পাহাড়ের বই

পাহাড়ের বই 

পৃথিবীর বুকে অনেক পাহাড়। অনেক রকমের পাহাড়। তার মানে, সব পাহাড় এক রকমের নয়। এতো রকম পাহাড়ের মধ্যে এক রকম পাহাড়ের নাম হলো পাললিক পাহাড় বা পলিপড়া পাহাড়। এই পাহাড়গুলো এক রকম বইয়ের মতো। তার মানে নিশ্চয়ই কাগজের ওপর কালি দিয়ে ছাপা জিনিস নয়। তবু বইয়ের মতোই। যেন ইতিহাসের বই। কেননা, ইতিহাসের বই থেকে অনেক যুগের অনেক রকম খবর পাওয়া যায়। রাজা অশোক কবে জন্মেছিলেন, কী রকমের লোক ছিলেন কিংবা, কী রকম ছিল আমাদের দেশের অবস্থা নবাবী আমলের আগে। এই রকম সব পুরনো খবর জোগানোই তো ইতিহাসের বইয়ের আসল কাজ। পাললিক পাহাড়গুলোর বেলাতেও ঠিক তাই। এগুলোর মধ্যে থেকেও অনেক অনেক খবর পাওয়া যায়, বহুদিন আগেকার সব খবর। 

ছ-কোটি বছর আগে পৃথিবীর বুকে কোন ধরনের জীবজন্তু ঘুরে বেড়াতো? আজকাল যে-রকম ঘোড়া আমাদের গাড়ি টানছে, তখনকার কালে কি সেই রকমের ঘোড়া ছিল? আজকাল জানতে পারা গিয়েছে। –না, সেকালে মোটেই এরকমের ঘোড়া ছিল না। তখনকার কালে পৃথিবীর কোথাও এ-রকম ঘোড়ার চিহ্ন ছিল না। তার বদলে ছিল এই ঘোড়াদের পুর্বপুরুষ। কিন্তু সেই পূর্ব-পুরুষদের দেখতে একেবারে অন্য রকম। আগেই 

এক হাত উঁচু হবে। আর তাছাড়া এদের পায়ে ঘোড়ার খুর ছিল না; তার বদলে সামনের 

চেহারা নয় কি? ঘোড়ার এই পুর্বপুরুষদের নাম ইয়োহি পাস। তার মানে, ছ-কোটি বছর ধরে নানানভাবে বদলাতে বদলাতে সেই ইয়োহি পাসের বংশধররা আজকালকার ঘোড়া হয়ে গিয়েছে। 

কিন্তু জানা গেল কোথা থেকে? ওই পাহাড়ের বই থেকে। যেগুলোর নাম দেওয়া হয় পাললিক পাহাড়। কিন্তু কেমন করে জানা গেল? এ-কথার উত্তর বুঝতে গেলে প্ৰথমে ভেবে দেখতে হবে এই পাহাড়গুলো জন্মালো কেমন করে। 

তুমি তো জানোই, পৃথিবীর সমস্ত নদী বয়ে চলেছে সমুদূরের দিকে। কিন্তু নদীগুলোর সূরোত সবজায়গায় সমান জোর নয়। যেখানে ঢালুর দিকে রোত সেখানে তোড় খুব বেশি; যেখানে সমতল জমি, কিংবা যেখানে স্রোতের মুখে কোনো বাধা নেই, সেখানে তোড় অনেক কম। 

এখন ব্যাপারটা হলো এই যে নদীগুলো খালি হাতে সমুদ্ররের দিকে ছুটছে না। পৃথিবী ধুয়ে, পৃথিবীর বুক থেকে নানান রকমের জিনিস বয়ে নিয়ে চলেছে সমুদূরের দিকে। মাটি আর ধাতু, গাছ-পাতা, শামুক গুগলি, মরা জন্তু জানোয়ার-এমনি কতো কি। রোতের তোড়াটা যেখানে কম সেখানে নদীর মধ্যেকার এই সব জিনিসগুলো থিতিয়ে মাটিতে জমতে থাকে। এইভাবে, অনেকদিন ধরে বেশ পুরু একথাক জিনিস নদীর তলায় থিতিয়ে বসলো। তারপর আবার অনেকদিন ধরে তার ওপরে থিতিয়ে বসলো আর এক থাক। এইভাবে, যুগের পর যুগ ধরে থাকের পর থাক জমতে থাকে। তারপর, ওপরের দিকের থাকগুলোর চাপে তলার দিকের থাকগুলো আস্তে আস্তে পাথর হয়ে যায়। সেই পাথরের যে পাহাড় তারই নাম হলো পাললিক পাহাড়। 

পাললিক পাহাড়গুলোকে তাই দেখতে ভারি মজার ধরনের। যেন একটা পাথরের চাদরের ওপর আর একটা পাথরের চাদর, তার ওপর আর একটা-এই রকম উপরি উপরি, থাকে থাকে সাজানো। এই রকমের পাহাড় দেখেছে কখনো? দেখতে পাওয়া এমন কঠিন নয়। কিন্তু মনে রেখো, যেখানেই এই রকমের পাহাড় সেখানেই বহুযুগ আগে হয় নদী ছিল, না হয় সমুদ্র ছিল। ভূমিকম্প-টুমিকম্পর মতো অনেক রকম রসাতল তলাতল কাণ্ড হয়ে পৃথিবীর ওপরকার চেহারাটা একেবারে বদলে গিয়েছে। সমুদ্র সরে গিয়েছে, নদী সরে গিয়েছে, আর জেগে উঠেছে। ওই সব পাললিক পাহাড়। 

এই পাললিক পাহাড়গুলোর আগাগোড়া বয়েস সমান নয়। যতো চূড়োর দিক ততো বয়েস কম, যতো নিচুর দিক ততো বয়েস বেশি। তা তো হবেই। কেননা, যতো ওপরের দিক ততোই নতুন পাথরের থাক। নানান রকম কায়দাকানুন করে এই পাললিক পাহাড়গুলোর বয়েস বের করে ফেলা যায়। পাহাড়গুলোর বয়েস মানে কোন থাকটার কতো বয়েস তাই। 

আরো মজার ব্যাপার আছে। পাহাড়গুলোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় একরকমের জিনিস, সেগুলোকে বলে ফসিল। 

ফসিল আবার কী? পাললিক পাহাড়গুলোর মধ্যে যেন নানানরকমের মূর্তি ঠাসা রয়েছে। কোনোটা ঠিক গাছের পাতার মতো, কোনোটা বা হুবহু শামুকের মতো, কোনটা বা মাছের মতো, অন্য কোনো জীবজন্তুর হাড়ের মতো কোনটা বা। হরেক রকম সব জিনিস। পাথরের তৈরি হুবহু মূর্তির মতো। এইগুলোকেই বলে ফসিল। যদি কখনো যাদুঘরে বেড়াতে যাও তাহলে নিজের চোখে দেখে এসো ফসিলগুলো কী রকম দেখতে হয়। যাদুঘরে অনেক সব ফসিল সাজানো থাকে । 

কিন্তু কথা হলো, এগুলো এলো কোথা থেকে? আগেই বলেছি, নদীগুলো পৃথিবীর বুকের ওপর থেকে ধুয়ে নিয়ে যায় হরেক রকমের জিনিস। এইসব জিনিসের মধ্যে গাছ পাতা রয়েছে, শামুক গুগলি রয়েছে, রয়েছে নানান রকম জীবজন্তুর মরা শরীর। যেখানে নদীর স্রোত একটু থিতিয়েছে, সেখানে নদীর জলের সঙ্গে মেশানো সব জিনিসগুলো নদীর তলার দিকে জমতে শুরু করে : বালি, মাটি, নানান রকমের ধাতু। সেইগুলো জমতে জমতেই তো শেষ পর্যন্ত পাললিক পাহাড় হয়। তাই এই সব জিনিসগুলো যখন মাটির তলায় থিতিয়ে বসছে তখন তার সঙ্গে নিশ্চয়ই থেকে যাচ্ছে কিছু কিছু গাছ পাতা, কিছু কিছু শামুক গুগলি কিছু কিছু মরা মাছ, মরা জন্তু-জানোয়ারের শরীর। এতো সবের মধ্যে অবশ্য বেশির ভাগই পচে যায়। সেগুলোর আর কোনো চিহ্ন থাকে না। কিন্তু নানান কারণে কতকগুলো পচে না নষ্ট হয় না। তার বদলে পাথর হয়ে যায়। যেগুলো পাথর হয়ে যায় সেগুলোরই নাম হলো ফসিল। ঠিক যেমনটি গাছের পাতা ছিল তেমনটিই দেখতে রয়েছে, কেবল পাথর হয়ে গিয়েছে। তাই মনে হয় যেন পাথরের মূর্তি। নিখুঁত মূর্তি। 

কিন্তু, কেমন করে পাথর হয়ে গেল? মনে আছে তো, আগেই বলেছি। প্রত্যেক প্রাণীর শরীর খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম একরকম অংশ দিয়ে গড়া, সেই অংশগুলোর নাম হলো ‘কোষ’। এখন ভেবে দেখো নদীর তলায় থিতিয়ে জমা একটা মাছের শরীরের কথা। ওই ভাবে থিতিয়ে যাবার পর তার শরীরের প্রত্যেকটি কোষের মধ্যে যে প্রোটোপ্লাজম, তাকে হটিয়ে দিয়ে তার জায়গা দখল করে বসে নানান রকম খনিজ জিনিস। ফলে, কোষগুলোর গড়ন ঠিক থাকে।—কেবল ভেতরের মালমশলাটা বদলে যায়। এইভাবে প্রত্যেকটা কোষের ভেতরকার মালমশলা যখন বদলে গেল তখনও পুরো মাছটার চেহারা মাছের মতোই রইলো, কিন্তু প্রোটোপ্লাজম দিয়ে গড়া মাছ নয়-পাথরের মাছ। ফসিল। আজো যদি একটা ফসিল থেকে খুব পাতলা একটা টুকরো কেটে নেওয়া যায় আর অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা যায় ওই টুকরোটাকে, তাহলে তার মধ্যেকার কোষগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাবে। এ-কোষ পাথরের তৈরি।

এইবারে ভেবে দেখো পাললিক পাহাড়গুলোর কথা। ওপর ওপর আর থাকে থাকে সাজানো পাথরের স্তর। কোন স্তরের বয়েস কতো তা জানতে পারা গিয়েছে। আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে নানান স্তরে নানান রকম ফসিল। এর থেকেই বুঝতে পারা যায় কোন যুগে পৃথিবীর বুকের ওপর কোন ধরনের প্রাণীদের বাস ছিল, বুঝতে পারা যায় যুগের পর যুগ ধরে বদলাতে বদলাতে, বদলাতে বদলাতে, কোন কোন প্রাণী শেষ পর্যন্ত আজকের পৃথিবীর প্রাণী হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *