পৃথিবীকে জয় করা

পৃথিবীকে জয় করা 

মেহনত। পৃথিবীকে জয় করা। কথাটা শুনতে তো খুবই সোজা লাগে। মেহনতের গুণেই পশুর রাজ্য পেছনে ফেলে এগিয়ে এলো মানুষ। তার মানে কিন্তু পশুরা মেহনত করতে জানে না, একমাত্র মানুষই জানে মেহনত করতে ! এইবার হয়তো কথাটা নিয়ে একটু খানি খটকা লাগবে। পশুরা মেহনত করতে জানে না মানে? বলদ যখন ঘানি টানছে, কিংবা গাধা যখন মোট বইছে, তখন কি ওরা মেহনত করছে না? না। খাটছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাকে মেহনত বলে না। আসলে, কলু খাটাচ্ছে বলদকে, ধোপা গাধাকে দিয়ে মোট বওয়াচ্ছে। কিন্তু তাঁতি যখন তাত বুনছে, কামার পিঠছে হাতুড়ি, কিংবা শিকারী যখন ধনুক বেঁকিয়ে তীর ছুঁড়ছে, তখন একেবারে অন্য রকম কথা। ওরা জানে ওরা কী করছে, ওরা কী চায়; ওরা জানে কেমনভাবে করলে ভালো করে করা যায়। ঘানির বলদ জানে না সে কী চায়, সে যা করছে তা কেন করছে। তাই ঘানিতে ঘোরাটা বলদের পক্ষে মেহনত করা নয়। মেহনতকারী হলো কলুঃ সে-ই ঘানি বানিয়েছে, বলদ জুড়েছে, ঘানি চালাচ্ছে। 

মেহনত মানে নিশ্চয়ই পরিশ্রম। চলতি কথায় যাকে বলে গতর খাটানো। তবু, যেকোনো রকম গতির খাটানোকেই মেহনত বলা চলে না। একজন পাগল যদি রাস্তায় লাফঝাপ করতে করতে গলদঘর্ম হয়ে যায় তাহলেও তাকে মেহনতকারী বলা হয় না। কেননা, ওই গতর খাটানোটা তার পক্ষে পাগলামি, মেহনত নয়। পশুর দল বনের মধ্যে খাবারের আশায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একে কি মেহনত বলা হবে? না একেও মেহনত বলা হবে না। কেননা, এ হলো পৃথিবীর মুখ চেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা। মেহনত মানে, মনের মতো করে পৃথিবীকে বদল করা, পৃথিবীকে জয় করা। একটু সাধু ভাষায় বললে বলা যায়, বাঁচবার পরিকল্পনা নিয়ে পরিশ্রম করা। 

বাকি সব জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের আসল তফাতটা ওইখানেই। বাকি সবাই বেঁচে থাকে যেন পৃথিবীর দয়ার ওপর নির্ভর করে, পৃথিবীর মুখ চেয়ে। যদি খাবার জেটে তাহলেই পেট ভরবে, নইলে নয়। যদি জোটে মাথা গোঁজবার জায়গা তাহলেই মাথা গুজতে পারবে, নইলে নয়। পৃথিবীর সঙ্গে তার লড়াই। সে যেন পণ করেছে। লড়াই করে পৃথিবীর কাছ থেকে নিজের দরকার মতো জিনিস আদায় করে নেবে। তাই মাটির বুকে লাঙল দিয়ে সে আদায় করছে ফসল, পাথর কেটে তৈরি করছে পথ, আকাশকে জয় করবার জন্য বানিয়েছে উড়োজাহাজ, পাতালকে জয় করবার জন্যে পরেছে ডুবুরির পোশাক। রূপকথার সবচাইতে ডাকসাইটে দৈত্যও যা কল্পনা করতে পারতো না। আজকের মানুষ তাই করে চলেছে। অনায়াসে, যেন খেলার ছলে। পৃথিবীকে জয় করবার এমনই ধুম । 

পৃথিবীকে জয় করা। তার মানে কিন্তু বিদেশীর দল যেমনভাবে বাইরে থেকে একটা দেশ জয় করতে আসে তেমনভাবে মোটেই নয়। কেননা, মানুষ তো আর পৃথিবীর বাইরের কেউ নয়। মানুষ পৃথিবীরই একটা অংশ, পৃথিবীরই কতকগুলো জিনিস বদলাতে বদলাতে শেষ পর্যন্ত মানুষ হয়েছে। বিদেশীরা যখন একটা দেশ জয় করতে আসে তখন নিজেদের আইন-কানুনগুলো জয়-করা দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়। মানুষ কিন্তু পৃথিবীকে জয় করে একেবারে অন্যভাবে : পৃথিবীর যে-সব আইনকানুন সেগুলোকে সবচেয়ে ভালো করে চিনতে শিখে, আর মানতে পেরে—তবেই মানুষ জয় করে পৃথিবীকে। কথাটা শুনতে হয়তো খাপছাড়া লাগবে; পৃথিবীরই আইনকানুন যদি মানা হলো তাহলে আর পৃথিবীকে জয় করা হলো কেমনভাবে? অথচ তাই-ই। পৃথিবীর আইনকানুনকে যতো বেশি উড়িয়ে দেবার চেষ্টা, পৃথিবীর কাছে তাতোখানিই হার। পৃথিবীর নিয়মকানুনকে যতো বেশি স্পষ্ট করে চিনতে পারা যায়, মানতে পারা যায়, ততোই এগুলোকে লাগানো যায় নিজের দরকার মতো কাজে, পৃথিবীর ওপর তাই ততোখানিই জিত। 

ধরা যাক দুজন মাঝির কথাঃ একজন হয়তো নদীর স্রোতের নিয়মকানুন জানে না, জানে না বাতাসের নিয়মকানুন। আর একজনের কাছে হয়তো এ-সব ব্যাপার খুব স্পষ্টভাবেই জানা আছে। যে-বেচারা এ-সব জানে না। সে তো প্রাণপণ চেষ্টা করেও ভালো করে নৌকো বাইতে পারবে না। আর, যার কাছে এ-সব ব্যাপার স্পষ্ট জানা আছে, সে অনায়াসেই নৌকোয় পাল খাটিয়ে তরতর করে এগিয়ে যাবে।—রোতের নিয়মকে সে জেনে নিয়েছে, বাতাসের নিয়মকে সে মেনেছে। আর তাই পেরেছে। এ-সব নিয়মকে সবচেয়ে ভালো করে নিজের কাজে লাগাতে, নদীকে বশ করতে, জয় করতে পৃথিবীকে। 

কিংবা ধরা যাক, উড়োজাহাজে চেপে আকাশকে জয় করবার কথা। আকাশের নিয়ম, বাতাসের নিয়ম, বাতাসে ভর দিয়ে আকাশে ভাসবার নিয়ম, এই সব নিয়মকানুন যখন দিতে। তার আগে নয়। কিন্তু কেউ যদি বলতো, ও—সব নিয়মকানুন আমি জানি না, জানতে চাই না, তাহলে সে কি কখনো পারতো আকাশে পাড়ি দিতে, আকাশকে জয় করতে? 

তাই, পৃথিবীকে জয় করবার জন্যে দরকার পৃথিবীকে চিনতে পারা, জানতে পারা। কিন্তু এখানে একটা ভারি মজার কথা আছে। মানুষ যদি হাত গুটিয়ে চুপটি করে পৃথিবীর কথা শুধু ভাবে,— ভাবতে ভাবতে মাথার চুল একেবারে পাকিয়ে ফেলে।— তাহলেও তার পক্ষে পৃথিবীকে চিনতে পারা যায় না; তার জন্যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলাও দরকার, দরকার পৃথিবীকে জয় করবার চেষ্টাও । অর্থাৎ কি-না, মেহনত। চিনতে না পারলে জয় করবার উপায় নেই, আবার জয় করবার চেষ্টা না করলে উপায় নেই চিনতে পারবার। এ এক ভারি মজার ব্যাপার, নয় কি? মানুষ যতো বেশি করে পৃথিবীকে জয় করে চলেছে ততোই ভালো করে চিনতে শিখছে পৃথিবীকে; আবার মানুষ যতো ভালো করে চিনতে শিখছে পৃথিবীকে, ততোই বেশি করে পারছে তাকে জয় করতে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *