চলো যাই শহরে

চলো যাই শহরে 

মানুষ তখনো আজকালকার অর্থে বড়ো বড়ো শহর গড়তে শুরু করে নি, প্রধানতই গ্রাম আর গ্রাম। ক্ষেতে-খামারে ভূমিদাসের দল। পাথরের দুর্গে রাজা-জমিদার। গির্জায় গির্জায় পুরোহিত-পাদ্রী। আর ওই বীরপুরুষদের বল্লম। হাজার খানেক বছর। ধরে ইওরোপে সভ্যতার চেহারাটা মোটের ওপর এই রকমই। তারপর যেন মোড় ঘুরলো। 

মোড়-এর কথাটা মনে রাখতে হবে। গ্রামের পর গ্রাম, টানা টানা রাস্তা চলেছে। এক গ্রামের পর আর এক গ্রাম পেরিয়ে। এই সব রাস্তাগুলোর বড়ো বড়ো মোড়ে মাঝে মাঝে মেলা বসতো, আর এই মেলাগুলো দিনের পর দিন বেশ জাঁকালো হয়ে উঠতে লাগলো, কেনা-বেচার রেওয়াজ বাড়তে শুরু করলো। আর তারপর, কেনাবেচার রেওয়াজ যতো বাড়তে লাগলো ততোই এই সব মোড়গুলোর আশপাশেই দেখা দিতে লাগলো বড়ো বড়ো শহরের সূচনা। মোড় ঘুরলো মানুষের সভ্যতা, এগিয়ে এলো গ্রাম ছেড়ে আধুনিক শহরের দিকে। 

কেন আমনভাবে মোড় ঘুরলো? তার কারণ, ওই কেনাবেচার রেওয়াজ বেড়ে যাওয়া। কেনা-বেচার রেওয়াজ কেন বাড়লো? এই কথাটা ভালো করে বুঝতে হবে।

এর আগে পর্যন্ত, তার মানে পুরো সামন্ত যুগ ধরে, মানুষের মেহনত বেশির ভাগই চাষবাসের কাজে। কুটিরশিল্প বা কারিগরদের কাজ যে ছিলো না তা নয়, কিন্তু প্ৰধান ঝোকটা তার ওপর নয়। কিন্তু সামন্ত-যুগের শেষাশেষি দেখতে পাওয়া যায় ঝোঁকটা তার ওপর নয়। কিন্তু সামন্ত-যুগের শেষাশেষি দেখতে পাওয়া যায় ঝোঁকটা বদলে যাচ্ছে, অনেক অনেক মানুষ চাষবাস ছেড়ে কুটিরশিল্পের দিকে বেশি করে মেহনত করতে শুরু করছে। আর তাই, চাষীদের কাজ আর কারিগরদের কাজ, এ-দুয়ের মধ্যে তফাতটা বেশ স্পষ্ট হয়ে এলো। দেখা গেলো কারিগরদের দল একটা নতুন দল। তাঁতি-মুচি, মিৰি-ছুতোর, কুমোর-কামার, এই সব নানান রকম কারিগব। মধ্য যুগে কিন্তু কারিগর বলে এ-রকম একেবারে আলাদা কোনো দল ছিলো না-চাষীরাই খানিকটা করে সময় কারিগরের কাজ করতো। 

কারিগর বলে আলাদা একটা দল যতোই স্পষ্ট হয়ে পড়ে ততোই সরগরম হয় হাটবাজারগুলো। কেননা চাষীদের কাজ আর কারিগরদের কাজের মধ্যে একটা মস্ত তফাত আছে। চাষীদের মেহনত দিয়ে যে-জিনিস তৈরি তার মধ্যে অবশ্য অনেকখানিই যায় জমিদারদের কবলে, কিন্তু যেটুকু বাকি থাকে সেটুকু কেনা-বেচা বা লেনদেন করার জন্যে নয়,— তার বদলে নিজেদের ভোগে লাগাবার জন্যে, নিজেদের ব্যবহারের জন্যে। কিন্তু কারিগরদের মেহনত দিয়ে যে-জিনিস তৈরি হয়। তার মধ্যে বেশির ভাগটাই লেনদেনের জন্যে, কেনা-বেচার জন্যে,—নিজেদের ব্যবহারের জন্যে নয়। ধরো, একজন চাষী বিশ মণ ধান ফলালো, এই বিশ মণের মধ্যে হয়তো বেশিটা গেলো জমিদারের কবলে, কিন্তু বাকিটা বাজারে বিরি করবার জন্যে নয়, তার বদলে নিজের সংসার চালাবার জন্যে, নিজেদের পেটের জ্বালা মেটাবার জন্যে। কিন্তু একজন তাঁতি যদি মেহনত করে বিশ জোড়া কাপড় বোনে তাহলে এই বিশ জোড়ার মধ্যে হয়তো উনিশ জোড়াই বাজারে বিক্‌রি করবার জন্যে নিজের পরনের জন্যে নয়, লেনদেন করবার জন্যে। একটা কোনো জিনিস। যদি নিজে ব্যবহার করবার জন্যে তৈরি না করে বাজারে বেচবার জন্যে তৈরি করা হয়, লেনদেন করবার জন্যে তৈরি করা হয়, তাহলে সে-জিনিসটাকে বলে পণ্য। তাই কারিগরদের কাজ বেড়ে যাওয়া মানেই পণ্য তৈরির কাজ বেড়ে যাওয়া, আর পণ্য তৈরির কাজ বেড়ে যাওয়া মানেই সরগরম হয়ে ওঠা হাটবাজারগুলো— কেননা, হাটবাজারগুলোতেই তো পণ্য নিয়ে কেনা-বেচা। 

কিন্তু কেনা-বেচার কাজটা করবে কে? কারিগররা নিজেরা নিশ্চয়ই নয়। তার বদলে, ব্যবসাদারের দল। ব্যবসাদাররা দশটা গ্রাম টহল মেরে কারিগরদের জিনিস কিনে নিলো আর তারপর সেগুলো নিয়ে চললো হাটবাজারে কেনা-বেচার জন্যে। হাটবাজারগুলো তাই ব্যবসাদারদের ঘাটি, সেখানে ব্যবসাদারদেরই বেশি ভিড়। এর আগে পর্যন্ত ব্যবসাদারদের অবস্থাও তেমন ভালো নয়, দেমাকও তেমন বেশি নয়। কিন্তু তাদের ব্যবসা যতোই ফোঁপে উঠতে লাগলো ততোই বদলাতে লাগলো তাদের অবস্থা। 

ওদের ব্যবসাগুলো ফেঁপে ওঠবার আরো একটা কারণ ছিলো। সামন্ত যুগে পাণ্ডা-পাদ্রীদের উৎসাহে একরকম যুদ্ধযাত্রার রেওয়াজ শুরু হয়েছিলো, সেগুলোকে ওরা বলতো ধৰ্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড। নাম ধর্মযুদ্ধ, কেননা যুদ্ধযাত্রার পেছনে ধর্মের দোহাই! পাণ্ডা-পুরুতরা বলতো : পুবদিকের দেশেই ধীশুখ্রীষ্টের জন্ম, অথচ, সেদেশ মুসলমানদের কবলে, অতএব লড়াই করে জয় করতে হবে ওই সব দেশ। কিন্তু নামে ধর্মযুদ্ধ হলে কী হয়, আসল মতলবটো একেবারে অন্য। আসলে, পুবদেশের ধনরৎবের কথা শুনতে পুরোহিত আর জমিদারের চোখ লোভে চকচক করে উঠতো, সেই ধনরত্ন লুঠ করবার মতলবেই যুদ্ধ কেবল দেশের লোককে বোকা বানিয়ে খেপাতে না পারলে তো আর যুদ্ধ করা চলে না-লড়বে তো তারাই, মরবে তো তারাই, জমিদার আর পুরোহিত নিজেরা তো নয়। তাই ঢাক পিটিয়ে রটাবার ব্যবস্থা যে, ওগুলো আসলে ধর্মযুদ্ধ! ব্যবসাদাররা কিন্তু বিলক্ষণ ধূর্ত লোক; তারা ভাবলো এই মওকায় কিছু কামিয়ে নেওয়া যায়। আমীর-বাদশাদের ওইসব দেশে হরেক রকম শৌখিন জিনিস— খসবু আন্তর আর রান্নার মসলাপাতি থেকে শুরু করে হীরে-জহরত পর্যন্ত। ধর্মযুদ্ধের হিড়িকে ভিড়ে গিয়ে পুবদেশের থেকে এই সব শৌখিন জিনিস আমদানি করতে পারলে ইউরোপে চড়া দরে বিরি করা চলবে : পুরুত-পাণ্ড আর রাজা-জমিদাররা এমন সব শৌখিন জিনিস পেলে খুশি হয়েই কিনাবে! 

ব্যবসাদারের দল পুবদিকের দেশ থেকে হরেক রকম শৌখিন জিনিস আমদানি করতে লাগলো। এদিকে কিন্তু ইউরোপের রাজা-জমিদাররা খুব বড়োলোক হলেও তাদের হাতে কাচ টাকা তো বেশি নয়। তাদের কবলে অনেকখানি করে খাসজমি, অনেক ভূমিদাস সেখানে বেগার খাটে, পাওয়া যায় অনেক ফসল,— কিন্তু কাঁচ টাকা পাওয়া যাবে কোথা থেকে? জমিদাররা তাই দেখলো, খাস জমি রাখবার চেয়ে বরং জমিগুলো চাষীদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া; তারা চাষ করুক, ফসল বেচুক আর খাজনা দিক কাঁচা টাকায়। 

কেনা-বেচার রেওয়াজ বাড়লো; কেনা-বেচার ব্যাপারে ব্যবসাদারদের লাভ চারদিক থেকে; চাষীদের কাছ থেকে সস্তায় ফসল কিনে চড়া দরে বিক্‌রি করার লাভ, আবার চাষীদের হাতে যেটুকু নগদ টাকা দিতে হলো সেটুকুও জমিদারদের ঘর ঘুরে ব্যবসাদারদের কাছেই ফিরে আসবে।— কেননা শেষ পর্যন্ত জমিদাররা তো শৌখিন জিনিস কেনবার জন্যেই খরচ করবে সে-টাকা। তাছাড়া, ব্যবসাদাররা নগদ টাকা সুদে খাটাতেও কসুর করে নি : চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়া যাবে জমিদারদের, শৌখিন জিনিস কেনবার লোভে তারা সুদের কথায় পিছপা হয় না। কিন্তু ওরা শোধ দেবে কেমন করে? প্রজাদের অমানুষিক পীড়ন করে নগদ খাজনা আদায় করবারও তো একটা সীমা আছে! জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে তাই আবার জমি কেড়ে নিতে লাগলো; জমিতে প্রজা বসিয়ে চাষাবাদ করবার চেয়ে লোক লাগিয়ে ভেড়া চরানোয় নগদ লাভটা বেশি; জমিদারদের দেখাদেখি অনেক অবস্থাপন্ন চাষী ও এই দিকে মন দিতে লাগলো। দেখা গেলো, ছোটো ছোটো টুকরোয় ভাগ করা চাষের জমির বদলে বিরাট বিরাট ভেড়া চরাবার জমি। আর দেখা গেলো সর্বহারা মানুষের দল—আগে তারা চাষী ছিলো, কিন্তু চাষের জমিটুকু খোয়া যাবার পর গতির খাটাবার শক্তি ছাড়া তাদের আর কোনো সম্বল রইলো না। শেষ পর্যন্ত এরাই শহরে-শহরে ঘুরতে লাগলো। কারখানায় দিনমজুরি জোটবার আশায়। কিন্তু সে-কথা পরের কথা, একটু পরে তুলবো। 

ফেঁপে উঠতে থাকে ব্যবসাদারদের ব্যবসা, তাদের হাতে জমতে থাকে অনেক কাঁচা টাকা। তারা সওদাগরি নিয়ে দূর বিদেশে পাড়ি দেবারও তাল খোজে, বড়ো বড়ো নাবিকদের ডেকে বলে: সমুদ্ৰ পাড়ি দেবার পথ খোজো, খরচ যা লাগবে আমরা দেবো। কলম্বাস বার করলেন আমেরিকা, ভাস্কো-ডা-গামা ভারতে পৌঁছবার পথ। ব্যবসা-বাণিজ্য রমরমা জমে উঠতে লাগলো! 

এদিকে ব্যবসা যতোই জমে ওঠে ততোই ব্যবসাদারদের উৎসাহে দেশে জিনিস তৈরি করবার ব্যবস্থা বদলে যায়! বদলটা কী রকম? আগেকার দিনে কারিগর একটা পুরো জিনিস নিজেই তৈরি করতো।—যে কাপড় বুনছে সে-ই সুতো কাটছে, রঙ করছে। কিন্তু ব্যবসাদাররা দেখলো, একই লোক যদি পুরো একটা জিনিস নিজে নিজে তৈরি করতে চায় তাহলে সময় লাগে বেশি। তার চেয়ে বরং যে সুতো কাটবে। সে শুধু সুতোই কাটুক, যে তাঁত চালাবে সে শুধু তাঁতই চালাক, যে রঙ করবে। সে শুধু রঙই করবে। এইভাবে কাজ চলবে অনেক বেশি। তাছাড়া কেউ যদি সারাদিন ধরে একঘেয়ে একই কাজ করে চলে তাহলে তার পক্ষে এমন কিছু পাকা কারিগর হবার দরকার হয় না; তাই এই রকম ভাবে কাজটা ভাগাভাগি করে দেবার কায়দা চালু হলে শুধু আর ওস্তাদ কারিগরদের মুখ চেয়ে বসে থাকতে হয় না, মেহনত করবার লোক জোগাড় হয় অনেক বেশি। ওস্তাদরা শুধু তদারকটুকু করলেই হলো। 

কারিগরদের কাজের ব্যাপারে। এ ছাড়াও একটা মস্ত তফাত দেখা দিলো। কাজ করবার যা হাতিয়ার আর যন্ত্রপাতি, আগেকার দিনে সেগুলো ছিলো কারিগরদের নিজেদের জিনিস : তাতি যে— তাত তার, কামার যে—কামার শাল তার। কিন্তু নতুন অবস্থায় হাতিয়ার আর যন্ত্রপাতিগুলো কারিগরদের নিজেদের নয়। এগুলো হলো ওস্তাদ কারিগর আর ব্যবসাদারদের সম্পত্তি। কারিগররা এসে সেগুলো নিয়ে গতির খাটাবে, কিন্তু সেগুলোর মালিক হবে না। আর ওগুলো যতো ভালো হবে, যতো উন্নত হবে, ততোই বেশি জিনিস তৈরি করা যাবে; তাই ব্যবসাদার আর ওস্তাদ কারিগররা মন দিলো এগুলোকে ভালো করবার, উন্নত করবার দিকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *