দুচাকায় দুনিয়া – ৫

হল্যান্ডে প্রবেশ করলাম Zolle Meppel-এর পথ ধরে। এই দেশকে নেদারল্যান্ড বলে কেননা এটা সমুদ্রের নিচে সমতল জমি। বাঁধ দিয়ে সমুদ্রের জল পশ্চিমে আটকানো হয়েছে। চারদিকে অসংখ্য জলপথ (খাল), মাল নিয়ে যাতায়াতের সুবিধার জন্য উইন্ডমিলও দেখা যায় প্রচুর। দেশটা খুব সমতল বলে সাইকেল এখানে যানবাহনের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। লক্ষ লক্ষ সাইকেল রাস্তা দিয়ে চলছে। মোটর গাড়ি চলার রাস্তার দুই পাশেই সাইকেল চালাবার পথ।

আমরা Utrecht ইউনিভার্সিটির একটা হস্টেলে উঠলাম। ছেলেমেয়েরা আমাদের ভ্রমণকাহিনী শুনতে চাইল। সন্ধ্যার পর একটা গ্যালারিতে গিয়ে আমাদের ভ্রমণবৃত্তান্ত বললাম। ফলে কিছু রোজগারও হল।

পরদিন আমস্টারডাম শহরে পৌঁছলাম। প্রথমেই গেলাম একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিউজিয়াম দেখতে। ইন্দোনেশিয়া হল্যান্ডের অধীন জনবহুল দ্বীপ। সে দেশে যত রকম শস্য উৎপন্ন হয় এবং তা দিয়ে কোন কোন শিল্প চলে তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন এই মিউজিয়ামে দেখলাম। ভারতবর্ষে যা কিছু উৎপন্ন হয় সেসবই ইন্দোনেশিয়ায়ও জন্মায়। তাছাড়া ওই দেশে পেট্রোল পাওয়া যায়। পর্যাপ্ত চিনি হয় যা বিদেশে বহু পরিমাণে রপ্তানি করা হয় এবং তাতে প্রচুর অর্থাগম হয়।

এখানে জগদ্বিখ্যাত ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি না দেখলে মনে হয় জীবন বৃথা। গ্যালারিতে গিয়ে রেমব্রাঁ, হোলবাইন, ভ্যান ডাইক প্রভৃতির অপরূপ অরিজিন্যাল পেন্টিং দেখলাম।

এককালে ডাচ মাস্টাররা পৃথিবীর লোকেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তাঁদের পেন্টিং বাস্তবধর্মী ছিল, সেজন্য চিরনতুন। যুগে যুগে কলাশিল্পে ইউরোপের কয়েকটি দেশের প্রাধান্য ঘটেছে এবং কালের প্রবাহে তা লীন হয়েছে, একমাত্র ফরাসি শিল্পের মহিমা যেন শাশ্বত।

হল্যান্ডে মধ্যযুগের বড় বড় আর্টিস্ট যখন অন্তর্ধান করলেন তারপর বহুদিন সেরকম কেউ তাঁর স্থান নেননি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবার একজন ডাচ পেন্টার: ভ্যান গঘ জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভ্যান হল্যান্ডকে আর্ট জগতে আবার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভ্যান গঘের জীবনী পড়ে আমি মুগ্ধ। বইটির নাম “মাই ব্রাদার্স লেটার্স’–থিও নামে ভাইকে লেখা চিঠির সমষ্টি। ভ্যান গঘ সারাজীবন চেষ্টা করে পাঁচ টাকার বেশি দামে কোনও ছবি বেচতে পারেননি। তাও কেবল একবার। তারপর দুঃখ দৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে জীবন শেষ হয়েছে। আজ যদি কয়েক লক্ষ টাকা দিয়ে একটা ভ্যান গঘের ছবি কিনতে পারে কেউ, তা সে ভাগ্যবান। আগেকার দিনে সাহিত্য ও কলার ক্ষেত্রে সর্বত্রই দেখা গিয়েছে আর্টিস্ট বা সাহিত্যিক জীবদ্দশায় অতি কষ্টে কালাতিপাত করেছেন আর মৃত্যুর পর ভাগ্যলক্ষ্মী প্রসন্না হয়েছেন।

রেমব্রাঁর ‘সেলফ-প্রোট্রেট’ আমার বিশেষ ভালো লেগেছিল। তাঁর চরিত্র স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ছবিতে।

আমস্টার্ডাম ছেড়ে আমরা ডেন হাগ নামে হল্যান্ডের রাজধানীতে গেলাম। রানির প্রাসাদের জাঁকজমক দেখলাম। তারপর আমাদের গন্তব্য রটারডাম শহর ও বন্দর। সেখান থেকে জাহাজ নিয়ে আমরা ইংল্যান্ডে রওনা হব।

রটারডাম পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল। কোথায় থাকব ভাবছি। Mr. Metsdagh-এর নামে একটি চিঠি ছিল, সেটা সদ্ব্যবহার করবার সুযোগ হল। মিঃ মেৎসদাঘ সেখানকার একজন বিশিষ্ট নাগরিক। তিনি তাঁর বাড়ির বসবার ঘর ছেড়ে দিলেন। আমরা কম্বল মুড়ি দিয়ে রাত কাটালাম।

মিঃ মেসদাঘের চেষ্টায় দুদিন পরে একটা জাহাজ পেলাম, সেটা ডোভার বন্দরে নিয়ে গেল। সকালবেলায় পাসপোর্ট ইত্যাদি দেখিয়ে ইংল্যান্ডে প্রবেশ করলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে রওনা হলাম সাইকেলে। দিনের শেষে ক্যান্টারবেরি শহরে পৌঁছলাম। এই কাউন্টি, কেন্ট খুব সুন্দর দেখতে, ছবির মতো। টনব্রিজ ওয়েলশ সেভেন ওকস পার হলাম।

ক্যান্টারবেরি ক্যাথিড্রাল দেখতে গেলাম। চার্চ দেখে সন্ধ্যায় সাইক্লিস্ট ক্লাবে গেলাম। সেখানে অল্প খরচে থাকার ও খাবার ব্যবস্থা আছে। পরদিন ভোরেই রওনা হলাম লন্ডনের পথে।

আগের চেয়ে দিন অনেক বড় হয়েছে। আজ ১৭ এপ্রিল ১৯২৮ সাল, বিকাল চারটের সময় পৌঁছলাম লন্ডনে। আমরা লন্ডনে ভারতীয় ছাত্রাবাসের কাছে এসেছি এমন সময় ঝুর ঝুর করে বরফ পড়তে শুরু করল। তারিখটা মনে রাখার মতো, কেননা আমি ভাবিনি এপ্রিল মাসেও বরফ পড়তে পারে লন্ডনে

ছাত্রাবাস সাউথ কেনসিংটন পাড়ায়, ক্রমওয়েল রোডের ওপর। পথঘাট বাড়ি ইত্যাদি দেখে মনে হল পাড়াটা উচ্চাঙ্গের। ছাত্রাবাসের লোকেরা, আমাদের ঘিরে একটা ছোট্ট অভিনন্দন দিল। এখানে অধিকর্ত্রী, মিস বেক ছেলেদের ওপর নজর রাখেন। কেউ কেউ বলত তিনি গভর্নমেন্টের চর। তিনি আমাদের বললেন যে পরদিনই যেন আমরা হাই কমিশনার ফর ইন্ডিয়া, স্যার অতুল চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করি।

ডেলি এক্সপ্রেস ও ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড কাগজের রিপোর্টার আমাদের ছবি নিল এবং ইন্টারভিউ করল। পরদিন বিস্তারিত বিবরণ বেরোল। পথে বরফের ঘূর্ণিঝড়ে কীরকম নাস্তানাবুদ হয়েছি সেসব প্রকাশিত হল।

আমি একটু হাল্কা হয়েই আমার এক বিশেষ প্রিয় বন্ধুকে টেলিফোন করলাম। সে থাকে ক্রিস্টাল প্যালেসের কাছাকাছি। নাম চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি। ইউরোপে পৌঁছবার পর সমানে আমাকে চিঠি লিখে উৎসাহ দিয়েছে যাতে আমরা হাল ছেড়ে না দিই।

ভারতবর্ষে আমাদের দলের নাম ছিল ক্যালকাটা ট্যুরিস্ট ক্লাব। চন্দ্ৰনাথ ছিল তারই অন্যতম সদস্য এবং সে আমার সঙ্গে সাইকেলে লম্বা লম্বা পাড়ি দিয়েছে দেশে। সেজন্য সে বুঝত আমরা কী ভীষণ কষ্ট স্বীকার করে দেশের পর দেশ অতিক্রম করেছি।

অশোক, আনন্দ এবং আমি আশা করেছিলাম স্যার অতুলের কাছে আমাদের দেশের কমিটির চিঠি এসেছে। এবং হয়তো সেখানে সুখবর পাব। আমার দুই বন্ধু ইতিমধ্যে মুখ খুলে লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারছে— তাদের আগেকার জড়তা কেটে গেছে। ইংরিজি আমাদের ছোটবেলা থেকেই শেখা, তাই ভারতীয়রা ইংল্যান্ডে গিয়ে নিজেকে ব্যক্ত করতে পারে এবং কিছুটা অ্যাট হোম বোধ করে। তবে ইংল্যান্ডে এলে স্পষ্ট বোঝা যায় ইংরিজি ভাষাও কত রকমের। প্রত্যেক কাউন্টিতে ভাষা একটু অন্যরকম করে বলে। আমাদের দেশে যেমন মাদ্রাজি ইংরিজি, পাঞ্জাবি ইংরিজি বা বাঙালি ইংরিজি, সেরকম আর কি। শুনেছি চিন দেশের লোকেরাও সম্পূর্ণ অন্যরূপে ইংরিজি ভাষা বলে। তাকে পিজিন ইংরিজি বলা হয়। শুনলে মনে হয় টেলিগ্রাফিক ইংরিজি। যাইহোক, স্যার অতুল চ্যাটার্জি আই সি এস একজন খাঁটি সাহেব মানুষ। পান থেকে চুন খসলে তিনি বিরক্ত হন। আমরা সকালে ফিটফাট হয়ে হাই কমিশন অফিসে হাজির হলাম। স্যার অতুল ডেকে পাঠালেন, তাঁর প্রথম কথা ভারতবর্ষ ছাড়ার আগে তাঁকে কি একবার জানানো হয়েছিল? আমরা কেমন করে আর কেনই বা স্যার অতুলের মতো একজন চাকুরে, আই সি এস-এর হুকুম নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে বেরোব, ভেবে পেলাম না। তিনি হঠাৎ আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে পড়লেন ভেবে আমরা একটু বিস্মিত হলাম। তিনি বললেন কারও কাছ থেকে কোনও চিঠি আমাদের জন্য নেই। তিনি নিজে স্টেটসম্যান কাগজে ছবি দেখে মনে মনে বুঝেছিলেন একদিন হয়তো আমরা লন্ডনে পৌঁছব। তিনি এতদিন ধরে রাগ পুষে রেখেছেন আমাদের অপেক্ষায়।

শেষকালে কথা কাটাকাটি হল। স্যার অতুল-এর রক্তের চাপের মাত্রা বেড়ে গেল আর আমরা ছাত্রাবাসে ফিরলাম। যথাশীঘ্র অন্যত্র চলে যাবার হুকুম হল। মিস বেক আগেই খবরটা পেয়েছিলেন।

বন্ধুরা মনমরা হয়ে পড়ল। সেদিনই বিকালে ব্রাজিলের অ্যাম্বাস্যাডর-এর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, আমার সেখানে যাবার সম্পূর্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও।

অ্যাম্বাসাডার বুড়ো মানুষ এবং অত্যন্ত ভদ্র। তিনি সব শুনে এবং আমাদের কাগজপত্র দেখে রাজি হলেন তাঁর দেশে যাবার অনুমতি দিতে।

অশোক ও আনন্দ উৎফুল্ল হয়ে কাগজপত্রে সই করল। দুদিন পরেই জাহাজ ছাড়বে লন্ডন থেকে রিও ডি জানেরোর জন্য। এইসব ঘটনা এত দ্রুততালে এগোবে আমি ভাবতে পারিনি। আমি অশোক ও আনন্দকে বললাম যে আমি পৃথিবী ভ্রমণের আশা এখনও ছাড়িনি। আমি আমার দেশেই ফিরতে চাই সফল মনোরথ হয়ে। ব্রাজিলে যাব ট্যুর করার পথে তখন দেখা হবে। গুড লাক টু ইউ বলে ওরা ২৯ এপ্রিল রওনা হল জাহাজে ব্রাজিলের উদ্দেশে টিলবেরি ডক থেকে।

এদিকে আমার ভ্রমণ যে কেমন করে চালাব, তার কোনও হদিশ নেই। তখন মনে হল যেমন করে হোক, যেখানে হোক সদুপায়ে দৈহিক বা মাথা খাটিয়ে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করব আর সেই অর্থে ভ্রমণ সম্পূর্ণ করতে পারব এমন আমার বিশ্বাস ছিল। একজনের মতো আয় করা সোজা।

পরে যাই হোক, আপাতত আমার জীবনের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল এভাবে। তিনটি বীর বঙ্গসন্তান অ্যাডভেঞ্চারের তাগিদে আমার সঙ্গে একসঙ্গে দেশছাড়া হয়েছিল দুবছর আগে। তারা এখন গেলেম কে কোথায়, এই অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি। প্রাণে অফুরন্ত আশা, দেহে অসীম শক্তিও ছিল। সব যেন নিমেষে আমাকে ছেড়ে চলে গেল। সঙ্গে যে টাকা আছে হিসেব করে চললে এক মাস চলে যাবে। ভাবলাম, এরমধ্যে খুঁজে নেব অন্য কাজ

লন্ডনে থেকে যাবার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইনস্টিটিউট অব ব্যাঙ্কার্সের ফাইনাল অংশটুকু পরীক্ষা দিয়ে পাশ করা। খেলাধুলা ও শরীরচর্চা নিয়ে অনেকদিন দেশে কাটিয়েছি। ভবিষ্যতের জন্য ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কে ফিরে গিয়ে উন্নততর কাজ যাতে করতে পারি তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। দেশে থাকতে ক্যালকাটা কমার্শিয়াল কলেজে এ আই বি পরীক্ষার প্রথম দুই অংশ পাশ করা ছিল। এমন সুযোগ আর হবে না। তাছাড়া আমার খুব ইচ্ছা ছিল রয়্যাল ফটোগ্রাফির সোসাইটির হলে আমার তোলা সব ছবি দিয়ে একটা প্রদর্শনী করা।

বিখ্যাত মিডল্যান্ড ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার, মিঃ হাইডের সঙ্গে দেখা করে আমার পরিচয় দিলাম আর ব্যাঙ্কে কাজ শেখবার সময় এ আই বি পরীক্ষা দেবার কথা বললাম।

আমি মিঃ হাইডের কাছ থেকে নিয়োগপত্র নিয়ে পরদিন ১৯৬নং পিকাডিলি ব্রাঞ্চে উপস্থিত হলাম। আমার সহকর্মীরা সবাই ভদ্র ও ভালো। তারা আশ্বস্ত হল যখন শুনল যে আমি আগেই ব্যাঙ্কে কাজ করেছি। রোপার নামে একটি যুবকের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। সে আমাকে আমার কাজ বুঝিয়ে দিল। এই পিকাডিলি ব্রাঞ্চে অনেক আর্টিস্ট, প্রোডিউসার ও ডিরেক্টরদের অ্যাকাউন্ট ছিল, কাজের ভেতর দিয়ে যাঁদের সঙ্গে আলাপ হল এবং তাঁদের সৌজন্যে আমার সৌভাগ্য হয় ভালো ভালো থিয়েটার দেখবার।

পিকাডিলি হচ্ছে বিরাট লন্ডন শহরের কেন্দ্রস্থল। এখানে ভালো ভালো থিয়েটার, সিনেমা ও রেস্তোরাঁ আছে। দিনের চেয়ে রাতে এ পাড়া সরগরম। হাজার বাতি জ্বলে, একেবারে দিনের মতো দেখায়।

লন্ডন শহরটা কত বড় একটু নমুনা দিই। লন্ডনের বাইরে যে কোনও এক জায়গা থেকে পিকাডিলি পৌঁছেতে অন্তত ৩০ মাইল পার হতে হবে। তার মানে শহরটা এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত অন্তত ৬০ মাইল, কোথাও কোথাও তার চেয়ে বেশি।

আগে লন্ডনবাসীদের ককনী বলা হত, যাঁরা সেন্টপল গির্জার ঘণ্টাধ্বনি এলাকার মধ্যে জন্মাত। ক্রমে ক্রমে যত সাবার্বান বা শহরতলি আছে তারা লন্ডনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে নিল। টেমস নদীর দুই পারের সমস্ত লোক এখন লন্ডনবাসী।

আমাদের কলকাতার তেমন সৌভাগ্য হয়নি। গঙ্গার ওপারে অন্য শহর হাওড়া। লন্ডনে দশ মিলিয়ান লোকের বাস। কলকাতায় মাত্র চার মিলিয়ান, এখন প্রায় সাত- আট মিলিয়ান। লন্ডন এক হিসাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। ভারতবর্ষ তথা পৃথিবী জুড়ে বহু দেশ এখান থেকে শাসিত হয়।

আমি লেখাপড়া করি ও ব্যাঙ্কে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকি। সুবিধা পেলে আর্ট গ্যালারি, মিউজিয়াম, থিয়েটার, নাচ ও গানের আসরে যোগ দিই। অনেক বন্ধু হয়েছে, তারা বেশিরভাগ ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমান। কোনওদিনই জাতিবিচার করতে শিখিনি। মুসলমান বন্ধুরা আমাকে খুব ভালবাসত এবং আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গর্ববোধ করত।

টটেনহাম কোর্ট রোডের ওয়াই এম সি এতে আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত বলবার নেমন্তন্ন পেলাম। অনেক স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গে আলাপ হল। তার মধ্যে দুজন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মিস চ্যানিং ও স্যার লুইস ক্যাসন ও তাঁর জগদ্বিখ্যাত স্ত্রী, সিবিল থর্নডাইক। মিস চ্যানিং তাঁর বাড়ি, গোল্ডারস গ্রিনে চায়ের নেমন্তন্ন করলেন পরের শনিবার। প্রতি রবিবার দুপুরে লাঞ্চ খেতে তাঁর বাড়িতে যেতে আমন্ত্রণ জানালেন।

মিস চ্যানিং খুবই সুশ্রী ভদ্রমহিলা। বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। তাঁর বাড়িতে গিয়ে এক আশ্চর্য জিনিস দেখলাম। বসবার ঘর ভর্তি কয়েক হাজার সংস্কৃত বই ও পুথি। মিস চ্যানিংয়ের বাবা আই সি এস হয়ে ভারতবর্ষে বড় কাজ করতেন। তিনি বেশিরভাগ সময় সিমলায় কাটাতেন। তাঁর সংস্কৃত সাহিত্যের ওপর অনুরাগ জন্মায়, সেজন্য ভারতীয়রা তাঁকে পণ্ডিত চ্যানিং নামে অভিহিত করেছিলেন। মিস চ্যানিং সিমলায় জন্মগ্রহণ করেন। সেজন্য তিনি নিজেকে ভারতীয় বলতেন, যদিও তাঁর চোখের রং নীল এবং চুল সোনালি রঙের। তিন বছর বয়সে তিনি ভারতবর্ষ ছাড়েন, কিন্তু ভারতীয়দের প্রতি তাঁর অদ্ভুত টান।

মিস চ্যানিংয়ের সঙ্গে আলাপের পর ৪৫ বছর আমাদের বন্ধুত্ব টিকেছিল যতদিন পর্যন্ত না ৯৫ বছরে তাঁর মৃত্যু হয় এই কলকাতায়। এঁর কথা এত লেখবার আছে যে, একখানা পুরো বই লিখে শেষ করা যায় না। এমন আশ্চর্য ব্যক্তিত্বপূর্ণ জীবন সচরাচর দেখা যায় না। তাই মিস চ্যানিংয়ের সম্বন্ধে অল্প কিছু এখন লিখছি।

বিলাতে ডেভনসায়ার-এর স্কুলে ও কলেজে পড়া শেষ করে তখনকার ইংল্যান্ডের রেওয়াজ অনুসারে সেবাব্রত নিয়ে নার্সিং শিখতে আরম্ভ করেন। তাঁর দক্ষতার জন্য পরে ডিস্টিঙ্গুইশন সার্ভিসেস মেডেলও পান।

মিস চ্যানিং তারপর রাজনীতিতে যোগ দেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই নিজেকে লেবার পার্টিতে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। আই সি এস-এর মেয়ে হয়ে কনসার্ভেটিভ পার্টিতে না ঢুকে শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দেবার মধ্যে মিস চ্যানিংয়ের মনের প্রসার ও উদারতার পরিচয় পাওয়া যায়। যখন লেবার পার্টি প্রথম ক্ষমতায় আসীন হল তখন তারা মিস চ্যানিংকে মন্ত্রিত্ব পদে নিয়োগ করতে চাইল কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বন্ধু মিস মার্গারেটে বন্ডফিল্ডের নামোল্লেখ করলেন। আমি কর্মী থাকতে চাই, কোনও পদপ্রার্থী নই, এই ছিল তাঁর মনের কথা।

রবিবার দুপুরে লাঞ্চ খেতে গেলাম সিবিল থর্নডাইকের বাড়িতে। তাঁর স্বামী, স্যার লুইস ক্যাসন খুব বুদ্ধিমান ও সহৃদয় লোক। তাঁদের দুই মেয়ের বয়স তখন ২০, ২২ হবে। তাদের নাম অ্যান ও মেরি ক্যাসন। ভ্রমণ সম্বন্ধে খুঁটিনাটি অনেক আলোচনা হল। তারপর স্যার লুইস রবীন্দ্রনাথের লেখা নাটকের উল্লেখ করলেন। স্যার উইলিয়াম রদেনস্টাইনের সহায়তায় তিনি একবার ‘ডাকঘর’ নাটক ইংরিজিতে অভিনয় করেছিলেন।

রদেনস্টাইনের সঙ্গেও আমার বেশ ভাব জমেছিল এবং তাঁর বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছিলাম। রদেনস্টাইন রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত হয়েছিলেন। শুনেছি ইংল্যান্ডের বিদ্বজ্জন সমাজে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও লেখা পরিচিত করেন যার ফল হল ইয়েটসের সঙ্গে সহযোগিতা এবং পরে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি।

আরেকজন ভারতীয় রদেনস্টাইনের কাছে বিশেষ উপকৃত। সে আমার পরম বন্ধু, উদয়শঙ্কর। স্যার উইলিয়াম রদেনস্টাইন রয়েল কলেজ অব আর্টসের নামকরা প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। আর্ট জগতের সঙ্গে যাঁরা কোনওরকমে যুক্ত তাঁরা সবাই কামনা করতেন তাঁর সঙ্গ।

আনা পাভলোভার সঙ্গে রদেনস্টাইন উদয়শঙ্করের আলাপ করিয়ে দেন কৃতী ছাত্ৰ হিসাবে। উদয়শঙ্করের তুলির কাজের চেয়ে নাচে বেশি ঝোঁক ছিল। সে সময় বুঝে পাভলোভার কাছে ‘কৃষ্ণ রাধা’ নৃত্য ‘ব্যালে’ করার কথা বলল। আর একক ও যুগ্ম নাচে দেখিয়ে দিল নাচ কী ধরনের হবে। পাভলোভা মুগ্ধ। তিনি রদেনস্টাইনের কাছে উদয়কে ধার চেয়ে নিলেন এবং দুবছর পৃথিবীর নানা স্টেজে দুজন নাচলেন।

এমনইভাবে উদয়ের জীবনে নাচ দেখা দিল। তারপর আমৃত্যু তাঁর সাধনা হল নাচের উৎকর্ষ সাধন। একজন সুইস ভদ্রমহিলা আর্টিস্ট এলিশ বোনার (পরে পদ্মবিভূষণ) তাকে খুব সাহায্য করেছিলেন দল গঠন করতে এবং ভারতবর্ষের বাইরে নানা দেশে উদয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে। উদয়ের মাধ্যমে মিস বিয়েট্রিস স্ট্রেট নামে আরেক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার আলাপ ও বন্ধুত্ব হয়। উত্তরকালে বিয়েট্রিস প্রচুর অর্থ সাহায্য করেন উদয়কে।

ফুটবলের দেশে এসেছি। একটা শনিবার ফিনসবেরি পার্কে বিখ্যাত আর্সেনাল ও চেলসির খেলা দেখতে গেলাম। কী বিরাট স্টেডিয়াম, খেলা হল খুব দ্রুততালে, এখানে ধাক্কা মেরে বল কেড়ে নেওয়া সম্পূর্ণ নিয়মসঙ্গত দেখলাম। আমার এক ফুটবল খেলার বাঙালি বন্ধু আর্সেনাল টিমে স্থান পেয়েছিল, তার নাম ননী সিকদার খালি পায়ে খেলে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। পরে যখন বরফ পড়তে আরম্ভ করল এবং মাঠ ভীষণ পিচ্ছিল হল, তখন তার খালি পায়ে খেলার উৎসাহ চলে গেল।

এখন এপ্রিলের শেষেও ইংল্যান্ডে বসন্তকাল, কিন্তু শীত খুব। একদিন ব্যাঙ্কের কাজ শেষ করে ক্রিস্টাল প্যালেসে বন্ধু চন্দ্রনাথের বাড়ি নিমন্ত্রণ রাখতে ও উইক-এন্ড কাটাতে গেলাম। আমি আমার একটি মাত্র লাউঞ্জ স্যুট পরে গিয়েছিলাম। চন্দ্রনাথ, ডাক নাম ‘চনু’ আমার কাপড়চোপড়ের সব ব্যবস্থা ঠিক করে রেখেছিল, চনুর ও আমার মাপ ছিল এক। আমার সামনে ভালো স্যুট বিছিয়ে দিয়ে সে বলল যেটা খুশি ও যটা খুশি বেছে নে। এইসব স্যুট আমার কোনও কাজে লাগবে না। এর অর্থ তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছিলাম! চনু ছয় ফুট লম্বা ছিল আমার মতো এবং তার মতো বন্ধু-বৎসল, সহৃদয় ও বুদ্ধিমান যুবক আমি কমই দেখেছি। যে তাকে চিনেছে সেই ভালোবেসেছে।

গৃহস্বামিনী চন্দ্রকে খুব স্নেহ করেন। আমাকে তিনি উপস্থিত অতিথিদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ডিনার শেষে সবাই আমার ভ্রমণকাহিনী শোনবার আগ্রহ দেখাল। আমিও খুব উৎসাহ করে বললাম। তখন রাত এগারোটা বাজে, কিন্তু তখনও শেষ হল না।

রাত বারোটার সময় বাড়ির সংলগ্ন বাগানে একটা চেরি গাছের নিচে আমি বিছানা পাতলাম যদিও চনুর প্রশস্ত শোবার ঘরে আমার বিছানা প্রস্তুত ছিল। রাত তখন তিনটে হবে, এমন একটা বিকট শব্দ হল, মাথার ওপরে যেন গাছটায় বজ্রপাত হয়েছে। আমি অবাক হয়ে নিজেকে দেখলাম অস্পষ্ট আলোতে যে আমি বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে আছি। ঘুমস্ত অবস্থা থেকে কেমন করে তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠলাম বিছানার ওপর, স্মরণে এল না। খানিকক্ষণ পরে বিছানার ওপর ধপ করে একটা ইঁদুর পড়ল। বুঝলাম পেঁচা আমার আগমনে অখুশি, তাই বিকট চেঁচিয়ে আমার ঘুম ভাঙাল।

ইঁদুরটা ফেলে দিয়ে আবার শুলাম। তখন বাড়িতে ঢোকবার সব দরজা বন্ধ। শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত্রে বেশ শীত আছে দেখলাম।

চার-পাঁচদিন পরে চনু বিকালে আমার বাড়িতে উপস্থিত। দুই বন্ধু মিলে ডিনার খাব এবং ডুরি লেন থিয়েটারে শো বোট দেখতে যাব। আমেরিকা থেকে এই বইটা নাম করে লন্ডনে এসেছে। স্টেজের ওপর জল স্টিমার, লোকজন উঠছে নামছে আর তার সঙ্গে নাচ-গানও চলছে। এরকম বিরাট স্টেজ কখনও দেখিনি। আমাদের দেশে কাপড়ের ওপর নানা রং দিয়ে আঁকা দৃশ্য ওপরে টাঙিয়ে রাখা হত। তারপর যেরকম সিন প্রয়োজন সেটি ওপর থেকে নামিয়ে দেওয়া হত। একেবারে সেকেলে ব্যাপার। অনেক বছর পরে শিশিরকুমার ভাদুড়ি আমাদের দেশে সেট সিন তৈরি করে অবস্থার উন্নতি ঘটান। এরজন্য তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং নানাবিধ উন্নতির ভেতর দিয়ে নিজের কৃতিত্ব প্রকাশ করেন।

শো বোটের ওপর আকর্ষণ ছিল পল রোবসনের গান। ইংল্যান্ডের লোকেরা এত গুরুগম্ভীর গলার গান আগে কখনও শোনেনি। এই নিগ্রো গায়কের নাম তখন সবার মুখে শোনা যেত। কত গায়ক পল রোবসনের অনুকরণে ওলম্যান-রিভার গাইল কিন্তু কেউই তার ধারে কাছে এল না।

বন্ধুকে বিদায় দিয়ে আমি ছাত্রাবাসে ফিরলাম।

দুদিন পরে মিস বেক-এর কাছে শুনলাম স্যার অতুল আমাকে ডেকেছেন। স্যার অতুল আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন করে আমি দেশে ফিরে যাব। আমার রাগ হয়ে গেল, বললাম ‘যেদিন আমার ইচ্ছা ও সুবিধা হবে।’ স্যার অতুল বললেন, হ্যারি পালটের লেকচার শোনবার জন্য লন্ডনে সময় কাটানোর অর্থ হয় না। প্রত্যুত্তরে বললাম যে আমি স্বাধীন দেশে আছি, তাঁর তাঁবেদার নই। স্বাধীনভাবে আমার সব কিছু করবার অধিকার আছে।

দুদিন পরে ছাত্রাবাস ছেড়ে হ্যাম্পস্টেড হিথের খুব কাছে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে উঠে গেলাম। ফ্ল্যাটটা মিস চ্যানিং খুঁজে বের করেন— তাঁর বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে। একটা বসবার ও শোবার ঘর, একটা রান্নাঘর ও বাথরুম মিলে ফ্ল্যাটটা তিনতলার ওপর, মন্দ নয় একজনের পক্ষে। মিস চ্যানিং-এর টেলিফোন আমি ব্যবহার করেছি যথেষ্ট। তাছাড়া তাঁর নেমন্তন্ন লেগেই ছিল।

হঠাৎ এক সকালে মিস থর্নডাইক, পরে ‘ডেম সিবিল থর্নডাইক’ (মস্ত সম্মানের অধিকারী) আমার ব্যাঙ্কে উপস্থিত। তিনি বললেন যে একটা অত্যুৎকৃষ্ট ‘প্লে’ হবে, তার নাম ‘ওথেলো’। মরিস এভান্স, পল রোবসন, পেগি এসক্রাফট, থর্নডাইক নিজে ও স্কট ইত্যাদি মিলে ‘স্টার কাস্ট’।

মিস থর্নডাইক-এর মতে, এক অপূর্ব ‘ওথেলো’ দেখতে পাব। আমাকে একটা পাস দিলেন প্রথম রাত্রের অভিনয় দেখবার জন্য। পল রোবসনের প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ। এত ভালো অভিনেতা তিনি খুব কম দেখেছেন। আরও বললেন যে শেক্সপিয়ার রোবসনের জন্য যেন ‘ওথেলো’ লিখেছিলেন।

প্রথম রাত্তিরে অভিনয় এত ভালো হয়েছিল যে সবাই খুব প্রশংসা করেছিল। কোনও কোনও লোকের মতে, একটি মাত্র খুঁত হচ্ছে যে পল রোবসন নিগ্রো হয়ে শ্বেতাঙ্গিনী ডেসডিমোনার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করা দৃষ্টিকটু হয়েছে। অভিনয়ের মধ্যেও কালাধলার প্রশ্ন!

আমি অধীর আগ্রহে ‘ওথেলো’ দেখতে গেলাম চনুকে নিয়ে। সে টিকিট কেটে আলাদা বসেছিল। যা দেখলাম এবং যা শুনলাম সব যেন বাস্তবের রূপ নিয়েছিল দর্শকদের কাছে, এত সুন্দর ও ভালো অভিনয়। পল রোবসন কলেজে ছাত্রাবস্থায় শেক্সপিয়ারের নাটকে অভিনয় করেছে কিন্তু কারও ধারণা ছিল না সে কত উঁচু দরের অভিনেতা।

দ্বিতীয় দিন অভিনয়ের পর ‘ওথেলো’ বন্ধ করে দেওয়া হয় বর্ণবৈষম্যের জন্য। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম সাদা রং-এর কী দেমাক। মিস থর্নডাইকের মনে সাদা- কালোর পার্থক্য ছায়াপাত করে না। ক্যাসন পরিবারের লোকেদের প্রকৃতি বোধ হয় অন্য ধাতু দিয়ে প্রস্তুত।

যাহোক আমি চিরদিন সেই রাত্রের ‘ওথেলো’ নাটকে রোবসনের অভিনয়ের কথা মনে রাখব। অনেক শ্রেষ্ঠ অভিনেতাকে এই অংশে দেখেছি। তুলনায় তারা রোবসনের ধারে কাছে আসে না। পল রোবসনের অভিনয় করা আর হল না। তিনি গান গেয়ে সবার মন জয় করেই সন্তুষ্ট থাকতে পারলেন না। ক্রমে ক্রমে কমিউনিজম তাঁকে আকৃষ্ট করল যদিও তিনি ইংল্যান্ডেই বসবাস করতে শুরু করলেন। আরেকটিবার আমি পল রোবসনকে ইউজিন ওনিলের’ নাটক ‘হেয়ারি এপ’-র ফ্লোরা রোবসনের সঙ্গে অভিনয় করতে দেখেছি।

হ্যামস্টেড হিথ খুব কাছেই। আগস্ট মাসে White Monday Fair বসল সেখানে, আমি একরকম খেলায় দুবার জিতলাম। প্রথমবার পেলাম একটা হাঁস, দ্বিতীয়বার পেলাম একটি নারকোল।

আমার এক ভাগ্নে, সুকুমার ব্যানার্জি, আই সি এস পরীক্ষা দেবার জন্য অক্সফোর্ডে ছিল। আমি প্রায়ই তার কাছে যেতাম। তার অনেক ভারতীয় ও ইংরেজ বন্ধুর সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল। সবাই মিলে লন্ডনে অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ডের টেস্ট ম্যাচ দেখতে আসবে এবং আমাকে টিকিট জোগাড় করে দিতে হবে। আমি রাজি হলাম।

অক্সফোর্ড থেকে পাঁচজন এল খেলা দেখতে। তিনজন ভারতীয় ও দুজন ইংরেজ। ওভালে খেলা হচ্ছে। ভালো বসবার জায়গা পেলাম। দুপুরবেলায় লাঞ্চ খাবার সময় একটা কাণ্ড হয়ে গেল। লাঞ্চপ্যাকেটের (৬ জনের জন্য) টিকিট কিনে বাক্স নেবার ‘কিউ’-এ দাঁড়ালাম। টিকিটের নম্বর মিলিয়ে বাক্স দিচ্ছিল। আমার পালা আসবার আগেই একজন বিরাটকায় ইংরেজ আমার সামনে এসে দাঁড়াল এবং অবজ্ঞার সুরে সরে যেতে বলল। আমি প্রথমটা বুঝতে পারিনি। কারণ জিজ্ঞাসা করতে কেবল এককথায় বলতে লাগল ইউ কান্ট স্ট্যান্ড বিফোর মি’, অর্থাৎ তুমি আমার আগে ‘কিউয়ে’ দাঁড়াতে পার না। তখন আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি, আমি তার টিকিটের নম্বর জানতে চাইলাম। সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবার বলল, ‘ইউ কান্ট স্ট্যান্ড বিফোর মি’। ‘আই হ্যাড মেনি ‘বয়েস’ লাইক ইউ ইন ইন্ডিয়া’ অর্থাৎ ভারতবর্ষে তোমার মতো অনেক চাকর আমার অধীনে কাজ করত। লোকেরা কিন্তু বিরাট বপুর অন্যায় আবদারে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, তারাও দুয়েকজন টিকিটের নম্বর দেখতে চাইল। কিন্তু লোকটার মারমূর্তি দেখে পিছিয়ে গেল।

তখন আমি অতিষ্ঠ হয়ে লোকটার গলা ধরে বললাম, ‘তুমি বড় ঝামেলা করছ’। সে আমার হাতটা খপ করে ধরেই আমার চোখের ওপর এক ঘুষি মারল। গেলাম টেস্ট ম্যাচ দেখতে তারপর শুরু হল মারামারি। বলাই চ্যাটার্জি ও অশোক চ্যাটার্জির কাছে বৃথা বক্সিং শিখিনি। মুখটা চট করে সরিয়ে নিয়ে উল্টে একটা ঘুষি মারলাম পুরো জোরে। ফলে রক্তপাত হল। ভিড় জমে গেল। দমবার ছেলে নই। মারামারিতে যখন বাধ্য করেছে তখন ফলভোগ করতেই হবে। সুকুমার ও তার বন্ধুরা অবাক হয়ে দেখল মামা হাতাহাতি ছেড়ে ঘুষোঘুষি করছে এক ইংরেজের সঙ্গে।

অবশেষে সাহেবকে মাটিতে ফেলে তার বুকে চড়ে বসলাম। দ্বন্দ্বের শেষ হল। লজ্জায় ও অপমানে লোকটার চমক ভাঙল। সব লোকের আমার প্রতি সহানুভূতি ছিল, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। সবাই আমাকে সমর্থন জানাল, আমি উঠে খাবার নিতে চলে গেলাম।

ছয় বাক্স খাবার নিয়ে টেবিলে খেতে বসলাম। খানিক পরে আশ্চর্য হয়ে দেখি সেই লোকটা সাত বোতল বিয়ার নিয়ে আমার দিকে এগোচ্ছে। আবার মারামারি হবে আশঙ্কা করে আমি আগন্তুকের দিকে চেয়ে রইলাম। কোনও কথা না বলে সে টেবিলের ওপর বোতলগুলি রাখল এবং আমাকে লক্ষ করে বলল ‘আমি কি বসতে পারি’? আমিও অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভদ্রতা করে বসতে বললাম। ভাবলাম আজকের দিনটা মাটি হয়ে গেল। এমন সময় লোকটা বলল ‘আই অ্যাম সরি’ তারপর প্রত্যেকের সামনে একটা করে বোতল রেখে বলল ‘এসব তোমাদের জন্য এনেছি— আমার বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিল, আমি সত্যিই দুঃখিত’। আমাদের ঘিরে মস্ত ভিড় জমে গিয়েছিল। কী আর করি লোকটার বাড়ানো হাতে হাত রেখে করমর্দন করলাম এবং তখন জিজ্ঞেস করলাম যে সে ভারতবর্ষে কোনওদিন গিয়েছিল কিনা। খুব গর্ব করে বলল যে সে আসামে এক চা-বাগানে বিশ বছর ম্যানেজার ছিল। তখন আমি ব্যাপারটা বুঝলাম, ভারতবর্ষে তোমার মতো অনেক ‘বয়’ ছিল— এ কথাটার অর্থ।

গাওয়ার স্ট্রীটের ভারতীয় ছাত্রাবাস আমাকে একদিন নিমন্ত্রণ করল লাঞ্চ খাবার ও ভ্রমণকাহিনী শোনাবার। অনেকের সঙ্গে আলাপ হল। বিশেষ খুশি হলাম পুরনো ক্লাস ফ্রেন্ডসের দেখা পেয়ে যেমন, অজয় আচার্য (পরে সুবিখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার) ও শামসুজ্জোহা, সে উত্তরকালে কলকাতা হাইকোর্টে রিসিভার হয়েছিল। আর দুজন যুবকের সঙ্গে আলাপ হল যারা আমার সারা জীবনের বন্ধু হয়ে গেল। একজন তুষার রায়, অন্যজন রঞ্জিতকুমার সেন।

খ্যাতনামা কবি, সুরকার ও ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গেও পরিচয় হল। তিনি আমাকে প্রথম প্রশ্ন করলেন গান গাইতে জানি কিনা। আমি ‘না’ বলাতে দুঃখিত হলেন। মাঝে মাঝে তাঁর আসরে গান শুনতে যেতাম রঞ্জিত সেনের (টুলুর) সঙ্গে। চরিত্রগুণে অতুলপ্রসাদ সেনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। অমন অমায়িক রুচিসম্পন্ন বুদ্ধিমান লোক কম দেখা যায়। তন্ময় হয়ে তিনি ঠুংরি গান গাইতেন। টুলু সেনকে শেখাতেও তাঁর উৎসাহ খুব।

আমার বন্ধু চন্দ্রনাথের কৃপায় প্রথম অভিজ্ঞতা হল কয়েকটি বিষয়ে। একদিন সে চেলসি ফ্লাওয়ার শো দেখবার টিকিট কিনে নিয়ে এসে হাজির। ‘এই ফ্লাওয়ার শো’তে একমাত্র ‘ক্রিসানথেমাম’ ফুলই দেখানো হয়। আমি কখনও একসঙ্গে এত ক্রিসানথেমাম দেখিনি

পরদিন শনিবার ‘ওয়েমল্বী’তে ফুটবল কাপ ফাইনাল দেখতে গেলাম। ‘স্টেডিয়ামে’র মধ্যে এক লক্ষ লোকের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। খেলা আরম্ভ হতে প্রায় এক ঘণ্টা বাকি। মাঠের মাঝখানে একটা মঞ্চের ওপর একজন লোক দাঁড়িয়ে। ডান হাতে ছোট একটা সরু লাঠি নিয়ে সবাইকে একসঙ্গে গান ধরতে ইঙ্গিত করল। সব জানা গান, তাছাড়া হাজার হাজার কাগজে ১০টা গান ছেপে বিনামূল্যে সবাইকে বিতরণ করেছিল— আমার কাছেও এক কপি ছিল। এক লক্ষ স্ত্রী-পুরুষ সমস্বরে গান ধরল— গণসঙ্গীত বা বৃন্দগান যাকে বলে। সব কটা গান হয়ে যাবার পর মঞ্চটা সরিয়ে নিল এবং টটেনহাম হটসপার বনাম বোল্টন ওয়ান্ডারার্সদের খেলা শুরু হল। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জও এই মাঠে খেলা দেখতে এসেছেন।

একটা জরুরি টেলিফোন সংবাদে জানলাম চন্দ্রনাথ পরদিন আমার সঙ্গে লাঞ্চ খাবে, সাউথ কেনসিংটনের রাশিয়ান রেস্তোরাঁতে। যথাসময়ে দেখা হল।

‘ওয়েট্রেস্’ খাবারের অর্ডার নিতে এল। চনু দুটো বড় হুইস্কির অর্ডার দিল এবং জল বা সোডা না মিশিয়ে একটার পর একটা খেল। আমি হতবাক হয়ে বললাম এই রকম করলে কতদিন শরীর টিকবে? চনু আমার হাত ধরে বলল, মন দিয়ে শোন। আমার কাছে একটা চরম দুঃসংবাদ এসেছে। হার্লে স্ট্রীটের বিশেষজ্ঞ যাঁর চিকিৎসাধীনে সে ছিল অনেকদিন, তিনি জানিয়েছেন যে সাত থেকে দশদিনের বেশি চনু বাঁচবে না, এমনই খারাপ ধরনের টি বি তার গলায় হয়েছে। তখন এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়নি, টি বি-র কোনও চিকিৎসাই ছিল না। তবু আমার মনে হল ডাক্তার হয়তো ভুল করছেন। চনুর উচিত বাবা-মার কাছে যথাশীঘ্র চলে যাওয়া। আজকালকার মতো তখন এরোপ্লেন ছিল না। জাহাজে কলকাতা পৌঁছতে অন্তত ২০ দিন লাগত।

ওয়েট্রেস্ স্যুপ নিয়ে এল। তার সঙ্গে আমার চোখের জল মিশিয়ে ফেরৎ দিলাম। এই দুঃসংবাদে আমারও আর কিছু খাওয়া হল না। চন্দ্রনাথ তখন ধীরস্থির, সে বুঝেছে মৃত্যু তার দ্বারে। খুব সহজভাবে সে কথাবার্তা বলল এবং অনুরোধ করল যাতে আমি কলকাতায় ফিরে তার বাবা মা স্ত্রীকে সব খবর দিই। বিদায় নিয়েই চনুর বাবাকে একটা লম্বা টেলিগ্রাম পাঠালাম। তিনি টেলিগ্রাফ মানি অর্ডার করে টাকা পাঠালেন এবং টিকিট কিনে দিলেন প্রথম জাহাজে জায়গা রিজার্ভ করে। তিন দিনের মধ্যে লন্ডন ছেড়ে আমার বন্ধু মার্সেলস-এর পথে রওনা হল। মিসেস মীশন ছেলের মতো ভালোবাসতেন চনুকে। তিনি ফ্রান্সে গেলেন জাহাজে উঠিয়ে দিতে। যাবার সময় চনু বলল ‘এসব তোর কারসাজি, যাক ভালোই করেছিস যদিও আমার বাড়ি পৌঁছবার মতো পরমায়ু আর নেই’। আমি বললাম ‘নিশ্চয়ই পৌঁছবি’।

চন্দ্রনাথ তারপর সাত বছর বেঁচেছিল। উত্তরপাড়ার কাছে গঙ্গার ওপর একটা বোটে সে তার বাবার সঙ্গে থাকত এবং যতদিন বেঁচেছিল আমাকে উৎসাহ দিয়ে চিঠি দিয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে।

রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি থেকে নিমন্ত্রণ পেলাম প্রদর্শনী করবার। একশো ছবি পাঠালাম। দশদিন কেটে গেল ছবিগুলো সাইজ-মাফিক সাজিয়ে গুছিয়ে পাঠাতে। লোকের ভিড় জমতো ছবি দেখবার জন্য— এক সপ্তাহ পরে ছবি ফেরৎ আনলাম। কার্ডবোর্ড দিয়ে বাঁধাবার পর ছবিগুলো এক বোঝা হয়ে দাঁড়াল।

প্রদর্শনীর দুটো বড় ফল পেলাম। প্রথমটা হচ্ছে যে আমি এ আর পি এস নির্বাচিত হলাম। ফটোগ্রাফির জগতে এটি একটি বিশেষ সম্মান। দ্বিতীয় হচ্ছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ব্রুস, ফ্রান্সিস ইয়ংহাসব্যান্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় সে কথা আমি আগেই বলেছি। জেনারেল ব্লুস এই সোসাইটির একজন বিশেষ সদস্য আর স্যার ফ্রান্সিস ইয়ংহাসব্যান্ড হচ্ছেন রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। তিনি ইংল্যান্ডের এক কৃতী সন্তান। একাধারে সেনাধ্যক্ষ, লেখক ও পরিব্রাজক। তিনি অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে তিব্বত গিয়েছিলেন। তিব্বতে খুব ঘুরেছেন এবং অপূর্ব বই লিখেছেন। ইংল্যান্ডের মতো দেশে যেখানে যোদ্ধা, অ্যাডভেঞ্চারার, ট্র্যাভেলার বিপুল সংখ্যক সেখানে রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি হওয়া অতি সম্মানের। স্যার ফ্রান্সিস এখন বৃদ্ধ। তিনি হিন্দু দর্শনশাস্ত্র নিয়ে মেতে আছেন।

জেনারেল ব্রুসের সঙ্গে সৌহার্দ্য জমে উঠেছিল। তিনি প্রায়ই আমাকে তাঁর বাড়িতে ডাকতেন। আমার মনে হত যেন এক ছোটখাটো ভারতীয় মিউজিয়ামে এসেছি, এত সুন্দর সুন্দর স্ট্যাচুয়েট ও পাথরের ওপর খোদাই করা কাজ চারদিকে ছড়াছড়ি।

স্যার ফ্রান্সিস ইয়ংহাসব্যান্ডের বাড়িতেও নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। এঁর বাড়িতেও নানারকম তিব্বতীয় কারুকার্যে ভরা জিনিসপত্র দেখলাম। লেডি ইয়ংহাসব্যান্ড অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। ধীরে ধীরে কথা বলেন এবং ইয়ংহাসব্যান্ডকে ভগবানের অবতারের মতো সম্মান ও সমীহ করে চলতেন।

রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির মিটিংয়ে মোটামুটি কী বলব এবং কী বললে ভালো হয় সে সম্বন্ধে স্যার ফ্রান্সিস আমাকে তালিম দিলেন।

এক সপ্তাহ পরে সোমবার আমি আমার ভ্রমণের ধড়াচুড়ো পরে সাইকেলে সোসাইটি হলের মিটিংয়ে গেলাম। লোকে লোকারণ্য। ভারতবর্ষের নতুন হাই কমিশনার, স্যার বি এন মিত্র মহাশয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, আলাপ হল। অফুরন্ত ট্র্যাভেলার-এর সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার ব্রুস আমায় আলাপ করিয়ে দিলেন। আমার সেদিকে খেয়াল ছিল না। সামনে পরীক্ষায় কেমন করে পাশ করব সেই সম্বন্ধে মনের মধ্যে আলোচনা করছিলাম। একঘণ্টা পরে স্যার ফ্রান্সিস সভাপতি হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং প্রথম ভারতীয় ভূপর্যটক বলে অভিনন্দন জানালেন। বেশিরভাগ লোক ইভনিং স্যুট পরে গিয়েছিল। মনে হল, খুবই গণ্যমান্য। মস্ত বড় হল আলোয় আলো।

আমি এক রকম কম্পিত বক্ষে সন্ত্রস্ত চিত্তে আমার বক্তব্য শুরু করলাম। গলায় যেন আওয়াজ বেরোচ্ছে না। প্রথমে নিজের কথা নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম না। তারপর গলাটা ঝেড়ে নিয়ে জোর গলায় বলতে আরম্ভ করলাম। আমরা কত কষ্ট করে মরুভূমি এবং পরে শীতকালে সারা ইউরোপ পার হয়ে এসেছি সে কাহিনী শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। স্যার ফ্রান্সিস এমন সময় উঠে মাইকে জানালেন যে আমি ভারতবর্ষ থেকে কোনওরকম সাহায্য পাইনি। সবাই আমার বক্তব্য শুনল, আমি পরে কোন পথে কোথায় যাব এবং কবে আন্দাজ বাড়ি ফিরব। আমার বক্তব্যের শেষে স্যার ফ্রান্সিস জানালেন সোসাইটির তরফ থেকে আমাকে ফেলোশিপ দেওয়া স্থির হয়েছে। প্রভূত হর্ষধ্বনি ও হাততালির ভেতর মিটিং শেষ হল।

প্রশ্নোত্তরের সময় টি শ নামে এক ভদ্রলোক মরুভূমি কোন পথে পার হয়েছি জানতে চাইলেন। আমি বলার পর তিনি বললেন যে মোটামুটি ওই পথে তিনি উটের দল নিয়ে পার হয়েছেন এবং পায়ে হেঁটে বালির ওপর চলার কষ্ট তিনি ভালোরকমই জানেন। সৌদি আরব থেকে তিনি ডের-এর-জোর দিয়ে বাগদাদ গিয়েছিলেন অর্থাৎ আমাদের উল্টোপথে।

স্যার ফ্রান্সিস ফিস ফিস করে আমাকে বললেন, ইনি হচ্ছেন লরেন্স অব আরেবিয়া। আমি বললাম, আমি আলাপ করে ধন্য হলাম।

ইংরেজ সুধীজন সমাজে এত উৎসাহ পেলাম যে মনে মনে আরেকবার প্রতিজ্ঞা করলাম যেমন করে পারি এবং যতদিনে হোক আমার ভ্রমণ শেষ করব।

মিটিং শেষ হল। স্যার ফ্রান্সিস আমাকে ‘শ’-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি নিমন্ত্রণ পেলাম হ্যাম্পশায়ারে তাঁর কটেজে যাবার ও থাকবার। সে সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল।

শনিবার বিকেলে ক্রমওয়েল রোডে অতুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গে চা খেতে গেলাম। লখনউয়ের অনেক গল্প হল। সেইদিনই বিকালে দিলীপ রায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এবং দুজনে মিলে গান গাইলেন। এমন সময় রঞ্জিত সেনও (টুলু) এল। পরে, ভালো দেশি খাবার ও গান শোনবার ইচ্ছা হলে কতদিন যে টুলু সেনের ফ্ল্যাটে গিয়েছি তার ঠিক নেই।

একদিন টুলু সেনের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি বার্লিনের নশা সেন। জার্মানি থেকে এম ডি পাশ করে ডাক্তার হয়ে বিলেতে আরও পড়তে এসেছে। আমরা তিনবন্ধু হৈ চৈ করলাম। পরে কয়েকদিনের জন্য বেলসাইজ পার্কে নশার ফ্ল্যাটের পাশেই আমি একটা ঘর নিলাম এবং সেখান থেকে পিকাডিলিতে ব্যাঙ্কের কাজে যেতাম। আবার সপ্তাহের তিন সন্ধ্যায় রিজেন্ট স্ট্রীট পলিটেকনিকে ফটোগ্রাফি চর্চা করতাম। আমার সময় কোথা দিয়ে চলে যেত তার খেয়াল থাকত না।

সাউথ কেনসিংটনে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, সায়েন্স মিউজিয়াম এবং ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট মিউজিয়াম দেখে এলাম। কী ভালো লাগল! শেষোক্ত জায়গায় অনেক ভারতীয় চারুকলার সামগ্রী দেখেছি যেমন ইন্ডিয়া হাউস লাইব্রেরিতে দেখেছি ভারতীয় বই, পুথি ও মিনিয়েচার পেন্টিং।

ব্রিটিশ মিউজিয়াম একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান। গ্রিক রোমান ও পুরাতন মিশরের অমূল্য প্রত্নতত্ত্বের জিনিসে ঠাসা। অনেক ভাস্কর্য ইত্যাদিও রয়েছে।

একটু অবস্থাপন্ন ইংরেজের বাড়ি ও কন্টিনেন্টের লোকের বাড়ি যেমনভাবে চিন দেশের শিল্পকলার জিনিস দিয়ে ভর্তি দেখেছি তাতে আমার মনে হত যেন চিন দেশ উজাড় করে এরা ইউরোপে সব নিয়ে এসেছে। এই থেকে বোঝা যায় কী পরিমাণ আর্টসামগ্রী চিন দেশে জন্মেছিল। তার রপ্তানি আজও শেষ হয়নি। কোনও ‘সেল’ দেখতে গেলে প্রথমেই নজরে পড়ে চিন দেশের তৈরি জিনিস অসংখ্য সাজানো রয়েছে বিক্রির জন্য। অনেক চড়া দামে সব বিক্রি হয়। বড় লোকের বাড়ি সাজাবার, বিশেষ অঙ্গ এগুলি। জার্মানিতে ইজিপ্টের চারুকলার কাজও অনেক বাড়িতে দেখেছি।

রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির মারফৎ একটা চিঠি পেলাম। আমার প্রদর্শনী দেখে খুশি হয়ে রাশিয়ান এম্ব্যাসি নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছে এই কথা জানিয়ে যে আমি যদি রুশ দেশে গিয়ে আমার যা ভালোলাগে তেমন একশো বাছাই ছবি তুলি তবে তার সমস্ত খরচ রুশ সরকার দেবে— খাওয়া-থাকার, তাছাড়া কিছু পারিতোষিক ও

এই নিমন্ত্রণ পরে কাজে লাগিয়েছিলাম।

দক্ষিণ কেনসিংটন দিয়ে চলবার পথে একদিন লক্ষ করলাম একটা বড় বাড়ির দরজায় লেখা ইউ আর ওয়েলকাম।

ইতস্তত করতে করতে বাড়িতে ঢুকলাম। লোকেরা খুব সেজেগুজে ইভনিং ড্রেস পরা, চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাকে বিদেশি দেখে সবাই উৎসাহ দেখিয়ে একটা হলে নিয়ে গেল। সেখানে রুশ ভাষায় একটা নাটক হচ্ছিল। হংস মধ্যে বক যথা আমি সাধারণ বেশভূষায় রাশিয়ানদের মাঝে গিয়ে বসলাম। ভাষা বুঝি না কিন্তু এমন একটা হাসির ব্যাপার স্টেজে ঘটল যা দেখে আমিও হাসি থামাতে পারলাম না।

ইন্টারভেলের সময় পাশের মেয়েটি আমাকে হাসতে দেখে জিজ্ঞাসা করল আমি রুশ ভাষা জানি কিনা। না বলাতে তার উৎসাহ না কমে বেড়ে গেল। মেয়েটির নাম নীনা মেজকি, তার মার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল। ক্রিকেট খেলার বিখ্যাত মাঠ ওভালের কাছে তাদের বাড়ি। আমাকে তাদের বাড়ি নেমন্তন্ন করল।

নীনারা আসলে হোয়াইট রাশিয়ান। রুশ বিদ্রোহের সময় এরা দেশ ছেড়ে ১৯১৭ সালে পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।

সেদিন রাশিয়ান এমিগ্রের দল পুনর্মিলন উপলক্ষে একত্র হয়ে হাসি গান থিয়েটার নাচ ইত্যাদিতে যোগ দিয়েছিল।

থিয়েটার শেষ হবার পরই হল ঘর থেকে সব চেয়ার সরিয়ে দিয়ে, নাচ শুরু হল। নীনা আমাকে নাচের জায়গায় নিয়ে গেল। আমি খুব সহজেই নাচতে আরম্ভ করলাম। নীনা ছিল আনা পাভলোভার নাচের দলের একজন ব্যালে ডান্সার। দেখতে একটুও সুন্দর নয় কিন্তু ফিগার ভালো। আমার সঙ্গে ভাব হবার পর অনেক নিমন্ত্রণে তাকে নিয়ে নাচতে গিয়েছি। নীনা আমাকে আনা পাভলোভার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। তাঁর মুখে উদয়ের প্রশংসা শুনলাম। উদয়শঙ্করের নাচ দেখতে বললেন যদি সুযোগ পাই।

নীনার মার কাছে রুশ চলিত ভাষা শিখতে আরম্ভ করলাম।

সাউথ কেনসিংটনে থাকতে অনেক বন্ধু হয়েছিল। ৬ জুন বন্ধুরা বলল ‘ডার্বি’ ঘোড়দৌড় দেখতে যাবে এবং সেটা আমার যাওয়ার ওপর নির্ভর করছে। ওদের ধারণা আমি নিশ্চয় ঘোড়ার রেস সম্বন্ধে সব কিছু জানি যেহেতু খবরের কাগজের স্পোর্টসের পাতায় ঘোড়দৌড় সম্বন্ধে লেখা আমি রোজ পড়ি। কিন্তু আমি কখনও রেস খেলিনি বা রেসের মাঠে যাইনি। ঘোড়া আমি ভীষণ ভালোবাসি। তাদের গতিবিধি আমি লক্ষ করি। কাগজে দেখি কে কত জোরে দেড় মাইল দৌড়চ্ছে— কোন ঘোড়ার বাবা এবং মা কে। তারপর জকিদের ইতিহাস মুখস্থ করা আমার রোগ বিশেষ।

কাদ্রি নামে এক বন্ধুর গাড়িতে আমরা পাঁচজন নিউ মার্কেটে এপসম ডার্বি রেস দেখতে গেলাম।

বন্ধুরা পকেট ভর্তি টাকা এনেছিল বাজি খেলার জন্য কিন্তু আমি বললাম কেবলমাত্র একটি রেসে আমি টাকা ফেলব, কেননা আগা খাঁর ঘোড়া বাহামের রেকর্ড আমার খুব মনোমত এবং তার জকি, হ্যারি র‍্যাগও ভালো। সেদিন অন্য একটি ঘোড়া জিতবে এমনই মাঠের খবর। লক্ষ লক্ষ টাকা তার ওপর লোক ঢালল। আমি আমার ও বন্ধুদের টাকা নিয়ে বাহাম-এর ওপর খেললাম। প্রথম দিকে খুব ভালো দাম ছিল। সাধারণের বিশ্বাস ফেয়ার প্রে জিতবে— বাহাম জিতবে না সেজন্য দর ছিল এক টাকায় একশো টাকা।

দারুণ উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে ডার্বি দৌড় শেষ হল। বাহাম জিতল। টাকা নেবার বেলায় মাত্র আমরা দুজন বুকির কাছে গেলাম। আমার প্রত্যেক বন্ধু পঁয়ষট্টি পাউন্ড পেল পাঁচ পাউন্ডের পরিবর্তে, প্রায় হাজার টাকা। তখন বন্ধুদের আহ্লাদ ধরে না। তারা ঠিক করল আমি নিশ্চয় পাকা জুয়াড়ি, কিন্তু আমি ঠিক তার উল্টো। আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম কখনও খেলতে যাব না। ডার্বিতে যাওয়া শুধু একটা অভিজ্ঞতা লাভের জন্য।

টাকা তুলতে গিয়ে দেখি অন্যজন মিঃ এফ জি হোয়াইট। সে আমারই বয়সী, কলকাতায় ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কে আমার বস ছিল।

আমরা পরস্পরকে দেখে খুবই আনন্দিত। পকেট ভর্তি টাকা পুরে হোয়াইট বলল আর সে খেলবে না। আমারও সেই মত। ওদিকে পরের রেস খেলার ঘণ্টা বাজল। বন্ধুরা পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও আমি তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম না। তারা মনমরা হয়ে রেস না খেলে চারদিক ঘুরে দেখতে লাগল। হোয়াইট তাদের কাছ থেকে আমাকে নিয়ে মাঠের বাইরে এল।

আমি খেলাধুলা করতাম বলে দেশে থাকতে হোয়াইটের সঙ্গে আমার ভাব ছিল। সেখানে সে পদমর্যাদা বজায় রেখে চলত। এখানে সবাই স্বাধীন, সবাই সমান। বরং সে এমনভাবে ব্যবহার করতে লাগল যেন আমি তার এক পুরনো বন্ধু।

পথে সে একটা টুথ ব্রাশ কিনল দেখে আমি বললাম ওটা কী হবে? হোয়াইট হেসে বলল তোমার জন্য। এই উইক-এন্ড তুমি আমার সঙ্গে কাটাবে এবং তোমার কাছে আমি ভ্রমণকাহিনী শুনব। সঙ্গে আমার কাপড়চোপড় কিছু নেই, তবে কি আমি এক কাপড়ে দুদিন কাটাব? হোয়াইট বলল তুমি আর আমি এক কাঠামোর, দেখো আমার কাপড়-জামা সব তোমার ফিট করবে।

উইম্বলডন কমনের ওপর খুব সুন্দর বাড়িটা। হোয়াইট বাড়ি পৌঁছেই এক ভদ্রমহিলাকে চট করে আসতে বলল। তার নাম জ্যানি, এর সঙ্গে শীঘ্রই তার বিয়ে হবে, তারপর দুজনে ভারতবর্ষে যাবে চাকরিস্থলে।

জ্যানির স্বভাবটা ভালো, হোয়াইট আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তার এর আগে কোনও ভারতীয়র সঙ্গে পরিচয় হয়নি; অথচ ভারতবর্ষে বহু বছরের জন্য থাকতে যাবে হোয়াইটের সঙ্গে— এই অবস্থায় আমাকে দেখে বা পেয়ে বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করল।

চায়ের টেবিলে জ্যানি মাঝখানে এবং আমরা দুই পাশে দুজন বসেছি হঠাৎ জ্যানি আমার এবং হোয়াইটের হাত ধরে বলল, আমাদের বন্ধুত্ব যেন চিরদিন থাকে। আমার এই রকম সহৃদয় ব্যবহার খুব ভালো লাগল।

ডার্বিতে জেতার আনন্দে আমরা দুজনে ভরপুর। বহু রাত পর্যন্ত তিনজনে গল্প করলাম, তারমধ্যে আমিই বেশি বক বক করেছি।

পরদিন প্রাতরাশ খেয়ে আমরা ঠিক করলাম কিউ গার্ডেন্স (বোটানিক্যাল) দেখতে যাব। এত সুন্দর বাগান আর এত বড়— এর আগে কখনও দেখিনি। চারদিকে ফুল আলো করে রয়েছে। বেড়াতে বেড়াতে যেখানে লাইলাক ফুল রাশি রাশি ফুটে রয়েছে সেখানে গেলাম। প্রথমেই সে অপূর্ব দৃশ্য দেখে মনে পড়ল

কাম টু কিউ
কাম টু কিউ
লাইলাক টাইম
কলিং ইউ।

—কীটসের কবিতাটি। বেশিরভাগ ইংরেজ রেসে একগাদা টাকা জিতলে অন্তত এক পিপে মদ খেয়ে ফেলত। হোয়াইট তাদের মতো নয়। কেবলমাত্র ডিনারের সঙ্গে ফরাসি মদ খাওয়াল। হোয়াইট আমার গোমাংস খাওয়া দেখে অবাক। আমাকে বলল যে সে আমার জন্য অন্য কিছু রাঁধতে দিতে ভুলে গেছে। আমি ঠাট্টা করে বললাম যে তার মতলব ছিল আমার জাত মারবার। হোয়াইট আরও বলল যে ভারতবর্ষে সে মুরগি খেয়ে খেয়ে হয়রান হয়ে গিয়েছে— তাই বিলেতে এলে সুস্বাদু গো-মাংস খায়। আমি স্বীকার করলাম যে আমি যখন যা পাই তা খাই। খাওয়ার সঙ্গে জাতের কোনও সম্বন্ধ নেই। তাছাড়া আমি জাতিভেদও মানি না।

জ্যানি বুঝল না আমরা কী বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। হোয়াইট তাকে বলল যে যখন ভারতবর্ষে যাবে তখন সহজেই সব বুঝতে পারবে।

রবিবার রাতটা মনে হল গল্প করেই কাটবে বসবার ঘরে। রাত একটার সময় আমি মনে করিয়ে দিলাম যে পরের দিন অর্থাৎ সোমবার আমাকে মিডল্যান্ড ব্যাঙ্কে চাকরিতে যেতে হবে। জ্যানি তখন আমাকে অনুরোধ করল আরও দুয়েকদিন তাদের সঙ্গে কাটাতে, কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। বললাম মিস চ্যানিং তাহলে পুলিশে খবর দিয়ে সার্চ পার্টি পাঠাবেন।

যা হোক আমি কথা দিলাম যে পরের শনিবার আসব উইক-এন্ড কাটাতে। সোমবার সকালে যখন হোয়াইট আমাকে ব্যাঙ্কে পৌঁছে দিল— আমি তাকে ভেতরে নিয়ে ম্যানেজার, মিঃ রলফ-মিচেল ও অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম।

পরের উইক-এন্ডও হোয়াইট ও জ্যানির সঙ্গে কাটালাম। তারপর আবার দেখা হয়েছিল দশ বছর পরে। দেশে ফিরে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের রাজামুন্দ্রি ব্রাঞ্চে তখন আমি গিয়েছি— সে সব অনেক পরের কথা

হ্যাম্পস্টেড হিথে একদল যুবক ছিল তারা প্রতিদিন সকালে হিথের মাঠে চার মাইল দৌড়ত। আমি তাদের দলে ভিড়লাম। লর্ড আইভির একটা সুন্দর বাড়ি আছে হিথের গভীরে। সেই বাড়ির আর্ট গ্যালারি দেখবার মতো। অনেক মাস্টার্সদের অরিজিন্যাল পেন্টিং আছে। এসব এই পরিবারের নিজস্ব কালেকশন। আইভির বাড়ির সামনে আমরা দশ মিনিট বিশ্রাম করে আবার বাকি পথ দৌড়ে বাড়ি ফিরতাম।

আমার অনেক ভালো ভালো উচ্চশিক্ষিত ইংরেজ ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তারা কেউ কেউ কোয়েকার সম্প্রদায়ভুক্ত। কেন জানি না কোয়েকাররা আমাকে আপনার লোক মনে করে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করত এবং প্রায়ই খাওয়াত। কোয়েকাররা সকলেই উচ্চমনা এবং পরোপকার ব্রতসাধন করে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশায় এরা বিদেশীয় কি ভারতীয় কি নিগ্রোর মধ্যে কোনও পার্থক্য করত না। বরং মনের ভাবটা এই রকম যে সর্ব জাতির লোকের সঙ্গে মেশো, সবাইকে ভালোবাসতে শেখো।

মিস্টার ও মিসেস কিং খুব ধনী কোয়েকার। হ্যাম্পস্টেড হিথে তাঁর প্রকাণ্ড বাগান ও টেনিস কোর্টওয়ালা বাড়ি। নিমন্ত্রিত হয়ে সেখানে গিয়ে দেখি ষোলটি নানা দেশীয় যুবক-যুবতী টেনিস খেলতে গিয়েছে। তাদের মধ্যে দুটি নিগ্রো ছেলে ও একটি মেয়ে। ভারতীয় আমি একা। বাকি সব কন্টিনেন্টাল ও আমেরিকান— তাছাড়া জন ও জেন কিং নামে তাদের ছেলেমেয়েও ছিল। একটা কোর্টে এতগুলি লোকের ভিড়। তবু আমি এক সেট খেলতে পারলাম।

এক শনিবার প্রাতরাশ সেরে ওয়েস্টমিনিস্টারে টেমস নদীর ওপর স্টিমারে বেড়াতে গেলাম। দিনটা সুন্দর। নদীর ধারে ধারে কত লোক বসে লাঞ্চ খাচ্ছে বা পিকনিক করছে।

গ্রের এলিজি যে চার্চ নিয়ে লেখা সেটা দেখতে গেলাম। তারপর উইন্ডসর কাসল। এই কাসলের ভেতর সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। রাজা রানি সেদিন কাসলে এসেছিলেন। লন্ডনে তাঁরা যখন হাঁপিয়ে ওঠেন তখন নদীর ধারে খোলামেলা এই জায়গায় রাজপরিবার চলে আসেন।

একদিন পার্লামেন্ট ও ওয়েস্টমিনিস্টার এবী দেখতে গেলাম। পাশেই ‘বিগ বেন’ ঘড়ি। নদীর ওপর পার্লামেন্ট বাড়িটা। ফুটপাথের ধারে ‘বডিসিয়ার’ একটা পাথরের মূর্তি, অবশ্য কাল্পনিক

সেদিন টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। ভোরে যথারীতি লন্ডন হ্যারিয়াস দলের ছেলেদের সঙ্গে দৌড়তে বেরিয়ে গেলাম। হিথের পথ উঁচু-নিচু। ছুটতে ছুটতে কখন গর্তে পা ফেলেছিলাম খেয়াল নেই, ছিটকে পড়লাম এবং বিষম চোট খেলাম। বন্ধুরা তুলে ধরল। আমি তাদের সবাইকে বিদায় দিয়ে জন কিং-এর কাঁধে ভর করে বাড়ি চলে এলাম।

কুঁচকিতে খুব ব্যথা। অসহ্য যন্ত্রণায় দুপুরে অতি কষ্টে চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালে গেলাম। একটা ইনজেকশন দিয়ে ২৪ নম্বর ফ্রি বেডে ভর্তি করে নিল।

একজন আইরিস নার্স ছিল, তার তত্ত্বাবধানেই আমি ছিলাম। নার্সের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল, ভদ্র পরিবারের মেয়ে। অত্যন্ত ভদ্র এবং সৌজন্যপূর্ণ তার ব্যবহার আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমার কী হয়েছে? নার্স বলল, তুমি আছাড় খেয়েছ ঠিকই, তারপর কী হয়েছে সেটা এখন গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরদিন বড় সার্জেন এসে আমাকে পরীক্ষা করে সব শুনলেন এবং বললেন যে খুব সম্ভবত দুটো বড় বড় অস্ত্রোপচার করতে হবে। আমার মত জানতে চাইলেন। আমি বললাম যে আপনারা যা ভালো বোঝেন তাই করবেন। ডাক্তার আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনে খুবই আশ্চর্য ও আগ্রহান্বিত হয়ে বললেন যে মরুভূমিতে বালি ঠেলে ঠেলে চলে এবং ভারি মাল বয়ে ‘গ্রয়েন’ ফুলেছে এবং ব্যথা হয়েছে। দেখলে মনে হবে হার্নিয়া হয়েছে, কিন্তু তা নয়। অস্ত্রোপচার না করলে বিপজ্জনক হবে। দুপায়েই ভীষণ ব্যথা।

সার্জেন বললেন, যে দুদিন পরে যখন এফ আর সি এস পরীক্ষা হবে, আমাকে পরীক্ষার্থীদের দেখাতে চান। পরদিন যন্ত্রণার মধ্যে কাটল। ইনজেকশন দিয়ে পরে ব্যথা কমল। সোমবার সকালে হাসপাতালের ব্রেকফাস্ট খাবার পর একটা ট্যাক্সিতে চারজন রোগীকে রয়্যাল কলেজ অব সার্জেন হলে পাঠানো হল। বুঝলাম সবকটা কেসই হেঁয়ালিপূর্ণ, আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয় তা নয়। ডাক্তার ঠকাবার কলকাঠি বলা চলে।

বড় হলঘরের চারদিকে রোগীদের রাখা হয়েছিল। বিখ্যাত সার্জেনরা হলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, যেমন পরীক্ষার্থীরা আসছে, তাদের রোগীদের কাছে পাঠাচ্ছেন। পরীক্ষার্থীরা ঠিক জবাব দিলে ফেলোশিপ পাবে। না হলে আবার পড়, আরও পড়। আমার মনে হল এটাও একটা জুয়াখেলা।

পরীক্ষা হয়ে গেল। আমরা একটা ট্যাক্সিতে চারজনে হাসপাতালে ফিরে এলাম। আমাদের পারিশ্রমিক হিসাবে প্রত্যেককে একটা পাঁচ পাউন্ডের নোট দিল। কিছু টাকা লাভ হল।

পরদিন আমার অপারেশন হল দুই পায়েই। যখন জ্ঞান হল শুনলাম আমার দুই পায়ে দশ ইঞ্চি করে অপারেশন হয়েছে। খুব যত্নের সঙ্গে নার্স আইলিন আমার সেবা করছিল। হঠাৎ মনে হল বিদেশে সবার অগোচরে যদি আমার জীবন শেষ হয়, কেউ জানতেও পারবে না কী হয়েছিল এবং কোথায় বা গেলাম। রোগশয্যায় শুয়ে মা বাবা ভাই বোনের কথা বারবার মনে পড়ছিল। দেখতে দেখতে দশদিন কেটে গেল। দুপায়ের সেলাই খুলে দিল। দুদিন পরেই আমি বাড়ি চলে যাব। কিন্তু পায়ে এত ব্যথা যে চলতে ফিরতে কষ্ট হচ্ছিল। যেদিন হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে ঠিক তার আগের দিন ভিজিটিং সময়ে দেখি আমার পরিচিত তুষার রায় হাতে এক ঠোঙা আঙুর নিয়ে রোগীদের মাথার কাছে নম্বর দেখে যেন কাকে খুঁজছে। পাছে আমায় দেখে ফেলে, তাই মুখের ওপর চাদরটা টেনে ঢাকলাম।

আমার খাটের নম্বর ২৪ দেখে তুষার থমকে দাঁড়াল, তারপর আমার সামনে এসে মুখ থেকে ঢাকা সরিয়ে ফেলল। সে যে আমাকেই খুঁজছে এবং আমারই জন্য হাসপাতালে এসেছে সে কথা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল। খানিকক্ষণ গল্প করার পর তুষার চলে গেল এবং অফিস থেকে জেনে গেল কবে কখন আমাকে ছেড়ে দেবে।

আমি প্রমাদ গুনছিলাম যে ছাড়া পেয়ে হ্যাম্পস্টেডের বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠব কেমন করে। নির্দিষ্ট সময়ে হাসপাতাল আমাকে ছেড়ে দিল। চলতে পারি না। ফুটপাথের ওপর স্ট্রেচারে শুয়ে ট্যাক্সি ডেকে দিতে অনুরোধ করলাম নার্স আইলিনকে, সামনেই ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। উঠে দেখি ট্যাক্সির ভেতর তুষার রায়- সে হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে তুলল। আমি তো অবাক। আমার অবাক মুখের দিকে চেয়ে তুষার বলল যে সে হাসপাতালের অফিস থেকে শুনেছে আমার দুই পায়ের ১০ ইঞ্চি করে অপারেশন হয়েছে। অনেকদিন পর্যন্ত আমি চলাফেরাও করতে পারব না। ততদিন তুষারের গোল্ডার্স গ্রিনের বাড়িতে থাকব

আমার মস্ত সমস্যার সমাধান করল তুষার। আমি মনে মনে খুব তারিফ করে ভাবলাম এত অল্প পরিচয়ে কোনও মানুষ আজকাল অন্যের কথা চিন্তা করে না। বেশ পরিষ্কার পাড়া, ‘উডল্যান্ডস’-এর বাড়িতে উঠলাম।

কিছুকাল পরে আবার একটু একটু করে চলতে আরম্ভ করলাম। পড়াশোনা করবার পক্ষে এটা ছিল প্রশস্ত সময়। যে দেশে বেলা তিনটের সময় শীতের দিনে সূর্যাস্ত হয় সেখানে এখন গরম, রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত দিনের আলো। একদিন নার্স আইলিন দেখতে এল।

কলকাতায় আগে একবার আমার ওপর বড় রকমের অস্ত্রোপচার হয় ইডেন হাসপাতালে। সেখানের বন্দোবস্ত, ব্যবহার ও খাওয়া-দাওয়া চেয়ারিং ক্রস হাসপাতালের সঙ্গে তুলনা করা চলে, সেদিনের ইডেন হাসপাতালও এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল।

অপারেশনের পর দুমাস কেটে গেল। এখন অনেকটা চলতে পারি। রোজ রাত্রে দুই-তিন মাইল হেঁটে ঘুরে বেড়াই। যদিও এখনও দুপায়ে ব্যথা আছে এবং কোনও ভারি জিনিস তুলতে পারি না।

ছ-মাস পরে আমি পূর্বের সহজ অবস্থায় ফিরে গেলাম। সুবিধা পেলে অক্সফোর্ডে ভাগ্নের কাছে যাই। এত সুন্দর পুরনো শহর, এত ভালোভাবে রয়েছে দেখলে চোখ জুড়ায়। অনেক বড় বড় কলেজ চারদিকে। ইংরেজরা মনে করে ছেলে যদি অক্সফোর্ডে পড়তে পায় তো ভাগ্যের কথা, মেয়েদের জন্য মাত্র দুটি কলেজ। আমি বোট রেস দেখতাম আইরিস নদীর ওপর। আশপাশে অনেক সুন্দর বেড়াবার জায়গা ছিল, সেগুলো আবিষ্কার করতে ভালো লাগত। অক্সফোর্ডের সঙ্গে ভালোবাসার সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল।

লন্ডনে ফিরে গেলাম এ আই বি (অ্যাসোসিয়েট অব দ্য ইনস্টিটিউট অব ব্যাঙ্কার্স) পরীক্ষা দিতে। পাশ করলাম।

আফ্রিকায় ঘুরতে যাব বলে আমি মেম্বার হলাম স্যার হোৱেশ প্ল্যাঙ্কেট ফাউন্ডেশনে। সেখানে খুব ভালো লাইব্রেরি ছিল, অবসর মতো গিয়ে পড়তাম। এদিকে রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে পৌঁছেছেন। একটা খুব ভালো বাঙালি হোটেল ছিল— রেজিনা। সেখানে উঠেছেন। দেখা করতে গেলাম। আমার ভ্রমণ সম্বন্ধে তিনি কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। আমি বলেছিলাম কবির ‘দুরন্ত আশা’ পড়ে আমার দুরন্ত বাসনা হয় পৃথিবী দেখবার, তবে যখন সত্যি সত্যি আরব বেদুইনের সঙ্গে দিন কাটালাম তখন বুঝলাম বাস্তবের সঙ্গে কবিতার পার্থক্য অনেক। বাস্তব অনেক রূঢ়।

রথীবাবু ও প্রতিমাদেবী কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁরা আসার পর রবীন্দ্রনাথ আমার পরিচয় দিয়ে বললেন, রথী দেখেছ তোমার সঙ্গে বিমলের আশ্চর্য মিল আছে। আমি দেখলাম যে কয়েকটা বিষয় অন্তত সত্যিই মিল আছে। আমরা দুজনে একই রকম লম্বা, দুজনেরই রং ভালো, দুজনেরই চোখ কোটরগত। রথীবাবু খুশি মনেই আমার পাশে এসে হাত ধরলেন। তিনি অনেকদিন এই কটি কথা মনে রেখেছিলেন এবং আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতেন।

বললাম যে আমি ‘গীতাঞ্জলি’ সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছি এবং সেটি বাইবেলের মতো সর্বত্র আমার সঙ্গে ঘুরছে। কবিগুরু আমার কাছে আমার সামনে এক বিরাট পুরুষ। এই কথাগুলি তাঁকে শোনাতে পারব আমি ভাবিনি। তিনি খুশি হলেন এবং একটু হাসলেন। অসামান্য সুন্দর কবির মুখে যেন অপার্থিব রূপ দেখলাম। মনে মনে ভাবলাম এরকম সর্বাঙ্গসুন্দর ও সুপুরুষ আগে কখনও কোথাও দেখিনি। দেখলেই সান্নিধ্য কামনা করতে ইচ্ছা হয়। কোটি কোটি লোকের ওপর এই আশ্চর্য, দেবতুল্য মানুষের প্রভাব পড়ছিল, আমিও তাদের মধ্যে একজন।

কবিগুরু বললেন রথী, একটা চয়নিকা নিয়ে এস। সেই বইটি আমাকে উপহার দিলেন এবং আশীবাণী লিখলেন। আমার জীবনে একটি পরম মুহূর্ত কবির সামনে দাঁড়িয়ে। বলা বাহুল্য যে বইখানি আমার খুব প্রিয়। অনেক নিঃসঙ্গ দিন ও রাত্রের একমাত্র সঙ্গী ছিল সেটি। কবি আরও বললেন আমাকে, শান্তিনিকেতনে এস যখন দেশে ফিরবে। বহু বছর পরে আবার দেখা হল। তখন আমি সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। বয়সের ভারে কবি তখন নুয়ে পড়েছেন। আমার স্ত্রীকে প্রথমেই বললেন তোমার কর্তাকে জিজ্ঞেস কর, আগে আমি তার মতোই লম্বা ছিলাম কিনা। আমার মধ্যে দুটো অদম্য বাসনা ছিল—’পৃথিবী ভ্রমণ ও শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করা।

উডল্যান্ডস-এর বাড়িতে ফিরে একটা চিঠি পেলাম বি এস এ কোম্পানির বড় কর্তার কাছ থেকে। কমান্ডার হাবার্ট হচ্ছেন বি এস এ বার্মিংহাম কারখানার কর্ণধার তিনি ৪টে সাইকেল নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন আমাদের দেবার জন্য ১৯২৬ সালে। কমান্ডার হার্বাটের সঙ্গে মিডল্যান্ড ব্যাঙ্কের (১৯৬ পিকাডিলি) ম্যানেজার রলফ মিচেল-এর খুব ভাব। তাঁরা দুজনেই বার্মিংহাম শেলী ওক-এর কাছাকাছি বাসিন্দা। কমান্ডার হাবার্ট আমাকে নিয়ে একটা মিটিং করতে চান যদি ভবিষ্যতে আমার ভ্রমণে কোনও সাহায্য হয়।

যখন আবার ভ্রমণ শুরু করব তখন তো যাবই বার্মিংহামে। এটা হচ্ছে ট্যুরের বাইরে। একদিন পরেই রওনা হবার জন্য ইউস্টন রেলওয়ে স্টেশনে হাজির হলাম। আমাদের দেশে যেমন সময় হাতে নিয়ে ট্রেন ধরে আমিও তেমনই আধঘণ্টা আগে স্টেশনে পৌঁছলাম। কোনও ভিড় নেই। একটা ইঞ্জিন ট্রেনটাকে টেনে নিয়ে এসেছিল, সেটা সামনেই পড়ল। গাড়িতে উঠে জানলার ধারে বসলাম, ইঞ্জিনের দিকে মুখ করে। এক ইংরেজ ভদ্রমহিলা আমার সামনের সিটে বসলেন। আমাকে বললেন যে আমি যদি কিছু না মনে করি তো তিনি আমার সঙ্গে জানলার ধারে জায়গা বদল করবেন, কেননা তিনি ইঞ্জিনের দিকে পিছন ফিরে চলতে পারেন না। আমি তৎক্ষণাৎ জায়গা বদল করে বসলাম। খানিকক্ষণ পরেই বুঝলাম যে ভদ্রমহিলার ভুল হয়েছে— যে ইঞ্জিনটা দেখে তিনি জায়গা বদল করলেন সেটাতে মাত্র ট্রেনটাকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দিয়েছে। আসল ইঞ্জিন যেটা বার্মিংহামে আমাদের নিয়ে যাবে সেটা ১০-১৫ মিনিট পরে আসবে এবং ট্রেনের সামনে জুড়বে। তখনও অনেক সময় ছিল ভাবলাম আসল ইঞ্জিন যখন জুড়বে তখন আরেকবার জায়গা বদলের পালা শুরু করা যাবে। ভদ্রমহিলা রীতিমতো স্থূলাকৃতি ছিলেন। একমনে সেলাই করতে লাগলেন, আমি একটা উডহাউসের মজার বই পড়ছিলাম।

প্যাসেঞ্জাররা সব এক এক করে আসছে। এদেশে ট্রেনে জায়গার অভাব হয় না সচরাচর। ট্রেন ছাড়বার দুমিনিট আগে এলেও সবাই জায়গা পায়

দু-চার মিনিট এমনই কাটল। তারপর এক বীভৎস কাণ্ড ঘটল। অন্য একটা ট্রেনের ব্রেক খারাপ হওয়ার ফলে অদূরে লাল সিগন্যাল দেখেও গাড়ি থামানো গেল না। জোরে এসে ট্রেনটা আমাদের ট্রেনে ধাক্কা মারল। আমি হঠাৎ বিকট শব্দ শুনলাম কাচ ভাঙার, কাঠ ভাঙার ও লোহা ভাঙার। ট্রেনের কামরাগুলো চুরমার হতে হতে তালগোল পাকিয়ে স্টেশন পার হয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছল। আমার সামনে মোটা ভদ্রমহিলার দেহ নিমেষে আমার মুখের ওপর আছড়ে পড়ল। গাড়ির দেয়ালগুলো একটার পর একটা জুড়ে ও ভেঙে গিয়েছিল। চিন্তা করবার কোনও অবকাশ ছিল না। আমি অন্ধকারে অচৈতন্য অবস্থায় ট্রেনের নিচে তলিয়ে গেলাম।

দুঘণ্টা পরে যখন জ্ঞান হল আমি বুঝতে পারলাম রেলের লাইনের ওপরে মাথা রেখে শুয়ে আছি। ওঠবার চেষ্টা করলাম, দেখি আমার একটা পা আটকে আছে উঠতে পারব না। একজন ভদ্রলোক আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন ভয় পেয়ো না। তোমাকে বার করার ভার আমার। কয়েক মিনিটের মধ্যে এসিটিলিন টর্চ (কাটার) হাতে একজন লোক এল। আগুন দিয়ে লোহা কাটবার আগে আমার পায়ের দুপাশে দুটো বড় বড় জ্যাক দিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে লোহা কাটা হল। অতি সন্তর্পণে আমার পা ছাড়িয়ে আমাকে টেনে তুলল এবং স্ট্রেচারের ওপর শোয়াল। পাশের স্ট্রেচারে চেয়ে দেখি সেই ভদ্রমহিলা যিনি আমার সঙ্গে সিট বদল করেছিলেন। দেহে প্ৰাণ নেই, মাথার আঘাত সাংঘাতিক, মুখের দিকে চাওয়া যায় না।

ইতিমধ্যে একজন লোক এসে আমার নাম ধাম ও টিকিট নম্বর সব জেনে লিখে নিল। যাবার সময় বলল টিকিট সাবধানে রাখতে এবং কাউকে না দিতে।

প্ল্যাটফর্মে কতক্ষণ শুয়েছিলাম স্ট্রেচারের ওপর খেয়াল নেই। আমার মনে হচ্ছিল একটা ট্রেন দুর্ঘটনায় আমি জড়িয়ে পড়েছি এবং আমি বেঁচে আছি শুধু এই জ্ঞান আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল মাঝে মাঝে। খুব ব্যথা মাথায় ও সর্বাঙ্গে টের পাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে ঘুমিয়েও পড়ছিলাম। ইতিমধ্যে অবশ্য আমায় ব্রান্ডি খাইয়েছে এবং ইনজেকশন দিয়েছে।

হঠাৎ মনে পড়ল পরদিন সকালে বার্মিংহামে মিটিং-এর কথা। প্ল্যাটফর্মের অপর দিকে একটা ট্রেন দাঁড়িয়েছিল সেটা বার্মিংহাম যাত্রী। আমি বোধহয় প্রকৃতিস্থ ছিলাম না। স্ট্রেচার ছেড়ে ট্রেনের একটা কামরায় উঠলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে ছেড়ে দিল। যাত্রীরা আমাকে শোবার জায়গা ছেড়ে দিল— ঘুমিয়ে পড়লাম।

বার্মিহামে পৌঁছবার পরই পুলিশ আমাকে খুঁজে বের করল এবং অ্যাম্বুলেন্স-এ চড়িয়ে নিয়ে গেল হাসপাতালে। ইউস্টন স্টেশন ছেড়ে চলে যাবার পরই আমার খোঁজ পড়েছিল।

কেউ হয়তো বলেছিল আমি বার্মিংহাম-এর ট্রেনে উঠেছি। তৎক্ষণাৎ বার্মিংহাম পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছিল ট্রেনে আমার খোঁজ করতে এবং হাসপাতালে ভর্তি করতে।

হাসপাতালে ঢুকেই বললাম, আমার খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি গরম স্যুপ ও অন্যান্য খাবার এল। খেয়ে-দেয়ে মনে হল আমি খুব জোর বিপদ থেকে বেঁচে গিয়েছি! নার্স এসে আবার ইনজেকশন দিল। বড় ডাক্তার পার্ডি এসে আমাকে দেখে গেলেন।

ডাঃ পার্ডি একজন ভারতীয় নামকরা ধনী ডাক্তার। তিনি বললেন হার্বাটের সঙ্গে তাঁর ভাব আছে। আমার সঙ্গে যে মিটিং হবার কথা ছিল, সেটা বাতিল হয়ে গেল। ডাঃ পার্ডি আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে তুললেন। গৃহিণী ইংরেজ এবং কোমল স্বভাবের। বাড়িটা প্রকাণ্ড, প্রায় প্যালেসের মতো।

খুব সুখে তিনদিন কাটিয়ে লন্ডনে ফিরলাম। মাঝে মাঝে মাথায় যন্ত্রণা হয় তাও অল্পক্ষণের জন্য। প্রকাণ্ড অ্যাক্সিডেন্টে সম্পূর্ণ অক্ষত ফিরে আসব এমন আশা করা ভুল। এল এম এস রেলওয়ের একজন লোক এসে আমাকে একশো পাউন্ডের একটা চেক ক্ষতিপূরণ হিসাবে দিল।

বেশ সুস্থ বোধ করছি কিন্তু এখনও সাইকেল চালাবার উপযুক্ত হইনি। কুঁচকিতে এখনও ব্যথা।

হেনলি নামে একটা জায়গায় গেলাম রেগাটা দেখতে। রোয়িং আমার প্রিয়। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে রোয়িং-পারদর্শী যুবকেরা এসেছে। দারুণ উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে প্রতিযোগিতা হল। জার্মান ছেলেরা দুটি খেলায় জিতল। ইংরেজদের মতো স্পোর্টস, অ্যাডভেঞ্চার ও ভ্রমণ-প্রিয় স্ত্রী পুরুষ খুব কম দেখেছি। স্বামী-স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে কত পরিবার রোয়িং দেখতে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই বড় হলে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলার ভক্ত হয়।

আমার নিজের জীবনে দেখেছি ইংরেজরা আমাকে ভ্রমণে বেরোতে যত উৎসাহ দিয়েছে ঠিক তেমন আর কোনও দেশের লোকের কাছে পাইনি। সেটা না পেলে সব আশা ছেড়ে, দেশে ফিরে যেতাম। লক্ষ করেছি যে যখন আমি পৃথিবী-পর্যটক বলে পরিচয় দিয়েছি তখন আমি একজন কেউকেটা, তার বাইরে আমি অতিসাধারণ কালা আদমিদের একজন। আজকাল ভারতীয়দের প্রতি যেমন ইংরেজ জাতির বিরূপ ভাব ১৯২৮ সালে তেমন কিছু ছিল না। আগে বন্ধুর দল ছেলেমেয়ে সবাই কত নাচের হলে গিয়েছি এবং মিউজিকের তালে কত নেচেছি। মেয়েরা সবাই ইংরেজ বা কন্টিনেন্টাল। মনে হয় না ১৯৭৮ সালে সেটা আর সম্ভব।

জেনেরাল ইলেকশন দেখলাম। খুব শান্তির সঙ্গে শেষ হল। কনসার্ভেটিভরা হারল এবং লেবার গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হল। ভারতীয়দের রাজনৈতিক স্বাধীনতা দাবি সম্পর্কে এরা সহানুভূতিশীল।

কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবীর সঙ্গে আলাপ হল। প্রতি রবিবার যতদিন তিনি লন্ডনে ছিলেন, নিজের বাড়িতে সকালবেলায় উপাসনা করতেন। আমারও সেখানে যাবার ইচ্ছা হল।

প্রথম যৌবনে আমি খুব ধর্মপ্রাণ ছিলাম। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা প্রাণায়াম, আহ্নিক ইত্যাদি করতাম। সেই জন্যই পৃথিবীর নানা দেশে ঘোরবার সময় বিভিন্ন ধর্মমত বোঝবার চেষ্টা করেছি। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগত।

রবিবার সকালে সুনীতি দেবীর প্রার্থনা শুনতে গেলাম। সুন্দর বলবার ক্ষমতা, পিতা কেশব সেনের কাছে পেয়েছেন। উপাসনার সময় দেখেছি তাঁর মুখ ধর্ম ও শান্তভাবে উদ্ভাসিত। খুব ভালো লাগল।

আমাদের মধ্যে সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল। প্রায়ই দুপুরে তাঁর বাড়িতে খেতে যেতাম।

প্রার্থনার সময় অতুলপ্রসাদ সিংহ ব্রহ্মসঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত, কখনও কখনও অতুলপ্রসাদের গানও হত। ঘরোয়া বৈঠকে অতুলপ্রসাদের গান ভালোই লাগত। ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অলক্ষে আকৃষ্ট হলাম।

কিছুদিন পরেই রাজা রামমোহন রায়ের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ব্রিস্টলে যাওয়ার তোড়জোড় হল। এক ট্রেনভর্তি বাঙালি চললেন। আমার গাড়িতে গুরুসদয় দত্ত মহাশয় ও স্যার আলবিয়ান ব্যানার্জি ছিলেন। গুরুসদয় দত্ত মহাশয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল, তাঁর পুত্র বীরেন্দ্রসদয়ের সঙ্গে আমার ভাব ছিল বলে। স্যার আলবিয়ান একজন ভারত-প্রসিদ্ধ লোক। মহীশূর রাজ্যের দেওয়ান হিসেবে সুনাম করেছেন। পাশের গাড়িতে বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব ও আরও অনেক স্বনামধন্য লোকেরা চলেছেন।

ট্রেন সোজা ব্রিস্টল স্টেশনে থামল। শহরের মেয়র আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। সবাই রাজা রামমোহনের স্মৃতিস্তম্ভের কাছে যেখানে তাঁর ভস্ম রক্ষিত হয়েছে, সেখানে গেলাম। ব্রিস্টলবাসী অনেক লোক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে স্যার আলবিয়ান ও পরে গুরুসদয় মহাশয় রাজা রামমোহনের বহুমুখী প্রতিভা, তাঁর চরিত্রের মহত্ত্ব ও বুদ্ধিমত্তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন।

এই স্মৃতিসভায় ব্রিস্টলের মেয়র ও গুরুসদয় দত্ত মহাশয় রাজার স্বাদেশিকতা বোধের কথা বললেন। আমরা নীরবে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিলাম। রামমোহনের স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে পড়ল রুপার্ট ব্রুক-এর একটা কবিতার অনুকরণে এক কলি— ‘হিয়ার ইজ এ কর্নার অব ইংল্যান্ড হুইচ ইজ ফর এভার ইন্ডিয়া।’

দুপুরে ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটি দেখতে গেলাম। তার আগে এই শহরের লোকেদের আয়োজিত ভোজে যোগ দিলাম। ইংরেজ গুণগ্রাহী, তাই রামমোহনের মতো একটি অসাধারণ ভারতীয়ের স্মৃতিবাসরে তারাই উদ্যোক্তা হয়ে আমাদের এত লোককে খাওয়াল। রামমোহন যেখানে থাকতেন সেই বাড়িটি দেখতে গেলাম। বাড়িটিতে এখন ছোট ছেলেদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে।

লন্ডনে একদিন রাসেল স্কোয়্যারের ধারে পঙ্কজ গুপ্তর সঙ্গে দেখা। সে কলকাতায় আমার বাড়ির কাছে চায়ের দোকান ‘বেলভিউ’তে (হ্যারিসন রোড ও আমহার্স্ট স্ট্রীটের সংযোগস্থলে) রীতিমতো আড্ডা দিত। অনেক স্পোর্টসম্যানদের ‘বেলভিউ’ রেস্তোরাঁতে দেখেছি। আমার সঙ্গে পঙ্কজ গুপ্তর ভাব ছিল।

১৯২৮ সালে, পঙ্কজ গুপ্ত হকি খেলোয়াড়ের একটি দল নিয়ে প্রথমবার অলিম্পিকে লড়তে এসেছিল। রয়্যাল হোটেলে সবাই ছিল। সে আমাকে নিয়ে গেল তাদের সঙ্গে আলাপ করবার জন্য। প্রথমেই ধ্যানচাঁদকে ডাকল— তারপর এক এক করে সবার কাছে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। কলকাতায় আমি যখন টাউন হল থেকে বিদায় নিই তখন পঙ্কজ গুপ্ত সেখানে উপস্থিত ছিল। পঙ্কজ গুপ্তর বয়স বড় জোর তখন পঁচিশ হবে কি আরেকটু বেশি। এই একটি লোক ভারতবর্ষের হকি খেলার উন্নতি সাধনের জন্য প্রাণপাত করেছে। হকির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে তার নাম লেখা থাকবে।

সেই দিনই ‘লন্ডন ইলেভেন’ বনাম ভারতবর্ষ খেলা দেখতে গেলাম ‘মাৰ্টন এবি’ গ্রাউন্ডে। দুঃখের বিষয় ভারতীয়রা খালি পায়ে খেলার জন্য ও বিশেষ করে পনেরো দিন জাহাজের দোলা খেয়ে সবাই একটু আধটু টলমল করছিল, এক গোলে হারল পরদিন কম্বাইন্ড ব্রিটিশ টিমের সঙ্গে খেলা। আমরা প্রমাদ গুনলাম, কিন্তু ভারতীয় দল অনায়াসে অনেক গোলে জিতল। হকি জগতে ধ্যানচাঁদ নামে এক নতুন সূর্যের উদয় হল সেদিন। অবলীলাক্রমে দৌড়বার সময় তার হকিস্টিকে বল যেন সেঁটে থাকত। সে ইচ্ছামতো গোল করতে পারত। সমস্ত পৃথিবীর লোকেরা মুগ্ধ হয়ে ধ্যানচাঁদের খেলা দেখেছে এবং তারিফ করেছে বহু বছর ধরে।

পাঁচদিন পরে অলিম্পিক খেলার জন্য অ্যামস্টার্ডামে ভারতীয় দলের উপস্থিত হওয়া প্রয়োজন কিন্তু চারজন খেলোয়াড়ের ‘ফ্লু’ দেখা দিল। ডাক্তার ওষুধ ও চিকিৎসা চালাতে আরম্ভ করল, তাদের পরিবর্তে নতুন খেলোয়াড় দলে নিতে হবে। কে খেলবার উপযুক্ত এবং কাকে পাওয়া যাবে, তার কোনও স্থিরতা নেই। পঙ্কজবাবু বললেন, হকি খেলোয়াড় যারা লন্ডনে বা কাছাকাছি আছে তাদের নাম দিতে। আমি নীরেন দে ও জয়পাল সিংহের নাম বললাম। পঙ্কজবাবু জিজ্ঞেস করলেন; আমি আমার নামটা বাদ দিলাম কেন। যদি দিতাম তো আমার জীবনের ধারা হয়তো বদলে যেত। হকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে বিজয়ী হয়ে দেশে ফিরে যেতে হত। পৃথিবী ভ্ৰমণ আমার কাছে তখন এত বড় ধ্যান জ্ঞান যে তার পরিবর্তে আর কিছু চাইতাম না। সে কথা পঙ্কজবাবুকে জানালাম। সে এক মুখ পান ঠুসে বলল যে জয়পাল যখন এসে যাচ্ছে তাকে দিয়েই কাজ হবে। নীরেন দে-কে (পরে অ্যাডভোকেট জেনারেল অব ইন্ডিয়া) জানানো হয়েছিল কিনা জানি না। জয়পাল নিজেই জানিয়েছিল লন্ডনে আসছে সেই দিনই। তিনদিন পর দেখা গেল সব খেলোয়াড় প্রায় সেরে উঠেছে এবং একজন ছাড়া অ্যামস্টার্ডামে সকলেই খেলতে পারবে। তার স্থান নেবে জয়পাল।

আমি সুবর্ণ সুযোগ ছাড়তে চাইনি। আমস্টার্ডাম অলিম্পিকে ভারতের জয় জয়কার দেখে লন্ডনে ফিরলাম।

তারপর পৃথিবীতে হকি খেলার অনুশীলন চলতে লাগল। ভারত বহু বছর পুরোভাগে ছিল, এমনকি দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান জন্মাবার পরেও।

লন্ডনে বিখ্যাত আলবার্ট হলে সুবিধা পেলেই আমি যেতাম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আর্টিস্টরা সেখানে নাচ, গান ও বাজনায় আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছেন। একবার ক্রাইশলার বেহালা বাজাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল একটি বারো বছরের ছোট ছেলে, নাম “ইহুদি মেনুহিন’। ক্রাইশলারের বেহালা শোনবার জন্য ছয় মাস আগে টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। বিরাট হলে ৫,০০০ লোকের ভিড়। আমি ও ডাঃ শচীন ঘোষ দুটো ভালো জায়গায় বসবার সিট পেয়েছিলাম। বহু লোক থামের আড়ালে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না কিন্তু শুনতে পাচ্ছিল। ক্রাইশলার আশ্চর্য সুন্দর বেহালা বাজালেন। পাশে একটি তরুণী আমার কাঁধের ওপর দিয়ে খুব দেখতে চেষ্টা করছিল ক্রাইশলারকে। আমি তখন তাকে নিজের সিট ছেড়ে দিলাম, আমি তো খানিকক্ষণ দেখেছি এই কথা বলে। ভদ্রমহিলাটি খুব আপত্তি জানালেন আমার জায়গা নিতে, শেষ পর্যন্ত লোভ সামলাতে না পেরে আমার চেয়ারে বসলেন অনেক ধন্যবাদ দিয়ে। কথার উচ্চারণে বুঝলাম তিনি বিদেশিনী, আমেরিকান। ইন্টারভ্যালের সময় আরেকবার চেয়ার ফেরৎ দেবার কথা হল, আমি কান দিইনি।

অপেক্ষাকৃত লম্বা বলে আমি স্পষ্ট দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম। ক্রাইশলারে বেহালা শোনবার পর মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি ও হাততালি দিয়ে শ্রোতারা তাঁকে উৎসাহিত করল। সবাই থামল যখন তিনি বললেন যে সঙ্গে একটি ছেলেকে নিয়ে এসেছেন, নাম ‘ইহুদি মেনুহিন’– সে ক্রাইশলারের রচিত মিউজিক ও অন্যান্য মিউজিক বেহালায় বাজিয়ে শোনাবে। সবাই উৎসুক হয়ে ছোট্ট ছেলেটিকে দেখছিল।

মেনুহিন আধ ঘণ্টা বেহালা বাজাবার পর আবার বিপুল করতালি শোনা গেল। ক্রাইশলার বললেন, আমি আজকের মিউজিক শুনে এক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি, এই বালক একদিন জগদ্বিখ্যাত বেহালা বাদক হবে। সত্যিই তাই হয়েছে।

আমি ও ডাঃ ঘোষ ভিড়ের থেকে বেরিয়ে সোজা কোনসিংটন গার্ডেনসের দিকে (হাইডপার্কের একাংশ) ওপেন-এয়ার রেস্তোরাঁ লক্ষ করে চললাম। জানি ভিড় হবেই আর তখন বসবার জায়গা পাব না। একটা টেবিলে আমরা দুটো চেয়ার অধিকার করলাম। বাকি দুটো চেয়ার খালি রইল অন্যদের জন্য। জায়গাটা খুব সুন্দর। চারদিকে বড় বড় গাছ, পায়ের নিচে সবুজ ঘাস। গ্রীষ্মের পড়ন্ত রোদমাখা দিন ছিল। চায়ের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছি। তখন প্রায় সব টেবিল ভর্তি লোক।

আমরা দুজনেই লক্ষ করলাম যে মেয়েটিকে আমি বসবার জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলাম আলবার্ট হলে, সে একটা খালি চেয়ারের জন্য খোঁজাখুঁজি করছে। খুঁজতে খুঁজতে আমাদের সামনের চেয়ার খালি দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল এবং খুব হাসতে হাসতে বলল এবার তোমাকে জায়গা ছাড়তে হবে না। এই চেয়ার তো খালি বলে বসে পড়ল আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না রেখে। একটু পরেই খাবার এবং চা এল। ভদ্রতার খাতিরে ইয়ং লেডির জন্য আরও অর্ডার দিয়ে যা ছিল ভাগ করে খেতে আরম্ভ করলাম।

তখনও পর্যন্ত আমরা কেউ কারও নাম জানি না। ভদ্রমহিলা পরিচয় দিতে বলল তার নাম মিস হেলেন পাইস, বাড়ি ফোর্টডজ শহরে, আমেরিকায়। পেশা লেখিকা। নিউইয়র্কে একটা ছোটদের পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে হয়, বয়স ২২-২৩ হবে। সুশ্রী দেখতে, লাজুক ধরনের। কথাবার্তায় আমেরিকান টান ছিল।

আমরা নিজেদের পরিচয় দিলাম। আমার পরিচয় বলতে একমাত্র যাযাবর। বন্ধু শচীন ঘোষ, ডেন্টাল সার্জারি পড়ে, আমারই বয়সী। আমরা তিনজনেই কাছাকাছি বয়সের, ভাব হল সহজেই। অনেকক্ষণ গল্প হল। বিদায় নেবার সময় আমাদের প্রভূত ধন্যবাদ দিয়ে হেলেন তার বাড়িতে যাবার জন্য অনুরোধ জানাল পরের সপ্তাহে।

লন্ডনের বাইরে বার্ক হেমস্টেড ছোট্ট জায়গা— না শহর না গ্রাম। বন্ধুর সেদিন হাসপাতাল ডিউটি ছিল, সেজন্য আমি একাই হেলেনের বাড়ি পৌঁছলাম। ছোট টিলার ওপর সুন্দর জায়গায় বাড়িটা। বাড়ির মালিক ইংরেজ আর্মি অফিসার, মেজর আর্মস্ট্রং, ভারতবর্ষে কাজ করে অনেক জায়গায় ঘুরেছেন এবং তারপর এখন অবসরপ্রাপ্ত।

খুব উৎসাহ করে মেজর চায়ের সরঞ্জাম ও খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন হেলেনকে সাহায্য করবার জন্য। কালা আদমি দেখে উৎসাহটা কমে গেল মনে হল, হতে পারে আমার কল্পনা। ভারতবর্ষ থেকে সাইকেলে ভূপর্যটনে বেরিয়েছি শুনে মেজরের আমার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেল। বলল, কী চমৎকার ব্যাপার, আমার ইচ্ছা হচ্ছে ভূপর্যটনে যোগ দিতে তোমার সঙ্গে। উৎসাহের চোটে আমাকে ডিনার খেয়ে যেতে বলল। সেটা সেদিন সম্ভব নয় বলে, পরের সপ্তাহে চা ও ডিনারের নেমন্তন্ন নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

আলাপ হবার পর দেখলাম যে মেজর আর্মস্ট্রং লোকটি মন্দ নয়। সে ভারতবর্ষে জীবন কাটিয়েছে ঠিকই কিন্তু কোনও ভারতীয় ভদ্র সন্তানের সঙ্গে তার আলাপ হবার সুযোগ হয়নি। আর্মি তখন চাইত না যে অফিসাররা জনসাধারণের সঙ্গে মেলামেশা করে। হেলেনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস ছিল। কিন্তু আমাদের তখন দেখলে বিশ্বাস হত না যে মাসখানেক আগে আমরা কেউ কাউকেও চিনতাম না।

আমরা নানা দেশীয় রেস্তোরাঁতে খেতে ও থিয়েটার দেখতে ভালোবাসতাম : ইংরেজ জাতির এটা সাংস্কৃতিক জীবনের একটি বিশেষ দিক। ‘ওল্ড ভিকে’ শেক্সপিয়ারের বই দেখতাম। তারপর ‘শ্লোন’ থিয়েটারে বার্নার্ড শর প্লেও দেখেছি।

একদিন আমি লক্ষ করলাম যে হেলেনের শুকনো মুখ ও বিমর্ষ ভাব। খাবার নেমন্তন্ন আগের মতো গ্রহণ করল না। একটা কিছু ঘটেছে নিশ্চয়, জিজ্ঞাসা করলাম বার বার কিন্তু কোনও সঠিক জবাব পেলাম না। বলল যে দেশ থেকে ভালো খবর আসছে না, ব্যস ওই পর্যন্ত। আমার হঠাৎ মনে পড়ল যে ইংরেজি একটা খবরের কাগজে দেখেছিলাম আমেরিকায় একটার পর একটা ব্যাঙ্ক ফেল করছে এবং যারা আমেরিকান ‘লেটার অব ক্রেডিট বা ট্র্যাভেলার্স চেক’ নিয়ে বিদেশে গিয়েছে তারা পথের ভিখারির মতো অবস্থায় পড়েছে।

হেলেনের ব্যাপারটা তখন বুঝলাম। তার ট্র্যাভেলার্স চেক লন্ডনে অচল। বাড়িতে টেলিগ্রাম ও চিঠি পাঠিয়েছে কিন্তু সাড়া পাচ্ছে না। বোধহয় তার মা ও বোন গ্রীষ্মের ছুটিতে কোথাও বেড়াতে গিয়েছে তাই খবর পৌঁছয়নি। মেজর আর্মস্ট্রং-এর কাছে বহু টাকা পড়ে গেছে বলে সে খুব লজ্জিত। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে আমেরিকায় ফিরে যেতে তার আপত্তি আছে কিনা এবং জাহাজ ভাড়া সমেত তার ধার মোট কত টাকা

খুব অনিচ্ছাসত্ত্বে সে আমার প্রশ্নের উত্তর দিল। লজ্জায় মুখ লাল। আমি একদিন পরেই জাহাজের টিকিট নিয়ে বার্ক হ্যামস্টেডে উপস্থিত হয়ে হেলেনের হাতে টাকা দিলাম। সে আপত্তি করল না। মেজরকে তার প্রাপ্য টাকা দিতে সেও খুশি হল। চায়ের পর আমরা দুজন লুটন হিলসের ওপর বেড়াতে গেলাম। সূর্য অস্ত যাবার পরেও আমরা অনেকক্ষণ গল্প করলাম। কেমন করে এত অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের দুজনের এত ভাব জমে উঠেছিল সেকথা বারবার মনে হচ্ছিল। জীবনের ও যৌবনের ধর্মই বোধহয় এইরকম, মনের মিল হলে পরস্পরের প্রতি ব্যবহার সহজ হয়ে যায়।

১৫ দিন পরে আমি টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফারে হেলেনের কাছ থেকে পেলাম সমস্ত টাকা ও সেইসঙ্গে হেলেন ও তার মা-বোনের আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা চিঠি আর আমেরিকায় পৌঁছলে প্রাইসদের বাড়িতে থাকবার নিমন্ত্রণ। পরে এদের কথা আরও লিখব যখন আমেরিকায় পৌঁছব।

সেই সময় বাঙালি কবি, কামিনী রায় লন্ডনে উপস্থিত হলেন। গাওয়ার স্ট্রীটে ছাত্ররা একদিন তাঁর সম্মানার্থে মিটিং ডাকল। কয়েকদিন পরেই সরোজিনী নাইডু লন্ডনের লাইসীয়াম ক্লাবে ‘মহিলাদিগের জন্য’ বলবার জন্য আহূত হলেন। তাঁর বিষয় ছিল রাউলেট অ্যাক্টের প্রতিবাদ। অপ্রীতিকর বিষয় হলেও মিসেস নাইডুর আশ্চর্য সুন্দর করে বলবার ক্ষমতায় তাতে তিক্ততা রইল না। আমরা ক্যাক্সটন হলে তাঁর বক্তৃতা শোনবার সুযোগ পেলাম।

১৯৩১-এর গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডে সাড়া পড়ে গেল গান্ধীজি আসছেন। একদল ছাত্রের সঙ্গে আমি মার্সেলসে গেলাম গান্ধীজিকে অভ্যর্থনা জানাতে। সেই সময় আমি কয়েকটি ছবি তুলেছিলাম গান্ধীজির। একটা ছবি কিস্টোন কোম্পানি কিনে আমাকে অনেক টাকা দিল যার ফলে আমার যাতায়াতের খরচ উঠে গেল। লন্ডনে পৌঁছবার পর আমি অনেকবার গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভারতবর্ষের লোকেরা বিশ্বাস করত গান্ধীজি দেশকে স্বাধীন করতে পারেন, সে যেমন করেই হোক। সবাই উদগ্রীব হয়েছিল ইংরেজ গভর্নমেন্টের আলাপ আলোচনার ফলাফল জানবার জন্য। ইংল্যান্ড তখন হয়তো ভেবেছিল রাজনীতির চালে আরও বেশ কিছুদিন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা লাভ ঠেকিয়ে রেখে দিতে পারবে। কেবল কথার পরে কথার মারপ্যাচ— হিন্দু-মুসলমান দুটো দল খাড়া করে ইংরেজরা আমাদের লড়িয়ে দিল— আমরাও যথারীতি লড়তে আরম্ভ করলাম। এই সুযোগে ইংরেজ ভেবেছিল সুখে রাজত্ব এবং দোহন চালাবে। গান্ধীজি একটি কথায় সব বানচাল করে দিলেন ‘আই শ্যাল গিভ দ্য মুস্লিমস অব ইন্ডিয়া এ ব্ল্যাঙ্ক চেক’ অর্থাৎ আমি মুসলমানরা যা চায় তাই দেব। গান্ধীজির কথা লিখতে গেলে আমার গল্প আর ফুরোবে না, তাই এই পর্যন্ত।

আমি আরেকজন মহাপুরুষকে জেনেছিলাম যিনি গান্ধীজির মতো সর্বত্যাগী, সাধারণের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর নাম ডাঃ এলবার্ট সোয়াইত্জার। আমার একজন সুইশ বন্ধু, হানস মেটলার একদিন আমাকে ধরে নিয়ে গেল তাঁর সঙ্গে আলাপ করাবার জন্য। আমিও আলাপ করে মুগ্ধ। অনেকাংশে গান্ধীজির সঙ্গে ডাঃ সোয়াইজারের সাদৃশ্য রয়েছে। একদিন হানসের সঙ্গে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে তাঁর ‘অর্গান’ বাজানো শুনতে গেলাম। সত্যিই অপূর্ব বাজালেন। বাক-এর মিউজিকের তিনি শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার।

ডাঃ সোয়াইজার আমাকে দেখলেই গান্ধীজির কথা শুনতে চাইতেন। তিনি গান্ধীজিকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। একদিন বললেন যে রাজনীতিবিদ লোক সাধু হতে পারে আগে তিনি তা বিশ্বাস করতে পারতেন না।

একজন ইংরেজ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে আমি একটা আধুনিক শিল্পগোষ্ঠী ও লেখকের দলে যোগ দিলাম। সবাই তরুণ-তরুণী। কেউ লেখে, কেউ ছবি আঁকে বা ভাস্কর্য করে। প্রতি শুক্রবার একজন কারও বাড়িতে বৈঠক বসে। আমি ছিলাম এই দলের বাইরে থেকে আলোচনা শোনবার শ্রোতা। ম্যাকডোনাল্ড নামে একজন কবি এবং ডানলপ নামে একজন পেন্টার কিছুটা খ্যাতি লাভ করছিল তখন, আজ পঞ্চাশ বছর পরে তাদের কারও নাম তো আর পাই না। এক শুক্রবারের সন্ধ্যায় আমার ওপর হুকুম হল যে ভারতীয় ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করতে হবে। আমি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করলাম। মানে বোঝালাম যত দূর পারলাম। সকলেই তখন একমত যে বাংলাভাষা খুব ছন্দমধুর, অনেকটা নাকি ফরাসি বা ইতালীয় ভাষার মতো।

আগেই বলেছি আমার লন্ডনে আসার প্রথম দিকে ভাব হয়েছিল নীনার সঙ্গে। সে আমাকে নিয়ে গেল এক রবিবার সকালে পাভলোভার বাড়িতে। তিনি তখন নিজে কসরৎ করছিলেন তার সঙ্গে সঙ্গে দুটি মেয়েকে ও একটি ছেলেকে তালিম দিচ্ছিলেন। আমাদের দুটো চেয়ারে বসবার ইঙ্গিত করে নাচতে লাগলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে বিনা খরচে নাচ দেখলাম।

এই সম্পর্কে মনে পড়ল আরেক নৃত্য পটিয়সীর কথা। মাদাম আর্জেন্টিয়া— স্প্যানিস ডান্সার, জগদ্বিখ্যাত নাচিয়ে। দুই হাতে কাঠের কাস্টিনেট নিয়ে যখন নাচতেন তখন মনে হত গানের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

ভিয়েনা থেকে টেলিগ্রাম পেলাম আমার এক জাঠতুতো ভাই বিদ্যুৎ মুখার্জির কাছ থেকে যে সে লন্ডনে আসছে প্যারিসের পথে। ভাষার অসুবিধার জন্য সে চেয়েছিল যে আমি প্যারিসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি এবং তাকে লন্ডনে নিয়ে আসি। এত অল্প সময় হাতে ছিল যে তাড়াতাড়ি লন্ডন, ডোভার, ক্যালের পথে প্যারিসে গেলাম। ভাই বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট এবং আমার স্নেহের পাত্র। আমাকে প্যারিসে দেখে বিদ্যুৎ যেন অকূল সমুদ্রে কূল পেল। ঠিক করলাম দুয়েকদিন প্যারিসে থেকে লন্ডনে ফিরে যাব। একটা এগজিবিশন হচ্ছিল প্যারিসে তার নাম ‘কলোনিয়াল এক্সপোজিসন’, আমরা দেখতে গেলাম। সে এক অপূর্ব আলোর ইন্দ্রপুরী তৈরি হয়েছিল আলোর মালা দিয়ে। প্রথমেই আঙ্কোরভাট মন্দির দেখতে গেলাম। ভারতবর্ষের বাইরে যত হিন্দু মন্দির আছে এটি তাদের মধ্যে বৃহত্তম। কাম্বোজ দেশে আসল মন্দিরের এটি প্রতিলিপি, তার এক-চতুর্থাংশ ভাগ হিসাবে তৈরি। এমনই ফরাসি কৌশলে তৈরি যে দিনে রাতে হাজার হাজার লোক মন্দিরের ওপরে এবং ভেতরে চলাফেরা করছে অথচ কেউ বুঝতে পারছে না যে এটি আসল মন্দির নয়, নকল মাত্র। নিখুঁত কারুকার্য ও ভাস্কর্য পাথরের ওপর ফুটিয়ে তুলেছিল। রাত্রে তাদের ওপর ফ্লাড লাইট দিয়ে একেবারে দিনের মতো করেছিল।

আঙ্কোরভাট দেখে ঠিক করে ফেললাম যে কম্বোডিয়াতে গিয়ে আসল মন্দির দেখব। কিছুদিন আগেই এই মন্দির আবিষ্কার সম্বন্ধে একটা সুন্দর বই পড়েছিলাম বইটির নাম ‘Four faces of Shiva’। অজন্তা গুহা যেমন হঠাৎ শত শত বছর পরে আবিষ্কৃত হয় ঠিক তেমনই এবং প্রায় একই সময়ে আঙ্কোরভাটেরও সন্ধান মেলে।

আঙ্কোরভাট মন্দির দেখে এবং ফরাসি সুস্বাদু খাবার খেয়ে মনটা খুশিতে ভরে গেল। তারপর কাছেই একটা প্যান্ডেলের সামনে বিজ্ঞাপন দেখলাম Dance of Hindu Gods and Godesses. The wonder dancer, Uday Shankar ইত্যাদি।

দুটো টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। প্রথমেই এক সুইশ ভদ্রমহিলা আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কে এবং কোনও ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারি কি না। ভদ্রমহিলার নাম মিস এলিস বোনার। উদয়শঙ্কর যে আজ পৃথিবী জোড়া নাম করেছে তার গোড়াপত্তন করেন ইনিই।

নাচ শেষ হলে মিস বোনার আমাকে নিয়ে গেলেন উদয়শঙ্করের সঙ্গে পরিচয় করাতে এবং নাচ কেমন লাগল তা বলতে। তেমন ভালো লাগেনি সেদিন যেমন পরে তার নাচ আমায় নেশার মতো পেয়ে বসেছিল। সে রকম উচ্ছ্বসিত প্রশংসা সেদিন তাই করতে পারিনি। এ সম্বন্ধে পরে লিখব সবিস্তারে।

উদয়শঙ্কর আমাকে প্রথমেই নিকট আত্মীয়ের মতো গ্রহণ করেছিল। আমার সম্বন্ধে কারও কাছে হয়তো সে শুনেছিল, তাই সাহস ও কষ্টসহিষ্ণুতার প্রশংসা করে বলল যে পরদিনও নাচ দেখতে এবং একসঙ্গে খেতে। তিমিরবরণ, বিষ্ণুদাস শিরালি, তার ভাই রাজেন্দ্র, দেবেন্দ্র এবং রবিশঙ্করের সঙ্গেও আলাপ হল। আমাকে একটা বই দিল পড়ে পরদিন ফেরৎ দেবার জন্য। মূল্যবান বইটার নাম ‘মিরর অব জেস্টাস’ —আনন্দকুমার স্বামীর লেখা। আরও দুজনের সঙ্গে আলাপ হল, একজন উদয়শঙ্করের কাকা এবং অন্যজন মামা, কাকা হলেন কনকলতার বাবা। এদের মধ্যে প্রত্যেকেই কোনও না কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে, বলা উচিত একাধিক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে। তার ওপর নাচতে পারে, কাকা ছাড়া সবাই। আমি এরকম মিউজিক লাভিং ফ্যামিলি কখনও দেখিনি। নাচিয়ে রবীন্দ্রশঙ্কর তখন বারো বছরের ছেলে এবং ভবিষ্যতে জগদ্বিখ্যাত সেতার বাদক রবীন্দ্রশঙ্করকে সেদিন ‘রবু’ বলে জানলাম। দ্বিতীয় দিনে বইটা পড়ার পর দেখলাম সত্যিই উদয়শঙ্করের নাচ খুব ভালো লাগল। প্রথম দিনে আরেকজন আর্টিস্টের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তার নাম সিমকি। ফরাসি দেশের মেয়ে। অপূর্ব ভারতীয় নাচ শিখেছে উদয়শঙ্করের শিক্ষাগুণে। সিমকি ভালো পিয়ানো বাজাতে পারত। দলে আরও কয়েকজন মিউজিশিয়ান ছিল। সবাই যুবক ও উৎসাহী। বইটা ফেরৎ দিতে গেলাম উদয়শঙ্করকে। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল এবার নাচ কেমন লাগল। আমি বললাম ভীষণ ভালো। সেইদিন থেকে আমাদের মধ্যে নিবিড় আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। সবার সঙ্গে ‘তুমি’র সম্বন্ধ হল।

নাচের সময় উদয়শঙ্করের দলের অনেকগুলি ছবি তুলেছিলাম। পরে ওরা যখন লন্ডনে নাচতে এল তখন কয়েকটি ছবি বিক্রি করে টাকা পেলাম। উদয়ের পরের ভাই, রাজেন্দ্রশঙ্করের খুব ফটোগ্রাফি শেখার ইচ্ছা। আমরা দুজনে একসঙ্গে অনেক ছবি তুলেছি এবং আলোচনা করেছি। রাজেন্দ্র ভালো লেখা-পড়া করেছিল এবং সাহিত্যানুরাগী ছিল। আমার খুবই অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। পণ্ডিত রবীন্দ্রশঙ্কর, তখনকার ‘রবু’ আমাকে আপন দাদার মতো দেখত এবং দেখা হলেই ভ্রমণকাহিনী শুনতে চাইত। মাতুল তিমিরবরণ, শিরালিও আমাকে স্নেহের চোখে দেখত

লন্ডনে ফিরে এলাম বিদ্যুৎকে নিয়ে। হ্যাম্পস্টেডে একটা বাড়িতে তার থাকবার ব্যবস্থা করলাম।

প্যারিসে গিয়ে দুটো লাভ হয়েছিল: উদয়কে আবিষ্কার করা ও মাদাম কুরির দর্শন লাভ।

লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবের সভ্য হিসাবে সেখানে প্রায়ই যেতাম। এখনই আমার ভ্রমণকাহিনী বলার পর অনেক বিদেশি ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল। তাদের মধ্যে একটি মেয়ে ছিল যার গায়ে খুব জোর এবং বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। নাম মিস এঞ্জেলা গেস্ট, বাবা একজন সোসালিস্ট মেম্বার অব পার্লামেন্ট। সামান্য সুযোগ পেলেই এঞ্জেলা দাঁড়িয়ে উঠে সোসালিজম বা কমিউনিজম সম্বন্ধে লেকচার দিত।

পরে এঞ্জেলা গেল স্পেনে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন হয়ে। কিছুদিন ফ্রাঙ্কোর দলের সঙ্গে লড়াই করেছিল, তারপর বন্দুকের গুলিতে নিহত হয়। আমার আরেকটি ইংরেজ বন্ধু ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রাণ দিল। বহুদিন পরে একটি ফরাসি যুবকের সঙ্গে আমেরিকায় বসে আলাপ করবার সময় কথায় কথায় এঞ্জেলা ও অন্য যুবকটির মর্মন্তুদ কাহিনী শুনেছিলাম। ফরাসি যুবকটি জখম হয়ে পিরেনিশ পাহাড় পার হয়ে ফ্রান্সে ঠিক সময়ে পৌঁছে যায়, তাই তার প্রাণ রক্ষা হয়

আমারও খুব ইচ্ছা হয়েছিল একবার ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডে’ যোগ দিয়ে স্পেনে লড়তে যাবার। কিন্তু পৃথিবী ভ্রমণ আমার সমস্ত মন-প্রাণ জুড়ে ছিল। সেই উদ্দেশ্য ত্যাগ করে আর কোনও অ্যাডভেঞ্চার বরণ করবার ইচ্ছা আমার ছিল না। কতবার ভেবেছি মাউন্টেনিয়ারিং শিখব এবং দেশে ফিরে ‘মাউন্ট এভারেস্ট’-এর শৃঙ্গে উঠব। সুইজারল্যান্ডে ভ্রমণ করবার সময় সে সুযোগ আমি দুহাতে আঁকড়ে ধরেছি এবং অল্প প্রশিক্ষণ থাকা সত্ত্বেও পর্বতের চূড়ায় চূড়ায় উঠেছি ও নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।

রোজ কয়েক মাইল করে হেঁটে হেঁটে দুপায়ের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছিলাম। সাইকেলটা নিয়ে রোজ খানিকক্ষণ চড়তাম যতদিন পর্যন্ত না বুঝলাম যে আমি চলবার উপযুক্ত হয়েছি।

একদিন ওয়েলস বেড়াবার ইচ্ছায় বেরিয়ে পড়লাম। দক্ষিণ ইংল্যান্ডের হ্যাম্পসায়ার, ডরশেটসায়ার, ডেভনসায়ার খুব সুন্দর সাজানো কাউন্টি। ছোট ছোট পাহাড় কার্পেটের মতো ঘাস দিয়ে মোড়া। প্রথম প্রথম দিনে ৪০-৫০ মাইলের বেশি যেতাম না। হ্যাম্পসায়ারে একটা ঠিকানায় উপস্থিত হলাম। সামনেই মিস্টার শ, যিনি ‘লরেন্স অব আরেবিয়া’ নামে বিখ্যাত। তিনি একটা মোটর সাইকেল সারাচ্ছেন দেখলাম। ওভার-অল পরা কালিঝুলি মাখা কিন্তু সহজেই চেনা যায়। ‘রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি’র মিটিংয়ে অল্প সময়ের জন্য দেখা ও আলাপ হয়েছিল। যা হোক আমার কথা তাঁর মনে ছিল। প্রথমেই আরবি ভাষায় সম্বোধন করলেন তুমি আমার বন্ধু।’ আমি হেসে উত্তর দিলাম। দুজনে দুকাপ কফি নিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করার পর আমি বিদায় নিলাম। ‘শ’ অল্পদিন পরেই মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান।

সোয়ান্সি পৌঁছলাম। বড় শহর, ওয়েলসের রাজধানী বলা চলে। কাছেই অনেক কয়লার খনি আছে তা স্পষ্টই বোঝা যায়। ওয়াই এম সি এ-তে উঠলাম। একদিন বিশ্রাম নিয়ে উত্তর ওয়েলসের দিকে চলতে আরম্ভ করলাম। মধ্য ওয়েলসে না গেলে বোঝা যায় না দেশটা কত সুন্দর। পাহাড়, উপত্যকা, গাছপালা, হ্রদ, নদী-নালা আর বড় বড় নামের গ্রাম জোড়া দেশ। সব নামের আগে ‘হলান’ দেওয়া যেমন হলানবেরিশ, হলানডাননো ইত্যাদি।

ওয়েলসের লোকেরা অপেক্ষাকৃত গরিব। ব্যবহার খুব ভালো। ছবি তোলবার পক্ষে ওয়েলস একটা ভূস্বর্গ। খাবার খুব সাদাসিধে, বেশিরভাগ সেদ্ধ।

কুড়িদিন পরে ঘুরতে ঘুরতে মধ্য ওয়েলসের উপবনের দেশ থেকে উত্তরে সমুদ্রের ধারে হলানডাডনোতে পৌঁছলাম। গরমের দিনে সমুদ্রসৈকতে হাজার হাজার লোকের ভিড়, সৈকতের একধার থেকে রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ের ওপর। সূর্যাস্তের পর এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ধারের শহরটিকে খুব সুন্দর দেখায়

অল ইংল্যান্ড সাইক্লিস্ট ক্লাবের নিমন্ত্রণে একটা তাঁবুতে থাকবার জায়গা পেয়েছি। খাওয়াটা ইউরোপে কোথাও কোনও সমস্যা নয়। সব জায়গায়, বিশেষ করে যদি জায়গাটা সুন্দর হয় তবে একাধিক খাবার রেস্তোরাঁ দেখা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *