রোমের দম্ভ

রোমের দম্ভ 

কিন্তু এটা কি ঠিক উচিত ব্যাপার? ক্রীতদাসের দল শুধুই খেটে মরবো, খেতে পাবে। না, আর যারা মেহনত করবে না তারাই লুঠবে ফুর্তি? এ-প্রশ্নের জবাব দিলেন এক মহাপণ্ডিত, তিনি বাস করতেন রোম নগরে। তিনি বললেন, মানুষের দল ঠিক মানুষের শরীরের মতোই। এ-শরীরে হাত আছে, আবার পেট বলে জিনিসও আছে। হাত-দুটো তো সারাদিন খাটে, তবু খাই-খাই করে না। পেটটা একটুও খাটে না, অথচ সমস্ত খাবার তো তার জন্যেই। মানুষের দলের বেলাতেও ওই রকমের হওয়া চাই:কেই কেউ খাটবে, শুধু খাটবে,— কিন্তু তাদের পক্ষে খাই-খাই করা চলবে না। আবার কেউ কেউ বিলকুল গতির নড়াবে না, শুধু খাবে। এতে কারুর পক্ষেই মেজাজ গরম করা চলবে না; শরীরের মধ্যে হাতজোড়া কি কখনো বেঁকে বসে, কখনো কি বলে-সব খাবারটাই যখন পেটে যায়। তখন আর আমরা খেটে মরি কেন? 

খাসা কথা। রোমানদের পক্ষে একেবারে মনের মতো কথা। কেননা, ওদের অন্দর মহলের খবরটা ওই গ্রীকদেরই মতো-সেই ক্রীতদাস, বেঁচে থাকবার জন্যে যতোখানি মেহনত দরকার তার দায়টা ক্রীতদাসদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা। এদিক থেকে গ্রীকদের সঙ্গে রোমানদের তফাত ছিলো। উনিশ-বিশের : গ্রীকরা হয়তো ফালতু সময়টায় বসে থিয়েটার দেখতো আর রোমানরা হয়তো সিংহের খাঁচায় ক্রীতদাসকে পুরে দিয়ে মজা দেখতে সিংহ কেমন করে মানুষ ছিড়ে খায়! গ্রীকরা হয়তো ক্রীতদাসদের অষ্টপ্রহর লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতো না, হয়তো ক্রীতদাসদের লেখাপড়াও শেখাতো, কেননা লেখাপড়া শিখে নিলে ক্রীতদাসরাই বাড়ির ছেলে।পুলেদের লেখাপড়াও শেখাতো, কেননা লেখাপড়া শিখে নিলে ক্রীতদাসরাই বাড়ির ছেলে। পুলেদের লেখাপড়া শেখাতে পারবে; তার মানে মাস্টারি করবার মেহনতটুকুও ক্রীতদাসদের ঘাড়ে তুলে দেওয়া যাবে। আর রোমানরা হয়তো ক্রীতদাসদের জন্যে ব্যবস্থা রেখেছিলো। শুধু চামড়ার চাবুকের। এই সব উনিশ-বিশের তফাত। এই সব তফাত নিয়ে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করবারও মানে হয় না। কেননা, যাকে বলে দাস-প্রথা সেদিক থেকে দুই-ই এক; সেই গোরু-ভেড়া আর হাল-লাঙলের মতো মানুষ নিয়ে কেনা-বেচা, সেই নগদ পয়সা দিয়ে কেনা মানুষগুলোর ঘাড়ে মেহনতের সবটুকু দায় তুলে দেওয়া—গ্ৰীক সভ্যতার অন্দর মহলে যে-রকম, রোমান সভ্যতার অন্দর মহলেও সেই রকমই । 

তফাত আসলে দুটো সভ্যতার সদর মহলের। ক্রীতদাসদের কাঁধের ওপর মেহনতের সবটুকু দায় চাপিয়ে দিয়ে গ্রীকরা মন দিয়েছিলো শিল্প, সাহিত্য, দর্শন আর বিজ্ঞানের দিকে। কিন্তু রোমানরা? ওরা মন দিয়েছিলো। শুধু ডাকাতি করবার দিকে— শুধু পরের দেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লুঠতরাজ করবার দিকে। রোমানদের ইতিহাসে তাই একের পর এক যুদ্ধের কথা, লেখাপড়া বা জ্ঞানচর্চা করবার কথাটা বড়ো নয়। তার মানে, রোমান সভ্যতার অন্দর মহলে ক্রীতদাসদের আর্তনাদ, সদর মহলে ডাকাত দলের উল্লাস। অবশ্য অনেকে রোমানদের অনেক রকম কীর্তিকলাপ নিয়ে উচ্ছাস করেন।—কেউ বা শোনাতে চান ওদের বীরৎবের কথা, দিগ্বিজয়ের মহিমা। আবার কেউ বা বলেন রোমানদের তৈরি আইনকানুনগুলো নাকি খুবই অসাধারণ। কিন্তু অতো উচ্ছাস করবার আগে মনে রাখা দরকার দিগ্বিজয়টা হলো ডাকাতিরই গালভরা নাম আর আইনকানুনগুলো আসলে গরিব লোকদের শায়েস্তা রাখবার কায়দাকানুন ছাড়া কিছুই নয়। 

কিন্তু ক্রীতদাসরা যে শুধু মুখ বুজে চামড়ার চাবুক খেয়েছে। এ-কথা মনে করলেও নেহাতই ভুল করা হবে। ওরাও শিখেছিলো দল বাঁধতে, দল বেঁধে একজোট হয়ে মাথা তুলে দাড়াতে, বলতে; অত্যাচার মানবো না, মানবো না চামড়ার ওই চাবুক, সিংহের খাচায় ফেলে দিয়ে ফুর্তি দেখার পালা। বিদরোহ করেছিলো। ওরা— বারবার বিদরোহ, দারুণ বিদ্‌রোহ সে সব। মালিকদের মালিকানা বারবার টলমল করে উঠেছে। তাছাড়া, মালিকদের নিজেদের মধ্যেও মারামারি কাটাকাটি : পরের দেশ লুঠ করে আনা অগাধ ধনরত্ব আর এই ধনরৎবের ভাগাভাগি নিয়ে মারপিট। একদিকে ক্রীতদাসদের বিদ্‌ৰোহ আর একদিকে নিজেদের মধ্যে মারপিট— শেষ পর্যন্ত এরই দরুন শেষ হলো রোমের দম্ভ। কেমনভাবে তাই দেখা যাক। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *