নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন
পৃথিবীটা সত্যি নয়। পৃথিবীকে বদল করা যায় না।-এই কথায় সত্যিই যদি সাধারণ মানুষ মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করতো? তাহলে? তাহলে মানুষের গল্পে এর চেয়ে বড়ো তোলপাড় নিশ্চয়ই আর কিছু হতে পারতো না। কেননা মানুষের গল্প হলো পৃথিবীকে জয় করবার গল্প। পৃথিবীকে বদল করবার গল্প। পৃথিবীটা সত্যি নয়, পৃথিবীকে জয় করা যায় না— এই সব কথায় মানুষ যদি সত্যিই মনে প্ৰাণে বিশ্বাস করতে শুরু করতো তাহলে থেমে যেতো মানুষের গল্প, নদীর সূরোত বন্ধ হয়ে যে-রকম জলের ডোবা হয়ে যায়। সেই রকম অবস্থা হতো মানুষের গল্পের। ইতিহাসের।
তা হয় নি। কেনে হয় নি। তাই বলবো।
অবশ্য মালিকদের কাছে, যারা রাজা-উজির আর পাণ্ডা-পুরুতে হয়ে বসেছে তাদের কাছে, পৃথিবীকে বেশি করে জয় করবার তাগিদটা বরাবরই বড়ো কম। কী হবে পৃথিবীকে অতোশতো বদল করে? তার চেয়ে বরং লক্ষ লক্ষ মানুষের মেহনতকে যদি খুব ভালো করে, খুব নির্মমভাবে, শোষণ করা যায় তাহলেই–তো নিজের ঘরে জমবে দেদার সম্পত্তি, পাওয়া যাবে ঢালাও ফুর্তি। সমস্ত মানুষে কথাটা ভাবলে অবশ্য অন্য কথা। তাহলে পৃথিবীকে বেশি করে জয় করায় লাভ আছে বৈকি। যতো বেশি করে জয় করা যাবে ততোই দুঃখের আর অভাবের চিহ্ন মুছবে সবাইকার কপাল থেকে। কিন্তু মালিকদের দায় পড়েছে সমস্ত মানুষের কথা ভাবতে! শুধু নিজের সুখ-সুবিধে টুকু নিয়ে ব্যস্ত বলেই পৃথিবীকে বেশি করে জয় করবার ব্যাপারে ওদের মাথাব্যথাটা নেহাতই কম।
যেমন ধরো, চাকা-ওয়ালা গাড়ির কথা। বিশ জন মানুষ পালকি কাঁধে বইবে, না চাকাওয়ালা গাড়ি পোষা জানোয়ার দিয়ে টানানো হবে? যদি চাকা-ওয়ালা গাড়ির চলন হয় তাহলে যাদের কাধে পালকি বইবার দায় তারা রেহাই পায়, আর তাদের মেহনতটা পৃথিবীকে আরো বেশি করে জয় করবার কাজে লাগাতে পারে। অর্থাৎ, চাকা-ওয়ালা গাড়ির চলন হওয়াটা পৃথিবীকে অনেক বেশি করে জয় করবার ব্যাপার। কিন্তু মালিকদের মাথায় একথা আসতে চায় না। তাই, প্রাচীন মিশরের যারা মহাপ্রভু ছিলো তাদের পক্ষে এই কথাটা ভেবে দেখবার দরকার পড়ে নি। সেই জন্যেই মানুষ চাকা-ওয়ালা গাড়ি তৈরি করতে শেখবার হাজার বছর পরে মিশর দেশে চালু হলো এই ধরনের গাড়ি। পৃথিবীকে জয় করবার কাজ কী রকম ভাবে ঠেকিয়ে রাখবার চেষ্টা তা বুঝতেই পারছো!
মালিক-প্রভুরা বরাবরই ওই রকম। পৃথিবীকে বদল করার উৎসাহ নেই, বরং বদলকে ঠেকিয়ে রাখবার চেষ্টাই। মানুষ যখনই পৃথিবীকে নতুন নতুন ভাবে জয় করবার নতুন নতুন উপায় বের করেছে, মালিকের দল সৃষ্টি করেছে নতুন নতুন বাধা। কখনো বা জিত হয়েছে মালিকের। পৃথিবীকে বেশি করে, ভালো করে, জয় করবার পথ আবিষ্কার করা গেলেও মানুষ এগুতে পারে নি। সেই পথে। কাজে আসে নি মানুষের আবিষ্কার। আবার কখনো-বা হার হয়েছে মালিকদের, নতুন আবিষ্কারকে প্ৰাণপণে বাধা দিয়ে তারা ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি মানুষের এগিয়ে চলায়, হার হয়েছে মালিকদের; নতুন আবিষ্কারের জোরে, নতুন হাতিয়ার হাতে মানুষের দল হটিয়ে দিয়েছে মালিকদের। মালিকদের হটিয়ে দেবার পর কখনো-বা শক্তি এসেছে মেহনতকারী মানুষদের হাতেই; কিন্তু বেশির ভাগ বেলাতেই শক্তিটা এসেছে নতুন এক ধরনের মালিকদের হাতে। এই যে নতুন ধরনের মালিক, এরা যখন দেখে মানুষ আরো নতুন, আরো ভালো, আরো আশ্চর্য ভাবে পৃথিবীকে জয় করবার পথ খুঁজে পেয়েছে তখন এদেরও বুক ভয়ে কেঁপে ওঠে। এরাও মরিয়ার মতো রুখে দাঁড়ায় নতুন আবিষ্কারের বিরুদ্ধে।
পৃথিবীকে বদল করার নামে মালিকদের আতঙ্ক। তাই ওদের দলের বড়ো বড়ো ডাকসাইটে পণ্ডিতেরা নানান রকম বুদ্ধির কসরত করে প্রমাণ করতে চায় বদল যা-কিছু তা মায়া, তা মিথ্যে! আসলে যা সত্যি তার মধ্যে বদল নেই। সত্যু হলো অনাদি, অনন্ত, শাশ্বত! কিন্তু মেহনতকারী মানুষের চোখে এই সব বুদ্ধির কসরত যতো ধাঁধাই লোগাক না। কেন, তারা আসলে এই ধাপ্পাবাজিতে ভোলে নি। জনগণ যদি সত্যিই এই ধাপ্পাবাজিতে ভুলে যেতো, পৃথিবীকে বেশি করে, ভালো করে, বদল করবার তাগিদ যদি সত্যিই মুছে যেতো তাদের মন থেকে কী সৰ্বনাশই হতো তাহলে! কিন্তু মেহনতকারী মানুষ মনে প্ৰাণে এই সব কথায় বিশ্বাস করে নি বলেই আজো মানুষের পক্ষে পৃথিবীকে নতুন করে গড়বার স্বপ্ন, পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনবার স্বপ্ন। সেই পৃথিবীতে শোষণ নেই, পরের মেহনত দিয়ে গড়া জিনিস লুট করে নিজের ভাড়ার ভর্তি করবার কথা ওঠে না। সেই পৃথিবীতে লোভ নেই, হিংসে নেই, নেই রক্তারক্তি বাধাবার নেশা। সেই পৃথিবীতে মানুষ বাঁচবে মিলেমিশে, একসঙ্গে। দশের ভালোতেই একের ভালো, একের ভালোতেই দশের ভালো।
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আসবে,-জনগণের এই স্বপ্ন তার গানে, তার উপকথায়। শোষকের দল যে-গল্প সৃষ্টি করেছে, কিংবা যে-গল্পের সৃষ্টি হয়েছে শোষকদের খুশি করবার জন্যে সেগুলো অনেক শৌখিন। অন্য রকমের। সেগুলোয় আমোদ-প্রমোদর কথা, মালিকদের মন-যোগানো কথা। জনগণের সৃষ্ট গল্প সে-রকম নয়। দু-চারটে নমুনা দেখলেই বুঝতে পারা যাবে।
ধরা যাক, একটা রূপকথার কথা। এক বীর দৈত্যপুরীতে বন্দী হয়ে রয়েছে, দৈত্যেরা তার মাথায় সোনার কাঠি ঠেকিয়ে তাকে যাদু করেছে, ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। জনগণের আশা আর ইচ্ছে দিয়ে গড়া এই বীরটি! সোনার শক্তি যাদের হাতে তারা, অর্থাৎ দৈত্যের মতো মালিকেরা, তারা বন্দী করে রেখেছে। মালিকদের অনেক অনেক টাকা, সোনার শক্তিটাই তাদের আসল শক্তি, তাই সোনার কাঠি ছুঁইয়ে বীরটিকে বন্দী করবার গল্প। কিন্তু জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা চিরটা কাল বন্দী হয়ে থাকবে না, সেই বীরের ঘুম ভাঙবে একদিন! ঘুম ভাঙাবে কে? শাক-কুড়ুনি মেয়ে। জনগণের একজন, মেহনতকারীদেরই একজন-বড়ো গরিব, শাক কুড়িয়ে দিন কটায়। আর তারপর? বীরপুরুষের ঘুম ভাঙবার পর? ওই শাক-কুড়ুনি মেয়ের হাত ধরে সে দৌড়ে যাবে অনেক দূরে। সেখানে একটা পুকুর আছে। সেই পুকুরে এক ডুব দিয়ে সে তুলে আনবে একটা ছোট্ট কৌটো। কৌটোটার মধ্যে দৈত্যদের প্রাণভোমরা লুকোনো। তারপর আঁচল পেতে ধরবে ওই শাক-কুড়ুনি মেয়ে, আর সেই আঁচলের মধ্যে পুরে বীরপুরুষ দলে মারবে এই প্ৰাণ-ভোমরাকে, আর দৈত্যপুরীর সমস্ত দৈত্য আছড়ে-পিছড়ে মরে যাবে। শেষ হবে শোষকদের দাপট। তারপর জনগণের আশা-ইচ্ছে দিয়ে গড়া সেই বীরপুরুষ ফিরে পাবে তার দেশ, সে-দেশে রাণী হবে ওই শাক-কুড়ুনি মেয়ে, আর সেই দেশে সমস্ত মানুষ সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর করবে। দৈত্যদের দাপট নেই, জল নেই মানুষের চোখে।
কিংবা, ওই কড়িগাছের গল্পটাই ধরো না। গায়ের কাছেই একটা কড়িগাছ ছিলো। সুন্দর সুন্দর আর গোটা গোটা কড়ি ধরে গাছটা যেন ঝলমল করতো। তো সব সুন্দন সুন্দর কড়ি, কিন্তু গায়ের মানুষ গাছটার কাছে ঘেঁসতে পারে না। কেননা, গাছটার মালিক হলো এক সাংঘাতিক বাঘ, সমস্ত দিন আর সমস্ত রাত্তির ধরে গাছটার চারপাশে তার কড়া পাহারা। তার মানে? মানে, মানুষ আবিষ্কার করছে ঐশ্বর্য, তবু সে-ঐশ্বর্ষে মানুষের অধিকার নেই। অধিকারটা অপরের, সে-ই মালিক। তাই বাঘটার অমন কড়া পাহারাদারি; গায়ের ছোটো ছোটোছেলেমেয়ের দূর থেকে গাছটাকে দেখে, কাছে যাবার সাহস পায় না। কিন্তু বাঘ কি চিরকাল অমনভাবে গাছটাকে আগলে বসে থাকবে? জনগণের গল্পে বলে, না তা নয়। মালিকদের ওই মালিকানা একদিন শেষ হবে, পৃথিবীর ঐশ্বর্য এসে পৌছবে মানুষের হাতে, জনগণের হাতে! তাই রূপকথার গল্পে বলে, গায়েরই একটি ছোট্ট মেয়ে একদিন এমন এক কাণ্ড করে বসবে যার ফলে ওই পাহারাদার বাঘের মুখটা ফুটন্ত ফ্যানে পুড়ে খাক হয়ে যাবে। মরে যাবে বাঘ। শেষ হবে তার পাহারাদারির পালা। আর কড়িগাছটা আসবে গায়ের ছেলে-মেয়েদের দখলে। মালিকের দাপট শেষ। পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী।
এই তো রূপকথার গল্প। এই রকমের অনেক সব গল্প।
কে লিখলো এই সব গল্প? কেউ জানে না। আমি শুনেছি। আমার ঠাকুমার মুখ থেকে, আমার ঠাকুমা শুনেছিলেন তাঁর ঠাকুমার মুখ থেকে। আসলে, সত্যিইতো কোনো একজন লোক কোনো একদিন মাথা খাটিয়ে এইসব গল্প ফাঁদতে পারে নি। তাই এ-সব গল্প কবে লেখা তা কেউ জানে না। অনেক অনেক বছর ধরে অনেক অনেক আশা-আকাঙক্ষা এইসব গল্পে রূপ নিয়েছে। অনেক অনেক বছর ধরে অনেক অনেক মানুষ স্বপ্ন দেখেছে এই পৃথিবী বদলে গিয়ে নতুন এক পৃথিবী আসবে। সে-পৃথিবীই হলো আসল রূপকথার রাজ্য। সে পৃথিবী প্রাচুর্যে টলমল, সেখানে জল নেই মানুষের চোখে, দাপট নেই দৈত্যের।
সেই পৃথিবীর স্বপ্ন। দুনিয়াকে বদল করবার স্বপ্ন। জনগণের মন থেকেও যদি নিভে যেতো এই স্বপ্ন, যদি তারাও ভাবতো এই দুনিয়ার বদল নেই, এই দুনিয়াকে বদল করা যায় না, তাহলে থেমে যেতো মানুষের গল্প। কিন্তু জনগণ তা ভোলে নি। ওই নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন তার মনকে বাঁচিয়ে রেখেছে, আর তাই দিনের পর দিন হাতের হাতিয়ার দিয়ে সে বদল করে চলেছে পৃথিবীকে।
থেমে যায় নি মানুষের গল্প। মানুষের গল্প থামবে না কোনোদিন।