যে গল্পের শেষ নেই – দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
যে গল্পের শেষ নেই – দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
ফ্ল্যাপ-১
‘যে গল্পের শেষ নেই’ … আমি নিজেই শুধু বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়িনি-ছেলেদের এবং সাধারণ মানুষদের পড়াচ্ছি। তারা কি বোঝে কতখানি বোঝে কিভাবে বোঝে যাচাই করার জন্য। কঠিন কথা, একেবারে অজানা কথা সহজ করে বুঝিয়ে বলা বা লেখার চেয়ে কঠিন কাজ জগতে খুব কমই আছে। বৈজ্ঞানিকদের জন্য বিজ্ঞানের বই লেখার সময় জানা থাকে তারা কতটা বোঝেন না।—কিন্তু অজ্ঞদের বেলা পড়তে হয় মুস্কিলে। তাদের মগজে কি আছে আর কি নেই—যা আছে তার স্বরূপ কি-এসব আন্দাজ করা কঠিন। অথচ শুধু এটুকু আন্দাজ করলেই চলে না। প্ৰতিনিয়ত তাদের মগজটা কি দিয়ে কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তা না জানলেও চলে না…
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
.
ফ্ল্যাপ-২
দর্শনের ছাত্র। জীবনদর্শনের অন্বিষ্ট উপায় হিসাবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন অধ্যয়ন তথা লেখনী চালন। এই লেখার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ছিল দুঃসাহসী অভিযান, নূতন পথের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা—যা কোথাও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং কোথাও বিশেষভাবে সমালোচিত। কিন্তু তার মানসিকতা ছিল অভিযাত্রীর-সেখান থেকে তিনি অস্থলিত। কি ছিল তার নিরীক্ষা-পরীক্ষার বিষয়? তা ছিল এক প্রকার দর্শন-বিজ্ঞানের সমন্বয়-যেটা আমি মনে করি দর্শনের ছাত্রের পক্ষেই সহজ ও সম্ভবপর। দর্শন পদ্ধতি একটা সামগ্রিক দিগদর্শনের মতো। তিনি সেই পন্থায় মানব জীবন ও মানব সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে প্রথমদিকে অনেকগুলি সহজপাঠ্য (বিজ্ঞানভিত্তিক না হলেও) বিজ্ঞানমুখী গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলি তার শিক্ষক জীবনের প্রথম দিকে লেখা। অনুমান করতে পারি—আমাদের দেশের সর্বত্র দর্শনশাস্ত্র পঠন পাঠনের যে ব্যবস্থা আছে তার ঐকাদেশিকতা এবং বিজ্ঞানভিত্তিকতার অভাব তাঁর মতো সমাজ-সচেতন রাজনীতি-করা লোকের কাছে অসুবিধাজনক ঠেকেছে। সুতরাং প্রাথমিক কাজ হিসাবে তিনি নিজেকে মনস্তত্ত্বের ছাত্র হিসাবে তৈরি করলেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী হয়ে উঠেছে সমাজ-তাত্ত্বিক, সাম্যবাদী এক ইতিহাসনিষ্ঠ মানুষের। সে সময়কার গ্রন্থগুলির বক্তব্য তিনি পরে পূর্ণ থেকে পূর্ণতর করেছেন পরবর্তী রচনাগুলিতে। বিশ্ববিজ্ঞানদৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয়েছে প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের তথ্য বিশ্লেষণে এবং আধুনিক মতবাদের সাহায্যে পরিবেশনায়। এই তার সত্যকার দেশপ্ৰেম, মানবহিতৈষন তথা আত্মবিষ্কারের সুপরিণত উপলব্ধি বলে মনে হয়েছে।
গোপাল হালদার
.
ফ্ল্যাপ-৩
গল্প আবার সত্যি হয় নাকি? হয়, যদি সে গল্প হয় মানুষের, আর গল্পটার ভিত্তি যদি হয় বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদী ইতিহাস। লৌকিক-দৈবিক, উচিত-অনুচিত, বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞান, সৃষ্টি-ধ্বংস সমস্ত কিছুর পেছনেই আমরা কেবল মানুষকে, মানুষ আর প্রকৃতির দ্বন্দ্বকেই দেখতে পেয়েছি। প্রকৃতির বুকে মানুষের সেই উদ্ভব বিবর্তন আর বিকাশের কথা সঠিকভাবে না বুঝলে, মানুষকে নিয়ে কোনো কথা বলার জোর থাকে না সব সময়। কাজেই, সহজভাবে, যথাসম্ভব পরিপূর্ণভাবে এসব বোঝার তাগিদ আমাদের বরাবরই ছিল। প্রাক মানুষ, মানুষ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব রাজনীতি ইত্যাকার বিষয় নিয়ে বিস্তর মোটা-মোটা কেতাব লেখা হয়েছে, রয়েছে অতি-মূল্যবান রেফারেন্স বই কিংবা এনসাইক্লোপেডিয়া। কিন্তু এগুলো থেকে মানুষের কথা ঠিক যেন মনপ্ৰাণ দিয়ে বোঝা যায় না; হয়তো মুখস্থ করা যায়, কিন্তু মন ভরেনা যেন সাধারণ সহজ-বুদ্ধির পাঠকদের। পাঠকদের অতৃপ্তিকে মিটানোর জন্যই দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর ‘যে গল্পের শেষ নেই’ বইটি। ঠিক যেন পাঠকরা যা চাইছিল তাই বলেছেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বইটিতে। একেবারে গল্প বলার মতো অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্যময় প্ৰাঞ্জল কথা কাহিনীতে ভরা। একটুও প্রাচীনত্ব, একটুও জড়ার লক্ষণ নেই। শুধুই মানুষের কথা বইটির প্রতিটি পাতায় হোক না তা বহু বছর আগের লেখা, কথাগুলো তো আজও সত্যি।
.
ভূমিকা
ফরমাস পেয়েছিলাম এমন গল্প বলতে হবে যে-গল্পের শেষ নেই। এ-হেন গল্প অবশ্য অনেক আছে, কিন্তু তার মধ্যে বেশির ভাগই ফাঁকির গল্প। অথচ যার কাছ থেকে ফরমাস তাকে কোনোমতেই ফাঁকি দেওয়া যায় না।
ফাঁকিও থাকবে না, শেষও থাকবে না,-এমনতরো গল্প শুধু একটাই। সেটা হলো মানুষের গল্প। কতো কোটি বছর আগে শুরু হয়েছে এই গল্প তার খাঁটি হিসেব করাই দায়, আর আজো কোটি কোটি খবরের কাগজের পাতায় সরগরম এই গল্প। আরো অনেক কোটি খবরের কাগজ ছাপিয়েও এ-গল্প শেষ করা যাবে না। গল্পটা বেড়েই চলেছে।
তাই শুরু করতে গেলাম মানুষের গল্প। কিন্তু শুরু করতে গিয়ে দেখি বড় মুশকিলঃ মানুষের গল্প বলতে গেলে মানুষের কথা থেকে শুরু করা যায় না। কেননা, এককালে পৃথিবীতে মানুষের টিকিটি খুঁজে পাবার জো ছিল না। আবার তারও আগে-ঢ়ের আগে—দুনিয়ার কোথাও চিহ্ন ছিল না পৃথিবী বলে কোনো কিছুর।
ভয় পাবার ভান করলাম, বললাম, ‘থাক্ থাক্। তোমাকে আর অতোখানি কষ্ট করতে হবে না; গল্প বলতে আমি রাজি হলাম।’
‘বেশ’, মেয়েটি আমার খাটের ওপর জাঁকিয়ে বসলো আর বললে, ‘তাহলে শুরু করো তোমার গল্প।’
আমি বললাম, শুরু তো যা-হোক একটা করে দেওয়া যায়। কিন্তু ভাবছি, শেষ করবো কেমন করে?’
মেয়েটি অম্লান বদনে বললো, ‘শেষ করা নিয়েই যদি অতো ভাবনা তাহলে শেষ না হয় না-ই করলে!’
আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, ‘তার মানে?’
‘কেন? তার মানে, এমন গল্প বলে যাও যে-গল্পের শেষ নেই।’
আমি বললাম, ‘এ তো ভারি ফ্যাসাদের কথা হলো। কেননা, শেষ নেই এমন গল্প বেশির ভাগই হলো ফাঁকির গল্প। অথচ, তুমি লোকটি এমনই চালাক যে তোমাকে ফাঁকি দেওয়া তো চলে না।’
‘উঁহু, রুণু বললো, ফাঁকি দেওয়া চলবে না। এমন গল্প বলতে হবে যার মধ্যে একটুও ফাঁকি নেই।’
এমনতরো ফরমাস পেলে সবাই খুব বিপদে পড়ে। আমিও খুব বিপদে পড়লাম। বললাম, ‘শেষও থাকবে না, ফাঁকিও থাকবে না।—এ-রকম গল্প যে একটাই আছে। কিন্তু সেটা শুনতে কি তোমার ভালো লাগবে?’
‘কেন? কার গল্প সেটা? লক্ষী-পেঁচার না হুতোম-পেঁচার?’
‘সেই তো বিপদ। লক্ষী-পেঁচারও নয়, হুতোম-পেঁচারও নয়। সেটা হলো তোমার গল্প, আমার গল্প, আমাদের সবাইকার গল্প। তার মানে, মানুষের গল্প। আবার তার মানে গল্পই। নয়, সত্যি কথা; পণ্ডিত ভাষায় যাকে বলে ইতিহাস।’
‘উঁহু। ও সব পণ্ডিত ভাষা বলা চলবে না।’
‘তা না হয় নাই বলবো।’
‘তাছাড়া, এ-গল্প তুমি জানলে কোথা থেকে?’
‘আমি জেনেছি, বই-টই পড়ে।’
‘বইতে কি সব সত্যি কথা লেখা থাকে?’
‘সব বইতে নয়’, আমি বললাম, অনেক বইতে সত্যি কথা লেখা থাকে, আবার অনেক বইতে মিথ্যে কথা লেখা থাকে। যে-সব বইতে সত্যি কথা লেখা থাকে। সেগুলোর পণ্ডিত নাম হলো বৈজ্ঞানিক বই।’
‘না না, আর বলবো না।’
‘তুমি কি সেই সব বই থেকেই গল্পটা বলবে?’
‘তইতো ভাবছি।’
‘বেশ। শুরু করো তোমার গল্প। কিন্তু মনে থাকে যেন—শেষও করতে পারবে না, ফাঁকি দিতেও পারবে না।’
‘শুরু করছি! কিন্তু তার আগে একটা কড়ার করতে হবে। কথায় কথায় তুমি আমাকে এ-রকম জেরা করতে পারবে না; কেননা, তাহলে কথায় কথায় আমার গল্প থুবড়ে পড়বে, এগুতে পারবে না।’
‘রাজি আছি’, রুণু বললো।
আর আমি শুরু করলাম আমার গল্প।
Leave a Reply