দুচাকায় দুনিয়া – ৬

দুদিন পরে একটা মাছ ধরার জাহাজের সঙ্গে ব্যবস্থা করলাম আয়ারল্যান্ডে যাবার। পাঁচদিন অপেক্ষা করার পর জাহাজ ছাড়ল, হেরিং মাছ ধরতে। সাধারণত নর্থ সীতে মাছের জন্য যায়, কিছুকাল আইরিশ সীতে চেষ্টা করার পর। জাহাজ বললে অত্যুক্তি হয়। দরকার হলে বড় জোর চারজন লোক সেখানে রাত কাটাতে পারে। আসলে সেটা একটা স্টিম লঞ্চ।

জাহাজটা সকাল ছটার সময় রওনা হল। সারাদিন ঠুক ঠুক করে চলে সন্ধ্যার একটু আগে আয়ারল্যান্ডের উত্তরে লন্ডনডেরি শহরের উপকূলে আমরা পৌঁছলাম। আমি অনেক ধন্যবাদ দিয়ে এখানেই নামলাম। ওয়াই এম সি এ-তে উঠলাম।

ম্যানেজার একজন যুবক, খুব উৎসাহী। আগেই খবরের কাগজের রিপোর্টারদের ডাকল। তারা ক্যামেরা নিয়ে হুড়মুড় করে আমার ঘরে ঢুকে পড়ল কিছুক্ষণ পরেই। প্রশ্নের পর প্রশ্ন চলল। ছবিও তুলল। পরদিন খবরের কাগজে বিশদ বিবরণ বেরোল। তার মধ্যে ভুলও অনেক ছিল; যেমন আমাকে নাকি মরুভূমিতে বাঘে তাড়া করেছিল। যারা পড়েছে তারা নিশ্চয় হেসেছে এবং ভেবেছে কী গুলবাজ রে বাবা! মিঃ বাসবি আমাকে তাঁর বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ডিনারের নেমন্তন্ন করলেন। পরিপাটি ছোট সংসার। আয়ারল্যান্ডের লোকেরা ভারতবাসীদের ওপর খুব সহানুভূতিশীল, যদি জানতে পারে যে আমরা স্বাধীনতাকামী। মিঃ বাসবি ছিলেন রোমান ক্যাথলিক যদিও এই উত্তরাঞ্চলের লোকেরা বেশিরভাগ প্রোটেস্ট্যান্ট, তারা স্বাধীনতা চায় তবে ইংরেজের সঙ্গে সব সম্পর্ক বজায় রেখে— যা মোটেই সম্ভব নয়। ক্যাথলিকরা চায় সমস্ত আয়ারল্যান্ড, এমনকী উত্তরাংশও স্বাধীন রাজ্য হোক যেমন বাকি আয়ারল্যান্ড হয়েছে।

বাসবিদের কাছে বিদায় নিয়ে ওয়াই এম সি এ-তে ফিরলাম। শোবার ঘর ছিল না। দুটো সোফা জুড়ে ভালো বিছানা তৈরি করলাম।

একদিন শহরটা ঘুরতে বেরোলাম। বিশেষ দ্রষ্টব্য কিছু নেই। পরদিন বেলফাস্টের পথ ধরলাম খুব ভোরে। পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। এই শহরের লর্ড মেয়র, স্যার জর্জ মনিপেনি আমাকে নাগরিক অভ্যর্থনা জানালেন। স্যার জর্জ, লন্ডনডেরির কাগজে আমার ইতিবৃত্তান্ত পড়ে ঠিক করেছিলেন সিভিক রিসেপসন দেবার। এখানের সবচেয়ে বড় হোটেলে আমি তিনদিন থাকবার নিমন্ত্রণ পেলাম।

হারল্যান্ড উলফ নামে জাহাজ নির্মাণের কারখানা— গ্রেট ব্রিটেনের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান— দেখতে গেলাম। জাহাজ তৈরির গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত দেখবার সুযোগ পেলাম। আশা করলাম যেন আমাদের দেশেও একদিন এইরকম কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। কয়েক সহস্ৰ কর্মী জানাল যে আমি যেন তাদের সঙ্গে ক্যান্টিনে লাঞ্চ খাই। আমি রাজি হলাম। সে কি উদ্দীপনা আমাকে দেখবার জন্য। লাঞ্চের পর ছোটখাটো একটা বক্তৃতা করলাম ধন্যবাদ দিয়ে।

বিকালে ভাইসরয় অব নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বাড়িতে চা খাবার নেমন্তন্ন পেলাম। ভারতবর্ষের ভাইসরয়ের জন্য যে রকম জাঁকজমকের ব্যবস্থা আছে –এখানে সেরকম কিছু নয়। একজন নামমাত্র বড় অফিসার। আমার পৌঁছনোর খবর পেয়ে ভাইসরয় ও তাঁর স্ত্রী এবং একটি ছেলে আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। বেশ ঘটা করে চায়ের বন্দোবস্ত হয়েছিল। শর্ট ব্রেড আমার খুব ভালো লাগে দেখে ভাইসরয়ের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের দেশে এই জিনিসটি হয় কিনা। আমি বললাম পাওয়া যায় কলকাতায় সেই সব জায়গায় যেখানে ইংরেজ, স্কটিশ ও আইরিশরা চা খেতে যায়। আরও বললাম যে আমাদের দেশে আমাদের নিজস্ব নানারকম খাবার পাওয়া যায় যা খুবই সুস্বাদু ও মুখরোচক।

ভাইসরয় আমাকে পরামর্শ দিলেন বেলফাস্টের কাছাকাছি সুন্দর দ্রষ্টব্য সব দেখতে। স্বীকার করলেন যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে দক্ষিণ পশ্চিম আয়ারল্যান্ডের তুলনা হয় না— আমি যেন কিলার্নি বেড়াতে যাই।

এই বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ডানলপ নামে একজন বেলফাস্টের লোক সলিড রাবার টায়ারের পরিবর্তে হাওয়া-ভরা টায়ার আবিষ্কার করে জগদ্বিখ্যাত হয় এবং প্রচুর ধন অর্জন করে। পৃথিবীর এমন কোনও দেশ নেই যেখানে ডানলপের টায়ার বিক্রি হয় না।

একটি মধ্যবিত্ত আইরিশ পরিবারের মেয়ে মিস ডরথি ও কনেল আমাকে নেমন্তন্ন করে পাঠাল, তাদের সঙ্গে উইক-এন্ড কাটাবার জন্য। ডরথির সঙ্গে দেখা করার আমার প্রয়োজন ছিল। আমার একটি মুসলমান বাল্যবন্ধু, বেলফাস্টে ছাত্রাবস্থায় কয়েক বছর আগে ডরথির সঙ্গে পরিচিত হয় এবং প্রেমে পড়ে উভয়ত। বন্ধুর নাম সামসুজ্জোহা। আমার সঙ্গে তার মিত্র ইনস্টিটিউশনে একই ক্লাশে পড়বার সময় ভাব হয়। সে অ্যান্টনিবাগানে অর্থাৎ আমার বাড়ির কাছেই থাকত। সেই ভাব অনেকদিন টিকে ছিল।

ডরথিদের বাড়ি দুদিন কাটালাম। সামসুরের সঙ্গে বিয়েতে খুব অনিচ্ছাসত্ত্বে মত দেন বাবা মা, তার প্রধান কারণ এই যে আর কখনও তারা মেয়েকে দেখতে পাবেন না। জাতি বৈষম্য ভাব ছিল না বরং জামাই উচ্চশিক্ষিত ভদ্র পরিবারের ছেলে ভেবে মনটাকে প্রস্তুত করেছিলেন এই বিষয়ে।

ডরথি মেয়েটি খুব নম্র, ভদ্র ও মিষ্টি স্বভাবের, দেখতেও ভালো। আমাকে সে খুশি করবার জন্য সদাই ব্যস্ত। ভারতবর্ষের নানা বিষয় প্রায়ই জিজ্ঞেস করত যেমন দৈনন্দিন জীবন, স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্ক, শ্বশুর-শাশুড়ির পুত্রবধূর প্রতি ব্যবহার, গ্রীষ্মের প্রকোপ ইত্যাদি। সে মনে মনে ভারতবর্ষে আসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। আমি সামসুরের কাছে ‘ফার্স্ট ক্লাশ সার্টিফিকেট’ –ডরথির নামে লিখে চিঠি পাঠালাম লন্ডনে। কোনও কারণে তার ও ডরথির শেষ পর্যন্ত মিলন হয়নি

বেলফাস্টের কাছে সমুদ্রের ধারে এক আশ্চর্য জিনিস দেখতে গেলাম। কারা যেন সমুদ্রের ধারে বসে পাথর পরিষ্কারভাবে কেটে খোদাই করে কী বানিয়েছে— ভারতবর্ষ ও সিংহলের মধ্যে জলপথে সমুদ্রের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত পাথরের স্তম্ভ যে রকম দেখা যায় অনেকটা সেই ধরনের, যদিও অনেক ছোট।

ডরথি ও তাদের পরিবারের সবাইকে আতিথেয়তার জন্য প্রভূত ধন্যবাদ জানিয়ে আমি ডাবলিনের দিকে রওনা হলাম। পথে এক রাত একটা নাম না-জানা ছোট্ট গ্রামে একটি চাষী পরিবারের সঙ্গে কাটালাম। ডাবলিন একটা মস্ত বড় শহর। এখানের ইউনিভার্সিটি বিখ্যাত, বিশেষ করে স্ত্রীরোগের নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হয় বলে ডাবলিনে পাশ করা গাইনোকলজিস্টদের সুনাম ও পসার পৃথিবীর সব দেশে। ডাবলিনে ওয়াই এম সি এ-তে উঠলাম। এখানে কোনও শোবার ঘর নেই। ম্যানেজার বললেন, আমার খুব কষ্ট হবে, তবে যদি যেমন করে হোক থাকতে চাই, তাতে তাঁর আপত্তি নেই। আমি রাত্রে খাওয়াদাওয়া সেরে তিনতলার এটিকে গেলাম কয়েকটা চেয়ার জুড়ে শোবার বন্দোবস্ত করতে। ম্যানেজার বললেন যে পরদিন সকাল আটটার সময় ওয়াই এম সি এ-এর হলঘরে প্রার্থনা হবে। তিনি সেখানে আমার উপস্থিতির জন্য অনুরোধ করলেন।

সারারাত ভালো ঘুমোতে পারিনি সরু সরু নড়বড়ে চেয়ারে শুয়ে, তাই খুব সকালেই উঠে পড়লাম। ওয়াই এম সি এ-র কাছেই একটা রেস্তোরাঁতে গিয়ে বেশ করে চা রুটি ডিম খেয়ে প্রস্তুত হলাম দিনের কাজের জন্য, আটটায় প্রার্থনায় যোগ দিতে গেলাম। অনেক লোক এসেছিল। একজন ৬০-৬৫ বছরের সুদর্শন, পাকা চুলওয়ালা ভদ্রলোক ‘সারমন অন দ্য মাউন্ট’ থেকে পাঠ করলেন এবং প্রার্থনা করলেন। শেষ হলে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে এবং কোথা থেকে এসেছি। পরিচয় পেয়ে নিজেই আমার কাছে এসে দুই হাত বাড়িয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় শুয়েছিলাম রাত্রে। তিনি যতদূর জানেন ওই বাড়িতে শোবার কোনও ব্যবস্থা নেই। এটিকের কথা বলাতে, তিনি তখনই চললেন তিনতলায়। সেখানে দু সার চেয়ার মুখোমুখি সাজানো ছিল তখনও। বৃদ্ধ ভদ্রলোককে চার্লি বলে সবাই ডাকত। চেয়ারগুলো দেখে হাসতে হাসতে বললেন আমি এখন বিশ্বাস করছি যে তুমি ভারতবর্ষ থেকে বাই-সাইকেলে সুদূর আয়ারল্যান্ডে এসেছ। তারপর আমাকে বললেন তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিতে যত শীঘ্র পারি, তাঁর বাড়িতে যেতে হবে থাকবার জন্য। এ কথা বলে অপেক্ষা করতে লাগলেন এবং ভারি রুকস্যাক যেটা আমার কাঁধের ওপর থেকে ঝোলে এবং যাতে আমার চলতি সংসারের যাবতীয় জিনিস থাকে, সেটা তুলে নিলেন। আমি বিছানাপত্তর গুটিয়ে ভাবছি সাইকেলটা নিয়ে কেমন করে যাব, জিজ্ঞাসা করে জানলাম তার বাড়ি বালিবোডেন প্রায় ১২ মাইল দূরে। আমি বললাম যে সাইকেলে চড়েই যাব, ইচ্ছা করলে তিনি এগোতে পারেন তাঁর মোটরে।

ইতিমধ্যে খবরের কাগজের রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফাররা হাজির। তাদের তাড়াহুড়ো করে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ওয়াই এম সি এ বাড়ির বাইরে গেলাম। বেরিয়েই দেখলাম চার্লির রোলস রয়েস দাঁড়িয়ে আছে। ম্যানেজার তাঁকে এই কথা বলে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন যে চার্লি ওয়াই এম সি এ-র শুভাকাঙক্ষী এবং তরুণদের বন্ধু। এখন বুঝলাম চার্লি মস্ত বড়লোক। আমি রিপোর্টারদের সঙ্গে কথা বলবার সময় চার্লি তাঁর স্ত্রীকে টেলিফোনে জানালেন যে তিনি এক অদ্ভুত জীব নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। কফি টফি ইত্যাদি যেন তৈরি থাকে। পাছে আমি মত বদলাই চার্লি আগে থেকেই তাই হ্যাভারস্যাকটা নিজের গাড়িতে উঠিয়েছিলেন। হাল্কা হয়ে আমি মোটর গাড়ি অনুসরণ করতে আরম্ভ করলাম অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে।

প্রায় একঘণ্টা পরে বালিবোডেন পৌঁছলাম। সুন্দর একটা অ্যাভেনিউয়ের মধ্যে রাস্তা চলে গেছে বাড়ি পর্যন্ত। এক বৃদ্ধা ও তাঁর কন্যা চার্লির সঙ্গে আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। বৃদ্ধা বললেন মেয়ের নাম আইভি। স্ত্রীর নাম গার্টি। দক্ষিণের বারান্দা থেকে খুব সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। দূরে একটা ডেয়ারি ফার্ম। এর মাঝখানে উঁচুনিচু মাঠে গরু চরে বেড়াচ্ছে। ছোট একটা জলাশয় ছিল যাতে কোনও কোনও গরু জল খাচ্ছে— সুন্দর একটা গ্রাম্যদৃশ্য। সেই বারান্দায় পরিচারিকা প্রকাণ্ড ট্রে সাজিয়ে কফি ইত্যাদি নিয়ে এল। কত গল্প হল তার ঠিক নেই। আমার ধর্মমত কী জিজ্ঞাসা করাতে বললাম যে আমি হিন্দু।

অল্পক্ষণের মধ্যে আমাকে গার্টির এত ভালো লাগল যে হঠাৎ বললেন তাঁদের একটি পুত্র ছিল যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারায়। সে ছেলে খুব বীর ছিল এবং অনেকটা আমার মতো লম্বা, রঙের তফাৎ অবশ্যই ছিল। ছেলের কথায় মাতৃ-হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠল। চোখের জল মুছলেন।

কফি খেয়ে চার্লির সঙ্গে এস্টেট দেখতে বেরোলাম। মাঠের ওপারে যে ডেয়ারি ফার্ম দেখা যাচ্ছিল সেটা চার্লির। ডাবলিন শহরে দুধ সাপ্লাই হয় চার্লির ফার্ম থেকে। বড় কারবার। আমাদের দেশি ভাষায় চার্লি একজন শিক্ষিত গোয়ালা। আমাদের দেশের গোয়ালাদের সঙ্গে এদের প্রভেদ এই যে তারা দুধের নামে জল দেয় না। পৃথিবীর অন্যত্র কোথাও দুধের সঙ্গে জল মেশাতে দেখিনি। খাবারে ভেজাল দেওয়া আমাদের বিশেষত্ব!

ডেয়ারি ফার্মে ৫০০ ভালো গরু ছিল। বৈজ্ঞানিক প্রথায় গোপালন হয় যাতে গরুর সুস্বাস্থ্য হয়, অনেকদিন বাঁচে এবং ভালো দুধ দেয়।

ফার্মের লোকেরা কয়েকটা হস্টেল করে থাকে। অপেক্ষাকৃত কম লোকের দ্বারা দুধ দোয়ানো হয় যেহেতু মেশিনে সে কাজ হয়। গরুর সামনে দিয়ে জল ও খাবারের পরিখা কাটা থাকে, যাতে সহজে একসঙ্গে সবাই জল এবং খাবার খেতে পায়। আমাদের দেশে গরুকে পুজো করে কিন্তু তার যত্ন করে না। গোয়াল এবং খাটাল নোংরামির ডিপো। তাই সেখানে দোয়ানো দুধ কীরকম দুষ্ট বীজাণু ভরা তা সহজেই অনুমান করা যায়। ছেলেমেয়েদের অনেক সময়ে নানা রোগ জন্মায় দুধ খাওয়ানোর ফলে।

চার্লি আমাকে নিয়ে ফার্ম দেখতে গেলেন এবং সময় কাটালেন নানারকম সমস্যা ও হিসাবপত্র সামলাতে। বাড়িতে ফিরতেই গার্টি বললেন যে আমার ঘর তিনি নিজে ঠিক করে দিয়েছেন। চার্লির ঘরের কাছেই একটা বড় খুব সুন্দর ঘরে ঢুকে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার হ্যাভারস্যাকের থেকে সব জিনিস বের করে পরিষ্কার করে ঝেড়ে মুছে ঘরের চারদিকে সাজানো। আর সেই সঙ্গে চার্লিদের অফুরন্ত দামি দামি স্ট্যাচুয়েট, কার্পেট ইত্যাদি রাখা ছিল। আমি প্রথমেই মনে মনে খুশি হলাম এই কথা ভেবে যে ওঁরা একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত যুবককে বাড়ির সবচেয়ে ভালো ঘর ছেড়ে দিলেন, তাঁদের খুব কাছেই থাকতে পারব বলে। গেস্টরুমও আছে এবং যথেষ্ট আরামেরও কিন্তু সেটা অনেক দূরে।

বাথরুমে ভালো করে স্নান সেরে লাঞ্চ খেতে গেলাম। চার্লি ও গার্টির মধ্যে কী একটা আলোচনা হচ্ছিল আমাকে নিয়ে। আসলে দুজনে মতলব করছিলেন কী করে আমাকে তাঁরা বেশ কিছুদিন, অন্তত বড়দিন পর্যন্ত এগারোদিন আটকে রাখতে পারেন। আমাকে দেখে দুজনেই হেসে ফেলে মতলবটা স্বীকার করে ফেললেন। প্রত্যেক বছর চার্লি তাঁর ফার্মের লোকেদের এবং আত্মীয়-স্বজনদের বড়দিনে এক বিরাট পার্টি দেন। এবার পার্টির প্রধান আকর্ষণ আমাকে করতে চান। ভ্রমণ সম্বন্ধে আমাকে কিছু বলতে হবে। আমি যদি রাজি না হই তো আমার সাইকেল ছাড়া পাবে না। ইউরোপে প্রথম বড়দিন কাটিয়েছি, ঝড়, বরফ ও অল্প জামাকাপড় নিয়ে শীতের কষ্টের মধ্যে। এবার রাজসূয় যজ্ঞ দেখা যাক। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলাম।

লাঞ্চের সময় আমাকে ওঁরা বিয়ার দিতে চাইলেন কিন্তু আমি ধন্যবাদ দিয়ে ‘না’ বললাম। অসময়ে খাওয়ার জন্য এবং ঠিক মতো খাবারের অভাবে ও উপবাসের জন্যই হয়তো, আমার পেটে মাঝে মাঝে একটা ব্যথা অনুভব করতাম যদিও সেটা এখন খুব কম। আবার ভ্রমণ করতে পারছি বলে আমার মনে ফুর্তি অনেক, যদিও মাঝে মাঝে বন্ধুদের কথা ভেবে মন খারাপ হত। তারাও অনেক সাধ করে, অনেক চেষ্টার ফলে বাড়ি ছেড়েছিল। তারপর কে কোথায় গেলাম তার ঠিক নেই। এটা স্পষ্ট বুঝেই আমি একা চলব ঠিক করেছিলাম যখন দেখলাম সঙ্গে টাকা না থাকলে চারজনের দল মোটেই সফল হতে পারবে না। সাধারণ লোক চারজন ট্যুরিস্টকে হঠাৎ থাকতে, খেতে দিতে পারে না। চারজনের একসঙ্গে চাকরি জোটানোও প্রায় অসম্ভব।

লাঞ্চ খাবার পর চার্লি ও গার্টি বিশ্রাম করতে গেল। আইভি আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেল তার জন্য তৈরি হচ্ছে যে ছোটদের স্কুলবাড়ি, সেটি দেখাতে। এস্টেটের একপ্রান্তে বেশ সুন্দর একটা বাড়ি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। একশো ছোট ছোট ছাত্রছাত্রী আশ-পাশ থেকে এসে সেখানে পড়বে। কোনও মাইনে লাগবে না। টিচাররা সবই বিনাপারিশ্রমিকে কাজ বা পরিশ্রম করবেন, শ্রমদানের মতো।

আইভির স্বামী নিউইয়র্কে একটা বড় আমেরিকান ফার্মে কাজ করে। তার নাম ডীন, বছরে একবার সে ছুটিতে আয়ারল্যান্ডে আসে। তার মা বাবার বেশ বয়স হয়েছে, তাছাড়া বিরাট সম্পত্তির অধিকারিণী বলে আইভিকে ডাবলিনে থাকতে হয় মা বাবার কাছে। আইভি মাঝে মাঝে আমেরিকায় স্বামীর ঘর করতে যায় কিছুদিনের জন্য।

আইভি আমাকে একটা সিগারেট দিয়ে বলল যে অনেকক্ষণ ধোঁয়া না ছেড়ে তার অস্বস্তি লাগছিল। চার্লি সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না। আমি বললাম যে আমিও খাই না, খেলে নিশ্চয় তাকেও খাওয়াতাম। তবে আই শ্যাল কিপ ইউ কোম্পানি’। আইভির আমার সব যাতে ভালো লাগে সে দিকে খুব দৃষ্টি ছিল। একটা বেড়াবার প্রোগ্রাম শেষ হতে না হতে সে আরেকটা তৈরি রাখত।

সন্ধ্যার সময় চারজনে ড্রয়িংরুমে বসে নানারকম গল্প হত। ভারতবর্ষকে জানবার ও সেখানে যাবার ইচ্ছা খুব দুজনেরই, বিশেষ করে গার্টি চায় তাজমহল দেখতে।

আমি বললাম পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে সব কষ্ট সহ্য করেও ভারতবর্ষে তাজমহল দেখতে যাওয়ার সার্থকতা আছে। আমার কোনও ভাষাই তার পার্থিব সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে পারবে না। তিনজনে মিলে ঠিক করল এবার জেমসের ছুটি বাড়িয়ে নিয়ে ইন্ডিয়া ট্যুরে চারজনে মিলে যাবে। আমার দেশে ফিরতে অনেক দেরি সেজন্য আমি ভারতবর্ষে সেই সময় থাকব কিনা তার কোনও স্থিরতা নেই। ইউরোপে সব দেশে দেখতাম তারা বিদেশিকে দেশ দেখার নানারকম প্রলোভন দেখাত। এমনিভাবে ছুটির সময় লক্ষ লক্ষ লোক এদেশ সেদেশ ঘুরে বেড়ায়। আমাদের দেশ এত সুন্দর কিন্তু কোনও সাদর আহ্বানের ব্যবস্থা নেই।

রাত্রে ডিনার মানে ভূরিভোজ। ডিনারের পর আইভি গান গাইল পিয়ানোতে বসে। সবশেষে যখন শুতে যাবে ঠিক তার আগে চার্লি ও গার্টি বলল ‘আমরা শুতে যাবার আগে রোজ একটু প্রার্থনা করি’। আমি ‘তথাস্তু’ বলে চেয়ার থেকে নেমে কার্পেটের ওপর অন্যদের সামিল হয়ে হাঁটুগেড়ে বসলাম এবং নীরব প্রার্থনা হল। এমনই রোজ পাঁচ মিনিটের জন্য হত।

গারট্রুড হচ্ছে গার্টির আসল নাম, সে আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত ধনী পরিবারের মেয়ে। চার্লির অবস্থাও খুব ভালো ছিল, তার ওপর গার্টির অফুরন্ত ধন। চার্লি সাধারণের কাছে লর্ড রাথ ফার্নহাম নামে পরিচিত।

পরদিন গার্টি বসে বসে তার বাপের বাড়ির যত আত্মীয় ও বন্ধু আছে সবাইকে আমার খবর দিল। উদ্দেশ্য হচ্ছে যে আমার বাড়িতে এমন ইন্টেরেস্টিং অতিথি রয়েছে, তোমরা তাকে ডাকছ না কেন?

গার্টির রেকমেন্ডেশনের জোর ছিল। পত্রপাঠ গিনেশ পরিবার ও লর্ড আইভি পরিবারের কাছ থেকে নেমন্তন্ন এল আমার সঙ্গে চার্লি, গার্টি ও আইভির। এ বাড়ি সে বাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে কাটালাম। আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট কসগ্রেভের বাড়ি চার্লির বাড়ির কাছেই। নেমন্তন্ন করলেন পরদিন ব্রেকফাস্ট খাবার। কসগ্রেভ খুব বুদ্ধিমান ও বাস্তবধর্মী লোক, তাই ডি ভ্যালেরার মতো জনপ্রিয় নেতাকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন। একজন ফটোগ্রাফার কসগ্রেভ পরিবারের সঙ্গে আমার ছবি তুলল।

আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধে ফিয়ানা ফেল দলের নেতা, ইমন ডি ভ্যালেরার সঙ্গে দেখা করবার আমার সবচেয়ে বেশি ইচ্ছা ছিল। চার্লি সে সাধটা পূর্ণ করল ডি ভ্যালেরাকে টেলিফোনে আমার কথা বলে। তিনি সাদরে নেমন্তন্ন জানালেন তাঁর বাড়িতে যাবার জন্য। রাজনীতিক্ষেত্রে চার্লি ও ডি ভ্যালেরা বিপরীতপন্থী, তবু দুজনের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্ব ছিল। ইমন ডি ভ্যালেরা হচ্ছেন আয়ারল্যান্ডের বিরাট পুরুষ। দীর্ঘদিন ইংরেজের সঙ্গে লড়ে দেশে স্বাধীনতা আনতে পেরেছেন। সবাই খুব সম্মান করে তাঁকে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু নেতা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা পেতেই হবে এই ছিল ডি ভ্যালেরার একটি মূলমন্ত্র। তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে আন্তরিক শ্রদ্ধার আকর্ষণে আবদ্ধ বলে জানালেন। যারা ভেবেছিল আয়ারল্যান্ডের মতো ছোট দেশ স্বাধীনতা পেলে ডুবে যাবে, তারা দেখল ইংল্যান্ডের সাহায্য না পেয়ে, তার শোষণনীতি থেকে মুক্তি পেয়েই এখন স্বাধীন আয়ারল্যান্ড ভালোভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ডি ভ্যালেরা আমার দেশের সম্বন্ধে নানাবিধ প্রশ্ন করলেন। তারপর আমি সসম্মানে তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিদায় নিলাম। আমাদের দুজনের একটি ছবি তোলা হল লাইব্রেরি ঘরে।

গার্টি আমাকে প্রায়ই বড় দোকানে শপিং করতে নিয়ে যেত এবং নানারকম কৌশলে আমার জন্য উপহার কিনত। আমার ভালো গ্লাভস নেই দেখে একজোড়া দামি চামড়া ও পশমের দস্তানা কিনে নিয়ে এল। সেইসঙ্গে রুমাল, মোজা ও সানগ্লাস। খ্রিস্টমাসের দিন সবাইকে যখন উপহার দেওয়া হবে তখন এগুলি আমি পাব। আমি মুশকিলে পড়লাম, তাহলে আমাকেও দিতে হয় চার্লি পরিবারের তিনজনকে। অত টাকা নেই। ভালো বই তিনজনের উপযুক্ত কিনে রাখলাম।

বড়দিনে ডেয়ারি ফার্মের বড় বার্ন হাউসে, বিপুল সংখ্যক অতিথিদের সমাগম হয়েছিল, প্রায় ৫০-৬০ জন হবে, ‘টার্কি’ ডিনার খাবার জন্য। প্রথমে আইভির গান হল। চার্লি সবাইকে অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রত্যেকের শুভ কামনা করল। একটি ছোট্ট উপাসনা করে বলল, তার বাড়িতে খ্রিস্টমাস এবার বিশেষ অর্থপূর্ণ: ‘বাইবেলে যেমন তিনজন পুবদিক থেকে রেড সী অতিক্রম করে পশ্চিমে এসেছিল, তেমনই আমার বাড়িতে এই অতিথি প্রাচ্য থেকে উপস্থিত হয়েছে।’ এই কথা বলে সে আমার দিকে আঙুল দেখাল। চার্লি আমাকে তার কাছে ডাকল এবং বলল ‘জাস্ট সে এ ফিউ ওয়ার্ডস’ অমনি সবাই হর্ষধ্বনি করে হাততালি দিল। থামবার পর আমি বললাম, আইরিশ আতিথেয়তায় আমি অভিভূত, আয়ারল্যান্ডের মতো আশা করি আমার দেশও স্বাধীনতা লাভ করবে। আবার হর্ষধ্বনি।

পাছে বকর বকর দীর্ঘ হয়ে যায়, তাড়াতাড়ি চার্লি উঠে বলল, বন্ধুগণ! আমি আরেকটা সুখবর দিচ্ছি, দ্য ডিনার ইজ রেডি। দুপুরে টার্কি ডিনার খেয়ে যে যার বাড়ি চলে গেল। আমিও চার্লির বাড়িতে আমার ঘরে গেলাম।

সন্ধ্যায় বসবার ঘরে ‘খ্রিস্টমাস ট্রি’ ভালো করে আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। গাছের ডাল থেকে কয়েকটা জালের মোজা ঝুলছিল, তার ভেতরে বাড়ির লোকেদের জন্য উপহার ছিল। আমি রবীন্দ্রনাথের তিনখানা বই কিনেছিলাম। ইংরিজিতে লেখা গীতাঞ্জলি, দ্য গার্ডনার ও দ্য গোল্ডেন বোট। গার্টি আমাকে গ্লাভস দিয়ে সস্নেহ চুম্বন দিলেন। আমি সবাইকে বই দিলাম। রবীন্দ্রনাথের কোনও বই চার্লির লাইব্রেরিতে দেখিনি।

চার্লি পরিবার সকাল থেকে এক সুরে সাধতে আরম্ভ করেছে যাতে আমি আর এক সপ্তাহ তাদের সঙ্গে থাকি। সেটা সম্ভব নয় অনেক কষ্টে বুঝিয়ে, আমি খ্রিস্টমাসের একদিন পরে রওনা হলাম।

আমার উদ্দেশ্য দক্ষিণে কর্ক বন্দরে যাওয়া। কর্ক শহরের স্বাধীনতাকামী মেয়র ম্যাকসুইনি ৭২ দিন প্রায়োপবেশন করে প্রাণত্যাগ করেন। আমি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে চিঠি লিখে যোগসূত্র স্থাপন করেছিলাম।

মিসেস ম্যাকসুইনি স্বামীর মৃত্যুর পর নিতান্ত নিঃসঙ্গ বোধ করেন। স্বভাবতই তিনি স্বামীর সম্বন্ধে খুব গর্বিত। আমাদের দেশের অনেক নেতার কথা জানেন— বিশেষভাবে সুভাষচন্দ্র বসুর। এই থেকে আমার মনে হয়েছিল যে বোধহয় নেতাজি আয়ারল্যান্ডের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে নিজের একাত্মবোধ জানিয়েছিলেন। মিসেস ম্যাকসুইনির বাড়িতে একরাত কাটিয়ে পরদিন পশ্চিমে গলওয়ে শহরের দিকে রওনা হলাম। শ্যানন নদীর ওপর বাঁধ তৈরি হচ্ছিল, সেটা দেখা আমার উদ্দেশ্য ছিল। সমতল জমির ওপর দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছিল, তার পাশে গভীর খাল কেটে নদীর অধোগতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি হবার পর জল ওপরে উঠিয়ে আবার নদীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। পৃথিবীতে আর কোথাও এমনভাবে (অবশ্য সেদিন পর্যন্ত) বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রণালী ব্যবহার করা হয়নি। এটি জার্মান ইঞ্জিনিয়ারদের কৃতিত্ব।

এক আইরিশ বৃদ্ধার কাছে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে গলওয়ে শহর দেখতে বেরলাম। পুরনো শহর, জরাজীর্ণ অবস্থা। আয়তনে ছোট। সন্ধ্যার পর ক্লান্ত হয়ে রাস্তার ধারে একটা রেস্তোরাঁতে ঢুকলাম। মালিক নিজে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কী খেতে চাই। পরমুহূর্তে বলল, ভালো মাছ, আলুভাজা দিতে পারে। আমি তথাস্তু বলে খবরের কাগজ পড়তে লাগলাম। যথাসময়ে একটা বড় প্লেটভর্তি লেমন সোলমাছ ও আলুভাজা দিয়ে গেল একটি ফুটফুটে মেয়ে, বয়সে ১২-১৪ হবে। হয়তো তার বাবারই রেস্তোরাঁ। আমি হাত ধোবার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলাম ঘরের অন্য প্রান্তে যেখানে বেসিন ও কল ছিল সেইদিকে।

ফিরে এসে দেখি একটা কাণ্ড হচ্ছে। পাঁচ-ছয়টি ছোট ছেলে আমার প্লেটের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সব আলুভাজা কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। আমি যে পিছনে দাঁড়িয়ে সেদিকে কারও খেয়াল নেই। মালিক অপ্রস্তুত হয়ে হা হা করে উঠতে ছেলেরা দুহাতে যা পারল আলুভাজা নিয়ে বেরিয়ে গেল। তারা আমার জন্য মাছভাজাটা অক্ষত অবস্থায় রেখে গিয়েছিল। ব্যাপারটা বোঝবার জন্য মালিককে জিজ্ঞেস করলাম যে ছেলেরা কারা এবং কেন কেবলমাত্র আলুভাজা লুট করে ক্ষান্ত রইল।

মালিক শুকনো মুখ করে আমার দিকে চেয়ে বলল, স্যার, ওরা বড় গরিব। বোধহয় কদিন খেতে পায়নি। আমি এখনই আরেক প্লেট খাবার দিচ্ছি। প্লেটটা সরাবার সময় বলল যে আগে ওরা কখনও এমন করেনি। আমি তখনই রেস্তোরাঁর বাইরে গিয়ে দেখি সবাই ছুটে আরও একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। আমি সবাইকে এক প্লেট করে আলুভাজা দেব প্রতিশ্রুতি দিলাম এবং যা হয়ে গেছে তার জন্য কোনও শাস্তি দেব না বললাম। ছেলেরা আমাকে বিশ্বাস না করে ভাবল যে তাদের ধরবার ফাঁদ পেতেছি বুঝি।

তখন আমি মালিককে বললাম, পাঁচ প্লেট আলুভাজা ছেলেদের জন্য দিতে। মালিক থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার বলতে বলতে রাস্তায় বেরিয়ে গেল এবং ছেলেদের নাম ধরে ডাকল। ছেলেরা অপ্রস্তুত হয়ে ইতস্তত করতে লাগল, তারপর একটি একটি করে রেস্তোরাঁতে এল। মালিক হেসে জানাল যে আমি সবার জন্য টাকা দিয়েছি। পরিষ্কার করে হাত ধুয়ে ছেলেরা এসে আমার নাগালের বাইরে বসল। আমি সবার জন্য ফিস অ্যান্ড চিপস অর্ডার দিলাম। সবাই মহাখুশি, তবু মনে মনে ভয়, পাছে ধরে আমি তাদের শাস্তি দিই। আমাদের জন্য ছয় প্লেট মাছ ও আলুভাজা এল। ছেলেদের মুখে তখন হাসি ধরে না। একসঙ্গে সবাই বলল ভেরি সরি, স্যার। আজ সারাদিন কিছু খেতে পাইনি।

ছেলেদের মলিন বেশ, খালি পা, মুখে কখনও জল সাবান পড়েছে বলে মনে হল না। দুহাত দিয়ে খেতে যাচ্ছিল। মালিক বলল কাঁটা-ছুরি ব্যবহার করতে। একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে ভদ্রলোকের মতো চলতে। স্পষ্টই বোঝা গেল তারা ছুরি-কাঁটাতে অনভ্যস্ত।

এই একটি ঘটনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় আয়ারল্যান্ডের আর্থিক অবস্থা কী, ইংরেজ রাজত্বের শোষণনীতির কী ফল। আশা করি স্বাধীন গণতান্ত্রিক আয়ারল্যান্ডে আবার সুখের দিন ফিরে আসবে।

আইরিশরা গরিব। জগৎজোড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নানারকম কাজ খুঁজে বেড়ায় এখানকার তরুণ-তরুণীরা, অনেকে সৈনিক হয়। মেয়েরা সবচেয়ে বেশি নার্স হয়। লন্ডনে আমার যখন অস্ত্রোপচার হয় তখন একটি আইরিশ নার্স কী পরিমাণ সযতে আমাকে দেখাশোনা করেছিল, তা চিরকাল মনে রাখব।

আইরিশ মেয়েরা দেখতে সুন্দর। আয়ারল্যান্ডের লোকেরা মনে করে যেহেতু তাদের দেশে খুব বৃষ্টি সেজন্য ঘাস ও গাছপালা যেমন চিরসবুজ তেমনই তাদের মেয়েদের ত্বকও সুন্দর ও মসৃণ।

গলওয়ে ছেড়ে আসবার সময় মনে পড়ল যে আমি পশ্চিম ইউরোপের শেষ সীমান্তে পৌঁছেছি। এবার আতলান্তিক মহাসমুদ্র পার হলেই আমেরিকা

আয়ারল্যান্ডের বিশেষ দ্রষ্টব্য, কিলার্নি হ্রদ বেশি দূরে নয়। কিলার্নির কাছে ওই নামে ছোট গ্রাম আছে। সেখানে এক বিপ্লবী, রবার্ট ও সিনের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে আমার আলাপ ছিল। রবার্টের বাড়িতে থাকবার নিমন্ত্রণ জানাল। বাড়িতে মা-বোন ছাড়া আর কেউ ছিল না। রবার্টের বয়স তখন ২৭-২৮। বোন দুবছরের ছোট, একটা স্কুলে পড়ায়। আমার জন্য একটা সাদাসিধে পরিষ্কার ঘর ঠিক হল। রবার্ট সাংবাদিক- আইরিশ হেরল্ড কাগজে লেখে। যা সামান্য রোজগার হয় তাতে কোনওমতে সংসার চলে যায়। সে অবিবাহিত। সারাজীবন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছে। তার কাহিনী শুনে আমার মনে হল আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস শুনছি। বন্দুক বোমা নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়িয়েছে। রবার্টের বান্ধবী ধরা পড়ল, তার ওপর অশেষ অত্যাচার ও পরে তার কারাদণ্ড হল। জেল খাটতে খাটতে দুরারোগ্য যক্ষ্মা ব্যাধিতে সে মারা গেল। যেদিন তার মরদেহ কফিনে ভরে সমাধিস্থ হচ্ছে সেদিন রবার্টও ধরা পড়ল। দুবছর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে তার ওপরে, সহকর্মীদের ধরিয়ে দেবার জন্য। শেষপর্যন্ত তার জয় হয়েছে। কারণ রবার্ট নিজের দেহের ওপর অমানুষিক কষ্ট সহ্য করেছে, তবু বন্ধুদের ধরিয়ে দেয়নি। কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে তার জিদ বজায় রাখার জন্য। রবার্ট স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না, সারাক্ষণ তার অসাড় জিভ দিয়ে লালা পড়ে। তার কথা বুঝতে তাই অসুবিধা হয় কিছুটা। লেখার কাজ ছাড়া তার আর কোনও উপায় ছিল না। সে ডি ভ্যালেরার খুব স্নেহের পাত্র। আমি যখন ডি ভ্যালেরার সঙ্গে আমার ছবি দেখালাম তখন রবার্টের চোখ মুখ আনন্দে ভরে উঠল।

রবার্টের মা খুব সাদাসিধে ডিনার রেঁধেছিলেন। আলুর স্যুপ, রুটি, মাখন, কুমড়ো সিদ্ধ ও আলুভাজা। শেষকালে একটা পুডিং। রবার্ট বলল, তাদের এই ধরনের খাবার নিত্যনৈমিত্তিক। গরিবদের এছাড়া অন্য পন্থা নেই

পরদিন সকালে রবার্ট একটা সাইকেল জোগাড় করে আমার সঙ্গ নিল। আয়ারল্যান্ডে কিলার্নির মতো এত সুন্দর জায়গা আছে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না। সে কী অপরূপ শ্যামসমারোহ। পাহাড়, হ্রদ, গাছপালা, মাঠ মিলে এক স্বপ্নের দেশ মনে হচ্ছিল। আমার কাছে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে রবার্ট প্রস্তাব করল যে কিলানির ওপর একটা আর্টিকেল লিখতে হবে ‘আইরিশ ইন্ডিপেন্ডন্ট’ কাগজের জন্য। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলাম। যা লিখেছিলাম তার থেকে সামান্য উদ্ধৃত করছি। পঞ্চাশ বছর আগের লেখা এখন আবার পড়ে প্রথমেই মনে হল কী রোমান্টিক ছিলাম তখন। প্রকৃতির বর্ণনা দিতে কবিত্ব করেছি তিন কলাম ছাপার অক্ষরে।

আমার ভ্রমণ পথে লোকেরা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেছে আমার সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে কোন জায়গা। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন ছিল যতক্ষণ না রূপসী কিলানির অপরূপ রূপ দেখেছি। আমি কিলানি দেখলাম যেন এক স্বপ্নের রানি, কবির কবিতা, আর্টিস্টের কামনা বাস্তবে রূপায়িত। তার সৌন্দর্য কথার মালা গেঁথে বর্ণনা করা যায় না।

বিস্তীর্ণ হ্রদ ‘লাফলীন’ (লেক অব লার্নিং)-এর কাকচক্ষু জলের ওপর ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ দেখলে মনে হয় হীরের বাক্স খোলা, তার মধ্যে মণিমুক্তখচিত নানা রঙের গহনা। হ্রদের ওপারে আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় (কারান্টিনো হিল) ও তার সাঙ্গপাঙ্গ পাহাড় একটার পর একটা দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রহরীর মতো। এত সবুজ একসঙ্গে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না’। ইত্যাদি।

পরদিন সকালে রবার্ট ও তার বন্ধু ডোনাল্ড এবং আমি সাইকেলে রওনা হলাম ব্লার্নি কাসল দেখবার জন্য। ভারতবর্ষের লোকের কাছে কাসলটি এমন কিছু নয়, তবে একটা কথিকা আয়ারল্যান্ডের সর্বত্র প্রচলিত, সেটা হচ্ছে এই যে কাসলের ওপর কষ্ট করে কেউ যদি একটি কালো কষ্টিপাথর চুম্বন করতে পারে তো সে একজন মনভোলানো বক্তা হতে পারবে। আমি ছাদের ওপর উঠে দেখলাম, যে পাথরটা খুব কঠিন জায়গায় অবস্থিত। খানিকটা ঝুঁকি নিয়ে আমি পাথরে পৌঁছলাম। তারপর আজও ভাবি, কই আমার তো অসাধারণ বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা হয়নি যদিও ‘আই কিসড দ্য ব্লানি স্টোন’।

তিন বন্ধু মিলে আমরা একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলাম। বিকালে বাড়ি পৌঁছে দেখি ‘আইরিশ ইন্ডিপেন্ডন্ট’ কাগজের ফটোগ্রাফার আমার জন্য অপেক্ষা করছে। একটা ছবি তুলে, আর্টিকেলটা লেখার জন্য পঞ্চাশ পাউন্ড চেক দিল।

কাছেই আরেকটা সুন্দর জায়গা আছে নাম গ্যাপ অব ডানলো। সেটা দেখতে গেলাম দুই আইরিশ বন্ধুকে নিয়ে। জায়গাটা সুন্দর কিন্তু চারদিকে রুক্ষ পাহাড়। লেকের কাছে একটা কটেজ দেখলাম। ডোনাল্ড বলল, সেটা কেট কিয়ারনিজ কটেজ। কেট কিয়ারনিকে নিয়ে অনেক কবিতা লেখা আছে। একটা ছোট্ট চার লাইনের কবিতা কটেজের ভেতর ঢুকেই চোখে পড়ল:

‘Old Betty having lived here all her days,
Couldn’t understand the Tourists’ lavish praise.
She thought there was now’t to see,
only the hills, Watter and the trees!

যে তিনটি জিনিস দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় যেমন পাহাড়, জল ও গাছ, তদের ওপর Kate Kearneyর বীতরাগ, Watter কথাটি তারই ব্যবহৃত।

ওসিন পরিবারের কাছে বিদায় নিয়ে ডাবলিনের দিকে ফিরে চললাম, মধ্য আয়ারল্যান্ড দিয়ে। পথে আগা খাঁর ঘোড়া রাখার বিরাট আস্তাবল। সমস্ত রেসের ঘোড়া আয়ারল্যান্ডে রাখার দুটো উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমটা হচ্ছে, ইংল্যান্ডের চেয়ে অনেক কম খরচে ঘোড়া রাখা যায়। দ্বিতীয়ত, আয়ারল্যান্ডে অপেক্ষাকৃত কম ঠান্ডা, সেজন্য ঘোড়ার স্বাস্থ্য ভালো থাকে। আমাদের দেশে মানুষের প্রাণের দাম নেই। কিন্তু একটা ভালো রেসের ঘোড়ার দাম পাশ্চাত্য দেশে বহু লক্ষ টাকা।

ডাবলিনে পৌঁছে গার্টিকে ফোন করে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে জানালাম যে পরদিন আমি ইংল্যান্ডে ফিরে যাব যদি জাহাজ পাই। গার্টি বলল তা তো হবে না। ওর বাড়িতে আমার নামে আইরিশ রেডিওস্টেশন থেকে একটা চিঠি পাঠিয়েছে ভ্রমণ সম্বন্ধে কিছু বলবার জন্য। তিনদিন পরে আমন্ত্রণ। এরকম অর্থোপার্জনের পন্থা ছাড়তে আমি অনিচ্ছুক, তবু গার্টিকে জানালাম যে ডাবলিনে কোনও হোটেলে আমি থাকব। টেলিফোন ইতিমধ্যে হাত বদল হল চার্লির কাছে। চার্লির সঙ্গে তর্ক করা চলে না। আমি আবার চার্লিদের বাড়িতে গেলাম। সে কি অভ্যর্থনা— যেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। চার্লি সবাইকে বিয়ার ও স্যান্ডউইচ খাওয়াল। ঠিক এই সময় ওদের মেয়েও বাড়ি ফিরেছে। সবাই মিলে ভীষণ হৈ চৈ আরম্ভ করে দিল আমাকে ঘিরে। আমার ভালো লাগছিল, তবু ভাবছিলাম কবে নিজের মা বাবা ভাই বোন ও বন্ধুদের কাছে ফিরে গিয়ে এমনই আনন্দ করতে পারব। মনে মনে জানি সেটা অনেক পরের কথা। তাই একটুক্ষণ পরেই ভুলে গেলাম সেসব কথা।

চার্লির এক বৃদ্ধ বন্ধু সেদিন ওইখানে ছিলেন আমাকে দেখবার জন্য। তিনি হঠাৎ বলে বসলেন কিছু বল। সবাই চুপ করে আমার মুখের দিকে তাকাল। অগত্যা আমি আয়ারল্যান্ড ভ্রমণের কথা, কিলার্নির কথা এবং সর্বত্র কীরকম আতিথেয়তা পেয়েছি সেই সম্বন্ধে বললাম। অবশেষে বললাম যে চার্লি ও গার্টির বাড়িতে বালিবোডেনে ফিরে আমার মনে হচ্ছে যেন আমি আমার বাড়িতে ফিরেছি। এই বলার পরই আইভি আমার পাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে বলল আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব্লার্নি পাথরে চুমু খেয়ে পরিব্রাজকের কীরকম মুখ খুলে গিয়েছে। তিনদিন পরে রেডিওতে আবার একবার তার প্রমাণ পাব।

পরদিন চার্লির সঙ্গে ডাবলিনে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল দেখতে গেলাম। প্রথমেই দেখা পেলাম ডাঃ অজয় আচার্য ও ডাঃ প্যাটেলের। একজন ইংরেজ ডাক্তারের সঙ্গে (ডাঃ চ্যাপল) লন্ডনে আরেক ডাক্তার বন্ধুর বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। তারও দেখা পেলাম। ডাঃ চ্যাপল লন্ডনে ফিরে গাইস হসপিটালের সঙ্গে যুক্ত হয় ও পরে ডাক্তার হয় রয়্যাল ফ্যামিলির।

রেডিওতে একটা বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর হল, নজরানা পেলাম ত্রিশ পাউন্ড। আরেক সপ্তাহ পরে যদি একটা এনগেজমেন্ট নিতে চাই ভারতে মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে বলবার জন্য, তা হলে সেই সুযোগ পাব। কিন্তু আমি নারাজ হলাম। বিষয়বস্তু খুব আমার মনোমত হওয়া সত্ত্বে সময়ের অভাব আমাকে গররাজি হতে বাধ্য করল।

এবার স্টিমার ধরে ইংল্যান্ডে ফিরলাম। হলিহেড থেকে লিভারপুল শহরে গেলাম। রাত্রের অন্ধকারে পৌঁছে সালভেশন আর্মির হস্টেলে উঠলাম। ছয় পেনি দিয়ে একটা বিছানাসুদ্ধ খাট ও একটা ছোট আলমারি পেলাম। একটা হলঘরে অনেক বিছানা পর পর সাজানো রয়েছে। বহু লোক বিছানার ওপর শুয়ে বা বসে রয়েছে। সবার মলিন বেশ। গরিব মনে হয়। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। স্নানের সময় যার যা সম্পত্তি আছে অফিসে জমা দিয়ে যায়, চুরি যাওয়ার ভয়ে। এই শহরে ‘ওয়ার্ল্ড জাম্বোরি’ হচ্ছে বয়েস স্কাউটদের। পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে স্কাউটরা এসেছে। আমি ভারতীয় ক্যাম্পে ‘স্যাটা বোস’-এর দলে ভিড়লাম।

লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল আমাকে দেখতে চাইলেন। ক্যাম্পে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হল। একটু পরে লর্ড হাজির হলেন। আমি স্কাউট স্যালুট দিলাম। খুশি হয়ে কাঁধে হাত রাখলেন এবং একটা স্কার্ফ উপহার দিলেন। দুদিন জাম্বোরি ক্যাম্পে কাটিয়ে সোজা চেস্টার শহরে গেলাম। ইতালি থেকে রোমানরা পশ্চিমপ্রান্তে এতদূর অবধি রাজত্ব বিস্তার করেছিল। রাস্তাটাও রোমান যুগের সাক্ষ্য দেয়। বিশেষত্ব হচ্ছে যে রাস্তার দুধারে মাটি ও পাথর দিয়ে তৈরি দেওয়াল। চেস্টার ইংল্যান্ডের পুরনো শহর। সিজারের সৈন্যবাহিনী দুহাজার বছর আগে এ শহর দখল করেছিল।

ইয়র্কের ক্যাথিড্রাল দেখে আমি গেলাম হোয়াইট হল বলে একটা খুব সুন্দর বাড়িতে। ব্যাঙ্কে কাজ করবার সময় এক সহকর্মীকে (ইংরেজ) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে ইংল্যান্ডে এলে তার মা বাবার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করব। সে আমার কথা লিখে মা বাবাকে চিঠি দিয়েছে। হোয়াইট হল বাইরে থেকে পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি বড়লোকের বাড়ি মনে হয়। প্রকাণ্ড বাগানের মাঝখানে বাড়ি। গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় কুকুর চিৎকার করে ছুটে এল আমার দিকে। সেইসঙ্গে সামনের বারান্দায় এক খুব সুশ্রী ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন এবং আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন যে আমি তাঁর ছেলে স্টানের বন্ধু। কুকুর থামিয়ে হাসি হাসি মুখে আমার দিকে এগিয়ে এলেন এবং বললেন, ইউ আর বিমল— দ্য গ্লোব ট্রটার! আমি স্বীকার করলাম। ভদ্রমহিলার নাম লেডি ডানবার, তিনি স্টানের মা। আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন যে তাঁর স্বামী ডনকাস্টারে গেছেন, রেসের ঘোড়ার তদ্বির করতে। সন্ধ্যার সময় ফিরবেন। স্যার লোরেন ডানবার রিটায়ার করবার পর রেসের ঘোড়া নিয়ে মেতে উঠেছেন এবং তাই নিয়ে খুব আনন্দে আছেন। বিশেষ করে সেদিন টেলিফোনে খবর দিলেন স্ত্রীকে যে তাঁর ঘোড়া প্রথম হয়েছে।

লেডি ডানবারের বাটলার এসে আমার হাত থেকে সাইকেল নিল। আমি হ্যাভারস্যাকটা কাঁধের ওপর থেকে নামিয়ে ধরে আছি। স্ট্যানের মা আমাকে সাহায্য করবার জন্য রুকস্যাকের একাংশ ধরতে গেলেন, তারপর আমার যাবতীয় সংসারের ওজন দেখে বললেন বাপরে! এ যে একটা পাথরের মতো ভারি। তুমি কেমন করে এই জগদ্দল পাথর বয়ে বেড়াও। আমি বললাম পৃথিবী ভ্রমণ করতে করতে বোঝা বইতে শিখতে হয়েছে।

প্রশস্ত বসবার ঘরে ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর ধারে চায়ের সাজ-সরঞ্জাম তৈরি। লেডি ডানবার আমাকে সস্নেহে সেদিকে নিয়ে গেলেন। আরেকটি ইংরেজ ভদ্রমহিলা বসেছিলেন। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন যে আমি তাঁর ছেলে স্ট্যানের বন্ধু কলকাতা থেকে আসছি।

চা খেতে বসে নানারকম গল্পগুজব হল। তারপর বাগান দেখতে বেরলাম। নানা দেশ থেকে গাছ ও বীজ সংগ্রহ করে খুব যত্ন করে বাগান সাজানো হয়েছে, দেখবার মতো। প্রায় সন্ধ্যার অন্ধকার হয়ে এসেছে এমন সময় বাড়ির কর্তা, স্যার লোরেন ডানবার উপস্থিত হলেন। আমার দিকে হাসি হাসি মুখে দুহাত বাড়িয়ে এগোলেন। আমি হাত ধরলাম। বললেন ইউ আর দ্য ডেয়ারিং গ্র্যান্ডসন অব নিবারণ! (আমার ঠাকুর্দার ছোট ভাইয়ের নাম নিবারণ মুখার্জি) টেল মি অল এবাউট ইয়োর অ্যাডভেঞ্চারস। মাই সন থিঙ্কস নো এন্ড অব ইউ। ভদ্রমহিলা বাধা দিয়ে বললেন যে সব পরে হবে। এখন চা খাবে চল। যেতে যেতে দুবার শুনলাম, মাই হর্স ওয়ান ফর দ্য ফার্স্ট টাইম দিস আফটার-নুন। ইউ ব্রট আস লাক। আই হোপ উইল স্টে উইথ আস ফর সামটাইম। হোয়াট ডু ইউ সে, মাদার?

স্যার লোরেনের বুড়ো বয়সের একমাত্র পুত্র স্ট্যানলি ডানবার ও আমি একসঙ্গে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কে কাজ করতাম। আমি সেখানে ১৯২৩ সালে যোগ দিই। আমাদের মধ্যে খুব ভাব ছিল। আর এই কারণেই সে অন্যান্য সহকর্মী ইংরেজের কাছে খানিকটা একঘরে, অত্যাচারিত ও অপমানিত হয়েছে। ভারতবর্ষে ভারতীয়দের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা তো দূরের কথা, একটু কাছে টেনে নিয়ে মানুষের যোগ্য সম্মান দিয়ে ব্যবহার করাও সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সমাজে তখনকার দিনে অননুমোদিত ছিল। আমাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটির দিনে যখন স্ট্যানকে দেখা গেল পেলিটি রেস্তোরাঁতে স্যান্ডি খাওয়াচ্ছে তখন শুরু হল তার অমার্জনীয় অন্যায়ের তালিকা। স্ট্যানলির বাবা স্যার লোরেন ডানবার ছিলেন ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার প্রথম গভর্নর। তাঁর সুনাম ও প্রতিপত্তি দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তখনই তাঁর একটু-আধটু দুনা ইংরেজ মহলে ছিল যে তিনি বাঙালি কর্মচারীদের সহানুভূতির চোখে দেখেন। শুনেছি অনেক গরিব কেরানির ছেলেকে পড়াতে তিনি অর্থ সাহায্য করতেন। এসব কথা আমি কলকাতায় থাকতেই শুনেছি তাঁর যুগের লোকেদের কাছে।

এহেন লেকের ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা অথবা প্রতিবাদ করার সাহস কোনও ইংরেজের ছিল না। অথচ স্ট্যানের ব্যবহারে সবাই ক্ষুণ্ণ, যেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন সে অবশ্যাম্ভাবী করে তুলেছে। সাবধান করার পরও যখন অবস্থার কোনও পরিবর্তন হল না তখন তাকে কলকাতা থেকে অর্থাৎ আমার সঙ্গ থেকে অনেক দূরে লখনউতে বদলি করে দেওয়া হল এই কথা বলে, যে হেড অফিসে কাজ পরে শিখলেও চলবে, এখন ব্রাঞ্চ চালানো শিখতে যেতে হবে। তার জন্য অবশ্য স্ট্যানকে প্রমোশন দেওয়া হল।

সে লখনউ পৌঁছেই চিঠির পর চিঠি এবং টেলিগ্রাম পাঠাল। ছুটি নিয়ে অন্তত কিছুদিনের জন্য সেখানে থাকবার অনুরোধ। এই সবের খবর যদি কলকাতার সাহেব মহল জানতে পারত তো আমার চাকরিতে ইস্তফা অনিবার্য হত ও স্ট্যানকে অপদস্থ করা হত নিশ্চয়ই।

যখন একমাসের ছুটি পাওয়া হল, আমি চাঁদনি চকে গিয়ে দুটো ভালো সাদা ট্রাউজার প্রত্যেকটি ৫ টাকা দামে ও দুটো টুইলের শার্ট ২ টাকা ৪০ পয়সা দিয়ে কিনলাম। স্পোর্টসের জন্য হাফপ্যান্ট পরতাম। তাছাড়া মালকোচা দেওয়া ধুতি ও হাফ হাতা টুইলের শার্ট ছিল আমার বেশ।

তৃতীয় শ্রেণীর প্যাসেঞ্জারে আমি লখনউ স্টেশনে পৌঁছে দেখি ছয় ফুট লম্বা, সুদর্শন ইংরেজ যুবক তার ফোর্ড গাড়ি নিয়ে আমাকে খুঁজছে। তখন লখনউয়ের বড় মোগলাই স্টেশন তৈরি হয়নি। ‘লং লস্ট ব্রাদারের’ মতো দুজনে পরস্পরকে দেখে খুব খুশি। গাড়িতে উঠলাম। রয়্যাল হোটেল নামলাম। স্ট্যানের পাশের কামরায় আমার স্থান হয়েছিল। আমি এর আগে দামি হোটেলে কখনও উঠিনি। আমি এইসব খরচের কথা ভাবছি দেখে স্ট্যান বলল যে আমি তার অতিথি, সব খরচের ভার তার। স্ট্যানের সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম একজোড়া কেডস জুতো কেনার জন্য, দাম মাত্র আড়াই টাকা। বিকালে হোটেল সংলগ্ন টেনিস কোর্টে খেললাম যতক্ষণ না সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল। বিশ্রাম করে চা ইত্যাদি খেলাম কোর্টের ধারে, অন্য ইংরেজরা আড়চোখে আমাকে দেখল। ইতিমধ্যে স্ট্যানেরও অনেকটা আক্কেল হয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে মেশা যে তার লখনউ বদলি হবার একমাত্র কারণ সে কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল। ভাগ্যে এখানে তার ওপরওয়ালা কেউ ছিল না তাই আমার জন্য জবাবদিহি করতে হয়নি কারও কাছে।

আমার বয়স তখন ২১। স্ট্যানের বয়স ২০। আমি লখনউ শহরে দ্রষ্টব্যস্থান দেখতে বেরোতাম যখন স্ট্যান যেত ব্যাঙ্কে। ইমামবাড়া ইত্যাদি দেখে আমি মুগ্ধ। স্ট্যানের কাছে গল্প করলাম। সেও আমার সঙ্গে একদিন দেখতে গেল এবং ফিরে এসে বলল যে ভালো লেগেছে এবং আরও জানতে চাইল অযোধ্যার নবাবদের কথা।

সাদেক আলি নামে একজন বড় শিকারির সঙ্গে স্ট্যানের ব্যাঙ্কে আলাপ হয়েছে। আমাদের দুজনকে বাঘ শিকারে অনেকদূর হালডৌনি অঞ্চলে নিয়ে যাবে বলল। শনিবার একটা পরব ছিল। ব্যাঙ্কের ছুটি। শুক্রবার সন্ধ্যায় আমরা তিনজন রওনা হলাম। মাত্র একটি বন্দুক, তবু কারও ভয় নেই, সঙ্গে যখন সাদেক আলি আছে। সারারাত গাড়ি চালিয়ে হিমালয়ের পাদদেশে পাহাড়ি জায়গায় পৌঁছলাম।

পরদিন দুপুরবেলায় নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে চারদিক সার্ভে করল সাদেক আলি। একটা গাছের ওপর আমাদের বসবার ব্যবস্থা হল।

চাঁদনি রাত ছিল। অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম একটা বড় বাঘ আমাদের গাছের সামনে দিয়ে চলেছে। সাদেক গুলি ছুড়ল। বন্দুকের গুলির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে বাঘ প্রচণ্ড লাফ দিল, তারপর অদৃশ্য হল।

পরদিন সূর্যের আলো যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখা গেল, আমরা সারারাত গাছে বসে মশার কামড় খেলাম। বাঘকে জখম করবার পর রাত্রে জঙ্গলে তার খোঁজ করা কিংবা চলাফেরা বিপজ্জনক। পরদিন গ্রামের লোকেরা এল। বন্দুকের শব্দ পেয়েছিল। তারপর খুব সাবধানে বাঘের দেহাবশেষ খুঁজতে বেরলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে একজন গ্রামের লোক দৌড়ে এসে বলল সে বাঘকে একটা ঝোপের কাছে শুয়ে থাকতে দেখেছে।

বাঘ নড়ে না চড়ে না দেখে সাদেক আলি সবাইকে কাছে আসতে বলল। বাঘটা মানুষ-খেকো নয় জেনে আমার আপসোস হচ্ছিল কেন অনর্থক অমন সুন্দর একটা জীবকে হত্যা করা হল। খুব সহজে বাঘ শিকার হল বটে কিন্তু তার পিছনে অধ্যবসায়, অভিজ্ঞতা ও অব্যর্থ বন্দুকের টিপ অনস্বীকার্য।

আলি বাঘের সৎকার করবে বলে গ্রামের লোকেদের সাহায্য চাইল, তারাও হাত লাগাবার জন্য খুব উৎসুক। তাদের কেবলমাত্র দুটি প্রার্থনা, কয়েকটা বাঘের নখ ও বাঘের চর্বি সবটাই দিতে হবে। আলি চামড়া ছাড়াতে বসল। সে বলল স্ট্যানকে চামড়াটা দেবে। সব ব্যবস্থা করতে দুদিন সময় লাগবে। সেজন্য আমরা রওনা হলাম লখনউ ফেরার পথে। স্ট্যানের কাছে আরও তিনদিন থেকে মথুরা, বৃন্দাবন ও হরিদ্বার দেখতে গেলাম। স্ট্যানকে আমার পৃথিবী ভ্রমণের ইচ্ছার কথা জানালাম। সে তখনই বলল যে আমাদের দলে যোগ দেবে। সে তো অনেক পরের কথা। যা হোক বিলেত গেলে তার মা বাবার বাড়িতে থাকতে হবে।

স্যার লোরেনের ইচ্ছায় সে রাত্রের ডিনারের নাম দেওয়া হল বেঙ্গল ডিনার এবং মুরগির কারি, পাঁপড় ভাজা, আমের চাটনি ইত্যাদি দিয়ে খুব মুখরোচক ভোজনের ব্যবস্থা হয়েছিল। হোয়াইট হল নাকি বেঙ্গল ডিনারের জন্য প্রসিদ্ধ, কর্তা গিনি দুজনেরই খুব তারিফ করে খেলেন, সেইসঙ্গে আমিও। তারপর ছেলে সম্বন্ধে নানারকম প্রশ্ন করে সব খবর জানতে চাইলেন। লেডি ডানবারের বাবা ইংরেজ কিন্তু মা বর্মার রাজপরিবারের একজন বর্মী রাজকন্যা। মিশ্র বিবাহের ফলে সাধারণত ছেলেমেয়েরা সুশ্রী ও সুন্দর দেখতে হয়। বাবা ইংরেজ হওয়ার ফলে লেডি ডানবার বেশ লম্বা ও মার দিকে পেয়েছেন সৌম্যকান্তি। আমাকে গৃহিণী যখন বললেন যে তিনিও আমার মতো ভারতীয়, আমি তাঁর মুখের ও অবয়বের দিকে চেয়ে দেখলাম কোথাও ভারতীয় গন্ধ আছে কিনা! তখন বললেন যে তিনি যখন জন্মান তখন বর্মা ভারতবর্ষেরই অংশ, আর সেই হিসাবে তিনি ভারতীয় এবং বর্মীয়। একদিন থিব পরিবারের সঙ্গে নিকট আত্মীয়তার বন্ধন তাঁর মায়ের ছিল।

পরদিন সকালে স্যার লোরেন বললেন যে তিনি কয়েকটি পরিবারকে ডিনারে নেমন্তন্ন করেছেন, আমার সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। অর্থাৎ সেদিনও আমার রওনা স্থগিত রইল।

বিকালে স্বামী-স্ত্রী আমাকে নিয়ে মোটরে বেরলেন ইয়র্ক ক্যাথিড্রাল দেখবার জন্য, তারপর লেমিংটন স্পা দেখতে গেলাম। আমাদের দেশে বক্রেশ্বর বা রাজগীরের মতো। গরম জলের স্প্রিং আছে, সে জল গন্ধকমিশ্রিত, সেজন্য নানারকম বাতজাতীয় রোগের পক্ষে খুব উপকারী।

ইয়র্কের একটা দোকানে গাড়ি থামল। লেডি ডানবার আমার জন্য খুব সুন্দর একটা পশমের স্কার্ফ কিনে আনলেন। আমি অনেক ধন্যবাদ দিয়ে নিলাম। বাড়ি ফিরে স্ট্যানকে আমরা তিনজনে মিলে একটা চিঠি লিখলাম। সে সেই সময় দিল্লিতে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের শাখাতে কাজ করে।

রাত্রে বাড়ি আলোয় আলো। ছটি মাঝবয়সী স্বামী-স্ত্রী ডিনার খেতে এলেন। খাবার শুরু হবার আগে স্যার লোরেন আমার বড় করে পরিচয় দিলেন। এরপর আমার পালা। আমি সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে ডানবারদের আতিথেয়তার কথা বললাম। কেমন করে তাঁদের সঙ্গে আমার জানাশোনা হল। এরপর তারা ভ্রমণকাহিনী শুনতে চাইল। ডিনার আমার মাথায় উঠে গেল। এই অবস্থায় আমি দেখেছি যে আমার ভাগ্যে খাওয়া হয় না। কথা বলতেই সময় কেটে যায়। যাহোক আমি শুরু থেকে ইয়র্ক পর্যন্ত মোটামুটি একটা ইতিবৃত্ত দিলাম। পরে প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হল। এর ফাঁকে ফাঁকে কিছু খেয়ে নিলাম। খুব ভালো খাস ইংরিজি ডিনার হয়েছিল। ভ্রমণকাহিনী শুনে মনে হল সবাই খুশি এবং ডানবারদের সঙ্গে একমত যে আজকালকার ভারতীয়রা, বিশেষ করে বাঙালিরা খুব সাহসের পরিচয় দিচ্ছে।

আমি আমার নির্দিষ্ট ঘরে শুতে যাচ্ছি এমন সময় দেখি লেডি ডানবার এক কাপ ওভালটিন ও একটা আপেল আমার বিছানার পাশে টেবিলের ওপর রেখে বেরিয়ে আসছেন। আমাকে সামনে দেখে বললেন তুমি তো ডিনার খাবার সুযোগ পাওনি তাই খিদে পাবে। সেজন্য কিছু খাবার রাখলাম। আমাকে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন আমি আরও দুদিন থাকতে পারি কি তাঁদের বাড়িতে? আমি না বলাতে তিনি দুঃখিত হয়ে বললেন, আচ্ছা কাল দেখা যাবে।

স্ট্যানের মাকে দুঃখ দিয়ে আমার খারাপ লেগেছিল, তাই প্রাতরাশ খাবার টেবিলে পরদিন আমি বললাম ইউ উইন, আই স্টে ফর টু মোর ডেজ। আনন্দে ভদ্রমহিলা দুই হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। পরদিন রাত্রে বারোজন বন্ধুর নেমন্তন্ন হল। আমি গল্পচ্ছলে ধীরে-সুস্থে খেতে খেতে আমার ভ্রমণকাহিনী সেদিনও বললাম। প্রশ্নোত্তরের সময় মহিলা অতিথিরা প্রায় একবাক্যে জিজ্ঞাসা করলেন আমি বিয়ে করেছি কিনা, আমার কত বয়স এবং আমার মা বাবা আছেন কিনা। আরও কত প্রশ্ন হল মজার মজার।

সবাই আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। ডিনার পার্টি শেষ হল। স্ট্যানের মা বললেন উই আর ভেরি প্রাউড অব ইউ বিমল, অ্যান্ড উই হ্যাভ বিকাম ফন্ড অব ইউ ইন সাচ এ শর্টটাইম। আমিও তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা করে শুতে গেলাম।

দুদিন পরে সকাল নটার সময় আমি লাউঞ্জ স্যুট ছেড়ে ধড়াচুড়ো ও টপবুট পরলাম। তারপর প্রথমে লেডি ডানবারের সঙ্গে করমর্দন করতে গেলাম তিনি হাত ধরে সস্নেহে কাছে টেনে বললেন আমি স্ট্যানকে তোমার মধ্যে পেয়েছিলাম। দেশে ফিরে যেন তোমাদের বন্ধুত্ব প্রগাঢ় ও সার্থক হয়

স্যার লোরেন আমার দুই হাত ধরে বললেন গড ব্লেস ইউ। তারপর একটা কাণ্ড করে বসলেন। আমার হাতের মধ্যে দুটো দশ পাউন্ডের নোট গুঁজে দিলেন।

হাতের মুঠো খুলে যখন দেখলাম টাকা, তখন আমার রক্ত গরম হয়ে উঠল, আমি অপমানিত বোধ করলাম। ধারণাটা হয়তো আমার সম্পূর্ণ ভুল কিন্তু তখন তাই মনে হয়েছিল। আমি ভাবতাম কখনও কারও দয়ার প্রার্থী হব না। একটা দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় খেলে গেল। বাটলার আমার কাঁধে যখন হ্যাভারস্যাক তুলে দিল আমি করমর্দন করে থ্যাঙ্কস বললাম ও একটা দশ পাউন্ডের নোট তার হাতে গুঁজে দিলাম। মেড একটা স্যান্ডউইচের প্যাকেট নিয়ে এগিয়ে এল। আমিও থ্যাঙ্কস দিয়ে সেটা নিলাম এবং বাকি দশ পাউন্ডের নোট তার হাতে গুঁজে দিলাম। বাটলার ও মেড আমার বদান্যতায় অভিভূত। হাতের মুঠো খুলে দুজনেই প্রায় একসঙ্গে দেখল যে দুখানা বড় নোট। আমার মান-অপমান জ্ঞানটা হয়তো একটু বেশি টনটনে। পরে অনেকবার মনে হয়েছে যে স্যার লোরেন আমার সঙ্গে যে রকম আত্মীয়ের মতো প্রথম থেকে ব্যবহার করেছেন তাতে তাঁর মনে সদিচ্ছাই ছিল অপমানের চিন্তা ছিল না। ভেবেছিলেন টাকা দিলে কত সময় কত কাজে লাগবে। যা হোক আমার ব্যবহারে স্যার লোরেন মর্মাহত হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। আমি বাটলারকে সাইকেলটা একবার ধরতে দিয়ে বললাম প্লিজ ফরগিভ মি। আই ডু নট অ্যাকসেপ্ট মানি ফ্রম এনি ওয়ান আনলেস আই আর্ন ইট। স্যার লোরেন একটু হেসে বললেন, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইউ অল রাইট অ্যান্ড আই এডমায়ার ইউ অল দি মোর। আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

ইয়র্কে থাকতে বি এস এ-র কর্ণধার কমান্ডার হার্বাটের সঙ্গে টেলিফোনে জানালাম যে দুয়েকদিন পরে বার্মিংহাম পৌঁছব। বার্মিংহাম মেল খুব পাবলিসিটি করেছিল। আমি শহরের প্রান্তে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে খবর পেলাম যে লর্ড মেয়র আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। সিটি হলে মেয়রের সঙ্গে দেখা করলাম। খবরের কাগজের রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফার উপস্থিত ছিল সেখানে। অনেক গণ্যমান্য লোক ও ভারতীয়দের মধ্যে ডাঃ পার্ডি হাজির ছিলেন। লর্ড মেয়র একটা স্পিচ দিলেন এবং আমার সাহস ও কষ্টসহিষ্ণুতার প্রশংসা করলেন। বার্মিংহাম শহরে লোকেদের তরফ থেকে তিনি তিনদিনের জন্য কুইন্স হোটেলে থাকবার নিমন্ত্রণ জানালেন। আমার সেখানে থাকা হল না কারণ ডাঃ ও মিসেস পার্ডি আগেই আমাকে তাঁদের বাড়িতে থাকবার জন্য বলেছিলেন।

সিটি হল থেকে বি এস এ-র অফিস ও কারখানায় গেলাম। কমান্ডার হাবার্ট মস্ত রিসেপশনের বন্দোবস্ত করেছিলেন। অফিসের সমস্ত পদস্থ কর্মচারী কমান্ডারের ঘরে উপস্থিত। একটা ককটেল পার্টি হল। আগেই বলেছি কমান্ডার হাবার্ট বি এস এ কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আমরা যখন কলকাতায় টাউন হল থেকে তিন বছর আগে যাত্রা শুরু করি, কমান্ডার হাবার্ট উপহার হিসাবে আমাদের চারজনকে চারখানা সাইকেল দিয়েছিলেন।

সেদিনের লোকের ভিড়, উৎসাহ ও মিঃ জে এম সেনগুপ্তের বক্তৃতা তিনি ভোলেননি। ককটেল পার্টিতে সেই কথা উল্লেখ করে বললেন, মানুষ ও মেশিন দুই- ই সব বাধা বিপত্তির ঊর্ধ্বে উঠেছে। সেদিন কলকাতায় আমি নিশ্চিত জানতাম যে বি এস এ সহজে হার স্বীকার করবে না। কিন্তু তখন আমার মনে সন্দেহ জেগেছিল যে চারজন আরোহী শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকবে কিনা। মরুভূমির অসহ্য গরম এবং আল্পসের ওপর বরফের ঝড়ে অসহ্য শীত কেমন করে সহ্য করবে ভেবে ঠিক করতে পারিনি, বিশেষ করে যখন শুনলাম যে কারও কাছে একটা পয়সাও নেই।

আজ আমরা সবাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছি মিঃ মুখার্জিকে যাতে তিনি সফলকাম হন এবং সুস্থ দেহে বাড়িতে ফিরতে পারেন। তিনি একটা চিঠি খুলে সবার জন্য পড়লেন। তাতে ওয়াকার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি জানিয়েছিলেন যে তাঁরা আমাকে ও সমস্ত অফিসারদের নেমন্তন্ন করেছেন কর্মচারীদের সঙ্গে ক্যান্টিনে লাঞ্চ খাবার জন্য। কমান্ডার হাবার্টও নিমন্ত্রিত। লাঞ্চ খাবার সময় একঘণ্টা বেশি ছুটি দেবার অনুরোধ সেই চিঠিতে ছিল। সেদিন বিকালে একঘণ্টা বেশি পরিশ্রম করে তারা তা পুষিয়ে দেবে জানিয়েছেন।

বিরাট ক্যান্টিনের হল, তার একপাশে একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে, চার- পাঁচজন লোক বসবার উপযুক্ত।

খুব উত্তেজনা ও উৎসাহের সঙ্গে মিটিং হল। ইতিমধ্যে আমার সাইকেলের নম্বর থেকে বি এস এ-র লোকেরা বের করে ফেলেছে কোন শ্রমিক সেটা ১৯২৬ সালে অ্যাসেম্বল করেছে। তাকে প্ল্যাটফর্মের ওপর আসতে বলা হল। একজন খুব লাজুক যুবক এল আমার কাছে। সবার দিকে তার মুখ ফিরিয়ে দিয়ে আমি বললাম যে সবাই আমাকে বাহাদুরি দিচ্ছে কিন্তু যে লোকটি সেটা সম্ভব করেছে সে এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি চাই তোমরা তারও যোগ্যতা স্বীকার কর। বলার সঙ্গে সঙ্গে তিন হাজার শ্রমিক একসুরে কাম অন পিটার বলে উঠল। অনেক হাততালি এবং শেষকালে বলল থ্রি চিয়ার্স ফর গ্লোব ট্রটার মুখার্জি, থ্রি চিয়ার্স ফর কমান্ডার হাবার্ট, অ্যান্ড থ্রি চিয়ার্স ফর পিটার। হল ফেটে পড়ল হিপ হিপ হুড়রে ধ্বনিতে। সবাই যখন থামল তখন আমি চিৎকার করে বললাম, থ্রি চিয়ার্স ফর বি এস এ বাইসাইকেল। আরেকবার হাততালি ও হিপ হিপ হুড়রে হর্ষধ্বনি হল।

লাঞ্চ ছিল খুব সাধারণ সাদাসিধে ব্যাপার, লিভার অ্যান্ড কিডনি পাই ও পরে প্রুনশ ইন সিরাপ। আর চা যে যত চায়।

সন্ধ্যাবেলায় কমান্ডার হার্বাটের বাড়ি এবং শেলি ওকে বহু লোক নিমন্ত্ৰিত হয়েছিল ককটেল খাবার ও আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য। সেখানে মিঃ হ্যারিসন নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি ডানলপ রাবার কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। যেহেতু আমি ডানলপ টায়ার ব্যবহার করেছি, তাই তিনি তাঁদের কারখানায় যাবার নিমন্ত্রণ করলেন পরদিন। কমান্ডার হার্বাটের বাড়িতে সাইকেল ব্যবসায়ের বহু লোকের সঙ্গে আলাপ হল। সেখানে বিরাট ডিনারের ব্যবস্থা হয়েছিল। সবাই আমার কাছে ভ্রমণকাহিনী শুনতে চাইল। আমি যথাসাধ্য বকবক করলাম। আর তারপর হর্ষধ্বনি ও হাততালি। আমি বললাম সে সবই কমান্ডার হার্বাটের প্রাপ্য।

খুব ঘটা করে আমার বি এস এ সাইকেলটা শহর প্রদক্ষিণ করবে এই ব্যবস্থা হয়েছিল। আমারও গাড়ির সঙ্গে থাকার কথা কিন্তু আমি নারাজ বলে গেলাম না।

বার্মিংহাম শহরের উপকণ্ঠে বর্নভিল নামে খুব সুন্দর জায়গায় ক্যাডবেরিজ চকোলেটের কারখানা আছে। ক্যাডবেরি কোম্পানির অফিস থেকে নেমন্তন্ন পেলাম কারখানা দেখবার। তার কর্ণধার, হোরেস আলেকজান্ডার যিনি পরে স্যার হোরেস হন, ক্যাডবেরি পরিবারের একজন বিশিষ্ট লোক ও পার্টনার। দুঃখের বিষয় সেদিন বিশ্বশান্তির ব্যাপারে তিনি জেনেভায় একটি মিটিংয়ে গিয়েছিলেন,তাই আমার সঙ্গে আলাপ হল না। কোয়েকার সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্যাডবেরি পরিবারের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

স্যার হোরেস আলেকজান্ডারের নাম সব ভারতীয়দের কাছে স্মরণীয় দুটি কারণে, প্রথম হচ্ছে তিনি ভারতবর্ষে বসবাস করতে আসেন এবং কলকাতায় ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। গান্ধীজি স্যার হোরেসের ব্যবহারে আকৃষ্ট হন, যার ফলে স্যার হোরেস আলেকজান্ডার গান্ধীজির অনুবর্তী হন। বিদেশি, যাঁরা গান্ধীজির সঙ্গ কামনা করে তাঁর সঙ্গে মিলেছিলেন তাঁদের মধ্যে স্যার হোরেস অন্যতম।

আমি ক্যাডবেরির কারখানা দেখে যখন বেরিয়ে আসছি তখন আমার হাতে মস্ত বড় এক বাক্স চকোলেট দিয়ে গেল একটি সুন্দরী তরুণী, আর সেইসঙ্গে কনগ্র্যাচুলেশনস বলে করমর্দন করল।

সন্ধ্যাবেলায় ইন্টারন্যাশনাল হাউস, শেলী ওকে নেমন্তন্ন ছিল। এটি একটি নানান দেশীয় ছাত্রাবাস। তারা সবাই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পড়াশোনা করত। খুব হৃদ্যতার সঙ্গে আমাকে ছাত্র-ছাত্রীরা গ্রহণ করল। আলাপ হল অনেকের সঙ্গে। চা-বিস্কুট খাওয়াল সেদিনের আলোচ্য বিষয় ছিল স্টুডেন্ট লাইফ ইন ইন্ডিয়া। আমি যথাসাধ্য ভারতবর্ষে ছাত্রজীবনের কথা পুরাকালে যেমন ছিল অর্থাৎ টোলে পড়া, ব্রহ্মচর্যাশ্রম, নালন্দা থেকে বর্তমান যুগের (বিশ শতকের) স্কুল-কলেজ পর্যন্ত বললাম। সেই সময় পর্যন্ত স্ত্রীশিক্ষা আজকের দিনের মতো প্রসার লাভ করেনি। কলেজে পড়া মেয়ের সংখ্যা তখন প্রায় এক হাতে গুনে ফেলা যেত। আজকাল যেমন মনে হয় ঠিক তার উল্টো। মেয়েরাই পড়াশোনা করে আগ্রহের সঙ্গে, ছেলেরা সিনেমা, পলিটিক্স, খেলাধুলা, মারপিট নিয়েই ব্যস্ত, পড়ার সময় কোথায়?

আমার ভ্রমণ সম্বন্ধে অনেকে উৎসাহী হয়ে প্রশ্ন করল, বিশেষ করে বার্মিংহাম মেল কাগজে আমার সচিত্র ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়ে। অনেকক্ষণ ধরে নানা বিষয়ে আলোচনা হল।

ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে ডিনার খাবার পর ফিল্ম স্লাইড দিয়ে আমার তোলা ভারতবর্ষের মন্দির, স্থাপত্য সম্বন্ধে ছবি দেখালাম। মনে হল সবাই ভারতবর্ষের গৌরবময় অতীতের ছবি দেখে মুগ্ধ। আমাদের দেশের সম্বন্ধে এদের ধারণা এতই কম যে সেদিক থেকে আমাদের অবস্থা প্রায় আফ্রিকার টাঙ্গানিকা কিংবা উগান্ডার সামিল।

কথাবার্তা বলতে এত দেরি হয়ে গেল যে আমি তাড়াতাড়ি পাততাড়ি গুটোবার চেষ্টা করছিলাম। ছেলেমেয়েরা নাছোড়বান্দা, তারা বলল যে রাত্রিবাস হস্টেলে করার ব্যবস্থা হয়েছে। পরদিন প্রাতরাশের পর ছুটি পাব। আমি রাজি হলাম এক শর্তে যে আমার পরে, নানা দেশের ছেলেমেয়েরা গান গেয়ে বা নেচে তাদের দেশের পরিচয় দেবে।

জার্মান, ফরাসি, আফ্রিকান (বান্টু), নরওয়েজিয়ান ও সুইডিশ ভাষার অনেক গান হল। বান্টু ছেলেটি আফ্রিকার গোল্ডকাস্ট-নিবাসী। তার যেমন গলা তেমনই গাইবার ক্ষমতা।

রাত দশটার পর নাচ আরম্ভ হল। অনেকের সঙ্গে নাচলাম। আগে নাচের নামে আমার গায়ে জ্বর আসত। কেবল মনে হত যদি পা মাড়িয়ে ফেলি, এখন সে অবস্থা কেটে গেছে, রীতিমতো উপভোগ করতে শিখেছি। রাত দুটো পর্যন্ত নাচ গান হল। ভাগ্যে সেদিন শনিবার ছিল। আমার কোনও কাজ ছিল না পরদিন। দুশো পরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমি একমাত্র ভারতীয়। আমার এত খাতির এবং জনপ্রিয়তায় ভালোই লাগছিল মনে মনে

রবিবার প্রাতরাশ খেয়ে ইন্টারন্যাশনাল হাউসের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম।

বার্মিংহামে ফিরে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি একজন বিখ্যাত সাইকেল সিট প্রস্তুতকারক, ব্রুকসের পার্টনার, মিঃ মিড তাঁর নাম। বাড়িতে চায়ের ও রাত্রে ডিনারের অনুরোধ এড়ানো গেল না। বিকালে মিডের বাড়ি উপস্থিত হলাম। একটি ছোটখাটো পার্টি হচ্ছিল। সবাই অভ্যর্থনা জানিয়ে আমাকে তাদের মাঝখানে বসাল, তারপর চায়ের সঙ্গে যথারীতি প্রশ্নোত্তর হল। অ্যাডভেঞ্চার সম্বন্ধে সবাই জানতে উৎসুক।

চায়ের পর অতিথিরা একে একে বিদায় নিল। মিডদের বাড়ির সংলগ্ন বাগানে একটু বেড়াতে গেলাম, একমাত্র কন্যা মিস আইরীনি মিডের উৎসাহে। সুন্দর সাজানো বড়লোকের বাগান, দেখলেই মনে হয় যেন পৃথিবীর সবরকম ফুল ও রঙের সমাবেশ সেখানে হয়েছে।

ডিনার খাবার পর বাড়ি যাব ভাবছি এমন সময় আইরীনি তার মা বাবাকে বলল সে আমাকে নিয়ে ডান্সে যাবে। মিঃ মিড বললেন বেশ তো। গাড়ি নিয়ে যাও। মিসেস মিড বললেন, আইরীনি একা বাড়ি ফিরবে সেটা কি ভালো হবে। আমি তখন বললাম যে বাড়িতে পৌঁছে আমি ট্যাক্সি করে ফিরে যাব। সেই কথাই রইল। আইরানি গাড়ি আনতে গেল। যতদূর সম্ভব মিসেস মিডকে আশ্বস্ত করে গাড়িতে উঠলাম। আধুনিকা আইরীনি প্রথমেই আমাকে নাম ধরে ডেকে তার পাশে বসতে বলল। সে কিছু বলতে চায় মনে হল। একটা ডান্স হলে গিয়ে গাড়ি থামল। দু-চারবার নাচবার পর আইরীনি অনেকটা সহজ ও শান্তভাবে একটা টেবিলে বসল এবং গল্প জুড়ে দিল। বেশিরভাগ প্রশ্ন আমার সম্বন্ধে, আমি বিয়ে করেছি কিনা। আইরীনির ধারণা আমি এই ভ্রমণ শেষ করবার আগে মৃত্যুর কবলে পড়ব। আমি যে বেঁচে আছি সেটা অশেষ সুকৃতির ফল। চিরকাল যে আমার সৌভাগ্য অটুট থাকবে এ কথা কে বলতে পারে।

আমি ঠাট্টা করে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কী করতে বল শুনি একবার? আইরীনি উৎসাহিত হয়ে বলল যে আর বিপদের মধ্যে জেনেশুনে যেও না। তখন ঠাট্টা চালিয়ে বললাম তারপর? আইরীনি আমার হাত ধরে বলল, আমাকে সঙ্গে নাও। বিপদের সম্ভাবনা কমে যাবে। আমার টাকার অভাব নেই।

উত্তর শুনে এবং আইরীনির মিনতিভরা মুখের দিকে চেয়ে আমি ঠাট্টা ভুলে তখন চমকে উঠেছি। এত অল্প আলাপে কোনও শিক্ষিত মেয়ে তার জীবনের একটা কঠিন সমস্যা এত সহজে নিষ্পত্তি করতে পারবে আমি কল্পনাও করিনি, ভাবা তো দূরের কথা। আমি বললাম, পৃথিবী ভ্রমণ আমাকে শেষ করতেই হবে। ইট ইজ সো ভেরি ইম্পর্টেন্ট টু মি। আমি কথা দিচ্ছি যে জেনেশুনে বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ব না। অনেক অনুরোধেও যখন কোনও ফল হল না, তখন আইরীনি হাল ছাড়ল। নাচবার জন্য আইরীনিকে যখন টানলাম, দেখলাম তখন সে আনমনা। অবস্থাটা হাল্কা করবার জন্য আইরীনিকে তার নিজের কথা বলতে বললাম। সে স্কুলের ও কলেজের কথা এবং দুজন মেয়ে বন্ধুর কথা বলল। একজন বন্ধু মার্গারেটের সম্প্রতি বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে বন্ধু নেই। ছেলে বন্ধু চায় না, ছেলেরা মিথ্যা ব্যবহার করে বলে। আমি যে ছেলে সে কথা মনে করিয়ে দিলাম। আইরীনি বলল যে ইন্ডিয়ানস আর নট লাইক দ্যাট। আমি চা খাবার সময় সমবেত লোকেদের যখন অ্যাডভেঞ্চার সম্বন্ধে বলছিলাম আইরীনি নাকি ঠিক করেছিল আমাকে মরতে দেবে না। আমি ভাবলাম নিশ্চয় মনস্তাত্ত্বিকরা বলতে পারবেন আইরীনি কেন অমন মনস্থ করেছিল।

আইরীনিকে বাড়ি পৌঁছে দেবার পথে কয়েকবার শুনলাম যে সে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে, একথা আমি যেন না ভুলে যাই। ইনফ্যাটুয়েশন কাকে বলে আমি প্রত্যক্ষ করলাম। আইরীনির জন্য দুঃখিত বোধ করা ছাড়া আর বেশি কিছু করবার ক্ষমতা আমার ছিল না। সে কিন্তু সিরিয়াস।

বিছানায় শুয়ে অনেক রাত্তির পর্যন্ত আইরীনির কথা ভাবলাম আর মনে মনে বললাম, এমন অপাত্রে কেন কোনও মেয়ে ‘রসস্য নিবেদনং’ করতে গেল।

আইরীনিকে আমার কোনও ঠিকানা দিতে পারলাম না, নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল না। তার ঠিকানা আমি নিলাম কিন্তু মনে মনে জানতাম যে আমি চিঠি লিখে কোনওদিন ভাবপ্রবণ সুন্দর তরুণীর জীবন আর ঘোলা করে দেব না।

পরদিন সকালবেলায় তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা হলাম। সারাদিন সাইকেলে মিডল্যান্ডসের উঁচু-নিচু রাস্তা পার হয়ে অক্সফোর্ডে পৌঁছলাম। ইংল্যান্ড দেশটা খুবই সুন্দর যদি বৃষ্টি না হয়। মনে হয় সমস্ত দেশ সবুজ কার্পেটে মোড়া। অক্সফোর্ডে সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের একটা হস্টেলে উঠলাম। ঘর বলতে ছোট ছোট কিউবিকল, চারদিকে মাথা পর্যন্ত হাল্কা কাঠের দেওয়াল। একরাত থাকতে মাত্র এক শিলিং লাগে। অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারদের এই সুবিধা দেওয়া হয়। আমাকে অনেকদিন আগে সভ্য করা হয়েছিল। তখন সমস্ত অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালিত হোটেলের তালিকা আমাকে দিয়েছিল এবং সেইসঙ্গে একটা চিঠিতে সর্বত্র আমাকে সবরকম সুবিধাসমেত থাকতে দেবার অনুরোধ ছিল।

অক্সফোর্ড শহরের ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে, শত শত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত কলেজ সব দেখতে বেরলাম। বহু কলেজের ছবি তুলে একটা সিরিজ করলাম, স্লাইডে দেখাবার মতলবে। এখানে অনেক লোকের বাস, মরিসের কারখানার জন্য।

বেশ কিছুদিন অক্সফোর্ডে কাটালাম। এ জায়গাটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। ইফলি খেলার মাঠ শহরের মধ্যে। প্রায়ই খেলা দেখতে যেতাম। আইসিস নদীতে ছেলেমেয়েরা রোয়িং, পান্টিং, কেনোয়িং ইত্যাদি নানারকম বোট নিয়ে দাঁড় বাইবার খেলায় ব্যস্ত। নদী খুব অপরিসর, নালা বললেই চলে। পরিষ্কার জল, টেমস নদীতে গিয়ে মিলেছে।

অক্সফোর্ড ছেড়ে হাই ওয়াইকম্বের পথে লন্ডনের দিকে রওনা হলাম। ওয়াইকম্বে এসে দেখি রাস্তায় ভিড়। বিখ্যাত আমেরিকান বক্সিং ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন, জিন টানে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে চার্চ থেকে বেরচ্ছে। আমি টানেকে কনগ্র্যাচুলেশনস জানালাম। টানে যেমন স্বাস্থ্যবান ও সুপুরুষ, তার ব্যবহারও তেমনই অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক। সবাই টাকার লোভেই বক্সিং করে যায় যতদিন সামর্থ্য থাকে, টানেই একমাত্র ব্যতিক্রম। সে শ্রেষ্ঠ মুষ্ঠিযোদ্ধার আসন যেদিন অধিকার করল, তার কদিন পরে বক্সিং থেকে বিদায় নিল। মাঝে মাঝে কাগজে পড়ি যে টানে ব্যবসা করে খুব লাভবান হয়েছে এবং সুখে ও সম্মানের সঙ্গে ঘর সংসার করছে।

লন্ডনে ফিরলাম। গোল্ডার্স গ্রিনে উডল্যান্ডসে তুষার রায়ের বাড়িতে উঠলাম। আবার ব্যাঙ্কের কাজ ও পড়াশোনা খুব মন দিয়ে করতে লাগলাম।

যথাসময়ে AI B London পরীক্ষা দিলাম এবং আশাতীত ভালো ফল পেলাম। সারাজীবন তো পৃথিবী ভ্রমণ করে কাটাতে পারব না। ভবিষ্যতে একদিন স্থায়ীভাবে কোথাও থাকতে হবে এবং সংসারের সব দায়িত্ব পালন করতে হবে। অর্থ ছাড়া সেসব কিছুই সম্ভব নয়। এই পরীক্ষায় পাশ করার ফলে যে কোনও ব্যাঙ্কে ভালো কাজ করার উপযুক্ত হলাম।

শীঘ্রই লন্ডন ছেড়ে উত্তর পুবের রাস্তা ধরলাম এবং রাতের অন্ধকারে কেম্ব্রিজে পৌঁছলাম। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ইউনিভার্সিটি কেম্ব্রিজ। অক্সফোর্ড যেমন আর্টস বিষয় পড়ানোর জন্য বিখ্যাত, কেম্ব্রিজ তেমনই বিজ্ঞানের নানা বিভাগের জন্য খ্যাতি লাভ করেছে। ক্যাম নদীর ওপর কেম্ব্রিজ শহর। একেবারে ইউনিভার্সিটি টাউন যাকে বলে। দুদিন এখানে থেকে উত্তরে চলতে আরম্ভ করলাম। ইংল্যান্ডের লেক ডিস্ট্রিক্ট অপূর্ব সৌন্দর্যময় শুনেছিলাম। সবটা ভালো করে ঘোরার ইচ্ছে।

প্রথমে দেখলাম স্ট্র্যাটফোর্ড-অন-এভনে শেক্সপিয়ারের বাড়ি ও তার সঙ্গে তাঁর মিউজিয়াম। রাত্রে শেক্সপিয়ারের একটা প্লে দেখলাম ইমোজেন।

কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়ি দি ডাভ কটেজ সবচেয়ে বড় দ্রষ্টব্যস্থান আমার কাছে। এখন বাড়িটা একটা মিউজিয়াম। আগেকার দিনে আমরা ছাত্রাবস্থায় পড়তাম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, টেনিসন, শেলী, কীটস, বায়রন, স্কটের লেখা কবিতা। যেসব জায়গার ওপর লেখা বা যেখানে লেখকদের জীবন কেটেছে সেইসব জায়গা হয়ে গিয়েছিল তীর্থস্থানের মতো। এমন পরিপাটিভাবে সব সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে যে দেখে তৃপ্তি হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *