পাথরের দুর্গ আর বীর পুরুষের বল্লম

পাথরের দুর্গ আর বীর পুরুষের বল্লম 

শেষ হলো রোমের দম্ভ, সে প্রায় যীশুখ্ৰীষ্ট জন্মাবার শ-পাঁচেক বছর পরের কথা। 

অচল হয়ে পড়লো দাসপ্রথা। মালিকরা দেখলো ক্রীতদাস কিনে আর লাভ নেই। তাই তারা একটা অন্য ব্যবস্থা করতে শুরু করলো। সে-ব্যবস্থাটা হলো, নিজেদের এলাকার বড়ো বড়ো জমিগুলো ভাগ করে নিয়ে আলাদা আলাদা টুকরোয় আলাদা আলাদা চাষী বসানো। এ-ছাড়া অবশ্য নিজেদের জন্যে তারা অনেকখানি করে খাস জমিও রেখে দিলো। ব্যবস্থা হলো, চাষীরা অর্ধেকটা করে সময় বেগার খাটবে প্রভুদের ওই খাস জমিতে, আর বাকি অর্ধেকটা করে সময় খাটবে নিজেদের টুকরো জমিতে। মালিকদের জমিতে মেহনত করবার ফলটা পাবে মালিক, টুকরো জমিতে মেহনতের ফলটা পাবে চাষীরা। কিন্তু তাই বলে চাষীরা যে পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে গেলো তা মোটেই নয়, প্রভুর মর্জি ছাড়া গা থেকে এক পা নড়বারও হুকুম নেই, যেন জমির সঙ্গে শেকল দিয়ে তাদের বেঁধে রাখবার ব্যবস্থা। তাই তাদের নাম হলো ভূমিদাস, ইংরেজীতে বলে সাফ। 

এদিকে রোমের দম্ভ শেষ হবার মুখোমুখি সময় থেকে ইউরোপের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে নতুন এক জাতের লোক, তাদের নাম টিউটনজার্মান। এরা নানান জায়গা দখল করতে শুরু করলো। আর এদের সঙ্গে মিশেল খেতে লাগলো। সেই সব জায়গার পুরোনো জাতগুলো। এইভাবে মিশেল খেতে খেতে সারা ইউরোপময় নতুন নতুন জাতি দেখা দিতে লাগলে এই সব নতুন নতুন জাতিই হলো আজকালকার ইংরেজ, জার্মান, ফরাসী। নতুন জাতিদের মধ্যে আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে লাগলো। ওই ব্যবস্থাই: বড়লোক আর তাদের বড়ো বড়ো খাস জমি, ভূমিদাস আর তাদের টুকরো জমি—বড়োলোকের জমিতে ভূমিদাসদের বেগার খাটা। 

একদিকে সার্ফ, মেহনতের সবটুকু দায় তাদেরই ওপর। আর একদিকে বড়োলোক, মালিক। মালিকদের মধ্যে অবশ্য ছোটে-বড়োর নানান তফাত। সবচেয়ে চুড়োয় বসে দেশের মহারাজা। তারপর ছোটোখাটো রাজা-রাজড়া, আবার তাদের তলায় জমিদার, জায়গিরদার, নানান ধরনের। ইংরেজীতে এদের সব হরেক রকমের নাম : আর্ল, কাউন্ট, ব্যারন। এক এক এলাকার ভূমিদাসদের মেহনত দিয়ে তৈরি জিনিস লুঠ করবে। সেই এলাকার জমিদার, জায়গিরদার। তার থেকে খানিকটা বাখরা পাবে বড়ো জমিদার, আবার তারো খানিকটা বাখরা পাবে আরো বড়ো জমিদার-এই ভাবে শেষ পর্যন্ত মহারাজের ভাড়ার পর্যন্ত। লুঠের মাল থাকে-থাকে, ধাপে ধাপে, বাখরা করার ব্যবস্থা। 

শোষকদের মধ্যে, রাজা-রাজড়া ছাড়াও পাণ্ডা-পুরুতদের দল। তখনকার গির্জেগুলোয় তাদের ঘাটি, তাদের মধ্যেও ছোটো-বড়ো-মাঝারির নানান তফাত। ধর্মের নামে গরিব ঠকিয়ে যা আদায় করা যায়। তারও বাখরা এই সব ছোটো-বড়োমাঝারি পাণ্ডা-পুরুতদের মধ্যে। যে সবচেয়ে চুড়োয় বসে তার নাম পোপ, তারও অগাধ সম্পত্তি, অনেক প্রতিপত্তি। পাণ্ডা-পুরুতদের আসল কাজ ছিলো দেশের লোককে অজ্ঞানের অন্ধকারে আচ্ছন্ন রাখা, যাতে তারা মাথা না তুলতে পারে, যাতে তাদের চোখ না ফোটে, তারা যাতে ঝিমিয়ে থাকে তারই ব্যবস্থা করা। তাই সব রকম লেখাপড়ার ওপর এই গির্জে-ওয়ালাদের কড়া পাহারাদারি— ধর্মের পুঁথিতে যা লেখা আছে তা ছাড়া একটি কথাও মুখ ফুটে বলবার জো নেই; বলতে গেলেই নাস্তিক বলে, ডাইনী বলে পুড়িয়ে মারা হবে। অবশ্য ধর্মের পাঁথি পড়বার অধিকার বা ক্ষমতা সকলের নেই। প্রাচীন কালের ভাষায় লেখা। সহজ মাতৃভাষায় তর্জমা করতে যাওয়া বিপদের ব্যাপার। 

দাসপ্রথার পর ইউরোপে এই যে নতুন ধরনের ব্যবস্থা দেখা দিলো এর নাম দেওয়া হয় সামন্ত-প্ৰথা। 

দাসপ্রথার ভিত্তিটায় যে-রকম ক্রীতদাসের মেহনত, সামন্ত-প্রথার ভিত্তিতে সেই রকম ভূমিদাসদের মেহনত। আর পাছে এই ভূমিদাসদের দল বেঁকে বসে সেই জন্যে হরেক রকম আইন-কানুন। কিন্তু শুধু আইন-কানুন হলেই তো আর চলবে না! পাইক-পেয়াদাও দরকার—আইনগুলো যদি কেউ মানতে নারাজ হয় তাহলে বল্লম উচিয়ে তেড়ে আসবে পাইক-পেয়াদার দল। এই সব পাইক-পেয়াদার যারা সর্দার তাদের নাম দেওয়া হতো নাইট বা বীরপুরুষ। বল্লম হাতে বৰ্মা গায়ে ঘোড়ার ক্ষুরের ধুলো উড়িয়ে দেশময় তারা শাসকদের দাপট জারি করে বেড়াতো, হেন অত্যাচার কল্পনা করা যায় না। যা তাদের অসাধ্য ছিলো। আসলে এই সব নাইট বা বীরপুরুষরা ছিলো ছোটোখাটো ডাকাতদলের সর্দারই। বড়োলোকরা দেখলো এদের খানিকটা খাতির করতে হবে, আর 

তাছাড়া লুঠের মাল থেকে কিছুটা বাখরাও দিতে হবে। খাতির করে ওদের রাজসভায় ডাকা হলো, বলা হলো ওরা বীরপুরুষ, ওরা নাইট। 

বীরপুরুষের দল! সকাল বেলায় হাঁটু গেড়ে তারা যীশুখ্রীষ্টের নামে শপথ করে, বলে আতকে ত্ৰাণ করাই আমাদের জীবনের ব্ৰত। আর তারপর, চরম অত্যাচারের ধ্বজা উড়িয়ে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সমস্ত দেশটাকে ওরা কাঁপিয়ে বেড়ায়। বীরপুরুষ বই কি! ওদের নিয়ে কতোই না ছেলেভুলোনো রঙিন গল্প, কতোই না গল্প বড়ো বড়ো পাথরের দুর্গে বসে যে-সব জমিদার শুধু আয়েস করতো তাদের নিয়ে। কিন্তু এই সব গল্প শুনে ভুললে চলবে না ভূমিদাসদের কথা, যাদের মেহনত দিয়ে সামন্ত যুগের সবটুকু ঐশ্বর্য গড়া হয়েছে, অথচ যাদের পিঠে শুধু অভাব আর অত্যাচারের বোঝা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *