৪
জার্মানি এক মহান দেশ। এই জাতিও দুর্ধর্ষ এবং সত্যই বহুগুণসম্পন্ন। এদের জাতিগত গুণ উচ্চশিক্ষা লাভ করা এবং প্রাণপণ পরিশ্রম করে নিজের তথা দেশের উন্নতিসাধনে সচেষ্ট থাকা। আমার ধারণা নিয়মানুবর্তিতায় কোনও জাত এদের হারাতে পারবে না। যদিও কোথাও লেখা থাকে যে ঘাসের ওপর চলা নিষিদ্ধ তা হলে একজন লোকও ঘাসের ওপর পা ফেলবে না। সেজন্য ‘ফেরবোটেন’ (Forbidden বা নিষিদ্ধ) কথাটার তাৎপর্য জার্মানদের কাছে একেবারে মন্ত্রের মতো কাজ করে।
হেরম্যান কোলবের কৃপায় এবং অস্ট্রিয়ায় ঘোরার ফলে জার্মান ভাষা আমার কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। নতুন একটা দেশ ভ্রমণ করবার কথা ভাবলেই ভাষাতঙ্ক জাগে, জার্মানিতে তার ব্যতিক্রম হল।
হঠাৎ বরফ গলে যাওয়ার ফলে ভীষণ কাদা হয়েছিল রাস্তায়। এ এক নতুন বিপত্তি। তবু জলকাদার ভেতর দিয়ে সাইকেল চালানো অপেক্ষাকৃত কম কষ্টকর। পাহাড় থেকে নামতে নামতে নদীর দুধারে পাশাউ শহর দেখলাম। মনে হল চারদিকে কয়লার খনি, যেজন্য ধোঁয়ায় অন্ধকার ও অস্পষ্ট। হয়তো অনেক শিল্পও আছে, তার সঙ্গে চিমনির ধোঁয়া আরও কষ্টকর ঠেকছিল।
ইউরোপে এসে দেখছি যেখানে কয়লার খনি সেখানেই কাছাকাছি শিল্প গড়ে উঠেছে। পরে জিনিসটা প্রত্যক্ষ করেছি অনেক বিশদভাবে। যত কয়লার খনি থাকে, তত লোহার কারখানা।
শহরে একরাত ছোট হোটেলে কাটালাম। পরদিন আমরা যখন রুটি-কোকো নিয়ে প্রাতরাশ খেতে বসেছি, জার্মান যুবকরা দলে দলে ঘরে উপস্থিত হল। তারা শুনতে চায় আমরা কেমন করে ভিয়েনা থেকে এই শীতে ও বরফের ঝড়ের মধ্য দিয়ে পাশাউ পৌঁছেছি। সবাই খুব আশ্চর্য যে ভারতবর্ষ অর্থাৎ গ্রীষ্মপ্রধান দেশের লোক হয়েও আমরা বরফের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এগোচ্ছি।
কলেজের ছেলেরা খুব জিদ করল তাদের মধ্যে দু-চারদিন কাটাতে কিন্তু আমাদের তাড়া ছিল বার্লিন পৌঁছবার। বার্লিন অনেক দূরে এবং সামনে বোহেমিয়ান পাহাড় ও জঙ্গল পার হতে হবে। আপাতত এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা আমাদের সামনে। ছাত্রদের অনুরোধ রাখতে পারব না বললাম, এমন সময় হোটেলের মালিক আমাদের জন্য চার কাপ কফি করে নিয়ে এলেন এবং খাবার জন্য অনুরোধ করে বললেন যে কফির দাম দিতে হবে না। অধিকন্তু ঘরের ভাড়াও দিতে হবে না। আমাদের কফি খাবার কোনও অন্তরায় রইল না, কোকোর পরই কফি খেলাম। লোকে কথায় বলে বিনামূল্যে বিষও খাওয়া যায়— এ তো ভালো জিনিস, কফি।
রওনা হতে দশটা বাজল— ছেলেদের ‘অটোগ্রাফ’ নেবার উৎসাহ খুব। পাশাউ ছেড়েই পাহাড়ে উঠতে আরম্ভ করলাম। পাশাউ যেন গর্তের ভেতর নিচে। চারটের সময় একটা নাম না-জানা গ্রামে বিয়ার হলে বা পাব-এ আশ্রয় নিলাম। পাহাড়ে হেঁটে সাইকেল ঠেলে উঠতে খুবই পরিশ্রম হয়েছিল। তাছাড়া দুপুরে কোথাও থামিনি খাবারের জন্য।
যথারীতি বসে বসে ঢুলতে ঢুলতে রাত এগারোটা পর্যন্ত কাটালাম। যে পাব-এ আসে সেই আমাদের বিয়ার খেতে দেয়। আমরা বিয়ার খাই না বললে জার্মানরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ত। নিশ্চয় ভাবত এটা খুবই আশ্চর্যের কথা যে ভারতবাসীর মতো সুসভ্য লোকেরা বিয়ারের মর্ম বোঝে না। অনেকে গর্ব করে বলত যে তারা জীবনে কখনও জল খায়নি। পানীয় জলের পরিবর্তে বিয়ার অনেকেই খায়। বিয়ার খুব সস্তা এবং পুষ্টিকর খাদ্য। ছেলেমেয়েরা সমান তালে বিয়ার খায়। আমার কেবলই মনে হত যে বিয়ার খাবার টাকায় রুটি ও চিজ কিনলে আমরা অধিকতর লাভবান হব। পেটে যখন খাবার পড়বার সম্ভাবনা কম ও অনিশ্চিত তখন বিয়ার খাবার প্রশ্ন ওঠে না। অনেক সময় স্বাদ পাবার জন্য লোভ ও ইচ্ছা হয়েছে, কিন্তু ব্যস ওই পর্যন্ত।
আইসার নদীর ধারে রেগেনসবুর্গ শহরের দিকে যাচ্ছি। ছেলেবেলায় হোহেনলিন্ডেন কবিতায় পড়েছি, ‘আইসার রোলিং র্যাপিডলি’ সেই নদীর সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় হল।
এই শহরটা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নদীর ধারে দুই চূড়াওয়ালা একটি সুন্দর গির্জা। জার্মানির সব গ্রাম ও শহরই পরিচ্ছন্ন। রাস্তায় ময়লা ফেলা তো দূরের কথা একটুকরো কাগজ এমনকী দেশলাইয়ের কাঠি পর্যন্ত কেউ ফেলে না। রাত্রের আলোয় রাস্তা চিকচিক করে। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত শহরের রাস্তা সাফ করতে হয়। জার্মানিতে তার প্রয়োজন হয় না। ক্বচিৎ কখনও ময়লা ঝাঁট দেবার গাড়ি গভীর রাত্রে, রাস্তা নীরবে সাফসুফ করে চলে যায়। ঘোড়ারগাড়ি ও মোটরগাড়ি ছাড়া অন্য কোনও যানবাহন নেই। রিকশা, ঠেলাগাড়ি, হাতগাড়িতে আমাদের দেশের শহরগুলি ভর্তি। এখানে সেসব কিছুরই বালাই নেই।
রেগেনসবুর্গ-এর এক গির্জায় দেখলাম কীরকম তোড়জোড় হচ্ছে খ্রিস্টমাসের জন্য। মাত্র তিন সপ্তাহ পরে বড়দিন। এখন থেকে রাস্তায় আলোর মালা, গাছে আলো ও দোকানে-দোকানে, আলোর মধ্যে সাজানো সব জিনিস দেখতে ভালো লাগছিল।
বাভেরিয়ার দক্ষিণ-এর দিকটায় অনেক রোমান ক্যাথলিক জার্মান আছে। মার্টিন লুথারের প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশগুলি ‘প্রটেস্ট্যান্ট’ হয়ে যায়। বাকি সব দেশ রোমান ক্যাথলিক। ‘রুশিয়ান অর্থোডক্স’ নামে আরেকটি খ্রিস্টান সম্প্রদায় আছে। তারা বলকান ও গ্রিস দেশে আধিপত্য বিস্তার করে।
আমাদের পরের গন্তব্যস্থান হচ্ছে মিউনিখ, জার্মানির অন্যতম বড় শহর। তিনদিন বরফের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এগোতে লাগলাম। একটু একটু করে। যতই ওপরে উঠি ততই বরফঢাকা সব। জঙ্গলের মধ্যে এক-আধটা গ্রাম পেতাম—অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত মনে হত। সাদা বরফে সব আচ্ছন্ন হয়েছে। আমাদের মতো ভারতবাসীর কাছে সে এক অভিনব দৃশ্য। ঠিক যেন খ্রিস্টমাস কার্ডে (বরফের) আঁকা ছবি।
মিউনিখ শহরে পৌঁছে আমরা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস-এর দিকে গেলাম। একটা ঘর পেলাম থাকবার জন্য। আর্ট গ্যালারি দেখলাম। মধ্য যুগের জার্মান আর্টিস্ট ডিউরার (Durer)-এর তিনখানি অরিজিন্যাল পেন্টিং দেখলাম অন্যান্য বিখ্যাত পেন্টিং-এর সঙ্গে।
একটি মস্ত দ্রষ্টব্য আছে এই শহরে যার সমান জগতে বিরল। সেটি হচ্ছে সায়েন্স মিউজিয়াম। কয়লার খনি, জাহাজের আধখানা, এরোপ্লেন ইত্যাদি বড় বড় জিনিস দিয়ে ঠাসা বিরাট মিউজিয়াম। প্রত্যেক তরুণ-তরুণীদের এটা দেখা উচিত। শত-শত বই পড়ে যতখানি হৃদয়ঙ্গম করা যায় তার চেয়ে বেশি শেখা যায় এসব চাক্ষুষ দেখে।
মিউনিখ-এ আমাদের দুদিন থাকবার কথা। আমাদের ঘরটায় ‘সেন্ট্রাল হিটিং’ ছিল। অর্থাৎ গরম ফুটন্ত জলের অনেক পাইপ ঘরের ভেতর দিয়ে ঘুরে চলে গিয়েছে। যেখানে এইরকম জলের পাইপ আছে সেইখানেই ঘর গরম। হাঙ্গেরি ছাড়ার পর থেকে শীত ও বরফের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শরীর অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। তাই ঠিক করলাম এখানে দু-তিন দিন বিশ্রাম করে সুদীর্ঘ পাহাড়ে বরফঢাকা পথ পার হয়ে নুরেনবার্গ শহর দেখে লাইপজিগ যাব। বরফ পড়া দুদিন কম আছে। শরীরের দিক থেকে বিশেষ প্রয়োজন নিজেদের কর্মক্ষম করে তোলা। আমাদের কাছে মোট একশো টাকা আছে। তা নিয়ে কোনও মতে বার্লিন শহরে পৌঁছব। আমাদের এখনও আশা সেখানে কমিটির চিঠি ও টাকা নিশ্চয় পাব। আগে যেরকম হতাশ হয়েছি সেজন্য একবার ভাবলাম যে বার্লিনে টাকা না পেলে কী করব। কিছু করবার অন্য পন্থা বের করতে হবে। অশোক, আনন্দ ও মণীন্দ্র একসঙ্গে বলল যে, তা বলে পৃথিবী ভ্রমণ ছাড়ব না। ভারতীয়দের পক্ষ থেকে এই প্রথম প্রচেষ্টা কিছুতেই পরিত্যাগ করব না। শেষপর্যন্ত ঠিক হল যে আমাদের মধ্যে একজনও যদি কোনও প্রকারে সক্ষম থাকে তো সে আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাবে- যতদূর পারে। সম্ভব হলে সে একাই ভ্রমণ সম্পূর্ণ করবে।
মণীন্দ্র একটু বেসুরো গাইল; ‘ধর যদি বার্লিনে টাকা না আসে তখন পৃথিবী ভ্ৰমণ শেষ করব বলে জিদ ধরে চললে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।’ আমাদের মনে হল ওকথা ভেবে এখন লাভ নেই। দেশের নেতৃস্থানীয় লোকেরা যখন ভরসা দিয়েছেন তখন কিছুটা নির্ভর করা উচিত।
আমরা চারজনে একটা মস্ত বড় চিঠি লিখে আমাদের দুরবস্থার কথা কুমারকৃষ্ণ মিত্রকে জানালাম এবং অনুরোধ করলাম বার্লিনে প্রতিশ্রুতিমতো টাকা পাঠাতে। আমরা নিজেদের যোগ্যতার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় পার হয়েছি। আমরা যে অমানুষিক কষ্ট সহ্য করতে পারি— অল্প কাপড়ে এবং ‘স্টারভেশন ডায়েটের’ ওপর নির্ভর করে তা প্রমাণ দিয়েছি। একটি বছর পথে পথে কেটেছে। সবরকম বাধা- বিপত্তি পার হয়ে এগিয়ে চলেছি, কারও কাছে আর্থিক সাহায্য চাইনি বা নিইনি।
জার্মানিতে পৌঁছে শীতের সময় যেমন কষ্ট হচ্ছিল তেমনই আপসোস হচ্ছিল যে অনেক জিনিস দেখবার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এই শীতপ্রধান দেশের লোকেরা খুবই কর্মক্ষম। অদ্ভুত পরিশ্রমী, শীতের দিনে ফুটপাথের ধারে সাজিয়ে-গুছিয়ে খাওয়া বসা, গল্প করা বন্ধ হয়ে যায়। তখন সব কারখানায় ভীষণ কাজ। দরজা-জানলা বন্ধ করে বাড়ির ভেতর নানান কাজে দেশসুদ্ধ লোক ব্যাপৃত। শীতকে তাড়াবার ওষুধ হচ্ছে পরিশ্রম করা এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল রাখা।
আমরা যথেষ্ট পরিশ্রম করি এবং দেহকে খাটাই, তবে কেন এত কষ্ট? দুটো কারণ: পুষ্টিকর খাবার থেকে বহুদিন আমরা বঞ্চিত। দ্বিতীয় কারণ, শীতের উপযুক্ত গরম কাপড় আমাদের কিছুই ছিল না। তৃতীয়ত, আরেকটা দারুণ অসুবিধা আমাদের ছিল। সেটা হচ্ছে দিনে-রাতে গরম জায়গায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে দেহটাকে চাঙ্গা করতে পারিনি। দেহ পুনরুজ্জীবিত করবার সোজা পথ হচ্ছে মাঝে মাঝে গরমে সময় কাটানো।
আমাদের বিশ্রাম নেবার সময় ছিল না। মূলমন্ত্র ছিল ‘চরৈবেতি’ অর্থাৎ এগিয়ে চল, এগিয়ে চল।
জার্মান ভাষায় বলবার, পড়বার এবং লেখবার মোটামুটি ক্ষমতা আমার হয়েছে। নানা লোকের সঙ্গে কথা বলে, বই পড়ে ভাষায় দখল বাড়াতে আরম্ভ করেছিলাম বলে আমার খুব সুবিধা হল। যেখানে ইচ্ছা যাদের সঙ্গে ইচ্ছা মিশতে ও চলাফেরা একাই করতাম। আমার বন্ধুরা ভাষা শেখার চেষ্টায় ‘ইতি’ করে দিয়েছিল। শিখে লাভ হবে না বলে ওরা হাল ছেড়ে দিল। আমার উৎসাহ ততোধিক বেড়ে গেল। ভবিষ্যতে কী হবে সে কথা না ভেবে আমি বর্তমানে অর্থাৎ জার্মানিতে যতদিন থাকব অন্তত ততদিন মহা সুবিধায় দিন কাটাব।
কলেজের একটি ছাত্র এসে খুব উৎসাহ নিয়ে জানাল যে সে তার বাবাকে আমাদের কথা বলেছে। তিনি রেডিওর এক কর্তাব্যক্তি— আমাদের ভ্রমণ সম্বন্ধে কিছু রেডিওতে বলবার আমন্ত্রণ জানালেন। আমি দ্বিধার সঙ্গে রাজি হলাম। পরদিন সকালে রেডিও অফিসে গেলাম, সন্ধ্যায় কী বলব ঠিক করতে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানাল সব ঠিক আছে আমি রেডিওতে বলতে পারব।
সন্ধ্যা সাতটার একটু আগে রেডিও অফিসে উপস্থিত হলাম এবং যথাসময়ে একটা ছোট বক্তৃতা করলাম এবং ভারতবর্ষ থেকে কোন পথে কত কষ্ট করে ডিসেম্বর মাসে মিউনিখ (জার্মানদের কাছে) পৌঁছেছি তার একটা ইতিবৃত্ত দিলাম। তারপর প্রশ্নোত্তর হল অল্পক্ষণ। হঠাৎ আমাকে অনুরোধ করল ট্যাগোর-এর ভাষা যদি জানি তো একটা গান গাইতে। আমি বললাম যে তার পরিবর্তে একটা জার্মান গান শোনাব যেটা সবেমাত্র শিখেছি। তথাস্তু। গানটা খুব সোজা একটা ‘লালাবাই’ অর্থাৎ ছোট ছেলে-মেয়ের ঘুম পাড়ানির গান। পরের গানটা উঠগো ভারতলক্ষ্মী’ গাইলাম। যদিও সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়। পরে শুনেছিলাম যে গান নাকি ভালো হয়েছিল, যা গেয়েছিলাম তা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল। যদিও আমি জানি যে আমার গান খানিকটা বেসুরো হয়েছিল।
পারিশ্রমিক হিসাবে পঞ্চাশ মার্ক অর্থাৎ জার্মান টাকা রোজগার করলাম। দেশি টাকার তুলনায় তার মূল্য হবে ৪৫ টাকা।
বন্ধুদের ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে ৫০ ডয়েস মার্ক অশোককে দিলাম। সবাই খুব খুশি, ঠিক হল ‘সেলিব্রেট’ করব। আমরা সেই রাত্রেই একটা সস্তার রেস্তোরাঁতে গিয়ে পেট ভরে খাব। মুসুর ডালের স্যুপের সঙ্গে রুটি এবং এক টুকরো পর্ক বা শুয়োরের মাংসের সঙ্গে আলুসেদ্ধ ও বাঁধাকপি দিয়ে মহানন্দে ডিনার সারলাম। মোট খরচ হল সাড়ে সাত মার্ক বা ছয় টাকা। মনে হল মাঝে মাঝে এইরকম পেটভরে ইচ্ছামতো খেলে আবার পূর্ণোদ্যমে চলতে পারব।
শীতের সময় এইসব দেশে গাছে একটাও পাতা থাকে না— সবুজ বলতে কেবলমাত্র পাইন গাছ যেমন সেডার অব লেবানন, প্রুশ ইত্যাদি। শাক-সব্জি বাজার থেকে তথা দেশ থেকে উধাও। এরা বাঁধাকপি কুচি কুচি করে কেটে ভিনিগারে ডুবিয়ে রাখে এবং সমস্ত শীতে তা খায়। অনেক জার্মান ভিনিগারে জরানো বাঁধাকপি, যাকে সাওয়ার ক্রউট বলে, সেটা সারা বছর খায়। গরিব লোকেরা ভিনিগারে ডোবানো হেরিং মাছ ও রুটি খেয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়।
মিউনিখে একটা বিখ্যাত ফুলের বাজার আছে। দুঃখের বিষয় শীতের দিনে সেটা খালি পড়ে ছিল। ফুলের অস্তিত্ব সেখানে দেখতে পেলাম না।
আরও দ্রষ্টব্য সব দেখবার জন্য পরদিন বেরিয়ে পড়লাম প্রাতরাশ সেরেই। বন্ধুরা অনিচ্ছা প্রকাশ করল আমার সঙ্গে টহল দিতে বেরোতে।
আমি ঘুরতে ঘুরতে একটা মস্ত বিয়ার হাউসের সামনে পৌঁছেছি, একদল লোক আমার পিছু পিছু আসছিল। আমাকে একরকম ভিড়ের ঠেলায় বিয়ার গার্ডেনের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল। সেখানে একজন অস্ট্রিয়াবাসী লেকচার দিচ্ছিল। শুনলাম তার নাম হিটলার। বক্তব্য হচ্ছে যুদ্ধের পর ‘মিত্রপক্ষ জার্মানি ও অস্ট্রিয়াকে কেটেছেঁটে ছোট্ট করে দিয়েছে। ‘ভেরসাই সন্ধিপত্র’ ছিঁড়ে ফেলে দাও। জার্মান ভাষাভাষীদের একত্র হয়ে এই অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে … ইত্যাদি’। হিটলার একজন ‘ইন্টিরিয়র ডেকোরেটর’ ও রংয়ের মিস্ত্রি। যুদ্ধের সময় জার্মানির হয়ে লড়েছিল। একজন নেতা হবার ইচ্ছায় জার্মানির ও জার্মানদের গুণগান গাইছে। কথা বলবার সময় মনে হল হিটলার সম্মোহন বাণ ছাড়ছে। আরও শুনলাম যে যুদ্ধে হারার জন্য নাকি ইহুদিরা দায়ী। তারা শত্রুতা করে মিত্রপক্ষের হাতে জার্মানির হার ঘটিয়েছে। তাদের উৎখাত করতে হবে। সবাই খুব তারিফ করছে সেই বক্তৃতার। মিটিং শেষ হবার পর আমাকে হাজির করল হিটলারের সামনে। দাম্ভিকতাপূর্ণ চেহারা দেখে ও বক্তৃতা শুনে আমার একটুও ভালো লাগেনি। আমি ভারতবাসী জেনে প্রথম প্রশ্ন হল আমাদের দেশে কত ইংরেজ আছে। আমি বললাম, কত শত জানি না তবু এক লক্ষ নাগাদ হবে। তখনই দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, ‘এই মুষ্টিমেয় ইংরেজকে কেন আমরা অর্থাৎ ৩৫০ মিলিয়ন (১৯২৭) ভারতবাসী ফুঁ দিয়ে বে অব বেঙ্গল-এ ঠেলে পাঠাই না’। তৃতীয় প্রশ্ন হল, আমাদের নেতা কে? গান্ধীজির নাম শুনে বলল সে একজন ভীতু লোক তাই নন্-ভায়োলেন্স পন্থায় স্বাধীনতা আনতে চায়। আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স অভ্যাস করতে হলে বরং অতিমাত্রায় সাহসের প্রয়োজন। হিটলার তখন খেদের সুরে বলল যে ভারতবর্ষ যদি জার্মানির হাতে থাকত তাহলে জার্মানরা হিমালয়ে আলুর চাষ করত। এই কথার সঠিক মানে বুঝলাম না তবে ইঙ্গিতটা খুব সুস্পষ্ট। গান্ধীজিকে অপমানের সুরে ‘ভীতু’ বলেছিল বলে আমার গা জ্বলছিল। আর কথা না বলে আমি সেখান থেকে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলাম এবং মনে মনে ভাবলাম যে কী ভাগ্যিস, ভারতবর্ষ জার্মানির অধীন নয়। আমরা নিশ্চয়ই কারও অধীনে থাকতে চাই না। তবু একথা আমি স্বীকার করি যে কিছু ইংরেজ ভারতবাসীর মঙ্গল কামনা করছে এবং অশেষ উপকার করছে আমার দেশের। তাঁরা চিরস্মরণীয়।
জার্মানদের ‘ওয়েস্ট আফ্রিকায় শাসনে’র কথা একটা বইয়ে পড়েছিলাম, তাতে জার্মানদের অত্যাচারী বলা হয়েছে। ফরাসিদের রাজত্ব পদ্ধতির কিছু নমুনা সিরিয়াতে দেখেছি। আপাতদৃষ্টিতে তা শোভন হলেও কোনও সিরিয়ান চাইবে না ফরাসিরা তাদের দেশ শাসন করে। ফরাসিদের সবচেয়ে বড় গুণ হল যে তারা বর্ণবৈষম্য মনেপ্রাণে মানে না। কালাধলার একই মাপকাঠি। ফলে সিরিয়ান ও ফরাসি স্ত্রী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। একজন সিরিয়ান আমাকে বলেছিল যে ফরাসিরা সবাইকে সস্তায় ভালো মদ খাইয়ে সন্তুষ্ট রাখতে ও রাজত্ব চালাতে চায়।
মনভর্তি বিরক্তি নিয়ে বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলাম। তারা জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কী? সমস্ত ঘটনাটা বললাম। প্রথমেই আরম্ভ করলাম যে আমি এক পাগলের পাল্লায় পড়েছিলাম। তার ভীষণ আপসোস যে ভারতবর্ষে জার্মানদের বদলে কেন ইংরেজরা রাজত্ব করছে। একটা সামান্য নগণ্য দ্বীপবাসীর অধীন বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্য, একি কম পীড়া দিচ্ছিল সেই পাগলকে! অবশেষে নিষ্ফল আক্রোশে জানাল, গান্ধীজিকে ‘কাওয়ার্ড’ বলে। আমি নিজেকে খুব সামলে সেখান থেকে চলে এসেছি। মারামারি করলে হয়তো হাজতবাস করতে হত।
হিটলারের অনুগামী তখনও বেশি দেশে ছিল না, কিন্তু ওর কথাগুলো জার্মানদের মনে রঙের তুলি বুলিয়ে দিচ্ছিল। যুদ্ধের রশদ যারা জোগাড় দেয় তারাই হিটলারকে ঠেলে ওপরে তোলবার চেষ্টা শুরু করছিল।
বন্ধুদের মত হল যে, আমার উচিত নয় ট্যাঙশ ট্যাঙশ করে বিদেশে শহরময় ঘুরে বেড়ানো। আমি একমত নই। বিদেশে বেড়ানোর উদ্দেশ্য হল ভাবের আদান-প্রদান করা বিভিন্ন জাতির লোকদের সঙ্গে মিশে
পরদিন মিউনিখ ছেড়ে নুরেনবার্গের পথ ধরলাম। কঠিন পথ সামনে। শীতের প্রকোপ বাড়ছে দিনের পর দিন। বরফ আবার পড়তে শুরু করেছে।
আবার সেই বরফ ও শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এগোচ্ছি। দিনে কতবার হাত নীল হয়ে যেত তার আর হিসাব রাখিনি। জামাকাপড় যা আমাদের ছিল সব প্রায় ছিঁড়ে গিয়েছে। তালি দিতে হবে, তবে কবে, কোথায় দেব— তা ঠিক করতে পারলাম না। শহরে কোথাও বেশিদিন থাকতে হলে ব্যবহার করবার একটা আলাদা ট্রাউজার ও একটা শার্ট ছিল। ভাবছি, সেইগুলো ব্ৰীচেস-এর নিচে পরে একটু গরম থাকবার চেষ্টা করব। দুদিন পরে তাই করতে হল কিন্তু শীতের প্রকোপ কিছুতেই কমছে না বরং শীত আমাদের কুঁকড়ে বেঁকিয়ে দিচ্ছিল।
বরফের ঝড়ের মধ্যে কোনওমতে নিজেদের টানতে টানতে শ্রান্ত ও অবসন্ন অবস্থায় নুরেনবার্গ শহরে পৌঁছলাম। একদিন থাকবার কথা। পথে এক খবরের কাগজের ফটোগ্রাফার আমাদের ছবি তুলেছিল এবং পরদিন তা প্রকাশিত হল। রিপোর্টাররা আমাদের ইতিবৃত্ত নিয়ে গিয়েছিল।
নুরেনবার্গে থাকার জায়গা পাচ্ছিলাম না। একজন সন্ধান দিল যে একটা ‘পান্সিয়ন’ আছে আমরা সেখানে কম খরচায় থাকতে ও খেতে পারি। ইউরোপের সর্বত্র বোর্ডিং হাউসকে পান্সিয়ন বলে। তাছাড়া ডর্মিটরি আছে— সেখানে সারি সারি খাট পাতা থাকে, একটা পছন্দ করে নিলেই হল। ভাড়া খুব কম, মাত্র তিন টাকায় একরাত কাটানো যায়। খাওয়া মাত্র দুই টাকা। স্যুপ, রুটি ও সামান্য শুয়োরের মাংস আর আলুসেদ্ধ হচ্ছে মামুলি খানা। কখনও কখনও চিজ দেয় ‘সসেজের’ বদলে। স্নানের ব্যবস্থা আছে। সেজন্য ছয় আনা পয়সা দিতে হয় গরম জলের জন্য। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সব বন্দোবস্ত। আমরা পান্সিয়নে উঠলাম।
পরে অন্য অনেক দেশে দেখেছি, স্যালভেশন আর্মির লোকেরা এইরকম ব্যবস্থা করে গরিব লোকেদের রাত কাটাবার সুবিধা করেছে। পরে সে কথা লিখব। পান্সিয়নে থাকে ছাত্ররা বা নিম্ন বেতনের চাকরিজীবীরা। স্যালভেশন আর্মি হচ্ছে বেকার এবং গরিব লোকেদের জন্য। দুইয়ের পার্থক্য অনেক— দুই স্তরের বললে ভালো হয়। পরে এর চেয়ে উন্নতমানের অনেক বোর্ডিং হাউসে থেকেছি, সেখানে ব্যবস্থা অনেক ভালো।
আমি যথারীতি নুরেনবার্গ শহরে টহল দিতে বেরোলাম। আমরা সম্পূর্ণ ‘অসময়ের ট্যুরিস্ট’ বলে অবাক হয়ে চেয়ে থাকত, কোথাকার অবাচীন আমরা, তা নিশ্চয় ভাবত! শীতের দিনে বরফের মধ্যে কেউ কি দেশ ভ্রমণে বেরোয়?
কাগজে পড়েছিলাম যে ইংরিজি পদ্ধতিতে তৈরি একটা খুব সুন্দর ফুলের বাগান আছে— দেখবার মতো। চারদিকের সমতল জমি থেকে এক হাত-দেড় হাত নিচে বাগান অবস্থিত বলে ইংলিশ গার্ডেন বলা হয়। চারদিক বরফে আচ্ছন্ন বলে কিছু দেখতে পেলাম না। খ্রিস্টমাস আগত প্রায় সেজন্য দোকান সব খুব সাজানো এবং কেনা-বেচা হচ্ছে জোরসে।
আমার মনে হচ্ছিল কোনও ভাবনা নেই যেন; দুপুরের নির্দিষ্ট জায়গায় গরম খাবার পাব পেট পুরে, বেলা তিনটের সময় আবার বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্যে বেরিয়েছিলাম তাই পথে হীরালাল রায় (পরে যাদবপুর কলেজের বিখ্যাত প্রফেসর) মহাশয়ের সঙ্গে দেখা হল। তিনি মিউনিখ শহরে ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করছিলেন। কাজ নিয়ে একদিনের জন্য নুরেনবার্গে এসেছেন।
যখন পৃথিবী ভ্রমণে বেরোই একবছর আগে তখন যাদবপুর কলেজে আমাদের জন্য এক সম্বর্ধনা সভা হয়। জাতীয়তাবাদী হীরালালবাবু সেখানে উদ্যোক্তা ছিলেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। হীরালালবাবুকে টানতে টানতে আমাদের আস্তানায় নিয়ে এলাম। তিনিও খুব খুশি হলেন আমাদের দেখে। বন্ধুদের দেখে অনেক আনন্দ প্রকাশ করলেন এবং উৎসাহ দিলেন। আমাদের আসল অবস্থা যে কত সঙ্গীন হয়ে পড়েছে সে কথা জানানো হল না। কেবল বলেছিলাম দেশ ছাড়ার পর থেকে কমিটির কাছ থেকে কোনও খবর বা চিঠি পাইনি।
আমরা আমাদের অতিথিকে কফি খাওয়ালাম। তিনি বললেন যে, বিচিত্রা মাসিক পত্রিকায় আমার লেখা ভ্রমণকাহিনী পড়েছেন। তিনিও দৈনিক কাগজে আমাদের কথা লিখবেন। বিদেশে দেশের পরিচিত লোক দেখলে খুব ভালো লাগে।
আবার পাহাড়ে পিছল পথে উঁচুতে উঠছি, নিচে নামছি, এবং মাঝে মাঝে আছাড় খাচ্ছি। তবু চলেছি লাইপজিগ শহরের পথে। কড়া ঠান্ডা বাতাস যদি একটু কম হত তো বাঁচতাম। বরফের ঘূর্ণিঝড় থেকে একটু আড়ালে দাঁড়ালে শীতের কষ্ট অনেক কম টের পেতাম। খোলা মাঠে ও পাহাড়ে আড়াল কোথায়?
সেই একঘেয়ে বরফ, পাহাড়, অনশন, জামাকাপড়ের অভাবের কথা আর কত বলা যায়! জীবন সত্যিই দুঃসহ এবং কষ্টকর হয়ে উঠেছিল।
নাকে এবং চোখের পাতায় আইসিল নিয়ে লাইপজিগ পৌঁছলাম কয়েকদিন পরে। লোকেরা আমাদের মতো বরফঢাকা কালা আদমি দেখে কৌতূহলী হল বেশ। সবাই জানতে চায় আমরা কে, কোথায় যাচ্ছি। সেখানে তখন একটা বিরাট প্রদর্শনী আরম্ভ হয়েছিল। তার নাম বিখ্যাত লাইপজিগ ফেয়ার— ভারতবর্ষের কিছু মামুলি জিনিস যেমন পাট এবং পাটজাত দ্রব্যাদি, রুপোর সূক্ষ্ম কাজ, শাঁখের ও আইভরির কাজের নানারকম মূর্তি দেখলাম। ভারতীয় রান্নার মশলার খুব চাহিদা বুঝলাম। গরম মশলা, আদা, এলাচ ও তেজপাতা ইত্যাদি দেখে কল্পনা করেছিলাম আমাদের দেশি খাবার তৈরি করার কত হাঙ্গামা, যদিও সেগুলি খুব মুখরোচক। এদেশের লোকেরা ‘পিলাফ’ অর্থাৎ পোলাওয়ের এবং কারির কথা পড়েছে বা শুনেছে। আমাদের প্রায়ই জার্মানরা জিজ্ঞেস করত তার স্বাদ কীরকম। মুখে বলে আর কি স্বাদ বোঝানো যায়। তাই আমরা জবাবটা এড়িয়ে যেতাম।
পরদিন আমরা একটি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের বিরাট কারখানা দেখতে গেলাম। শুনলাম তারা বহু ওষুধ ভারতবর্ষময় রপ্তানি করে।
লাইপজিগ ছেড়ে আমরা আবার পথে বেরোলাম। বার্লিন পৌঁছতেই হবে। সেখানে আমাদের ভাগ্যে কী লেখা আছে কে জানে!
মণীন্দ্র বলল, হেস্তনেস্ত একটা সেখানে হবেই। ধর যদি টাকা না আসে তখন বা তারপর ভ্রমণ আর সম্ভব নয়। শীতের মধ্যে যে কষ্ট করে এতদূর এসেছি, আর বেশিদিন সে অবস্থায় পড়লে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এবিষয়ে আমিও একমত। যেভাবে এতদিন চলেছি সেভাবে চলা অসম্ভব। তবু কেন জানি না আমি আশাবাদী বলে অনেকটা মনে মনে শান্ত। উপায় বের করতেই হবে যদি টাকা না আসে।
তহবিলে অর্থাৎ হাতে তখন আছে ১১৫ টাকা। এই আমাদের মোট সম্বল। অশোক বলল যাই হোক, বার্লিনে পৌঁছে এক-এক জোড়া গরম মোজা সবার জন্য কিনতে হবে।
পথে ছোট শহরে বা বড় গ্রামে এক নতুন থাকবার ব্যবস্থা দেখলাম— যেখানে খুব কম টাকায় পরিষ্কার খাবার, থাকবার জায়গা পাওয়া যায়। এর নাম ইউগেন্ড হেরবের্গে’ অথবা ইউথ হস্টেল। এই হস্টেল যেখানে পেতাম সেখানেই উঠতাম। কিছু খরচ হত কিন্তু গরম ঘরে খাটে শুতে পেতাম। ইউথ হস্টেল মুভমেন্ট তখন সবে শুরু হয়েছে এবং সবাই এদের বন্দোবস্তর প্রশংসা করত শুনতাম।
আনাহাল্ট নামে ছোট একটা শহরের দিকে এগোচ্ছি। বিকালের মধ্যে পৌঁছতে পারব ভরসা ছিল। কিন্তু আবার হঠাৎ বরফের ঝড় ওঠার ফলে আমরা দু-চার মাইলের বেশি এগোতে পারলাম না। একটা রাস্তার ধারে গ্রামে পৌঁছেই ঠিক করলাম যে সেখানে কোথাও রাত কাটাতে হবে। সবাই আমাদের একটা ভেগ্রান্টস রেফিউজে নিয়ে গেল। একটা কয়লার আগুনের চিমনি ও তার তিনদিকে তিনটে ঘরে কাঠের তিন সার শোবার জায়গা— আমরা তথাস্তু বলে একটা ঘরে ঢুকলাম। আগুনটায় বাইরে থেকে কয়লা দেওয়া যেত। একজন বেশ খুঁচিয়ে আগুনটা গনগনে করে দিয়ে চলে গেল। সন্ধ্যা সাতটার সময় একজন লোক এল মিউনিসিপ্যালিটি থেকে। আমাদের ও অন্য দুটি বেকার যাযাবর যারা আশ্রয় নিয়েছিল তাদের ডাকল। আমাদের পরিচয় এবং পাসপোর্ট ইত্যাদি দেখে অপেক্ষা করতে বলল। অন্য দুটি জার্মান যুবকদের জামা- কাপড় খুলিয়ে ভালো করে আলোয় দেখল যে তাদের গায়ে পোকা আছে কিনা। তারপর আমাদের পালা। তদনুরূপ পরীক্ষা করে ছেড়ে দিল বুঝলাম, এটা বিনামূল্যে থাকবার জায়গা বলে খুব বুঝেসুজে লোককে অনুমতি দেয়।
বাঙ্কে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুলাম, ঘর ছোট্ট। তার মধ্যে চারটে সাইকেল রেখে আরও স্থানাভাব। আমরা আরামে ঘুমিয়ে পড়লাম। চিমনির গায়ের গরম আমাদের ঘরে ভালোই পাচ্ছিলাম। চিমনিটা ফাটা ছিল দু-চার জায়গায় সেজন্য বেশি গরম হাওয়া ঘরে ঢুকছিল। সেটা একরকম আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছিল। পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত ঘরের দরজা খুলিনি দেখে মিউনিসিপ্যালিটির লোক দরজা বাইরে থেকে খুলে ফেলল এবং দেখল আমরা চারজনে বেহুঁশ ও অচৈতন্য। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে ঘরে ঢুকেই বললেন যে ‘কোল গ্যাস’ চিমনির ফাঁক দিয়ে ঘরে পৌঁছেছে এবং আদেশ দিলেন যাতে আমাদের শীঘ্র টেনে বাইরে ফাঁকা জায়গায় বের করা হয়।
আমি নিচের বাঙ্ক-এ শুয়েছিলাম বলে আমার একটু কম বিষাক্ত গ্যাস লেগেছিল। অন্য লোকের টানাটানিতে আমার আচ্ছন্ন ভাব কেটে গেল। আমিও বন্ধুদের টানতে আরম্ভ করলাম। বাইরে বরফের ওপর খানিকক্ষণ শুয়ে থাকবার পরেই সব ঠিক হয়ে গেল। ডাক্তার বলে গেলেন যে চিমনি না সারিয়ে যেন কোনও লোককে ভে গ্রান্টস রেফিউজে থাকতে দেওয়া না হয়। আমাদের কাছে অনেক মাফ চেয়ে ডাক্তার বিদায় নিলেন। হোম-এর কাছাকাছি এল নদী। ইচ্ছা করছিল নদীর ঠান্ডা জলে মুখ-হাত ধুয়ে চাঙ্গা হতে কিন্তু নদী জমে গিয়েছে। ছোট ছেলেমেয়েরা নদীর জমা বরফের ওপর মনের আনন্দে স্কেটিং করছে।
আর মাত্র একশো মাইল বাকি আছে বার্লিন পৌঁছতে। পাহাড় থেকে নামছি ব্রান্ডেনবুর্গ-এ, সমতল জমির ওপর খুব ভালো রাস্তা কিন্তু বরফে ঢাকা। সকালবেলায় মোটরগাড়িতে ‘কাটার’ লাগিয়ে রাস্তা একবার সাফ করে দিয়েছে। আরও দুয়েকবার সাফ করবে যদি আবার বরফ জমে। কিন্তু রাস্তা ভীষণ পিছল, সাবধানে চলেছি।
তিনদিন পরে বিশে ডিসেম্বর ১৯২৭ সালে বিকাল ৪টেয় বার্লিন পৌঁছলাম। সেদিন শনিবার ছিল। পরদিন রবিবার পোস্ট অফিস বন্ধ। আমরা অধীর আগ্রহে সোমবারের অপেক্ষায় রইলাম। প্রথমেই গেলাম নয়-কোলন পাড়ার ওয়াই এম সি এ-তে। শুনেছিলাম যেখানে সস্তায় থাকতে, খেতে পারব। আমরা থাকবার জায়গা পেয়ে গেলাম। একজন ভদ্রমহিলা ওয়াই এম সি এ দেখাশোনা করেন, তিনি হলেন ডিরেক্টর। ওয়াই এম সি এ-তে স্ত্রী ও পুরুষ দুইই থাকতে পারে।
ওয়াই এম সি এ বাড়ির অতিথিদের জন্য প্রত্যেকের পৃথক ঘর আছে। কম খরচায় থাকার জন্য বেসমেন্ট-এর বন্দোবস্ত আছে জেনে আমরা সেখানে গেলাম। বাড়ির নিচে ডর্মিটরি। প্রথম মহাযুদ্ধের ফেরৎ অনেক লোহার খাট ছিল। টু-টায়ার বা দুই সারি খাট তাতে কাঠের পাটাতন লাগানো ছিল। আমরা সেই খাটে শোব ঠিক করলাম। ডিরেক্টরের নাম ফ্রাউ স্টেলা— আমাদের প্রতি বিশেষ সদয় ব্যবহার দেখালেন। তিনি বললেন যে, ডাইনিংরুমে আমরা যা খাব তার দাম দেব। শোবার খরচ লাগবে না। যখন দলে দলে ছাত্ররা গ্রাম থেকে বার্লিন শহর দেখতে আসে তারা গ্রীষ্মকালে লোহার খাটগুলি ব্যবহার করে। মাত্র আধ মার্ক ভাড়া ছয় আনা— তাও আমাদের দিতে হবে না।
শহর ভীষণ রকম আলোকসজ্জায় মণ্ডিত। চারদিন পরেই খ্রিস্টমাস। বিকালে পরিষ্কার হয়ে বেরলাম শহর দেখতে। প্রথমেই আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন দেখতে গেলাম। মাটির নিচে সুড়ঙ্গ পথে ট্রেন যাতায়াত করছে। টিকিট কেটে লিফট-এ চড়ে নিচে নামলাম, নিমেষে ট্রেন ছেড়ে দিল। সামনেই স্টোন, শহরের ম্যাপে লেখা ছিল শহরের পশ্চিম প্রান্তে কুরফুরস্টেনডাম পাড়া, সেখানে গেলাম, চওড়া রাস্তা ও বড়লোকেদের বাস। আলোয় আলোকিত সেই পাড়া। কাছেই টিয়ার গার্টেন অর্থাৎ চিড়িয়াখানা। ভিয়েনা শহরে একজন অস্ট্রিয়ান বন্ধু তার আত্মীয়ের নামে একটি চিঠি দিয়েছিল। খুঁজে খুঁজে জার্মান পরিবার, আর্নহাইমদের বের করলাম। ব্যোমগার্টনার-এর বন্ধু এবং ভারতীয় বলে সবাই খুব খাতির করল ও আত্মীয়তা দেখাল। কর্তা গিন্নি তিন মেয়ে ও একছেলে সবাই খুব ভদ্র। বড় মেয়ে প্রায় সমবয়সী। ভাব হয়ে গেল। তার নাম গারট্রুড— ডাক নাম, গের্ডা। বলাবাহুল্য এটি ইহুদি পরিবার। পরদিন সন্ধ্যাবেলায় টেবিল টেনিস ও ডিনারের নেমন্তন্ন পেলাম।
আবার ইউ বার্ন অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ড রেল চড়ে ওয়াই এম সি এ-তে ফিরলাম। ট্রেন খুব পরিষ্কার। বার্লিন শহর মস্ত বড় কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় সে অদ্বিতীয়। রাস্তা পর্যন্ত চকচক ঝকমক
আন্ডারগ্রাউন্ড রেল আমাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দিল। রাস্তায় অনেক লোক চটপট গাড়িতে চলাফেরা করতে পারে না ভিড়ের জন্য। মাটির নিচে ভীষণ জোরে নির্ভয়ে ইলেক্ট্রিক ট্রেন চলে। সেজন্য অল্প সময়ের মধ্যে শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাওয়া যায়। ট্রেন একটার পর একটা ছুটছে। দূরত্ব বা দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান সামান্য। এমন ব্যবস্থা আছে যে দুটো ট্রেন খুব কাছাকাছি এলে আপনি পিছনেরটা বন্ধ হয়ে যায়। ইলেক্ট্রিক কাট অফ সিস্টেম, একেবারে সুনিশ্চিত।
ডিনার খাবার আগে আমাকে ফিরতে দেখে বন্ধুরা নিশ্চিন্ত হল। ভেবেছিল আমি বুঝি পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাছে সব শুনে বন্ধুদের ভরসা হল শহর দেখতে যাবার। পরদিন সকালে টিয়ার গার্টেনে জু দেখতে যাব, আন্ডারগ্রাউন্ড রেলপথে এবং বাসের দু’তলায় বসে শহর দেখতে দেখতে ওয়াই এম সি-এ ফিরব এই ঠিক হল। বন্ধুদের বলেছিলাম আর্নহাইম পরিবারের সঙ্গে আলাপ করবার। তারা অনিচ্ছুক বলে আমি বেশি অনুরোধ করলাম না। বুঝতে পারছিলাম যে বন্ধুরা ভারতবর্ষ থেকে কমিটির চিঠি ও টাকা পাবে কিনা সেই উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। আমারও উৎকণ্ঠা কিছু কম নয় কিন্তু যে সুযোগ ও অভিজ্ঞতা আমার সামনে উপস্থিত তাকে দূরে ঠেলে ফেলে দিই কেমন করে। কিছু নাই হক, বার্লিন পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছি বরফের ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং বার্লিন শহর দেখেছি এইটুকুই লাভ। কেন জানি না, আমার মনে সন্দেহ জেগেছে কমিটি কোনও টাকা বা চিঠি পাঠায়নি। হয়তো কমিটির অস্তিত্ব আমরা কলকাতা ছাড়ার পরই লোপ পেয়েছে। আমি সাধারণত আশাবাদী, তবে আশা করবার কোনও কারণ দেখছিলাম না। না হলে এক বছরের মধ্যে আমাদের খোঁজ-খবর পর্যন্ত কেউ নিল না। অর্থ সাহায্য না পেলে চার বন্ধুতে মিলে দল বেঁধে পৃথিবী ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। একজন অথবা বড় জোর দুই বন্ধুতে মিলে কোনও নতুন উপায়ে ভ্রমণ চালানো যেতে পারে। সে উপায়টা কী, সঠিক বা স্পষ্ট জ্ঞান কিছু ছিল না। মনে হচ্ছিল কোনও উপায়ে রোজগারের ব্যবস্থা করতে পারলে হয়তো এগনো যাবে। কতদিনে তাহলে ভ্রমণ শেষ হবে তা কে বলতে পারে।
প্রথমেই ঠিক করলাম যে ফটোগ্রাফি ভালো করে শিখতে হবে।
পাতাল রেল চড়ে বন্ধুদের খুব ভালো লাগল। জু গার্ডেনে কলকাতা জু-র তুলনায় এমন কিছু দ্রষ্টব্য নেই— সাদা ভালুক ও শীল ছাড়া। বাগানটাও তুলনায় অনেক ছোট কলকাতার চেয়ে।
রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধা গনগনে আঁচের উনুনে চেস্টনাট ভাজছিল। চিনাবাদামের চেয়ে অনেক বড়, অনেকটা কাঁঠালবিচির মতো। লোকেরা খুব খায়। আমরাও ২০- ২৫টা কিনলাম এবং খেতে খেতে শহর দেখতে বেরোলাম। বিকালে বন্ধুরা ক্লান্ত হয়ে ওয়াই এম সি এ-তে ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করল। একটা বাসের টিকিট কেটে বন্ধুদের তুলে দিলাম। সোজা নয়-কোলন যাওয়া যায়।
সন্ধ্যাবেলায় গের্ডার সঙ্গে তাদের বাড়ি গেলাম। গৃহকর্ত্রীর বয়স হয়েছে প্রায় ৫২ আমাকে বললেন যে আমি তাঁর ছেলেমেয়েদের বয়সী, সেজন্য আমিও যেন তাকে মুত্রী বা মা বলে ডাকি। এরপর থেকে আর্নহাইম পরিবারে আমার নিত্য নিমন্ত্রণ ও অবাধ গতিবিধি হয়েছিল। মহিলাটির কাছে আমি মায়ের মতো ভালোবাসা পেয়েছি।
মিঃ আর্নহাইম ব্যবসায়ী, একটু গম্ভীর প্রকৃতির। বাড়িতে এসে মুখ হাত ধুয়ে মাথায় ভেলভেটের টুপি পরে খাবার টেবিল বাতি দিয়ে সাজালেন। ‘মুত্ৰী’ একটা বড় রুটি, দামি কাপড় ঢাকা দেওয়া, কর্তার সামনে টেবিলে রাখলেন। কর্তা, ইহুদি ভাষায় মন্ত্র পড়তে আরম্ভ করলেন। ছেলেমেয়েরা ও আমি এবং গৃহিণী চুপ করে শুনলাম। তারপর সেই রুটি সবার ছিঁড়ে নেবার পালা। ইহুদিরা হাজার হাজার বছর ধরে আরবদের সঙ্গে পাশাপাশি থেকেছে। সেজন্য অনেক আচার ব্যবহার দুই জাতের মধ্যে একই। যেমন রুটি ছিঁড়ে খাওয়া এবং তাই দিয়ে সবার সঙ্গে ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপন করা। এইরকম অনুষ্ঠান প্রতি রবিবার হয়। একে ‘সাবাথ’ পালন করা বলে। সাবাথ এদের কাছে পবিত্র দিন।
ডিনারের পর আর্নহাইম পরিবার আমাকে ঘিরে বসল, ভ্রমণকাহিনী শোনাবার জন্য। সিরিয়ার মরুভূমিতে আমরা এজরার সমাধি দেখেছি শুনে কর্তার আমার ওপর ভক্তি অনেক বেড়ে গেল। স্যামসন ও ডেলায়লা সেখানে কিছু কাল বাস করেছিল। সেজন্য আজও ইহুদি যুবক-যুবতী সেখানে যায় বিয়ে করতে। আমাদের সঙ্গে এক জায়গায় মিল আছে। দেখলাম বিয়ের পর বাসর জাগার ব্যবস্থা ওদেরও আছে। মেয়েরা বিশেষ করে বর-কনেকে ঘিরে হাততালি দেয় ও গান করে রাত কাটায়।
আমার জন্য মুত্রী অনেক মুখরোচক খাবার রেঁধেছিলেন। খুব তারিফ করে খেলাম। আমি সকাল সকাল বাস ধরে ওয়াই এম সি এ-তে ফিরলাম। পরদিন জানা যাবে আমাদের চারজনের ভাগ্যে কী আছে, যখন বড় পোস্ট অফিস খুলবে। একটা রাত আরও অপেক্ষা করতে হবে। লোহার খাটিয়ায় বাঙ্কে শুয়ে পড়লাম, বন্ধুরা তখন নিদ্ৰামগ্ন।
দল বেঁধে দশটার পর আমরা বড় পোস্ট অফিসে হাজির হলাম। সেখানে যথারীতি জানাল যে আমাদের কোনও চিঠি বা মানি অর্ডার নেই, কেবলমাত্র ভারতীয় গ্লোব ট্রটার, বিমল মুখার্জির নামে, একটা চিঠি আছে। সেটা আমার মা ও অনুজ, বিখ্যাত হকি খেলোয়াড় নির্মল মুখার্জির লেখা।
আমাদের মাথায় বজ্রপাত। সমস্ত আশা ও পৃথিবী ভ্রমণের আকাঙক্ষা ছাড়তে হবে। তারপর কী করব অথবা কোথায় যাব জানি না। আমি ইত্যবসরে নির্মলের চিঠি বন্ধুদের পড়ে শোনালাম। সে লিখেছে যে কুমারকৃষ্ণ মিত্র মহাশয়ের সঙ্গে আহিরীটোলার বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিল। কুমারবাবু আমাদের চিঠি পেয়েছেন বললেন কিন্তু কোথা থেকেও কোনও সাহায্য পাননি বলে তিনি একা আমাদের খরচ বহন করবার ভার নিতে অনিচ্ছুক। এই চিঠি পড়ার পর আমাদের অবস্থাটা স্পষ্ট বোঝা গেল। নিজেদের গতি নিজেদেরই করতে হবে। সবাই বিমর্ষ হয়ে ওয়াই এম সি এ-র বেসমেন্টে ফিরলাম।
এখন ঠিক হল প্রথম কাজ হচ্ছে টাকা রোজগার করা— যাতে শীতটা বার্লিনে কাটাতে পারি। বরফের সঙ্গে লড়াই করতে হবে অথচ গরম জামাকাপড় নেই। এমন সময় গের্ডার কাছ থেকে টেলিফোন এল। সে জানাল যে হামবোল্ড হাউসে একটা বড় সভা ডেকেছে, সেখানে আমাদের চারজনের উপস্থিতি প্রয়োজন। ভ্রমণ সম্বন্ধে বলবার অনুরোধ এল। গের্ডা বন্দোবস্ত করেছে, চারদিন পরে হবে। আমি বললাম যে আমাদের অর্থের প্রয়োজন, সেজন্য এক টাকার প্রবেশমূল্যে আমাদের অভিজ্ঞতা শোনাব। তথাস্তু বলে গের্ডা টেলিফোন রাখল। আমি বন্ধুদের কিছু না বলে ঠিক করলাম মিটিংয়ের পর বার্লিন ব্রড কাস্টিং অফিসে যাব একটা লেকচারের ব্যবস্থা করতে।
আমাদের নিজেদের মধ্যে অনেক আলোচনা হল, কিন্তু স্থির হল না কিছুই। আমরা কী করতে পারি ভেবেই পেলাম না। আমি বললাম যে কোনওরকমের কাজ দেখবার চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে কী খাব শীতের মাসগুলিতে?
কিছু স্থির না হলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে আমাদের ভ্রমণে ছেদ পড়ল বার্লিনে। অশোক ও আনন্দ বলল ইংল্যান্ড পর্যন্ত শীতের পর কোনওরকমে যেতে হবে। তারপর কে কোথায় যাবে এবং কী করবে ঠিক হবে। ইতিমধ্যে আরও দুটো চিঠি লিখে স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী ও মিঃ জে এন বাসুকে সমস্ত পরিস্থিতি জানিয়ে দিলাম এবং লিখলাম যে আমরা গর্তের মধ্যে পড়েছি যদি ওঠবার কোনও পথ তাঁদের জানা থাকে তো বার্লিনে জানাতে— অন্তত তিনমাস আমাদের এখানে কাটাতে হবে। আমার বিশেষ নিজস্ব মত হল যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উপার্জনক্ষম হওয়া
বেতারবার্তা কেন্দ্রতে বিকালে গেলাম। তারা আমাকে বলল যে বিলম্ব না করে সেইদিনই রাত্রে প্রোগ্রাম দেবে। আমি টাকার লোভে একটু বেশি লম্বা প্রোগ্রাম চাইলাম। তখন ভদ্রলোক জানালেন যে ১৫০ মার্ক পাবে ৩০ মিনিটে। খুশি হয়ে audition ঘরে চলে গেলাম। একজন ভদ্রলোক প্রশ্নোত্তর করবার সময় বললেন যে তিনি মিউনিখ – এ আমার ছোট্ট বক্তৃতা শুনেছেন। সেই ভরসায় ৩০ মিনিটের ব্যবস্থা হয়েছে।
আমি বেতারে বলবার পর ১৫০ মার্ক বা দেশি টাকায় ১৪০ টাকা নিয়ে ওয়াই এম সি এতে ফিরলাম। একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ডাইনিং হলে আমি একাই ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে বললাম কেমন করে টাকা লাভ হয়েছে। অশোককে টাকা দিলাম, নিজের বাস ও পাতাল রেল ভ্রমণের জন্য ৫ টাকা রেখে দিলাম।
হামবোল্ড হাউস-এ মিটিংয়ে গেলাম দুদিন পর। ভীষণ ভিড়, লোকেদের খুব উৎসাহ। ভারতবর্ষের নানা জায়গার ছাত্ররা এসেছিল। ইংরিজি ভাষায় বলার তাগিদ এল। বেশ কিছু বিদেশিও সেখানে হাজির। তারা সবাই জার্মান নাও হতে পারে।
‘নশা’ সেন অগ্রণী হয়ে আমাকে মিটিংয়ে উপস্থাপিত করল, প্রথমে জার্মান ভাষায় তারপর ইংরিজিতে আমার পরিচয় দিল। আমার আগেই লেখা উচিত ছিল যে ‘নশা সেনের সঙ্গে বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ‘আপনি’ ছেড়ে ‘তুমি’র সম্পর্কে নেমেছি আমরা দুজনে। সেন আমাকে স্বোয়েন হেডিন, ন্যানসেন ও আমুন্দসেন ইত্যাদি বিখ্যাত পর্যটকদের সঙ্গে তুলনা করে বলল যে আমি সেই ধাতু দিয়ে তৈরি একজন ভারতীয়। ভারতবর্ষ থেকে দারুণ গ্রীষ্মের মধ্যে মরুভূমি পার হয়েছি এবং অসম্ভব শীতের মধ্যে ব্যাভেরিয়ান আল্পস-এর ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই খুব হাততালি দিল।
আমি কম্পিত বক্ষে উঠলাম আমাদের ভ্রমণের ইতিবৃত্ত বলতে। তার বিবরণ দিলাম— যদিও মনের মধ্যে এই বিষয়ে তখন কোনও সাড়া পাচ্ছিলাম না এবং ভাবতেও পারছিলাম না কী করে আমরা এগোতে পারব।
মিটিং শেষ হবার পর অসংখ্য লোকের নেমন্তন্ন পেলাম। ‘নশা’ সুবন্ধুর মতো তাদের নাম ঠিকানা লিখল।
৪১৫ টাকা হাতে এল, খরচ কিছুই ছিল না। কর্তৃপক্ষদের ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম।
বন্ধুদের কাছে যখন মিটিংয়ের উৎসাহী লোকেদের কথা বললাম এবং অনেক টাকা রোজগার হয়েছে শুনে সবাই আনন্দ প্রকাশ করল। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে শীতের দিনগুলো আমরা বার্লিনে কাটাতে পারব। বন্ধুরা নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছিল এবং পরামর্শ করে স্থির করেছিল ভ্রমণ এইখানেই শেষ।
মিটিংয়ে যাঁদের সঙ্গে আলাপ হল তারা হলেন, শ্রী বীরেন চট্টোপাধ্যায়, মিসেস সরোজিনী নাইডুর ভাই তাদের মধ্যে অন্যতম। এত উচ্চশিক্ষিত, ভদ্র ও নিরহঙ্কার লোক আমি দেখিনি। সৌম্য ঠাকুর আমার স্কুল, মিত্র ইনস্টিটিউশনে এক ক্লাস ওপরে পড়ত, সেও উপস্থিত। আরেকজন ভারতীয় ডাক্তার ননীগোপাল মৈত্রর সঙ্গেও আলাপ হল এবং পরে হৃদ্যতাও জন্মেছিল।
আমি বন্ধুদের জানালাম যে ফটোগ্রাফি শিখব টেকনিসে হোকসুলে, যতদিন বার্লিনে থাকব। বন্ধুদের মত হল যে অনর্থক অর্থব্যয় হবে একজনের জন্য। শেষপর্যন্ত সবার মত হল এবং ৫০ টাকা ফি দেবার জন্য নিলাম ৪১৫ টাকা থেকে। রবিবার বার্লিনের একধারে ‘ভেয়ান সে’ নামে লেকে পিকনিক করতে গেলাম আমরা।
গের্ডাদের বাড়ি প্রায়ই যাই। সে একদিন আমাকে নিয়ে শহরের বাইরে নয়স্টাড নামে একটা জায়গায় বিখ্যাত ‘সাঁ-সুশি’ প্রাসাদ দেখাতে নিয়ে গেল। ইতিহাস প্রসিদ্ধ ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট শহর থেকে দূরে একটা শান্তিময় পরিবেশে পাহাড়ের ওপর ওই প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলেন। ফরাসি লেখক ভলটেয়ারের সঙ্গে সম্রাটের বন্ধুত্ব ছিল। তিনি অনেকদিন সম্রাটের সঙ্গে ছিলেন।
অনেক শখ করে সম্রাট প্রাসাদের নাম রাখলেন ‘সাঁ-সুশি’ অর্থাৎ ফরাসিতে ‘দুঃখহীন’। কিন্তু প্রাসাদ তৈরি করবার সময় কেউ খেয়াল করেননি যে পাহাড়ের চূড়ায় একটা উইন্ডমিল রয়েছে সেটা শোবার ঘরের পাশে বললেই ভালো হয়। প্রথমদিন গৃহপ্রবেশের ঘটা যখন শেষ, তখন সম্রাট শুতে গেলেন। সারারাত উইন্ডমিল-এর ক্যাচ কোঁচ শব্দে ঘুম হল না।
সকালেই চেম্বারলেনকে ডেকে বললেন তাঁর বিনিদ্র রজনী কেটেছে। যেমন করে হোক সেই বিকট শব্দ যেন বন্ধ করা হয়। চেম্বারলেন প্রাসাদে একরাত্তির কাটিয়ে ঠিক এই কথাই ভাবছিল যে উইন্ডমিল তো সরানো যাবে না তবে ভেঙে ফেলা যাবে সম্রাটের হুকুমে। এটা আর এমন কী বড় কথা, দরকার হয় তো উইন্ডমিলের মালিককে খেসারত দেওয়া যাবে। চেম্বারলেন কয়েকজন সৈন্য নিয়ে উইন্ডমিল-এর দরজায় উপস্থিত হয়ে মালিককে ডেকে বলল, ‘আমি সম্রাটের নামে তোমাকে এখনি শব্দ বন্ধ করতে বলছি।’ ম্যুলর জবাব দিল যে যতক্ষণ বাতাস বইবে ততক্ষণ তার উইন্ডমিলও চলবে। সম্রাট রেগেমেগে হুকুম দিলেন ভেঙে ফেলবার। ম্যুলর ছুটে গেল বার্লিনে এবং হাইকোর্টে সম্রাটের নামে নালিশ রুজু করল। হাইকোর্ট চিরদিনের মতো সম্রাটের হস্তক্ষেপ বন্ধ করবার হুকুম দিল। তাই আজও প্রাসাদের পাশে সেই উইন্ডমিল সমানে জাঁতায় গম ভাঙছে। এরপর সেই ম্যুলর এক ঐতিহাসিক পুরুষ হয়ে যায়। সম্রাট ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট হাইকোর্টের রায় মেনে নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন নামটা বদলে প্রাসাদের অন্য নাম রাখবেন। ভলটেয়ার বলেন যে সম্রাটের মহত্ত্ব বাড়বে যদি তিনি প্রাসাদের নাম না বদলে ম্যুলরের সঙ্গে আপসে একসঙ্গে বাস করেন। তাই হয়েছিল।
একটা জার্মান কাগজ কিনে সারা সকালটা পড়বার চেষ্টা করলাম একটা ডিক্সনারির সাহায্যে। আজ খ্রিস্টমাসের পূর্বদিন। আমাদের ওয়াই এম সি এ-তে তার ছোঁয়াচ লেগেছে। গাছে গাছে আলো এবং একটি বিশেষ টবের গাছে, নাম— আরোকেরিয়া, খুব সাজানো হয়েছে।
দুপুরবেলা আমরা চার বন্ধু একটা টেবিলে খাচ্ছি, এমন সময় ফ্রাউ স্টেলার-এর সঙ্গে একটি জার্মান তরুণী এসে ডাইনিং হলে একটা টেবিল অধিকার করল। তখন একবারও ভাবিনি এই ভদ্রমহিলা আমাদের একজনের জীবনে ধ্রুবতারার মতো অর্ধ শতাব্দীরও বেশি একসঙ্গে কাটাবে। তরুণীর সোনালি রঙের চুল। ভালো স্বাস্থ্য। কিন্তু অতিকষ্টে খুঁড়িয়ে চলছিল। শারীরিক কষ্টের মধ্যে মেয়েটির চোখে-মুখে হাসি। মনে হল খুব সহজ সরল স্বভাব। খাওয়া শেষ হলে আমাদের টেবিলের সামনে দিয়ে যাবার সময় তরুণী খুব সাবধানে আমাদের উদ্দেশ করে গ্রুশ করল। পরে আমাদের ফস্টার-মাদার ফ্রাউ স্টেলারের কাছে শুনলাম নাম মিস আনালিসে বোল্ডট। হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ি যাবার পথে ওয়াই এম সি এ-তে কিছুদিন থেকে শরীর সুস্থ করে যাবে।
তার সঙ্গে সবার ভাব হয়ে গেল। আনালিসে সামান্য ইংরিজি জানত, তা এত কম যে কথাবার্তা চালানো যায় না। বাধ্য হয়ে আমার জার্মান ভাষায় যতটুকু জ্ঞান হয়েছে তার ওপর নির্ভর করতে হল। আনালিসে ও বন্ধুদের মধ্যে আমি দোভাষীর কাজ করতে শুরু করলাম। আমরা ফ্রাউ স্টেলার ও আনালিসেকে কফি খাবার ও গল্প শোনার নেমন্তন্ন জানালাম।
ওই অল্প সময়েই আনালিসে আমার এক বন্ধুর মনে রঙের ছোপ লাগিয়েছিল বিশেষভাবে। সে হল অশোক।
বিকালে আর্নহাইমদের বাড়ি গেলাম। খ্রিস্টমাসের নেমন্তন্ন ছিল। মুত্রী আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে বললেন যে সেদিন মিঃ ভাদুড়ি আসবেন। তাঁর সঙ্গে গের্ডার বিবাহ ঠিক হয়েছে। পরে ইনি দেশে ফিরে ‘বেঙ্গল ব্রুয়ারি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ভাদুড়ির সঙ্গেও আমার ভাব হল।
বাড়ি অর্থাৎ ওয়াই এম সি এ-তে ফ্রাউ স্টেলারের জন্য একটা স্কার্ফ উপহার নিয়ে ফিরলাম। সামান্য জিনিস, সামান্য দাম, উপহারে দামের খবর কে রাখে। এত দয়াপরবশ হয়ে এই ভদ্রমহিলা আমাদের যত্ন করতেন যে আমি খুব কৃতজ্ঞতা বোধ করতাম তাঁর আত্মীয়তাপূর্ণ ব্যবহারে।
ডিরেক্টর স্টেলার আমাকে তাঁর ঘরে কফি ও কেক খাবার নেমন্তন্ন করেছিলেন। আমি গেলে খুব খুশি হয়ে বললেন যে আমাকে অর্থাৎ একজন ভারতীয়কে দেখে তাঁর জার্মান মেয়েদের দুর্ভাগ্যের কথা মনে হচ্ছে। আমরা কীরকম শান্তিকামী অথচ জার্মানদের উচ্চাশার শেষ নেই, যুদ্ধ বাধাবার জন্য যেন পা বাড়িয়েই আছে। তাঁর মতে, জার্মান মেয়েদের তিন অবস্থা: প্রথমটা হচ্ছে তাদের আত্মপ্রসাদ, যখন দেশসুদ্ধ লোক তাদের বাহবা দিয়ে গুণ গায়, বীর প্রসবিনী জার্মান মা, বীরের স্ত্রী হবার সৌভাগ্য ইত্যাদি বলে।
তারপর রাজনীতিবিদ জার্মানরা যুদ্ধ বাধিয়ে বসে। কিছুদিন জয়গান চলে। দ্বিতীয় অবস্থা ক্ষণিকের যখন জার্মানিদের কাছে সবাই হার স্বীকার করে। জয়ের নেশায় সবাই তখন আনন্দে আত্মহারা। তারপর বিপরীত হাওয়া বয়, যুদ্ধে শেষপর্যন্ত জার্মানিকে মিত্রপক্ষ হার স্বীকার করতে বাধ্য করে। তখন দুঃখ-কষ্ট হাহাকার ছাড়া আর কিছু থাকে না। সবচেয়ে পীড়াদায়ক যে স্বামী, পুত্র, ভাই, প্রিয়জন সব যখন একে একে মরণের মুখে তখন কে বীরজায়া, কে বীরতনয়া, তার হিসাব কে রাখে। তৃতীয় অবস্থার সূচনা হয় যখন সব হারিয়ে মেয়েদের মনে দয়া, স্নেহ, কোমল বৃত্তিগুলি আবার জেগে ওঠে। যে শান্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে তাকেই ভালো লাগে। স্টেলারের মনে হয় এখন তৃতীয় দশা। এখন সর্ব জীবে দয়া, সব মানুষকে ভালোবাসার চোখে দেখতে আরম্ভ করেছেন। তাঁর স্বামী, একমাত্ৰ পুত্ৰ সন্তান ও দুই ভাই যুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছেন।
দুই যুগ বা তিন যুগের মধ্যে যখন যুদ্ধের ক্ষত সব মিলিয়ে যায়, যখন এই কর্মনিষ্ঠ বুদ্ধিদীপ্ত জার্মান জাত আবার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ব্যবসা প্রতিপত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারে, আবার যখন শিল্পের চাকা পুরোদমে চলতে থাকে তখন জার্মানদের মাথায় আবার পোকা নড়ে ওঠে। আবার প্রমাণ করবার চেষ্টা জাগে যে জার্মানি সবার ঊর্ধ্বে, যেমন তাদের জাতীয় সঙ্গীতে আছে ‘জার্মানি, জার্মানি সবার সেরা।’
বৈজ্ঞানিকরা তখন নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শিল্পপতিরা অজস্র অর্থ ব্যয় করে যুদ্ধের মাল-মশলা তৈরি করবার জন্য। যারা গত যুদ্ধের সময় নাবালক ছিল তারা এখন নতুন যৌবনের দল। তারা এগিয়ে আসে আগেকার কালের বিখ্যাত যোদ্ধাদের মতো দেশের কাজে প্রাণ দিয়ে অমর হবার জন্য।
যুদ্ধ বাধবার আগে দেখা গিয়েছে যে জার্মানরা সমৃদ্ধির চরমে উঠেছে। সবাই কর্মরত। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাল রপ্তানি করছে জার্মানরা। তবু তার ক্ষোভ যে ইংরেজদের মতো তাদের বিরাট সাম্রাজ্য নেই। তাদের ইংরেজ পতাকাকে সম্মান দেখিয়ে সব জায়গায় ঘোরাফেরা করতে হয়। এ কি কম পরিতাপের কথা! তুর্কিতে আনাতোলিয়ায় ভ্রমণ করবার সময় যে জার্মান যুবক বহুদিন আমাদের সঙ্গ নিয়েছিল তার মনের কথাও এইরকমই ছিল। বলা চলে, দেশসুদ্ধ লোকের এই একই মনোভাব দেখা যাচ্ছে জার্মানি যুদ্ধ করে কোনও অভাবের জন্য নয়, বরং স্বভাবের জন্য।
আমরা দেশকে জননী রূপে কল্পনা করি। জার্মানরা দেশকে ‘ফাদারল্যান্ড’ বলে। প্রায় সব দেশের জাতীয় সঙ্গীতে মাতৃভূমিকে সকল দেশের সেরা ইত্যাদি অলঙ্কারে বিভূষিত করে। যদিও আমরা সেটা ধ্রুব সত্য মনে করে পাশের দেশের সঙ্গে যুদ্ধ লড়তে যাই না, যেমন জার্মানরা করে।
হোকসুলে ভর্তি হয়েছি ফটোগ্রাফি শেখবার জন্য। আরেকজন বঙ্গসন্তান চারু গুহ আমার ক্লাসে যোগদান করলেন। শ্রীগুহ একজন কৃতীছাত্র, পরে কলকাতায় হ্যারিসন রোডে ও এলবার্ট বিল্ডিংয়ে স্টুডিও খুলে খ্যাতির উচ্চ শিখরে ওঠেন।
কিছুদিন পরে উফা স্টুডিও থেকে আরেকজন বাঙালি, বিভুভূষণ ঘোষ এল স্টিল ফটোগ্রাফি ও সিনেমোটোগ্রাফি শেখবার জন্য। সে আমার চেয়ে অনেক ছোট, পরে সে একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার হয়েছিল চলচ্চিত্র জগতে।
ডাঃ বিমল গুহ যাঁর কথা আগেই লিখেছি, তিনি আমার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো হয়েছেন। একদিন বললেন যে তাঁর এক বিশেষ পরিচিতা ভদ্রমহিলা, মাননীয়া ‘বুইলো’– অর্থাৎ বিখ্যাত জার্মান জেনেরাল ফন বুইলোর বিধবা স্ত্রী— আমাকে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার খাবার নেমন্তন্ন করেছেন। বেশ জমজমাট ব্যাপার, গিয়ে দেখলাম। তবু লেডি বুইলোর আগেকার মতো সঙ্গতি নেই। বড়জোর বার্লিন শহরে অবস্থাপন্নদের পাড়ায় একটা ভালো বাড়ি ও সামান্য টাকা, আর ছিল সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র, কার্পেট, কাটগ্লাসের ও ড্রেসডেন-এর বিখ্যাত চিনামাটির বাসন, সব বড়লোকের বাড়িতে যেমন দেখেছি।
লেডি বুইলো খেদ করে বললেন যে তাঁর সর্বস্ব খুইয়েছেন কয়েক বছর আগে, যখন সাংঘাতিক মুদ্রাস্ফীতি হয়। সে রকমটা ইতিহাসে বিরল। একটা রুটির দাম জার্মান টাকায় ৫,০০০ মার্ক পর্যন্ত হয়েছিল। একটা ডিমের দাম ৭,০০০ মার্ক। সব জিনিসের দাম এই অনুপাতে বেড়ে গেল। বাড়তে বাড়তে একটা রুটির দাম পৌঁছল পঞ্চাশ হাজার টাকায়। বাজার করতে গেলে থলে ভর্তি লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে যেতে হত। যা জিনিস কেনা হবে তা দিয়ে বড়জোর একদিন সংসার চলবে। অচিরে এক লক্ষ পৌঁছল দশ লক্ষে এবং দশ লক্ষ পৌঁছল দশ মিলিয়নে। লোকদের ঘরে যার যা ছিল ফুটপাথে বের করে দিল বিক্রি করবার জন্য। জলের দরে সব কেনাবেচা চলল। কত ভালো ভালো বাড়ি হাত বদল হল তার ঠিক নেই রুটির জোগাড় দিতে।
লেডি বুইলো আমাকে একটা ঘর দেখালেন তার নাম মিলিয়ন রুম। আরেকটা ঘর, তার নাম বিলিয়ান রুম অর্থাৎ ঘরের সমস্ত দেওয়ালে নোটগুলি সাঁটা হয়েছে এমনভাবে যে দেখলে মনে হয় বুঝি Wall paper। শীতের দেশে নিয়ম হচ্ছে সুন্দর কাগজ দেওয়ালে লাগিয়ে ঘর সাজানো এবং সেইসঙ্গে ঘর গরম রাখার চেষ্টা। ‘ওয়াল পেপার’ কিনতে যত নোট লাগবে সেই কাগজের নোট দিয়ে লোকেরা ওয়াল পেপারের কাজ সারত।
এমনিভাবে প্রথম মহাযুদ্ধের তিন বছর পরে জার্মানরা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। বেশি লোকের ধারণা যে মুদ্রাস্ফীতি ও দেশসুদ্ধ বিপর্যয়ের কারণ হচ্ছে ইহুদিদের কারসাজি। কত ইহুদি যুবক যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে সে কথা সবাই ভুলে গেল। নিজেদের দুঃখের জন্য অন্যকে দায়ী করা মানুষের স্বভাব। তাই যুদ্ধে হারার পর সব কষ্ট দুঃখ অসুবিধার জন্য ফ্যাসিস্ট জার্মানরা ইহুদিদের দায়ী করল, যুদ্ধে হার হল ইহুদিদের ষড়যন্ত্রে, অপমানজনক সন্ধি ‘ট্রিটি অব ভেরসাই’ হল ইহুদিদের জন্য! লোকে, বিশেষ করে হিটলারের মতো ফ্যাসিস্টরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের বদনাম দিল। প্রোপাগান্ডা করা নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হয়ে উঠেছিল। ক্রমে ক্রমে লোকেরা ইহুদিদের প্রতি বিরক্তি ও অবজ্ঞা প্রকাশ করতে আরম্ভ করল। তখন অনেক ইহুদি মনীষী, যেমন বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন ও অন্যরা জার্মানি ছেড়ে আমেরিকায় বসবাস করতে গেলেন। আমার জানা একজন ইহুদি ডাক্তার, ডেমিড মিনেহান যিনি গত যুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে দেশ সেবার জন্য আইরন ক্রুস (যুদ্ধকালীন সবচেয়ে বড় সম্মান) পেয়েছিলেন, তিনি যখন দেখলেন লোকেরা তাঁকে অসম্মান করছে তখন তিনি সব বেচে দিয়ে মিশর দেশে চলে গেলেন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে, একটা হাসপাতালে ডাক্তারি করবার জন্য।
ইহুদিদের অবদান জার্মানিকে নানাদিকে সমৃদ্ধ করেছিল। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ডাক্তার, প্রফেসর, বৈজ্ঞানিক, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক, অনেকে ইহুদি ছিলেন।
লেডি বুইলোর ভূরিভোজ অনেক ঘটা করে হল— তারপর আমার পালা। আমার পরিচয় দেবার পর আমি আমাদের ভ্রমণ সম্বন্ধে কিছু বললাম। মানচিত্র এল, গ্লোব এল এবং সবাই উৎসাহ দেখিয়ে নানারকম প্রশ্ন করল। দু-চারজন ভদ্রমহিলা ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করলেন আমার বিবাহের কী হবে? কবে, কোথায় কোন দেশে এবং কার সঙ্গে বিবাহ হবে জানবার ঔৎসুক্য দেখালেন।
ডাইনিং টেবিলের ওপর যে টেবিলক্লথ পাতা ছিল, সেটার বয়স পঞ্চাশের বেশি। সেটি বিবাহের যৌতুক। আমি যে প্লেটে খাচ্ছিলাম সেটিও ওই সময়ের।
ডিনার শেষ করে সবাই আগুনের ধারে বসলাম কফি খাবার ও খোস গল্প করবার জন্য। ডাঃ গুহ খুব আমুদে লোক ছিলেন। তিনি অনেক মজার মজার গল্প করলেন। সবাই মিলে আমাকে ঘিরে ধরে তাদের হাত দেখতে বলল। আমি যতই বলি পামি, জানি না, তাদের উৎসাহ ততই বাড়তে আরম্ভ করল। এক মহিলার হাত দেখার ভঙ্গি করে বললাম, ‘একজন লম্বা, তামাটে রং, সুন্দর দেখতে ইয়ংম্যান তোমার জীবনে আসছে।’ সবাই খুব হাসতে শুরু করল এবং আমার হাত দেখার পালা শেষ হল।
অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি রওনা হলাম। বেশ রাত্রি হয়েছিল। রাস্তায় মানুষ ও গাড়ি কম। পাতাল রেলে কয়েকটি যাত্রী। ওয়াই এম সি এ পৌঁছে দেখি বন্ধুরা নিদ্ৰামগ্ন।
পরদিন সকালে প্রাতরাশ খেতে ডাইনিং হলে যাচ্ছি এমন সময় আনালিসে এসে আমার হাতে জার্মান ভাষায় লেখা অশোকের নামে একটা চিঠি দিয়ে বলল তর্জমা করে দিতে। চিঠির মূলকথা কী জানবার জন্য অশোক ব্যস্ত। খাবার পর আমি তর্জমা করে অশোককে শোনালাম যে আনালিসে আমাদের সঙ্গে এবং বিশেষ করে অশোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব সূত্রে আবদ্ধ হতে চায়। আমি সেইদিন বিকালে আনালিসে ও অশোককে নিয়ে কাছেই একটা রেস্তোরাঁতে কফি খেতে ও গল্প করতে গেলাম। দুজনের মাঝখানে আমি বসে পরস্পরের কথা তর্জমা করে দিলাম। ভদ্রমহিলা খুব কষ্টে হাঁটেন, তাই বেশি দূর যেতে পারিনি। ডাক্তার নাকি রোজ হাঁটতে বলেছেন, তাই কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে চলাফেরা করেন।
অশোক গল্প করে আশ্বস্ত ও খুব খুশি হল। যদিও আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না এদের ভবিষ্যৎ আছে কিনা এবং তা কেমন রূপ নেবে।
আমি লক্ষ করেছি ভারতীয়দের প্রতি জার্মানরা শ্রদ্ধাবান, প্রধানত দুটি কারণে: প্রথমটি রবীন্দ্রনাথের একবছর আগে জার্মানিতে উপস্থিত হওয়া এবং সর্বত্র তাঁর বিরাট সম্বর্ধনা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে পুরনো হিন্দু শিক্ষা, দর্শন, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। জার্মানরা অবাক হয়ে যায় যখন মহেঞ্জোদড়ো ও হরপ্পা শহরের ৪,০০০ বছর বয়স শোনে। তাছাড়া বেশিরভাগ জার্মান স্ত্রী-পুরুষ বিশ্বাস করে আমরা শান্তিকামী। যুদ্ধে হারার পর তাদের বেশি করে মনে হয় যে মারামারি লোকক্ষয় ইত্যাদির চেয়ে শান্তি অনেক বেশি কাম্য।
বার্লিন শহরে খুব বরফ পড়েছে কদিন, যানবাহন ও লোক চলাচল একরকম বন্ধ। পাতাল রেলের পথে চলাফেরা করায় বিপদের সম্ভাবনা কম।
একদিন দেখলাম যে লোক নেওয়া হচ্ছে রাস্তা থেকে ঠেলবার যন্ত্র দিয়ে বরফ ঠেলে একপাশে রাখবার জন্য। আমিও নাম লেখালাম। তারপর পাঁচঘণ্টা বরফ ঠেলে রাস্তার মাঝখানটা গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত করা আমার কাজ ছিল। আমার সঙ্গে আরও ১৫ জন সাফ করার কাজে লেগেছিল।
কাজের নির্দিষ্ট সময় পার হবার সঙ্গে সঙ্গে একজন লোক আমাদের প্রত্যেককে ১৫৬ মার্ক দিল। আমি সবরকম কাজ করবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। যা জানি না তা শিখে নেব, এই ছিল আমার সংকল্প। ফলে কালকে ছিলাম চিফ গেস্ট বা প্রধান অতিথি জার্মান জেনারেল বুইলোর বাড়িতে, আজ জমাদার, রাস্তা সাফ করছি।
একজন ব্যবসাদার আমাকে আরেকটা কাজ দিলেন। তাঁর যত ইংরিজি চিঠি আসে সেগুলো সকালবেলায় আমাকে মোটামুটি বুঝিয়ে দিতে হবে। যা পারতাম না তা ডিক্সনারির সাহায্যে পরিষ্কার করা যেত। মাসে ৩০০ মার্ক রোজগারের পথ হল। নশা সেনের আগ্রহে আমার জন্য একজোড়া আইস স্কেটিং শ্য জোগাড় হল। আমার পা এতবড় ও চওড়া যে সহজে মাপসই জুতো পাওয়া যায় না। তারপর আমরা তিনজন স্কেটিং রিংয়ে কুরফুরস্টেনডামে গেলাম। অনেক কসরৎ করে আস্তে আস্তে পড়াটা থামাতে পারলাম আর আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম আড়ষ্টভাবে চলতে পারলাম।
সেনের উৎসাহের সীমা নেই। আমাকে এর পরে নিয়ে গেল স্কি শেখাবার জন্য। এটা খুব শক্ত নয় যতক্ষণ না পাহাড়ে ভীষণ উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়বার চেষ্টা করছি। বরফের দিনে দেশসুদ্ধ লোক স্কি পরে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়ায় বরফের ওপর দিয়ে। যারা খুব এক্সপার্ট তারা পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথে জোরে স্পাইড করে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ লাফিয়ে চলবার চেষ্টা করে। লাফাবার রেস হয় কে কত উঁচু দিয়ে ডিঙিয়ে যেতে পারে।
জার্মানিতে আরও তিন মাস কাটাতে বাধ্য হলাম বরফের জন্য। বন্ধুরা দেশে ফেরা ঠিক করেছে— যদি অন্য কোনও দেশে বসবাস করতে সক্ষম না হয়। মণীন্দ্র বলল যে সে জার্মানিতেই থাকবে। আমার ইচ্ছা এগিয়ে চলার, অন্তত লন্ডন পর্যন্ত তারপর দেখা যাবে।
ফটোগ্রাফি শেখা ও ভাষা শেখা পূর্ণোদ্যমে চলছে। ঠিক করলাম যত শীঘ্র পারি একটা ছবির প্রদর্শনী করব— আমাদের ভ্রমণকে কেন্দ্র করে। বার্লিনে ছয় মাসের মধ্যে সেটা সম্ভব হবে না তার কারণ সব আর্ট গ্যালারি বা ‘এগজিবিশন হল’ সারা বছর খালি পাওয়া যায় না। গ্রীষ্মের সময় সবাই রোদ পোয়াতে এবং খেলাধুলাতে ব্যস্ত, আর্ট-এর ধার ধারে না। ইতিমধ্যে লন্ডনে রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সেক্রেটারিকে চিঠি লিখলাম এগজিবিশনের জন্য। তিনি রাজি হলেন। লিখলেন, লন্ডনে গিয়ে এ বিষয়ে যোগাযোগ করতে।
অশোক ও অ্যানালিসে আমাকে নিয়ে প্রায় রোজই বেড়াতে যেত। কাছেই একটা পার্কের বেঞ্চে বসে গল্প করতাম। অশোক ভালো জার্মান শেখবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার অনেক আগে আনালিসে ইংরিজিতে ধীরে ধীরে মনের কথা ব্যক্ত করতে পারল।
মণীন্দ্রকে বাদ দিয়ে আমাদের তিনজনের মধ্যে ঠিক হল যে পশ্চিম জার্মানি পার হয়ে হল্যান্ডে যাব এবং সেখান থেকে কোনও জাহাজে কাজ নিয়ে লন্ডনে যাব। মণীন্দ্র দল ছাড়ল যদিও, আপাতত, অর্থাৎ যতদিন আমরা না রওনা হচ্ছি ততদিন সে একসঙ্গে থাকবে এবং কাজের চেষ্টা দেখবে।
পশ্চিম জার্মানিতে আমরা যখন যাচ্ছিই তখন আনালিসের বাড়িতে আমরা দুয়েকদিন থাকতে পারি লিয়ার শহরে। আনালিসে তার মা-বাবাকে দেখাতে চায় তার মনের মানুষকে এবং সময়ে সম্ভব হলে অশোককে বিয়ে করবে, এইরকম মনোভাব ব্যক্ত করে চিঠি লিখল।
একদিন শ্রীমতী হাথি সিং আমাকে ও ননীগোপাল মৈত্রকে নিমন্ত্রণ করলেন তাঁর সঙ্গে চা খাবার জন্য। আমরা হয়তো সময়ের কিছু আগেই পৌঁছেছিলাম। শ্ৰীমতী টেনিস র্যাকেট হাতে ফিরলেন। ফ্ল্যাটটি পরিপাটিভাবে সাজানো। শ্রীমতী একটি বিখ্যাত ভারতীয় পরিবারের মেয়ে। তিনি চায়ের সঙ্গে ‘টা’ ইত্যাদি খাওয়ালেন। তারপর গল্প চলল। ঘরে কয়েকটা নাচের ভঙ্গির ছবি ছিল তাই দেখে আমি শ্রীমতীকে অনুরোধ করলাম নাচ দেখাবার জন্য। তিনি রাজি হলেন। তাঁর নাচ সত্যি দেখবার মতো। পরে ইনি সৌম্য ঠাকুরকে বিবাহ করেন।
নশা সেন ইতিমধ্যে ভিয়েনা শহরে এক ‘বলরুম ডাইনিং’-এর প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলেন। একটা কাপ ও প্রথম হওয়ার জন্য ৫,০০০ শিলিং পুরস্কার নিয়ে এল। সেনের নাকি টাকার বিশেষ দরকার ছিল।
বার্লিনে চার মাস থাকার পর আমরা তিনজন: অশোক মুখার্জি, আনন্দ মুখার্জি ও আমি রওনা হলাম ‘ব্রেমেন’ শহরের দিকে। মণীন্দ্র ঘোষ বলল যে যদি লন্ডনে গিয়ে আমরা সুবিধা করতে পারি আরও দেশ ঘোরার তবে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে, না হলে বার্লিনেই সে ইতি টানল। রওনা হবার সময় ফ্রাউ স্টেলার অত্যন্ত কাতর হয়ে আমাকে সেদিন বলেছিলেন তাঁর ছেলে নাকি আমার বয়সী ছিল।
বার্লিন ছাড়তে কষ্ট হল একমাত্র নশা সেনের কথা ভেবে। আর তার সঙ্গ পাব না, হয়তো কখনও আর দেখাও হবে না।
মার্চ মাসের শেষ, কিন্তু এখনও ভীষণ ঠান্ডা ও শীত। বরফ পড়া বন্ধ হয়েছে। সুন্দর পিচের রাস্তায় সাইকেল জোরে চালাতে অসুবিধে হল না। কিছুদিন বিশ্রাম করে দুবেলা পেট ভরে খেয়ে এবং গরম ঘরে রাত কাটিয়ে মনে হচ্ছিল আমরা আরামপ্রিয় হয়ে পড়েছি। আমাদের যা টাকা জমেছিল তার একাংশ মণীন্দ্রকে দিয়ে গেলাম।
প্রথমে এমডেন শহরে পৌঁছলাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান যুদ্ধজাহাজ এমডেন সিঙ্গাপুরে আটকে পড়েছিল। সেখান থেকেই ওই জাহাজ অনেকগুলি ব্রিটিশ জাহাজ ধ্বংস করে। তারপর সমুদ্র থেকে মাদ্রাজ শহরের ওপর Shell ফেলে। পরে অনেকগুলি ব্রিটিশ জাহাজ চারদিক থেকে ঘিরে এমডেনকে ধ্বংস করে। দুঃসাহসিকতার জন্য নৌবহরের ইতিহাসে এমডেন অমর হয়ে থাকবে। এমডেন শহরের লোকেরা যুদ্ধজাহাজ এমডেন-এর কীর্তি-কলাপের জন্য খুব গর্ববোধ করে।
তারপর ব্রেমেন শহর। এটা নৌবহরের ঘাঁটি। প্রতি দশজন লোকের মধ্যে ছয়- সাতজনই নাবিক কিংবা জাহাজের কাজে যুক্ত। দেখলাম ছেলে ক্যাডেটরা সাদা ও নীল জামাকাপড় পরে ড্রিল করছে। জার্মানরা কুচকাওয়াজে সিদ্ধহস্ত। ড্রিল করতে পারলে আর কিছু চায় না।
একটা ছোট্ট শহর লিয়ারের দিকে আমরা চলেছি। কখন পৌঁছে গেছি টের পাইনি। হঠাৎ শুনলাম রাস্তার ধারে আনালিসে আমাদের নাম ধরে ডাকছে। আমরা ঠিক করেছিলাম রেলওয়ে স্টেশন হোটেলে থাকব। কিন্তু আনালিসের মাথায় অন্য বুদ্ধি খেলছিল। সে বলল যে তার বাড়ি খুব কাছেই এবং বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কোনও ওজর আপত্তি শুনল না। ওর স্বভাব ছিল এত মিষ্টি যে বেশিক্ষণ তর্ক করা চলে না। বরং তাতে রাস্তায় আরও ভিড় জমে যাবার সম্ভাবনা।
আনালিসেদের বাড়ি গেলাম। তার বাবার বেশ বয়স হয়েছে, মাথায় টাক। করুণাময়ী মা আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। সেইসময় কার্ল নামে ভাই ও এলশা নামে বোনের সঙ্গেও আলাপ হল। ভাই-বোন খুব কাছাকাছি ২০ থেকে ২৪-এর মধ্যে বয়স।
সেদিনই স্থানীয় খবরের কাগজের তরফ থেকে একজন রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফার এসে উপস্থিত। একটা ইন্টারভিউ হল আর সেইসঙ্গে ছবি তোলা। পরদিন সকালে সেই সব প্রকাশিত হল।
মিঃ বোল্ট বললেন যে আমরা তিনদিন যখন লিয়ার-এ থাকব তখন তাঁর বাড়িতেই আমরা অতিথি হব। অন্য কোথাও থাকা চলবে না। মিঃ বোল্ট অনেক বছর ব্রাজিলে কফি চাষ করেছিলেন। সেজন্য বহির্জগতের খবর রাখেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পর্তুগিজ ভাষা জানেন। আনালিসের মা অনেকক্ষণ ধরে আমার সঙ্গে গল্প করলেন। বেশিরভাগ, জানবার জন্য আমার মা বাবা ভাই বোন আছেন কিনা। সবার কথা বললাম।
কার্ল আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেল, দেখলাম ড্রেসিং টেবিলের একপাশে আমাদের ছবি। প্রথম কথা জিজ্ঞাসা করল আমি নাচতে জানি কিনা। সেন আমাকে বার্লিনে তৈরি করে দিয়েছেন এই বিষয়ে। কার্ল তখনই ঠিক করল যে সেইদিন চায়ের নাচে আমাকে এলশাকে ও তার বান্ধবীকে নিয়ে একটা বিখ্যাত রেস্তোরাঁতে যাবে।
এলশা সাধারণ জার্মানদের মতো মোটা নয়। গড়ন লম্বা ও স্বাস্থ্য ভালো। খুব ইচ্ছা আমার সঙ্গে ভাব জমাবার। কার্লের মনটা খুব পরিষ্কার, সে আমাকে নিজের ভাইয়ের মতো গ্রহণ করেছিল।
এলশা আমাকে নিয়ে লিয়ার শহর দেখতে বেরোল। রাস্তার লোকেরা কেউ কেউ ভাবল আমি রেড ইন্ডিয়ান, আর নয়তো ইতালিয়ান বা ব্রাজিলিয়ান ইত্যাদি। ইউরোপ ও আমেরিকায় কেউ ইন্ডিয়ান বলে পরিচয় দিলে দেশসুদ্ধ লোক মনে করে যে রেড ইন্ডিয়ান। আমেরিকায় বিশেষ করে হিন্দু ইন্ডিয়ান কিম্বা গান্ধীর ইন্ডিয়া অথবা টাগোরের ইন্ডিয়ার লোক বললে ভারতীয়দের ঠিক চিনতে পারে।
আমরা ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে একটা রেস্তোরাঁতে গেলাম। বিকালে কার্লের নেমন্তন্ন ছিল সেজন্য আর সময় নষ্ট না করে এলশাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে ফিরলাম।
অশোককে নিয়ে আনালিসে বেরিয়েছে। কোথায় গেছে বলে যায়নি। আনন্দ শরীর ভালো ছিল না। বাভেরিয়ান আল্পস-এ বরফের মধ্যে খুব নাস্তানাবুদ হবার পর আনন্দ আমাকে কয়েকবার বলেছে যে তার ফুসফুসে কষ্ট হয়, সেজন্য সে চলাফেরা কম করে। মিসেস বোল্টের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছিল কী মাধ্যমে তা বলতে পারব না।
বিকালে কার্ল, তার বান্ধবী, এলশা ও আমি বেরোলাম সেজেগুজে। সাজবার মধ্যে আমাদের প্রত্যেকের একটা লাউঞ্জ স্যুট ছিল। সেটি সযত্নে কম্বলের মধ্যে মুড়ে রাখতাম।
নাচের হলে অনেক তরুণ-তরুণী উপস্থিত হয়েছিল। চলতি নাচ ছিল চার্লস্টন রুম্বা। ফকসউট, ওয়ালটজ ও ট্যাঙ্গো। এলশা ও কার্লের বান্ধবীর সঙ্গে অনেক নাচলাম। এরইমধ্যে কার্ল জিদ ধরেছে আমাদের আরও দু-চারদিন থাকবার জন্য তাদের বাড়িতে।
একদিন পরেই বুঝতে পারলাম বোল্ট পরিবার অশোককে ভালো চোখে দেখে এবং একদিন সে এ বাড়ির জামাই হবে। মিঃ বোল্টের ব্রাজিল খুব পছন্দ। তিনি সেখানে বহুদিন কাটিয়েছেন। বিরাট দেশ অথচ অল্প লোকের বাস। কোনও লোক ব্রাজিলে থাকতে চাইলে কর্তৃপক্ষের আপত্তি নেই একটুও। এই ব্রাজিলের মুক্তিযুদ্ধে একটি বড় অংশ গ্রহণ করেছিলেন একজন বাঙালি— কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস। তাঁর জীবনী পড়েছি। খুব ভালো লেগেছিল। ব্রাজিলের লোকেরা তাঁকে আজও শ্রদ্ধায়
স্মরণ করে।
মিঃ বোল্ট একটা চিঠি দিলেন অশোককে পর্তুগিজ ভাষায় লেখা, লন্ডনের অ্যাম্বাস্যাডারের নামে। তাঁর মতে, ব্রাজিলে আমাদের তিনজনেরই স্থান হবে। অথচ ব্রাজিলে যাবার ব্যাপারে আমার একটুও উৎসাহ ছিল না। আমাদের চিরদিনের ইচ্ছা যদি কোথাও কোনও দেশে বাকি জীবন কাটাই তবে সে দেশ হবে ভারতবর্ষ। অশোক, আনন্দ ও মণীন্দ্রর দেশে না ফেরার একটা যুক্তিপূর্ণ কারণ ছিল। দেশের গণ্যমান্য লোকেরা আমাদের বিদেশ ভ্রমণে ও অ্যাডভেঞ্চার করতে পাঠালেন, মাসে মাসে টাকা পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। তারপর টাকা তো দূরের কথা, কেউ চিঠি লিখে আমাদের খোঁজখবরও নিলেন না। ওরা বোকা বনে দেশে ফিরতে রাজি নয়।
কেন জানি না প্রথম থেকেই আমার মনে হয়েছিল যে এইরকম পরিস্থিতি হতে পারে। মনুষ্যচরিত্র, বিশেষ করে বাঙালির— বোধহয় আমি চারজনের মধ্যে বেশি চিনতাম। সেজন্য আমার ক্ষোভ কম। মনে মনে ভাবতাম বরং দেখা যাবে ভ্রমণ সম্পূর্ণ করবার কী বা কত রকম পন্থা বের করতে পারি ভবিষ্যতে। হয়তো আমাকে একাই সারা পৃথিবী পাড়ি দিতে হবে, যদি অশোক ও আনন্দ ব্রাজিল রওনা হয় লন্ডন থেকে
ভারতবর্ষ থেকে লিয়ার পর্যন্ত আসতে বুঝেছি পৃথিবীটা কত বড়। আমরা অনেক ঘুরলেও তার সামান্য অংশই দেখতে সক্ষম হব
কার্ল এবং তার দুই বোনের আগ্রহে আমরা আরও একদিন বোল্ট পরিবারের কাছে রয়ে গেলাম।
বিদায়ের দিন এল। সবার মুখ গম্ভীর চিন্তাকুল। আমরা বোল্ট পরিবারের সঙ্গে হেসে খেলে কদিন কাটালাম। এলশা দুটো মজার কাণ্ড করেছিল যা আমার চোখে পড়ল: প্রথমটা হচ্ছে যে সে অকারণে মাস্টার্ড শিশি থেকে বের করে খাচ্ছিল। মাস্টার্ডে ঝাঁঝ, সেজন্য তার দুই চোখে জল। এমন শুধু শুধু ঝাল খেয়ে উঃ আঃ বাপরে মারে, করার অর্থ কী? তখন সে বলল যে একটা বইয়ে পড়েছে ভারতীয়রা খুব লঙ্কার ঝাল খায় তাই সে লঙ্কার বদলে মাস্টার্ড খেয়ে সহ্য করার অভ্যাস করছিল। খালি পায়ে থাকারও ওই একই কারণ। তাছাড়া সে ঘন ঘন আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল তার ভারতবর্ষ যাবার বাসনা। আমার মনে পৃথিবী ভ্রমণের নেশা তখন এত প্রবল যে তার কোনও কথায় আমার কান দেবার সময় ছিল না।
বোল্ট পরিবারের সবার মুখ বিষাদপূর্ণ করে যখন আমরা রওনা হলাম তখন পাড়ার বহু লোক এসেছিল আমাদের বিদায়ের শুভেচ্ছা জানাতে।
হামবুর্গ-এর দিকে রওনা হলাম। চমৎকার রাস্তা। খটখটে সুন্দর রোদমাখা দিন। সন্ধ্যায় আমার পরিচিত এক ভারতীয়ের নিমন্ত্রণে (ডাঃ জ্যোতিষ রায়) তাঁর বাড়িতে উঠলাম। ডাঃ রায় ল্যান্ডলেডিকে বলে আমাদের জন্য খুব সুন্দর থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।
অশোক ও আনন্দর মন খারাপ আনালিসে ও তার পরিবারের সবাইকে ছেড়ে এসে। হামবুর্গে তারা কোথাও বেরোবে না ঠিক করেছিল। ডাঃ রায় ও আমি শহর দেখতে বেরলাম। হামবুর্গ জার্মানির দ্বিতীয় বড় শহর এবং তিনটে ছোট শহর একত্র হওয়ার ফলে হামবুর্গের লোকেরা নানা কাজে, শিল্পে, জাহাজের কারবারে বিত্তশালী হয়ে উঠেছিল। হামবুর্গ, আলটোনা ও হারবুর্গ মিলে একটা বেশ বড় শহরে পরিণত হয়েছিল। প্রথমেই গেলাম জার্মানির সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর— ভেরথাইর্ম দেখতে। তিনজোড়া গরম মোজা কিনলাম।
ডাঃ রায় Tropical disease নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। হামবুর্গের স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন দেখতে গেলাম। সেখানের কর্ণধার বিখ্যাত ডাক্তার ম্যুলরের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি অনেক ভারতীয় গবেষককে চেনেন যারা তাঁর কাছে কাজ শিখেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ভারতীয় ছাত্রদের সম্বন্ধে আপনার কি মত? বৃদ্ধ ম্যুলর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভারতীয় ছেলেরা জার্মানদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। তারা সহজেই বিষয়বস্তু বুঝতে সক্ষম হয়। সব সময় লক্ষ করেছি যে তারাই ক্লাসে বা পরীক্ষায় প্রথম স্তরের ছাত্র। অথচ বেশিরভাগ ভারতীয়রা পরীক্ষায় পাশ করার পরই লেখাপড়ায় বা গবেষণায় ইস্তফা দেয়। আর আমাদের ভোঁদা জার্মান ছেলেরা কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করার পর সত্যিকারের পড়া ও গবেষণা আরম্ভ করে। তখনই তারা বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে এবং তার গবেষণার ফল পুস্তকাকারে প্রকাশ করে থাকে আর সেসব পড়েই ভারতীয় ছেলেরা পরীক্ষায় পাশ করে।
ডাঃ ম্যুলর মারা যাবার অল্পদিন পরে তাঁর প্রিয় ছাত্র জ্যোতিষ রায় গবেষণা ক্ষেত্রে অনেকগুলি অবদান প্রকাশ করলেন এবং পরে সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে উঠলেন। তখন ভারত সরকার তাঁকে ডিরেক্টর জেনারেল অব বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মেডিসিন পদে উন্নীত করল। বেঁচে থাকলে ডাঃ ম্যুলর অন্তত জ্যোতিষ রায়ের ক্ষেত্রে তাঁর ভুল স্বীকার করতেন।
ডাঃ ম্যুলর তাঁর স্ত্রীকে টেলিফোন করে বললেন যে সঙ্গে দুজন ভারতীয়কে নিয়ে তিনি শীঘ্রই বাড়ি যাচ্ছেন লাঞ্চ খেতে।
হামবুর্গ ছেড়ে অস্ট-ফ্রিজল্যান্ড-এর দিকে এগোলাম। এখানকার গরু দুধের জন্য বিখ্যাত। ফ্রিজল্যান্ড ডেয়ারি ফার্মিং-এর জগৎপ্রসিদ্ধ গরুগুলি মাঠে দাঁড়িয়ে রয়েছে বা ঘাস খাচ্ছে। দেখলে মনে হয়, তাদের স্তন দুগ্ধভারাবনত—জোরে চলতে তাদের কষ্ট হয়, ছুটে যাওয়া তো দূরের কথা। দুধে মাখনের অংশ শতকরা সাতের কম নয়। পরে এমনটি ডেনমার্কেও দেখেছি। আমাদের দেশে একমাত্র মোষের দুধই এই পরিমাণ মাখনবহুল।
এই দেশের লোকেরা ফ্লেমিশ ভাষায় কথা বলে। বোঝা যায় জার্মানের থেকে অন্যরকম।