দুচাকায় দুনিয়া – ১৭

১৭

নিউইয়র্ক থেকে ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়া জাহাজ দক্ষিণে পানামা ক্যানেলের ভেতর দিয়ে উত্তরে সানফ্রান্সিস্কো যাচ্ছে। যাত্রীরা সবাই আনন্দে মেতে আছে। এদের হলিডে ট্রিপার্স বলে। বেলা চারটের সময় বালবোয়া পৌঁছলাম। এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। বালবোয়া ছেড়ে পানামা দেশের মধ্যে সাইকেল চালাতে আরম্ভ করলাম। রাস্তা ভালো নয়। দুদিনে আশি মাইল পার হলাম।

এরপর দক্ষিণে আমেরিকার কলম্বিয়া দেশে প্রবেশ করলাম। যতই দক্ষিণে যাই ততই পাহাড় মাথা আরও উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাঁচ হাজার ফুট পাহাড়ে উঠেছি। রাস্তা নেই বললেই হয়। লোকজন অতি বিরল। অতি কষ্টে চলতে হচ্ছে। তেমনই ঠান্ডা। একজন লোক বলল, বগোটা শহরে যেতে হলে আট হাজার ফুট পাহাড় আন্ডিজ পর্বতমালার উত্তরাংশ পেরতে হবে।

হঠাৎ রাস্তা নিচে নামতে আরম্ভ করল। নামতে নামতে চোকা নদীর ধারে এসে পৌঁছলাম। এখানে মানুষের বসবাস নেই। কিন্তু চারদিকের দৃশ্য অপূর্ব সুন্দর। নদী পার হয়েই আবার উঠতে আরম্ভ করলাম। পাহাড়ি পথে ওঠা-নামার ঘুরপাক খেতে খেতে চলেছি। মনে হচ্ছে-আমি ভুল পথে চলেছি। এদিকে আসাই আমার ভুল হয়েছে। আগে কল্পনা করেছিলাম দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাংশ ধরে অরিনেকো, গুয়ানা ইত্যাদি হয়ে ব্রাজিলে প্রবেশ করব। খবর নিয়ে জানলাম ওদিকে কোনও পথ নেই, যেটা আমাকে রিও দি জানেরো শহরে নিয়ে যেতে পারে, মধ্যে হাজার হাজার মাইল দুর্ভেদ্য জঙ্গল। তারপর সেখান থেকে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারেস শহরে যাবার কথা। অরিজিনাল প্ল্যান ছিল চিলির ভ্যালপ্যারিশো বন্দরে পৌঁছে সাউথ সি আইল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জের দিকে এগোব। সেটা তো হল না। এখন দেখছি এ পথে বেশি দূর এগোতে পারব না। দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম দিকটায় মাথা থেকে পা পর্যন্ত আন্ডিজ পাহাড় প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাহাড় হয়তো পার হতে পারব এই আশা ছিল। রাস্তার অভাবে আন্ডিজ এখানে দুর্লঙঘ। ভারি সাইকেল ও আমার পিঠের বোঝা নিয়ে মনে হচ্ছে নিচে কোথায় পড়ে যাব ঠিক নেই। মশার অত্যাচারও খুব। সাধারণত এত উঁচুতে ঠান্ডায় মশা থাকে না। ভাগ্যিস জন্তু-জানোয়ার দেখা যাচ্ছে না। কোলোন থেকে অনেক টিনের খাবার নিয়েছিলাম। সেগুলো এখন আমার খুব কাজে লাগছে।

চারদিকে ভীষণ পাহাড়, মাঝে আমি একা। মনে হত পাহাড় আমাকে গিলে খাবে। চারদিন পরে মডলেনা নদীর ধারে এলাম। টোলিমা শহর নদীর ধারে। এতদিন লোকজনের মুখ দেখিনি। শহরটা ছোট, পাহাড়ের গায়ে, অনেক দূর থেকে দেখা যায়। টোলিমায় একটা মশারি কিনলাম। বোঝা বেড়েই চলেছে।

টোলিমায় একদিন থেকে আবার পাহাড়ে চড়তে আরম্ভ করলাম রাজধানী বগোটা পৌঁছবার জন্য। বগোটা নয় হাজার ফুট উঁচু। পাহাড়ের রাস্তা আছে। উঠতে নামতে তিনদিন কেটে গেল তারপর বগোটা পৌঁছলাম। বেশিরভাগ লোক রেড ইন্ডিয়ান, সাইকেল দেখে সবাই অবাক। মোটর গাড়ির অভিজ্ঞতা কলম্বিয়াবাসীর হয়েছে।

উইলিয়াম বেলস বলে এক পাদ্রীর নামে একটা চিঠি ছিল। তাঁকে খুঁজে বের করলাম এবং দুয়েক রাতের মতো থাকবার আশ্রয় চাইলাম। বেলসের স্ত্রী মাথা। আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। একবার পরিচয় হবার পর বেলসরা আমার পাসপোর্ট দেখতে চাইল। পরে সবাই মিলে পুলিশ থানায় গেলাম। উইলিয়াম ওরফে বিল বলল যে আমি তার পরিচিত, আর ঝঞ্ঝাট রইল না। বেলস আধা ইংরেজ ও আধা আমেরিকান। মেথডিস্ট চার্চের লোক। সবাই খুব শ্রদ্ধা করে।

থানা থেকে বাড়ি ফেরবার পথে মস্ত এক ভিড় ঠেলতে ঠেলতে এগোলাম। সবাই চুপ করে আমার মতো আজব লোকটাকে দেখছিল। কেউ কেউ প্রশ্ন করছিল আমি কোন দেশের লোক, কোথায় যাচ্ছি ইত্যাদি। বগোটা থেকে ইকোয়াডরে কিটো শহরে যাব শুনে বলে, না সাইকেল নিয়ে তা সম্ভব নয়, খুব উঁচু পাহাড়।

একটি ছোট মেয়ে আমাদের তিনজনের জন্য কফি নিয়ে এল। অনেক গল্প হল। পরদিন হাট বার। আমি হাটে যাব মনস্থ করলাম। বেলসরা সাদাসিধে, ধর্মভীরু ও অতিথিপরায়ণ লোক। আমার খুব যত্ন করলেন। আমার বিছানাপত্তর বের করতে দিলেন না। তাঁরা ফায়ার প্লেসের সামনে খাবার পর বসে আমার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত শুনলেন। ইকোয়াডর হয়ে পেরুতে যাব শুনে বললেন খুবই কঠিন কাজ। ভীষণ উঁচু আন্ডিজ পাহাড় জোড়া সারা পথ। আমি শুনে আশ্বস্ত হলাম যে গাড়ি যাবার পথ আছে। তার মানে ঠেলতে ঠেলতে সাইকেল নিয়ে চলতে হবে।

হাটে গিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে সব পণ্যদ্রব্য বেচাকেনা দেখছি, একজন রেড ইন্ডিয়ান ইশারায় আড়ালে আমাকে ডাকল। জামার ভেতর থেকে একটা মানুষের মাথা বের করে দেখিয়ে বলল, পাঁচ ডলার। আমি শুনেছিলাম এদিকের লোকেদের অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মানুষের চুলসুদ্ধ মাথা (ব্রেন চোখ ইত্যাদি ফেলে দিয়ে) যাবজ্জীবন রেখে দিতে পারে। শোনা যায়, রেড ইন্ডিয়ানরা বিজাতীয় লোক ধরে তার গলা কেটে ফেলে সব ভেতরের জিনিস ফেলে দেয়। তারপর গলা দিয়ে মাথার ভেতর গরম পাথর ঢুকিয়ে সমস্ত মুখটাকে সজীব রাখে। কেবলমাত্র দুই চোখ সুতো দিয়ে বাঁধা। কারণ জিজ্ঞাসা করতে জানলাম যে ইভিল স্পিরিট চোখের মধ্যে থাকে। বন্ধ করে দিলে ভূতপ্রেতের ভয় নেই। গরম পাথর বা অন্য কোনও উপায়ে এই কাজ হয় বলে মাথাটা অপেক্ষাকৃত ছোট হয়ে যায়। সেজন্য মাথার চুল আরও ঘন দেখায়। আমি পাঁচ ডলার দিয়ে মাথাটা কিনলাম। সব জিনিসটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পেপার মাসে দিয়ে তৈরি মুখোশের মতো।

বাড়ি এসে বেলসদের কাছে মাথা কেনার গল্প বললাম। দুজনেই গম্ভীর। মাথার তো মাথা ধরে গেল।

বিল বলল, যেমন করে পার তুমি ওই মাথা বিদায় কর। তুমি হয়তো জানো না যে কারও কাছে শ্রাঙ্কেন হেড পাওয়া গেলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আমি তৎক্ষণাৎ মাথাটা নিয়ে বাড়ির বাইরে গেলাম এবং পাহাড়ের গায়ে একটা নির্জন জায়গায় সেটা রেখে দিলাম।

বাড়ি আসতে মিল ও মার্থা দুজনেই জিজ্ঞাসা করল আমি ফেলে দিয়েছি তো? আমি কোথায় রেখেছি বললাম। তারা আশ্বস্ত হল এবং আমার প্রতি পূর্বের সহৃদয় ব্যবহার শুরু করল। আমি নিজের ভুল স্বীকার করে বারবার ভেরি সরি বললাম। আমার ক্যামেরার নেগেটিভে মাথাটার ছবি আমার হাতের ওপর তোলা রয়ে গেল।

পরদিন বগোটা ছেড়ে চল্লাম। দশদিন জনমানবহীন পাহাড়ি পথে চলেছি। কখনও কখনও দশ-বারো হাজার ফুট উঠতে হয়েছে। রাজধানী কিটো নয় হাজার ফুট। আমাদের দেশে গ্যাংটকের কথা মনে করিয়ে দিল। ছোট্ট শহর। লোকেরা পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত। তাদের সঙ্গে রেড ইন্ডিয়ানদের সংমিশ্রণ হয়েছে।

দেশটার নাম ইকোয়াডর কারণ বিষুবরেখা দেশের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছে। মারানন বা আমাজন নদীর অনেকগুলি উৎপত্তিস্থল আছে তাদের মধ্যে একটি পেলাম কিটোর আগে। কিটো শহর অত উঁচুতে অবস্থিত বলে বেশ ঠান্ডা। পাহাড় থেকে নামলে ভীষণ গরম লাগে। বেশিরভাগ পথ পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে নেমে চলেছে।

এ দিকের সব পাহাড় রুক্ষ। দূরের পাহাড়ের মাথায় বরফ সারা বছর থাকে। পুবদিকে গেলে ব্রাজিলের ঘন জঙ্গল। বুনো শুয়োরের প্রাদুর্ভাব সেখানে। পূর্বে কোনও পথ নেই পায়ে চলা সরু পাহাড়ি পথ ছাড়া। খুব সাহসী লোকেরা নিচে জঙ্গলে যায় বুনো শুয়োর মারবার জন্য। এই অঞ্চলের লোকেরা বুনো শুয়োর খেতে খুব ভালোবাসে। ঠান্ডার দেশ বলে রেখে খেতে পারে।

বন্যজন্তুর মধ্যে একদিন একটা পুমা দেখলাম। অনেকটা সিংহের মতো দেখতে। মানুষ দেখলেই তেড়ে আসে না, বরং ভয়ে ভয়ে দূরে থাকে। আরেকটি বুনোজন্তু মাঝে মাঝে দেখেছি। খুব সুন্দর ছোট উটের মতো। সাদা পশমে ভরা। তার নাম লামা।

মাত্র একদিন কিটোতে থাকবার পর রওনা হলাম, রিওবাসবা ও কুয়েনচা যাবার জন্য। ইকোয়াডর ছোট দেশ। শেষ ছোট শহর লরা। তারপরই পেরু।

পেরুর সীমান্তে আমাকে আটকাল। আমার বংশে কেউ পাগল নেই, এই সার্টিফিকেট চাই। আমার মনে হল পেরুতে বোধহয় অনেক বেশি সংখ্যায় আছে তাই আরও একজন পাগল বাড়ছি তারা স্বভাবতই চায় না। সৌভাগ্য যে সীমান্তরক্ষীকে যখন বললাম যে আমি একটি কাগজে লিখে দিচ্ছি আমার বংশে কেউ পাগল নেই, তখন সে তা মানতে রাজি হল।

রক্ষী বোধহয় ভেবেছিল পাগল না হলে কেউ সাইকেল নিয়ে সাংঘাতিক পাহাড়ি দেশে বেড়াতে যায়! ওঠবার সময় সব জায়গায় আমি সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে চলেছি। নামবার সময় মহা আরামে ব্রেক টিপে ভীষণ জোরে চলেছি।

আমার খুশিমাফিক একটা রাস্তা পছন্দ না হলে অন্য পথ ধরবার উপায় নেই। পথ যেদিকে চলেছে সেই দিকেই যেতে হবে।

পেরুতে প্রথম শহর পিউবা খুব ছোট। পিউবা সমুদ্রের বেশ কাছে একটা ব্যাক ওয়াটারের ওপর। পিউবাতে ভালো করে স্নান করলাম অনেকদিন পরে। আমি আর পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে ইচ্ছুক নই। যতদূর সম্ভব সমুদ্রের ধারের রাস্তা ধরে চলব।

আমার গন্তব্যস্থল দক্ষিণে ট্রকসিলো শহরে। এটা একটা বড় গ্রাম বললে ভালো হয়। জেলেরা সারাদিন ধরে মাছ ধরে। অনেক মাছের নাম জানি না, যা এখানে খায়। আর্কটিক ওয়াটারে ট্রলার চালাবার সময় আমি ভাবছিলাম অনেক মাছ চিনি। কিন্তু প্যাসিফিকে তাদের দেখা পাইনি। টুনা এদের দেশে খুব প্রিয় মাছ। বড় মাছ, জালে ধরা পড়ে না। মোটা সুতো বা বঁড়শি যদি গাঁথতে সক্ষম হয় তো সোজা পাড়ের দিকে নৌকো চালায়। ডাঙায় লোকেদের কাছে মাছ জমা দিয়ে আবার সমুদ্রে নৌকো বেয়ে চলে যায়।

একদিন জালে একটা বীভৎস দেখতে মাছ দেখলাম। তার নাম বারাকুড়া, খেতে যদিও খুব সুস্বাদু।

একটা ছোট নদীর ওপর অবস্থিত উয়ারাজ শহরের দিকে চলেছি। উয়ারাজে আমি ইনকা সভ্যতার কথা শুনলাম। পাহাড়ের ওপর মাঝে মাঝে বাড়ির সার দেখেছি। পাথরের তৈরি সেজন্য পুরনো হলেও আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা বাড়িরও মাথায় চাল নেই। আমার যাদের সঙ্গে পথে দেখা হল তারা ইনকা সভ্যতা সম্বন্ধে কিছু জানে না। পরে বিদেশিদের লেখা বই পড়ে বরং কিছু জেনেছি।

উয়ারাজ থেকে আমি চললাম ৪৫০ মাইল দূরে লিমা শহরের উদ্দেশে। আমি যত দূর সম্ভব সমুদ্রের ধার ধরে চলেছি। তাও এ পথে পাহাড় কম নয়। বিষুবরেখা থেকে দশ ডিগ্রি দক্ষিণে চলেছি।

দশদিন প্রাণপণ চেষ্টার ফলে লিমার পাশে কালাও বন্দরে পৌঁছলাম। পরদিন পৌঁছলাম লিমা শহরে। একটি পরিচিত লোকের নামে চিঠি ছিল, তার নাম সাস্ত্রো, সান্ত্রোর একটা স্টিভেডোর অফিস আছে। ভালোই হল। দক্ষিণে আন্ডিজ পাহাড়ের যেমন ঘনঘটা দেখছি, আশা নেই পার হতে পারব। চিলিতে ভ্যালপারাইসো যাবার ইচ্ছা তাই ত্যাগ করলাম। পাহাড়ি পথে ঘুরতে ঘুরতে, উঠতে নামতে চিত্ত যেন হয়েছে বিকল। এই দিক দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় সফরের পরিকল্পনা ভুল হয়েছে।

সান্ত্রো আমার জন্য একটা হোটেলে থাকবার ব্যবস্থা করল। হোটেল ছোট হলেও, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। খাবার মুখরোচক। দুদিন লিমায় কাটাবার পরে সাস্ত্রো খবর দিল আর দুদিনের মধ্যে একটা ফরাসি জাহাজ ছাড়বে তাহিতি দ্বীপ যাবার জন্য। মাল লোডিং হয়ে গিয়েছে, শুধু ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আছে। আমি তৎক্ষণাৎ জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম এবং সব ঠিক করে ফেললাম। জাহাজটার নাম সেন্ট জোন। সে তাহিতির পর হনলুলু যাবে।

হোটেলে ফিরে এসে হিসাবপত্র মিটিয়ে দিয়ে সেন্ট জোনে গিয়ে উঠলাম। এবার প্রশান্ত মহাসাগর পার হতে হবে।

সুন্দর দিনটা, এদিকে বৃষ্টিবিহীন বছর কাটে। জাহাজ ছাড়ল, পশ্চিমের দিকে এগোতে শুরু করলাম। আমার প্রথম কথা মনে হল যে এতদিন পরে আজ আমি দেশমুখো হয়েছি, এবার দেখতে দেখতে বাড়ি পৌঁছে যাব। আসলে বাড়ি কিন্তু এখনও বহুদূর।

ভূগোলের পাতা খুলে যখনই দেখেছি আমার জাহাজ পশ্চিম মুখে পেরুভিয়ান কারেন্টে ভর করে চলেছে, ততবার মনে হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের ওই পারেই তো আমার দেশ, ভারতবর্ষ। হঠাৎ কেন জানি না বাড়ির টান মনটাকে চঞ্চল করে দিল। বহু বছর বাড়ি ছাড়া। সব জিনিসের যেমন সীমা রাখা দরকার তেমনই পৃথিবী ভ্রমণে কত বছর লাগবে তারও একটা হিসেব জানা দরকার।

সেন্ট জোন চলেছে পাউলাটু দ্বীপপুঞ্জের হাউ দ্বীপের দিকে। সমুদ্র শান্ত। মনে হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগর একটা হ্রদের মতো স্থির। আট হাজার টন মাল বইছে সেন্ট জোন। আমি ছাড়া অন্য কোনও যাত্রী নেই এই জাহাজে। ফরাসি জাহাজ বলে খুব মুখরোচক রান্না। অনেকদিন পর ভালো ভালো ফরাসি রান্না খেলাম। ক্যাপ্টেন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও তিনজন অফিসারের সঙ্গে আমার জায়গা হত। সবাই খুব ভালো লোক। নাবিকদের মধ্যে একজন ভারতবর্ষের ক্যানানোরের পাশে মাহে গ্রাম থেকে এসেছে। তার সঙ্গে আলাপ করলাম।

হাউ দ্বীপ থেকে অনেক দূরে জাহাজ থামল। চারদিকে কোরাল আছে এবং জলের গভীরতা কম, সেজন্য লাগুনের বাইরে থাকাই শ্রেয়। অনেক ছোট ছোট বোট জাহাজের চারপাশে পিঁপড়ের মতো ভিড় করল। হাউ দেখা হল না।

পরদিন সকালে তাহিতির দিকে বারোশো মাইল দূরের পথে রওনা হলাম আমার অনেক দিনের সাধ সাউথ সী আইল্যান্ডে যাবার। সেটা পূর্ণ হতে চলেছে, ভেবে মনে মনে আনন্দ অনুভব করছিলাম। ফরাসি চিত্রকর গগ্যাঁর জীবনের অনেক বছর এই দ্বীপে কেটেছে। তাঁর জীবনী থেকে অনেক সুন্দর সুন্দর লেখা পড়েছি যাতে মনে হয় তাহিতি একটি ভূস্বর্গ আর সেখানের লোকেরা মানুষের আকারে দেবদেবী। কী উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।

তাহিতি পৌঁছতে আরও আটদিন কাটল। মানুষরা তো ভালো বটেই। সরল মন। পৃথিবীর বাইরে যেন তারা বাস করে। জীবনযাত্রার জন্য যেন কোনও তাড়া নেই। হাত বাড়ালে ফল ফুল পাওয়া যায়। বর্শা হাতে পুরুষেরা মাছ শিকার করে। মেয়েরা বেশিরভাগ সময় ফুলের মালা গাঁথে, গান গায়, তার ফাঁকে ফাঁকে রান্না-বাড়া ও সন্তানাদির পরিচর্যা। শেষের কাজগুলি যেন গৌণ কর্ম।

ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দ্বীপে নামলাম। মেয়েরা ফুলের মালা আমাদের গলায় দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। ক্যাপ্টেন খুশি, সবাইকে চুম্বন বিতরণ করল। সে যেন কৃষ্ণ আর ওরা গোপিনীর দল। ক্যাপ্টেন খুব গর্বের সঙ্গে আমার দিকে চাইল। আমি হেসে সমর্থন জানালাম।

অনেকদিন পরে আমার পরিচিত ফল, ফুল ও গাছ দেখলাম সুদূর তাহিতি দ্বীপে, যেমন পেঁপে, কলা, আনারস, জবা ফুল ইত্যাদি। বহুকাল পরে ময়না পাখির ডাক শুনলাম।

লোকেদের পলিনেশিয়ান বলা হয়। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, বড় বড় চোখ, সবার স্বাস্থ্য ভালো মনে হয়। পুরুষরা অপেক্ষাকৃত লম্বা ও পেশী সম্বলিত বলে সুশ্ৰী দেখায়। আকাশের নিচে খোলামেলা জায়গায় জীবনের বেশিরভাগ কাটে বলে, মন খুব সরল। হিংসা, দ্বেষ শুনেছি এদের মধ্যে নেই। গান বাজনা খুব ভালোবাসে।

আবহাওয়া এত ভালো যে সমুদ্রের ধারে বালির ওপর শুয়ে রাত কাটাতে খুব ভালো লাগে। বাড়ি বানাবার কোনও প্রয়োজন নেই। তবে মানুষ বাড়ির গণ্ডি দিয়ে নিজেকে স্বতন্ত্র রাখতে ভালোবাসে। প্রায়ই এই দ্বীপের লোকেরা একত্র হয়ে খাওয়াদাওয়া ও আনন্দ উৎসব করে। শুনেছি পলিনেশিয়ানেরা শত শত মাইল দূরে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দ্বীপে থাকলেও সবার ভাষা এক, যদিও কদাচিৎ তারা মেলবার সুযোগ পায়। এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে পলিনেশিয়ানেরা এক জাতি, একই জায়গা থেকে উদ্ভূত। আজ দূরত্ব সত্ত্বেও তাদের ভাষা একই রয়ে গেছে।

সেন্ট জোন নোঙর তুলে রওনা হল সাতদিন পরে হনলুলুর দিকে। এই দ্বীপটি এ দিকের দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে বৃহত্তম এবং সবচেয়ে উর্বর। তেরোশো মাইল পথ সেন্ট জোন অতিক্রম করল ছয় দিনে। প্রশান্ত মহাসাগরের রূপ প্রশান্ত ও সুন্দর।

হাওয়াই দ্বীপ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অংশবিশেষ। হনলুলু এই দ্বীপের রাজধানী মস্ত মস্ত বাড়ি, গাড়ি, বন্দর ইত্যাদি একত্র হয়ে হনলুলুকে একটি বৃহদাকার শহরের রূপ দিয়েছে। আমি সেন্ট জোন জাহাজকে বিদায় দিয়ে হনলুলুতে নামলাম। সে তাহিতিতে ফিরে যাবে।

পার্ল হার্বার থেকে আমার এক আমেরিকান বান্ধবী, মেরী ক্লাউ (ডাক নাম বেবি) এসে এদেশি প্রথামতো গলায় মালা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। স্টেশন ওয়াগনে আমাকে নিয়ে গাড়ি চলল পার্ল হার্বারের ওপর পাহাড়ে। বেবির বাবার খুব সুন্দর বাড়ি আছে। সেখান থেকে দৃশ্য অপূর্ব

পথে দেখলাম অসংখ্য মোটর গাড়ির ভিড়। ছেলেমেয়েরা টেনিস খেলছে, যেন ছুটি উপভোগে সবাই ব্যস্ত। পরদিন আনারস প্ল্যান্টেশন দেখতে গেলাম। বিস্তীর্ণ মাঠে ট্র্যাক্টর দিয়ে আনারস চাষ হয়। ফসল তোলার পর মাঠে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে যাতে সব জীবাণু মরে যায়।

হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অনেকগুলি দ্বীপে আগ্নেয়গিরি আছে। হনলুলুর একাংশে আজও ধোঁয়া ও লাভা উদিগরণ হচ্ছে। সেজন্যে দ্বীপের কোনও কোনও জায়গায় যাওয়া নিষিদ্ধ। হাওয়াই অদ্ভুত সুন্দর দেশ। প্রকৃতির সব কটি অবদান আছে পাশাপাশি, যেমন পাহাড়, জল, গাছ, ফল ও ফুল। কেবল মনে হয় মানুষের ভিড় ও ঘরবাড়ি বেশি। কয়েক বছর পরে হনলুলুর মতো জায়গা নিউইয়র্ক, শিকাগোর মতো বড় বড় আকাশছোঁয়া বাড়িতে ভরে যাবে। পলিনেশিয়ার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ডুবে যাচ্ছে সভ্যতার চাপে।

হাওয়াইয়ে লোকেরা সাউথ সী আইল্যান্ডের অন্য ছেলেমেয়ের মতোই হাসিখুশি, তাদেরই জীবনের সুরে বাঁধা।

সন্ধ্যাবেলায় সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়েছি। দশজন স্ত্রী-পুরুষ হাতে গিটার নিয়ে হাঁটু জলে গিয়ে দাঁড়াল এবং ডাঙার দিকে মুখ ফিরিয়ে গান শুরু করল। দেখতে দেখতে শত শত লোকের ভিড় জমে গেল। প্রায় এক ঘণ্টা অনেক গান গাইল। ভাষা বুঝি না বলে মনে হচ্ছিল সব গানের সুর এক, তবু শ্রুতিমধুর

রাত্রে ডিনার খেয়ে হনলুলুর মেয়েদের নাচ দেখতে গেলাম। আমার ভালোই লাগল।

একটা মস্ত বড় চিনির কারখানা আছে এখানে, সেটা দেখলাম। সাতদিন এমনিভাবে দ্বীপের চারদিকে ঘুরে কাটল। এখানে সর্বত্র আধুনিক সভ্যতার ছাপ।

একটা বড় জাপানি জাহাজে আমি একটা বার্থ পেলাম। জাহাজের নাম তাইয়ো মারু। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে হনলুলু এবং তারপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর পার হয়ে জাপানে ইওকোহামা বন্দরে পৌঁছবে।

পলিনেশিয়া দেশের অলিখিত নিয়ম হচ্ছে যে মেয়েরা দ্বীপে আগত অতিথিদের গলায় মালা দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়। দেশ ভ্রমণ শেষ হলে, জাহাজে ওঠবার সময় মালা জলে ফেলে দিতে হবে। তখন ডাঙা থেকে বিদায়ের গান গায় করুণ সুরে। জাহাজে উঠে মালা জলে ফেললাম এবং বান্ধবীর কাছে বিদায় নিলাম।

হনলুলু থেকে আমি একমাত্র যাত্রী ইওকোহামার পথে। সবার কৌতূহল হল এই ব্রীচেস পরা, রোদে পোড়া, তামাটে ছয় ফুট লম্বা মানুষটি কাঁধে, পিঠে ও সাইকেলের ওপর মাল নিয়ে কোথায় চলেছে।

জাহাজের যেখানে খেলাধুলা হচ্ছে সেই দিকে গেলাম। একদল ইয়ং আমেরিকান ছেলে একটি মেয়েকে নিয়ে সাফল বোর্ড খেলছিল। মেয়েটির স্পোর্টস উত্তম্যানের মতো চেহারা। ছেলেদের মধ্যে সে যেন মধ্যমণি। খেলার মধ্যে একটি শক্ত জায়গায় সবাই আটকে গেল। আমি দ্রষ্টা ছিলাম। হঠাৎ বলে ফেললাম যে ইট শুড নট বি সো ডিফিকাল্ট। তখনই সবাই আমাকে একটা সাফলার দিয়ে বলল, তুমি চেষ্টা করে দেখলে বুঝবে।

খেলবার সুযোগ পেয়ে মনে মনে খুশি। তাহলে দীর্ঘ একমাস সময় জাহাজে ভালোই কাটবে।

এর আগে দুয়েকবার সাফল বোর্ড খেলেছি, তবু চেষ্টা করে দেখি বলে শক্ত মারটা সহজেই হাসিল করলাম। ওরা বেশ একরকম আশ্চর্য হয়ে গেল। আমি নিজেও অবাক হয়েছিলাম। জন, বিল, জেমস, ল্যারি, চার্লস এগিয়ে এসে আমার করমর্দন করে নিজেদের পরিচয় দিল। এরা পরে সবাই অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েছিল। তরুণী আমার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বললে তার নাম এলিজাবেথ রে, আমি লিজবেথ বলে ডাকতে পারি। আমি সবাইকে জানালাম আমার পুরো নামটা, তারপর স্থানীয় রীতি অনুসারে বললাম বিমল বলে ডাকতে।

খেলা আবার শুরু হল। অতি সহজেই আমি সবার ওপরে হলাম। তারপর আরও নানা রকম খেলায় যোগ দিলাম। টেনিকয়েট আমি অনেকবার খেলেছি। মনে মনে জানতাম যে এই একটা খেলায় আমি সবাইকে হারাতে পারি। জাহাজের ডেকের ওপর এত উত্তেজনাপূর্ণ খেলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত। সব খেলাতেই লিজবেথ আমার পার্টনার। প্রত্যহ সব খেলা জিতে আমাদের ধারণা হয়েছিল যে প্রতিযোগিতা হলে আমরা সবাইকে হারিয়ে দেব।

একদিন সত্যি সত্যি প্রতিযোগিতা আরম্ভ হল। আমরা ফাইনালে উঠলাম। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম জিম ও পার্টনার তার স্ত্রী। তাদের খেলা দেখবার মতো। দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল পরিষ্কার। দুজনেরই স্বাস্থ্য খুব ভালো। জিমের কথা পরে লিখব। সেও মনে করত কেউ তাদের দুজনকে হারাতে পারবে না

খুব ঘটা করে ফাইনাল আরম্ভ হল। জিম, লিজবেথের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করতে লাগল যে আমি কুলকিনারা পাচ্ছিলাম না। তখন আমি আমার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে লিজবেথকে বাঁচিয়ে খেলতে লাগলাম। আমি রিংটা জিমকে দিলে সে তৎক্ষণাৎ লিজবেথের দিকে ছুড়ছিল। দ্বিগুণ পরিশ্রমে আমি লিজবেথ জয়ী হলাম। অনেক পুরস্কার এবং অনেক অভিনন্দন পেলাম। সবাই স্বীকার করল এ রকম চিত্তাকর্ষক খেলা কখনও দেখেনি।

জাহাজের ক্যাপ্টেন আমাদের দুজনের সম্মানে একটা ভোজ দিলেন।

সাফল বোর্ড খেলতেও আমরা জিতলাম। আরও চার রকম প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। প্রত্যেকটার ফাইনালে আমি ও এলিজাবেথ এবং শেষপর্যন্ত আমরা জয়ী। এরকম সৌভাগ্য আমার বোধহয় আর কখনও হবে না।

এবার জিমের কথা বলি। পেশাগতভাবে সে একজন লায়ন-টেমার। জাহাজের রিয়ার ডেকে খাঁচার মধ্যে একটা প্রকাণ্ড সিংহ ছিল জিমের তত্ত্বাবধানে। ওই সিংহের মালিক হলিউডের মেট্রো গোল্ডউইন মায়ার কোম্পানি। তারা জাপানি ছেলেমেয়েদের সিংহ দেখাবার জন্য একমাস টোকিও ও অন্যান্য জুতে যাচ্ছে।

সিংহ যখন মাত্র ছয় সপ্তাহের তখন থেকে জিম দেখাশোনা করে। জিমের সঙ্গে সম্বন্ধ একেবারে স্বাভাবিক। খুব ভাব। সিংহের মুখের হাঁর মধ্যে জিম মাথাটা ভরে দিতে দ্বিধা করে না। এখন পাঁচ বছর বয়স সিংহের। প্রকাণ্ড দেহ, মাথাটা কেশরসুদ্ধ ততোধিক বড়। থাবা দুটোর অসীম জোর। যে কোনও জানোয়ারের ঘাড় ভেঙে দিতে পারে অনায়াসে।

আমি প্রায়ই ডেকের একধারে রাখা খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সিংহের দিকে চেয়ে দেখতাম। মনে পড়ত সুদানে সিংহ দেখেছি ডজন হিসাবে। ভয়ে ভয়ে তাদের খুব কাছে যাবার চেষ্টা করিনি। সিংহের অত্যাচারে আমার আফ্রিকা ভ্রমণ সাৰ্থক হয়নি।

ক্যামেরা হাতে প্রায়ই খাঁচার পাশে আমাকে দেখে জিম একদিন বলল যে আমাকে খাঁচার ভেতর নিয়ে যাবে যদি আমি আরও কাছ থেকে ছবি তুলতে চাই। জিমের ওপর আস্থা ছিল। সে খাঁচা খুলে আমাকে ঢোকাল ভেতরে, কিন্তু আমার ঠিক সামনে জিম দাঁড়িয়ে রইল।

ক্যামেরা ঠিক করে অপেক্ষা করতে লাগলাম সিংহ কখন হাই তুলবে তখন দাঁত ও জিভের ভালো ছবি তুলব।

আমাকে প্রায়ই খাঁচার বাইরে দেখে সিংহ খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খাঁচার ভেতরে যাওয়ায় তার ঘোর আপত্তি মনে হল। আমার ক্যামেরার দিকে কটমট করে চেয়ে রয়েছে। আমার সাধ্য নেই আই লেভেলে অর্থাৎ চোখের কাছে ক্যামেরা তুলে দেখি।

অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সিংহ বিরক্ত হয়ে মুখব্যাদান করল, আমি তৎক্ষণাৎ সিংহের প্রকাণ্ড জিভসুদ্ধ একটি ছবি তুললাম। ছবি তোলবার ক্লিক শব্দ সিংহের কাছে এত সন্দেহজনক মনে হয়েছিল যে মুহূর্তের মধ্যে ক্যামেরার ওপর প্রচণ্ড থাবা মারল। আমি ঘটনাটা ভালো করে বোঝবার আগেই দেখি জিম আমাকে ঠেলে দরজার বাইরে ফেলে দিয়েছে এবং দরজা বন্ধ করে ফেলেছে। সিংহ জিমের পিঠে থাবা মারল।

জিম দরজা বন্ধ করে আমাকে ফিরে যেতে বলল এবং ছুটে গেল জাহাজের ডাক্তারের কাছে। তার পিঠে ছটা সেলাই পড়ল। স্টিচ করবার পরই ফিরে গেল আবার খাঁচায়। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। সিংহ ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছে যে সে অন্যায় করেছে, সেজন্য সে অনুতপ্ত। খাঁচার ভেতর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সিংহ মাথাটা দিয়ে জিমের মুখে ও কাঁধে ঘষতে লাগল। আমি বুঝলাম দুজনের মধ্যে শান্তি ফিরে এসেছে। আমার যাওয়াটা সে অপছন্দ করেছিল। তার ওপর মস্ত বড় পোর্ট্রেট লেন্স লাগানো ক্যামেরা যত নষ্টের গোড়া।

সিংহটা এতই পোষ্য ছিল যে জিম তার গায়ের নিচে সুড়সুড়ি দিলে সে নীরবে সহ্য করত। বশ্যতা স্বীকারের এটা নাকি চরম নিদর্শন। মুখের ভেতর মানুষের মাথা ঢোকানোয় তেমন বাহাদুরি নাকি নেই। সে যাই হোক, সিংহ মহাশয় যে সিংহকুলে একটি আশ্চর্য রকম বিশাল ও সুদর্শন জীব ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

জিম সিংহকে নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে মেট্রোর টাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে। সে সিংহের প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে পরিচিত। মেজাজের সামান্যতম পরিবর্তন জিমের চোখে ধরা পড়ে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে পিঠের ওপর সিংহের থাবার আঁচড় খেল। আজও আমার কাছে সেদিনের তোলা সিংহের মুখ্যব্যাদান করা ছবি রয়েছে।

জিমের স্ত্রীরও একটি পরিচয় আছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি মেয়েদের কলেজে সে ফিজিক্যাল ট্রেনিং দেয়। সেজন্য তার দেহ সুঠাম এবং কর্মকুশল। মনে হয় জিমের বিবাহ একেবারে যাকে বলে রাজযোটক।

আমার হাতে সারাক্ষণ লাইকা ক্যামেরা থাকত বলে সবাই আমার তোলা ছবি দেখতে চাইল। দু-চারখানা দেখাবার পর যখন বুঝলাম লোকেদের আগ্রহ আছে আরও ছবি দেখবার তখন আমি একটি প্রদর্শনী করতে রাজি হলাম। জাহাজের জাপানি অফিসাররা ভীষণ খুশি হয়ে সব রকম ব্যবস্থা করে দিল যাতে তিন দিন হলঘরে প্রদর্শনী হতে পারে। আমি মোট একশোখানা এনলার্জমেন্ট দেখাব ঠিক করলাম।

ক্যাটালগ ছাপানো সম্ভব নয় বলে লিজবেথ এগিয়ে এল সব ছবির টাইটেল লিখে দেবার জন্য। জাহাজের তরফ থেকে বড় বড় ইলেক্ট্রিক আলো ছবির ওপর ফেলবার বন্দোবস্ত করল।

প্রদর্শনীর চতুর্থ দিনে আমি আমার ভ্রমণকাহিনী বললাম। তারপর হঠাৎ আমার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল। সবাই ড্রিঙ্ক দিতে চায় কিংবা ইচ্ছা করে তাদের টেবিলে বসে খাই। ডিনারের পর নাচে সব তরুণীরা চাইত আমি তাদের সঙ্গে নাচি। ওদিকে লিজবেথের সঙ্গে ভাব আমার সবচেয়ে বেশি, একসঙ্গে খেলাধুলা করি বলে।

আমি যে দলের সঙ্গে সারাক্ষণ থাকি তারা সবাই আমেরিকান। জেমস একজন লেখক। কোলের ওপর টাইপরাইটার নিয়ে সারাদিন ঠকঠক করে টাইপ করত। যা শুনত, যা দেখত সব জিনিসের টাইপে রেকর্ড রাখত। পরে জেমস সারা জাপান ও চিনদেশের একাংশ আমার সঙ্গে ঘুরেছে। পৃথিবী পর্যটক হবার খুব শখ কিন্তু চিন দেশে পথের অভাবে রাজনীতিক গণ্ডগোলে পড়ে শখটা ছাড়ল। জেমসের মনটা ভালো। আমাকে মনেপ্রাণে নেতা বলে মেনে নিয়েছিল। সে থাকত কাছে কাছেই, সব সময় নানা রকম গল্প-গুজবের মধ্যে আমাদের ভালোই কাটত।

অন্য ছেলেরা কেউ ছাত্র ও কেউ ব্যবসা করবার ইচ্ছায় জাপানে ঘুরতে যাচ্ছে। ল্যারি ইলেক্ট্রনিক্স শিখতে আমেরিকা ছেড়েছে। জেমস ছাড়া আর কেউ চিন দেশে যাবে না।

জাহাজে বহু দেশের স্ত্রী-পুরুষ ছিল যাত্রী হিসাবে। মোটামুটি সবার সঙ্গে ভাব হয়ে গিয়েছিল। একজন আমেরিকান, নাম জনসন, জাপানিদের নিয়ন আলো তৈরি করানো শেখাতে যাচ্ছে। মতলব হচ্ছে সেখানে সুবিধা পেলে ব্যবসা ফেঁদে বসবে। আমাকে বলেছিল যে সে ভারতবর্ষের বড় বড় শহরে নিয়ন আলোর প্রচলন করবে।

প্রশান্ত মহাসাগর একেবারে শান্তশিষ্ট হ্রদের মতো। সন্ধ্যার পর তাইয়ো মারু আলোকসজ্জায় মণ্ডিত হয়ে তার বুকে চার হাজার মাইল দূরে জাপানের দিকে চলেছে।

সব জিনিসের যেমন শেষ আছে তেমনই প্রশান্ত মহাসাগরেও আছে। তার পশ্চিম প্রান্তে এসে ইয়োলো সির মধ্যে পড়েছি। জাপান আর তিন দিনের পাড়ি। এমন সময় ঝড় উঠল, ক্রমশ তার বেগ এত বাড়তে লাগল যে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি ও উত্তাল সমুদ্র। যত দিন সুন্দর দিন ছিল, তাইয়ো মারু হেসে খেলে প্ৰশান্ত মহাসাগরের বুক চিরে চলেছে গন্তব্য পথে। আজ প্রকৃতি বিক্ষুব্ধ। মানুষের সাধ্য নেই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। জাহাজ সত্যিই তোলপাড়।

ডিনার হলে কয়েকটি স্ত্রী-পুরুষ খেতে এসেছে। বেশিরভাগ যাত্রী সী সিক, ঘরের ভেতরে রয়েছে। সেই ভীষণ ঝড়ের দিনে, লিজবেথ আমার সঙ্গে ডেকে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের বিভীষিকা দেখছিল। প্রকাণ্ড জাহাজটা এক হাজার যাত্রী নিয়ে উঠছিল পড়ছিল, যেন একটা মোচার খোলা।

জাহাজের যন্ত্রপাতি সব বন্ধ। ঢেউ যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে তাইয়ো মারু সেদিকেই চলেছে। লক্ষ করবার বিষয় দেখলাম জাপানি নাবিকদের দক্ষতা। অমন দুঃসময়ে তারা স্থিরচিত্তে কাজ করে চলেছে।

কাল সকালে জাহাজ ইওকোহামা বন্দরে পৌঁছবে। অনেক রাত পর্যন্ত লিজবেথ ও আমি গল্প করলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *