মানুষের শত্রু মানুষ
মানুষের গল্প হলো পৃথিবীকে জয় করবার গল্প।
কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করি : একজন মানুষ পৃথিবীকে কতোখানি জয় করতে পারে? পৃথিবীর কাছ থেকে কতোটা জিনিস আদায় করতে পারে? ফলাতে পারে কতোটা ফসল, বুনতে পারে কতোটা কাপড়, গাঁথতে পারে কতোখানি ঘর?— এক কথায় কোনো জবাব দিতে পারবে? নিশ্চয়ই নয়। কেননা, জবাবটা অন্য একটা জিনিসের ওপর নির্ভর করছে, সে-জিনিসটার নাম হলো হাতিয়ার। হাতিয়ারটা যদি নেহাত বাজে ধরনের হয় তাহলে তাই দিয়ে প্রাণপণ খেটে একজন মানুষ পৃথিবীর কাছ থেকে বড়ো জোর এতোটুকু জিনিস আদায় করতে পারবে যা দিয়ে কোনোমতে নিজের জানটুকু বাঁচে। কিন্তু হাতিয়ারটা যদি খুব ভালো হয়? তাহলে নিশ্চয়ই অনেক জিনিস। যেমন ধরো, ছুঁচোলো পাথরের একটা টুকরো হাতে একজন মানুষ সারাদিন ভূতের মতো খেটেও, হয়তো আধ কাঠা জমি কোপাতে পারবে না, কিন্তু সেইমানুষকেই যদি একটা কলের লাঙল দাও তাহলে তার পক্ষে দিনে অমন বিশ-পঞ্চাশ বিঘে জমি চাষা অসম্ভব নয়। হাতিয়ার যতো ভালো, যতো উন্নত, পৃথিবীকে জয় করতে পারা যায় ততো বেশি করে ততো ভালো করে। দিনের পর দিন মানুষের হাতিয়ার অনেক উন্নত, অনেক ভালো হয়েছে। তাই দিনের পর দিন মানুষ পৃথিবীকে জয় করে চলেছে। অনেক অনেক বেশি করে। মানুষের দিগ্বিজয়ের যেন শেষ নেই।
কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে রাখতে হবে, এই দিগ্বিজয়ের কথার উলটো পিঠেই লেখা আছে এক ধরনের পরাজয়ের কাহিনী। এতো যে গৌরব তারই সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশ্ৰী আর নোংরা লজ্জার ব্যাপার। সেই ব্যাপারটার কথা বলি।
মানুষ চাষবাস করতে শিখলো, পশুকে পোষ মানাতে শিখলো, আর তারও ঢের পরে শিখলো লোহা গলাতে : দেখা গেলো মানুষের ক্ষেতে মানুষের পোষা জানোয়ার মানুষের তৈরি লোহার লাঙল টানছে—পৃথিবীকে যে কতোখানি জয় করতে পারা তা বুঝতে পারছে। নিশ্চয়ই। ফলে মানুষের জীবনে যেন আকাশ-পাতাল তফাত দেখা দিলো। আকাশ-পাতাল তফাত নয় কি? পৃথিবীর কাছ থেকে কতো বেশি জিনিস আদায় করতে পারা—এতো বেশি যে আগেকার তুলনায় আকাশ-পাতাল তফাতই। তাই মানুষের পক্ষে ওই পশুপালন আর চাষবাস করতে শেখাটাকে দারুণ রকম এগিয়ে আসাই বলতে হবে। কতোখানি বাড়লো। মানুষের শক্তি! কতোখানি বাড়লো মানুষের সম্পদ!
তবুও কিন্তু ভুললে চলবে না, এতোখানি এগিয়ে আসতে গিয়ে মানুষ যেন পেছনে ফেলে এলো একটা মস্তবড়ো আনন্দ আর শান্তির দিক। সেটা হলো, আগেকার কালের ওই সমানে-সমান সম্পর্ক। দিনের পর দিন মানুষ কতো এগিয়ে চলেছে সেই গল্পের জের একটু পরেই আবার ধরবো। কিন্তু যে-জিনিসটাকে মানুষ পেছনে ফেলে এসেছে সেইটার কথা ভুললে চলবে না। কেননা, অনেক দূর এগিয়ে, অনেক অনেক ঐশ্বর্যের মালিক হয়েও, আজকের দিনের মানুষ বুঝতে পারছে ওই সমানে-সমান সম্পর্কটাকে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হবে। তা নইলে, মানুষের জীবনে আনন্দ নেই, সুখ নেই, শান্তি নেই। তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে আজকের দিনের
মানুষ আগেকার কালের সেই ছেলে-মানুষের দশায় ফিরে যেতে চাইবে। সে জীবন যে অসহ্য অভাব আর অসহ্য দৈন্যের জীবন। সেখানে ফিরে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটাকে নতুন করে পাতাতে হবে। আর নতুন করে পাতাবার সময় খেয়াল রাখতে হবে সমানে-সমান হয়ে বঁচবার দিকে। তাই, উন্নতির পথে এগিয়ে চলতে চলতে মানুষ যে-জিনিসটা পেছনে ফেলে এসেছে।— আদিম যুগের সেই সমানে-সমান সম্পর্ক-সেই সম্পর্কটাকে আজ আবার নতুন করে। কিন্তু ঢ়ের উন্নতভাবে ফিরিয়ে আনবার দরকার। একটু ভাবলেই দেখতে পাবে, সেই সম্পর্কটা পেছনে ফেলে আসবার দরুন মানুষের আসলে কতো রকমের ক্ষতি হয়েছে, জুটেছে কত রকমের দুঃখ।
এর আগে পর্যন্ত মানুষের দল থাকতো মিলে-মিশে, একসঙ্গে। দলের মধ্যে সকলেই সমান। বড়োলোক-ছোটোলোকের তফাত নেই, তফাত নেই বড়োমানুষ-গরিব মানুষের, সকলেই মেহনত করে, আর সবাইকার মেহনতের যা মোট ফল তা দলের সবাইকার মধ্যে মোটামুটি সমান ভাগে ভাগ করে দেবার ব্যবস্থা। কিন্তু পৃথিবীকে বেশি করে, ভালো করে, জয় করতে শেখবার পর ওই পশুপালন আর চাষবাষ শেখবার পর-ভেঙে গেলো মানুষেমানুষে সেই সমানে-সমান সম্পর্ক। দেখা গেলো, মানুষের দল দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে শুধু একভাগ মানুষের ওপরেই মেহনতের আসল দায়টা,—আর একদল মানুষ গতির খাটায় না, আয়েস করে। কিন্তু যারা মেহনত করে তাদের কপালেই যতো দুঃখ ৪ তারা ভালো করে খেতে পায় না, পরতে পায় না, পায় শুধু ততোটুকু জিনিসই যা নইলে কোনোমতে জান বাঁচে না। অথচ মানুষের যা-কিছু জিনিস তার সবটুকু ওদেরই মেহনত দিয়ে তৈরি। তার মানে, ওদের মেহনত দিয়ে তৈরি জিনিস অন্যরা কেড়ে নেয়। অন্যেরা মানে কারা? ওই যারা শুধু আয়েস করে তাদের দল। তার মানে, একদল মানুষ মুখে রক্ত তুলে মেহনত করছে আর একদল মানুষ সেই মেহনতের ফল লুঠ করছে, মজা মারছে। যারা মেহনত করছে তারা সবাই ছোটোলোক আর গরিবলোক; যারা লুঠ করছে তারাই হলো বড়োলোক, তাদেরই খাতির সব চাইতে বেশি। এইটেই হলো নোংরা ব্যাপার, বিশ্বী ব্যাপার; এইটের কথা ভুলে গেলেও ভুল হয়ে যাবে।
ব্যাপারটা শুরু হলো কেমন করে আগে তাই বলি। যতোদিন মানুষের হাতিয়ার খুব বাজে ধরনের ততোদিন পর্যন্ত এ-রকম কোনো ব্যাপার শুরু হওয়া সম্ভবই নয়। কেননা, ওই হাতিয়ার হাতে সারাদিন মেহনত করে একজন মানুষ যতোটুকু জিনিস জোগাড় করতে পারে ততোটুকু দিয়ে কোনোমতে তার জান বাঁচে। তাই এ-অবস্থায় কারুর পক্ষেই অপরের মেহনত দিয়ে তৈরি জিনিস লুঠ করবার কথা ওঠে না। লুঠ হয়ে গেলে, যার মেহনত সেবেচারা যে প্ৰাণেই মারা যাবে, আর যদি প্ৰাণেই মারা যায় তাহলে সে আর মেহনত করবে: কেমন করে? কিন্তু হাতিয়ার উন্নত হবার পর অন্য কথা। তখন থেকে পৃথিবীকে বেশি করে জয় করতে শেখা। তাই, তখন থেকে সম্ভব হলো মানুষের পক্ষে বাড়তি জিনিস তৈরী করতে পারাঃ নিছক নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার পক্ষে যতোটুকু
জিনিস দরকার তার চেয়ে খানিকটা বেশি-তাই বাড়তি জিনিস। আর তাই, মেহনত দয়ে তৈরী জিনিস লুঠ করবার সম্ভাবনা। যে-লোক মেহনত করছে তার কপালে জুটবে শুধু ততোটুকু জিনিস যতোটুকু না হলে বেচারার জান যাবে, অথচ তারিই মেহনত দিয়ে তৈরী বাড়তি জিনিসটুকু লুঠ করে নেবে অন্য কেউ।
দেখা গেলো, লোক খাটিয়ে লাভ আছে। কিন্তু খাটানো যায় কোন লোককে? নিজের দলের মধ্যে কেউ যদি কাউকে ডেকে বলেঃ বাপুহে, তুমি আমার হয়ে খেটে দাও, কিন্তু তোমার খাটুনির যা ফল তা থেকে তুমি পাবে শুধু সেইটুকু যেটুকু না হলে তোমার ধড়ে আর প্রাণ থাকে না; বাকি জিনিসটা আমি মেরে দেবো,—তাহলে নিশ্চয়ই যাকে এ-কথা বলা হবে সে মনের সুখে এতে রাজি হয়ে যাবে না। তাহলে, এ-রকম মুখ বুজে মেহনত করবার মতো লোক জোগাড় করা যায় কোথা থেকে? প্রথম দিকটায় জোগাড় হতো দলের বাইরে থেকে। কেমন করে? ধরা যাক, দুটো দলের মধ্যে লড়াই হলো। লড়াইতে একদল জিতলো, একদল হারলো। যারা হারলো তাদের মধ্যে অনেকেই বন্দী হলো। কিন্তু এই বন্দী মানুষগুলোকে নিয়ে কী করা যায়? যতোদিন মানুষ পৃথিবীকে ভালো করে জয় করতে শেখে নি ততোদিন পর্যন্ত এদের প্রায়ই মেরে ফেলা হতো। কেননা ততোদিন পর্যন্ত দলের লোককে পেট ভরে খেতে দেওয়াই এক দারুণ সমস্যা, তাই দলের বাইরের লোককে দলের মধ্যে এনে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার কথা ওঠে না। কিন্তু হাতিয়ার উন্নত হবার পর থেকে অন্য কথা। তখন বন্দীদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখাটা নেহাত লোকসানের ব্যাপার নয়, বরং খুব লাভের ব্যাপারই। কেননা তখন থেকে মানুষের মেহনত দিয়ে তৈরি হয় খানিকটা করে বাড়তি জিনিস, ওই বাড়তি জিনিসটুকুই হলো আসল। লাভের ব্যাপার। তাই বন্দীদের আর মেরে ফেলা নয়, মেরে ফেলবার বদলে দাস করে রাখা। মুখ বুজে মেহনত করবে তারা, কিন্তু তাদের কপালে জুটবে শুধু উচ্ছিষ্ট অন্ন আর জীর্ণ বসন।
মানুষ শিকলো পৃথিবীকে বেশি করে জয় করতে আর শিখলো লুঠ করতে অপরের মেহনত দিয়ে তৈরি জিনিস। আর তারই ফলে, দল বেঁধে সমানে-সমান হয়ে বেঁচে থাকবার তাগিদটা গেলো ঘুচে। মানুষ চাইতে শিখলো জমানো জিনিসগুলো একেবারে নিজের করে নিতে। কিন্তু যে-জমিতে চাষ হচ্ছে সেই জমি, যে-পশুকে পালন করা হচ্ছে সেই পশুকে, যে-দাস মেহনত করে দিচ্ছে সেই সব দাস-যদি এ-সবের ওপর পুরো দলটার সকলের সমান অধিকার থাকে তাহলে তো কারুর পক্ষেই নিজস্ব কিছু জমানো সম্ভব হয় না। তাই জমির ওপর, দাসের ওপর, পশুর ওপর আলাদা আলাদা দখল বসতে লাগলো। দলের জমি দলের লোকদের মধ্যে আলাদা আলাদা করে বিলি করা হলো। যাদের ভাগে ভালো জমি পড়লো তারা বেশি ফসল পেতে শুরু করলো, তাদের ঘরে জমতে লাগলো বেশি সম্পত্তি। তারা হলো বড়োলোক। দেখা দিলো বড়োলোক আর গরিবলোকের মধ্যে তফাত। এর আগে পর্যন্ত সবাই গরিব, অসম্ভব গরিব,-তবু সবাই সমান।
চুরমার হয়ে গেলো মেহনতের মর্যাদা। যতোদিন পর্যন্ত সকলে সমানে-সমান ততোদিন পর্যন্ত সবাইকেই মেহনত করতে হয়। মেহনত না করলে যে বাঁচবারই উপায় নেই। তাই কেউ যদি দলের মেহনতে যোগ না দিতে পারে, যদি অথর্ব হয়ে পড়ে, তাহলে সে কপাল চাপড়ায়, পরের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকবার চেষ্টাটা যে চরম লজ্জা। জীবন আর মেহনত দুই ছিলো সমান। কিন্তু অপরের মেহনত দিয়ে গড়া জিনিস লুঠ করতে শেখবার পর মানুষ ভাবলো, যারা ছোটোলোক, যারা দাস, তারা ইতর,— শুধু তারাই তো মেহনত করবে। মেহনত করাটাই হলো ইতরের লক্ষণ। তার কোনো মর্যাদা নেই, সম্মান নেই, কিছু নেই।
আগে ছিলো শুধু পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের লড়াই। কিন্তু এখন থেকে দেখা দিলো মানুষের সঙ্গে মানুষের লড়াই। যারা মেহনত করবে। তাদের সঙ্গে যারা অপরের মেহনত দিয়ে গড়া জিনিস লুঠ করবে তাদের লড়াই।