ডাঙায় ওঠার পালা

ডাঙায় ওঠার পালা 

মনে রাখতে হবে, যখন থেকে মাছদের যুগ শুরু হয়েছে তখন থেকেই ডাঙার ওপর দেখা দিয়েছে সবুজের চিহ্ন। তার মানে, লতা-পাতা, ঘাস-গাছ। কিন্তু আজকালকার মতো লতাপাতা গাছপালা নয়। আজকালকার এই সব গাছ-গাছড়ারই পূর্বপুরুষ, কিন্তু সেগুলোর শেকড়-টেকড় নেই, মাটির ওপর যেন ভেসে বেড়াচ্ছে! এইগুলোর বংশধররাই বদলাতে বদলাতে শেষপর্যন্ত আজকালকার গাছপালা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

যাই হোক, মনে রাখতে হবে পুরো মাছদের যুগ ধরে। ডাঙার ওপর গাছপালা আর তাদের পূর্বপুরুষ ছাড়া আর কোনো রকম প্রাণীদেরই চিহ্ন নেই। ডাঙার ওপর জীবজন্তু দেখা দিয়েছে অনেক পরে। 

সবচেয়ে প্রথম ডাঙায় যে-সব জীবজন্তু দেখা দিলো তারা মাছদেরই বংশধর। তাই জল থেকেই তারা উঠে এলো। ডাঙায় উঠে এলো বটে, কিন্তু জলের সঙ্গে সম্পর্ক তারা ছাড়তে পারলো না। তাই তাদের খানিকটা জীবন জলের মধ্যে, আর খানিকটা জীবন ডাঙার ওপর। পুরোপুরি ডাঙার জীব তাদের বলা চলে না। তাদের বলে উভচরঃ তার মানে জলেও চলে, স্থলেও চলে। যেমন ধরো, আজকালকার ব্যাঙগুলো। ব্যাঙগুলো কি পুরোপুরি ডাঙার জীব? মোটেই নয়। ব্যাঙগুলো কি পুরোপুরি জলের জীব? তাও নয়। তাহলে? দু-জায়গারই জীব। তার মানেই উভচর। 

উভচররা পুরোপুরি ডাঙার জীব হতে পারলো না কেন? তার কারণ তাদের ডিমগুলো। 

নরম তুলতুলে তাদের ডিম। ডাঙায় সেই ডিম পাড়লে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। তাই ডিম পাড়বার জন্যে জলের মধ্যে ফিরে না গিয়ে উপায় নেই। যদি পারো তাহলে আজকালকার ব্যাঙের ডিম জোগাড় করো। দেখবে কী রকম নরম জিনিস। জলের মধ্যে না থাকলে ডিমগুলো রেফ নষ্ট হয়ে যাবে। 

তার মানে, মাছদের একদল বংশধর বদলাতে বদলাতে উভচর হয়ে গেল। তারা ডাঙাতেও থাকতে পারে, জলের মধ্যেও থাকতে পারে। কিন্তু কথাটা শুনতে যতো সহজই লাগুক না কেন, ব্যাপারটার মধ্যে এক দারুণ হাঙ্গামা আছে। 

হাঙ্গামাটা যে কী রকম তা তুমি নিজের চোখেই দেখতে পারো। জল থেকে একটা জ্যান্ত মাছ তুলে ডাঙায় ছেড়ে দাও, দেখবে খানিকক্ষণের মধ্যেই মাছটা খাবি খেয়ে মরে যাচ্ছে। কেন ওরকম মরে যায়? আমাদের ডাঙায় ছেড়ে দিলে তো আমরা ওরকম মরে যাই না! 

তার আসল কারণ হলো, আমাদের শরীরের মধ্যে ফুসফুস বলে একটা জিনিস আছে। মাছদের ফুসফুস নেই। 

ফুসফুস আবার কী? ডাঙার ওপর বাঁচতে গেলে ফুসফুসের দরকার পড়ে কেন? 

ডাঙায় চলাফেরা করবার সময় আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিই। তার মানে, বাইরে থেকে খানিকটা হাওয়া বুকের মধ্যে টেনে নিই। তারপর আমরা নিঃশ্বাস ফেলি। তার মানে, বুকের মধ্যে থেকে হাওয়াটা বার করে দিই। কিন্তু এর মধ্যে একটা মজা আছে। ঠিক যে হাওয়াটা বাইরে থেকে আমরা ভেতরে টেনে নিলাম। সেইটেই আবার বের করে দিই না। তার মধ্যে থেকে খানিকটা জিনিস যেন ছেঁকে নেওয়া হলো। শরীরের জন্যে, তারপর বাকিটুকু নিঃশ্বাস ফেলে বের করে দেওয়া হলো। যে জিনিসটুকু ছেকে নিয়ে শরীরের ভেতর রেখে দেওয়া হলো তার নাম অক্সিজেন। বাইরের হাওয়ায় অক্সিজেন রয়েছে। অক্সিজেন না হলে শরীর বাঁচে না। কিন্তু কথা হলো শরীরের মধ্যে আমরা কেমন করে। হাওয়ার থেকে অক্সিজেনটুকু আলাদা করি? তার কারণ ওই ফুসফুস। ফুসফুস শরীরের মধ্যেকার ভারি আশ্চর্য এক যন্ত্র। এ যন্ত্র দিয়ে হাওয়ার মধ্যেকার অক্সিজেন ছেঁকে নেওয়া যায়। মাছদের শরীরের মধ্যে এ-রকম যন্ত্র নেই। ডাঙায় তুললে মাছ তাই খাবি খেয়ে মরে যায়। 

কিন্তু তাহলে জলের মধ্যে মাছরা বাঁচে কেমন করে? কোথা থেকে পায় অক্সিজেন? জলের মধ্যে থেকে পায় নিশ্চয়ই। কেননা জলের সঙ্গে মিশেল আছে অক্সিজেনের। আর মাছদের শরীরে ফুসফুস না থাকলেও আর একটা যন্ত্র আছে, সেই যন্ত্র দিয়ে ওরা জলের থেকে অক্সিজেন ছেঁকে নেয়। এই যন্ত্রটার নাম হলো কানকো। মাছদের কানকো দেখেছে তো? মাথার দুপাশে দুটো কাটা জায়গা, টেনে ফাঁক করে দেখলে দেখবে টুকটুকে লাল। আসলে হয় কি জানো? মাছরা যখন জলের মধ্যে সাঁতরে বেড়াচ্ছে তখন ক্রমাগতই হাঁ করে করে মুখের মধ্যে তারা জল পুরছে। তারপর এই জল বেরিয়ে যাচ্ছে তাদের কানকোর মধ্যে দিয়ে। কিন্তু কায়দা আছে। কানকো দুটো এমনই মজার যন্ত্র যে তার মধ্যে দিয়ে জল বেরিয়ে যাবার সময় জলের সঙ্গে মেশানো অক্সিজেনটুকু শরীরের জন্যে ছেকে রেখে দেওয়া হয়। 

তাহলে সমস্যাটা কী রকম দেখো। মাছদের ফুসফুস নেই। ফুসফুস না থাকলে ডাঙায় বাঁচা যায় না। এদিকে মাছদেরই একদল বংশধর হয়ে গেল উভচর। তারা ডাঙায় বাচতে পারে। কেমন করে হলো? 

আসলে মাছদের যুগে যে-সব মাছদের বাস, মোটের ওপর তারা দু-রকমের। এক রকম হলো, হাঙর ধরনের মাছ। তাদের কঙ্কাল ঠিক হাড়ের তৈরি নয়; তরুণাস্থিা বলে একরকম নরম হাড় ধরনের জিনিস দিয়ে তৈরি। আর অন্য ধরনের যে মাছ তাদের কঙ্কালগুলো হাড় দিয়েই তৈরি।

এখন, এককালে হয়েছিল কি জানো? এই যে-সব হাড়ের কঙ্কাল-ওয়ালা মাছ, এদের শরীরের মধ্যে সত্যিই ফুসফুস গজিয়েছিল। তখন যদি তাদের শরীরের মধ্যে ফুসফুস না। গজাতো তাহলে তাদের পক্ষে বাঁচাই সম্ভব হতো না। কেননা, তখনকার দিনে পৃথিবীর আবহাওয়াটাই ছিল অন্য রকমের। যখন বৃষ্টি, তখন দারুণ বৃষ্টি। কিন্তু যখন অনাবৃষ্টি তখন এমন দারুণ অনাবৃষ্টি যে সবকিছু শুকিয়ে খাক হয়ে যাবার জোগাড়। অনাবৃষ্টির সময় জল শুকিয়ে পালে পালে প্রাণী মরতে শুরু করে, জলের মধ্যে পচতে থাকে তাদের শরীর, আর তাই ওই জলের মধ্যে থেকে অক্সিজেন জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তখন বাঁচবার একমাত্র উপায় হলো জলের ওপর মুখ তুলে ওপরের হাওয়া থেকে অক্সিজেন জোগাড় করা। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সেই অবস্থায় যে-সব মাছরা জলে থেকেও জল থেকে মুখ তুলে হাওয়া থেকে অক্সিজেন নিতে পারতো, শুধু তারাই টিকে যাবে। মাছেদের মধ্যে এরকম একদল কিন্তু ছিলই, যাদের এতোদিন অন্য মাছেদের থেকে আলাদা করে চেনা যায় নি। কিন্তু এখন অবস্থা বদলে যাবার ফলে শুধুমাত্র জল থেকে অক্সিজেন টানে যে সব মাছরা তারা মারা পড়তে লাগলো দলে দলে। আর অন্যদিকে পালে পালে বাড়তে থাকলো ওই হাওয়া থেকে অক্সিজেন টেনে নেওয়া মাছের দল। এরকম মাছের দেখা কিন্তু খুব কম হলেও আজও মেলে, যারা কানকো আর ফুসফুসের কাজ দুটোই সমানভাবে চালাতে পারে। এদের নাম হলো সিলাকস্থ । 

পৃথিবীর আবহাওয়া আবার বদলালো। দেখা গেল পরিস্কার জলের জায়গা অনেক রয়েছে, তার সঙ্গে দেদার অক্সিজেন মেশানো। এতোদিন পালে পালে মারা পড়ছিল যে-সব শুধু-কানুকোওয়ালা মাছরা, জলে অক্সিজেনের জোগান বাড়ায় তারা আবার দিব্যি বাড়তে লাগলো। 

সে যাই হোক, এখন উভচরদের রহস্যটা বুঝতে পারছে তো? যে-সব হাড়ওয়ালা মাছদের শরীরে এককালে ফুসফুস গজিয়েছিল তাদেরই বংশধর হলো ওই উভচরের দল। তাই উভচরদের শরীরেও ফুসফুস, আর তাই উভচরীরা বাঁচতে পারে, পারে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *