বোম্বেটেদের দল

বোম্বেটেদের দল 

এই সব অদলবদল চলতে লাগলো অনেকদিন ধরে, একটানা প্রায় চারশো বছর ধরে। আর তারপর দেখা গেলো পুরোনো সভ্যতার বদলে একটা নতুন সভ্যতার চেহারা। এতো আশ্চর্য এই নতুন সভ্যতা, যে চেয়ে দেখলে যেন চোখ ঝলসে যায় : শহরে শহরে বিরাট বিরাট কারখানা, চিমনির কালো ধোঁয়ায় আকাশটা যেন কুঁকড়ে উঠছে, কলের তীব্র বাঁশিতে শিউরে উঠছে। শেষ রাত—আর রূপকথার সবচাইতে ডাকসাইটে দৈত্যরাও যে-কাজ কল্পনা করতে পারতো না এই সব কারখানায় মানুষ তাই করতে শুরু করেছে প্ৰায় ছেলেখেলার মতো করে! 

কেমন করে মানুষ গড়লো ওই সব কারখানা? হাওয়া দিয়ে তো আর কারখানা গড়া যায় না। কাঁচা টাকা লাগে।—অনেক, অনেক কাঁচা টাকা। জমি কেনবার টাকা, বাড়ি গাঁথবার টাকা, কলকব্জা আর যন্ত্রপাতির জন্যে টাকা, কাঁচামাল কেনবার জন্যে টাকা, মজুরদের দিনমজুরি দেবার টাকা, তৈরী মাল দেশ-বিদেশে বিক্‌রির ব্যবস্থা করতে টাকা। টাকা, টাকা, টাকা। অনেক পুঁজি চাই, তা নইলে, অমন বড়ো বড়ো কারখানা-কারবার ফাঁদা যাবে কেমন করে? 

ব্যবসাদাররা এতো টাকা, এতো পুঁজি কেমন করে জোগাড় করলো? ব্যবসা করে? সওদাগরি করে? তেজারিতি করে? অনেকখানি তাই। কিন্তু শুধু তাতে অতো টাকা জোগাড় করা যায় না। তাই আরো একটা ব্যবস্থা ওরা করেছিলো। সেটার নাম হলো ডাকাতি করা, বোম্‌বেটেগিরি করা। তাই তখনকার ডাকসাইটে সওদাগরের দলগুলো ছিলো ডাকসাইটে বোম্‌বেটোদের দলও। ওলন্দাজ আর পর্তুগীজ, ইংরেজ, ফরাসী, স্প্যানিস,— কতোই না ডাকসাইটে বোম্‌বেটের দল। এদের ছিলো একটা দারুণ সুবিধে, বারুদ। প্ৰথম অবশ্য চীন দেশে তার আবিষ্কার। কিন্তু সেখানের ফুর্তিবাজ বাবুরা এই বারুদ দিয়ে রকমারি আতসবাজি বানাতে ব্যস্ত। কিন্তু ইউরোপে আবিষ্কারটা এসে পৌছবার পর সেই বারুদকেই ওরা বন্দুকে-কামানে ব্যবহার করতে শিখেছে, ওদের দাপট তাই আমন সাংঘাতিক। 

বোম্‌বেটেগিরির টাকা, অগাধ টাকা। সেই টাকাকেই পুঁজি করে নিয়ে ওরা নিজেদের দেশে নতুন সভ্যতা গড়তে পারলো, পারলো দৈত্যের মতো বড়ো বড়ো কারখানা খুলতে। একটা নমুনা দেওয়া যাক। 

আমাদের দেশ। ভারতবর্ষ। বিপুল ঐশ্বর্য তখন আমাদের দেশে। সেই ঐশ্বর্যের দিকে চেয়ে হরেক রকম বিদেশী বণিকের চোখ চকচক করে ওঠে। তাই সওদাগরের সাজে। অনেকে এলো বোম্‌বেটেগিরি করতে : পর্তুগীজরা এলো, ওলন্দাজ এলো, এলো ইংরেজ, এলো ফরাসী। এদের মধ্যে সবচাইতে ঘুঘু আর সবচাইতে সাংঘাতিক দল হলো ইংরেজ সওদাগরদের দল। ব্যবসার নামে আমাদের দেশ থেকে কী সাংঘাতিক লুঠতরাজ ওরা করেছে। আর ওই লুঠের মোহর জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে গিয়েছে নিজেদের দেশে। যদি নিয়ে যেতে না পারতো তাহলে নিজেদের দেশে অমন জমকালো কলকারখানা-ওয়ালা নতুন সভ্যতা ওরা গড়তেই পারতো না। 

ইংরেজ বণিকেরা যখন প্রথম এলো আমাদের দেশে তখন এ-দেশের অবস্থা খুবই ভালো। এখানে ওখানে এমন-কি জাকালো শহর পর্যন্ত গড়ে ওঠবার লক্ষণ দেখা দিয়েছে; তখনকার দিনে লণ্ডন শহরের চেয়ে ঢাকা-মুর্শিদাবাদ মোটেই কিছু ছোটো নয়। আমদানির চেয়ে আমাদের দেশ থেকে তখন রপ্তানিই বেশি। অথচ সেই সঙ্গেই মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের অতো সমৃদ্ধি সত্তবেও আসলে দেশের যেটা সভ্যতা সেটার কোনো শক্তি নেই, কেনা সমাজের গড়নটা হাজার বছরের পুরোনো, পচে-যাওয়া পুরোনো ধরনেরই গড়ন। ধর্মশাস্তরের আইন-কানুন অনুসারে গড়া তার ভিত। অথচ, ইংরেজরা তখন এক নবীন সভ্যতার দিকে পা বাড়িয়েছে, জমিদার-পুরোহিতের কবল থেকে মানুষকে মুক্ত করছে, করছে পৃথিবীকে নতুন করে জয় করবার পথ আবিষ্কার। তাই ওই বিদেশী বণিকের দল সওদাগরি করতে এসে শেষ পর্যন্ত পুরো দেশটা জুড়ে বিরাট এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারলো। ব্যবসা করতে এসে একেবারে একটা পুরো রাজত্ব ফেদে বসা। বড়ো কম। কথা তো নয়। আবার এ-কথা ভুললেও চলবে না যে আমাদের দেশ থেকে আমন সাংঘাতিক লুঠতরাজ করতে না পারলে ওরা নিজেদের দেশে ওই নতুন সভ্যতাকে পুরোপুরি গড়ে তুলতে পারতো কিনা সন্দেহ। 

লুঠতরাজটা কী রকম আগে তাই দেখা যাক। সওদাগরি করতে এসে ওরা দেখলে আমাদের দেশে থেকে নিয়ে যাবার মতো জিনিস রয়েছে দেদার; সেগুলো দেশে নিয়ে যেতে পারলে চড়া দামে বিক্‌রি করা চলে। দেদার লাভ। কিন্তু সত্যিই যদি সওদাগরি হয় তাহলে এতো জিনিসপত্তর নিয়ে যাবার সময় তার বদলে তো কিছু দিতে হয়। কিন্তু দেবার জিনিস কী আছে? এক পশমের তৈরি কাপড়াচোপড় ছাড়া তখনও পর্যন্ত ওদের দেশে এমন কিছু তৈরি হয় না। যা তখন আমাদের দেশে নেই; অথচ আমাদের এই গরম দেশে পশমের চাহিদা হবে কেন? তাই, আমাদের দেশ থেকে মালপত্তর সত্যি করে কিনতে হলে ওদের পক্ষে কাঁচা টাকা বয়ে আনা দরকার। কিন্তু এমনতরো ব্যবস্থা ওদের পক্ষে মনঃপুত হতেই পারে না, কাঁচা টাকা জোগাড় করবার জন্যেই বলে ওরা নিজেরা তখন হন্যে হয়ে ঘুরছে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে বেরিয়েছে সওদাগরি করতে ! তাহলে? কিছুদিনের মধ্যেই ইংরেজ বণিকেরা নিজেদের মতলব ঠিক করে ফেললো। রেফ মারপিট, রেফ ডাকাতি। জোর করে আমাদের দেশের জিনিস কেড়ে নিয়ে যাওয়া ! বন্দুক এলো, কামান এলো,–ওরা বললো লড়াই করযো। 

পলাসীর যুদ্ধ। তারপর লুঠ। সে যে কী লুঠ, কী লুঠ, তার হিসেব করাই কঠিন। জাহাজ বোঝাই করে লুঠের মাল চললো। ওদের দেশে। মর্জিমতো কোনো লুঠের থলিকে ওরা বললো খাজনা, কোনোটাকে বললো ভেট, নজর নাম দিলো কোনোটার বা। আবার কোনোটার কোনো নামই দিলো না। 

কাঁচা টাকার—বা হয়তো সেকালের সোনার মুদ্রার পাহাড় জমলে ওদের দেশে। আর সেই টাকাকেই পুঁজি করে ওরা খুললো বিরাট কারখানা। ওদের দেশের চেহারাটাই বদলে গেলো। তার আগে পর্যন্ত ওদের দেশের কারিগররা ছোটোখাটো হাতিয়ার আর যন্ত্রপাতি দিয়ে পণ্য তৈরি করতো। এবার থেকে তার বদলে বিরাট বিরাট কারখানা। এই যে অদল-বদল এরই নাম দেওয়া হয় শিল্পবিপ্লবী। কেমন করে সম্ভব হলো এই শিল্প-বিপ্লব? কেউ কেউ বলেন, কয়েকজন বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিকের কয়েকটা আশ্চর্য আবিষ্কারের দরুন এ-বিপ্লব সম্ভব হয়েছে। হারগ্রীয়েভ আবিষ্কার করলেন সুতোকল, ওয়াট আবিষ্কার করলেন বাষ্পের শক্তিকে মানুষ কেমনভাবে হাতের মুঠোয় আনতে পারে। এই রকম কতোই না আবিষ্কার। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে নিশ্চয়ই ছোটো করবার কোনো মানে হয় না। তবু শুধু ওই আবিষ্কার কাটির জন্যেও শিল্প-বিপ্লব সম্ভব নয়। আসল কথা হলো, ওই সব আবিষ্কারকে বড়ো বড়ো কারখানা খুলে কাজে লাগাবার কথা। এই কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করতে হলে বিস্তর টাকার দরকার। পুঁজি চাই। মূলধন চাই। তা নইলে তো বিজ্ঞানের আবিষ্কার মাঠে মারা যাবে। আমাদের দেশ লুঠ করবার আগেও ওদের দেশে বিজ্ঞানের আশ্চর্য সব আবিষ্কার হয়েছে, কিন্তু সেগুলোকে কারখানা খুলে কাজে লাগাতে পারা যায় নি। কেননা, তখন পর্যন্ত ওদের হাতে কাচা টাকার যোগান ছিলো না। 

মনে রাখতে হবে, ১৭৫৭-তে পলাসীর যুদ্ধ। ১৭৭৬ থেকে শিল্প-বিপ্লব শুরু। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *