল, ভারবাহী এরোপ্লেনে সবাই দূর জায়গায় যাতায়াত করবে। এমনকী প্লেনে গরু, ঘোড়া ও ছোট ছোট গাড়িও। ওডেসায় দুদিন কাটিয়ে একটি গ্রিক জাহাজ ধরলাম গ্রিসে পৌঁছবার জন্য। জাহাজটার নাম পিরায়ুস। জাহাজটা খুব ছোট, মাত্র ৫,০০০ টনের দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের কূলে কূলে পণ্য সম্ভার দেওয়া-নেওয়া করে।