বিপদ! বিপদ!

বিপদ! বিপদ! 

মুনাফার খাতিরে সভ্যতা। কিন্তু লাভটা দেশের লোকের নয়, মুষ্টিমেয় মালিকের। দেশের সাধারণ মানুষ শেষ পর্যন্ত দুর্দশার চরমে পৌঁছয়, কেননা তাদের দুর্দশা যতো বাড়ে মালিকদের মুনাফাও ততো বেশি হয়। এদিকে বিজ্ঞানের কল্যাণে কিন্তু কলকারখানাগুলো এতো ভালো, এমন উন্নত হয়ে চলে যে সেখানে যেন পাহাড়প্রমাণ মালপত্তর তৈরি হয়। আর মালিকরা শেষ পর্যন্ত ওই তৈরি মাল নিয়ে দারুণ বিপদে পড়ে। কেননা, মাল তো শুধু তৈরি হলেই হলো না; সেগুলোকে বিক্‌রি করাও দরকার। কিন্তু বেচা যায় কী করে? কাকে? দেশের লোকের এমন দুৰ্দশা যে কেনবার মতো পয়সা, নেই। তাদের অবস্থা যদি ভালো হতো তাহলে তারাই কিনতে পারতো। কিন্তু তাদের অবস্থা ভালো করা মানেই মালিকদের মুনাফায় ঘাটতি পড়া। শুধু মুনাফার খাতিরে যে-সভ্যতা সে সভ্যতায় এ-পথ বন্ধ। তাছাড়া মাঝে মাঝে দেখা যায় কলকারখানায় এতে বেশি মাল তৈরি হয়ে গিয়েছে যে বেচবার জন্যে তার সবটুকু বাজারে ছাড়লে দর একদম পড়ে যাবে। তাতেও তো শেষ পর্যন্ত মুনাফার ঘাটতি পড়বে। সে-পথও বন্ধ। 

তাহলে? 

তাহলে বিপদ।। দারুণ বিপদ! কিন্তু বিপদটা যে ঠিক কী নিয়ে তা ভেবে দেখতে গেলে খুবই অবাক হয়ে যাবে। খুব বেশি জিনিস তৈরি করে ফেলবার দরুন বিপদ, পৃথিবীকে খুব বেশি করে জয় করে ফেলবার দরুন বিপদ!! এমনিতে তাজ্জব ব্যাপার বলেই মনে হয় কি? পৃথিবীকে জয় করে পৃথিবীর কাছ থেকে বেশি জিনিস আদায় করাই তো মানুষের আসল উদ্দেশ্য; যতো বেশি জিনিস আদায় হবে ততোই তো মানুষের অভাব ঘুচবে, ঐশ্বর্য বাড়বে! খুব বেশি করে জিনিস আদায় করতে পারলে বিপদ হবে কেন? অথচ ধনতত্তরের যুগে দেখা যায় সত্যিই বিপদ। কেননা ধনতত্তরের যুগে মানুষের অভাব ঘোচাবার কথাটাই বড় কথা নয়। বড়ো কথা হলো, মালিকের ঘরে মুনাফা যোগানো। তাই বিপদ। বেশি জিনিস তৈরি করে ফেলার বিপদ। 

মালিকেরা ভাবে, এই বিপদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় কেমন করে? তারা নানান রকমের চেষ্টা করে। এক রকমের চেষ্টা হলো, বেশি জিনিস তৈরি হওয়া নিয়েই যদি বিপদ বাধে, তাহলে ওই বেশি জিনিসটাকে নষ্ট করে ফেলার চেষ্টা। এ এক ভারি তাজব ব্যাপার। দেশের লোকের গায়ে কম্বল নেই, শীতে কাঁপছে। অথচ, মালিকেরা লক্ষ লক্ষ কম্বলের স্তুপে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। দেশের ছেলে মেয়েরা দুধ খেতে পায় না, শুকিয়ে মরে। অথচ, মালিকেরা জাহাজ-বোঝাই-বোঝাই টিনের দুধ সমুদূরের তলায় ফেলে দিচ্ছে। মার্কিন দেশের মতো যে-সব দেশে ধনতন্ত্র খুব উন্নত হয়েছে সেই সব দেশে এই রকম ধবংসলীলা বারবার দেখা গিয়েছে। 

মালিকদের পক্ষে আর একটা চেষ্টা হলো, দেশের বাইরে তৈরি মাল বিরির জন্যে বাজার যোগাড় করা। দেশের লোক যদি অতো মাল কিনতে না পারে তাহলে অন্য দেশে চালান দিয়ে মালগুলো বিক্‌রি করার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু কোন দেশে চালান দেওয়া যায়? যে-সব দেশে ধনতন্ত্র সে-সব দেশে তো একই সমস্যা। তাই এমন দেশে চালান দিতে হবে যে-দেশ এখনো পিছিয়ে পড়ে আছে, ধনতন্তরের অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনি। যেমন ধরে ইংরেজ মালিকেরা আমাদের দেশে মালপত্তর বিরির ব্যবস্থা করলো। আমাদের দেশ অনেকখানি পিছিয়ে-পড়া দেশ বলেই এখানে ওদের পক্ষে মালপত্তর বিরি করার সুবিধে। কিন্তু পিছিয়ে-পড়া দেশ হলেও সে-দেশেও ব্যবসাদার-কারিগর আছে, বিদেশী মালে বাজার ছেয়ে গেলে তাদের স্বার্থে লাগে, তারা বেঁকে বসে। তাই তাদের ওপর জবরদস্তি করা দরকার। যেমন ধরো, বিলিতী কাপড় আমাদের বাংলাদেশে বিকরি করবার সময় সাহেব মালিকেরা দেখলো বাঙালী তাতিরা গোলমাল বাধাচ্ছে। তাই ওরা বাঙালী তাঁতিদের বুড়ো আঙুলগুলো কেটে দেবার বন্দোবস্ত করলো। কিন্তু এতোখানি জবরদস্তি চালাতে গেলে তো শুধু বাজারটুকু দখল করলেই চলে না। সেপাই-শান্তরী দিয়ে দেশটাকে পুরোপুরি শাসনে রাখতে হয়। তার মানেই, দেশটাকে জয় করা দরকার। জাপান যেমন চীন দেশকে জয় করবার চেষ্টা করেছিলো! জয় করতে পারলে মালিকদের পক্ষে কতোখানি সুবিধে দেখো; ওদেশ থেকে চাষীদের ওপর জবরদস্তি করে। কাঁচা মাল থেকে তৈরি মাল বানাতে পারবে, তারপর চড়া দরে সেই তৈরি মাল ওদেশের বাজারে ফেরত পাঠানো যাবে। 

পিছিয়ে-পড়া দেশের জমিদার-সামন্তরা ভাবে, এ বরং ভালোই ব্যবস্থা। কেননা যে-বিদেশীর দল দেশটাকে দখল করেছে তারা তো নিজেদেরই স্বার্থে দেশটায় কলকারখানার উন্নতি হতে দেবে না : পিছিয়ে পড়া দেশেও যদি কলকারখানার উন্নতি হয় তাহলে তো সে-দেশেও ধনতন্ত্র দেখা দেবে, আর ধনতন্ত্র যদি দেখা দেয় তাহলে পিছিয়ে পড়া দেশটাও বিদেশী ধনতারিক দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করবে। তাই বিদেশীর শাসনে জমিদার-সামন্তদের বিলক্ষণ লাভ। কেননা দেশে কলকারখানা বেড়ে যাওয়া মানেই জমিদারি প্রথা ভেঙে পড়া; অন্য সব দেশে যেখানে কলকাখানার সভ্যতা গড়ে উঠেছে সেখানে জমিদার-সামন্তদের সর্বনাশ হয়েছে। পিছিয়ে-পড়া দেশের জমিদার-সামন্তরা তাই বিদেশী শাসকদের আদর করে বরণ করে নিতে চায়, উত্তরে বিদেশী শাসকরাও এদের অনেক রকম সুযোগসুবিধে দেয়। মাঝখান থেকে দেশটার উন্নতি বন্ধ, যে পিছিয়ে-পড়া দশা সেই পিছিয়ে-পড়া দশাই থেকে যায় । 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *