বিজ্ঞান : কী ও কেন

বিজ্ঞান : কী ও কেন 

যুদ্ধ বলে ব্যাপারটা অবশ্য পৃথিবীতে নতুন নয়। আদিম কাল থেকেই এন্দলে-ওদলে লড়াই হয়েছে। মধ্যযুগ ধরে এদেশে-ওদেশে যুদ্ধ হয়েছে। আজকের মুনাফা-বিহ্ল আমাদের নায়কেরা লুটপাট, বোম্‌বেটগিরি আর যুদ্ধ করেই বড়ো বড়ো কলকারখানা গড়বার মূলধন জুটিয়েছে। তবুও তাদের মনের মতো সমাজে—যাকে বলে কিনা। ধনতত্ত্ব-সংকট যতোই ঘনিয়ে আসতে লাগলো ততোই এই যুদ্ধের যেন জাত-বদল হতে লাগলো। আগেকার কালের যুদ্ধে যতো মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার আয়োজন শুরু হয়েছে আর আজকের দিনের যুদ্ধে যতো মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার আয়োজন শুরু হয়েছে।—এই দুই-এর হিসেবে একেবারে আকাশপাতাল তফাত। এমনকি পৃথিবীটাই থাকবে কিনা নাকি মরা ছাই-এর একটা দালায় পরিণত হতে চলেছে সে প্রশ্নও আজ আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না! এমনই ভয়ংকর আজকের দিনে, যুদ্ধের তোড়জোড় থেকে অনেক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। 

মানুষ শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থায় পৌছালো কেন? ব্যাপারটা খতিয়ে বুঝতে গেলে কিন্তু, পিছন ফিরে তাকাতে হবে। আর তাকাতে যদি রাজি হও তাহলে একটা আশ্চর্য ব্যাপার চোখে পড়বে। তাকেই বলে একালের বিজ্ঞান! কথাটা শুনলে হয়তো প্রথমটায় চমকে উঠবে। ওঠবারই তো কথা। কেননা, আধুনিক বিজ্ঞানের সদরদের যারা খুলেছিলেন তাদের চোখের সামনে ছিল একেবারে অন্য একটা ছবি। মানুষের অনন্ত বা অফুরন্ত কল্যাণের ছবি। তাদের কাছে প্রকৃতিকে দিনের পর দিন আরো ভালো করে চিনে আর তারই ভিত্তিতে আয়ত্তবে এনে মানুষের কল্যাণ সাধনের বুঝি শেষ নেই। আর সেই বিজ্ঞানই কিনা আজ মানুষকে আতঙ্কে বিহ্বল করবার মতো এক জুজুবুড়ির রূপ ধরতে চাইছে! জুজুবুড়ি অবশ্যই গল্পকথা। কিন্তু আজকের আতঙ্কটা মোটেই তা নয়। অতি বড়ো সত্যি বলে যদি কিছু ভাবা যায় তাহলে সেই–জাতেরই ব্যাপার। 

এমনটা হলো কেন? তাহলে কি বিজ্ঞানের পথে এগুতে গিয়ে মানুষ গোড়াতেই একটা মস্ত ভুল করে বসেছে? আগেকার কালে দুঃখ ছিল, দৈন্য ছিল, ছিল নির্যাতিত মানুষের বুক ফাটা কান্না। আধুনিক বিজ্ঞানের যখন জন্ম, তখন তার প্রতিজ্ঞা মানুষকে 

এসবের হাত থেকে চিরকালের মতো মুক্তি দিতে হবে। কোথায় গেল সেই প্রতিজ্ঞ, সেই শপথ? তার বদলে আজ হঠাৎ এমন বিভীষিকা, একেবারে রসাতলে পাঠাবার এ-হেন আতঙ্ক? 

প্রশ্নটার উত্তর ভালো করে বুঝতে হবে। না-হলে আমাদের গল্পের আসল কথাটাই অস্পষ্ট থেকে যাবে। 

আধুনিক বিজ্ঞানের যখন সবে শুরু তখন এই বিজ্ঞান বলতে সত্যিই মাত্র কতোটুকু? আজকের দিনের তুলনায় তা যেন নেহাতই ছেলেখেলার ব্যাপার। কিন্তু তারপর-দিনের পর দিন—মানুষেরই চেষ্টায় বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে। যতো এগিয়েছে ততোই বেড়ে চলেছে তার এগুবার গতি। এগুবার হারটা খুবই বড়ো কথা। হিসেব করলে দেখা যাবে, গত পঞ্চাশ বছরে বিজ্ঞান যতোটা এগিয়েছে তার তুলনায় আগেকার কালের পুরো পাঁচ হাজার বছরের মোট অগ্রগতিও যেন তুচ্ছ!-

কিন্তু বিজ্ঞান যতোই এগিয়েছে–যাতো এগুচ্ছে–ততোই তার নিজের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। আগেকার কালে একজন বিজ্ঞানী একাই তার পুরো গবেষণার ভার নিতে পারতেন। কিন্তু একালে আর তা সম্ভব নয়। অত্যন্ত জটিল আর রকমারি যন্ত্রপাতি দরকার হয়, দরকার হয় সাহায্য করবার জন্যে একদল সহকারী কর্ম। এসবের খরচ এমনই বেশি যে বিজ্ঞানীটির পক্ষে নিজের থেকে যোগানো অসম্ভব। তাহলে টাকাটা আসে কোথা থেকে? বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, সরকার থেকে। কিন্তু সরকারের ভাড়ারে আমন বিশাল টাকা ঢালবে কে? খাজনা-টাজনা বাবদ সরকারের যা আয় তা ছাড়াও ঢের ঢের টাকা দরকার। কোথা থেকে আসবে বিজ্ঞানের গবেষণার জন্যে বাড়তি বিশাল টাকাটা? কোটিপতিদের কাছ থেকে ছাড়া আমন কোটি কোটি টাকা পাবার আর কি উপায়? অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত রাঘব বোয়ালের মতো বড়ো বড়ো শিল্পপতিদের কাছ থেকেই। হয়তো সরাসরি নয়; অনেক সময় সরকারি ভাঁড়ার ঘুরে, অনেক সময় বৈজ্ঞানিক গবেষণার কেন্দ্র ঘুরে বড়ো বড়ো বিশ্ববিদ্যালয় মারফত কখনো বা। কিন্তু শিল্পপতিরা তো দানছত্র খুলে বসে নি। তাদের একমাত্র হিসেব বলতে মুনাফা— অগাধ মুনাফা। বিজ্ঞানের গবেষণার জন্যে তারা যে খরচটা করতে রাজি সেটার পেছনেও একই উৎসাহ, একই উদ্দেশ্য। তাই সাধারণ মানুষ জানুক আর নাই জানুক, ওই শিল্পপতিদের প্রতিনিধিরা সরকারে জাঁকিয়ে বসে; জাঁকিয়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয় আর গেবষণাকেন্দ্রগুলির পরিচালক সমিতিতে। এরাই একটা নীতি বেঁধে দেবেঃ বৈজ্ঞানিক গবেষণার যে ফলাফল তা কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে। কথাটা আমেরিকা-ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশে অতি বড়ো সত্য। 

একই গবেষণার ফল মোটের ওপর দুরকম উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। মানুষের কল্যাণ বা মানুষের সর্বনাশ। নমুনা হিসেবে দু-চার কথা বলে রাখা যায়। বিজ্ঞানের অগ্রগতি হতে হতে আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে তা ঠিকমতো বুঝতে পারাই দুস্কর এবং এই ফল মানুষকে দিয়েছে দুর্বর শক্তি। একদিকে পুরো দুনিয়া থেকে অন্নাভাব, চিকিৎসার অভাব একেবারে চিরকালের মতো মুছে ফেলবার শক্তি; অন্যদিকে অতি ভয়ংকর জীবাণু-অস্ত্র তৈরি করার শক্তি, দেশকে-দেশ একেবারে শ্মশানে পরিণত করবার মতো ক্ষমতা। 

প্রশ্নটা তাই, এই সব শক্তিকে কোন উদ্দেশ্যে নিয়োগ করা হবে? প্রশ্নটার মাত্র দুটো উত্তর সম্ভব। মানুষের কল্যাণ আর মানুষের ধ্বংস। ওই সব একই শক্তি মানুষের কল্যাণে লাগালে প্ৰায় যেন রাতারাতি দুনিয়ার চেহারাটাই বদলে দেওয়া যায়। প্রায় অফুরন্ত শক্তির ভাণ্ডার পারমাণবিক শক্তির। জীববিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার কাজে লাগাতে পারলে কৃষিকাজ থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান পর্যন্ত সর্বত্রই মানুষের কী অনন্ত আশা সকলের নাগালেই খাদ্য ও রোগমুক্তির সম্ভাবনা এমন অসম্ভব বেড়ে যায় যে তা প্রায় কল্পনার অতীত। পৃথিবীর নানা অনুন্নত দেশের মানুষ আজ প্রায়ই নিরান্ন, অনেক দেশেই উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কাতারে কাতারে মানুষ মরছে। আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞান ঠিকমতো প্রয়োগ করতে পারলে পৃথিবী থেকে দুঃখ-দারিদ্র অভাব অনটন কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। 

কিন্তু দায় পড়েছে ওসব কথা ভাববার। মালিকদের হিসেবের খাতাটাই অন্য রকম। তাতে শুধু মুনাফার হিসেব। তাই সরকার থেকে শুরু করে গবেষণাকেন্দ্রগুলোয় তাদের যারা তাবেদারি করছে তারাও প্রভুদের স্বার্থে এই হিসেবের গণ্ডি পেরুতে নারাজ। কিন্তু বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো কোন কাজে লাগাতে পারলে ওই মুনাফার চাহিদা সবচেয়ে ভালো করে—সবচেয়ে বেশি করে মেটানো যায়? যুদ্ধের জন্যে ভয়ংকর সব মারণাস্ত্র তৈরি করতে পারলে। পরমাণু শক্তি চালিত একটা ডুবোজাহাজ বা উড়োজাহাজ বোঝাই একটা যুদ্ধের জাহাজ তৈরির ফরমাস পেলে তার থেকে যে নগদ লাভ তার কি কোনো সীমা পরিসীমা আছে? এ-হেন শুধু একটা জাহাজ বানাতে যা খরচা তাই দিয়ে আফ্‌রিকার ছোটোখাটো একটা পুরো দেশের চেহারাই তো পাল্টে দেওয়া সম্ভব; সেখানে আর অর্ধভুক্ত, অর্ধনগ্ন, রোগাক্রান্ত কোনো একটি মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না! কিন্তু শিল্পপতিদের তাতে কী আসে যায়? মুনাফা মিলবে কিছু? কতোটা? 

বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে মারণাস্ত্র তৈরি করার কাজে লাগানোর আরো একটা মস্ত সুবিধে আছে। সাধারণ জীবনে ব্যবহারের জন্যে কাপড়-চোপড়ের মতো জিনিস তৈরি করবার মহা ঝামেলার কথা আগেই বলেছি। কিনবে কে? বাজারের তো একটা সীমা আছে। খদেরদের নাগালের বাইরে বাড়তি জিনিস তৈরি হলে অনেক সময়ই ইচ্ছে করে তা নষ্ট না করে উপায় নেই। নইলে এসব জিনিসের দাম এমনই পড়ে। যাবার ভয় যে, মুনাফার কথা ভুলে যেতে হয়। কিন্তু যুদ্ধের অস্ত্র তৈরির ব্যাপারে এই ভয় একে বারেই নেই। বাজার যেন অফুরন্ত। শুধু রটিয়ে দিতে পারলেই হলো, দেশের সঞ্চিত অস্ত্রশস্ত্রগুলো মামুলি হয়ে গেছে; তাই অন্য দেশের তুলনায় অনেকটাই অকেজো—যুদ্ধ লাগলে আগেকার অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে কাজ চলবে না। ব্যস! এই কথাটি রটিয়ে দেওয়া মাত্রই 

দেশের সাধারণ লোকের মধ্যে থেকেই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। বাতিল করো ওই সব মামুলি অস্ত্র; আধুনিক অস্ত্র তৈরি করার জন্যে নতুন ফরমাস দেওয়া হোক। কথাটা কায়দা-মাফিক রটাবার একটা সোজা উপায়ও আছে। যুদ্ধে যারা সেনানায়কের কাজ করে সবে অবসর নিয়েছে এহেন বেশ কিছু লোককে সরকারের নীতি বা পরিকল্পনা-নিয় সমিতিতে বসিয়ে দাও; আমন অভিজ্ঞ লোকের পরামর্শে সাধারণ মানুষ বরং খুশিই হবে। আর এহেন অভিজ্ঞ লোকগুলিকে খুশি করবার সবচেয়ে সোজা কায়দা এদের দেদার টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখো। সরেফ ঘুষ? শব্দটা বড্ড খারাপ। শুনতে কানে লাগে। কিন্তু বোধহয় খেতে ভালো। যারা খায় তারা খুশিই হয়। আর কর্তাদের কাছ থেকে এইভাবে অজস্র টাকা পেলে তারা বিশেষজ্ঞ হিসেবে অনায়াসেই ঘোষণা করবে; আগেকার কালের অস্ত্রশস্ত্রগুলো ফেলে শিল্পপতিদের ফরমাস দাও নতুন আর আরো মারাত্মক অস্ত্র তৈরি করতে। কী করে করা যায়? তার জন্যে তো বিজ্ঞানের গবেষণা চলছে। কাজে লাগাও সেই বিজ্ঞানকে। 

কথাগুলো হয়তো খুব সোজা করে বললাম। কিন্তু সোজা ভাষায় বললেই সত্যি কথাটা মিথ্যে হয়ে যায় না। টি ভি থেকে শুরু করে সবরকম প্রচার যত্তরেরও মালিক ধনতান্ত্রিক দেশের যে-বাস্তুঘুঘুরা ছলে-বলে লোকের সামনে রকমারি মিথ্যে কথার ডালি সাজিয়ে, আর আরো অনেক উপায়ে সাধারণ লোকেরই ভোট কুড়িয়ে সরকার জাকিয়ে বসে, দিনকে রাত বানায়-সাধারণ লোকই তো তাদের ভোটের পান্ধি কাধে বয়ে সরকারে বসিয়েছে। তার জন্যে কতো খরচা করতে হয়েছে সে-সবের হিসেব করে লাভ কি! সেই খরচাই হাজার গুণ বেড়ে, ফেঁপে ফুলে কী রকম চেহারা নেবে, সেইটেই আসল হিসেব। 

পারলে লাগাও যুদ্ধ। যুদ্ধ লাগাতে না পারলেও একটা গোল-গোল রব তো তোলা যায়। ওই বুঝি শক্রর পাল এলো বলে। তাকে যুদ্ধ বলে না। বলে ঠাণ্ডা যুদ্ধ। অনেক সময় ওতেই চলে। সাপও মরে, লাঠিও ভাঙে না। যুদ্ধের আয়োজন করতে করতেই পাহাড়-প্রমাণ মুনাফা জোটে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *