মনের মতো কথা
আরো একটুখানি তলিয়ে দেখা যাক, দেখা যাক ঠিক কোনা ধরনের কথাগুলো শাসকদের মনের মতো কথা। খুব মোটামুটিভাবে বললে বলতে হবে, এই ধরনের কথা আছে দুটো। এক হলো, এই যে দুনিয়া এটা আসলে সত্যি জিনিস নয়। আর দু-নম্বরের কথা হলো, এই দুনিয়াতে আসলে কোনো অদলবদল নেই, যা সত্য তা চিরকাল একই রকম, তা বদলায় না। কথা দুটোকে ভালো করে বোঝবার দরকার আছে।
প্রথমত, দুনিয়টিকে আমরা যেভাবে দেখি সেইভাবে দেখাটা ঠিক দেখা নয়। আমরা দেখি, এই দুনিয়ায় মাটি আছে, মাটির বুকে ফসল ফলায় মানুষ আর সেই ফসল খেয়ে পেট ভরে মানুষের। শাসকদের মনের কথা হলো, এই সবই ভুল দেখা। যেমন, ভুল করে মানুষ অনেক সময় দড়িতে সাপ দেখে-সেই রকম। আসলে ওখানে আছে দড়ি, সাপ নয়। তবু অন্ধকার আর অজ্ঞানের ঘোরে ভুল করে কেউবা ভাবলো সাপই। এও তেমনি। আছে। অন্য রকমের জিনিস, সাধারণ মানুষ ভুল করে দেখছে মাটির পৃথিবী, রক্তমাংসে গড়া মানুষ, এই রকম কতোই না!
কিন্তু এই ধরনের কথাটাই শাসকদের মনের কথা কেন? কেননা, সাধারণ মানুষকে যদি কোনোমতে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে এই মাটির পৃথিবীটা সত্যি নয়, রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া মানুষগুলোও সত্যি নয়, সত্যি নয়। মানুষের পেটের জ্বালা সত্যি নয় অন্ন-বস্ত্ৰ যা দিয়ে পেটের জ্বালা মেটানো যায়, শীতের হাত থেকে শরীরকে বাঁচানো যায়।— তাহলে সাধারণ মানুষের মনটা অন্য দিকে যাবে, মাটির পৃথিবীর কাছ থেকে আদায় করা জিনিসপত্তরগুলোকে আর তারা অতো দামী মনে করবে না। আর সাধারণ মানুষের মন যদি সত্যিই অন্যদিকে যায় তাহলে শোষকরা তো দিববি নিশ্চিন্তি।
ভেবে দেখো একবার। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাটির বুকে ফসল ফলায় তারা যদি বলতে শুরু করেঃ ওই ফসলটাই হলো সত্যি, ওই ফসল দিয়ে পেট ভরানোটাই হলো সত্যি; আমি চাই ওই ফসল, যতোটা আমার মেহনত দিয়ে তৈরি ততোটার ওপর দখল শুধু আমার, আর কারুর নয়’-তাহলে? যদি সমস্ত মেহনতকারী মানুষ মাটির পৃথিবীটাকে এইভাবে সত্যি বলে চিনতে শুরু করে, তাহলে শাসকদের মন ভয়ে কেঁপে উঠবে না কি? তাই শাসকদের মনের কথাটা উলটো ধরনে কথা। মাটির পৃথিবীটা সত্যি জিনিস নয়, এর পেছনে অন্য কিছু আছে, যা সত্যি, যা বাস্তব।
আর অদল-বদল। পৃথিবীটা কি সত্যিই বদলে যায়? আজ তার চেহারাটা যে-রকম আগামীকাল কি সেই রকম আর থাকবে না? বদলে গিয়ে অন্য রকম হয়ে যাবে? শাসকের দল নিশ্চয়ই আর্তনাদ করে বলবেঃ না না, তা কিছুতেই নয়, তা কখনো হতেই পারে না। আজকের দিনে পরের মেহনত দিয়ে গড়া জিনিস লুঠ করে যে-রকম মজায় দিন কাটছে বরাবরই যেন সেই রকম ভাবে দিন কাটে। পৃথিবী বদলে গিয়ে অন্য রকম হয়ে গেলে চলবে কেন? আসলে, পৃথিবীতে অদল-বদল বলে আমরা যা কিছু দেখি তার সবটুকুই হলো দেখার ভুল। বদল আসলে নেই, ভুল করে মনে করছি বদল দেখছি বুঝি। এও ওই দড়িতে সাপ দেখারই মতো। শোষকের দল এই কথাটাও সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করাতে চায়। বলতে চায়, পৃথিবীটা চিরন্তন, অদল-বদল বলে বাস্তবিকই কিছু নেই পৃথিবীতে।-
মোটামুটি এই দুটো কথাই হলো শাসকদের মনের মতো কথা। এই দুটো কথা যদি সাধারণ মানুষের মনে খুব গভীরভাবে গেঁথে দেওয়া যায়। তাহলে তার মন একেবারে চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে থাকবে, শোষণের বিরুদ্ধে, শাসনের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, এই মন কোনোদিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আর মন যদি না ওঠে তাহলে হাতও উঠবে না। হাত না উঠলে নিশ্চিন্তি!
তাই ধর্ম ছাড়াও শাসকদের তরফ থেকে অন্য রকম ব্যবস্থাও বন্দোবস্ত আছে। মস্ত বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের মুখ দিয়ে এই কথাগুলো প্রচার করানো। তারা সব এমনই ডাকসাইটে পণ্ডিত যে তর্ক করে দিনকে রাত বলে প্রমাণ দিতে পারেন! তুমি হয়তো স্পষ্টই বুঝছে যে তোমার দারুণ খিদে পেয়েছে, এক দল ভাত গিললেই তোমার পেটের জ্বালা জুড়োবে। কিন্তু ওই সব বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা এমন সব তর্কের মারপ্যাচ শুরু করবে: যে তোমার কাছে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাবে, আর তুমি শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হবে যে তোমার কথাটাই ভুল,
ওদের কথাটাই সত্যি। মেহনত করবার সময়, গতির খাটাবার সময়, মানুষ স্পষ্টই দেখছে যে তার হাতের কোদালটা সত্যিকারের কোদাল, যে-মাটিটা কোপানো হচ্ছে সেটাও আসলে সত্যিকারের মাটি, আর শেষ পর্যন্ত যে-ফসলটা ফলছে। সেটাও নেহাতই সত্যিকারের ফসল। কিন্তু মেহনতের কথাটা, গতির খাটাবার কথাটা, আলাদা কথা। যখন থেকে মানুষের সমাজ চিড় খেয়ে দু-ভাগে ভেঙে গিয়েছে তখন থেকেই গতির খাটানো আর মাথা খাটানোর মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই, গতর খাটাবার সময় যেকথাটাকে স্পষ্ট আর সত্যি বলে মনে হয় মাথা খাটিয়ে সেই কথাটাকেই একেবারে তুল আর বাজে কথা বলে প্রমাণ করে দেওয়া।
যতো দিন কেটেছে ততোই ধারালো হয়েছে, শাণিত হয়েছে শোষকদলের পণ্ডিতদের এই সব যুক্তি-তর্কগুলো! দিনের পর দিন ধরে যারা দিনকে রাত করে চলেছে, আর সবাই মুগ্ধ হয়ে বলেছেঃ কী অসাধারণ পণ্ডিত! কী বিদ্যা! কী বুদ্ধি! শোষকরা খাতির করে সভায় ডেকে এনেছে। এইসব পণ্ডিতদের।
এমন কি আজকের পৃথিবীতেও এই ধরনের ব্যাপারে শেষ নেই। তার কারণ আজকের পৃথিবীতেও এক দিকে শোষক আর শাসক আর একদিকে মেহনতকারী মানুষ, যাদের ভুল বোঝানো দরকার। তারা হয়তো ক্ষেপে উঠবে, বলবো ? ‘পৃথিবীকে বদল করবো। আমরা! শেষ হবে শোষণ, পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আসবে।’