১৫
শীতের মুখে ইউরোপের উত্তর-প্রধান দেশে যাবার ইচ্ছা ছিল না, তবু তার আমন্ত্রণ এড়ানো গেল না। কথা রইল এক সপ্তাহকাল অন্তত ইয়ার্লের বাড়িতে থাকব। আমার থাকাকালীন এলিসও সেখানে গিয়েছিল, বিশেষ করে কাই নিলশেনের ভাস্কর্য দেখবার জন্য। অপূর্ব তার কাজ! লোকে তাঁকে বলে মিকেল অ্যাঞ্জেলো অব দি নর্থ। বেলজিয়াম হয়ে আমি ডুসেলডর্ফ ও ব্রেমেন ছেড়ে ল্যুবেক থেকে জাহাজ নিয়ে ডেনমার্কের কোপেনহাগেন শহরে পৌঁছলাম।
টেলিফোন যোগে আক্সেল ইয়ার্লকে আমার পৌঁছনোর খবর জানালাম। তারপর রাত প্রায় দশটায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে হিলেরয়েড শহরে গেলাম। সেখান থেকে চার মাইল দূরে স্ট্রয়েডামে যখন হাজির হলাম দেখি মিঃ ইয়ার্ল বাড়ির সব আলো জ্বেলে আমার জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। আমাকে পুরনো বন্ধুর মতো সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।
ডিনার শেষ করে দোতলার একটি প্রশস্ত ঘরে থাকবার জায়গা পেলাম। ইয়ার্ল সকাল সাড়ে ছটার সময় আমাকে প্রস্তুত থাকতে বললেন। প্রাতরাশ সেরে সোফিনবার্গে ডেয়ারি ফার্ম দেখতে যাবার কথা ঠিক হল।
স্ট্রয়েডাম বাড়িটার নাম। শত শত একর জঙ্গল, মাঠ, জলাশয় ইত্যাদি ঘেরা। বাড়ির সংলগ্ন বাগান দেখবার মতো। স্ট্রয়েডাম দেখলে মনে হয় ভূস্বৰ্গ। বাড়িটা বিরাট। জানলার বাইরের দৃশ্য অপূর্ব।
প্রথম রাত্রে স্ট্রয়েডামে আমার যা অভিজ্ঞতা হয় তা কখনও ভুলব না। প্রকাণ্ড বড় বসবার ঘরে ঢুকেই সামনের দেওয়ালে অজন্তার পদ্ম হাতে নারীর ছবিটি জীবন্তের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথার ওপর অজন্তার গন্ধর্ব যাত্রা বেশ বড় করে আঁকা রয়েছে। এই দুটো কাজই অসাধারণ সুন্দর, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমি অবাক হয়ে দেখছি দেখে ইয়ার্ল হাসলেন। তারপর সুদূর ডেনমার্কের নিভৃত স্ট্রয়েডামে কেমন করে কোথা থেকে এল জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, কাল সব কথা হবে। এখন হাত ধুয়ে নাও, খাবার তৈরি। খাবার ঘরে ঢুকে আরেকবার আশ্চর্য হলাম। দেওয়াল জোড়া তাজমহল, চাঁদনি রাতে আঁকা। আরও ভারতবর্ষের নানা বিষয়ের পেন্টিং দেওয়ালে ঝুলছে। আমার কাছে মস্ত একটা হেঁয়ালি মনে হল।
ইয়ার্ল বললেন, আমি বুঝতে পারছি তোমার আমার মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হবে! আজ থেকে আমি তোমাকে বিমল বলে ডাকব, তুমি আমাকে আকসেল বলে ডাকবে। প্রথমটা আমার সঙ্কোচ লাগত। আমার বয়স ২৭, আকসেলের বয়স ৬০। পরে অভ্যাস হয়ে গেল এবং যে গভীর বন্ধুত্বের ইঙ্গিত শুনেছিলাম তা গভীরতম আত্মীয়তায় পৌঁছেছিল। অনেক রাত হয়েছিল বলে প্রথম দিনই মিসেস ইয়ার্লের সঙ্গে পরিচয় হল না। আমার মনে হয় তিনি অপেক্ষা করছিলেন আমার সম্বন্ধে তাঁর স্বামীর মন্তব্য জানবার জন্য।
পরদিন সকালে প্রাতরাশ খাবার জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা হয়েছিল। মিসেস ইয়ার্ল আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বৃদ্ধার চেহারা রানির মতো, দেখলে ভয় ও ভক্তি দুইই হয়। তিনি প্রথমেই বললেন, আকসেলের সঙ্গে যেমন নাম ধরে ডাকবার সম্পর্ক পাতিয়েছি, তাঁর সঙ্গেও তেমনই হবে। অর্থাৎ তাঁকে ইয়ুটা বলে ডাকতে হবে। শুধু এইটুকুই এখন বলব যে ইয়ুটা আমার নিকটতম বন্ধু, মা ও বোনের স্থান অধিকার করেছিল,গভীর ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে।
পরদিন সাতটার সময় আকসেল ও আমি রওনা হলাম বাড়ির পিছনেই উপবনের ভেতর দিয়ে সোফিনবর্গ ডেয়ারি ফার্মের দিকে। সমস্ত পথটা, বড় বড় গাছের গা ঘেঁষে, কখনও ছোট বড় পুকুরের পাড় দিয়ে।
সোফিনবর্গে গিয়ে দেখি আকসেলের বিরাট জমিদারি। সেখানে চারশো সব চেয়ে ভালো জাতের গরু আছে। বারোটা বড় বড় ঘোড়া, অসংখ্য শুয়োর, কয়েক হাজার মুরগি বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে রয়েছে। আকসেলের কাজ হল সমস্ত ফার্মটা পরিক্রমা করা এবং লোকেদের সব কাজ যথাযথ বুঝিয়ে দেওয়া। ফার্মে চারটে অতিকায় ষাঁড় ছিল। তাদের নাম রেখেছিল জুলিয়াস, ব্রুটাশ, কায়াস ও সীজার। একেকটা ষাঁড়ের দাম ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এদের আলাদা একটা বাড়িতে রাখা হয়। ফার্মের চারদিকে ঘাস খাবার মাঠ আছে ভাগ ভাগ করা। কোনওটায় গরু, কোনওটায় ঘোড়া, ভেড়া ইত্যাদি ছাড়া হয় দিনেরবেলায়। তাছাড়া ছিল চাষের জন্য বড় বড় জমিতে লাঙল দেবার ব্যবস্থা। বাড়ি ও ফার্ম মিলে ১২০০ একর।
আমাদের দেশে বলদে লাঙল দেয়। ইউরোপে বড় বড় ঘোড়া এই কাজটা করে। ফার্মের জীবজন্তুর জন্য যাবতীয় খাদ্য নিজেরাই উৎপাদন করে। ডেয়ারি ফার্ম মানে কেবলমাত্র একটা বড় শেড ও একপাল গরু নয়। সব ফার্মের সঙ্গে অনেক জমিও আছে।
গ্রীষ্মকালে গরু ঘোড়াকে মাঠে ঘাস খেতে ছেড়ে দিলেই যথেষ্ট। শীতের সময় মাঠের ওপর সাদা বরফ প্রায়ই জমে থাকে। তখন মাটি খুঁড়ে বীট ও সব্জি বের করে জন্তুদের খেতে দেয়। আমরা গরুকে খড় খেতে দিই শুনে সবাই হাসে। বলে ওতে সার পদার্থ কতটুকু?
আমাদের দেশে কত গরু আঁস্তাকুড় থেকে কাগজ, চট, সব্জির খোসা ইত্যাদি খেয়ে দিন কাটায়, সে কথা না বলাই ভালো মনে করে চুপ করে গেলাম। আমরা গরুকে পুজো করি কিন্তু তার প্রতি কোনও যত্ন নিই না
শুয়োরের ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ছোট বয়স থেকে শুয়োরকে শেখানো হয় যাতে নির্দিষ্ট জায়গায় সে ময়লা করতে পারে। ডেনমার্কে শুয়োর কী খায় সেটা জানা ভালো। মাখন তুলে নেবার পর ঘোলটা শুয়োরকে খাওয়ানো হয়। সেই সঙ্গে আলু ও গম ভাঙা মেখে দিলে শুয়োর ভালোবেসে খায় এবং সে স্বাস্থ্যবান রোগমুক্ত জীব হয়। বেকন বা হ্যাম তৈরি করার আগে ল্যাবরেটরিতে দেখা হয় সে শুয়োর সম্পূর্ণ নীরোগ কিনা। শুয়োরকে মাঝে মাঝে পরিষ্কার কাদা মাটিতে খেলতে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে। এই কারণে পাশ্চাত্য দেশে শুয়োরের মাংস খাওয়ার প্রচলন খুব বেশি। অন্য মাংসের চেয়ে সুস্বাদু তো বটেই।
দুদিন পরে, আকসেলের শরীর অল্প অসুস্থ হল। আমার ওপর অনুরোধ হল যে সোফিনবর্গ ফার্মে গিয়ে সব জীবজন্তুর ও কর্মীদের খবর আনতে হবে। আমি একাই গেলাম এবং সব দেখে শুনে মন্তব্য লিখে দিলাম। আকসেল মহা খুশি। আমাকে উৎসাহিত করবার জন্য বলল, এবার থেকে তুমি রোজ রিপোর্ট দেবে। খুব ভালো হয়েছে।
আকসেল সেরে উঠল দুদিন পরে, কিন্তু আমি অসুস্থ হলাম। কেন জানি না পেটে ব্যথা অনুভব করছিলাম। ডাক্তার এসে বললেন যে গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়েছে, সময়ে না খাওয়ার জন্য বা অনেকদিন ধরে অনিয়ম করার জন্য। ডাক্তারের পরামর্শ হল যে ঠিক নিয়মমতো রোজ খুব সাদাদিধে খাবার ও দুধ খেতে হবে, সেই সঙ্গে ওষুধ। ব্যথা বাড়লে অস্ত্র ফুটো হবে এবং জীবন সংশয় হবার সম্ভাবনা। তখন অপারেশন অনিবার্য।
এই খবরটাতে আমার মন যত খারাপ হল, ইয়ার্ল পরিবার ততই খুশি, যে আমাকে আটকাতে পারা যাবে। অল্পদিনের মধ্যে এঁরা আমাকে এত ভালোবেসেছিলেন যে মনে হয় যেন সে গল্পের কথা।
ইয়ুটা সমানে বড় বড় আর্টিস্ট, বৈজ্ঞানিক, স্থাপত্য বিশারদ, কবি ইত্যাদিকে ডিনারে নেমন্তন্ন করে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন। এই বাড়িতে আমার ভাব হয় অনেকের সঙ্গে যেমন নীলস বোর (পরমাণু-বৈজ্ঞানিক), মেরিয়ান অ্যান্ডারসন (নিগ্রো জগদ্বিখ্যাত গায়িকা) এবং ডেনিশ রাজকবি হান্স হাটুয়িগ শেডর্ফ, পরিবার সহ এঁরা প্রায়ই আসতেন।
আমার পেটের ব্যথা কিন্তু না কমে বাড়তেই লাগল। তখন সবচেয়ে বড় ডাক্তার গ্রামকে ডাকা হল। তিনিও বললেন, সাবধানে, সুনিয়মে থাকার প্রয়োজন। সারতে অনেক সময় লাগবে। আমার মাথায় বজ্রপাত হল। শেষকালে ডেনমার্কে এসে কি আমার পৃথিবী ভ্রমণ শেষ করব?
দু-চারদিন শুয়ে থাকার পর আবার সোফিনবর্গে যেতে আরম্ভ করলাম। আমি যখন আটকা পড়েছি তখন আমি আকসেলকে জানালাম যে সোফিনবর্গে গো-পালন শিখব এবং সেখানেই থাকব। ইয়ার্ল পরিবার তাতে খুব খুশি কারণ আমি তখনই না বেরিয়ে কাজে মন দেব। একটি শর্ত করলেন, আমি যেখানে আছি সেইখানেই থাকব এবং খাব।
আকসেল প্যারিসে বিশ বছর পেন্টিং করেছে, তবু তার মন ভরেনি। ভারতবর্ষ তাকে টানল এবং সে এদেশের শিল্প সম্পদ দেখে মুগ্ধ। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যস্ত সমস্ত ঘুরে সে নানা বিষয়ের পেন্টিং করে।
আকসেলের সঙ্গে এদেশের বহু গণ্যমান্য আর্ট-উৎসাহীদের সঙ্গে আলাপ হয়। সাঁচি, তাজ, অজন্তা, ইলোরা ইত্যাদি দেখে সে আমার দেশকে ভালোবেসে ফেলে। স্যার জন মারশাল, হ্যাভেল, স্যার আকবর হায়দরি (যিনি নিজামের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন) ইত্যাদির সঙ্গে অনেক পরামর্শ হয়। বিষয়টা হচ্ছে কেন ভারতীয় ছেলেরা ফ্রান্সে ও ইতালিতে যায় শিল্প শিখতে যখন তার নিজের দেশে অমূল্য এবং অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। ফলে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল আর্টস প্রথম কলকাতায় জন্মগ্রহণ করল। আকসেল মনে করত একমাত্র বড় ভারতীয় আর্টিস্ট যিনি ঠিক পথে চলে সব চেয়ে উন্নতমানের পেন্টিং করেছেন, তিনি হচ্ছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।।
আকসেল ১৯০৩ ও ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে দুবার এদেশে অনেক দিনের জন্য আসে। যে সব অরিজিনাল ভারতীয় পেন্টিং দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, সেগুলি আকসেলের আঁকা। বাড়িতে অন্যান্য ঘরে আরও পেন্টিং ছিল। বেশিরভাগ একটা অন্য বাড়িতে রাখা ছিল। সব ছবি উঁচু মানের। আকসেল ফরাসি দেশে দীর্ঘদিন ধরে পেন্টিং করে টেকনিকটা খুব ভালো রপ্ত করেছিল আর তার সঙ্গে ভারতীয় বিষয়বস্তুর প্রতি গভীর অনুরাগ, এই দুই সমন্বয়ের ফলে তার পেন্টিং সত্যিই অপূর্ব।
অত উঁচু মানের পেন্টিং কিন্তু কখনও কোনও প্রদর্শনীতে আকসেল দেখায়নি। আকসেল বলে তার নিজের আনন্দের জন্য এঁকেছেন এবং তাইতে সে খুশি।
ছবির বাড়ির চাবি জোগাড় করে খুলে অমূল্য ভারতীয় পেন্টিংয়ের সমারোহ দেখেছি। ছবির সম্বন্ধে আলোচনা করতেও আকসেল নারাজ, যে ছবি স্ট্রয়েডামে টাঙানো আছে তাদের সম্বন্ধে একবার দু-চার কথার মন্তব্য শুনেছিলাম। যেমন ‘তাজমহল’ ছবিটা চাঁদনি রাতে আঁকা, এটা বৌদ্ধ ভিক্ষুর অনুরাধাপুরে আঁকা, ওটা স্যার আকবরের পুত্রবধূকে আঁকা, সেটা গুরুদাসপুর ‘গুরদোয়ারা’, এমনই এক কথায় তার বক্তব্য সে শেষ করত।
ভারতীয় জিনিসের প্রতি সৌন্দর্যবোধ যেমন পাশ্চাত্য দেশবাসীর মনে সহজে জাগে, আমাদের তেমন হয় না। হয়তো সারাক্ষণ দেখি বলে। কলাগাছের বিরাট বড় পাতা ইউরোপের কোনও গাছের হয় না। কলার ঝাড়ের পিছনে সূর্যাস্ত হচ্ছে, সেটা পেন্টিংয়ের একটা ভালো বিষয়বস্তু হতে পারে, আমাদের দেশের লোকেরা ভাবে না। যতবার ছবিখানি দেখেছে দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে ততবার আকসেলের মনে পড়ে কলাগাছের বড় পাতা, সেইসঙ্গে অস্তরবির বিচিত্র রং।
আকসেল এত বড় একজন দিগগজ মানুষ যে তার সম্বন্ধে লিখে কয়েকটা বইয়ের পাতা ভরানো যায়। আমি অল্প কিছু লিখছি, এই ভারতপ্রেমিককে জগতের কাছে জানাবার জন্য। একজন মানুষ একটা জীবনে কত বিষয় আয়ত্ত করতে পারে আকসেল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সে একজন ভাষাবিদ এবং লেখক। ভিশনে ব্লাডে বা ঝরাপাতা বইটা তার বহু আদৃত হয়েছে বিদ্বজ্জন সমাজে। ভাস্কর্যে তার হাত পাকা। কোপেনহেগেনের আর্ট গ্যালারিতে আকসেলের তৈরি স্ট্যাচু দেখা যায়। আমার একটা বাস্ট করেছিল। সেটা মনে হয় জীবন্ত।
পাখির সম্বন্ধে তার জ্ঞান সুগভীর। একদিন বাগানে বসে চা খাচ্ছি, একটা পাখির ডাক শুনে আকসেল বলল এ ডাক তো শুনিনি। বিমল তুমি চট করে লাইব্রেরিতে গিয়ে অরনিথলজির বইটা ও বাইনোকুলার নিয়ে এস। আমি বইটা এনে সামনে দাঁড়ালাম। আকসেল বলল, খোল ২৬৫ পাতা, দেখ তো এই সব কথার বিবরণ দেওয়া আছে কিনা পাখিটার সম্বন্ধে। এই কথা বলে বাইনোকুলার দিল আমার হাতে। আমি দেখলাম আকসেল যা বলল সেখানেও তাই। বইটায় আরও লেখা আছে যে এই পাখি ডেনমার্কে (জাটল্যান্ডে) অনেকদিন আগে একবার এসেছিল।
আকসেলের বাগানে এবং উপবনে সব গাছের সঙ্গে পাখির বাসা লাগানো আছে, তাদের ডিম পাড়তে উৎসাহিত করার জন্য। গরমের দিনে কত পাখি দেখা যায় তার ইয়ত্তা নেই। রাত্রে নাইটিংগেল পাখির গান শুনেছি। দিনেরবেলায় মাঠে লাঙল চালাবার সময় লার্কের ডাক শুনেছি এবং সে পাখি দেখেছিও।
শীতকালে বরফ পড়বার আগেই পাখিরা সব দক্ষিণে গরম দেশে চলে যায়।
যে সব পাখি স্ট্রয়েডামে জন্মায়, তাদের পায়ে রিং পরিয়ে দেওয়া হয়। সেই রিঙের গায়ে লেখা থাকে জন্মমাস ও ঠিকানা। পরে অনেক দূর দূর দেশে এমনকী আফ্রিকায় এইসব পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। পক্ষিবিদরা গতিবিধি লক্ষ করে লিখে রেখেছেন এবং তা বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়।
সোফিনবর্গ ফার্মের বার্ন হাউসের ওপর সারস পাখির জন্য বাসা করা আছে। শীতান্তে ভিক্টোরিয়া নায়ানজা হ্রদের কাছ থেকে অসংখ্য সারস পাখি উত্তর ইউরোপে এসে থাকে। সেখানে ডিম পাড়ে এবং বাচ্চাদের বড় করে, যতদিন না তারা আফ্রিকায় উড়ে যেতে সক্ষম হয়।
একদিন এক আশ্চর্য ঘটনা হল। বার্ন হাউসের কাছ দিয়ে আমি ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছি এমন সময় দেখলাম মা সারস পাখি তিনটে বাচ্চার মধ্যে একটার ঘাড় মটকে ছুড়ে ফেলে দিল। আমি ভাবলাম হয়তো বাসা থেকে পড়ে গেল তাই বাচ্চাটাকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে সেই উঁচু বার্ন হাউসের ওপর উঠলাম এবং বাসায় বাচ্চাটাকে রাখলাম, যেখানে অন্য দুটি বাচ্চা ছিল।
আমি ওপর থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে মা বাসায় ফিরে এল এবং সজোরে বাচ্চাটাকে নির্যাতন শুরু করল, যেন মেরে ফেলাই উদ্দেশ্য। তারপর ঘাড় বারবার মুচকে ছুড়ে ফেলল আবার।
বাচ্চাটা প্রায় জীবস্মৃত। তখনও প্রাণ আছে দেখে তুলে নিলাম এবং স্ট্রয়েডামে নিয়ে গেলাম ঘোড়ার পিঠে বসে।
হেমন্তে যখন সব পাখি দক্ষিণে উড়ে চলে গেল, সেই বাচ্চা আমার কাছে রয়ে গেল। পরে তিন ফুট বড় হল এবং ঘর থেকে ঘর ঘুরে বেড়াত।
একজন পক্ষিবিদ ঘটনাটি শুনে বললেন যে সারস দুটির বেশি তিনটি বাচ্চা পুষতে চায় না। খাবার জোগাড় কঠিনতর হয়। তাছাড়া বাসায় জায়গা হয় না। এই সব কারণে যে বাচ্চা দুর্বল, সে হয়তো আফ্রিকায় দূর পথে যেতে পারবে না, তাই তাকে মা মেরে ফেলে। পক্ষী জগতের নিয়ম নাকি এই
আমার পোষা বাচ্চার নাম দিলাম ভাইকিং। সে মস্ত বড় এবং সুস্থ দেহ নিয়ে বিজ্ঞ মানুষের মতো আমার পিছনে পিছনে চলত।
পরের বছর বার্ন হাউসের ওপর বাসায় ভাইকিংকে বসিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ফিরে দেখি আমার আগে ভাইকিং বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকদিন আমাকে বেশ বেগ পেতে হল বোঝাতে যে তাকে আমি বিশ্ব ভ্রমণে নিয়ে যেতে পারব না। তার স্থান অন্য পাখিদের সঙ্গে। আমিও এক সারস পাখির মতো কিছুদিন পরে দূরে চলে যাব তখন কে ওকে দেখবে?
আমি একটা বড় পেঁচা ও খেঁকশিয়াল পুষেছিলাম, পেঁচাটার খিদে পেলে মোটা গলায় ‘হু’ বলে ডাকত। খেঁকশিয়ালটা ডাকত না কিন্তু আমার কোলে পিঠে চড়ত।
স্ট্রয়েডামের এস্টেটের মধ্যে অনেক হরিণ ছিল। তারা যেখানে খুশি চলে বেড়াত। বাইরের জঙ্গলে চলে যাবার সম্ভাবনা ছিল না বললেও হয়, চারদিক অনেক মাইল উঁচু তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। রাত্রে বাড়ির বারান্দার ওপর হরিণ উঠে আসত মুখরোচক খাবারের খোঁজে।
দিনেরবেলায় জানলার বাইরে চাইলে সবুজ ঘাসের ওপর হরিণদের দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। ভারি সুন্দর দেখায়। একটা সিক্কা (এক রকম আফ্রিকান হরিণ) হরিণের সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল। প্রায় রোজ আমার হাত থেকে গাছের এক রকম শেকড় খেত। একদিন কী দুর্মতি হল জানি না, সে শেকড় না ঘেয়ে শিং দিয়ে মারবার জন্য ছুটে এল। অতি কষ্টে ধ্বস্তাধস্তি করে তার শিং ধরে ফেললাম। তারপর অপ্রীতিকর ঘটনা শুরু হল। যতই শাস্তি দিই না কেন, সে পরমুহূর্তে উঠেই আবার শিং নিয়ে তেড়ে আসে। শেষকালে হরিণের শিং ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে লোহার তারের জালের মধ্যে মাথাটা আটকে দিলাম।
জাল টপকে, দুই রক্তাক্ত হাত নিয়ে আকসেলকে সব ঘটনা বললাম। সে বলল যে সিক্কা হরিণ ঠিক পোষ মানতে চায় না,তাছাড়া মেটিং সিজনে ওদের মাথা খারাপ হয়। আকসেল তৎক্ষণাৎ তার শিকারি কর্মচারীকে হুকুম দিল সিক্কাকে গুলি করে মেরে ফেলবার জন্য।
আরেকবার একদিন সোফিনবর্গ ফার্ম থেকে মাঠের ওপর দিয়ে স্ট্রয়েডামে আকসেল ও আমি লাঞ্চ খেতে আসছিলাম। এমন সময় কালান্তক যমের মতো সীজার নামের ষাঁড় কোথা থেকে তেড়ে এল আকসেলকে গুঁতো মারবার জন্য। আমি শেষ মুহূর্তে আমার বুটসুদ্ধু একটা লাথি মারলাম সীজারের চোখে, খানিকক্ষণ বোধ হয় ভালো দেখতে পাচ্ছিল না এই অবসরে আকসেল মাটি থেকে উঠে বেড়ার দিকে ছুটতে লাগল আমি তখনই গিয়ে আবার চোখে লাথি মারলাম। সীজার ইতস্তত করছে, বুঝতে পারছে না কাকে তাড়া করবে। ইতিমধ্যে আকসেল গেট পার হয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছল, আমিও সুবিধা পেয়ে তারের জালের ওপর চড়ে বসলাম যাতে নাগাল না পায়। সীজার এমন ক্ষেপে গেছে যে মনে হচ্ছে যাকে দেখবে তাকেই শেষ করে দেবে।
আকসেল তখনও হাঁপাচ্ছিল। দুজনে আস্তে আস্তে বাড়ি গেলাম। শিকারির ডাক পড়ল, এবার সীজারের পালা। কিছুক্ষণ পরেই তার দেহ মাটির ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে। যার দাম ছিল ষাঁড় হিসাবে ১৫,০০০ টাকা সে মাংস হিসাবে বিক্রি হবে ৬০০ টাকায়। যখনই কোনও জন্তু হিংস্র হয়ে যায় তখনই তাকে মেরে ফেলা এদেশের নিয়ম। না হলে অন্য মানুষের জীবন সংশয় হবে।
ভারতবর্ষ থেকে একটা কলা গাছ, খেজুর গাছ ও বুগেনভিলিয়া আকসেল নিয়ে গিয়েছিল ডেনমার্কে। সবাইকে যত্ন করে সে হট হাউস (সারা বছর নব্বই ডিগ্রি উত্তাপের মধ্যে রাখত) দেখাত।
ফুলে ভরে বুগেনভিলিয়া মস্ত বড় হল কিন্তু কলা ও খেজুর গাছ তেমন বাড়ল না যদিও বেঁচে থাকল ভালোভাবেই। ফল ফুল কিছুই হল না এই দুটো গাছে। আকসেল তাদের সামনে গিয়ে নমস্কার জানায় এবং বিড় বিড় করে বলে,ভারতবর্ষের সঙ্গে তুমি আমার প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ। বেঁচে থাক, তাহলেই আমার আনন্দ ।
আকসেলের লাইব্রেরিতে ৫,০০০ বই আছে নানা ভাষার— তার মধ্যে ভারতীয় বিষয়ে লেখা স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও পেন্টিং সম্বন্ধে অনেক বই। দেখলাম ও সি গাঙ্গুলির লেখা বই আকসেলের খুব পছন্দ। নিয়মিতভাবে আমার দেশ থেকে তার কাছে বই পাঠানো হয়। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে নানা দুর্মূল্য বই লাইব্রেরিতে রয়েছে। সময় পেলে সে সব বই যথাসাধ্য দেখেছি।
আকসেল এক কালে ভারতবর্ষে গিয়েছিল বলেই যে আমার দেশকে ভালোবাসত, এমন নয়। আকসেলের ভারতপ্রেম নিত্য, শাশ্বত সদাজাগ্রত রূপ নিয়েছে। আমার সঙ্গে আলাপ তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে। আমি ভারতবর্ষের এক জীবন্ত মানুষ। আমাকে পেয়ে সে যেন নতুন করে ভারতবর্ষের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করল।
আকসেলের একটা রেসের ঘোড়া ছিল। একদিন বলল, এই ঘোড়া তোমাকে দিলাম। একে ভালোবেসো, যত্ন কর। ঘোড়াটির নাম প্রিন্স। কিং নাম যেন তাকে আরও বেশি মানাত। যেমন বড়সড় তেমনই সুন্দর দেখতে। বড় বড় চোখ দিয়ে আমার মুখের দিকে দেখত। খালি হাত দেখলে আমার ব্রীচেসের পকেটে নরম মুখটা দিয়ে ঘষত আর খুঁজত এক টুকরো চিনি। সে ভীষণ চিনি ভালোবাসত। আমি রোজ একটি কিউব তাকে খাওয়াতাম। এমনিভাবে আমাদের দুজনের মধ্যে গভীর বোঝাপড়া ও ভালোবাসা জন্মাল।
যখন বাড়ির সবাই ঘুমোত, আমি তখন প্রিন্সের ওপর স্যাডেল চাপিয়ে চড়তাম এবং রাস্তার ওপারে গ্রিপস্কভ জঙ্গল ও ছোট বড় টিলার ওপর প্রিন্স উদ্দাম ছোটাছুটি করত। একদিন ভোরবেলায় দেখি এক তরুণী ঘোড়া ছুটিয়ে আমার পিছু পিছু চলেছে। জঙ্গল যেখানে শেষ হল সেখানে থামলাম। পাশেই তরুণীও থামল, আমি গুড মর্নিং বললাম, নিজের নাম ও পরিচয় দিলাম। তরুণী বলল, তার নাম মিস স্কাউ অর্থাৎ মিস জঙ্গল। সে হেসে বলল যে প্রিন্সকে ভালোরকম চেনে, ইয়ার্লের প্রিয় ঘোড়া। আমি বললাম, প্রিন্স এখন আমার হয়ে গেছে।
আমি ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরলাম এবং মিস স্কাউয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা আকসেলকে বললাম। সে বলল যে মিস স্কাউয়ের তিনকুলে কেউ নেই। ওর মা বাবা মারা যাবার পর ওদের একটা বড়আস্তাবল ও দশটি রাইডিং ঘোড়া নিয়ে এক ট্রেনিং স্কুল খোলে। সারাদিন ঘোড়ার ওপরই থাকে। ভালো টিচার। যথেষ্ট রোজগার হয়। স্টেবলের একাংশে মিস স্কাউয়ের থাকবার জায়গা। সে দশটি ঘোড়াকে দেখাশোনা করে ও চোখে চোখে রাখে। নিজের রান্নাবাড়া করে, মনে হয় সুখেই “ আছে।
পরের দিন মিস স্কাউয়ের সঙ্গে আবার দেখা জঙ্গলের ভেতর। সেদিন অনেক দূর গেলাম। এই প্রকাণ্ড গ্রিপস্কভ জঙ্গলের সবটা তার নখদর্পণে। জঙ্গলে কোথাও পথ ছিল না, বার্চ ও পাইন গাছে ঠাসা। শত শত বছর ধরে পাইন পাতা পড়ে নিচেটা ঘোড়া চালাবার পক্ষে চমৎকার হয়েছিল। আমার কেবলই মনে হত একা গেলে হারিয়ে যাব গাছের মধ্যে। আগে বেশি দূর যাবার সাহস হত না।
রাইডিং সেরে মিস ফরেস্টের স্টেবল দেখতে গেলাম। আমি তাকে ফরেস্ট বলে ডাকতাম। দেখতে সে সুশ্রী, বয়স ২৪-২৫ হবে। আমাদের দেশে ভাবা যায় না যে একটি তরুণী একা ঘোড়ার স্টেবলে বাসা বেঁধে ঘোড়ার সঙ্গে জীবন কাটায় এবং রাইডিং লেসন্স দেয় ছেলেমেয়েদের, সে নির্ভয়ে থাকে এবং সবার সম্মানের পাত্রী।
যারা ঘোড়া নিয়ে চড়তে গিয়েছিল তারা একে একে স্টেবলে ফিরল। মিস ফরেস্ট প্রত্যেক ঘোড়ার গায়ে হাতে পায়ে হাত বুলিয়ে আদর জানাল, তারপর স্টেবলে যথাস্থানে ঘোড়াকে ছেড়ে দিল। সে একাই সমস্ত ঘোড়ার পরিচর্যা করত। ফরেস্টের নিজস্ব ঘোড়াটি খুব সুন্দর। সোনালি রং, ঘাড় ও ল্যাজের চুল সাদা সিল্কের মতো। তার নাম সীতা, আমার দেওয়া।
এয়ারফোর্সের একজন অফিসার, লেফটেন্যান্ট ইয়েনসনের সঙ্গে মিস ফরেস্টের স্টেবলে আলাপ হল। ইয়েনসন সবেমাত্র বিয়ে করেছে। তার বাড়িতে হিলেরয়েডে আমাকে চা খাবার নেমন্তন্ন করল।
আমি একটা রাইডিং ক্লাবে ভর্তি হলাম। প্রতি রবিবার স্ত্রী পুরুষ দল বেঁধে দূরে কোথাও যাওয়া এবং কফি খাওয়া আমাদের কাজ ছিল। অন্যদিন ভোরে গ্রিপস্কভ জঙ্গলে অনেকে রাইডিং করত। দলে সভ্য ছিল বাইশ জন। তাদের মধ্যে আমার খুব খাতির ছিল। অনেকদিন ক্যামেরা নিয়ে যেতাম, সুন্দর জায়গা দেখে ছবি তুলতাম। বাইশটি ঘোড়ার মধ্যে প্রিন্স সবচেয়ে বড় ও সুন্দর দেখতে ছিল। তার স্বভাবটাও ছিল চঞ্চল। ঘোড়ার ওপরে উঠে যত দূরে যাও যত উঁচু খড়ের ঢিবি লাফাও, কিছুতেই দ্বিরুক্তি নেই, কেবল দাঁড় করিয়ে রেখ না। মনে হত আমরা যাত্রাশেষে সদস্যরা মিলে যখন গল্প করতাম তখন প্রিন্সও গল্প করতে চাইত এবং পারত না বলে চটে যেত। সবাই প্রিন্সকে ভালোবাসত।
আমার দুদিন রাইডিং অ্যাকসিডেন্ট হয়। প্রথমবার স্যাডলের পেটের চামড়া ছিঁড়ে যাওয়াতে আমি মাটিতে পড়লাম। প্রিন্স বুঝতে পারল না, আমার কী হল। লাফালাফি শুরু করল আমার দেহের চারপাশে কিন্তু এখন সাবধানে তোলপাড় করল যে আমার আঁচড়টি লাগেনি। আরেকদিন জঙ্গলে দেখলাম গাছ পড়ে আছে এক জায়গায় অনেক। প্রিন্সের স্বভাব ছিল তাদের ওপর দিয়ে লাফিয়ে যাওয়া। দুটো গাছ এত কাছাকাছি পড়ে ছিল যে কেমন করে লাফাব আমি ভাবছি, এমন সময় প্রিন্স খুব জোরে ছুটে প্রথম গাছটি পার হল এবং পরমুহূর্তেই জাম্প করল দ্বিতীয় গাছটি পার হবার জন্য। আমি টাল সামলাতে না পেরে প্রিন্সের মাথার ওপর দিয়ে মাটিতে ছিটকে পড়লাম।
এমন বেকায়দায় হাতের একটা বুড়ো আঙুলের ওপর চাপ দিয়ে পড়লাম যে আমার হাত অবশ হয়ে গেল। কোনওরকমে উঠে দাঁড়ালাম। ঘামে প্রিন্সের সর্বাঙ্গ ভিজে গিয়েছিল, সে কাছে এসে কাঁধের ওপর মাথা রেখে দাঁড়াল। ভাবটা এই, আহা তোমার কি খুব লেগেছে?
অবশ হাত নিয়ে অনেকক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে হাঁটলাম, তারপর আস্তে আস্তে যখন একটু সহ্য করবার অবস্থা হল, প্রিন্সের ওপর কোনওমতে চড়লাম এবং বাড়ি পৌঁছলাম। বন্ধুরা দেখতে এল এবং সবাই বলল যে সাতবার না পড়লে কিংবা কলার বোন না ভাঙলে ভালো রাইডার হওয়া যায় না।
ইয়ুটা ডাক্তার ডেকে গরম জলের সেঁক দিয়ে এমন একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বাধাল যে সবার প্রাণান্ত। ডাক্তার বললেন, হাড় ভাঙেনি তবে মচকে গেছে। ডাক্তারও একজন রাইডিং ক্লাবের সদস্য। অনবরত ডেনিশ শুনতে শুনতে আমার কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি অল্প অল্প বলতেও আরম্ভ করলাম।
পেটের ব্যথার চিকিৎসা চলছে, অনেক কমেছে তবে সারতে দেরি আছে। খাওয়াদাওয়া খুব নিয়মিত এবং পরিমিত। আগে ছিল আমার উটের জীবন। যেখানে খাবার পেয়েছি, প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি খেয়েছি দুর্দিনের কথা ভেবে। আবার না খেয়েও অনেক দিন নিরম্বু উপবাসে কাটিয়েছি। পেটে খাবার পড়ছে না অথচ প্রাণপাত পরিশ্রম করছি, এইটেই আমার ডেওডেনাল আলসার হবার কারণ। দেড় মাস হয়ে গেল অথচ আমার আলসার সারেনি জেনে ইয়ুটা ও আকসেলের কী আনন্দ, তাহলে আমি বেশ আটকা পড়লাম। ডাক্তার বলছেন, ভ্রমণে বেরোলে মৃত্যু অনিবার্য
আকসেল বলেছিল, সোফিনবর্গ ফার্মে কাজ করার জন্য হাত খরচ পাব। আমার পক্ষে অনেক টাকা, কেননা থাকার, খাওয়ার কোনও খরচ ছিল না। ট্যুরের জন্য টাকা জমাতে আরম্ভ করলাম।
রোজ সকালে সোফিনবর্গে গিয়ে ঘোড়ার সাহায্যে লাঙল চালানো থেকে ফার্মিংয়ের জন্য কাজ, মুরগি, শুয়োর, ঘোড়া ও গো-পালন আমার ভালোই লাগত। আকসেল আমার জন্মদিনে একটা বড়, দুজন বসবার উপযুক্ত মোটরগাড়ি উপহার দিল। তার পেট্রোলের খরচ আমার লাগত না। আমার সম্পত্তি বাড়ছে দেখে আমি আতঙ্কিত হলাম।
একদিন সবচেয়ে বড় দর্জির ডাক পড়ল। সে এসে আমার মাপ নিয়ে গেল এবং দশদিন পরে ছটা দামি কাপড়ের স্যুট বানিয়ে নিয়ে এল। বড় বড় পার্টিতে যেতে হবে সেজন্য টেল কোট এবং সাধারণ ইভনিং ওয়্যার বা ড্রেস স্যুটও এল। আনুষঙ্গিক শার্ট, রুমাল ইত্যাদি কিছুই বাকি থাকল না।
ইয়ার্লদের কৃপায় অনেক বড় ও মাঝারি পরিবার থেকে আমি নিমন্ত্রণ পেলাম। চেনাশোনার পরিধি বেড়েই চলেছে। ডেনিশরা রীতিমতো ভদ্র ও শিক্ষিত জাতি। তারা দুটো জিনিস বিশেষ ভালোবাসে। মোমবাতি জ্বেলে ডিনার খাওয়া এবং সবরকম শিল্পকলায় আগ্রহ দেখানো। কেউ মিথ্যা কথা বলে না, চৌর্যবৃত্তি নেই বললেই চলে।
কয়েকটা ঘটনা মনে পড়ে যা থেকে ডেনিশদের সাধুতা ও সংস্কৃতি কত উচ্চমানের বোঝা যায়। একদিন আমি ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের পথে চলেছি। একটা পাথরের ওপর ইট চাপা দেওয়া কাগজ ও টাকা ভরা খাম আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ঘোড়া থেকে নামলাম ও দেখলাম একটা ছোট্ট চিঠি লেখা রয়েছে, এই সংলগ্ন খামটি পোস্ট অফিসে দয়া করে জমা দিও।
তিন মাইল দূরে আমি পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্টমাস্টারের সঙ্গে দেখা করে খামটা দিলাম। ব্যাপারটা জানবার জন্য অপেক্ষা করলাম। খামখানি খুলে পোস্টমাস্টার বললেন, এতে ত্রিশ টাকা আছে মানি অর্ডার করবার জন্য। এক বৃদ্ধা গ্যাদেভাং গ্রামে থাকে। আমরা প্রতি মাসে এই রকম পাই এবং যথাস্থানে পাঠাই।
ডেনমার্কে প্রচুর মাখন তৈরি হয়। সব ডেয়ারি থেকে বড় বড় টিনভর্তি দুধ নিয়ে মায়ারিতে কো-অপারেটিভ মাখন প্রস্তুত হয়। সেখানেই বেকন, হ্যাম তৈরি করবারও জায়গা। দুধে জল দেওয়ার কথা এদেশের মানুষের চিন্তার বাইরে। দুধ কত কত ঢালছে তা মাপবার লোকও নেই। যার দুধ সে লিখে দেয় এবং টিনভর্তি করে নিয়ে যায়। মাসের শেষে হিসাব হয় এবং ডেয়ারিকে সব প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে দেয়।
একবার এক দুর্মতিপরায়ণ চাষী জল মিশিয়ে মায়ারিতে দুধ ঢালতে লাগল। কিছুদিন পরে দেখা গেল মাখন কম হচ্ছে। মায়ারির লোকেরা অগোচরে প্রত্যেকের দুধ পরীক্ষা করতে করতে সেই ফার্মারকে বের করে ফেলল যে দুধে জল মেশাত। এটা এত বড় অন্যায় যে মায়ারির লোকেরা এবং কয়েকজন গভর্নমেন্ট অফিসার ফার্ম ইনস্পেকশনে গেল। প্রথমেই কত গরু আছে এবং তারা মোট কত দুধ দেয় তার হিসেব করে সবাই দেখল যে প্রত্যেক দিন ফার্ম থেকে অনেক বেশি দুধ মায়ারিতে সাপ্লাই হয়। অর্থাৎ জল মেশানো হয়।
ফার্মের মালিককে ডেকে একজন মায়ারির ইনস্পেক্টর তাকে জলের টিপকলের সামনে নিয়ে গেলেন এবং টিপকলের মুখে একটা বীট (গরুর প্রিয় খাদ্য) ঢোকাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। মালিক জিজ্ঞেস করল এটা কী হচ্ছে? ইনস্পেক্টর বললেন, তোমার যে গরু সবচেয়ে বেশি দুধ দেয় তাকে আদর করে বীট খাওয়াচ্ছি।
এই ঘটনা বিরল। সব ফার্মের লোকেরা মনে রেখেছে যে দুধে জল মেশানোয় দেশের ক্ষতি এবং আবালবৃদ্ধবনিতার ক্ষতি।
আমি এক চাষীর বাড়ি বেড়াতে গেলাম। সে খুব সমীহ করে তার বাড়ি দেখাল ও সবার সঙ্গে ডেকে আলাপ করাল। চাষী অবসর সময়ে ছবি আঁকে। ছবি খুব উঁচু দরের, আমি তার একটা ছবি আমার বাড়িতে টাঙাতে পারলে গর্ববোধ করতাম। চাষীর নাম ওলসন। সে ফরাসি ধরনে হাল্কা রঙের ছবি আঁকত।
আমাদের দেশের তুলনায় এদেশে জীবনযাত্রা অনেক উন্নতমানের। পোকামাকড়, আরশোলা, মাছি এবং মশার উপদ্রব নেই বলে দৈনিক জীবন অনেক আরামের
একজন নিগ্রো মহিলা গায়িকা, মিস মেরিয়ন অ্যান্ডারসনের গান একদিন শুনতে গেলাম কোপেনহাগেন শহরে। সবাই তার গান শুনে মুগ্ধ। সাধারণত মেয়েরা সরু গলায় গান গায়। কিন্তু ক্বচিৎ কখনও এমন গায়িকা দেখা যায় যারা সরু থেকে মোটা স্বর গাইতে পারে। তাদের কলোরাটুরা বলা হয়। মেরিয়ন অ্যান্ডারসন এই শ্রেণীর গায়িকা। মেরিয়ন যখন নিগ্রো স্পিরিচুয়াল গাইত তখন মনে হত একজন ছেলে গাইছে। তার আসল গলা, মেসো সোপ্রোনো এবং সেটা খুবই শ্রুতিমধুর।
পাশ্চাত্য সঙ্গীতে পল রোবসন যেমন পুরুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, মেরিয়ন অ্যান্ডারসন তেমনই স্ত্রীজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর দুজনেই নিগ্রো এবং আমার সৌভাগ্য যে দুজনের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়েছিল। মেরিন ও ইয়ুটা দুই বন্ধু। সে থাকতে এল স্ট্রয়েডামে এবং একটা গেস্টরুম তাকে দেওয়া হল। সারাদিন মেরিয়ন ও আমি কখনও বাড়ির সংলগ্ন বনে কিংবা বাগানে বেড়াতে যেতাম। কখনও তাকে পিয়ানোয় গান চর্চা করতে শুনেছি। অনেক সময় আমরা গল্প করে সময় কাটিয়েছি।
মেরিয়ন তার দেশে মা, বাবা আর বয় ফ্রেন্ডের গল্প করত। অনেকদিন দেশ ছাড়া। কয়েক বছর ধরে ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্সে সঙ্গীতচর্চা করছে। তারপর একদিন তার শিক্ষক পরামর্শ দিলেন এক সঙ্গীতের অনুষ্ঠান করতে কোপেনহাগেন শহরে। সেই প্রথম অনুষ্ঠানে ৫,০০০ লোক শুনতে এসেছিল এবং সেই রাত্রেই মেরিয়ান অ্যান্ডারসন পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়িকা রূপে সর্বজন-স্বীকৃতি পেল।
লেফটেন্যান্ট ইয়েনসেনকে আমি এরোপ্লেন চালানো শেখবার কথা বলেছিলাম। তারপর দুজনে কোপেনহাগেন শহরের কাছে কাস্ট্রপ এরোড্রোমে গিয়ে প্লেন চালানো শিখতে আরম্ভ করলাম ও কয়েক সপ্তাহের মধ্যে লাইসেন্স পেলাম। একদিন প্লেনটা নিয়ে সোফিনবর্গের একটা মাঠে নামলাম। গম চাষের মাঠ, আল নেই, তাছাড়া খুব এবড়োখেবড়ো নয়। আমি প্লেন থেকে নামবার পর আকসেল প্রথমেই এগিয়ে এসে কনগ্র্যাচুলেশন জানাল। তাকে প্লেনের ওপর উঠতে বললাম এবং অল্পক্ষণের মধ্যে এস্টেটের ওপর প্লেন উড়িয়ে ঘুরতে অরাম্ভ করলাম।
মাটিতে এসে নামবার পর আকসেলের এত স্ফূর্তি হল দেখে আমি খুব উৎসাহিত বোধ করলাম।
ডেয়ারি ফার্মে যাদের সঙ্গে কাজ করি তাদের একে একে সবাইকে ওপরে ঘুরিয়ে আনলাম।
সোফিনবর্গ ফার্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমার খুব সমাদর ছিল। তারা প্রায়ই নানা বিষয় বলবার জন্য আমাকে অনুরোধ করত। আমি ল্যান্টর্ন স্লাইড দেখিয়ে দেশ-বিদেশের গল্প বলতাম।
যেসব ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে করতে কোনও কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে তারা যাতে শিক্ষার গুণ লাভ করতে পারে, তাদের জন্য ডেনমার্কে ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুলে পড়ার পদ্ধতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। শিক্ষালাভ করবার একমাত্র উপায় আমরা জানি বই পড়া এবং লেখা। হাই স্কুলের টিচাররা এখন এমনভাবে পড়ান যে বই খাতার প্রয়োজন কম। একুশ বছর না হলে ছাত্র-ছাত্রী নেওয়া হয় না। নানারকম বিষয়বস্তুতে যাতে ছেলেমেয়েরা আগ্রহ দেখায় তেমনভাবেই পড়ানো হয়। হেডমাস্টারের নাম ক্রিস্টিয়ানসেন। তাঁর ব্যক্তিগত উৎসাহ এবং পঠনপদ্ধতি তাঁকে একজন বিখ্যাত লোক করেছে।
পৃথিবীর নানা দেশে এই হাই স্কুলে পড়াবার রীতি অনুকরণ করবার চেষ্টা হচ্ছে। কোনও কারণে লেখাপড়া ছাড়লে কোনও লোক যাতে মূর্খ হয়ে না থাকে, যাতে সে উচ্চশিক্ষা ও সংস্কৃতির স্বাদ পেতে পারে, তার জন্য এই স্কুলের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে।
ক্রিস্টিয়ানসেনের সঙ্গে দেখা করে হাই স্কুল সম্বন্ধে জানবার আগ্রহ দেখালাম। তিনি রাজি হলেন এক শর্তে যে আমি ইংরিজি পড়াব এবং দেশ-বিদেশের গল্প বলব নানা বিষয়ে।
স্কুলটা হিলেরয়েডের কাছেই। আমি সোফিনবর্গ ফার্ম থেকে ছুটি নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুলে থাকতে গেলাম। টিচারদের সঙ্গে আমার থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। সবার কাছে খুব ভদ্র ব্যবহার পেয়েছি। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আমার সময় ভালোই কাটত।
এক শনিবার বিকেলে আমি স্ট্রয়েডামে উইক-এন্ড কাটাতে গেলাম। হঠাৎ ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুল থেকে টেলিফোন এল যে একজন ভারতীয় ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতিতে আকৃষ্ট হয়ে দেখতে এসেছেন। নাম কী জিজ্ঞাসা করলাম, উত্তর পেলাম, মিঃ দূত। আমি আরও জানলাম তিনি কলকাতা থেকে আসছেন।
গাড়িটা নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুলে ফিরে গেলাম, ভাবলাম মিঃ দূতকে একবার দেখে আসি।
দরজা খুলে দেখি গুরুসদয় দত্ত মহাশয় বসে কী লিখছেন। আমাকে দেখে বললেন, আরে বিমল, তুমি এখানে পড়াও, আমি একবারও ভাবিনি। আমি বললাম, আমিও একবারও ভাবিনি দূত মানে আপনি। গুরুসদয় দত্ত মহাশয়কে পেয়ে আমি খুব খুশি। তাঁর ছেলের বয়স আমার চেয়ে কিছু ছোট হলেও দুজনের বন্ধুত্ব ছিল। এই সূত্রে তিনি আমাকে চিনতেন ও স্নেহ করতেন।
আমি ক্রিস্টিয়ানসেনের অনুমতি নিয়ে গুরুসদয় দত্ত মহাশয়কে বললাম, আমার সঙ্গে গাড়িতে উঠতে স্ট্রয়েডামে যাবার জন্য। কথা রইল দুদিন পরের সোমবার দত্ত মশায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভারতবর্ষের গল্প বলবেন।
আকসেল ও ইয়ুটার সঙ্গে দত্ত মহাশয়ের আলাপ করিয়ে দিলাম। তাঁরা সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। বাড়ির যে অংশে আমি থাকতাম সেখানে পাশেই আরেকটা শোবার ঘর ছিল। সেখানে সুটকেস নিয়ে গিয়ে রাখলাম। দত্ত মহাশয় মুখ হাত ধুয়ে নিলেন এবং সন্ধ্যা ছটার সময় নিচে একতলায় বসবার ঘরে উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁর প্রিয় ব্রতচারী নাচের কথা বললেন। এই নাচের ভেতর দিয়ে স্বাস্থ্য লাভ হবে এবং সেই সঙ্গে দেশত্ববোধও জাগবে। প্রশস্ত বসবার ঘরে ম্যান্টেলপিস ছিল একধারে। সেখানে ফায়ার প্লেসে কাঠের আগুন জ্বলছিল ধীরে ধীরে। সামনে একটা অতিকায় সাদা ভাল্লুকের বরফের মতো শুভ্র চামড়া পাতা ছিল। নভেম্বর মাস। মাঝে মাঝে বাইরে বরফ পড়ছিল। বেশ কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছিল, চারটের সময় বিকালে সূর্যাস্ত হবার পর থেকে। দারুণ শীতের আশঙ্কা করে দত্ত মশায় অনেকগুলি গরম জামা পরেছিলেন।
আমরা সবাই মিলে যখন বসবার ঘরে একত্র হলাম। আমি দত্ত মহাশয়ের বিশেষ পরিচয় দিয়ে বললাম যে তিনি একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী কিন্তু তিনি মনেপ্রাণে ভারতীয়, আমাদেরই একজন। ব্রতচারী নাচের কথা বললাম।
গুরুসদয় দত্ত মশায় সেদিন খুব খুশি মনে ছিলেন। তিনি কয়েকটি নাচের অর্থ বুঝিয়ে দিয়ে নাচ আরম্ভ করলেন। একটার পর একটা নাচছেন এবং একটা একটা করে গরম জামা খুলে ফেলতে লাগলেন। জ্বলন্ত কাঠের গুঁড়িটা থেকে আগুন ঘরটাকে গরম করে তুলেছিল, তার ওপর রাইবেশের তাণ্ডব নৃত্যে দত্ত মশায়ের গরম লাগছিল। তিনি পেঁয়াজের খোসার মতো জামাগুলি খুলে আরাম করে বসলেন।
আকসেলের সঙ্গে খাবার পর অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা হল কেমন করে লিগ অব নেশনসের মাধ্যমে পৃথিবীর সব দেশে ব্রতচারী নাচ চালু করা যেতে পারে। দত্ত মশায়ের তখন বেশ বয়স হয়েছে। অতক্ষণ ধরে কেমন করে নাচলেন সেকথা আজও আমি ভাবি। ডেনমার্ক ছেড়ে তিনি জেনেভা যাচ্ছেন ব্রতচারীর কথা জানাতে ও নাচ দেখাতে।
দুদিন গুরুসদয় দত্ত মহাশয়ের সঙ্গে নানা বিষয় গল্প ও আলোচনা করে কাটালাম। খুব ভালো লাগল।
সোমবার ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুলে দত্ত মহাশয়কে এক অভ্যর্থনা জানালেন ক্রিস্টিয়ানসেন। পাঁচশো ছাত্রছাত্রী উপস্থিত সেই হলে। তিনি অতিথির পরচিয় দিতে গিয়ে গৌরবময় ভারতবর্ষে অতীতের কথা তুললেন এবং প্রসঙ্গক্রমে সাবিত্রী সত্যবান উপাখ্যানটি বললেন। ক্রিস্টিয়ানসেন খুব সুন্দর করে গল্পের তাৎপর্য বোঝালেন ডেনিশ ভাষায়। তাঁর শেষ হবার পরেই গুরুসদয় দত্ত মহাশয় দাঁড়িয়ে উঠে ইংরিজিতে বললেন, এই রকম সাবিত্রী আমার জীবনে পেয়েছিলাম। সরোজনলিনীর কথা বললেন এবং তাঁর স্মরণার্থে সে প্রতিষ্ঠান গড়েছেন তার কথাও। সঙ্গে সঙ্গে ব্রতচারীর জন্মকথা বললেন। নাচবার আগে গানের অর্থ বুঝিয়ে দিয়ে নাচতে আরম্ভ করলেন। আমি দোভাষীর কাজ করলাম। ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখলাম খুব উৎসাহ।
জাটল্যান্ড বা ডেনমার্কের মেনল্যান্ডে বেড়াতে গেলাম। কোপেনহাগেন ও হিলেরডে একটা দ্বীপের ওপর। আরও কয়েকটি দ্বীপ ও মেনল্যান্ড মিলিয়ে ডেনমার্ক দেশ। মাত্র ৪০ লক্ষ লোকের বাস। কিন্তু এদের সভ্যতা ও কৃষ্টি এত উঁচু পর্যায়ের যে জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মেনল্যান্ড ও দ্বীপগুলির মধ্যে সারাক্ষণ মোটরগাড়ি, বাস, সাইকেল চলাফেরা করে, এমনকী কয়েকটি ট্রেনও আসে যায় জাহাজের মাধ্যমে। ঘাটে জাহাজ থামা মাত্র মোটরগাড়ি নামল উঠল এবং যাত্রীসুদ্ধ ট্রেনও গেল ও এল। সমস্ত ব্যাপারটা এত চটপট হয় যে আশ্চর্য হতে হয়। জাহাজ যেখানে থামল তার সামনে রেললাইন পাতা আছে। এগুলি বাইরের লাইনে মিশে যায়। সহজেই ট্রেন থেকে না নেমে যাত্রীরা বসে থাকতে পারে। ইচ্ছা করলে জাহাজের রেস্তোরাঁতে বসে কফি, খাবার ও বিয়ার খেয়ে যথাস্থানে পৌঁছে যেতে পারে। ইউরোপের ভ্রমণকারীদের খুব সুবিধা। কী খাব, কোথায় যাব এই সব ভাববার কোনও প্রয়োজন নেই। মুখরোচক, সস্তা ও স্বাস্থ্যকর খাবার সর্বত্র পাওয়া যায়। পকেটে পয়সা থাকলেই হল।
জাটল্যান্ডকে ডেনিশরা ইয়ুল্যান্ড বলে। উত্তর জাটল্যান্ড তেমন উর্বর নয়। জমির তিন দিকে সমুদ্রের লোনা হাওয়া ফসল নষ্ট করে। গভর্নমেন্ট থেকে প্রত্যেক ডেনিশকে (যে চাষ করতে চায়) বিনামূল্যে দুই বিঘা জমি, গরু, ঘোড়া ও কিছু টাকা দেওয়া হয়। এগুলি তার জন্মগত অধিকার। দেশটা ছোট অথচ জমি সবাইকে দিতে গভর্নমেন্ট স্বীকৃত। জাটল্যান্ডে সবাই যেতে চায় না। সেজন্য অন্যত্র বড় বড় জমিদারকে প্রায়ই গভর্নমেন্ট থেকে লেখে জমি ছেড়ে দেবার জন্য।
আকসেলের কাছে এই রকম চিঠি এল। সে তৎক্ষণাৎ তার জমির একাংশ ছেড়ে দিল, যারা নতুন চাষী হতে চায় তাদের জন্য। শুনলাম যে কয়েকবার গভর্নমেন্টের কাছ থেকে আকসেল অনুরোধ পেয়েছে এবং প্রত্যেক বারই সে জমি ছেড়ে দিয়েছে খুশি মনে। আকসেল মনে করে যে সমাজতান্ত্রিক দেশে অন্যদের সঙ্গে তার সৌভাগ্য বণ্টন করে নিতে হবে। অন্য জমিদারও জমি ছেড়ে দেয়, তবে খুশি মনে দেয় কিনা জানি না। আমাদের দেশে জমিদার জমি গ্রাস করে, স্বেচ্ছায় জমি ছেড়ে দিয়েছে বলে কখনও শুনিনি।
আকসেল তো সোশালিস্ট বটেই, এমনকী বলতে পারি যে কমিউনিজমের সাম্যবাদ তার প্রাণে সাড়া জাগিয়েছিল। আমি রাশিয়া ভ্রমণ করে এসেছি বলে নানা বিষয় আমাকে জিজ্ঞাসা করত এবং মন দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করত। আমি যেটুকু দেখেছি সেইটুকুই বলতে পারতাম। রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝতাম না বলে কমিউনিজমের আসল কথাটা ঊহ্য রয়ে যেত।
কোপেনহাগেন ইউনিভার্সিটি থেকে দক্ষিণ ভারতের মন্দির সম্বন্ধে বলবার আমন্ত্রণ পেলাম। আকসেল আমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে গেল। তাঞ্জোরের মন্দির সম্বন্ধে আমি একটা ভুল খবর দিলাম স্লাইড দেখাবার সময়। ভুল যে করেছি তৎক্ষণাৎ মনে পড়ল। কিন্তু সংশোধন করবার তখন আর সময় নেই। আমি পরের মন্দিরটির বিশেষ স্থাপত্য সম্বন্ধে কী বলব সেই কথা ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। ভুল রয়ে গেলে।
আমার বলবার সময় পার হয়ে এল। আমি ভাবলাম ওই ভুলটি কে লক্ষ করবে আর কেই বা বৈষ্ণব ও শাক্তর পার্থক্য বুঝে উঠবে।
মিটিং শেষ হয়ে গেল। আকসেলের সঙ্গে দেখা হতে প্রথমেই সে বলল, তুমি ভালোই বলছ কিন্তু একটা ভুল তোমার দৃষ্টি এড়িয়েছে। আর বেশিদূর বলবার আগেই আমি বললাম যে আমি জানি যে আমি ভুল করেছি কিন্তু সে বিষয় যখন সচেতন হলাম তখন ফেরবার রাস্তা আমার ছিল না। আকসেল খুশি হয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে গাড়িতে গিয়ে উঠল।
সোফিনবর্গ ফার্মে কুড়িজন অ্যাপ্রেন্টিস ছেলেমেয়ে ছিল যারা ডেয়ারি ফার্মিং শিখত। আমিও তাদের দলের একজন। আমাদের নানারকম পরীক্ষা হল সব রকম শেখার পর। আমি পাশ করার সার্টিফিকেট পেলাম।
ডেনমার্কে অনেক ডেয়ারি ফার্ম দেখেছি যার ফলে বুঝলাম আকসেলের ডেয়ারি ফার্ম সবচেয়ে উন্নত ধরনের, আর অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চালানো হয়। লাভের দিকে আকসেলের মোটেই দৃষ্টি ছিল না। তবু তার খুব লাভ হল স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত উপায়ে ফার্ম চালাবার ফলে।
দক্ষিণ ভারতবর্ষে থাকবার সময় আকসেল একটা ছবি দেখেছিল যাতে শ্রীকৃষ্ণ ছোট গোপালের বেশে একটা গরুর বাঁট থেকে দুধ খাচ্ছে। সে অবধি তার ইচ্ছা হয় যে এত ভালো খাঁটি দুধ তৈরি করবে যা না ফুটিয়ে শিশুকে দেওয়া যাবে। অনেকদিন পরীক্ষা করেছে কিন্তু তেমন ফল পায়নি। একদিন আমাকে তার মনের কথা বলল এবং আবার একবার জীবাণুশূন্য দুধ তৈরি করবার চেষ্টা করবে জানাল।
জীবাণুর প্রধান কারণ হল, গরুর গলার দড়ি, দেহের ময়লা, গোয়ালের পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং যারা দুধ দুইবে তাদের হাতের ও বালতির নোংরা।
প্রথমেই দুধ পরীক্ষা করবার জন্য আকসেল একটা ল্যাবরেটরি স্থাপন করল। তারপর ব্যবস্থা হল গরু দড়ি ছাড়া লোহার ফ্রেমের মধ্যে থাকবে অথচ যথেচ্ছ বসতে দাঁড়াতে ফিরতে পারবে। তৃতীয় ব্যবস্থা হল দুটো বড় নতুন ঘরের। গরুর দুধ দুইবার আগে তাকে ভালো করে স্নান করিয়ে দেওয়া হয় অল্প গরম জলে। তারপর ড্রাই চেম্বারের ভেতর দিয়ে জীবাণুমুক্ত হয়ে যাবে অন্য ঘরে, সেখানে সাদা টালি দেওয়া দেওয়াল ও মেঝে। ছেলেমেয়েরা জীবাণুমুক্ত ওভার অল পরে বালতি হাতে অপেক্ষা করে দুধ দুইবার জন্য। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেল (ম্যাডসন ইনস্টিটিউট থেকে রিপোর্ট) যে দুধ যতদূর জীবাণুমুক্ত হতে পারে ততখানি সোফিনবর্গ ফার্মের দুধ হয়েছে।
আকসেল এত খুশি হল তার অসামান্য সাফল্যে যে সে একটা মস্ত মেশিনের অর্ডার দিল। সেটা দুদিনের মধ্যে এসে গেল। এই মেশিনের বিশেষত্ব হল যে দুধ ঢেলে দেবার পর আর মানুষের হাত লাগবে না অথচ দুধ কার্ডবোর্ডের বোতল ভর্তি হয়ে বেরিয়ে আসবে।
বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করে জীবাণুমুক্ত দুধ তৈরি করতে গিয়ে অ্যাকসেল একটা অমূল্য জিনিস আবিষ্কার করে ফেলল। গরু জীবাণুমুক্ত হলে তাদের প্রত্যেকের আয়ু চার-পাঁচ বছর বেড়ে যায়। ব্যবসার দিক দিয়ে এটা কম লাভের কথা নয়।
আকসেল যখন এই চেষ্টা শুরু করল যে শিশু গরুর বাঁটে মুখ দিয়ে জীবাণুমুক্ত দুধ খেতে পারবে, তখন ডেনমার্কের মতো চারদিকে ডেয়ারি ফার্মের দেশে সবাই ঠাট্টা আরম্ভ করল যে মিলিওনেয়ার ফার্মার হলে এই রকমই হয়। সাতকাণ্ড রামায়ণের শেষে দেখা যাবে দুধের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কিন্তু তা হল না তার কারণ দেখা গেল যে গরু আরামে থাকার ফলে বেশি পরিমাণ দুধ দিতে লাগল, সাধারণ দুধের দামেই সোফিনবর্গের দুধ বিক্রি হতে লাগল। তখন সমালোচকদের মুখ বন্ধ হল। অ্যাকসেল মনে করল তার জীবন সার্থক হয়েছে।
এক সপ্তাহ পরে আকসেল একটা কাণ্ড করে বসল। লাইব্রেরি ঘরে আমার ডাক পড়ল। আমাকে দেখে স্বামী-স্ত্রী দুজনে হাসি চাপতে পারছে না। একটা কাগজ দিয়ে আকসেল বলল, এইখানে তোমার নাম সই করে দাও। কী ব্যাপার, কোনও উত্তর নেই। সই করবার পর ইয়ুটা বলল, তোমার যে রকম অ্যাডভেঞ্চারাস স্পিরিট, তাতে আমরা ভাবলাম যে তোমাকে একটা এরোপ্লেন উপহার দেব। আমাদের মাঝে মাঝে চড়িও। এই কথা বলে আমার হাতে দ্য হাভিলান্ড কোম্পানির তৈরি একটা টাইগারমর্থ প্লেনের কাগজপত্র দিল। আমার এমন অভিভূত অবস্থা যে গলা দিয়ে স্বর বেরল না। মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম কিন্তু আবার মনে হল আকসেল ও ইয়ুটা আমরা পায়ে শিকল দিয়ে বাঁধতে চায়। মুহূর্তে আমার আনন্দ উবে গেল ভ্রমণে কবে বেরোতে পারব এই কথা ভেবে।
লেফটেন্যান্ট ইয়েনসেনের সঙ্গে পরামর্শ করলাম কেমন করে এরোপ্লেনটা খাটিয়ে টাকা রোজগার করা যেতে পারে। দুটো পথ বেরোল। একটা হচ্ছে এরিয়াল সার্ভে এবং অন্যটি প্রত্যেক ডেয়ারি ফার্মের ওপর থেকে ছবি তুলে বিক্রি করা। দুটোই খুব লাভবান কাজে হাত দিলাম।
এরোপ্লেন থেকে অনেক ছবি তুললাম। তারপর সেগুলো বড় করে হিলেরয়েডে এক ফটোগ্রাফারের দোকানে দেখবার জন্য কাগজে আমন্ত্রণ জানালাম। অর্ডার বুক করলাম অনেক, যথাসময়ে। এমনই করে সারা ডেনমার্কে যেখানে যত ডেয়ারি ফার্ম আছে সেগুলির বেশিরভাগের ছবি তুললাম। আমাদের একজন এজেন্ট জুটে গেল সে বিক্রি করার সব ভার নিল।
সমুদ্রের ধারে প্লেন নিয়ে গেলে লোকেরা অস্থির করে তুলত উড়িয়ে আনার জন্য। আমরা দুজন প্যাসেঞ্জার একসঙ্গে নিতাম। মাত্র দশ টাকা চার্জ। সারাদিন উড়লেও লোকেদের উৎসাহ কমত না।
কাস্ট্রপ এরোড্রোমটা একেবারে সমুদ্রের ধারে। একদিন কাস্ট্রপ থেকে সমুদ্রের ওপর বেশিদূর যাইনি, একটা এলবাট্রস পাখির সঙ্গে এরোপ্লেনের প্রোপেলার ব্লেডের সংঘর্ষ লাগল। তারপরই প্লেন সামলানো দায় হল। আমি তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে কাস্ট্রপ রানওয়ে যে দিকে সেই দিকে নামতে আরম্ভ করলাম ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে। একেবারে কুলে এসে জলে পড়লাম।
আর মাত্র কুড়ি হাত যেতে পারলে এরোড্রোমে নামতে পারতাম। তাড়াতাড়ি বেল্ট খুলে এরোপ্লেনের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে, যারা কাছেই সান বেদিং করছিল তাদের সাহায্য চাইলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে দুটো দড়ি নিয়ে বোট এল এবং টানতে টানতে প্লেনটাকে এরোড্রোম পর্যন্ত পৌঁছে দিল। আমার চামড়ার পোশাক জলে ভিজে মনে হচ্ছিল কয়েক মন ভারি হয়ে গিয়েছে।
এরোপ্লেনের কোনও ক্ষতি হয়নি প্রপেলার ব্লেড ছাড়া। ইনশিওরেন্স কোম্পানি নতুন করে আরেকটা ব্লেড কিনে দিল।
একজন অ্যাডভেঞ্চারাস ইয়ং স্পোর্টসম্যান যা কামনা করে সবই আমার হাতে এল। স্বপ্ন বাস্তব হল। কেবল একটি জিনিসের অভিজ্ঞতা হয়নি। তাও শীঘ্রই হল। একটা ইয়ট (পালতোলা রেসিং নৌকো) চালানো।
ইয়ুটার এক বিশেষ বান্ধবীর মেয়ে সনিয়া হাটুং স্ট্রয়েডামে প্রায়ই আসত, বিশেষ করে সপ্তাহান্তে। সনিয়ার বাবা কমান্ডার হাটুং (ডেনিশ নেভির কর্ণধার) একটা ইয়টের মালিক ছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে আমাকে ও সনিয়াকে নিয়ে ক্যাটেগাট সমুদ্রে ইয়টে পাড়ি দিতেন। আমি এক নতুন থ্রিল পেতাম।
স্ট্রয়েডামে জন্মদিন হত খুব ঘটা করে। আকসেল কিংবা ইয়ুটার জন্মদিনে ওরা আমাকে এত প্রেজেন্ট দিত যেন আমারই জন্মদিন। বছরে তিনবার করে আমার জন্মদিন পালন হত। যে দিনটায় আমার সঙ্গে আকসেল ও ইয়ুটার দেখা হয় সেটা হচ্ছে প্রথম। আসল জন্মদিন হচ্ছে দ্বিতীয় এবং আরও একটা জন্মদিন ছিল— পাসপোর্টের তারিখ অনুসারে। যেটাই আসল হোক, তিনবার হৈ চৈ করে বিরাট ভোজ ও প্রেজেন্ট দিয়ে বুড়োবুড়ি খুশি। নিত্য নতুন ফন্দি করে আর কী করলে আমার মতো বনের পাখিকে ধরে রাখা যায়।
আমি কী চাই জিজ্ঞাসা করলে বলি আমার ভ্রমণ সম্পূর্ণ করতে চাই। আমার উত্তর শুনে দুজনেই জিজ্ঞেস করে আমার কি অসুবিধা হচ্ছে— কিছুর অভাব আছে কি? আমি কেমন করে বোঝাই যে যেদিন ডাক্তার আমাকে ফিট বলবে তার পরদিন আমি আবার আমার চলার পথে বেরিয়ে পড়ব।
আকসেল ও ইয়ুটার ধারণা হল আমি ক্রমাগত বুড়োবুড়ির সঙ্গ লাভে একেবারে বিরক্ত ও উত্ত্যক্ত। আমার সৌভাগ্য কোনওদিন তারা কারও সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে আটকে রাখবার চেষ্টা করেনি।
ইয়ুটার জন্মদিন এল। সকালবেলায় আমার ছুটি। প্রাতরাশ খেয়ে ভেতর দিকের বাগানের একটা বেঞ্চে বসে আছি, এমন সময় আকসেল ও ইয়ুটা আমাকে ডাকল ওদের সঙ্গে বেড়াতে যাবার জন্য। স্ট্রয়েডামে পৌঁছবার আগে বার্চের অ্যাভেনিউ ছিল। সেটা ধরে আমরা অল্পদূর যাবার পর ছোট টিলার ওপর রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট খুব সুন্দর বাড়ির সামনে ওরা থামল। ইয়ুটা হ্যান্ডব্যাগ থেকে এক তাড়া চাবি বের করে আমার হাতে দিল। মনে হল বাড়ির চাবি দিয়ে আমাকে দরজা খুলতে ইঙ্গিত করল। আমি বাড়ির দরজা খুলে চাবি ফেরৎ দিতে গেলাম। কিন্তু ওরা বলল, চাবি এখন থেকে আমার কাছে থাকবে। তখন অভিসন্ধি ঠিক ধরতে পারলাম।
বাড়িটায় তিনখানা বড় সাজানো ঘর তা ছাড়া দুটো বাথরুম, কিচেন ইত্যাদি ছিল। কাচের জানলার পর্দা সরালে সব ঘর থেকে অপূর্ব বাইরের দৃশ্য। অদূরে পাইন গাছের মাথার ওপরে ‘স্ট্রয়েডাম’ বাড়িটা ছবির মতো দেখায়।
সব বাড়িটা ঘুরে দেখবার পর দুজনেই খুব আগ্রহ ভরে জিজ্ঞাসা করল বাড়ি আমার কেমন লাগল। আমি বললাম খুব চমৎকার বাড়ি কিন্তু কার জন্য? ইয়ুটা বলে ফেলল যে আমার জন্য। আমি অনেক কষ্টে নিজের দুঃখ চেপে মাথা নাড়লাম, না আমার জন্য হতেই পারে না?
আমাকে স্থিতিবান করবার চেষ্টা এভাবে বিফল হল দেখে স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই খুব মুষড়ে পড়ল। আমি খুশি করবার জন্য বললাম, আমার স্ট্রয়েডামে বাড়ি তো রয়েছে। আকসেল তখন বলল, হ্যাঁ তুমি চিরকাল স্ট্রয়েডামে থাকতে পার এমন ব্যবস্থা করে দেব। এখন আমরা স্বামী-স্ত্রী ঠিক করলাম যে তুমি বুড়োবুড়ির মধ্যে থেকে হয়তো হাঁপিয়ে উঠবে, তখন নিজের বাড়িতে কিছুদিন থাকলে আমাদের প্রতি তোমার ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ থাকবে।
কিছুক্ষণ পরে বাড়ি ফিরেই শুনলাম যে সলিসিটর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। স্ট্রয়েডামে সম্পত্তি দেখাশোনা করা অ্যাটর্নির কাজ। তাঁর নাম ওলেসেন। তিনি কাগজপত্র তৈরি করে এসেছেন যাতে আমার ও আকসেলের সই পড়লে তবে বাড়ির মালিক হব আমি।
আমি যখন কোনও কাগজেই সই করলাম না, অ্যাটর্নি এত অবাক হয়ে গেলেন যে বড় বড় চোখ তুলে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী? আমি হেসে বললাম, এর প্রয়োজন হবে না, আসুন এখন কড়া এক কাপ কফি খাওয়া যাক। চার কাপ কফির অর্ডার দিলাম।
এমন সময় আকসেলের পুত্র, ইয়েনস ইয়ার্ল তার দুটি মেয়ে নিয়ে বেড়াতে এল। ইয়েনস একজন ইঞ্জিনিয়ার আমার থেকে বয়সে অল্প বড়। বিয়ের পর আকসেল ও ইয়ুটা তার জন্য একটা খুব সুন্দর বাড়ি ও বাগান তৈরি করে দিয়েছে সমুদ্রের কাছে। সেখানে অনেকবার উইক-এন্ড কাটাতে গিয়েছি, ইয়েনস ও তার স্ত্রীর নিমন্ত্রণে।
মেয়ে দুটির বয়েস মাত্র তিন চার। বড়টির নাম পুটে ও ছোটটির নাম ইয়ুটে। বোধ হয় আমার ব্রাউন রং দেখে দুই বোনই মুগ্ধ এবং তারা আমার সঙ্গ ছাড়ে না।
দীর্ঘ আঠারো বছর পরে আবার স্ট্রয়েডামে সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন পুটের বিয়ে হয়ে স্বামীর সঙ্গে অন্য দেশে থাকতে গিয়েছে। ইয়ুটের বয়স একুশ। প্রচণ্ড লম্বা ডানপিটে মেয়ে। আমার প্রতি তাদের ছেলেবেলার ভালোবাসা তখনও অটুট।
আমি দুই বোনকে নিয়ে সোফিনবর্গ ফার্ম দেখাতে গেলাম। ইয়ুটের ভয়-ডর বলে কিছু নেই। বিরাট ঘোড়ার নিচ দিয়ে লুকোচুরি খেলতে আরম্ভ করল, তাদের গায়ে পায়ে হাত বুলিয়ে দিল। আমি ভাবলাম যদি একটা ঘোড়া অসাবধানে পা ফেলে তো ইয়ুটে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।
যেখানে অতিকায় চারটে ষাঁড় ছিল সেখানে ইয়ুটে নির্ভয়ে তাদের গলা জড়িয়ে ধরতে যেত। পুটে আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম পুচকে মেয়ের অসীম সাহসিকতা। তার জীবজন্তুর প্রতি অশেষ ভালোবাসা। শুয়োরের ঘরে বাচ্চাগুলো ধরে তাদের কোলে তুলে নেবেই। মুরগির ঘরে মুরগি ধরে আদর করবে—এমন ছিল ইয়ুটের স্বভাব। আশ্চর্যের বিষয়, সব পশুপাখিই ইয়ুটেকে ভালোবাসত, ভয় পাওয়া তো দূরের কথা।
আকসেল ও ইয়ুটার সঙ্গে কোপেনহাগেন শহরে প্রায়ই থিয়েটার কিংবা কনসার্ট শুনতে যেতাম। ডেনিশ ভাষা বেশ শ্রুতিকটু এবং কঠিন তো বটেই কিন্তু আমার কাছে সরল মনে হত। জার্মান জানার জন্য বোধ হয় সহজ ঠেকেছিল। থিয়েটার আমি বেশ উপভোগ করতাম। সোফিনবর্গ ফার্মে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সারাক্ষণ ডেনিশ ভাষায় কথা বলতে বা শুনতে হত। সে জন্য ওই ভাষা আমার ভালোই লাগত।
একদিন ভিগো আনসেন নামে মালির বাড়িতে ডিনারের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম। ভিগোর স্ত্রীর নাম গুদ্রুন। দুজনেই বাইশ-তেইশ বছরের হবে। কী পরিপাটি সংসার। সব পরিষ্কার ঝকঝকে এবং সুন্দর করে সাজানো। দেখলে চোখ জুড়ায়। বাড়ি এমনই তৃপ্তির জায়গা হওয়া উচিত। বসবার ঘরে একটা টেবিলের ওপর ল্যাম্প এবং কয়েকটি বই গোছানো রয়েছে। তাদের মধ্যে হর্টিকালচার সম্বন্ধে তিনখানা বই। একখানা হান্স হার্টউইগ সেডর্ফের কবিতার বই। অনেকগুলি কবিতা, আমাদের পাশের দেশ সিংহল দ্বীপের ওপর। সেখানে সেডর্ফ (পোয়েট লরিয়েট অব ডেনমার্ক) বেড়াতে গিয়েছিলেন। অনুরাধাপুর দেখে মুগ্ধ হয়ে একটি কবিতা লেখেন। আমার বেশ ভালো লাগল। খুব দরদ দিয়ে লেখা।
সৌভাগ্যক্রমে কয়েকদিন পরেই ইয়ার্লদের বাড়িতে সেডর্ফ সপরিবারে নিমন্ত্রিত হয়ে এলেন। আমি তাঁর কবিতার প্রশংসা করাতে তিনি একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি একজন ভারতীয় হয়ে সেডর্ফের কবিতা জানলাম কেমন করে। মোট কথা সের্ডফ ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেল। অনেকদিন তাঁদের বাড়িতে গিয়েছি।
ইয়েনশের বাড়ি আমাদের তিনজনের নেমন্তন্ন ছিল। বাড়িটা ভারি সুন্দর। অতি আধুনিক ছাঁদে তৈরি। বারান্দা থেকে সমুদ্রের নীলজল দেখা যায়। আকসেলের স্থাপত্যবিদ্যার পরিচয় পাওয়া যায় বাড়িটা দেখলে। খাবার সময় দুটো মোমবাতির বাতিদান জ্বালা হল এবং অন্য সব আলো নিভিয়ে দিল। এটা একটা ডেনিশ প্ৰথা। বলা উচিত, স্কানডিনেভিয়ান প্রথা।
দেখতে দেখতে হেমন্তের দিন এগিয়ে এল। কনিফার বা পাইন ছাড়া প্রত্যেকটি গাছের পাতায় সুন্দর হলদে এবং লাল রঙের ছোপ লেগেছে। অল্পদিন পরে সব পাতা ঝরে যাবে। বনের পথ অপূর্ব সুন্দর লাল রঙে ছেয়ে যাবে। ভারি মনোরম দৃশ্য। গাছগুলি নিষ্পত্র শীর্ণদেহে আগামী বছরের বসন্তের অপেক্ষায় ঝড় বরফ ঠান্ডা সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকবে।
দিন ছোট হয়ে গেছে। একদিন তুষারপাত হল। মাঠ ঘাট বাড়ি সবার ওপর সাদা বরফের পলেস্তারা পড়ল। আমার মন খারাপ লাগল। পাঁচ ছয় মাসের মধ্যে সাইকেল চালানো যাবে না। খুব সাবধানে থাকা সত্ত্বেও আমার পেটের ব্যথা সারছে না।
ডেনমার্কে ক্রিয়োলাইটের (যা দিয়ে সব চেয়ে ভালো অ্যালুমিনিয়াম তৈরি হয় কারখানা ও ব্যবসা আছে। আকসেলের বাবা এই কারবার প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রভূত লাভবান হন। এখন আকসেলরা তিনভাই ও এক বোন সেই সম্পত্তির মালিক। বোনের মৃত্যুর পর তাঁর আয় দুই মেয়ের মধ্যে সমান ভাগ হয়ে যায়।
আকসেলের বাবা লোকহিতকর কাজে অনেক অর্থ ব্যয় করেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড হাসপাতাল স্থাপন। হানসেন নামে এক ডাক্তার কৃত্রিম সূর্যরশ্মি দিয়ে কুষ্ঠরোগ সারাতে সক্ষম হয়েছে জেনে তিনি হানসেন লুইশ অর্থাৎ হানসেনের আলোকবর্তিকা, নাম দিয়ে কুষ্ঠরোগীদের জন্য হাসপাতাল তৈরি করলেন। সমস্ত ইউরোপ থেকে বিশেষ করে আইসল্যান্ড থেকে কুষ্ঠরোগীরা এখানে এসে আরোগ্যলাভ করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণভাবে কুষ্ঠরোগ দূর হল।
আকসেলের কাকা টিটগান একজন মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি অক্ষয়কীর্তি লাভ করেন ইংল্যান্ড থেকে জাপান পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপন করে। সুদূর সাইবেরিয়ার মধ্য দিয়ে এই লাইন চলে গিয়েছে। টিটগান অনেক সম্পত্তি ও সম্মান লাভ করেন। স্ট্রয়েডাম তাদের মধ্যে একটি। উত্তরাধিকারসূত্রে আকসেল সেটি পায়। আকসেল সোফিনবর্গ ফার্ম কিনে স্ট্রয়েডামের সঙ্গে যোগ করেছে।
স্ট্রয়েডামের নিজস্ব একটা ফার্ম ছিল। এখন সেটা পোল্ট্রি হয়েছে এবং সোফিনবর্গের যেসব গরুর দুধ দেবার বয়স হয়নি, তাদের রাখা হয়।
ইউরোপে চিনি তৈরি হয় সাদা বীট থেকে। আমাদের দেশে হয় আখ থেকে। বীটের মস্ত কাজ হচ্ছে যে শীতের দিনে গরু ঘোড়াকে বাঁচিয়ে রাখে। শীতের ঠিক আগেই মাটি খুঁড়ে হাজার হাজার বীট (প্রত্যেকটার ওজন দেড় কেজি থেকে তিন কেজি) লম্বা স্তূপ করে রাখা হয়। এগুলি ঠান্ডায় নষ্ট হয় না। এই স্তূপকে ব্যাটারি বলা হয়। একাধিক ব্যাটারি রচনা করে তাদের ওপর মাটি ও ঝরা পাতা ছড়িয়ে দেয়। যথাসময়ে তার ওপর বরফ পড়ে যায় এবং বীটকে তাজা রাখতে সাহায্য করে।
স্ট্রয়েডামের চারদিকে বিস্তীর্ণ জঙ্গল, মাঝে মাঝে পুকুর এবং বার্চ কিংবা পাইনের সার দাঁড়িয়ে আছে। অনেকদিন আমি জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করেছি। মাঝে মাঝে খেঁকশিয়াল, খরগোশ ও হরিণ দেখলাম। তারা তাঁবুর অর্থ না বুঝে খুব কাছে আসত। ক্যামেরার শাটারের আওয়াজে চমকে থমকে দাঁড়াত। তারপর কিছু বুঝতে না পেরে হয় দৌড়ে পালাত, নয়তো নিজেদের মধ্যে খেলা ও কলহে মেতে যেত।
শীতের সন্ধ্যায় বাড়িতে কোনও অতিথি না থাকলে, আকসেল তার অফুরন্ত জ্ঞান ভাণ্ডারের দরজা খুলে আমাকে ডাকত আলোচনার জন্য। আমাদের মধ্যে গুরু শিষ্য সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রায়ই ডিনারের পর আকসেল বই নিয়ে বিছানায় ঢুকত। তখন ইয়ুটা ও আমি দোতলার বসবার ঘরে বসে খোস গল্প করতাম। কখনও কখনও চয়নিকা থেকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা তর্জমা করে শোনাতাম।
ইয়ুটার ভাই ও তাঁর স্ত্রী লেরকেনবর্গ নামে একটা বিরাট সম্পত্তির মালিক। বাড়িটা মস্ত রাজপ্রাসাদ। তার মধ্যে অফুরন্ত সাজানো ঘর, থিয়েটার, নাচবার ঘর ও তাস খেলবার ঘর ছিল।
উইক-এন্ড কাটাতে আমরা তিনজনে নিমন্ত্রিত হয়ে ইয়ুটার ভাই লুন্ডের প্রাসাদে গেলাম। এখানেও সংলগ্ন একটি বড় ডেয়ারি ফার্ম আছে, সেইসঙ্গে ঘোড়া ও শুয়োরের মস্ত ব্যবসা চলে।
লেরকেনবর্গ কাসল কোনও রাজা মহারাজার অধীনে এককালে ছিল। বড় বড় ঘর সেই রকমভাবে সুসজ্জিত। লুন্ডরা সেই প্রাসাদের একপ্রান্তে মাত্র কয়েকখানি ঘরের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল। গেস্টদের জন্য দরকারমতো আরও কয়েকটি ঘর খোলা হয়। বাকি ঘর (প্রায় নব্বইটি) আসবাবপত্রসুদ্ধ কাপড় চোপড় দিয়ে ঢাকাই থাকত। ফার্নিচারগুলি দেখবার মতো। বসবার ঘরের দেওয়ালে ‘গবেগাঁ’ (আগেই লিখেছি কার্পেটের চেয়ে সূক্ষ্ম কাজের ছবি) ও মাটিতে দামি দামি পারস্য দেশীয় কার্পেট পাতা থাকত।
বিরাট বাগান চারদিকে। বাগান এতবড় রাখার খরচাই কত বলা যায় না। লুন্ড পরিবার আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। আমার ব্রাউন রং দেখে আমার প্রতি খুবই আকৃষ্ট হল।
মিঃ লুন্ডের সঙ্গে আমি ডেয়ারি ফার্ম দেখতে গেলাম। এক হাজার গরু আছে। তাদের দোহন করা হয় যন্ত্র দ্বারা। আকসেলের ফার্মেও এমনই যন্ত্র দিয়ে চারশো গরু দুইবার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু যেদিন আকসেল বুঝলে যে মেশিনের চেয়ে হাতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে দোওয়ার সুফল অনেক, তখন থেকে পাইপ, যন্ত্র ও মেশিন বাতিল হয়ে গেল।
ঘোড়াশালায় বড় বড় ঘোড়া দেখতে গেলাম। পঞ্চাশটি ঘোড়াই দেখতে অতিকায় এবং তাদের বেশিরভাগেরই সন্তান-সম্ভাবনা। ঘোড়ার ঘাড়ে, ল্যাজে ও পায়ে মস্ত মস্ত লোম। এগুলিকে বেলজিয়ান ড্রাফট হর্স বলা হয়। জমি লাঙ্গল দিতে, ফার্মের গাড়ি টানতে ঘোড়াগুলি খুব উপযুক্ত।
ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এই ঘোড়া দেখা যায়। শহরে বিয়ারের বড় বড় গাড়ি টানে দুটিতে কিংবা গ্রামাঞ্চলে জমিতে অক্লান্তভাবে লাঙ্গল দিতেও দেখেছি। খুব শান্ত স্বভাব, মানুষের সঙ্গে থেকে থেকে এরা আধা মানুষ হয়েছে।
লেরকেনবর্গের চাষের জমি দেখবার মতো। আঁচড় দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়েছে। একটা জমিতে খুব সুন্দর ফেশান্ট পাখি দেখলাম। ইউরোপের সর্বত্র ফেশান্ট মারা হয় সুস্বাদু মাংসের জন্য।
সেদিন রাত্রে শুনলাম যে লুন্ডের জন্মদিন উপলক্ষে ফার্মে এক পার্টি হবে। সন্ধ্যার পর লুন্ড পরিবার ও আমরা তিনজন ফার্মের বার্নহাউসে গেলাম। ফার্মের কর্মচারী ত্রিশজন স্ত্রী-পুরুষ ভালো বেশভূষা করে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। মদ বিতরণ হল। একটু পরে ব্যান্ড বাজল। তখন লুন্ড একজনের পর আরেকজন মহিলার হাত ধরে নাচতে আরম্ভ করলেন। পুরুষ কর্মচারীরা একে একে মিসেস লুন্ডের সঙ্গে নাচল।
আমি একপাশে বসে বসে আমোদ উপভোগ করছিলাম আর ভাবছিলাম একেই ডেমোক্রাসি বলে। প্রভু ও কর্মচারীর পার্থক্য ভুলে সমাজে এক হয়ে মিশতে পারার মধ্যে সৎশিক্ষা ও সৎচেষ্টা আছে। বেশি কথা ভাবতে সময় দিল না। তরুণীর দল আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাদের সঙ্গে নাচবার জন্য। নাচলাম অনেকের সঙ্গে।
ইয়ুটা আমার ওপর ভীষণ খুশি হয়ে বলল, তুমি যে নাচতে পার এবং নাচতে এতো ভালোবাস, একথা কেন বলনি আমায়? এককালে আমিও নাচতে ভালোবাসতাম। এখন এত বুড়ি হয়ে গেছি যে নিজের দেহভার সামলাতে পারি না। এবার থেকে তোমার জন্য আমার বাড়িতে নাচের পার্টি দেব। ফলে সোনিয়া, বিটেন বিরগিটে, উরশুলা ও মেরিয়ান নিমন্ত্রিত হল টি পার্টিতে।
পৃথিবী ভ্রমণ করতে করতে ঘুরপাক খেয়ে স্ট্রয়েডামে এসেছিলাম। এখানে ভ্ৰমণ ছাড়া আর সব কাজ ভালোই হচ্ছে। সোফিনবর্গ ফার্মে ডিউটি দিই, ইন্টারন্যাশানাল স্কুলে পড়াই, এরোপ্লেন থেকে এয়ার সার্ভে করি— এমনই নানা কাজে আমার দিন কেটে যায়।
শীত এসে গেল বলে। মাঠ বরফে ঢাকা। কিছুদিনের মতো এরোপ্লেন চালানো বন্ধ।
এই সময় মিউজিক, অপেরা, থিয়েটার ও অন্যান্য আর্টের খুব চর্চা হয়। কারখানাগুলোও জোর চলে।
আমার পেটের ব্যথা অনেক কম, সেদ্ধ খাওয়া ও সময় মাফিক খাওয়ার ফলে। আমার বিশ্বাস যে ডেওডেনাল আলসার ক্রমে ক্রমে সেরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভয় হয় পাছে আমি অপারগ হয়ে পড়ি এবং ভ্রমণে ইস্তফা দিতে হয় শেষ অবধি।
আকসেলের জীবনের পরিণতি এতই রোমাঞ্চকর যে এখানে তার কথা আরও লিখতে ইচ্ছা করছে। আমি স্ট্রুয়েডাম ছেড়ে যাবার ছয় বছর পরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হল। আকসেলের ধারণা ছিল, জার্মানরা ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলি যেমন হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নরওয়ে ইত্যাদিকে গ্রাস করবেই একদিন। হিটলার যখন প্রচণ্ড বিক্রমে ফ্রান্স জয় করে ইংলন্ডের দিকে এগোতে লাগল আকসেল তারই মধ্যে ইংরাজ ওয়ার-অফিসের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে গেল উত্তর নরওয়ের পথ ধরে। যথাসময়ে ডেনমার্কও জার্মানির কবলে এল।
তখন আকসেল যদিও বৃদ্ধ তবু অসীম উৎসাহে যুবকদের একটি গেরিলা দল তৈরি করে সে জার্মানদের সর্বত্র বাধা দিতে লাগল। গ্রিপস্কভ জঙ্গলে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ইংরেজরা এরোপ্লেন থেকে বন্দুক-গোলাগুলি ফেলত, ডেনিশ যুবকরা সেগুলির সাহায্যে জার্মানদের অশেষ ক্ষতি করতে লাগল।
অবশেষে একদিন প্লেন থেকে অস্ত্রশস্ত্র ফেলবার সময় জার্মানরা গ্রিপস্কভ জঙ্গল ঘেরাও করে। মাত্র একজন ডেনিশ যুবক ধরা দিয়ে অন্যদের বিপদমুক্ত করল। সেই যুবক, থরওয়াল্ডের ওপর অনেক অত্যাচার হল। তার বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখল যদি অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায়। যখন খোঁজাখুঁজি চলছে থরওয়াল্ড কাচের জানলার ভেতর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে সব ভেঙে চুরে বাইরের গমের খেতে গিয়ে পড়ল এবং এদিক সেদিক করতে করতে সরে পড়ে আশ্রয় নিল আকসেলের ফার্মে।
ডেনিশ যুবকদের কাছে ইতিমধ্যে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ইংরেজরা পৌঁছে দিয়েছে। তারা অন্তর্ঘাতী কাজ চালিয়ে দেশে চরম অরাজকতা ও অব্যবস্থার সৃষ্টি করতে লাগল।
কেমন করে জানা নেই জার্মানরা ঠিক করল আকসেল রয়েছে এই সব গণ্ডগোলের মূলে। থরওয়াল্ডকে আকসেল সরিয়ে ফেলল। ভোরে একদিন একটা জার্মান মিলিটারি ভ্যান হঠাৎ স্ট্রয়েডামে উপস্থিত হল এবং আচমকা আকসেলকে ধরে নিয়ে গেল। ইয়ুটা কাছেই ছিল তাকে কিছু বলল না।
জার্মানরা ভেবেছিল আকসেলকে ধরতে অনেক বাধা পাব। সেটা না পেয়ে ভ্যানটা ভীষণ জোরে চালিয়ে বাড়ির অ্যাভেনিউ পার হতে গেল। মোড়ের কাছে ভ্যানটা টাল সামলাতে না পেরে একটা গ্র্যানাইট পাথরের বুকে ধাক্কা মেরে উল্টে পড়ল। আকসেলের মালি ভিগো কাছেই দাঁড়িয়েছিল। সে ভ্যানের দরজা খুলে অজ্ঞান অচৈতন্য জার্মানদের টেনে বের করল। আকসেলের তেমন চোট লাগেনি।
অ্যাম্বুলেন্স এসে সবাইকে তুলে নিয়ে গেল হিলেরয়েড হাসপাতালে।
ডেনিশ ডাক্তাররা আকসেলকে দেখে অবাক। তার মতো বয়োবৃদ্ধ লোক কী করে জার্মানদের বিরুদ্ধাচরণ করছে। ডাক্তাররা ঠিক করল যেমন করে তারা পারে আকসেলকে নাৎসীদের হাত থেকে বাঁচাবে। এমন ভান করল যেন আকসেলের ভীষণ চোট লেগেছে মাথায়, তাকে নড়ানো যাবে না। নাৎসী বড় কর্তারা বলল আকসেলকে তাদের কাছে দিতে, বিচার হবে। বলা বাহুল্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মরবার জন্য পাঠাবে। ডাক্তাররা একবাক্যে মত দিল যে আকসেলের মাথায় কনকাসন হয়েছে, বিছানা ছাড়া তার বারণ।
কয়েকদিন পরেই থরওয়াল্ডের দল হাসপাতাল থেকে আকসেলকে নিয়ে উধাও হল।
বিদ্রোহীরা আকসেলকে এবং ইয়ুটাকে স্ট্রয়েডামে একটা ভীষণ দুর্গন্ধময় জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল। কেউ ভাবতেই পারেনি, যে সেখানে কোনও মানুষ থাকতে পারে। ইতিমধ্যে আকসেলের বাড়ি জার্মানরা দখল করেছিল। তারা আমার এরোপ্লেন ও যাবতীয় ক্যামেরার জিনিসপত্র এবং কাপড়চোপড় সরিয়ে ফেলল। একদিন গভীর শীতের রাত্রে গেরিলারা আকসেলকে চাষী সাজিয়ে ও ইয়ুটাকে তার সঙ্গে দিয়ে হেলসিঙ্কির বন্দরে একটা জাহাজে তুলল। তাদের পোরা হয়েছিল থলের মধ্যে এবং যেখানে থলে ভর্তি ময়দা রাখা ছিল তার পিছনের সারে সেই দুই বস্তায় অনেক ময়দা লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। জাহাজ সুইডেনে যাবে। জার্মান সৈনিকরা সব থলে ইনস্পেকশন করে গেল। কয়েকটি থলের মধ্যে বেয়নেট ঢুকিয়ে দেখল ময়দা ছাড়া আর কিছু আছে কিনা। ভাগ্যক্রমে আকসেলের থলে দূরে ছিল, কারও নজরে পড়েনি বা সন্দেহ হয়নি।
আধ মাইল দূরে ওপারে সুইডেন, মাঝখানে জলপথ। হেলসিববর্গ (সুইডেনে পৌঁছবার আগেই আকসেল ও ইয়ুটা থলের ভেতর থেকে মুক্তি পেয়েছিল। সুইডিশ বন্ধুরা তাদের সাদরে গ্রহণ করল। মুক্তিযোদ্ধারা আকসেলের উৎসাহে যুদ্ধকালে সংগ্রাম করে গেল নাৎসীদের বিরুদ্ধে। দুঃখের বিষয় আকসেল যখন দেশছাড়া হয়ে জার্মানদের কবল থেকে মুক্তি পেল, তখন সমস্ত আক্রোশ পড়ল মালি ভিগোর ওপর। তার ওপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছিল বেলসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে। সে সব জানত তবুও মালিককে ধরিয়ে দেয়নি কেন, এই হল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ। যুদ্ধ শেষ হলে আকসেল ও ইয়ুটা দেশে ফিরল আর আমেরিকানরা উদ্ধার করল ভিগোকে।
আকসেল লারসেন ডেনমার্কে প্রথম কমিউনিস্ট গভর্নমেন্ট স্থাপন করল এবং আকসেল ইয়ার্লকে প্রভূত সম্মানে ভূষিত করল। সম্মান লাভ হল ঠিক কিন্তু আকসেলের হৃদরোগ শুরু হল। ওদিকে মাতৃরূপিণী ইয়ুটার ক্যানসার হল এবং তিনি দেহত্যাগ করলেন কিছুদিনের মধ্যেই। এই বিদেশি মহিলা খুবই উচ্চশিক্ষিতা এবং এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। আমাকে তিনি আপনার বলে কাছে টেনেছিলাম। কতদিন দেখেছি আমার মুখের দিকে চেয়ে তন্ময় হয়ে তিনি কী ভাবছেন। এমন অবস্থায় আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা, তুমি কী দেখো আমার মধ্যে? ইয়ুটা বলল, তুমি তো হিন্দু, জন্মান্তর বিশ্বাস কর। আমি স্বীকার করলাম। তখন বলল যে সে বিশ্বাস করে আমার সঙ্গে জন্ম জন্ম তার নাড়ীর টান ছিল। আমাকে তার একটুও পর বা বিদেশি মনে হয় না। রঙের পার্থক্য আছে তবে সেটা নাকি তারই দুর্ভাগ্য যে তার রং আমার মতো খাঁটি ব্রাউন নয়। অনেক সময় ইয়ুটা আমাকে আদর করে ডাকত মাই চকোলেট সান। তার ধারণা ছিল আমি নাকি আকসেলের মতো সুপুরুষ, রঙের পার্থক্য ছাড়া। আকসেলের সঙ্গে আমার সাদৃশ্য ছিল যথেষ্ট। সেও ছয় ফুট লম্বা, তারও দীর্ঘ ঋজু দেহ কেবল মাথায় চুল বয়সের জন্য সব সাদা। বহু বছর পরে আমার স্ত্রীও একই মন্তব্য করেছিলেন আকসেলকে দেখে।
আমার সঙ্গে ইয়ুটার আর দেখা হল না। আকসেলের সঙ্গে হয়েছিল। দীর্ঘ পনেরো বছর পরে ১৯৪৮ সালে জানলাম আকসেলের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা এবং আমাকে ও আমার স্ত্রীকে দেখতে চায়। স্ত্রী পুত্র নিয়ে আবার স্ট্রয়েডামে আমার নিজের ঘরে থাকতে গেলাম অল্পদিনের জন্য। এখন থাক সে কথা।
দেখতে দেখতে আরও এক বছর ডেনমার্কে কেটে গেল। আমি অনেক ভালো আছি। সামনে শীত ও বরফ কিন্তু আমি তার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে চাই। সাইকেল ও হ্যাভারস্যাক খুঁজে বের করেছি। সব ঠিকঠাক, একদিন হঠাৎ যেমন এসেছিলাম তেমনি হঠাৎ পাড়ি দেব।
কোপেনহাগেন শহরে প্রায় যাতায়াত করতে হত। আমার নতুন উদ্যমের কার্যকলাপ দেখে আকসেল ও ইয়ুটা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। একদিন ডিনার খাবার পর আমি স্ট্রয়েডাম ছেড়ে পৃথিবী ভ্রমণে যাবার কথা বললাম। তর্কবিতর্ক হল না। নীরবে বুড়োবুড়ি চোখের জল ফেলল। আমি মনে মনে ব্যথা অনুভব করলেও সঙ্কল্প থেকে বিচ্যুত হলাম না।
রওনা হবার বারোদিন আগে থেকে এমন অদ্ভুত রকম মন খারাপ লাগছিল যে রাত্রে ঘুম হত না। যে পরিচারিকা আমার ঘর সাফ করত সে ইয়ুটার কাছে বলল যে রাত্রে আমি বিছানায় শুই না। ফলে ওদের মনের কষ্ট আরও বেড়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে সবাই যখন শুতে গিয়েছে আমি সাইকেল ও হ্যাভারস্যাক নিয়ে আমেরিকা যাবার জন্য রওনা হলাম। দুই ঘর ভর্তি কাপড়-জামা, ফটোগ্রাফির যন্ত্রপাতি পড়ে রইল, সেই সঙ্গে প্রিন্সও।
মনে কোনও দ্বন্দ্ব নেই, অথচ যারা এত ভালোবাসে ও আমাকে এত করে চায় তাদের ফেলে যেতে খুবই কষ্ট। সমস্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে আবার অনিশ্চিতের হাত ধরে চলেছি। কলকাতায় আমার মা, বাবা, ভাই, বোন, বন্ধু ও বাড়ি ছেড়ে আসতে সাত বছর আগে যেমন কষ্ট হয়েছিল ঠিক তেমনই বোধ করলাম এবারেও।
সারারাত সাইকেল চালিয়ে ভোরে কোপেনহাগেন শহরের বন্দরে গেলাম যদি জার্মানিতে যাবার জাহাজ পাওয়া যায়। ল্যুবেকগামী একটা মালবাহী জাহাজ বিকালে ছাড়বে। আমি সেটাতেই উঠলাম।