৩. ওয়াশিংটনের ডালাস এয়ারপোর্টে

দ্বিতীয় পর্ব
তোরো

ওয়াশিংটনের ডালাস এয়ারপোর্টে প্লেনটা ল্যান্ড করল। স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে এক তরুণ এসেছে তাদের নেবার জন্য।

–মিসেস অ্যাসলে, আমি জন বার্নস। মিস্টার রজার্স আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য উদ্গ্রীব। তিনি বলেছেন, আপনাদের হোটেলে পৌঁছে দিতে।

–অনেক ধন্যবাদ।

কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। তারা একটা লিমুজিনে গিয়ে বসলেন। ওয়াশিংটন শহরের দিকে গাড়িটা এগিয়ে চলেছে।

টিমের মনে উৎসাহ আকাশছোঁয়া। সে বলছে- দেখ দেখ, এটা লিংকন মেমোরিয়াল।

বেথ বলল- এটা হল ওয়াশিংটন মনুমেন্ট।

ম্যারি জন বার্নসের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার ছেলেমেয়েগুলোর হয়েছে এই দশা কী বলতে হবে বুঝতে পারে না।

শেষ পর্যন্ত তিনিও চিৎকার করলেন এই দেখ, এই হল হোয়াইট হাউস!

লিমুজিন পেনসিলভেনিয়া এভিনিউ দিয়ে ছুটে চলেছে। এখানে বিশ্বের কতগুলো আকাশরেখা দাঁড়িয়ে আছে। এই শহরটা সারা পৃথিবীকে শাসন করে। এখানেই ক্ষমতার কেন্দ্র বলা যেতে পারে, আমি এখন সেই ক্ষমতার একজন হব, ম্যারি মনে মনে ভাবলেন। একটু উত্তেজনা, একটু আনন্দ, কিছুটা দুর্ভাবনা।

ম্যারি বললেন কোথায় গেলে মিঃ রজার্সের দেখা পাব?

আগামীকাল সকালে তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।

.

পেট কোনরস, সিআইএ-র অন্যতম অধিকর্তা। এখন কাজে ব্যস্ত। সকাল তিনটে বেজেছে। প্রেসিডেন্টের দৈনিক কার্যকলাপ শুরু হবে। রিপোের্ট এসে গেছে, ছোটো ছোটো সংকেত চিহ্ন। সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে আশঙ্কা–প্রেসিডেন্ট এলিসন নাকি তাদের উপগ্রহ ব্যবস্থাতে আঘাত হানতে চলেছেন।

পেট কোনরসের কাছে খবর আসছে, প্রতি মুহূর্তে, ম্যারি অ্যাসলে ওয়াশিংটনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা পেটের কাছে জানানো হয়েছে। পেট ছবি দেখেছেন। পেট ভাবলেন, আঃ একেবারে নিখুঁত পরিকল্পনা!

.

রিভারটেল টাওয়ার। ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সের পাশে। ছোট্ট ফ্যামিলি হোটেল। সুন্দরভাবে সাজানো

একজন লাগেজ নিয়ে চলে গেল। ম্যারি তাকালেন।

ফোন বেজে উঠেছে।

পুরুষের কণ্ঠস্বর–মিসেস অ্যাসলে?

–হ্যাঁ।

–আমি বেন কোহন; ওয়াশিংটন পোস্টের এক রিপোর্টার। আপনার সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলতে পারি কী?

ম্যারির কণ্ঠে ইতস্তত আমরা এইমাত্র এসেছি। আমি খুবই…

–আমি মাত্র পাঁচ মিনিট সময় নেব।

–ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।

.

বেন কোহন খর্বাকৃতি, টগবগে মানুষ। পুরুষোচিত চেহারা। মনে হয় তিনি বোধহয় এক বক্সার। মনে হল এক সোর্স রিপোর্টার।

তিনি চেয়ারে বসলেন। বললেন– এই প্রথম আপনি ওয়াশিংটনে আসছেন, তাই তো?

 –হ্যাঁ, ম্যারি দেখলেন, ভদ্রলোকের হাতে কোনো নোটবই নেই। টেপরেকর্ডার নেই।

–আমি আপনাকে কয়েকটা বোকার মতো প্রশ্ন করব।

করতে পারেন।

–ওয়াশিংটন শহরটা কেমন লাগছে?

–আমি কোনো বিখ্যাত মানুষ নই। ওয়াশিংটনে এসে মোটামুটি ভালোই লাগছে।

–আপনি তো কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসার ছিলেন?

 –হ্যাঁ, আমি পড়াতাম পূর্ব ইউরোপ সম্পর্কে।

–প্রেসিডেন্ট পূর্ব ইউরোপ সম্পর্কে আপনার একটি বই পড়েছিলেন। আর ম্যাগাজিনের প্রবন্ধ। তাই তো?

-হ্যাঁ।

বাকিটা ইতিহাস।

–এমন ঘটতেই পারে।

তা বলবেন না। একইভাবে জিন কিক প্যাট্রিকের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রেগনের আলাপ হয়েছিল। জিনকে রাষ্ট্রপুঞ্জের অ্যাম্বাসাডর করে পাঠানো হয়। আপনিও সেই ধারাটিকে বহন করছেন। আপনার ঠাকুরমা-ঠাকুরদাদা রোমানিয়াতে জন্মেছিলেন, তাই তো?

–আমার ঠাকুরদাদা, ঠিকই বলেছেন।

বেন আরও পনেরো মিনিট থাকলেন। ম্যারির পূর্ব ইতিহাস জেনে নিলেন।

ম্যারি বললেন– কখন কাগজে এই ইন্টারভিউটা ছাপা হবে?

তিনি ফ্লোরেন্স আর ডগলাসকে কপি পাঠাবেন।

বেন বললেন- আমি এটাকে এখন সেফ করে রাখব। পরবর্তীকালে আবার কথা হবে, কেমন?

সাংবাদিক চলে গেছেন। বেথ আর টিম বলল- মা, ভদ্রলোক দারুণ ভালো!

ম্যারি ইতস্তত করছেন- জানি না, হয়তো তাই।

.

পরের দিন সকালে স্টানটন রজার্সের ফোন এল।

–গুড মর্নিং মিসেস অ্যাসলে। আমি স্টানটন রজার্স বলছি।

পুরোনো বন্ধুর পালা। হয়তো এই শহরে ওই ভদ্রলোককেই আমি একমাত্র চিনি, ম্যারি ভাবলেন।

–গুডমর্নিং মিঃ রজার্স। মিঃ বার্নস আমাদের সাথে দেখা করেছেন। হোটেলটা চমৎকার।

ভালো লাগছে?

–অসাধারণ!

–কিছু ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

কখন যাব?

আমরা আজ গ্রান্ডে লাঞ্চ করব। আপনার হোটেলের কাছে। একটার সময়।

-ঠিক আছে।

 –আপনার সঙ্গে আমি একতলার ডাইনিং রুমে দেখা করব।

এইভাবেই গল্পটা শুরু হল।

.

রুম সার্ভিসকে বলা হয়েছে, একটা ট্যাক্সি এসেছে। গ্র্যান্ড হোটেলে ম্যারি পৌঁছে গেছেন। গ্র্যান্ড হোটেলকে ক্ষমতার কেন্দ্র বলা যায়। নানা প্রান্তের রাষ্ট্রদূতরা এখানেই থাকেন। অসাধারণ রাজকীয় একটি বাড়ি, বিরাট লবি, ইতালিয়ান মার্বেল দিয়ে তৈরি করা মেজে। রাজকীয় কলামের ওপর স্থাপিত। চোখ জুড়িয়ে যায় এমন বাগান। ভেতরে একটা ঝরনা, বাইরে সুইমিং পুল। মার্বেল পাথরের তৈরি সিঁড়ি। তার পাশেই সাজানো রেস্টুরেন্ট।

–গুড আফটারনুন, মিসেস অ্যাসলে।

–গুড আফটারনুন, মিঃ রজার্স।

–এভাবে কথা বলে কী লাভ? আমরা পরস্পরকে স্টান আর ম্যারি বলে ডাকব।

–ঠিকই বলেছেন।

স্টানটনকে এখন একেবারে অন্যরকম লাগছে। তিনি অনেক কথা বললেন। আহা, ম্যারি ভাবলেন, উনি আমাকে গ্রহণ করেছেন।

–আপনি কি ড্রিঙ্ক করেন?

ধন্যবাদ। না, আমি করি না।

লাঞ্চের অর্ডার দেওয়া হল। অসম্ভব দামি, জাংশন সিটির মতো ছোটোখাটো হোটেল নয়।

-স্টান, আমি একটা কথা জানতে চাইছি। অ্যাম্বাসাডরকে কী পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়?

হাসি– এটা ভালো প্রশ্ন। আপনি বছরে পঁয়ষট্টি হাজার ডলার পাবেন। তার সাথে হাউজিং অ্যালাউন্স।

কাজটা কখন থেকে শুরু হবে?

–যে মুহূর্তে আপনি শপথ নেবেন।

কতদিন পর্যন্ত?

–আপনাকে প্রত্যেকদিন পঁচাত্তর ডলার করে দেওয়া হবে।

 হৃৎপিণ্ড আন্দোলন করতে শুরু করেছে।

–আমাকে কতদিন ওয়াশিংটনে থাকতে হবে?

একমাস। এই সময় আমরা আপনাকে প্রশিক্ষিত করে তুলব। ইতিমধ্যে আমাদের স্টেট সেক্রেটারি রোমানিয়া সরকারের কাছে খবর পাঠাবেন। এটা কতগুলো সরকারি ব্যাপার। আপনার কোনো সমস্যা হবে না।

তার মানে? রোমানিয়া সরকার আমাকে গ্রহণ করবে?

-চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা কমিটির সবাইকে ডাকব। তারা আপনার সঙ্গে ওই পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করবেন। এই দেশের প্রতি আপনি কতখানি অনুগত তা দেখা হবে। দেখা হবে এই কাজটাকে আপনি কত ভালোবাসেন।

তারপর কী হবে?

কমিটির মধ্যে ভোট হবে। প্রত্যেকে রিপোর্ট জমা দেবেন।

 ম্যারি শান্তভাবে বললেন– আগেও এমন হয়েছে।

–আপনার পক্ষে প্রেসিডেন্ট আছেন, হোয়াইট হাউসের পুরো সমর্থন আপনি পাবেন। আপনি একেবারেই চিন্তা করবেন না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, রোমানিয়াতে আপনার শুভ পদক্ষেপ আঁকা হবে। যে কদিন ওয়াশিংটনে আছেন, ছেলেমেয়েদের নিয়ে শহরটাকে ভালোভাবে ঘুরে দেখুন। আমি একটা গাড়ির বন্দোবস্ত করব। ড্রাইভার দিয়ে দেব। ইচ্ছে হলে হোয়াইট হাউসে আসতে পারেন, প্রাইভেট ট্যুরে।

–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। স্টানটন রজার্স হাসলেন আমার সৌভাগ্য।

.

হোয়াইট হাউসে প্রাইভেট ট্যুর! পরের দিন সকালেই। সঙ্গে একজন গাইড ছিল। তাদের জ্যাকোলিন রোজ গার্ডেনে নিয়ে যাওয়া হল। ষোড়শ শতকের আমেরিকান গার্ডেন। টলমলে জলের পুকুর আছে। গাছের সারি। ছোটো ছোটো গুল্ম। হোয়াইট হাউস কিচেন।

গাইড বলল- এই সামনে হল ইস্টউইন্ড, এখানে মিলিটারি অফিস আছে। প্রেসিডেন্টের সাংসদরা এখানেই থাকেন। তার পাশে ভিজিটার্স অফিস। প্রেসিডেন্টের পত্নীর অফিস। তারা পশ্চিম প্রান্তে চলে গেলেন। প্রেসিডেন্টের ডিম্বাকৃতি অফিস দেখা গেল।

টিম জানতে চাইল এখানে মোট কটা ঘর আছে?

গাইড ভদ্রলোক জবাব দিলেন– ১৩২টা ঘর। ৬৯টা ক্লোসেট, ২৯টা ফায়ারপ্লেস আর ১৭টা বাথরুম।

এইভাবেই গল্পটা পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছে গেল। ম্যারি ভাবলেন, আজ থেকে আমি হোয়াইট হাউসের এক অঙ্গ হয়ে গেলাম।

.

প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে ফোন এল। পরের দিন সকালে।

–গুড মর্নিং, মিসেস অ্যাসলে, প্রেসিডেন্ট এলিসন আজ সন্ধায় আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।

ম্যারি ইতস্তত করছেন- হা, কখন?

-তিনটের সময়?

 –ঠিক আছে।

–একটা লিমুজিন আপনাকে নেবার জন্য আসবে।

.

পল এলিসন উঠে দাঁড়ালেন। ম্যারি ওভাল অফিসে ঢুকে পড়েছেন।

তারা করমর্দন করলেন। ম্যারি হাসলেন- আপনাকে দেখে খুবই ভালো লাগছে মিঃ প্রেসিডেন্ট। এটা আমার কাছে এক মস্ত সম্মান।

বসুন মিসেস অ্যাসলে, আমি কি আপনাকে ম্যারি বলে ডাকতে পারি?

–প্লিজ।

তারা কৌচে বসলেন। প্রেসিডেন্ট এলিসন প্রশ্ন করলেন- আপনি কি আমার পরিকল্পনা জানেন?

–আমি ঠিক জানি না।

–আমি আপনার সর্বশেষ আর্টিকেলটা পড়ে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। বুঝতে পেরেছি, রোমানিয়া সম্বন্ধে আপনার অসাধারণ জ্ঞান আছে। মধ্য ইউরোপ সম্পর্কে আপনার ধারণাটা স্পষ্ট। তাই আপনার ওপর আমি নির্ভর করছি। গ্রোজাকে হত্যা করা হয়েছে। আপনার কাজটা আরও কঠিন হয়ে গেল। আপনি সাম্যবাদী দলগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলবেন।

তিরিশ মিনিট ধরে আলোচনা। শেষ পর্যন্ত পল এলিসন বললেন– স্টানটন রজার্স আপনার ওপর নজর রাখবে। সে ইতিমধ্যে আপনার অনুগামী হয়ে উঠেছে।

.

পরবর্তী বিকেলবেলা স্টানটন রজার্সের ফোন এল। বলা হল আজ নটার সময় চেয়ারম্যান অফ সেনেট ফরেন রিলেশন কমিটির সঙ্গে বৈঠক করতে হবে।

.

ফরেন রিলেশন অফিস আছে ওভাল বিল্ডিং-এ। ওয়াশিংটনের সবথেকে পুরোনো বাড়ি।

চেয়ারম্যানের বয়স হয়েছে। সবুজ চোখ। দেখে মনে হয়, তিনি এক ঝানু রাজনীতিবিদ।

তিনি ম্যারিকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন- আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুবই ভালো লাগছে। আমার নাম চার্লি ক্যামবেল। আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি।

ভালো অথবা খারাপ– ম্যারি ভাবলেন।

এখানে বসুন। কফি খাবেন কী?

–না, সেনেটর।

ম্যারির শরীরে একটা অস্থিরতা জেগেছে। তিনি বোধহয় এখন কাপ ধরতে পারবেন না।

এবার কাজের কথা বলা যাক। প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। আমরা সকলেই চাইছি আপনাকে সাহায্য করতে। কিন্তু আপনি নিজেকে কি যোগ্য বলে মনে করেন মিসেস অ্যাসলে?

-হ্যাঁ।

–ঠিক আছে, দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়।

.

রাত হয়েছে। ম্যারি আবার নিজের মনে কথা বলতে শুরু করেছেন। জাংশন সিটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আহা, সন্ধে হলে আমি বাড়ি ফিরে আসতাম। মনে আছে, তিন বছর আগে আমি একটা আইসকেটিং লড়াইতে জিতেছিলাম। এখন বড্ড ভয় করছে।

তুমি আমার পাশে আছো তো?

 সে রাতে ম্যারির চোখের তারায় ঘুম ছিল না।

.

সেনেট ফরেন রিলেশন কমিটির অফিস। পাঁচ জন সদস্য বসে আছেন। সামনে একটা ডায়ার্স। সেখানে পৃথিবীর মানচিত্র। উল্টোদিকে প্রেসের সাংবাদিক, সংখ্যায় প্রায় দুশোজন। টেলিভিশন ক্যামেরা তৈরি। পেট কোনরসকে দেখা গেল।

ম্যারি ঢুকলেন, বেথ এবং টিমকে নিয়ে।

ম্যারির পরনে কালো স্যুট। সাদা ব্লাউজ। ছেলেরাও সুন্দর পোশাক পরেছে। জিনস্ আর সোয়েটার। ওদের সর্বশ্রেষ্ঠ পোশাক।

বেন কোহন, টেবিলের সামনে বসে আছেন। চারদিকে নজর রেখেছেন।

ম্যারিকে কমিটির কাছে নিয়ে যাওয়া হল। উজ্জ্বল আলোর নীচে তাকে বসানো হল।

হিয়ারিং শুরু হল। চার্লি ক্যামবেল হাসলেন ম্যারির দিকে তাকিয়ে।

–গুড মর্নিং ম্যারি অ্যাসলে, আপনি কমিটির সামনে এসেছেন। আমরা কি প্রশ্ন করব?

 প্রশ্ন শুরু হল।

-নাম?

–বিধবা?

সন্তান?

–আপনার জীবনপঞ্জি অনুসারে আপনি কয়েককছর ধরে কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন, তাই না?

–ইয়েস স্যার।

আপনি কি কানসাসের বাসিন্দা?

 ইয়েস স্যার।

–আপনার ঠাকুরদাদা-ঠাকুরমা রোমানিয়ান?

 –শুধু আমার ঠাকুরদা।

–আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ব্লকের মধ্যে সম্পর্ক সংক্রান্ত প্রবন্ধ লিখেছেন?

ইয়েস স্যার।

 –সর্বশেষ প্রবন্ধটি ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। এটাই আমাদের প্রেসিডেন্টের নজরে আসে।

–ঠিকই বলেছেন।

মিসেস অ্যাসলে, আপনি কি বলবেন, কী বিষয় নিয়ে লেখাটা হয়েছে?

সব কিছু হারিয়ে গেল, ম্যারি নিজের মতো বক্তব্য পেয়েছেন। এবার শুরু হল মিসেস অ্যাসলের কথা বলা। সেনেটররা অবাক হয়ে শুনছিলেন। সত্যি, ভাবাই যায় না, এত স্বচ্ছ ধারণা, বোঝাই গেল প্রেসিডেন্ট ঠিক মানুষকে বেছেছেন।

.

ম্যারি হোটেলে ফিরে এলেন। স্টানটন রজার্সের গলা শোনা গেল।

-হ্যালো, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর।

আঃ, এতক্ষণে শান্তি। শেষ পর্যন্ত আমি জিতেছি।

কীভাবে আপনাকে ধন্যবাদ দেব, বুঝতে পারছি না। আমি এখন খুবই উত্তেজিত।

–আমিও, ম্যারি, স্টানের কণ্ঠস্বরে গর্ব, শেষ পর্যন্ত আমরা জিততে পেরেছি।

টিম চিৎকার করল– মা, তুমি জিতে গেছ?

 বেথ জানতে চাইল বাবা, এটা জানবে কী?

–হ্যাঁ, ডার্লিং, ম্যারি হাসলেন, আমি জানি, তোমার বাবা সব সময় আমায় সাহস জোগান।

.

ম্যারি ফ্লোরেন্সকে ফোন করলেন। খবরটা শুনে ফ্লোরেন্স কাঁদতে শুরু করেছেন– অসাধারণ। সমস্ত শহরে সকলের কাছে আমি খবরটা পৌঁছে দেব।

ম্যারি হাসলেন– তোমার আর ডগলাসের জন্য আমি আলাদা একটা ঘর রেখেছি।

–তুমি কখন রোমানিয়াতে যাচ্ছ?

 –দু-একদিন সময় লাগবে।

এরপর কী হবে?

এরপর ওয়াশিংটনে কয়েক সপ্তাহ থাকব। তারপর গন্তব্য রোমানিয়া।

.

বেন কোহন সবকিছু শুনলেন। তিনি ঠিক খুশি হতে পেরেছেন কী? এর উত্তর আমাদের অজানা।

.

১৪.

স্টানটন রজার্স যা ধারণা করেছিলেন, তাই ঘটল। সেনেটেররা সকলেই ভোট দিলেন। ম্যারির পক্ষে বেশির ভাগ ভোট পড়ল। প্রেসিডেন্ট এলিসন খবর পেলেন। রজার্সকে বললেন- আমাদের পরিকল্পনা সফল হতে চলেছে।

স্টানটন জবাব দিলেন- হ্যাঁ, কেউ আমাদের আটকাতে পারবে না।

.

পেট কোনরস অফিসে বসেছিলেন। খবরটা তার কাছে পৌঁছে গেল।

–রজার্সের চ্যানেলটা একবার দাও তো। কোনরস বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চ্যানেলটা চাই।

রজার্সের চ্যানেল পাওয়া গেল। আল্টা প্রাইভেট কেবল সিস্টেমে। খবর আসছে, যখন কোনরস একলা থাকেন, মাঝে মধ্যেই কেবলটা চালিয়ে দেন। এবার এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

পরের সপ্তাহে ম্যারি ডেপুটি সেক্রেটারিকে ডাকলেন। সিআইএ-র প্রধানকে ডাকা হল। কমার্স সেক্রেটারিকে, স্টেট নিউইয়র্ক ম্যানহাট্রন ব্যাঙ্কের ডিরেক্টরদের। কয়েকটি প্রধান ইহুদি সংগঠনের কর্তা ব্যক্তিদের। কেন? এঁদের কাছ থেকে উপদেশ নিতে হবে। কিছু কথা বলতে হবে।

সিআইএ-র প্রধান নেড টিলিনগাস্ট খুবই উত্তেজিত।

–ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, রোমানিয়া একটি সমস্যাকাতর দেশ। এই দেশের ওপর ভালোভাবে নজর রাখতে হবে। আমার মনে হচ্ছে, সরকার আপনাকে পূর্ণ সহযগিতা করবে।

.

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। সেক্রেটারি অফ স্টেট এই অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন।

পঁচিশ-তিরিশজনকে একসঙ্গে শপথ গ্রহণ করানো হয়। স্টানটন রজার্স সেই সকালে ম্যারিকে ফোন করলেন।

–ম্যারি, প্রেসিডেন্ট এলিসন আপনাকে হোয়াইট হাউসে আসতে বলেছেন। তিনি নিজে আপনার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। টিম এবং বেথকেও সঙ্গে আনবেন।

.

ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের ভিড়। প্রেসিডেন্ট এলিসন, ম্যারি এবং তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে এগিয়ে এলেন। টেলিভিশন ক্যামেরা ঝলসাতে শুরু করল। স্টিল ক্যামেরাতেও ফ্ল্যাশ দেখা গেল। ম্যারি আট ঘণ্টা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টের আচরণে উষ্ণতার ছাপ।

তিনি বলেছিলেন– এই পদের জন্য আপনিই সবথেকে সেরা বাজি। আমরা একসঙ্গে একটা স্বপ্ন সফল করব।

পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

–ডান হাতটা তুলবেন প্লিজ।

ম্যারি বলতে থাকেন– আমি ম্যারি এলিজাবেথ অ্যাসলে, শপথ করে বলছি যে, আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রতি আমার আনুগত্য বজায় রাখব। বিদেশি এবং স্থানীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকব। আমি সত্যের পথের অনুগামিনী হব। আমি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি আমার কর্তব্য সম্পাদন করব।

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। এখন ম্যারি এলিজাবেথ অ্যাসলের আর একটা পরিচয়, তিনি হলেন রোমানিয়া সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রের অ্যাম্বাসাডর।

.

ম্যারির গুরুত্বপূর্ণ জীবন শুরু হল। তাকে যুগোশ্লোভিয়ার ব্যাপারে কথা বলতে হবে। তিনি মল বিল্ডিং-এ প্রবেশ করলেন। ওয়াশিংটন এবং লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে এই বাড়িটির অবস্থিতি। একাধিক সহকারীর সঙ্গে আলোচনায় মেতে উঠলেন।

রোমানিয়ার লেক অফিসার জেমস স্টিকলি, বছর পঁচিশ ধরে এই কাজে মগ্ন আছেন। বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। মধ্যম আকৃতির চেহারা, মুখের ওপর বুদ্ধির ছাপ। পাতলা ছোটো দুটি ঠোঁট। চোখে ধূসরতার ছায়া। চোখের রং শীতল এবং দৃষ্টি বাদামি। তিনি এই ব্যাপারে এক তাত্ত্বিক। নানাভাবে ম্যারিকে সাহায্য করলেন।

সময় এগিয়ে চলেছে। একের পর এক কাজ। এক এক সময় ভীষণ ক্লান্ত মনে হয়। প্রত্যেকদিন সকালে স্টিকলি এবং ম্যারি রোমানিয়া সংক্রান্ত ফাইলগুলি অবলোকন করেন।

স্টিকলি বললেন– আপনার কপি তৈরি হয়েছে। খেয়াল রাখবেন, দুরকম কপি থাকবে, হলুদ কপিগুলো কাজের জন্য, সাদা কপিগুলো শুধু মাত্র তথ্য সরবরাহের জন্য। আপনার সাথে কেবলে যোগাযোগ থাকবে প্রতিরক্ষা দপ্তরের সঙ্গে। সিআইএ-র সঙ্গেও আপনার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকবে। ইচ্ছে করলে আপনি ট্রেজারি বিভাগের সঙ্গেও কথাবার্তা বলতে পারেন। একটা কথা মনে রাখবেন, কিছু আমেরিকান রোমানিয়ার বিভিন্ন জেলে বন্দি আছেন। রাষ্ট্রদূত হিসেবে আপনার প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হল সেইসব বন্দিদের মুক্তির ব্যাপারটা নিশ্চিত করা।

–তাঁদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?

–স্পাইগিরি করা, নিষিদ্ধ চাল বিক্রি এবং চুরি। রোমানিয়া পুলিশ যে-কোনো একটা অভিযোগ দিয়ে দিয়েছে।

ম্যারি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভাবতে পারেননি, এইরকম একটা কাজের দায়িত্ব তাকে নিতে হবে।

মুখে তিনি বললেন- ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব।

–মনে রাখবেন, রোমানিয়া কিন্তু লৌহযবনিকার অন্তরালে অবস্থিত একটি কমিউনিস্ট কান্ট্রি।

স্টিকলি আরও বললেন- আপনাকে আমি একটা প্যাকেট দেব। এটা শুধু আপনিই পড়বেন। এটা পড়ার পর আপনার মন্তব্য জানাবেন। কাল সকালে আপনি আসবেন কী? আর কোনো প্রশ্ন?

–না, স্যার।

উনি ম্যারির হাতে একটা ম্যানিলা এনভেলাপ তুলে দিলেন। তাতে লাল টেপ বাঁধা আছে। উনি বললেন- এটা অনুগ্রহ করে সই করুন।

.

হোটেলের পথে ফিরতে ফিরতে ম্যারি ভাবছিলেন, জেমস বন্ড ছবির এক নায়িকা হয়ে উঠেছি কী?

দেখলেন, ছেলেমেয়েরা সুন্দর পোশাকে সজ্জিত। মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে।

ম্যারি মনে করলেন, আজ একটা চাইনিজ ডিনার খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। তারপর অফিসে যাব।

তিনি বললেন কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আমরা আর একদিন বেরোব। আমাকে ঘরে থাকতে হবে। খুব দরকারি কাজ আছে।

ছেলেমেয়েরা কোনো কথা বলল না। তারা বুঝে গেছে, মাকে এখন থেকে এভাবেই সময় কাটাতে হবে।

দুই ছেলেমেয়েকে ভীষণ আদর করলেন ম্যারি। বললেন–দুঃখ করিস না। আগামীকাল, কথা দিচ্ছি!

.

যে কাগজপত্র জেমস স্টিকলি পাঠিয়েছেন, সেগুলো ম্যারি পড়ে ফেলেছেন। ম্যারি বুঝতে পারলেন, এটা প্রত্যেক রোমানিও আধিকারিক সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ। মাননীয় রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে বাণিজ্য দপ্তরের মন্ত্রী পর্যন্ত। তারা কী খেতে ভালোবাসেন, তাদের যৌন অনুভূতি কেমন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কেমন- সব। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনে তারা কোন কোন কুসংস্কারের দ্বারা প্রভাবিত, তাও পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে।

পড়তে পড়তে ম্যারি সত্যি অবাক হয়ে গেলেন। যেমন–বাণিজ্য মন্ত্রী, তিনি নাকি তার রক্ষিতা ওড্রাইভারের সঙ্গে শুতে ভালোবাসেন; আবার তার পত্নীর সাথে পরিচারিকার গোপন সম্পর্ক আছে, ..

রাত্রের অর্ধেকটা কেটে গেল। নামগুলো মনে করার চেষ্টা করছেন। এইসব মানুষদের সাথে তাকে কথা বলতে হবে। নিজের ওপর আস্থা ফিরে আসছে কী?

.

সকাল হয়েছে। সিক্রেট ডকুমেন্টগুলো ফেরত দেওয়া হল।

 স্টিকলি বললেন- আপনি রোমানিও নেতাদের সম্বন্ধে সব কথা জেনে গেছেন তো?

-হ্যাঁ, চেষ্টা করেছি। ম্যারি বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলেন।

একটা কথা মনে রাখবেন, রোমানিওরাও কিন্তু আপনার সম্বন্ধে সব কথা জেনে নিয়েছে।

কী ধরনের কথা?

–আপনি একজন ভদ্রমহিলা, আপনি একা, আপনাকে সহজেই শিকার করা যেতে পারে। ওরা আপনার একাকিত্ব নিয়ে খেলা করতে চাইবে। আপনার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা হবে। আপনার কণ্ঠস্বর টেপ করা হবে। এমব্যাসিতে এমনই ব্যবস্থা আছে। আপনার বাড়িতেও একই ব্যবস্থা। কমিউনিস্ট দেশে এমনটিই করা হয়ে থাকে। এসব জায়গাতে আমরা স্থানীয় লোকেদের নিয়োগ করি। আপনার বাড়িতে যারা পরিচারক হিসেবে কাজ করবে, তারা সকলেই রোমানিয়ান সিকিউরিটি পুলিশের লোকজন।

ম্যারি ভাবলেন উনি বোধহয় আমাকে ভয় দেখাতে চাইছেন। কিন্তু আমি এত সহজে ভয় পাব কেন?

ম্যারির প্রতিটি ঘণ্টা এখন আগে থেকে নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি সন্ধেবেলা নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তিনি যত্নে রোমানিয়ান ভাষা শিখছেন। ফরেন সাবজেক্ট ইন্সিটিউটে যোগ দিচ্ছেন। আইএসএ অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের সেক্রেটারির সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতে হচ্ছে।

সেনেট কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হচ্ছে। কতরকম অভিযোগ, কত প্রশ্ন, কত উপদেশ এবং আরও আরও প্রশ্ন।

বেথ এবং টিমের জন্য খারাপ লাগে। স্টানটন রজার্সের সহযোগিতায় তিনি একজন ভালো টিউটর পেয়েছেন। এছাড়া একই হোটেলে বসবাস করা অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বেথ আর টিমের ভাব হয়েছে। অন্তত খেলার সাথীতা পেয়েছে তারা।

সকাল থেকেই ম্যারির কর্মব্যস্ত জীবন শুরু হয়। সকাল আটটার সময় তিনি মিনিস্ট্রিতে যান রোমানিও ভাষা শিখবেন বলে। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল, ভাষাটা শেখা অসম্ভব। তারপর আস্তে আস্তে কিছুটা সড়গড় হয়ে এল।

.

জেমস স্টিকলি বললেন– আপনি এবার আমাদের মিলিটারি অ্যাটাসের সঙ্গে কথা বলবেন।

ভদ্রলোককে দেখলে মনে হয়, তিনি কঠিন কঠোর মনোভাবের, যথেষ্ট লম্বা, মধ্যবয়সি, মুখের ওপর আভিজাত্যের ছাপ।

ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, কণ্ঠস্বর গমগমে এবং কর্কশ। মনে হচ্ছে তিনি যেন ঠোঁটে আঘাত পেয়েছেন।

ম্যারি বললেন– আপনার সঙ্গে দেখা করতে পেরে আমি নিজেকে সুখী মনে করছি।

কর্নেল ম্যাককানি হবে তার প্রথম স্টাফ মেম্বার। কিছুটা উত্তেজনা ম্যারির মনের মধ্যে, ভাবতেই পারছেন না, তিনি কোন্ পদে উঠে গেছেন।

কর্নেল ম্যাককানি বললেন- আপনার অধীনে কাজ করার জন্য আমি ব্যগ্র হয়ে উঠেছি।

আপনি কি আগে রোমানিয়াতে গেছেন?

কর্নেল এবং জেমস স্টিকলি চোখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।

স্টিকলি বললেন– হ্যাঁ, উনি আগে ওখানে গেছেন।

.

প্রত্যেক সোমবার সকালবেলা অ্যাম্বাসাডরের একটা কর্মসূচি থাকে। তাকে আমরা কূটনৈতিক আলোচনার আসর বলতে পারি। ট্রেড ডিপার্টমেন্টের অষ্টম তলায়।

–ফরেন সার্ভিসে আমরা একাধিক কমান্ড রেখেছি। সবার ওপরে আছেন অ্যাম্বাসাডর। তার নীচে আছেন ডেপুটি চিফ অফ মিশন। তার তলায় আছেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা। অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, প্রশাসনিক উপদেষ্টা, সাধারণ বিষয়ের উপদেষ্টা। তার তলায় আছেন বাণিজ্য, কৃষি এবং সামরিক অ্যাটাসে।

কর্নেল ম্যাককানি বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কীভাবে এই প্রশাসনিক যন্ত্রটা কাজ করছে।

 পরবর্তী সেশনে কী পড়ানো হবে, তাও আলোচনা করা হল।

.

ওয়াটারগেট হোটেলে ম্যারি এবং স্টানটন রজার্স লাঞ্চে ব্যস্ত ছিলেন।

-প্রেসিডেন্ট এলিসন বলেছেন আপনি কিছু সামাজিক কাজকর্ম করবেন।

–কী ধরনের সামাজিক কাজ?

–নিয়মিত প্রেস ইন্টারভিউ দেবেন, রেডিয়ো এবং টেলিভিশনের সাংবাদিকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখবেন।

–এটা কি খুবই দরকারি?

হ্যাঁ। আপনাকে একটা নতুন ওয়ারড্রোব দেওয়া হবে। একই পোশাক পরে দুবার ছবি তুলবেন না।

স্টান, অনেক খরচ হবে, তাই তো? আমি বোধহয় ঘুমোতেই পারব না। সকাল থেকে মধ্যরাত অব্দি আমাকে ব্যস্ত থাকতে হবে?

-কোনো সমস্যা নয়, হেলেন মুডি আছেন তো!

–উনি কে?

উনি হলেন ওয়াশিংটনের এক পেশাদার মডেল রমণী। সবকিছু ওঁনার ওপর ছেড়ে দিন, উনি আপনাকে সাজিয়ে তুলবেন।

.

 হেলেন মুডিকে এক যৌনবতী কালো মহিলা বলা যেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি জনপ্রিয় মডেল হিসেবে কাজ করছেন। নিজস্ব শপিং সার্ভিস খুলেছেন। তিনি নির্দিষ্ট সময়ে ম্যারির হোটেলে এলেন। বেশ কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে কাটালেন। ওয়ারড্রোব খুঁটিয়ে দেখলেন।

তিনি বললেন- আঃ, জাংশন সিটির পক্ষে চমৎকার। কিন্তু আপনাকে তো ওয়াশিংটন ডিসির উপযুক্ত হতে হবে।

–আমার হাতে অত টাকা তো নেই।

 হেলেন মুডি বললেন বুঝতে পারছি। ঠিক আছে আপনাকে একটা মেঝে পর্যন্ত । লম্বা ইভিনিং গাউন পরতে হবে। ককটেল পার্টির জন্য আলাদা পোশাক। সান্ধ্য রিসেপশনের জন্য আলাদা পোশাক, টি পার্টির জন্য আলাদা এবং লাঞ্চ পার্টির জন্য আলাদা। রাস্তায় হাঁটার জন্য একটা আলাদ স্যুট। অফিসে পরার জন্য অন্য কালো পোশাক। আর যখন কোনো শোকসভায় যাবেন, তার জন্য উপযুক্ত পোশাক।

.

তিনদিন ধরে কেনাকাটা চলেছে। কেনাকাটা শেষ হল। হেলেন মুডি ম্যারি অ্যাসলেকে ভালোভাবে দেখে বললেন– আপনি যথেষ্ট সুন্দরী, কিন্তু আপনাকে আমি আরও সুন্দরী করে তুলব। আমি দেখছি কী করা যায়। আপনি রেনবোতে যাবেন, সুসান আপনাকে কিছু টিপস দেবেন। তারপর আপনার চুলের জন্য আপনাকে আমি সানসাইনে নিয়ে যাব। সেখানে বিলি আছেন, আপনার কোনো চিন্তা নেই।

.

কয়েক সন্ধ্যা পরে ম্যারি স্টানটন রজার্সের সাথে ডিনার টেবিলে বসেছিলেন। ম্যারির দিকে তাকিয়ে রজার্স বললেন– হেলেন আপনাকে একেবারে পালটে দিয়েছে।

.

সাংবাদিকরা উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। প্রেস রিলেশন্স-এর প্রধান ম্যারির সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।

একাধিক ক্যামেরার আলো ঝলসে উঠছে। একটির পর একটি অনুষ্ঠান, গুড মর্নিং আমেরিকা, মিট দ্য প্রেস, ফায়ারিং লাইট ইত্যাদি। ওয়াশিংটন পোস্ট এবং নিউইয়র্ক টাইমস থেকেও ম্যারির ইন্টারভিউ নেওয়া হল। আরও গোটা ছয়েক দরকারি এবং গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক কাগজ লন্ডন টাইমস, লে মনডে, টাইম ম্যাগাজিন, পিপল, আরও কত কী? ম্যারির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হল। তার ছবি সর্বত্র বেরিয়েছে। মনে হল, তিনি বুঝি এক লহমাতে নায়িকা হয়ে উঠেছেন।

টিম বলেছিল- মম, সমস্ত খবরের কাগজের পাতায় তোমার ছবি। প্রচ্ছদেও তোমার ছবি। ব্যাপারটা ভাবতে কেমন অদ্ভুত লাগছে, তাই না?

ম্যারি বলেছিলেন- আমিও ঠিক ভাবতে পারছি না রে। জানি না কী হবে।

 স্টানটন রজার্সকে ম্যারি এই ব্যাপারে অভিযোগ করেছিলেন।

উনি বলেছিলেন– এটা আপনার কাজের অঙ্গ। প্রেসিডেন্ট আপনার একটা ইমেজ বা ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাইছেন। যখন আপনি ইউরোপে পদার্পণ করবেন, সমস্ত মানুষ আপনার আসল পরিচয় জেনে যাবে।

.

বেন কোহন আর আকিকো বিছানাতে শুয়েছিলেন। সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে। আকিকো এক সুন্দরী জাপানি রমণী। রিপোর্টারের থেকে দশ বছরের ছোটো। তারা কয়েক বছর আগে দেখা করেছিলেন। তখন বেন কোহন মডেলদের সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন লিখছিলেন। তখন থেকে আকিকো তার সঙ্গিনী হয়ে গেছেন।

কোহনের কোনো একটা সমস্যা হয়েছে।

আকিকো শান্তভাবে বললেন- বেবি, কী হয়েছে বলো তো? তোমার মুখখানা ভার কেন?

–হ্যাঁ, কাজের চাপটা বড়ো বেড়েছে।

ঠিক আছে, আমি তোমার মনে শান্তি এনে দিচ্ছি।

–আকিকো, আমাকে একটা শক্ত প্রতিবেদন লিখতে হবে। এই শহরে যা ঘটেছে তার ওপর। শুধু তাই নয়, একজন বিশেষ মহিলা সম্পর্কে।

-বলো তো বুঝিয়ে।

–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কোথা থেকে শুরু করব।

–কী ব্যাপারে কথা বলছ?

–ম্যারি অ্যাসলে, ছটা ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আমি তার ছবি দেখেছি। গত দু-সপ্তাহে। এখনও পর্যন্ত তিনি তার পদে যোগ দেননি। আকিকো, মিসেস অ্যাসলেকে মুভি স্টারের মতো করে ভোলা হচ্ছে। তাই তাঁর ছবি এবং তার ছেলেমেয়ের ছবি সর্বত্র ছাপা হচ্ছে। কিন্তু কেন, আমি বুঝতে পারছি না।

এটা রাজনৈতিক চাল হতে পারে। এটা নিয়ে এত চিন্তা করছ কেন?

মডেল কন্যার এই কথা শুনে বেন কোহন সিগারেট ধরালেন। খানিকটা ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন- তুমি হয়তো ঠিক বলেছ সুন্দরী।

 জাপানি মেয়েটি আবার তার কাজ করতে শুরু করেছে। হাসতে হাসতে সে বলল সিগারেটটা নিভিয়ে দাও। আমার শরীরে আগুন জ্বালো!

.

ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যাডফোর্ডের তরফ থেকে একটা পার্টি দেওয়া হবে। স্টানটন রজার্স ম্যারিকে জানিয়েছিলেন।

–আমি সব ব্যবস্থা করব। শুক্রবার রাতে প্যান আমেরিকান ইউনিয়নে।

.

প্যান আমেরিকান ইউনিয়ানে একটা বড়ো বাড়ি। বিশাল বাগান আছে। নানা ধরনের অনুষ্ঠানে সেই বাগান ব্যবহার করা হয়। মহামান্য উপরাষ্ট্রপতি আহূত ভোজসভা। গণ্যমান্য মানুষেরা ইতিমধ্যেই এসে গেছেন। প্রাচীনকালের রুপোর পাত্রগুলি ঝকঝক করছে। তারই পাশাপাশি কাঁচের ডিনার সেট। অর্কেস্ট্রার শব্দ শোনা যাচ্ছে। যাঁরা এসেছেন তাদের আমরা রাজধানীর গণ্যমান্য ব্যক্তি বলতে পারি। ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং তার স্ত্রী ছাড়া উপস্থিত আছেন সেনেটর, অ্যাম্বাসাডর এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষেরা।

ম্যারি অবাক হয়ে তাকালেন সান্ধ্য সমাগমের দিকে। তিনি ভাবলেন, আমাকে সব মনে রাখতে হবে। হোটেলে ফিরলেই বেথ আর টিম জানতে চাইবে।

ডিনারের কথা ঘোষণা করা হল। ম্যারি একটা টেবিলে গিয়ে বসলেন। সেখানে সেনেটররা আছেন, বিভিন্ন বিভাগের উচ্চপদস্থ আধিকারিক আর কূটনীতিকরা। ডিনারটা চমৎকার! এই মানুষজনের সান্নিধ্যে এসে ম্যারির ভালোই লাগছিল।

.

রাত এগোরোটা, ম্যারি তার ঘড়ির দিকেতাকালেন এবং ডানদিকে বসে থাকা সেনেটরকে বললেন– এত রাত হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েকে বলেছিলাম, তাড়াতাড়ি ফিরব। তিনি উঠলেন। সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাদের সঙ্গে দেখা হল, সন্ধেটা মনে থাকবে, কেমন, শুভরাত্রি।

নীরবতা। সকলেই তাকিয়ে আছেন ম্যারির দিকে। তিনি ড্যান্স ফ্লোরের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন।

স্টানটন রজার্স ফিসফিস করে বললেন- হায় ঈশ্বর, কেউ বোধহয় ওঁনাকে বলে দেয়নি।

.

সকালবেলা স্টানটন রজার্স ম্যারির সাথে ব্রেকফাস্ট খেয়েছিলেন।

তিনি বললেন– ম্যারি, এই শহরে কতগুলো নিয়ম আছে। কতগুলো নিয়ম তো খুবই বোকা বোকা, কিন্তু সেগুলো মেনে চলতে হয়।

-আমার কোনো ভুল হয়েছে কী?

 তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন– আপনি বেশ কয়েকটা নিয়ম ভেঙেছেন। একটা কথা মনে রাখবেন যে, প্রধান অতিথি চলে যাবার আগে আপনি পার্টি থেকে কখনও বেরিয়ে আসবেন না। গতরাতে পার্টিতে মহামান্য ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তখনও তিনি সেখানে ছিলেন অথচ আপনি বেরিয়ে এসেছেন।

–আমি জানি না।

–আপনি কি জানেন, এর জন্য কতগুলো টেলিফোন কল এসেছে।

–আমি দুঃখিত স্টান, আমি নিয়মটা সত্যি জানতাম না। ঠিক আছে, আমি আমার ছেলেমেয়েকে কথা দিয়েছিলাম।

ওয়াশিংটনে শিশু বলে কেউ নেই। শুধু কিছু তরুণ তরুণী ভোটার আছে। এই শহরটা হল শক্তির শহর। কথাটা ভুলে গেলে চলবে কেমন করে?

.

 টাকা নিয়ে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এখানে থাকা-খাওয়ার খরচ হল ৫ ডলার ৫০ সেন্ট, অন্তর্বাসের খরচ ১ ডলার ৯৫ সেন্ট। না, এবার থেকে আর দোকানে কাঁচাবেন না, নিজের হাতেই কাঁচাকাচির কাজটা করবেন।

কিন্তু তা কী করে সম্ভব? অনেক কাজের দায়িত্ব তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ম্যারিকে এভাবে কাজ করতে দেখে ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে গেছে। এখন কারো সঙ্গে কথা বলার সময় কোথায়? বাথরুমের দরজা বন্ধ করে তিনি আবার কাপড় কাঁচার কাজে নিমগ্ন হলেন।

আহা, প্রেসিডেন্ট এসে যদি তাকে এই অবস্থায় দেখেন, তাহলে কী হবে?

 প্রেসিডেন্ট হয়তো খুশি হবেন। এভাবে খরচ কমাতে পারলে দেশের মঙ্গল।

 ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর এভাবে কাজ করছেন কেন? হয়তো প্রেসিডেন্ট বলবেন। আমি সেক্রেটারিকে বলে দিচ্ছি।

এটা নেহাতই একটা কাল্পনিক সংলাপ। ম্যারি হেসে উঠলেন আপন মনে।

 বাথরুমের দরজা দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। ম্যারি দরজাটা খুললেন, আবার কিছুটা ধোঁয়া ঢুকে পড়ল লিভিং রুমের মধ্যে।

ডোরবেলের শব্দ। একটু বাদে বেথ বলল– মা, জেমস স্টিকলি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

.

১৫.

বেন কোহন বললেন- ব্যাপারটা ক্রমশই খারাপ লাগছে। তিনি নগ্ন হয়ে বসে আছেন কমবয়সি রক্ষিতার সামনে। আকিকো তার পাশে। তারা মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠান দেখলেন।

আকিকো বলল- মেনল্যান্ড চায়নার জন্য আরও ভালো একটা প্রেক্ষাপট দরকার ছিল। এটা তো চিনাসমাজের প্রতিচ্ছবি। মনে হচ্ছে হংকং বা ম্যাকাউ।

–এই ভদ্রমহিলা চিন সম্পর্কে কী বলবেন? বেন কোহন দাঁত কিড়মিড় করতে থাকেন। তারপর আকিকোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ইনি কানসাসের এক গৃহকত্রী। সব বিষয়ে রাতারাতি জানলেন কী করে?

ভদ্রমহিলা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, রাগ করলে চলবে কেন?

হতে পারে, তা বলে এভাবে ইন্টারভিউ দেওয়া। আর সাংবাদিকদেরও হয়েছে, মা বাবার ঠিক নেই। নতুন কিছু দেখলেই হ্যাংলামো করতে শুরু করে। এই হল মিট দ্য প্রেস! ম্যারি অ্যাসলেকে আগে থেকেই শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। নাঃ, আমি ঠিক মানতে পারছি না। চার্লস লিমবার্গের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

–চালর্স লিমবার্গ কে?

–এটাই হল সমস্যা, আমরা কেউ কারও ভাষা বুঝতে পারছি না।

অন্য কোনোভাবে কথা বলা যায় কী?

 মেয়েটি এবার কাজ করতে শুরু করেছে। সে বেন কোহনকে বিছানাতে নিয়ে গেল। বেন কোহনের ওপর উঠে বসল। একটু পরিশ্রম করতে হবে। আহা, বেন কোহনের বুকে তার সিল্কের মতো চুল। পেটের সঙ্গে পেট ঠেকে গেছে। মেয়েটি বুঝতে পারল, এবার খোকা জাগতে শুরু করেছে। সে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করল, দু-একটা টোকা মারল। তারপর বলল- হ্যালো, আর্থার কী খবর?

–আর্থার তোমার মধ্যে ঢুকতে চাইছে।

 –এখন নয়, একটু বাদে তাকে আমি ঢুকিয়ে দেব।

সে উঠল, কিচেনে চলে গেল। বেন কোহন তাকিয়ে আছেন। টেলিভিশনের দিকে চোখ পড়ল। এবার ওই ভদ্রমহিলা আবার ভাষণ দেবেন। নাঃ, দেখতে ইচ্ছে করছে না।

–আকিকো, তুমি কী করছ? আর্থার যে ঘুমিয়ে পড়ল।

 –ওকে বলল একটু অপেক্ষা করতে। আমি এখুনি পৌঁছে যাচ্ছি।

কয়েক মুহূর্ত বাদে আকিকো ফিরে এসেছে। ডিশ ভর্তি আইসক্রিম, চেরি, আরও কত কী!

সাংবাদিক বললেন আমার খিদে পায়নি।

আকিকোর চোখে দুষ্টু হাসি- এটা কিন্তু খাবার জন্য নয়।

তবে?

 –দেখো না কী করি।

আকিকো হাসতে হাসতে সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে। সে আইসক্রিম নিয়ে মাখিয়ে দিচ্ছে সাংবাদিকের পুংদণ্ডে। আঃ, ঠান্ডা, ঠান্ডা একটা অনুভূতি, কোহনের অশান্ত মন শান্ত হচ্ছে।

এবার আকিকো বুঝতে পারল, দণ্ডটা ক্রমশই শক্ত হয়ে উঠেছে। নাঃ, এখনই মুখের ভেতর পুরে ফেলতে হবে।

বেনের গোঙানি শোনা গেল– আঃ, চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও। থেমো না।

আকিকো চেরি মাখিয়ে দিল। বলল– কলা খেতে আমি ভীষণ ভালোবাসি।

শুরু হয়েছে, শুরু হয়েছে সেই খেলা। বেনের মনে হল, তিনি যেন স্বপ্ন জগতের বাসিন্দা। হয়ে গেছেন। তিনি আর থাকতে পারছেন না। তিনি আকিকের ওপর চেপে বসলেন, মুখের ভেতর সব কিছু ঢেলে দিলেন।

টেলিভিশনে দেখাচ্ছে ম্যারি অ্যাসলের ছবি। ম্যারি বলছেন– আমেরিকার আদর্শবাদে যেসব লোক বিশ্বাস করে না, তাদের বশে আনতে গেলে একটা কাজ করতে হবে, তা হল বাণিজ্যিক আদান-প্রদান আরও বৃদ্ধি করা।

.

সন্ধে হয়েছে, বেন ইয়ান ভেলারেসকে ফোন করলেন হাই ইয়ান?

বেন, কী হয়েছে বলো?

একটা সাহায্য করতে হবে।

–নাম বলো, আমি দেখছি।

–রোমানিয়াতে যিনি আমাদের নতুন রাষ্ট্রদূত হয়েছেন, তার সঙ্গে দেখা করতে হবে।

–বেন, এটা স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। আমি তো ভাড়া করা হাত। তুমি সেক্রেটারি অফ স্টেটের সঙ্গে যোগাযোগে করো।

 বেন রিসিভার রেখে দিয়ে ভাবলেন– না, কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না।

তিনি শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন জাংশন সিটির কানসাসে যেতে হবে।

বেন কোহন জাংশন সিটিতে এসেছেন এর আগে মাত্র একবার। সারাদিন কাজ করেছেন শেরিফ মুনস্টারের সঙ্গে। তাকে একটা ভাড়া করা গাড়ি দেওয়া হয়েছিল। সি.আই.ডি অফিসে গিয়েছিলেন। সন্ধেবেলা প্লেন ধরে মানহারটুন। তাহলে? শহরটা সম্পর্কে তাঁর কোনো জ্ঞানই নেই!

প্লেন আকাশের বুকে পাখা মেলে দিয়েছে। এবারের গন্তব্য আরও গভীর এবং বিস্ময়কর।

.

ম্যারি অ্যাসলে ফরেন সার্ভিস বিল্ডিং-এর মানুষদের সাথে কথা বলছেন। জেমস স্টিকলিকে রিপোর্ট দিতে হবে।

একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এক ভদ্রলোক, দেখতে খুব একটা ভালো নয়। জিন্স পরা, গায়ে টিশার্ট এবং টেনিস জুতো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ দুটো উজ্জ্বল। নীলাভ দ্যুতি। তাকে দেখেই মনে হল, ঔদ্ধত্যের ছাপ আছে। ম্যারি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। রেগে বেরিয়ে এলেন, বুঝতে পারলেন, ওই ভদ্রলোকের দুটি চোখ তাকে অনুসরণ করছে।

.

 জেমস স্টিকলির সাথে আলোচনা এক ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয়েছিল। ম্যারি তার অফিসে ফিরে এলেন। অজানা আগন্তুক ম্যারির চেয়ারে বসেছিলেন ডেস্কের ওপর পা তুলে দিয়ে। কাগজগুলো দেখছিলেন। ম্যারি বুঝতে পারলেন, রক্ত মাথায় চড়ে গেছে।

–এখানে কী করছেন? আমি জানতে পারি কী?

ভদ্রলোকের চোখে দীর্ঘ অলস চাউনি। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন– আমি মাইক শ্লেট। বন্ধুরা আদর করে আমাকে মাইকেল বলে ডাকে।

ম্যারি বললেন– মিঃ শ্লেট, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?

–কিছুই না, আমরা প্রতিবেশী, আমি এখানে একটা বিভাগে কাজ করি। আপনাকে হ্যালো বলতে এসেছি।

বলা হয়ে গেছে। যদি সত্যি সত্যি আপনি কোথাও কাজ করে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনার নিজস্ব ডেস্ক আছে। দেখবেন, ভবিষ্যতে কখনও আমার ঘরে ঢুকে এভাবে বসে থাকবেন না।

আহা, রাগ করছেন কেন? আমি কানসিয়ানদের কথা শুনেছি, জানি না, আপনারা নিজেদের কীভাবে ডেকে থাকেন? শুনেছি আপনারা নাকি ভালো বান্ধবী হতে পারেন?

ম্যারি দাঁত কিড়মিড় করলেন– মিঃ শ্লেট, আমি দু-সেকেন্ড সময় দিচ্ছি, তার মধ্যেই এই অফিস থেকে আপনাকে বেরোতে হবে, না হলে আমি রক্ষীকে ডেকে পাঠাব।

–কথাটা কি আমি ভুল শুনছি? ভদ্রলোকের চোখে বরফ-শীতল চাউনি।

–সত্যি সত্যি যদি আপনি এই ডিপার্টমেন্টে কাজ করে থাকেন, আমি বলব বাড়ি চলে যান। দাঁত মাজুন, দাড়ি কামান, ভালোভাবে পোশাক পরুন।

-ঠিক আছে, আমি বউয়ের সাথে আলোচনা করব। কিন্তু বউ আমার কাছে নেই।

মাইক শ্লেটের দীর্ঘশ্বাস

ম্যারির মুখ আরও লাল– বেরিয়ে যান।

ভদ্রলোক ম্যারির দিকে তাকালেন– বাই হনি, পরে দেখা হবে।

 ম্যারি রাগে গুম হয়ে গেছেন– তোমার মুখখানা আমি আর দেখতে চাইছি না।

.

সকালটা কেটে গেল নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। জেমস স্টিকলি কোনো অজ্ঞাত কারণে ভীষণ রেগে গেছেন। দুপুরবেলা, ম্যারির খেতে ইচ্ছে নেই। তিনি ভাবলেন, ওয়াশিংটনের এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবেন। রাগটাকে কমাবার চেষ্টা করবেন।

লিমুজিনটা ফরেন সার্ভিস বিল্ডিং-এর একতলাতে পার্ক করা ছিল।

.

সুপ্রভাত, ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, ড্রাইভার বলল, আপনি কোথায় যাবেন?

–যেখানে দুচোখ যায়। মারভিন, তুমি খালি গাড়ি চালাও।

–ইয়েস, ম্যাডাম।

গাড়ি এগিয়ে চলেছে।

–আপনি কি এমব্যাসি বরাতে যাবেন।

–হ্যাঁ, ওখানেই ভালো হবে।

 ম্যাসাচুসেটস এভিনিউ।

মারভিন বলল- এখান থেকেই শুরু হয়েছে, সে বিরাট রাস্তার দিকে তাকাল, এমব্যাসির অফিস।

ম্যারি জাপানি এমব্যাসি ভবনটি চিনতে পারলেন। মাথায় পতাকা উড়ছে। ভারতীয় দূতাবাসের ওপর একটা হাতির প্রতিচ্ছবি।

একটা সুন্দর ইসলামিও মসজিদ, সামনে কিছু মানুষ হাঁটু মুড়ে প্রার্থনা করছেন।

 ম্যারি পৌঁছোলেন, ২৩ নম্বর স্ট্রিটে, সাদা পাথরের বাড়ি। চারদিকে পিলার আছে।

–এটাই হল রোমানিয়ান এমব্যাসি, মারভিন বলল।

 –এখানেই থামাও।

লিমুজিন গাড়িটা থেমে গেল। ম্যারি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। একটা চিহ্ন আছে, লেখা আছে, রোমানিও এমব্যাসি।

ম্যারি বললেন- একটু অপেক্ষা করো, প্লিজ। আমি ভেতরে যাব।

ম্যারির হৃৎপিণ্ড দ্রুত সঞ্চারিত হতে শুরু করেছে। এই প্রথম তিনি রোমনিয়ার সাথে সত্যিকারের সংযোগ রক্ষা করতে চলেছেন। আর কয়েকদিন বাদে এই দেশটি হবে তার কয়েক বছরের ঠিকানা।

বড়ো শ্বাস নিলেন। ডোরবেলে হাত রাখলেন। নীরবতা, আরও একবার চেষ্টা করলেন। এটা খোলা? তিনি দরজা খুললেন, ভেতরদিকে চলে গেলেন। রিসেপশন হল অন্ধকার, ঠান্ডা-ঠান্ডা অনুভূতি। একটা লাল রঙের কৌচ রয়েছে। দুটো চেয়ার। ছোট্ট টেলিভিশন সেট। পায়ের শব্দ শোনা গেল। একজন দীর্ঘ কৃশ মানুষ অত্যন্ত দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন।

তিনি বললেন– কী হয়েছে?

ম্যারি বললেন- গুড মর্নিং, আমি ম্যারি অ্যাসলে, আমি রোমানিয়ার নতুন অ্যাম্বাসাডর।

ভদ্রলোকের মুখে খড়ির সাদা দাগ। তিনি বললেন– হায় ঈশ্বর!

ম্যারি অবাক কিছু ভুল হয়েছে কী?

–আমরা আপনাকে আশা করিনি ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর।

–আমি জানি, এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই।

–অ্যাম্বাসাডর,…তিনি ভীষণ রেগে যাবেন।

–কেন? আমি তাকে হ্যালো বলতে এসেছি।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমায় ক্ষমা করবেন। আমার নাম গাব্রিয়েল স্টোইকা। আমি ডেপুটি চিফ অফ মিশন। আমরা অতিথিদের আশা করি না। দেখতেই পারছেন, তার কোনো ব্যবস্থা নেই।

ভদ্রলোকের আচরণের মধ্যে দারুণ অব্যবস্থার ছাপ। ম্যারি সেখান থেকেই চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে। ম্যারি দেখলেন, গাব্রিয়েল স্টোইকা আলো জ্বেলে দিলেন। চারপাশ আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চালিয়ে দেওয়া হল রুমহিটার।

তিনি আমতা আমতা করে বললেন- কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘরটা গরম হয়ে যাবে। আমরা এইভাবে জ্বালানির খরচ বাঁচাবার চেষ্টা করি। জানেন তো ম্যাডাম, ওয়াশিংটনে সব জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া।

ম্যারি বললেন- হ্যাঁ, আমি তা অনুভব করেছি।

না-না, ভাববেন না। অ্যাম্বাসাডর ওপরে আছেন। আমি তার কাছে আপনার আগমনের সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছি।

না, না, ওঁনাকে বিরক্ত করতে হবে না।

হাত থেকে তীর চলে গেছে, স্টোইকা অত্যন্ত দ্রুত ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছেন।

.

পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। স্টোইকা ফিরে এলেন।

আসুন, অ্যাম্বাসাডর আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য উদগ্রীব।

–আপনি কি এব্যাপারে সুনিশ্চিত?

–হ্যাঁ, উনি অপেক্ষা করছেন।

 ম্যারি ওপরে গেলেন। ওপরে একটা কনফারেন্স রুম, চোদ্দোটা চেয়ার, বিরাট একটা টেবিল। ক্যাবিনেটে নানা ধরনের মূর্তি, রোমানিয়া থেকে আনা হয়েছে। রোমানিয়ার বিরাট একটা ম্যাপ। একটা ফায়ার প্লেস। সেখানে রোমানিয়ান পতাকা। অ্যাম্বাসডর রাদু এগিয়ে এলেন। শার্ট পরেছেন। তাড়াতাড়ি একটা জ্যাকেট পরে নিয়েছেন। লম্বা ভদ্রলোক, গায়ের রং বাদামি। একজন পরিচারক আলো জ্বেলে দিয়ে গেল।

–ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, রাদু বললেন, ভাবতেই পারিনি, এভাবে আপনি আসবেন। আপনাকে ঠিক মতো স্বাগত সম্ভাষণ জানাতে পারলাম না। স্টেট ডিপার্টমেন্ট এব্যাপারে আগাম খবর দেয়নি।

ম্যারি বললেন– এটা আমারই দোষ। আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম একবার…

–না-না, আপনাকে দেখে খুবই ভালো লাগছে। টেলিভিশনে আপনাকে দেখেছি, খবরের কাগজের পাতায় আপনার ছবিও দেখেছি, আপনার সম্পর্কে জানতে খুবই আগ্রহী। শুধু আমি নয়, আমার সমস্ত দেশ। চা খাবেন কী?

যদি অসুবিধা না হয়।

না-না, অসুবিধার কী আছে। আপনার জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করবেন। ব্যাপারটা ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে।

ম্যারি ভাবলেন না, এভাবে আসা হয়তো উচিত হয়নি।

চা এসে গেছে। অ্যাম্বাসাডর থরথর করে কাঁপছেন। বলছেন– আমাকে ক্ষমা করবেন। এইভাবে অ্যাপায়ন করলাম।

ম্যারির মনে হল, এখন অদৃশ্য হতে পারলে ভালো হত।

অ্যাম্বাসাডর কিছু কিছু কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। ব্যাপারটা আরও খারাপ হয়ে গেল।

ম্যারি বললেন– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। গুডবাই, আশা করি, আবার দেখা হবে।

ম্যারি অতি দ্রুত সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

.

ম্যারি অফিসে ফিরে এলেন। জেমস স্টিকলি তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

–মিসেস অ্যাসলে, তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন, আপনি যা ইচ্ছে তাই করবেন? ভেবেছেন কী?

আমি ভেবেছিলাম, এটা গোপন থাকবে, ম্যারি মনে মনে ভাবলেন। না, আরও সতর্ক হতে হবে।

আমতা আমতা করে ম্যারি বলতে থাকেন– রোমানিয়ান এমব্যাসি? না, আমি আগে থেকে কিছু ভাবিনি। গাড়ি করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কী মনে হল নেমে পড়েছি।

আগের জীবনটা ভুলে যান, ওয়াশিংটনে আপনি কোনো এমব্যাসিতেই নামতে পারেন না। যখন এক অ্যাম্বাসাডর কোথাও যান, সরকারি অনুমতি দেওয়া হয়। কার্ড আসে। আপনি সমস্ত সিস্টেমটাকে নষ্ট করে দিয়েছেন। আমি আপনাকে কত বার বলেছি, এভাবে কাজ করবেন না। আপনি কি জানেন, আপনার এই হঠাৎ যাওয়াতে কী ক্ষতি হয়েছে? রোমানিয়ান এমব্যাসির লোকজনেরা ভাবছে আপনি সেখানে গেছেন তাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে।

–কী বলছেন?

ম্যারির সামনের পৃথিবী বোধহয় দু-ফাঁক হয়ে গেছে।

–চেষ্টা করুন, চেষ্টা করুন নিজের আভিজাত্য বুঝে চলার। আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের প্রতিনিধি। আপনার প্রতিটি কাজের ওপর সতর্ক নজর ফেলা হবে। আপনি এভাবে কাজ করছেন কেন? আমি কি ঠিকমতো বলতে পেরেছি?

ম্যারি ঢোক গিলে বললেন- ঠিক আছে, ভবিষ্যতে কখনও হবে না।

–আচ্ছা, উনি টেলিফোনের একটা নাম্বার ঘোরালেন, মিসেস অ্যাসলে আমার এখানেই বসে আছেন। আপনি কি এক্ষুনি আসবেন?

রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।

ম্যারি নীরবতার মধ্যে বসে থাকলেন, মনে হল ছোট্ট শিশুকে বকাঝকা করা হয়েছে।

 দরজা খুলে গেল। মাইক শ্লেটের হাসি মুখ।

ম্যারির দিকে মাইক তাকালেন দেখুন, আমি কিন্তু আপনার উপদেশ শুনেছি। দাড়ি কামিয়েছি।

স্টিকলি অবাক হয়ে বললেন- আপনাদের মধ্যে আগে দেখা হয়েছে?

ম্যারি তাকালেন শ্লেটের দিকে না, আমি ওঁনাকে আমার চেয়ারে বসে থাকতে দেখেছিলাম।

জেমস স্টিকলি বললেন মিসেস অ্যাসলে, মাইক শ্লেট, উনি আপনার ডেপুটি চিফ অফ মিশনের পদে কাজ করবেন।

ম্যারি যেন শুনতে পাননি– কী বললেন?

–মিঃ শ্লেট, ইস্ট ইউরোপিয়ান ডেস্কে কাজ করেন। তিনি ওয়াশিংটনের বাইরে থাকতে ভালোবাসেন। আপনাকে সাহায্য করার জন্য ওঁনাকে নিয়োগ করা হচ্ছে ডেপুটি চিফ হিসেবে।

ম্যারি বোধহয় চেয়ার থেকে পড়ে যাবেন না-না, এটা অসম্ভব!

মাইক হেসে বললেন আমি কথা দিচ্ছি ম্যাডাম, রোজ ভালোভাবে দাড়ি কামাব।

ম্যারি স্টিকলির দিকে তাকালেন– আমার মনে হয় এভাবে নিয়োগ করা উচিত হয়নি। একজন অ্যাম্বাসাডরের ওপরেই এই দায়িত্বটা থাকা উচিত। তিনি তার মনের মতো ডেপুটিকে নিয়োগ করবেন।

-ঠিকই বলেছেন, কিন্তু…

–তাহলে আমি মিঃ শ্লেটকে কখনও পছন্দ করব না।

 –সাধারণ অবস্থায় আপনি বলতেই পারতেন, কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। কারণ আদেশটা এসেছে খোদ হোয়াইট হাউস থেকে।

.

ম্যারি মাইক শ্লেটকে উপেক্ষা করে কাজ করবেন কী করে? এই ভদ্রলোকের উপস্থিতি সর্বত্র চোখে পড়ছে। পেন্টাগনের অভ্যন্তরে, সেনেট-এর ডাইনিংরুমে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের করিডরে। তিনি হয় ডেনিম আর টিশার্ট পরছেন, কিংবা খেলাধুলার পোশাক। ম্যারি বুঝতে পারছেন না, এই ধরনের পরিবেশে ভদ্রলোক এমন খোলা মেলা পোশাক পরে কী করে আসেন?

একদিন ম্যারি তাকে দেখলেন কর্নেল ম্যাককিনির সাথে লাঞ্চ খেতে। তাঁরা গোপন আলোচনায় মত্ত ছিলেন। ম্যারি বুঝতে পারলেন না, এই দুজনের মধ্যে এত বন্ধুত্ব হল কী করে? ব্যাপারটা ভেবে দেখতে হবে।

.

চার্লি ক্যামবেল, সেনেট-এর ফরেন রিলেশন্স কমিটির প্রধান। ম্যারির সম্মানে একটি নৈশভোজের আসর ডেকেছেন। কোরান গ্যালারিতে। ম্যারি ঘরে প্রবেশ করলেন। একাধিক সুন্দরী রমণীর দেখা পেলেন। তিনি ভাবলেন, হায়, আমি এদের দলভুক্ত নই।

কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তিনি জানেন না।

একডজন ফটোগ্রাফার সেখানে উপস্থিত আছেন। ম্যারির অনেকগুলো ছবি তোলা হল। তাকে অনেকের সাথে নাচতে হল। কোনো কোনো পুরুষ বিবাহিত, কেউ অবিবাহিত। কেউ কেউ তার টেলিফোন নাম্বার জানতে চেয়েছেন। তিনি রাগ করেননি, আবার অতিরিক্ত আগ্রহ দেখাননি।

তিনি সবাইকে বলেছেন- আমি দুঃখিত, কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে, অন্য ব্যাপারে মাথা ঘামাবার মতো সময় পাই না।

এডওয়ার্ড? হঠাৎ এডওয়ার্ডের কথা মনে পড়ে গেছে ম্যারির, সেই নৈশভোজের আসরে…

.

 তিনি টেবিলে বসেছিলেন, চার্লি ক্যামবেল এবং তার স্ত্রীর সাথে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের জনা কয়েক আধিকারিক। নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।

কয়েক বছর আগে মাদ্রিদে, এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। হাজার হাজার ছাত্র ব্রিটিশ এমব্যাসি ভবন ঘেরাও করেছিল। তারা জিব্রাল্টারের অধিকার চাইছে। তারা দরজা ভেঙে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর মিনিস্টারদের ফোন করা হয়। বলা হল, এখুনি পুলিশ পাঠানো হবে।

অ্যাম্বাসাডর বলেছিলেন, না, পুলিশ পাঠানোর দরকার নেই। কিন্তু দেখবেন, যাতে বেশি ছাত্র ভেতরে প্রবেশের অনুমতি না পায়।

তার মানে বোঝানো হচ্ছে, কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে হবে। ম্যারি এক মনে সবকিছু শুনছিলেন। মনে হল, এখানে সারারাত থাকলে বোধহয় ভালো হত।

অসাধারণ অভিজ্ঞতা, একটির পর একটি আলোচনা।

ম্যারির পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক বললেন- কাল আপনার কী অ্যাপয়মেন্ট?

ম্যারি বললেন- কাল রোববার, আমি একটু দেরি করে উঠব।

এক ভদ্রমহিলা বললেন তাহলে? কাল একটি ছুটি বলুন?

ম্যারি ঘড়ির দিকে তাকালেন এ কী? রাত দুটো বেজে তিরিশ মিনিট? এবার তো বাড়ি যাওয়া উচিত। স্টানটন রজার্সের সাবধান বাণী মনে পড়ল। যে-কোনো ডিনার পার্টিতে প্রধান অতিথি চলে যাবার আগে আসর ছেড়ে যাওয়া যায় না।

আজকে আমিই তো প্রধান অতিথি। ওঃ, হায় ঈশ্বর, ম্যারি ভাবলেন, আমি সকলকে জাগিয়ে রেখেছি।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বরে বললেন গুডনাইট, সকলকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসা জানাচ্ছি। ভারি সুন্দর কাটল আজকের সন্ধেটা!

তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। দরজার বাইরে চলে গেলেন। অন্য অতিথিরা তখন যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন।

.

পরের দিন সকালবেলা, হলওয়েতে মাইক শ্লেটের সঙ্গে দেখা হল। মাইক শ্লেট বললেন– আপনি সমস্ত ওয়াশিংটনবাসীকে শনিবার মাঝরাত্রি পর্যন্ত জাগিয়ে রেখেছিলেন।

মিঃ স্টিকলি, আমি বুঝতে পারছি না, কেন এই ভদ্রলোক আমার সাথে এভাবে লেগে আছেন?

স্টিকলির মুখে ভাবলেশহীন হাসি। তিনি কাগজ পড়ছিলেন। বললেন– কী সমস্যা?

মিঃ শ্লেট অত্যন্ত উদ্ধত, সবসময় ঝগড়া করার ফন্দি। আমি ওঁনাকে পছন্দ করছি না।

–হ্যাঁ, আমি জানি, ভদ্রলোক ওরকম স্বভাবের। কিন্তু…

–কী করব? ওঁনার সাথে কাজ করা আমার পোষাবে না। আপনি অন্য কাউকে ওঁনার জায়গাতে নিয়ে আসুন।

–আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

–হ্যাঁ।

মিসেস অ্যাসলে, পূর্ব ইউরোপের ব্যাপারে মাইক শ্লেটের কোনো তুলনা হয় না। আপনি কী করবেন? আপনি অবশ্যই ওঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন। আমায় দেখতে হবে, আপনার হাতে আমি যেন শ্রেষ্ঠ অস্ত্র দিতে পারি। ভবিষ্যতে মাইক শ্লেট সম্পর্কে আমি কোনো অভিযোগ শুনতে চাইছি না। আশা করি, আমার বক্তব্য বুঝতে পেরেছেন।

ম্যারি ভাবলেন- না, এই অপমানের জবাব দিতেই হবে।

 তিনি অফিসে ফিরে গেলেন। স্টানের সাথে কথা বলব? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, মাইক শ্লেটকে পরিচালনা করা আমার পক্ষে সম্ভব কিনা।

-দিবাস্বপ্ন দেখছেন?

ম্যারি তাকালেন। মাইক শ্লেট তার ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে একগোছা কাগজ।

উনি বললেন– এই কাগজগুলো আজ আপনাকে সমস্যা দেবে।

-পরের বার অফিসে এলে দরজায় নক করবেন।

মাইক শ্লেটের চোখে বিস্ময়- আচ্ছা, আমি তাই করব।

রাগ ক্রমশ মাথায় চড়ছে- মিঃ শ্লেট, আমি আপনার মতো লোকের সাথে কাজ করতে চাইছি না। আপনি উদ্ধত অবিবেচক দুর্বিনীত অশিক্ষিত।

আঙুল উঠে গেল–বাঃ, বেশ ভালো বলেছেন তো!

–আপনি কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছেন?

 গলা চড়ে গেছে। আমি আপনাকে সাহায্য করব না? ঠিক আছে, আমি দেখছি, কী করা যায়?

সামান্য কথাবার্তা। ম্যারি বুঝতে পারলেন, এই অবস্থার মধ্যে তাকে থাকতেই হবে। শেষ অব্দি এমন অবস্থা, ম্যারি অ্যাসলে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না।

মাইক বলছেন- ম্যারি অ্যাসলে, আপনি এই পদের যোগ্য নন। যদি কেউ ভেবে থাকেন, আপনাকে খুশি করবেন, তাহলে আপনাকে আইসল্যান্ডের অ্যাম্বাসাডর করে পাঠানো উচিত ছিল।

না, আর নয়। ম্যারি উঠে দাঁড়ালেন। সপাটে গালে চড় মেরে দিলেন।

 মাইক শ্লেট দীর্ঘশ্বাস ফেললেন– আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি ম্যাডাম। দিয়েছেন কী?

.

১৬.

আমন্ত্রণ পত্রে লেখা ছিল- রোমানিয়ার অ্যাম্বাসাডর আপনাকে ককটেলের আসরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। এর সঙ্গে ডিনারের ব্যবস্থা থাকবে।

ম্যারি শেষবারের মতো ভাবলেন– ইস, ওখানে যাওয়া আমার উচিত হয়নি।

তিনি নতুন পোশাক পরলেন। কালো ভেলভেটের সান্ধ্য পোশাক। লম্বা হাতা। কালো হাইহিল জুতো পরলেন। মুক্তোর নেকলেস।

বেথ বলল- মা, তোমাকে ম্যাডোনার থেকেও সুন্দরী দেখাচ্ছে।

ম্যারি বললেন- হ্যাঁ, আমার খুব উত্তেজনা হচ্ছে। টেলিভিশনে অনেকে আমাকে দেখবে। সকালে আমরা সবাই প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটনের বাড়িতে বেড়াতে যাব। মাউন্ট ভারননে।

–মম, ভালোভাবে থেকো কিন্তু।

 টেলিফোন বাজল- ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, লবিতে মিঃ স্টিকলি।

 ম্যারি ভেবেছিলেন অনেক ভালো হত, যদি আমি একা যেতে পারতাম।

না, কারও সাহায্য নিতে আর ভালো লাগছে না।

.

রোমানিয়ান এমব্যাসিতে অনেক মানুষের ভিড়। বাতাসে উৎসবের গন্ধ। এর আগে এমনটি দেখেননি ম্যারি। গাব্রিয়েল স্টোইকার সঙ্গে দেখা হল, ডেপুটি চিফ অফ মিশন।

–শুভ সন্ধ্যা, মিঃ স্টিকলি। আপনাকে দেখে খুবই ভালো লাগছে।

জেমস স্টিকলি ঘাড় নাড়লেন, বললেন আমাদের অ্যাম্বাসাডরের সঙ্গে দেখা করবেন না?

স্টোইকার মুখ দেখে মনে হল, ম্যারির সাথে তার কখনও দেখাই হয়নি। একেই বলে পেশাগত দক্ষতা। উনি বললেন- ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, ভেতরে আসুন।

ওঁরা হল দিয়ে এগিয়ে গেলেন। ম্যারি লক্ষ করলেন, সব কটা ঘরেই উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। অগ্নিকুণ্ডগুলো কাজ করতে শুরু করেছে। অর্কেস্ট্রা বাজনা। প্রত্যেকটা ফুলদানিতে প্রস্ফুটিত ফুলের বাহার।

অ্যাম্বাসাডর রাদু করবেসকু একদল মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। জেমস এবং ম্যারি সেখানে উপস্থিত হলেন।

শুভ সন্ধ্যা মি. স্টিকলি।

শুভ সন্ধ্যা অ্যাম্বাসাডর, আমি আমাদের অ্যাম্বাসাডরকে নিয়ে এসেছি।

 করবেসকু তাকালেন ম্যারির দিকে এবং বললেন– আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগছে।

ম্যারি ভেবেছিলেন ভদ্রলোকের চোখে পরিচয়ের চিহ্ন থাকবে। কিন্তু তা নেই। মারি বুঝতে পারলেন, এই জগৎটা একেবারেই পেশাদারী, এখানে ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির কোনো স্থান নেই।

একশো জনের মতো লোক ডিনারের আসরে উপস্থিত হয়েছেন। ছেলেদের পরনে ডিনার জ্যাকেট, মেয়েরা অসাধারণ সব গাউন পরেছে। ম্যারি খাবার টেবিলে বসে আছেন।

স্টিকলি জানতে চেয়েছিলেন– আপনি ড্রিঙ্ক করবেন নাকি?

ম্যারি বললেন আমি কখনও ড্রিঙ্ক করি না।

–হ্যায়, হায় কী দুর্ভাগ্য!

 ম্যারি অবাক হয়ে তাকালেন কেন?

–এটা হল আপনার কাজের অঙ্গ। প্রত্যেকটি কূটনৈতিক আসরে আপনাকে ড্রিঙ্ক দেওয়া হবে। যদি আপনি ড্রিঙ্ক না করেন, তাহলে অতিথি মনে কষ্ট পাবেন। এখন থেকেই দু একবার চুমুক দেওয়া শুরু করুন।

ম্যারি বলেছিলেন- ঠিক আছে, আমি ভেবে দেখছি।

ম্যারি চারপাশে তাকালেন। মাইক শ্লেট বসে আছেন। ম্যারি প্রথমে চিনতে পারেননি। মাইক ডিনার পোশাক পরেছেন। না, এই সন্ধ্যাবেলায় এমন সুন্দর পোশাকে ভদ্রলোককে খুব একটা খারাপ দেখাচ্ছে না। একটি হাত এক যৌনবতী স্বর্ণকেশিনীর কাঁধের ওপর এমনিই পড়ে আছে। নাঃ, অত্যন্ত সস্তা, ম্যারি ভাবলেন। এমনটিই তো হবে। মনে হয় বুখারেস্টে এই ভদ্রলোকের জন্য অনেক গার্লফেন্ড অপেক্ষা করে আছে।

মাইকের কথাগুলো মনে পড়ল আপনি একজন অ্যামেচার। যদি কেউ আপনাকে আইসল্যান্ডে পাঠাতো, তাহলে ভালো হত। নাঃ, বেজন্মা!

ম্যারি দেখলেন, কর্নেল ম্যাককিনিকে। ইউনিফর্ম পরেছেন, মাইকের সাথে হেঁটে যাচ্ছেন। মাইক ওই মহিলার কাছ থেকে অনুমতি নিলেন। কর্নেলের সাথে এককোণে চলে গেলেন। ম্যারি ভাবলেন, এই দুজনের ওপর নজর রাখতে হবে।

একজন পরিচারক শ্যাম্পেন নিয়ে ঘুরছিল।

ম্যারি ভাবলেন, আমারও এক গ্লাস খাওয়া উচিত।

জেমস স্টিকলি ম্যারির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি বললেন- হ্যাঁ, এইভাবেই কাজ করতে হবে।

.

কয়েক ঘণ্টা ধরে ম্যারির সাথে সকলের পরিচয় হল। সেনেটররা, গভর্নররা, ওয়াশিংটনের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। রোমানিয়া একটা গরম আসন। কেউ এই রোমানিয়াতে যেতে চায় না। আপনি এখানকার রাষ্ট্রদূত? ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন লাগে।

মাইক শ্লেট, জেমস স্টিকলি এবং ম্যাককিনির দিকে এগিয়ে এলেন। তখনও ওই স্বর্ণকেশিনীকে বগলদাবা করে রেখেছেন।

মাইক জড়ানো কণ্ঠস্বরে বললেন– গুড ইভিনিং, মিস ডেনিসনের সঙ্গে পরিচয় আছে কী? এই হল জেমস স্টিকলি, আর এ হল ম্যারি অ্যাসলে।

ইচ্ছে করেই আমাকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে।

 ম্যারি ঠান্ডা মাথায় বলেছিলেন- অ্যাম্বাসাডর অ্যাসলে।

 মাইক কপাল চাপড়ে বললেন– দুঃখিত অ্যাম্বাসাডর অ্যাসলে। মিস ডেনিসনের বাবাও একজন অ্যাম্বাসাডর ছিলেন। এক অসাধারণ কূটনীতিবিদ। অন্তত গোটা ছয়েক দেশে কাজ করেছেন, গত পঁচিশ বছর ধরে।

ডেবি ডেনিসন বললেন– বেড়ে ওঠার পক্ষে কী চমৎকার!

মাইক বললেন- ডেবির মধ্যে অনেক কিছু আছে।

ম্যারি মনে মনে বলেছিলেন, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

ম্যারি প্রার্থনা করেছিলেন, ডিনারের আসরে তাকে যেন মাইকের পাশে বসতে না হয়। প্রার্থনা মঞ্জুর হল। মাইক ওই অর্ধউলঙ্গ মেয়েটির সাথেই খেতে বসেছেন। ম্যারির টেবিলে আরও জনা দশ-বারোজন বিখ্যাত মানুষের উপস্থিতি। বেশ কয়েকটা মুখ খুবই পরিচিত। বিভিন্ন পত্রিকার প্রচ্ছদে দেখা যায়, অথবা টেলিভিশনের পর্দায়। জেমস স্টিকলি ম্যারির উলটোদিকে বসেছেন। ম্যারির বাঁদিকে যে ভদ্রলোক বসেছেন, তিনি একটা অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছিলেন। ডানদিকে এক লম্বা সোনালি চুলের ভদ্রলোক বসে আছেন। মুখখানা ভারি উজ্জ্বল এবং আকর্ষণীয়।

উনি বললেন- ডিনারে আপনার সাথে বসতে পেরেছি বলে খুবই ভালো লাগছে। আমি আপনার উগ্র সমর্থক।

ওঁনার কথার মধ্যে স্ক্যানডেভিয়ান ভাষার টান আছে।

 ম্যারি অবাক হয়েছে- ধন্যবাদ।

–আমি ওলাফ পিটারসন, সুইডেনের কালচারাল অ্যাটাসে।

মি. পিটারসন, আপনার সঙ্গে দেখা হল বলে আমি নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি।

–আপনি কখনও সুইডেন গেছেন?

না-না, আমি কোথাও যাইনি, এই দেশের বাইরে।

ওলাফ পিটারসন হাসলেন– কত কিছুই দেখার আছে।

 –হয়তো একদিন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেখানে যাব।

–আপনার ছেলেমেয়ে আছে? কত বয়স?

–ছেলের বয়স দশ, মেয়ের বয়স বারো। আমি ছবি দেখাব? ম্যারি তাড়াতাড়ি পার্স খুললেন, ছেলেমেয়ের ছবি দেখালেন। উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকা জেমস স্টিকলি ব্যাপারটার প্রতি নজর রেখেছেন। তিনি মাথা নাড়ার চেষ্টা করলেন।

ওলাফ পিটারসন ছবিগুলো দেখলেন। বললেন– বাঃ, ওদের দেখতে ঠিক আপনার মতো হয়েছে।

ম্যারি বললেন- না না, ওদের চোখদুটো বাবার মতো।

এইভাবে ওঁরা একে অন্যের সাথে কথা বললেন।

এডওয়ার্ড বলত, বেথ ঠিক তোমার মতো দেখতে হয়েছে। ও তোমার মতোই সুন্দরী হয়ে উঠবে। আর টিমের চেহারা কার মতো? না, সে আমার মতো হবে না।

ওলাফ পিটারসন আরও কিছু কথা বললেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন– আপনাকে একটা ব্যাপারে প্রশ্ন করব?

হ্যাঁ, করতে পারেন।

–আমি শুনেছি, আপনার স্বামী মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। আমি বেশ বুঝতে পারি, এই পৃথিবীতে একজন মেয়ের একা থাকা কতখানি কষ্টকর। তাই বলছি, আপনি কি এই কাজটা ঠিক মতো করতে পারবেন?

ম্যারির সামনে এক গ্লাস মদ রয়েছে। ম্যারি মদে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। ঠান্ডা এবং উত্তেজক। তার মনের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চারন।

ম্যারির মুখে স্মিত হাসি।

পিটারসন প্রশ্ন করলেন। আপনি কবে রোমানিয়া যাচ্ছেন?

–আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, ম্যারি আবার মদের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। প্রথমে বুখারেস্টে যাব। তিনি ধীরে ধীরে মদ পান করছেন। আঃ, এ জিনিসের স্বাদ আগে কখনও পাইনি কেন? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলেন তিনি।

ওয়েটার আবার গ্লাসটা ভর্তি করে দিল। ম্যারি মাথা নাড়লেন। চারদিকে তাকালেন, কত মানুষ, কতরকম শব্দ।

ওলাফ পিটারসন জিজ্ঞাসা করলেন– আপনি ঠিক আছেন তো?

–হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। ওলাফ, আর এক গ্লাস মদ হবে কী?

–হ্যাঁ, ওয়েটারকে বলা হল। ম্যারির ওয়াইন গ্লাস আবার ভর্তি করে দেওয়া হল।

ম্যারি বললেন– বাড়িতে আমি কখনও ড্রিঙ্ক করি না। কিন্তু সত্যি বলতে কী, এর আগে আমি কখনোই এভাবে ডিঙ্ক করিনি।

ওলাফ পিটারসন ম্যারির দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখে হাসি।

এবার অ্যাম্বাসাডর করবেসকু বললেন–ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ, এবার আমাদের আনুষ্ঠানিক ব্যাপারগুলো শুরু হবে।

সকলের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানানো হল। রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজানড্রোস আয়োনেসকু, মাদাম আয়োনেসকু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট, পাশাপাশি রোমানিয়ান এবং আমেরিকান পতাকা রাখা হল।

রোমানিয়ান অ্যাম্বাসাডর বললেন- আমরা নতুন অ্যাম্বাসাডরের কাছ থেকে দু-চার কথা শুনতে চাইছি।

ম্যারি উঠলেন। তার মনে হল পৃথিবীটা ঘুরছে। কোনোরকম উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলটা ধরলেন। সকলের দিকে তাকালেন। ভালো থাকুন, কোনো রকমে বললেন।

এত খুশি, এত আনন্দ তার জীবনে কখনও আসেনি। সকলের মুখে আনন্দ।

ম্যারি বললেন– সকলকে পেয়ে আমার খুবই ভালো লাগছে।

তারপর ওলাফ পিটারসনের পাশে এসে বললেন– মনে হচ্ছে, আমার ওয়াইনে কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ওলাফ বললেন- চলুন একটু বাইরে ঘুরে আসি। ঠান্ডা বাতাস দরকার।

–এত ঘুম পাচ্ছে কেন?

চলুন, বাইরে চলুন।

ওলাফ ম্যারিকে সাহায্য করলেন, ম্যারি হাঁটতে পারছেন না। জেমস স্টিকলি নানা ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি দেখেননি ম্যারি চলে গেছেন। ম্যারি এবং ওলাফ মাইক শ্লেটের টেবিলের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মাইকের চোখে এক অদ্ভুত নিরাপত্তাহীনতা।

ম্যারি ভাবলেন, মাইক বোধহয় আমার এই সৌভাগ্য সহ্য করতে পারছেন না। কেউ তো তাঁকে কথা বলার জন্য মঞ্চে ডাকেনি।

কথাবার্তা জড়িয়ে গেছে। ম্যারি বাইরে এলেন। তারপর ওলাফ তাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিলেন। ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিলেন। তারা একটা বিরাট অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এলেন। ম্যারি পিটারসনের দিকে তাকিয়েছেন।

আমরা কোথায় এসেছি?

–আমরা বাড়িতে পৌঁছে গেছি। ম্যারিকে ধরে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন ওলাফ পিটারসন।

আমি মাতাল হয়ে গেছি? ম্যারি জানতে চাইলেন।

–না-না, কিছু হয়নি।

–কেমন মজা লাগছে সব কিছুতে।

–কিছুটা ব্র্যান্ডি খেলেই আপনি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবেন।

 তারা এলিভেটরের কাছে গেলেন।

–কী বলছেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

পিটারসন তার হাতে হাত দিলেন।

এলিভেটরের দরজা খুলে গেল। তারা নেমে এলেন।

–এই মেঝেটা এলোমেলো কেন?

ওলাফ বললেন- ঠিক আছে আমি দেখছি।

পিটারসন কৌচের ওপর ম্যারিকে শুইয়ে দিলেন। পাশে বসলেন। ম্যারির চোখে সাত রাজ্যের ঘুম নেমেছে। ওলাফের ঠোঁট ম্যারির ঠোঁটের ওপর চাপ দিচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছেন ম্যারি, দুটি আগ্রাসী হাত তার উরু স্পর্শ করছে।

–আপনি কী করছেন?

–আপনি চোখ বন্ধ করে থাকুন, ডার্লিং, কথা দিচ্ছি, এতে আপনার ভালোই লাগবে। সত্যি তো, হাতের এই সুন্দর কারুকাজ, মনে হচ্ছে এডওয়ার্ড বুঝি কবর থেকে উঠে এসেছে।

ম্যারি বললেন– সে একজন দারুণ ডাক্তার ছিল।

আবার নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় চাপ দিয়ে ওলাফ বললেন- হ্যাঁ, আমি তা বিশ্বাস। করি।

আঃ, কখনও অপারেশনের দরকার হলে সকলে এডওয়ার্ডের খোঁজ করত।

ম্যারি শুয়ে পড়েছেন, উপুড় হয়ে, মনে হচ্ছে, কে যেন তাকে ধীরে ধীরে নগ্না করছে। এডওয়ার্ডের দুটি হাত, ম্যারি চোখ বন্ধ করলেন। বুঝতে পারছেন, দুটি ঠোঁট তার পিঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর একটা অত্যন্ত কোমল জিভ। এডওয়ার্ড তো এভাবেই আদর করত। কখনও বন্ধ করতে চাইত না।

ম্যারি বললেন– খুব ভালো লাগছে ডার্লিং, আমাকে গ্রহণ করো।

গম্ভীর, কণ্ঠস্বর- হ্যাঁ, আমি তোমাকে আরাম দেব এবং সন্তুষ্টি।

কিন্তু এ গলাটা তো এডওয়ার্ডের নয়। ম্যারি চোখ খুললেন। অবাক হয়ে গেলেন। বললেন- না, এখনই বন্ধ করুন।

ম্যারি ছিটকে সরে গেলেন। মেঝের ওপর পড়ে গেলেন।

ওলাফ পিটারসন বললেন– কিন্তু…

না। অ্যাপার্টমেন্টের দিকে তাকালেন। আমার ভুল হয়েছে, আমি বুঝতে পারিনি। আপনি কে?

ম্যারি বাইরের দিকে যাবার চেষ্টা করলেন।

ওলাফ বললেন- একটু অপেক্ষা করুন, আপনাকে সাহায্য করি।

কিন্তু আশেপাশে ম্যারি কোথাও নেই।

.

ম্যারি বাইরে এলেন, পথঘাট ফাঁকা, কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। এতক্ষণ ধরে যে ঘটনাটা ঘটে গেল, বিবেকের কাছে কীভাবে জবাবদিহি করবেন? আমি আমার দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করলাম? এইভাবে? এত মানুষের সামনে পুরো মাতাল হয়ে গেলাম? অপরিচিত একজনের অ্যাপার্টমেন্টে এলাম? সে আমাকে প্রায় ধর্ষণ করে ফেলছিল আর কী। আগামীকাল ওয়াশিংটনের সব কটা খবরের কাগজে মুখরোচক খবর বেরোবে। হায় ঈশ্বর, আমি কেন এখনও বেঁচে আছি?

.

বেন কোন গল্পটা শুনেছিলেন রোমানিয়ান এমব্যাসির মানুষদের কাছ থেকে। ওয়াশিংটনের এবং নিউইয়র্কের একাধিক খবরের কাগজের পাতায় চোখ মেলে দিলেন। না, এই ঘটনা নিয়ে কোনো শব্দ প্রকাশিত হয়নি। কেউ হয়তো খবরটাকে হত্যা করেছে। কিন্তু এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর।

কোহন তার বন্ধুকে ডাকলেন, আইয়ানকে।

পুরো গল্পটা শুনতে হবে। কোহন ভাবলেন, আমিই এই খবরটা প্রথম বের করব। তা হলে বোধহয় খবরের কাগজের বিক্রি বেড়ে যাবে।

.

একজন অতিথির সঙ্গে বেন কোহন বসে আছেন। উনি হলেন আলফ্রেড। আর আছেন টনি ভারজিও।

–আপনারা কি ড্রিঙ্ক করবেন?

 আলফ্রেড মারটিনির অর্ডার দিলেন।

বেন কোহন বললেন আমার কিছুই লাগবে না।

আলফ্রেড এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক। স্ট্রেট ডিপার্টমেন্টে ইউরোপিয় বিভাগে কাজ করেন। কয়েক বছর আগে ইনি মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। বেন কোহন সেই সংবাদটা চেপে দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই আলফ্রেড বেন কোহনকে ভালোবাসেন। ভালোবাসা অথবা কৃতজ্ঞতা।

–আল, আমি আপনার সাহায্য চাইছি।

কী ঘটেছে সব বলতে হবে।

নতুন অ্যাম্বাসাডর?

–হ্যাঁ।

রোমানিয়ান অ্যাম্বাসাডরের পার্টিতে কী হয়েছিল? আপনি কি তা জানেন?

–হ্যাঁ, আমি সব গুছিয়ে বলব। কিন্তু ঠিক মতো ছাপতে হবে।

কীভাবে? আমি সব খবর পেয়েছি।

তারপর? সংক্ষিপ্ত আলোচনা, কৌতুকের শব্দ। বলা হল, এই মহিলা এক সিনড্রেলা, এঁনার নাম কেউ জানতেন না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাতে জাদুদণ্ড ছিল। হঠাৎ তিনি গ্রেস কেলি হয়ে গেলেন। হয়ে গেলেন যুবরানি ডায়না অথবা জ্যাকেলিন কেনেডি। সব কিছু একজনের মধ্যে, হ্যাঁ, তিনি সুন্দরী, এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এইভাবে? এইভাবে এত বড় একটা পদে বসানো হল?

মারটিনি কাজ করতে শুরু করেছে।

আশা করি এতেই কাজ দেবে বেন কোহন?

-হ্যাঁ। তাহলে? ইতিমধ্যে অ্যাসলের বারোটা বেজে গেল। আর কিছু দরকার আছে। কী? প্রথমবার প্রেসিডেন্ট আবেদন করেছিলেন। শ্রীমতী জবাব দেননি। কারণ তার স্বামী প্রাকটিস ছেড়ে বাইরে যেতে পারবেন না। স্বামীর মৃত্যু হল, গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে, সব কিছু কেমন সাজানো বলে মনে হচ্ছে নাকি? এবার শ্রীমতী এলেন, বুখারেস্টে যাবেন। প্রথম। থেকেই একটা ষড়যন্ত্র, নিপুণ হাতের কারুকাজ, তাই নয় কী?

–কে আছে এর অন্তরালে? কে?

বেন কোহন বললেন- এটাই তো জ্যাকপট প্রশ্ন, কোটি টাকার প্রশ্ন।

–আমি বুঝতে পারছি না, শেরিফ মুনস্টারের সঙ্গে কথা বললে ভালো হয়। তিনি তো ওই ঘটনাটার প্রত্যক্ষদর্শী।

–আর কেউ?

দুজনের আলোচনা। ঠিক হল, শেরিফের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

আলফ্রেড মাথা নেড়ে বলেছিলেন– বেন, আমি বুঝতে পারছি না, এই রহস্যটা সমাধান করা সম্ভব কিনা।

–তবু চেষ্টা করতে দোষ কী?

আর একটা ষড়যন্ত্র, জাল বোনা শুরু হয়েছে। বেচারি ম্যারি তা জানতেও পারলেন না।

.

আলফ্রেড বেন কোহনের তথ্যটা বিশ্বাস করতেন। তিনি জানতেন সাংবাদিকরা সবসময় উত্তেজক খবরের সন্ধানে ছুটে বেড়ায়। বেন কোহনকে তিনি ভালোবাসেন। কিন্তু এই ব্যাপারটার সমাধান কী করে হবে?

আলফ্রেড ভাবলেন, একজনকে ডাকা যেতে পারে। ফোন করে একবার দেখা যাক।

.

পরদিন সকালে বেন কোহন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আকিকোকে বললেন– হয় আমাকে শতাব্দীর সেরা প্রতিবেদনটা প্রকাশ করতে হবে, অথবা এই পেশাটাই ছেড়ে দিতে হবে।

আকিকো চিৎকার করে বলল– ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে, তোমার দুষ্টু ছেলেটা এখন সুখেই থাকবে।

বেন কোহন ম্যারি অ্যাসলের সাথে দেখা করলেন।

.

–শুভ সকাল, অ্যাম্বাসাডর, আমাকে মনে আছে? আমি বেন কোহন।

–হ্যাঁ, ওই গল্পটা কি লেখা হয়ে গেছে?

না, এর জন্য আপনার সাথে আরও কিছু আলোচনা করতে হবে। আমি জাংশন সিটিতে গিয়েছিলাম, এমন কিছু খবর নিয়ে এসেছি, যা শুনলে আপনার ভালোই লাগবে।

-কী খবর?

 –একটু সময় নিয়ে বলতে হবে। কোথাও বসা যেতে পারে?

–কদিন আমি খুব ব্যস্ত থাকব। শুক্রবার সকালে আধঘণ্টা ফাঁকা আছে।

তিনদিন, বেন কোহন মনে মনে ভাবলেন।

– ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করব।

আপনি কি আমার অফিসে আসবেন?

প্রশ্ন ছুটে এল। আবার ম্যারি বললেন- এই বাড়ির নীচের তলায় কফিশপ আছে। সেখানে দেখা হবে।

.

কনট্রোলারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার কোনো উপায় নেই। তিনি লৌহযবনিকার অন্তরালে বসে থাকেন। তার টেলিফোন নাম্বার কেউ জানে না। মাত্র দু-একজন ছাড়া।

মাঝে মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে খবর পৌঁছে যায়। সন্ধ্যা ছটা, খবর পৌঁছোল, বুয়েন্স আয়ার্সে তখন রাত আটটা বাজে।

কনট্রোলার দুবার এই খবরটা শুনলেন। তিনি একটি নাম্বার ডায়াল করলেন। তিন মিনিট অপেক্ষা করলেন। নেউসা মুনেজের ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর।

কে?

কনট্রোলার বললেন- অ্যাঞ্জেল সম্পর্কে কিছু বলার আছে। তার জন্য আর একটা কাজের দায়িত্ব দেওয়া হবে।

তন্দ্রা মেশানো কণ্ঠস্বর–আমি জানি না, ও কোথায়?

 অধৈর্যের আভাস বন্ধ রাখার চেষ্টা না কখন আপনার সাথে ওঁনার দেখা হবে?

–আমি ঠিক বলতে পারছি না।

কনট্রোলারকে দেখে মনে হল। এই মুহূর্তে তিনি অসহায় হয়ে উঠেছেন। সত্যি এই মহিলার স্বভাবচরিত্র বুঝতে পারা যাচ্ছে না। তবুও তিনি বললেন- অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, এক্ষুনি উনি যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

–এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন, আমি একবার টয়লেটে যাব।

রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ। কনট্রোলার বসে থাকলেন। হতাশায় আচ্ছন্ন তার সমস্ত মুখ।

তিন মিনিট কেটে গেছে, মেয়েটি আবার রিসিভার ধরেছে।

–দেখছি কী করা যায়।

ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কি লিখে রাখবেন?

.

সেইদিন সন্ধ্যাবেলা ম্যারি কানাডিও এমব্যাসির এক ডিনার পার্টিতে গিয়েছিলেন। যখন তিনি যাবার জন্য তৈরি হলেন জেমস স্টিকলি বলেছিলেন- আমি অনুরোধ করব, এবার আর আপনি আগের মতো ব্যবহার করবেন না।

বোঝা গেল, জেমস স্টিকলি আর মাইক শ্লেট, এই দুজনে মিলে ম্যারির জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলবেন।

পার্টি শুরু হয়েছে। অনেক মুখ অচেনা অজানা। পাশেই গ্রিসের এক বিজনেস ম্যাগনেট বসেছিলেন। আর একদিকে ইংল্যান্ডের এক কুটনীতিবিদ।

অনেকের সাথে আলাপ-পরিচয় হল। অনেকে জানতে চাইলেন, নতুন এই কাজটা নিয়ে কেমন লাগছে?

কেউ কেউ বলেছিলেন- কানসাস থেকে পালিয়ে এসে ভালো লাগছে কিনা।

আর এক গায়ে পড়া ভদ্রমহিলা বললেন আমি কখনও মধ্য আমেরিকাতে যাইনি। জায়গাটা ভয়ংকর বলেই মনে হয়। ওখানে কী বা আছে? সারবন্দি জমি, সেখানে নানা শস্য আর গম তৈরি হচ্ছে।

ম্যারির চোখে-মুখে রাগ, কিন্তু কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন ওই খাদ্যশস্য থেকেই সারা পৃথিবীর মানুষের অন্ন সংস্থান হয়। তা জানেন কী?

ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বরে উদ্বিগ্নতা আমাদের আটোমোবাইল গ্যাসের সাহায্যে ছুটে চলে। কিন্তু আমি কি তৈলখনিতে গিয়ে থাকতে পারি? আমি কখনও পূর্ব দেশে যেতে পারব না। কানসাসও আমার মতে থাকার অযোগ্য জায়গা।

টেবিলে বসে থাকা অন্যান্যরা কী উৎকীর্ণ হয়ে শুনছিলেন।

ম্যারি একবার ভেবেছিলেন, প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু করলেন না। অনেক কথাই মনে পড়ে গেল, আগস্ট মাসে উৎসব, ইউনিভার্সিটির থিয়েটার হলে অভিনীত একটির পর একটি একাঙ্ক নাটক। রোববার সকালে মিলফোর্ড পার্কে পিকনিক, তার পরে টুর্নামেন্ট। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লেকের জলে বসে মাছ ধরার আনন্দ। মাঝে মধ্যে ব্যান্ডের বেজে ওঠা, আগুন জ্বেলে নাচ এবং আরও কত কী! শীতকালে স্কি খেলা, জুলাইয়ের চার তারিখে আতসবাজির আভাস, কানসাসের আকাশ তখন নানা বর্ণে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

ম্যারি ভদ্রমহিলাকে বললেন- যদি কখনও মধ্য আমেরিকাতে যান, তাহলে দেখবেন, আপনার এই ধারণা একেবারে বদলে গেছে। আমেরিকা শুধু ওয়াশিংটন, লসএঞ্জেলস এবং নিউইয়র্ককে নিয়ে গঠিত নয়। হাজার হাজার ছোটো ছোটো শহর আছে, তাদের অনেকের নাম হয়তো আমরা শুনিনি। সেখানে অনেক খনিশ্রমিক আছেন, সাধারণ কৃষক, আছেন কেরানির দল। তাদের সকলকে নিয়েই বিরাট এই পৃথিবীটা গড়ে উঠেছে। তাই নয় কি?

জেমস স্টিকলি ম্যারিকে পরের দিন সকালে বললেন আপনি এক নামি সেনেটরের বোনকে অযথা অপমান করেছেন? এটা কেন করলেন?

ম্যারি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছিলেন– উনি শুধু শুধু কয়েকটা দেশ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করছিলেন, তাই।

ম্যারি বুঝতে পারলেন, এখন মুখে কুলুপ এঁটে চলতে হবে।

.

বৃহস্পতিবার সকালবেলা। অ্যাঞ্জেলের মেজাজটা মোটেই ভালো নেই। বুয়েন্স আয়ার্স থেকে ওয়াশিংটন ডিসির দিকে উড়ানপাখি উড়ে চলেছে। কিছুটা দেরি হয়েছে। টেলিফোনে কে যেন বলেছিল, বিমানের মধ্যে বোমা আছে। পৃথিবীটি ক্রমশই থাকার পক্ষে অযোগ্য হয়ে উঠেছে। অ্যাঞ্জেল মনে মনে ভাবলেন।

ওয়াশিংটনে যে হোটেলটা ইতিমধ্যেই সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেটি অতি আধুনিক। কীভাবে এর বর্ণনা দেওয়া যায়? বুয়েন্স আয়ার্সে এত সুন্দর হোটেল আর একটাও নেই।

কাজটা শেষ করে আমি ফিরে আসব। কাজটা খুবই সোজা। আমার নামের পক্ষে খুবই খারাপ। কিন্তু টাকাটা ভালোই। আজ রাতে ফিরতে পারলে ভালো হয়।

অ্যাঞ্জেল পৌঁছে গেলেন। একটা ইলেকট্রিক্যাল দোকানে এসে থামলেন। তারপর পেন্ট শপে। শেষ অব্দি সুপার মার্কেটে। তিনটে লাইট বা কিনলেন। বাকিটুকু তার বাক্সের থেকে বের করতে হবে। হোটেলে ফিরলেন, দুটো ঢাকা দেওয়া বাক্সে লেখা আছে ভঙ্গুর, সাবধানে ব্যবহার করবেন। প্রথম বাক্সের ভেতর আছে হ্যান্ড গ্রেনেড, দ্বিতীয় বাক্সে আছে জোড়া দেবার জিনিসপত্র।

খুব সাবধানে কাজটা করতে হল। তিনি প্রথমে গ্রেনেডের ওপরদিকটা খুলে দিলেন। একই রকম রং করলেন ওই লাইট বালগুলোর ওপরে। তারপর আসল বিস্ফোরকটা বের করে সিসমিক বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দিলেন। অ্যাঞ্জেল খানিকটা তামার প্রলেপ দিলেন। বোঝা গেল, এটা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। ফিলামেন্ট লাগানো হয়ে গেছে। সবকিছু শেষ হবার পর মনে হল, এটা বুঝি একটা সাধারণ লাইট বা।

বাকি বালবলোকে একইভাবে সাজানো হল। এবার শুধু টেলিফোন কলের জন্য অপেক্ষা।

.

টেলিফোন এল রাত আটটার সময়। অ্যাঞ্জেল সব কিছু শুনলেন। কাজটা এবার শুরু করতে হবে।

রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। ওই লাইট বাগুলোকে প্যাক করা হল। বিশেষভাবে তৈরি করা আধারের ভেতর। ভরে দেওয়া হল সুটকেসে। তার সাথে থাকল কিছু ছেঁড়া কাগজ।

ট্যাক্সি এগিয়ে চলল, নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর দিকে। সময় লাগল সতেরো মিনিট।

.

লবিতে কোনো দারোয়ান নেই। অ্যাঞ্জেল এবার কাজটা শুরু করবেন। যে অ্যাপার্টমেন্টের ওপর আঘাত করতে হবে সেটা পঞ্চম তলে অবস্থিত। করিডরের একেবারে শেষ প্রান্তে। চাবিটা পুরোনো দিনের, খুবই সহজে খোলা যায়। অ্যাঞ্জেল এক মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে গেলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন। ভেতরে কেউ নেই।

লিভিংরুমের ছটা লাইট বাল্ব পাল্টে দেওয়া হল। তারপর ডুডেস এয়ারপোর্টের দিকে অ্যাঞ্জেল এগিয়ে চললেন, মধ্যরাতের ফ্লাইট ধরে তাকে বুয়েন্স আয়ার্সে ফিরতে হবে।

বেন কোহনের কাছে দিনটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোরবেলা একটা প্রেস কনফারেন্সে যেতে হয়েছে। সেক্রেটারি অফ স্টেট এটা ডেকেছিলেন। অনেক খবর পাওয়া গেল সেখান থেকে। এবার প্রতিরক্ষা দপ্তরে। মধ্য রাতে বেন কোহন বাড়ি ফিরলেন। ভাবলেন, আজ সারারাত জেগে নোট তৈরি করতে হবে। কাল অ্যাম্বাসাডর অ্যাসলের সঙ্গে জরুরি বৈঠক আছে।

আকিকো শহরের বাইরে গিয়েছে। কালকের আগে ফিরবে না। আঃ, আজ রাতে আমি একটু ঘুমোবার সুযোগ পাব কী?

কিন্তু ওই মেয়েটা, ওই মেয়েটা জানে কী করে খোসা ছাড়িয়ে কলা খেতে হয়।

বেন চাবি নিলেন। দরজা খুললেন। ঘন অন্ধকারে ঢাকা অ্যাপার্টমেন্ট। আলো জ্বালাবার জন্য সুইচের কাছে গেলেন। হাত দিলেন। তারপর মনে হল, ঘরের ভেতর কে যেন পরমাণু বোমা ফাটিয়ে দিয়েছে। তার দেহের খণ্ড খণ্ড অংশ দেওয়ালের সাথে লেপটে গেল।

পরের দিন সকালবেলা, আলফ্রেডের স্ত্রীর কাছ থেকে শোনা গেল, বেন কোহনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ভবিষ্যতে আর কখনও পাওয়া যাবে না।

.

স্টানটন রজার্স বললেন– আমরা সরকারি অনুমতি পেয়েছি। রোমানিয়া সরকার আপনাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়েছে। আপনার মনোনয়ন তারা অনুমোদন করেছে।

ম্যারি অ্যাসলের জীবনে এত উত্তেজক মুহূর্ত এর আগে কখনও আসেনি। ঠাকুরদা বেঁচে থাকলে খুবই খুশি হতেন।

–আমি খবরটা নিজেই দিতে এলাম ম্যারি। আমাদের প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। কালকে আপনি হোয়াইট হাউসে আসবেন।

সব ব্যাপারের জন্য আমি অত্যন্ত আগ্রহী। কীভাবে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না।

আমি কিছুই করিনি। রজার্স বললেন, প্রেসিডেন্ট আপনাকে নির্বাচন করেছেন। তবে নির্বাচনটা যে খুব ভালো হয়েছে তা বলতে পারি।

মাইক শ্লেটের কথা ম্যারির মনে পড়ল।

কোনো কোনো মানুষ সব ব্যাপারের সঙ্গে মানাতে পারে না। তারা ভুল ভাবে? ম্যারি ভাবলেন। এই যে আমার জীবন কেমন তরতর করে এগিয়ে চলেছে, মাইক শ্লেট হয়তো দুঃখ পেতে পারেন। এতে কী বা আমি করতে পারি?

দেখতে দেখতে তাঁদের দুজনের মধ্যে একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। স্টানটন রজার্স, প্রেসিডেন্টের কাছের মানুষ, আর ম্যারি অ্যাসলে, কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন এক সামান্য অধ্যাপিকা। আজ সেখান থেকে কত উঁচুতে এসে গেছেন! কিন্তু এডওয়ার্ড? এডওয়ার্ডের কথা এখনও মনে পড়ছে কেন?

.

গ্রিনরুম। প্রেসিডেন্ট এলিসন বসে আছেন। ম্যারি এবং স্টানটন রজার্স প্রবেশ করলেন।

 প্রেসিডেন্ট বললেন- খবরটা পেয়েছেন কী? এই হল আপনার চিঠি।

ম্যারির হাতে চিঠিখানা তুলে দেওয়া হল। ম্যারি পড়তে থাকলেন। মিসেস ম্যারি অ্যাসলেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে রোমানিয়ার প্রধান প্রতিনিধি পদে নির্বাচিত করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার হাতে সামুদায়িক দায়িত্ব এবং কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে।

প্রেসিডেন্ট একটি পাসপোর্ট তুলে দিলেন ম্যারির হাতে। কালো কভারের মধ্যে ঢাকা। সামনে লেখা আছে, কূটনৈতিক ছাড়পত্র।

ম্যারি ভেবেছিলেন, আর কয়েক সপ্তাহ এখানে থাকতে পারবেন। কিন্তু এখন অত্যন্ত দ্রুত তাকে যেতে হবে।

প্যারিস।

রোম।

বুখারেস্ট।

 শহরগুলির নাম পর পর মনে পড়ল তার।

.

সেদিন সন্ধ্যাবেলা, ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টার বেন কোহনের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হল। জানা গেল, গ্যাস বিস্ফোরণে তার মৃত্যু হয়েছে। স্টোভ ফেটে গ্যাস বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর আগুন জ্বালতে গিয়ে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে।

ম্যারি এই খবরটা দেখেননি। বেন কোহন এলেন না কেন? ম্যারি ভাবলেন। হয়তো ওই রিপোর্টার ভুলে গেছেন, অথবা এই ব্যাপারে আর আগ্রহী নন। তিনি অফিসে চলে গেলেন। কাজের মধ্যে ডুবে গেলেন।

.

ম্যারি এবং মাইক শ্লেটের সম্পর্কটা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। মাইক শ্লেট এক উদ্ধত মানুষ। সব সময় অপমান করতে চাইছেন। কিন্তু কেন? স্টানের সাথে এবিষয়ে কথা বলতে হবে।

স্টান ম্যারি এবং তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে ডুডাস এয়ারপোর্টে এসেছেন। সেখানে স্টেট ডিপার্টমেন্টের লিমুজিন গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে।

স্টানটন বললেন- প্যারিস এবং রোমের দূতাবাসে খবর পৌঁছে গেছে। তারা আপনাদের তিনজনের যথেষ্ট যত্ন করবে।

–আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্টান। আপনি আমার জন্য চমৎকার কাজ করছেন।

স্টানের মুখে হাসি আপনাকে সেবা করতে পেরে আমার ভালোই লাগছে।

আমরা কি রোম শহরটা ঘুরে দেখতে পাব?

টিমের প্রশ্ন।

স্টানের মুখ গম্ভীর মনে হচ্ছে এবার হয়তো হাতে সময় থাকবে না।

 এয়ারপোর্ট, ইয়ান ভিলিয়ান একডজন ফটোগ্রাফারকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বেশ কয়েকজন রিপোর্টারকে নজরে পড়ল। ম্যারি, বেথ এবং টিমের চারপাশ ঘিরে তারা দাঁড়িয়ে আছেন। সাধারণ প্রশ্ন করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত স্টানটন রজার্স বললেন– অনেক হয়েছে, এবার শেষ করুন।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের দুজন এগিয়ে এলেন। আর এয়ারলাইনের একজন প্রতিনিধি। ছেলেমেয়েরা ম্যাগাজিন স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। ম্যারিকে এবার এক প্রাইভেট চেম্বারে যেতে হবে।

ম্যারি বললেন– এই বোঝা আমি কীভাবে বহন করব? যদি আগে জানতাম, মাইক শ্লেট আমার ডেপুটি হবেন, তাহলে আমি অন্যরকম চিন্তা করতাম।

চোখের ভেতর বিস্ময়- মাইককে নিয়ে কোনো সমস্যা হবে কী?

সত্যি কথা বলব? লোকটাকে আমার মোটেই ভালো লাগে না। ওকে আমি বিশ্বাস করি না। আর কাউকে কি আনা যায় না?

স্টানটন বললেন আমি জানি না এই ব্যাপারটা কীভাবে সমাধান হবে। মাইক শ্লেটের পটভূমি অত্যন্ত উজ্জ্বল। তিনি মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে বেশ কয়েকবছর ধরে কাজ করেছেন। অসম্ভব পরিশ্রমী এবং চটপটে।

দীর্ঘশ্বাস– মিঃ স্টিকলি একই কথা বলেছিলেন।

জানি না, কেন আপনার এই অভিমত।

 আবার স্টানটন বলতে শুরু করলেন– যদি সত্যি সত্যি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, আমাকে জানাবেন। আমি চাইব না, আপনাকে বিরক্তির মধ্যে ঠেলে দিতে।

.

চার্লস ডগল এয়ারপোর্ট। বাড়িটা দেখতে সায়েন্স ফিকশনের কোনো গল্পের মতো। উঁচু পাথরের কলাম উঠে গেছে। ম্যারির মনে হল, একশোটা এক্সক্যালেটার বুঝি চারদিকে কাজ করছে। অসংখ্য মানুষের ভিড়। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।

ম্যারি বললেন- তোমরা কোথাও যেও না। হারিয়ে যাবে তাহলে।

কোন্ এক্সক্যালেটরে যাবেন? চারদিকে তাকালেন অসহায়ভাবে। এক ফরাসি ভদ্রলোক হনহন করে এগিয়ে চলেছেন। সামান্য কিছু ফরাসি শব্দ ম্যারি শিখেছেন। তার ওপর নির্ভর করে জানতে চাইলেন।

ফরাসি উচ্চারণে ভেসে এল–সরি ম্যাডাম, আমি ইংরাজি জানি না।

 উনি এগিয়ে গেলেন।

 ম্যারি অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন।

একটু বাদে পরিচ্ছন্ন পোশাকের এক আমেরিকান ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন।

-মাদাম অ্যাম্বাসাডর, আমাকে ক্ষমা করবেন। ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্টে আমার আসতে দেরি হয়েছে। আমার নাম পিটার কেলাস, আমি এখানকার মার্কিন দূতাবাসে কাজ করি।

–আপনাকে দেখে ভালো লাগছে। আমি তো কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

ম্যারি নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললেন।

পিটার কেলাস বললেন- কোনো চিন্তা নেই। এবার সব দায়িত্ব আমার।

সত্যি, পনেরো মিনিট বাদে দেখা গেল ম্যারি, বেথ আর টিম বাইরে পৌঁছে গেছেন। কাস্টমসের ঝামেলা অতি সহজে মিটে গেছে।

.

ইন্সপেক্টর হেনরি ডুরান্ট। ফরাসি ইনটেলিজেন্স এজেন্সির এক পুঁদে অফিসার। তাকিয়ে আছেন অপলক। ওঁরা লিমুজিনের ভেতর চলে গেলেন। গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। ইন্সপেক্টর টেলিফোন বুথের কাছে গেলেন, দরজা বন্ধ করলেন। পয়সা ফেললেন এবং নির্দিষ্ট জায়গায় ফোন করলেন।

.

লিমুজিন আমেরিকান এমব্যাসির সামনে এল। ফরাসি সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন।

পিটার কেলাস জানালা দিয়ে দেখলেন– মনে হচ্ছে দাঙ্গা বেঁধে গেছে।

ভেতরে ছিলেন হিউজ সিমন, ফরাসি দেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূত। টেকসাসে তার জন্ম। মাঝবয়সি, চোখ দুটিতে সহস্র প্রশ্ন। উজ্জ্বল লাল চুল।

ম্যাডাম অ্যাম্বাসাডর, সকলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে উগ্রীব। প্রেস ইতিমধ্যেই জ্বালাতে শুরু করেছে।

এক ঘণ্টা ধরে প্রেস কনফারেন্স হল। যখন সেটা শেষ হয়ে গেছে, ম্যারি খুবই ক্লান্ত। ম্যারি এবং তার ছেলেমেয়েকে অ্যাম্বাসাডর সিমনের অফিসে নিয়ে যাওয়া হল।

তিনি বললেন আপনাকে দেখে ভালোই লাগেছে। আমি শুনেছি, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আপনাকে নির্বাচিত করেছেন। আপনার ছবি আমি দেখেছি, লা মনডে পত্রিকাতে।

স্টানটন রজার্সের কাছ থেকে টেলিফোন পেয়েছি। হোয়াইট হাউস থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনি এবং আপনার ছেলেমেয়ে যাতে প্যারিসে ভালোভাবে থাকতে পারেন, তার জন্য আদেশ এসেছে।

অর্থাৎ ফরাসি অভিযান বোধহয় ভালোভাবেই শুরু হচ্ছে, ম্যারি ভাবলেন।

.

বিকেলের কাগজে সংবাদটা প্রকাশিত হয়েছে। ম্যারির জীবনী এবং ছবি। টেলিভিশনে মাঝে মধ্যে তার মুখ দেখানো হচ্ছে। পরের দিন সকালে কাগজে আবার একই খবর প্রকাশিত হল। একটু অন্যভাবে।

ইন্সপেক্টর ডুরান্ট কাগজের স্তূপের দিকে তাকালেন। হাসলেন। সব কিছু নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে চলেছে। কাজটা আশাতীত হয়েছে। আগামী তিনদিন অ্যাসলে খুবই ব্যস্ত থাকবেন। তিনি ভাবলেন মনে মনে।

.

ম্যারি এবং ছেলেমেয়েরা জুলেভার্নে রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারলেন। তারপর তারা শহর পরিভ্রমণে বেরোলেন।

পরের দিন সকালে লুভ্যার মিউজিয়ামে গিয়েছিলেন। লাঞ্চ করলেন ভারসাইলসে। ট্যুর আর্জেন্ট-এ ডিনার।

রেস্টুরেন্টের জানালা দিয়ে নোতরদামের দিকে তাকাল টিম। আর একটা সুন্দর প্রশ্ন করল- ওই কুঁজো মানুষটাকে কোথায় রাখা হয়েছিল?

.

প্যারিসের বাতাসে সর্বদা বসন্ত, মনে আনন্দ,। ম্যারি চিন্তা করলেন, এডওয়ার্ড থাকলে কতই না ভালো হত।

পরের দিন লাঞ্চ হয়ে গেছে। তারা এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে চলেছেন। ইন্সপেক্টর ডুরান্ট তাকাচ্ছেন। এবার রোমের উদ্দেশে যাত্রা।

মহিলাটি যথেষ্ট আবেদনী, দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, মুখখানা বুদ্ধিদীপ্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে? চোখ বন্ধ করলেন ইন্সপেক্টর, ভাবলেন, এই মহিলাকে শয্যাসঙ্গীনী করলে কেমন হয়? ছেলেমেয়ের চমৎকার ব্যবহার। আমেরিকানদের কাছ থেকে এতটা আশা করা যায় কী?

উড়ানপাখি উড়তে শুরু করেছে। ইন্সপেক্টর ডুরান্ট টেলিফোন বুথে গেলেন। বললেন, এবার যাত্রাপথ রোম।

.

রোম। মাইকেল অ্যাঞ্জেলো এয়ারপোর্ট। ম্যারি এবং ছেলেমেয়েরা নেমে এলেন।

টিম বলল– মম দেখো, ওরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

ম্যারি বুঝতে পারলেন, এবার তাকে ইতালীয় ভাষার সঙ্গে লড়াই করতে হবে।

সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন এই দেশটা কেমন লাগছে?

অ্যাম্বাসাডর অসকার ভিনার এসেছেন, তিনি একটু অবাক হয়েছেন।

তিনি বললেন- ফ্রাঙ্ক সিনাত্রাও বোধহয় এমন সংবর্ধনা পাননি। মাদাম অ্যাম্বাসাডর, আমি বুঝতে পারছি না, প্রেস আপনাকে নিয়ে এত আগ্রহী কেন?

ম্যারি বললেন আমি জানি, যেহেতু আমি সরাসরি প্রেসিডেন্টের দ্বারা মনোনীত, তাই আমার ওপর একটু বেশি আলোচনা হচ্ছে। এছাড়া যেসব দেশগুলো এখনও লৌহ যবনিকার অন্তরালে মুখ ঢেকে বসে আছে, সেখানে আমরা কী করব, তা জানতে প্রেস উদগ্রীব। এ ব্যাপারে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই।

কিছুক্ষণ কেটে গেছে। অ্যাম্বাসাডর ভিনার বললেন- চলুন, আজ সারাদিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটবে।

ইতালিয়ান সিক্রেট পুলিশের প্রধান ক্যাপটেন সিজার বারজিনি। তিনি জানতেন, ম্যারি কোথায় থাকবেন।

ইন্সপেক্টর দুজন লোক লাগিয়ে দিলেন। অ্যাসলের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে হবে। রিপোর্ট দিতে হবে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।

বোঝা গেল, সব কিছুই আগে থেকে ঠিক করা ছিল। দুই গোয়েন্দা রিপোর্ট দিতে থাকলেন– ম্যারিকে ট্রেভি ঝরনার পাশে দেখা গেছে। দেখা গেছে মিউজিয়ামের পাশে। ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ম্যারি তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।

পিজান নভোনাতে তারা দুপুরের খাবার খেয়েছেন।

ক্যাপটেন বারজিনি আনন্দের সঙ্গে মন্তব্য করলেন বাঃ, ছবির মতো পরিষ্কার।

.

অ্যাম্বাসাডর ভিনার ম্যারিকে নিয়ে এয়ারপোর্টে এলেন।

এবার রোমানিয়া, ম্যারির শেষ গন্তব্য।

.

ক্যাপটেন বারজিনি এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আসলে বিমানে উঠে গেলেন। বিমান এবার বুখারেস্টের দিকে উড়তে শুরু করছে। ফিরে এলেন টেলিফোন বুথের মধ্যে, বললেন- বালডারের জন্য একটা খবর আছে। সব কাজ ঠিক মতো হয়েছে। প্রেসের ভদ্রলোকদের আর কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব।

.

ম্যারি অ্যাসলের মনে হল, সত্যিই তো, এত বেশি সংবর্ধনা? এত উন্মাদনা কেন?

এবার রোমানিয়া, বেথ অবাক চোখে তাকিয়েছিল। বলল- মম্ দেখো, আমরা এখানে এসে গেছি।

ম্যারির মনে উত্তেজনা জেগেছে। প্লেনটা ধীরে ধীরে বুখারেস্ট শহরের ওপর নামছে।

অবশেষে আমার স্বপ্ন সফল হয়েছে। আমার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহান গণতন্ত্রের দায়িত্বভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।