প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

৩৩. প্রজনন ও জননাঙ্গ : লতাসাধনা ও তান্ত্রিক যন্ত্র

প্রজনন ও জননাঙ্গ : লতাসাধনা ও তান্ত্রিক যন্ত্র

ওই আদিম মাতৃপ্রধান বা শক্তিপ্রধান সংস্কৃতির সমস্ত দিক নিয়ে আলোচনার অবকাশ স্বভাবতই এখানে পাওয়া যাবে না। তার বদলে আমরা আদিমাতৃকা সংক্রান্ত বিশ্বাসের বিশেষ করে সেই দিকগুলিরই আলোচনা তুলবো, যেগুলি আমাদের তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার উপর আলোকপাত করতে পারে।

Venus of Willendorf

তন্ত্র-সাধনায় এক রকম চিত্রের ব্যবহার আছে। সেগুলিকে যন্ত্র বলে। যন্ত্রগুলি স্ত্রী-জননাঙ্গের প্রতীক। আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-বিশ্বাস থেকেই এই যন্ত্রগুলির উদ্ভব হয়েছে : ক্রমোন্নতির কোনো এক পর্যায়ে মানুষ এই নারী-জননাঙ্গকেই প্রজননের মূল কারণ বলে কল্পনা করেছে আর তাই তারই সাহায্যে প্রকৃতির উর্বরা-শক্তির বৃদ্ধি ও বিকাশকে আয়ত্তে আনতে চেয়েছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে প্রজনন রহস্য উদ্ঘাটন-প্রচেষ্টারও একটা ইতিহাস আছে : নারী জননাঙ্গকেই প্রজননের অন্যতম কারণ বলে কল্পনা করবার আগে মানুষ অন্যভাবে প্রজনন-রহস্য বোঝবার চেষ্টা করেছে এবং সেই বোধের উপর নির্ভর করেই সে-পর্যায়ের মানুষ প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতাকে আয়ত্তে আনবার চেষ্টা করেছে।

তান্ত্রিক যন্ত্রগুলি নিয়ে আলোচনা তোলবার আগে ওই প্রাকৃত বিশ্বাসটির ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত সামান্য আলোচনার অবতারণা করবো।

আমাদের আলোচনা এখানে কিছুটা বিক্ষিপ্ত হতে পারে। তাই আমাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকে শুরু করাই বাঞ্ছনীয় হবে।

প্রথমত, আমরা দেখবার চেষ্টা করবো যে আদিম মানুষ ক্রমশই নারী জননাঙ্গকেই প্রজনন-শক্তির আধার বলে চেনবার চেষ্টা করেছে।

দ্বিতীয়ত, প্রকৃতির ফলপ্রসূতাকে আয়ত্তে আনবার আশায় আদিম মানুষ স্বভাবতই ওই জননাঙ্গকেই অসামান্য গুরুত্ব দিয়েছে।

তৃতীয়ত, এই পর্যায়ের আদিম বিশ্বাসটির দিক থেকেই তন্ত্রের লতাসাধনা, ভগযাগ ও যন্ত্রগুলিকে বোঝবার সুযোগ আছে।

অতএব, পৃথিবীর নানান জায়গায় আজো যে-সব মানবদল পিছিয়ে-পড়া অবস্থায় আটকে রয়েছে তাদের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানকে বিশ্লেষণ করলে তন্ত্রের এই আপাতঃ-দুর্বোধ্য দিকগুলির উপর আলোকপাত হতে পারে।

 

প্রত্নতাত্ত্বিকের যে-আদিমতম মাতৃমূর্তিটি আবিষ্কার করতে পেরেছেন তার নাম দেওয়া হয় ‘ভিলেন্‌ডর্ফের ভেনাস’ বা ‘Venus of Willendorf’৷ এই মূর্তিটি প্রত্ন-প্রস্তর যুগে রচিত হয়েছিলো। আবিষ্কৃত হবার সময় দেখা যায়, মূর্তিটির গায়ে লাল গিরিমাটি মাখানো। অতএব, অনুমিত হয়, মূর্তিটি আধুনিক অর্থে শিল্প-নিদর্শন হতে পারে না। এর সঙ্গে জাদুবিশ্বাসগত অনুষ্ঠানাদির সম্পর্ক নিশ্চয়ই ছিলো।

মূর্তিটি গড়বার সময় শিল্পীর চেষ্টা ছিলো, নারীদেহের অন্যান্য অবয়বের অনুপাতে স্তনদ্বয়কেই প্রধানতম করে দেখানে : এর চোখমুখ প্রভৃতি স্পষ্টভাবে গড়বার কোনো উৎসাহই চোখে পড়ে না।

আদিম শিল্পীর এ-রকম প্রচেষ্টা কেন? উত্তরে প্রজনন-সংক্রান্ত আদিম ধারণার ক্রমবিকাশের আলোচনা তোলা দরকার।

আদিম মানুষের পক্ষে প্রজননের প্রকৃত রহস্য অনুমান করা সম্ভব নয়। তারা মৈথুনের সঙ্গে প্রজননের সম্পর্ক দেখতে শেখেনি। আধুনিক পণ্ডিতেরা(৫১৫) আদিম মানুষের এই অজ্ঞতার নানা রকম স্বাভাবিক কারণ অনুমান করে থাকেন। মৈথুনের অনুপাতে গর্ভসঞ্চারের দৃষ্টান্ত অবশ্যই দুর্লভ; তাই প্রাচীন মানুষদের পক্ষে মৈথুনকেই গর্ভসঞ্চারের কারণ মনে করা স্বাভাবিক নয়। ফলে, গর্ভসঞ্চার সংক্রান্ত নানারকম অবাস্তব ধারণা প্রশ্রয় পাওয়াই স্বাভাবিক। বস্তুত, পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের মধ্যে এ-জাতীয় নানা ধারণা দেখতে পাওয়া যায় এবং রূপকথা ও লোককথায় তার স্মারক খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।

এ-জাতীয় ধারণার মধ্যে অত্যন্ত প্রাকৃত পর্যায়ের একটি ধারণা(৫১৬) হলো, সন্তানের প্রথম আবির্ভাব হয় নারীর বক্ষদেশে; তারপর বক্ষস্থল থেকে সন্তান পেটের দিকে নেমে আসে। পেটের মধ্যে জরায়ু প্রভৃতি অঙ্গের কথা এই পর্যায়ের চিন্তাধারায় উদিত হয়নি। এই পর্যায়ের ধারণায় তাই স্তনদ্বয়ই প্রধানতম জননাঙ্গ। আধুনিক বিদ্বানের এ-জাতীয় ধারণার ব্যাখ্যা হিসেবে অনুমান করছেন, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থার প্রথম লক্ষণ স্তনদ্বয়েই দেখা যায়।

another mother figure

ব্রিটিশ নিউগিনির সিনাউগোলোদের(৫১৭)মধ্যে আজো এই আদিম ধারণাটি টিকে থাকতে দেখা যায়। এবং এই ধারণাটির দিক থেকে শুধুই যে ওই ভিলেনডর্ফের ভেনাস-মূর্তিটির ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তাই নয়; এ্যাস্টেক্‌স্‌রা(৫১৮) বসুমাতার মূর্তি কল্পনা করে বহু স্তনবর্তী নারী হিসেবেই। গ্রীক দেবলোকের আর্টেমিসও আদিতে বসুমাতা-মাত্রই ছিলেন এবং এফিসস্-এ(৫১৯)। তাঁকেও বহু স্তনবতী বলেই কল্পনা করা হতো। প্রাচীনচেতনার কলা-কৌশল হিসেবে কোনো একটি অঙ্গকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হলে হয় অঙ্গটিকে অস্বাভাবিকভাবে বড়ো করে চিন্তা করা হবে আর না হয় তো তার সংখ্যাবৃদ্ধি করা হবে। এখানে প্রত্ন-প্রস্তর যুগের আর একটি মাতৃমূর্তির(৫২০) ছবি উদ্ধৃত করা হলো; এই মূর্তিটির স্তনদ্বয়কেও অস্বাভাবিকভাবে বড়ে করে রচনা করা হয়েছে। কিন্তু সেইসঙ্গেই শিল্পী যেন নারী-জননাঙ্গ সম্বন্ধে-অন্তত গর্ভ সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছেন।

প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষের দিক থেকেই দেখতে পাওয়া যায়, জননাঙ্গ হিসেবেই মানুষ ক্রমশ নারীর যোনিকে চেনবার চেষ্টা করেছে। এখানে প্রত্ন-প্রস্তর যুগেরই আর একটি মাতৃমূর্তির ছবি উদ্ধৃত করা গেলো। এই মূর্তিটিতে অবশ্যই স্তনদ্বয়কে বাড়িয়ে বড়ো করে রচনা করবার চেষ্টা চোখে পড়ে; কিন্তু তাছাড়াও— বিশেষত মূর্তিটির বা হাতের নির্দেশ অনুসরণ করলে স্পষ্টই দেখা যায়,— শিল্পী যোনিকেও গুরুত্ব দেবার চেষ্টা করেছেন।

another mother figure 2

এর পর আমরা আরো তিনটি আদিম মাতৃকামূর্তির প্রতি মনোযোগ দেবার চেষ্টা করবো। তিনটিই অত্যন্ত প্রাচীন যুগের মূর্তি এবং শাক্ত মতবাদ যে প্রাচীন পৃথিবীর কতোখানি বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছিলো তার নিদর্শন হিসেবেও এই তিনটি মূর্তির সাক্ষ্য মূল্যবান। অবশ্যই ওই সাদৃশ্য থেকে কেউ যদি সিদ্ধান্ত করতে চান যে প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীতে ওই সুবিস্তীর্ণ এলাকা-জুড়ে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান প্রচলিত ছিলো, তাহলে আমাদের যুক্তির দিক থেকে সে-সিদ্ধান্ত খুব বেশি মূল্যবান হবে না। কেননা, আমরা দেখবার চেষ্টা করছি, এ-জাতীয় মূর্তি-রচনার পিছনে প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিযয় হলো বাস্তব প্রয়োজন বোধ। সেই প্রয়োজন বোধের সাদৃশ্যর দরুনই মূর্তিগুলির মধ্যেও অমন নিকট সাদৃশ্য। বস্তুত, ভারতবর্ষের মাটি খুঁড়ে পাওয়া আদিম মাতৃমূর্তির সঙ্গে অন্যান্য দেশের মাতৃমূর্তির কতোখানি মিল আছে তাই দেখাবার জন্যেই জনৈক আধুনিক গবেষক(৫২২) এই তিনটি আদিম মাতৃমূর্তিকে পরস্পরের সঙ্গে তুলনা করতে বলেছেন। প্রত্নতত্বমূলক খননের ফলে ভারতবর্ষের সীমান্ত থেকে চিত্রে-প্রদর্শিত সর্ব-উপরের বাঁদিকের মূর্তিটি খুঁজে পাওয়া যাবার পর মেজর গর্ডন দাবি করেন পৃথিবীর অন্যান্য কোথাওই ঠিক এ-রকম মূর্তির পরিচয় পাওয়া যায় নি। অর্থাৎ কিনা, ও-জাতীয় মূর্তি অনুপম। তারই উত্তরে সিমোন কর্বিয়ান দেখাতে চেয়েছিলেন, অনুপম তো দূরের কথা, মেসোপটেমিয়ায় খুঁজে-পাওয়া, ৩০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দের মূর্তির সঙ্গে এর সাদৃশ্য অত্যন্ত বিস্ময়কর। চিত্রে মেসোপটেমিয়ার মূর্তিটিকে ভারতবর্ষে পাওয়া মূর্তিটির ঠিক নিচে আঁকা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রাগৈতিহাসিক ইউক্রেনের মূর্তিটির সঙ্গেও এগুলির নিকট সাদৃশ্য রয়েছে।sari dhari প্রথম মূর্তিটিকে ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে (Sari Dhari–North West Frontier Province of India) প্রত্নতত্ত্বমূলক খননের ফলে উদ্ধার করা হয়েছে, দ্বিতীয়টি প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার  (Tell Ahmar) এবং তৃতীয়টি প্রাচীন ইউক্রেন-এর (Tripolje)। এই মাতৃমূর্তিগুলির রচনায় যোনি বা নারীজননাঙ্গের উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপণ করবার চেষ্টাটা খুবই স্পষ্ট। এই যোনি ক্রমশই জ্যামিতিক ত্রিকোণের আকার ধারণ করছে। এখানে বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের মাতৃমূর্তিটির দিকে নজর রাখা প্রয়োজন। কেননা, তন্ত্রে যন্ত্র হিসেবে প্রচলিত চিত্রগুলির সঙ্গে এই মূর্তির নিম্ন-ভাগের সাদৃশ্যর আভাস পাওয়া যায়। তন্ত্রে যেগুলিকে যন্ত্র বলা হয় সেগুলি আর কিছুই নয়, ওই নারী-জননাঙ্গের প্রতীকচিত্রমাত্র। তান্ত্রিক যন্ত্রের আলোচনায় আমরা একটু পরেই প্রত্যাবর্তন করবো। তার আগে দেখা দরকার, আদিম মাতৃপ্রধান বা শক্তিপ্রধান চিন্তাধারা ক্রমশই কী ভাবে নারী-জননাঙ্গ-কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

tantrik jantra 1

প্রাচীন মাতৃমূর্তির পরিকল্পনায় যদি জননাঙ্গকেই ক্রমশ নারীদেহের প্রধানতম অবয়ব বলে গ্রহণ করবার চেষ্টা দেখা যায় তাহলে স্বভাবতই কৃষিভিত্তিক প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে নারীদেহের অন্যান্য অবয়ব বাদ দিয়ে শুধুমাত্র যোনি বা নারী-জননাঙ্গের মূর্তি খুঁজে পাওয়া বিস্ময়ের ব্যাপার হবে না। হরপ্পা-মোহেনজোদারোর(৫২৩) ও ধ্বংসস্তৃপ থেকে খুঁজে পাওয়া এই জাতীয় একটি মৃন্ময় মূর্তির ছবি এখানে উদ্ধৃত করা গেলো।

mohenjo daro vagina statue

মোহেনজোদারোর মানুষেরা এ-জাতীয় যোনি-মূর্তি রচনা করেছিলো কেন? এর পিছনে নিশ্চয়ই প্রজননের কামনা ছিলো। কিন্তু শুধুমাত্র প্রজননের কামনাই নয়। তার সঙ্গে জড়িত ছিলো ধনোৎপাদনের কামনাও— কৃষিকাজের সাফল্য-কামনাও। কেননা এই যোনি-মূর্তি মানব-বিশ্বাসের এমন এক স্তরের সাক্ষ্য বহন করছে, যেখানে শুধুমাত্র সন্তান-উৎপাদনই নয়—প্রাকৃতিক উৎপাদনও—নারী জননাঙ্গের উপর নির্ভরশীল।

এই বিশ্বাসের এক অত্যাশ্চর্য মূর্ত প্রমাণ হরপ্পার ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। আমরা ইতিপূর্বে ৩৫৭ পৃষ্ঠায় হরপ্পার সেই সিলটির ছবি উদ্ধত করেছি।

কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই বিশ্বাসটির স্মারক সিন্ধুসভ্যতার মধ্যেই পরিসমাপ্ত নয়।

স্যর্‌ জন মার্সাল(৫২৪) বলছেন :

Although unique, so far as I am aware, in India, this striking representation of the Earth Goddess with a plant growing from her womb is not unnatural, and is closely paralleled by a terra cotta relief of the early Gupta age, from Bhita in the United Provinces, on which the Goddess is shown with her legs in much the same posture, but with a lotus issuing from her neck instead of from her womb.
আমি যতোদূর জানি, গর্ভসঞ্জাত লতাগুল্মসহ এ-জাতীয় বসুমাতা-মূর্তি যদিও ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে অনুপম, তবুও একে অস্বাভাবিক মনে করবার কোনো কারণ নেই। যুক্তপ্রদেশের ভিটা থেকে পাওয়া গুপ্তযুগের শুরুর দিকের একটি পোড়ামাটির ভাস্কৰ্য-নিদর্শনের সঙ্গে এর নিকট সাদৃশ্য রয়েছে : সেই নিদর্শনে দেখা যায় দেবীর পায়ের ভঙ্গি হরপ্পার ওই সিলটির বসুমাতা-মূর্তির মতোই, কেবল তার গর্ভ থেকে লতা বের না হয়ে ঘাড় থেকে পদ্মফুল বের হয়েছে।

earth goddess womb

দেবীর নাম ভগবতী। এই নামকরণ থেকেই অনুমান করা যায়, দেবীর সমস্ত অঙ্গের মধ্যে জননাঙ্গটিকেই প্রধানতম বলে বিবেচনা করা হয়েছে। কেন করা হয়েছে। তার কারণ, এর মূলেও প্রাচীন বিশ্বাসের সেই পর্যায়টিরই স্বাক্ষর খুঁজে পাওয়া যায় : নারী-জননাঙ্গ শুধুমাত্র সন্তান-এর উৎস নয়, পার্থিব ঐশ্বর্যের উৎসও :

অণিমাদি অষ্টবিধ ঐশ্বৰ্ষ, সমগ্র বীর্য, সমগ্ৰ যশ, সমগ্র ঐ, সমগ্র জ্ঞান এবং সমগ্র বৈরাগ্য—এই ষড়ৈশ্বর্ষের নাম ভগ।
ঐশ্বৰ্য্যস্য সমগ্ৰস্য বীৰ্য্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ।
জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব যণ্ণাং ভগ ইতীরিত: ॥ ২৬

কোন আদিম বিশ্বাসের প্রভাবে নারী-জননাঙ্গবাচক শব্দটিই ষড়ৈশ্বর্যবাচক শব্দে পরিণত হয়েছে,—সে-বিষয়ে নিশ্চয়ই ভেবে দেখবার প্রয়োজন আছে।

আপত্তি উঠতে পারে, ভগ বলতে আদিতে জনৈক বৈদিক দেবতাকেই(৫২৭) বোঝাতো। ঐশ্বর্য বিতরণই ছিলো সে-দেবতার বৈশিষ্ট্য। তাই, এ-শব্দের যড়ৈশ্বৰ্য-বাচকত্বের উৎপত্তি সেই দেবতার নাম থেকে হওয়াও অসম্ভব নয়।

উত্তরে বলা যায়, এ-কথা সত্যি হলেও এই প্রসঙ্গেই ওই আদিম বিশ্বাসটির কথা অপ্রধান হবে না। কেবল, সমস্যাটাকে একটুখানি অন্যদিক থেকে ভেবে দেখতে হবে : আদিতে যে-নাম ছিলো ঐশ্বর্যবাচক বা ঐশ্বর্যবিতরণ-মূলক, সেই নামই নারী-জননাঙ্গবাচক হয়ে দাঁড়ালো কী করে? এ-প্রশ্নের একটিমাত্র উত্তরই পাওয়া সম্ভবপর : নারী-জননাঙ্গকেই পার্থিব ঐশ্বর্ষের উৎস বলে বিশ্বাস করা হয়েছিলো, তাই।

এই আদিম বিশ্বাসটির দিক থেকে তান্ত্রিক ধ্যানধারণাগুলিকে কতোখানি বুঝতে পারা সম্ভব তাই দেখা যাক।

প্রথমত, তন্ত্রমতে নারী-জননাঙ্গের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। ‘স্ত্রীভগং পূজনাধারঃ'(৫২৮) বা এইজাতীয় কথা তন্ত্রে বহুবার পাওয়া যায়। বস্তুত, তন্ত্রের একটি প্রসিদ্ধ সাধনার নামই হলো ভগযাগ :

তথাপি প্রত্যয়ো নো চেৎ ভগযাগমখাচরেং।
কামিনীং যুবতীং যত্বাং পুষ্পিতাঞ্চ বিশেষতঃ ॥
তামানীয় প্রযত্বেন স্বঞ্চ ভূষপমাচরেং।
তামূর্ত্তেং স্বয়ং গন্ধৈররভূষণৈর্ব্বসনৈস্তথা ॥
মিষ্টান্নৈর্তোজয়িত্ব চ ভক্ত্যা পরময়া শিবে।
তাং বিবস্ত্রাং বিধায়ৈব স্থাপয়েদুর্দ্ধতল্লপে ॥
তত: পুজাং বিধায়ৈৰ নানাসভারসংযুতৈঃ।
তত্রৈব রময়েৎ যন্ত্রং রক্তচন্দনযাবকৈঃ ॥
ভগনামাং ভগপ্রাণাং ভগদেহাং ভগস্তনীং।
পুজয়েদষ্টপত্রেষু মধ্যে দেবীং প্রপুজয়েৎ ॥
রক্তগন্ধৈঃ রক্তমালৈা: রক্তবস্ত্রৈর্মনোরমৈঃ।
পুজয়েম্ভক্তিতে মন্ত্রী দেবীদর্শনকাম্যয় ॥
এতস্মিন সময়ে দেবী রতিমিচ্ছতি সা যদা।
লতান্ত রময়েদেবী যাবস্কোমং করোতি ন ॥
পুস্পিনী মকরলেন ততো হোমং সমাচরেং।
ওঁ নমস্তে ভগমালায়ৈ ভগন্ধপধরে শুভে ॥
ভগন্ধপে মহাভাগে ভোগমোক্ষৈকদায়িনী।
ভগবত্যাঃ প্রসাদেন মম সিদ্ধির্ভবিষ্যতি ॥
ইত্যাদি, ইত্যাদি।
(তর্জমা : বিশ্বকোষ, ৭ম খণ্ড, ৫২৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।

বলাই বাহুল্য, ওই আদিম বিশ্বাসটির উপরে এখানে পূজা, মোক্ষ ইত্যাদি নানাবিধ আধুনিক শব্দের পলি পড়েছে। তবু, তাকে অনুসন্ধান করবার জন্যে অন্তত একটি সূত্র উপরের উদ্ধৃতির মধ্যেই খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। সূত্রটি হলো, ‘লতা’ শব্দের ব্যবহার। কেননা, তন্ত্র-সাহিত্যে ‘লতা’ শব্দের একটি পারিভাষিক অর্থ আছে। সে-অর্থ হলো, নারী-জননাঙ্গ। এখানে কয়েকটি নমুনা উদ্ধৃত করা যায় :

ততঃ পরলতাসক্তঃ পুনঃকাৰ্য্যং তথৈব চ॥(৫২৯)
কিংবা,
নগ্নাং পরলতাং পশ্যন্‌ জপেৎ মন্ত্রমনন্যধীঃ॥(৫৩০)
কিংবা,
মহাপূজাং প্রকুর্ব্বীত লতামণ্ডলমধ্যগঃ॥(৫৩১)
কিংবা,
লতাভির্কেটিতে ভূত্বা জপেয়ন্ত্ৰমনন্তধীঃ॥৩২
কিংবা,
রাত্রে তাম্বলপুরান্তে লতামগুলমধ্যগঃ॥(৫৩৩)

ইত্যাদি, ইত্যাদি।

তন্ত্র-বিষয়ে যাঁরা অভিজ্ঞ তারা এই ‘লতা’ শব্দের তাৎপর্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবেন না। কিন্তু কোন্‌ বিশ্বাসের প্রভাবে উদ্ভিদ-বোধক এই শব্দটিই নারী-জননাঙ্গ-বোধক শব্দে পরিণত হয়েছে তার আলোচনা সাধারণত তোলা হয় না। অথচ, সে-আলোচনা বাদ দিয়ে তন্ত্রের আদি-তাৎপর্য কী করে নির্ণয় করা সম্ভব?

এই প্রসঙ্গেই তন্ত্রের একটি চিত্তাকর্ষক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা যায়। তন্ত্রকাররা প্রশ্ন তুলেছেন, কী কী লক্ষণ থাকলে তন্ত্র বলা হবে? এবং উত্তরে বলছেন, সেই লক্ষণগুলির মধ্যে একটি হলো তরু-উৎপত্তি বিষয়ের বর্ণনা : “উৎপত্তির্বিবুধানাঞ্চ তরূণাং কল্পসংজ্ঞিতম্” (৫৩৪)।

তন্ত্রে শুধুও যে ওই পারিভাষিক অর্থে লতা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তাই নয়। লতা-সাধনা বলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাধনারও নির্দেশ রয়েছে। এ-সাধনাও অতি গোপন,—উপরোক্ত সাধনার মতোই গুহ্যৎ গুহ্যতরং। এবং অতি কঠিন এই সাধনা :

বরং ফণী ধরিয়া বিষভক্ষণ করা সহজ, বরং সিংহশার্দুলের সহিত যুদ্ধ করা সহজ, কিন্তু লতা-সাধনা অতি কঠিন, অতি কঠোর।(৫৩৫)

এ-হেন গুহ্য ও কঠিন লতা-সাধনার মূল কথাটা কী? হুবহু উপরোদ্ধৃত ভগযাগের মতোই :

এই সাধনার প্রধান অধিকরণ স্ত্রী, এইজন্য ইহাকে লতাসাধনা কহে। এই সাধনার বিষয় তন্ত্রে বর্ণিত হইয়াছে..
লতায়াঃ সাধনং বক্ষ্যে শৃণুম্ব হরবল্লতে।
শতং কেশে শতং ভালে শতং সিন্দুরমগুলে।
স্তনদ্বয়ে শতদ্বন্দ্বং শতং নাভৌ মহেশ্বরি।
শতং যোনী মহেশানি উত্থায় চ শতত্ৰয়ম্ ॥
এবং দশশতং জপ্ত্বা সৰ্ব্বসিদ্ধিশয়ো ভবেৎ।
অথান্যৎ সংপ্রবক্ষ্যামি সাধনং ভূবি দুর্লভম্।
রজোহবস্থাং সমানীয় তদ্‌ যোনৌ স্বেষ্টদেবতাম্।
পূজয়িত্বা মহারাত্রৌ ত্রিনিদং পূজয়েন্মনুম্‌।
ইত্যাদি, ইত্যাদি।
।।ভাবাৰ্থ; বিশ্বকোষ, ১৭ খণ্ড, ১৮৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।।

বলাই বাহুল্য, আমাদের আধুনিক রুচি ও নীতিবোধের কাছে এই জাতীয় চিন্তাধারা বীভৎস কামবিকারের পরিচায়কমাত্র এবং আমাদের আধুনিক জ্ঞানের দিক থেকে এই জাতীয় ব্যবস্থাকে কোনো প্রকার সাধনপদ্ধতি মনে করবার মতো উৎকট ও অসম্ভব ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। এবং এ-বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের আধুনিক রুচিবোধ, নীতিবোধ এবং ধ্যানধারণাগুলি অমূলক নয়। তাই বীভৎস কামবিকার বা উৎকট ও অসম্ভব ধারণার তাগিদ ছাড়া আজকের দিনে তন্ত্রসাধন-পদ্ধতিতে প্রেরণা পাবার কথা অচিন্তানীয়। একথা ভুলে গিয়ে আজকের দিনে যদি কোনো দেশবাসী জনৈক বিদেশী বিচারকের তন্ত্রবিচারে মুগ্ধ হয়ে এই লতাসাধনাদির মধ্যেই অতীব উচ্চাঙ্গের আধ্যাত্মিক ধারণা আবিষ্কার করেন তাহলে তার উদ্ভাবনশক্তি দেখে স্তম্ভিত হলেও আমরা মানতে বাধ্য হবে যে, দেশের মানুষকে তিনি এক অন্ধ বিকৃতির মধ্যেই আবদ্ধ রাখতে চাইছেন। কিন্তু শুধু এইটুকু বললেই তান্ত্রিক সাধনাদি সম্বন্ধে সব কথা বলা হয় না। কেননা, এ-বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারতীয় সংস্কৃতির, বিশেষ করে বাংলা দেশের সংস্কৃতির চোদ্দ আনার উপরই হলো তান্ত্রিক।

বাস্তবিক এখন ভারতের সর্বত্রই, বিশেষত এই বাংলাদেশে যে-সকল ক্রিয়াকাণ্ড ও পূজাপদ্ধতি প্রচলিত, তাহা সমস্তই তান্ত্রিক।(৫৩৬)

এ-কথাকে অতিশয়োক্তি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই প্রশ্ন ওঠে; নিছক কামবিকার, বা অন্তঃসারশূন্য আজগুবি ধারণামাত্র, একটি জাতির সাংস্কৃতিক জীবনকে কী করে এমন গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করতে পারলো? এ-প্রশ্নের মাত্র দুটি উত্তর সম্ভবপর। এক, পুরো জাতটাই হলো কামবিকারগ্রস্থ। দুই, আধুনিক যুগের পটভূমিতে এই সব তান্ত্রিক ধ্যানধারণা বা সাধন-পদ্ধতির পরিণাম যাই হোক না কেন, এগুলির আদি-তাৎপর্য নিশ্চয়ই অন্য রকম ছিলো। অর্থাৎ, সমাজ-বিকাশের কোনো এক পর্যায়ে এই জাতীয় ধ্যানধারণা এবং সাধন-পদ্ধতিই বাস্তব অর্থে উদ্দেশ্যমূলক ছিলো, জীবনের কোনো এক বাস্তব তাগিদ মেটাতে চেয়েছিলো। আমরা এই দুটি সম্ভাবনার মধ্যে প্রথমটিকে অমূলক বলে প্রত্যাহার করতে চাই : পুরো জাতটাকে কামবিকারগ্রস্ত বলে কল্পনা করবার কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ আমরা দেখতে চাই : আধুনিক যুগের পটভূমিতে ওই তান্ত্রিক সাধনাদি যতো বীভৎস বিকৃতি বলে প্রতীয়মান হোক না কেন, সমাজবিকাশের যে-পর্যায়ে এগুলির উদ্ভব হয়েছিলো একমাত্র তারই পটভূমিতে এগুলির আদি-তাৎপর্য অনুসন্ধান করা যাবে। এবং আমাদের দেশের উৎপাদন-কৌশলের উন্নতি ব্যাঘাতগ্রস্ত ও বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেকেছে বলেই সমাজবিকাশের সে-পর্যায়ের ধ্যানধারণা এবং আচার-অনুষ্ঠানের স্মারক এমন জোরালোভাবে আমাদের সংস্কৃতিকে আধুনিক কাল পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছে। শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় –

সে-সব খাঁটি বাংলার জিনিস যদি খুঁজিয়া বাহির করিতে চাও, তবে বাঙালীর বৈষ্ণব ধর্ম, সহজিয়া ধর্ম এবং বাংলার তন্ত্র এবং তান্ত্রিক ধর্ম বুঝিবার এবং জানিবার চেষ্টা কর।…বাঙালার বাঙালীকে ঠিকমতো বুঝিতে হইলে, এই দেশের বৈষ্ণব ধর্ম এবং তন্ত্রের ধর্ম বুঝিতে হইবে।

কিংবা(৫৩৮),

এই সকল তন্ত্র-পুস্তকের মধ্যে বাঙালার দুই হাজার বছরের ইতিহাস লুকানো আছে, যুগে যুগে জাতির পদ্ধতি, রীতি নীতির কথা প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। এই তন্ত্ৰ-সাগর মন্থন করিতে পারিলে বাঙালার বহু লুপ্ত রত্নের উদ্ধার হইতে পারে, বাঙালা ইতিহাসে বহু তমসাবৃত কোটরে আলোকমালা ফুটিয়া উঠিতে পারে।

কিংবা(৫৩৯),

ব্রাহ্মণ্য-প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় বাঙালায় বহু জালজুয়াচুরি চলিয়াছিল, ঘটক ঠাকুরেরা অনেক সত্যের গোপন করিয়াছেন, স্মার্ত নাটোর ও নদীয়ার ব্রাহ্মণ রাজাদের প্রভাবে ও চেষ্টায় আরো অনেক গোলমাল গোলযোগ স্মৃতিশাস্ত্রের রূপার তবকে ঢাকা পড়িয়াছে। এই সকল আবরণ খুলিয়া সত্যের অনুসন্ধান করিতে হইলে তন্ত্রের আলোচনা করিতে হইবে। বাংলার গত দুই হাজার বৎসরের প্রকৃত ইতিহাস প্রচার প্রয়োজন, তীব্রবৃদ্ধি ঐতিহাসিকগণের সাহায্যে উহাদের আলোচনার প্রয়োজন এবং নিৰ্ভয়ে সত্য কথা বলিবার বুকের পাটারও প্রয়োজন; এই তিন প্রয়োজন সিদ্ধি না হইলে বাঙালী জাতির অতীত ইতিহাস ঠিকমতো প্রকাশিত হইবে না, বাঙালার পুরাতন গৌরবের মহিমা আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিব না।

আমাদের যুক্তিও নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু সেই সঙ্গেই আমরা এ-কথাও বলতে চাই যে, ওই প্রাচীন ধ্যানধারণাগুলির উপর আধুনিক যুগের ধ্যানধারণা আরোপ করে এগুলির মহত্ত্ব বাড়াবার চেষ্টা করলেও আমরা খাঁটি বাংলার জিনিসকে খুঁজে পাবো না, তার বদলে বরং আত্মপ্রবঞ্চনাই করবো। এই জাতীয় আত্মপ্রবঞ্চনার নমুনা শ্ৰীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাতেও বিরল নয়। যেমন, তিনি(৫৪০) বলছেন, “আবার তন্ত্রকে জাগাইয়া তুলিতে না পারিলে জাতি হিসাবে আমরা উন্নত হইতে পারিব না। ইহাই আমার বিশ্বাস।” আমাদের বক্তব্য ঠিক এর উল্টো। তন্ত্রকে জাগিয়ে তোলবার চেষ্টার বদলে আমাদের পক্ষে এইটুকু স্পষ্টভাবে বোঝা দরকার যে, আমাদের দেশের ওই তন্ত্রসাধনায় স্ত্রী-জননাঙ্গ প্রভৃতির উপর যে-গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো তার মূলে ছিলো অত্যন্ত আদিম পর্যায়ের এক বিশ্বাস : স্ত্রী-জননাঙ্গ শুধুই সন্তানদায়িনী নয়, শস্যাদি ঐশ্বর্যদায়িনীও। অতএব, এই বিশ্বাসটির স্বরূপ উপলব্ধি করার জন্য পিছু হটে পৃথিবীর প্রাচীন সংস্কৃতি এবং আধুনিক যুগেও যে-সব মানবদল পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ে আটকে থেকেছে তাদের আচারঅনুষ্ঠান, সম্যকভাবে বিচার করা দরকার। সে-বিচারের সাহায্যে আমর আমাদের সংস্কৃতির এই অঙ্গটিকে চিনতে পারবে এবং চিনতে পারবে৷ বলেই তা থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করতে পারবো(৫৪১)।

আমরা একটু পরেই পৃথিবীর প্রাচীন সংস্কৃতির নানা দৃষ্টান্ত এবং পিছিয়ে-পড়া মানুষদের নানান আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা তুলবো। তার আগে দেখা যাক, তান্ত্রিকেরা নারী-জননাঙ্গের উপর যে এতোখানি গুরুত্ব আরোপ করছেন তার মূলে এই বিশ্বাসটিই বর্তমান আছে যে, নারী-জননাঙ্গের স্পর্শেই প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য বর্ধিত হবে।

 

তন্ত্রে একজাতীয় চিত্রের ব্যবহার আছে। সেগুলিকে যন্ত্র বলে।

যন্ত্ৰ সাধারণত দুই প্রকার—পূজাযন্ত্র ও ধারণ-যন্ত্র। পুজাযন্ত্রে যে দেবতার পূজা করিতে হইবে, সেই দেবতার যন্ত্র অঙ্কিত করিয়া তাহাতে পুজা করিতে হয়। ঐরূপ যন্ত্রকে পূজাযন্ত্র বলা হয়।
যে যন্ত্র অঙ্কিত করিয়া ধারণ করা হয় তাহার নাম ধারণ-যন্ত্র। এই ধারণ-যন্ত্র ভূৰ্জপত্রে অঙ্কিত করিয়া ধারণ করিতে হয়।(৫৪২)

যন্ত্র নামের এই চিত্রগুলির তাৎপর্য কী?

তন্ত্রে লিখিত আছে,–দেবতার অধিষ্ঠান হইয়া থাকে, এই জন্য যন্ত্র অঙ্কিত করিয়া দেবতার পুজা করিতে হয়।(৫৪৩)

আমরা সাধারণত এই জাতীয় একটা ব্যাখ্যাই সহজে গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যন্ত্রগুলি যে পূজা, দেবতা ইত্যাদি আধ্যাত্মিক বিষয়ের চেয়ে প্রাচীনতর,—অর্থাৎ, পূজা ও দেবতাদির বিষয় পরে কৃত্রিমভাবে যন্ত্রগুলির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে,—যন্ত্রগুলিকে ভালো করে পরীক্ষা করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথমত, মোটের উপর একই চিত্রের সরে বিভিন্ন দেবদেবীর সম্পর্ক যা ঐক্য পরিকল্পিত হয়েছে(৫৪৪)। তার থেকেই বোঝা যায়, উক্ত সম্পর্কাদির চেয়েও যন্ত্রগুলি প্রাচীনতর। দ্বিতীয়ত, বহু যন্ত্রের সঙ্গেই যন্ত্রসংযুক্ত দেবতাটির স্পষ্ট বিরোধ দেখা যায়। আধুনিক তান্ত্রিক গ্রন্থাদিতে কয়েকটি প্রসিদ্ধ যন্ত্রের নাম হলো, গণেশযন্ত্র, শ্রীরামযন্ত্র, নৃসিংহযন্ত্র, গোপালযন্ত্র, কৃষ্ণযন্ত্র, শিবযন্ত্র, মৃত্যুঞ্জয়যন্ত্র ইত্যাদি(৫৪৫)। উল্লেখিত দেবতাগুলি সকলেই পুরুষ। অথচ, যন্ত্রগুলি অবধারিতভাবেই নারী-জননাঙ্গের প্রতীকচিত্র।

তান্ত্রিক যন্ত্রগুলি যে নারী-জননাঙ্গের প্রতীকমাত্র, এ-বিষয়ে ইতিপূর্বেই দক্ষ বিদ্বানেরা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ঐচক্রপূজা প্রসঙ্গে স্যর ভাণ্ডারকরণ(৫৪৬) বলছেন :

It consists in the worship of picture of the female organ drawn in the centre of another consisting of a representation of nine such organs, the whole of which forms the Sricakra….The pictures are drawn on a bhurja leaf or a piece of silken cloth or a gold leaf of silken cloth or a gold leaf. ইত্যাদি।

আমরা বলতে চাইছি, এইভাবে নারী-জননাঙ্গের চিত্র অঙ্কন করবার পিছনে এক আদিম বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়; সেই বিশ্বাস হলো নারীজননাঙ্গের উপরই প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতাও নির্ভরশীল।

প্রথমে দেখা যাক, এ-বিষয়ে তন্ত্রের আভ্যন্তরীণ তথ্য কী রকম।

ইতিপূর্বে (পৃঃ ৩৫৬-৩৫৮) দুর্গাপূজা-প্রসঙ্গে আমরা শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দের মতবাদ উদ্ধৃত করেছি। আদিতে দুর্গা যে শস্য-জননী ছিলেন এবং দুর্গোৎসব যে শস্য-উৎসবই ছিলো—সে-বিষয়ে শ্রীযুক্ত চন্দ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি কয়েকটি তথ্যের উল্লেখ করছেন। প্রথমত, দুর্গোৎসব হলো শারদোৎসব—ফসল পাকবার ঋতু তখন। দ্বিতীয়ত, শাকম্ভরী, অন্নপূর্ণা প্রভৃতি দুর্গার নাম। তৃতীয়ত, দুর্গাপূজায় নবপত্রিকার গুরুত্ব। এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, শ্রীযুক্ত চন্দের উল্লিখিত এই প্রমাণগুলি অসামান্য মূল্যবান। আমরা এখানে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্যের অবতারণা করবো।

প্রথমত শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়(৫৪৭) আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন,

এখন যে সিংহবাহিনী দশভূজা দুর্গার প্রতিমা গড়িয়া আমরা পূজা করিয়া থাকি, শত বর্ষ পুর্বে ঠিক এমনভাবের প্রতিমা বাংলার কারিকর গড়িত না। গোড়ায় যখন সিংহবাহিনীর মৃন্ময়ী মূর্তির পূজা এ দেশে প্রচলিত হয়, তখন কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী, কেহই ছিলেন না।…আসল কথা এই যে, দুর্গোৎসবের সময়ে যে প্রতিমা গড়াইয়া, চণ্ডীমণ্ডপ জোড়া করিয়া আমরা যে উৎসব করিয়া থাকি, সে উৎসবে ঠিক সেই প্রতিমার পূজা হয় না; পূজা হয় ভদ্রকালীর, পূজা হয় পূর্ণ ঘটের, দেবীকে আহ্বান করিতে হয় যন্ত্রে ও ঘটে।

তাহলে দুর্গাপূজার আদি-অকৃত্রিম রূপটিকে চিনতে হলে পুত্ৰকন্যাপরিবৃতা ওই দশভূজাকে বাদ দিয়ে যন্ত্র ও ঘটের উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা প্রয়োজন।

দুর্গাপূজার প্রধানতম অঙ্গ ওই যন্ত্র ও ঘটের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা যাক। যন্ত্রটির নাম সর্বতোভদ্রমণ্ডল। এটি তন্ত্রের একটি বিখ্যাত যন্ত্র :

sarbatsbhadramandal

এই চিত্রটি আঁকবার নির্দেশ দিয়ে বলা হচ্ছে(৫৪৮) :

ঘট্‌ত্রিংশতা পদৈর্মধ্যে লিখেং পদ্মং স্বলক্ষণম্।
বহিঃপঙক্ত্যা ভবেৎ পীঠং পংক্তিযুগ্মেন বীথিকা॥
দ্বারশোভোপশোভাস্রাং শিষ্টাভ্যাং পরিকল্পয়েৎ।
শাস্ত্রোক্তবিধিনা মন্ত্রী ততঃ পদ্মং সমালিখেৎ॥
পদ্মক্ষেত্রস্য সংত্যজ্য দ্বাদশাংশং বহিঃ সুধীঃ।
তন্মধ্যং বিভজেদ্‌বৃত্তৈস্ত্রিভিঃ সমবিভাগতঃ॥
আদ্যং স্যাৎ কর্ণিকাস্থানং কেশরাণাং দ্বিতীয়কম্।
তৃতীয় তত্ৰ পত্রাণাং মুক্তাংশেন দলাগ্রকম্।
বাহ্যবৃত্তান্তরালস্য মানেন বিধিনা সুধীঃ।
নিধায় কেশরাগ্রেষু পরিতোহর্ধনিশাকরান্‌॥
লিখিত্বা সাৰ্দ্ধসংস্থানি তত্ৰ সূত্রাণি পাতয়েৎ।
দলাগ্রণাঞ্চ যন্মানং তন্মানাৎ বৃত্তমালিখেৎ॥
তদন্তরালং তন্মধ্যসূত্রস্যোভয়তঃ সুধী।
আলিখেদ্বাহ্যহন্তেন দলাগ্রাণি সমন্ততঃ॥
দলমূলেষু যুগশঃ কেশরাণি প্রকল্পয়েৎ।
এতং সাধারণং প্রোক্তং পঙ্কজং তন্ত্রবেদিভিঃ ॥
…………………………………………
অঙ্গুলোৎসেধবিস্তারাঃ সীমারেখাঃ সিতাঃ শুভাঃ।
কর্ণিকাং পীতবর্ণেন কেশরাণ্যরুণেন চ॥
শুক্ল-বর্ণানি পত্রাণি তৎসন্ধীন্‌ শ্যামলেন চ।
রজসা রঞ্জয়েন্মন্ত্রী যদ্বা পীতৈব কর্ণিকা॥
কেশরাঃ পীতরক্তা: স্যুররুণানি দলানি চ।
সন্ধয়ঃ কৃষ্ণবর্ণা: স্যুঃ সিতেনাপ্যসিতেন বা॥
রঞ্জয়েৎ পীঠগর্ভাণি পাদাঃ স্যুররুণপ্রভাঃ।
গাত্রাণি তস্য শুক্লানি বীথিষু চ চতসৃষু॥
আলিখেৎ কল্পলতিকাং দল-পুষ্প-সমন্বিতাম্।
বর্ণৈনানাবিধৈশ্চিত্ৰৈঃ সৰ্ব্বদৃষ্টিমনোহরাম্॥
দ্বারানি শ্বেতবর্ণানি শোভা রক্তাঃ সমীরিতাঃ ।
উপশোভাঃ পীতবর্ণাঃ কোণান্যসিতভানি চ॥
তিস্রো রেখা বহিঃ কাৰ্য্যাঃ সিতরক্তাসিতাঃ ক্ৰমাৎ।
মণ্ডলং সৰ্ব্বতোভদ্রমেতং সাধারণং মতম্॥

অর্থাৎ

তন্মধ্যে ৩৬টি ঘর লইয়া সুলক্ষণ পদ্ম অঙ্কিত করিবে। ৩৬টি ঘরের বাহিরের এক পংক্তিতে পীঠ, তাহার পরের দুই পংক্তিতে বীথিকা হইবে। পরে অবশিষ্ট দুই পংক্তি দ্বারা মধ্যস্থলে দ্বার, উভয় পার্থে দুইটি করিয়া শোভা এবং শোভান্বয়ের পার্থে দুইটি করিয়া উপশোভা এবং পরে কোণ প্রস্তুত করিতে হইবে। যে ৩৬টি ঘর লইয়া পদ্ম অঙ্কিত, তাহার দ্বাদশটি ঘর বাহিরে পৃথক রাখিয়া তন্মধ্যস্থ ২৪টি ঘরকে ৩টি বৃত্ত দ্বারা সমভাগে বিভক্ত করিবে। উহার প্রথম বৃত্ত কণিকা, দ্বিতীয় বৃত্ত কেশর ও তৃতীয়টি পদ্মপত্র। যে দ্বাদশাংশ বাহিরে রাখা হইয়াছে, উহা পত্রের অগ্র। তৃতীয় বৃত্তের মধ্যস্থ স্থানের পরিমাণে পদ্মপত্র রচনা করিবে। কেশর সমূহের অগ্রভাগে অর্ধচন্দ্র অঙ্কিত করিবে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি রেখা-সমূহের মধ্যভাগে সূত্রপাত করত পদ্মপত্রের অগ্রগুলির সমান মাপে বৃত্তরেখা আঁকিবে।
মধ্যস্থ সূত্রপাতের দুই পার্শ্বে স্থির হস্তে দলাগ্র আঁকিবে। দলমূলে দুই দুইটি করিয়া কেশর করিতে হয়। ইহাকেই তন্ত্রবেত্তারা সাধারণ পদ্ম কহেন।…।
এক অঙ্গুলি উৎসেধ অর্থাৎ বেধ পরিমাণে শুভ্রবর্ণদ্বারা সীমারেখা সকল চিত্রিত করিয়া পীতবর্ণদ্বারা কণিকা, রক্তবর্ণগুণ্ডিকাদ্বারা কেশর ও শুক্লবর্ণদ্বারা পত্ৰসকল রঞ্জিত করিয়া শ্যামবর্ণে সমস্ত সন্ধিস্থান চিত্রিত করিবে। প্রকারান্তরে যথা— কর্ণিকা পীতবর্ণ, কেশরসকল পীত রক্তবর্ণ, পত্ৰসকল রক্তবর্ণ, সন্ধি কৃষ্ণবর্ণ, পীঠগর্ভ শুক্লবৰ্ণ কিংবা কৃষ্ণবর্ণ, পীঠপাদ রক্তবর্ণ ও পীঠগাত্র শুক্লবৰ্ণ করিয়া বীথিচতুষ্টয়ে পত্র ও পুষ্প সহিত কল্পলতা সর্ববর্ণদ্বারা বিচিত্রিত করিবে। এই কল্পলতিকা দর্শনমনোহর করিবে। দ্বারসকল শুক্লবৰ্ণ, শোভা রক্তবর্ণ, উপশোভা পীতবর্ণ ও কোণ চতুষ্টয় কৃষ্ণবর্ণ করিবে। মগুলের বহির্দেশে শ্বেত রক্ত ও কৃষ্ণবর্ণ তিনটি রেখা চিত্রিত করিবে। এই প্রকারে সাধারণ সর্বতোভদ্রমণ্ডল নির্মাণ করিতে হইবে।

এতোখানি জ্যামিতিক নিষ্ঠা নিয়ে, শোভা এবং উপশোভায় বিভূষিত করে, এই যে সর্বতোভদ্রমণ্ডলটি আঁকবার নির্দেশ পাওয়া গেলো, এর মূল কথা কী? তন্ত্রবেত্তারা জানেন, এর মূল কথা হলো অষ্টদলপদ্ম ও বীথিকা :

যট্‌ত্রিংশত পদৈৰ্ম্মধ্যে লিখেং পদ্মং সুলক্ষণম্।
বহিঃ পঙক্ত্যা ভবেৎ পীঠং পংক্তিযুগ্মেন বীথিকা॥

সুলক্ষণ পদ্ম এবং বীথিক; ওই বীথিকার নাম কল্পলতিকা :

আলিখেং কল্পলতিকা দলপুষ্পসমন্বিতাং।

প্রথমে মনে রাখা দরকার, তন্ত্রে এই পদ্ম এবং বীথিকার গুরুত্ব কতোখানি। কেননা, শুধুমাত্র সর্বতোভদ্রমণ্ডল নয়, প্রায় সমস্ত তান্ত্রিক যন্ত্রেরই মূল বিষয়বস্তু বলতে এই পদ্ম এবং বীথিকাই। এখানে কয়েকটি তান্ত্রিক যন্ত্রের ছবি দেওয়া গেলো (পৃ: ৪০৭—৮, নীচে); ছবিগুলিকে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন যন্ত্রের মধ্যে খুঁটিনাটির তারতম্য থাকলেও অষ্টদলপদ্ম এবং বীথিকাই সমস্ত চিত্রের মূল বিষয়বস্তু।

tantrik jantra 4

অতএব, যন্ত্র-প্রসঙ্গে প্রধানতম প্রশ্ন ওঠে, ওই পদ্ম বা অষ্টদলপদ্মের প্রকৃত তাৎপর্য কী?

বাংলার পূজাপদ্ধতি এবং তন্ত্রের যন্ত্র-সংকেতের সঙ্গে সামান্যমাত্র পরিচয় যাঁর আছে তিনিই জানেন, তন্ত্রে পদ্ম বা অষ্টদলপদ্ম নারী-জননাঙ্গের প্রতীক মাত্র। অনেক সময় তান্ত্রিক রচনায় পদ্ম শব্দটিকে একেবারে সোজাসুজি সেই অর্থেই গ্রহণ করা হয়। যথা(৫৪৯) :

পদ্মমধ্যে গতে শুক্রে সন্ততিস্তেন জায়তে ॥

তন্ত্রে ‘পদ্ম’-শব্দের এই জাতীয় ব্যবহার একটুও দুর্লভ নয়। বৌদ্ধতন্ত্র প্রসঙ্গে আধুনিক বিশেষজ্ঞ(৫৫০) বলছেন :

Vajra (with the variant mani) is a decent or mystic plgese for linga, the male organ, just as padma, lotus, is the literary rendering of bhaga or yoni,
অর্থাৎ, বজ্র (বা মণি) শব্দ পুরুষ-অঙ্গবাচক, যেমন পদ্ম শব্দ হলো নারী জননাঙ্গের সাহিত্যিক প্রতিশব্দ।

এই প্রসঙ্গেই মনে রাখা দরকার, পদ্মের এই প্রতীকী অর্থ শুধুমাত্র প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই নয় :

In Egypt and amongst the Saivites in India, the lotus is a symbol of the reproductive act (Creuzer, Symbolik und Mythologie, Leipzig, 1836-43, 1, i, 412). The Buddhists of north countries still repeat, without suspecting the origin of the phrase, ‘Om. The jewel in the lotus. Amen (Brinton, The Religious Sentiment, 214). In the West, too, these symbols persist, even when, as also among the Buddhists, they contradict the central doctrine of the religion in which they appear(৫৫১)
অর্থাৎ ভারতবর্ষের শৈবদের মধ্যে যে-রকম মিশরেও সেইরকম পদ্ম হলো যৌনমিলনের (অঙ্গের) প্রতীক। উত্তরাঞ্চলের বৌদ্ধরা এখনো কথাগুলির মানে না জেনেই আবৃত্তি করে : ‘ওম্‌! মণি পদ্মে হুং’! পাশ্চাত্যেও এই প্রতীকগুলি টিকে থেকেছে, এমন কি—বৌদ্ধধর্মের মতোই—ধৰ্ম-বিশ্বাসটির সঙ্গে এর বিরোধ সত্ত্বেও ।

তাহলে পদ্মের অর্থ নারীজননাঙ্গই। এই পদ্মই হলো সর্বতোভজমণ্ডলের— তথা সমস্ত তান্ত্রিক যন্ত্রের—মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু সেই সঙ্গেই লক্ষ্য করা দরকার, তান্ত্রিক যন্ত্রগুলিতে শুধুমাত্র পদ্মের চিত্র নয়; পদ্মকে ঘিরে রয়েছে বীথিকা। নারী-জননাঙ্গের সঙ্গে বীথিকার সম্পর্ক কী? তান্ত্রিক যন্ত্র প্রসঙ্গে এই প্রশ্নটি স্বভাবতই সবচেয়ে মৌলিক। আমাদের যুক্তি অনুসারে, এর মূলে আছে এক আদিম বিশ্বাস : যে-বিশ্বাস থেকে দেবীর নাম হয়েছিলো শাকম্ভরী, কিংবা, যে-বিশ্বাসের মূর্ত পরিচয় হরপ্পার ওই অত্যাশ্চর্য সিলটিতে টিকে আছে। এবং, এইভাবে প্রাকৃতিক উর্বরতার সঙ্গে মানবীর উর্বরতার সংযোগ কল্পনা করা হয়েছে বলেই তন্ত্রে নারী-জননাঙ্গকে উদ্ভিদ-বাচক নাম (লতা) দেওয়া সম্ভব হয়েছিলো।

দুর্গাপূজার আলোচনায় ফেরা যাক। দুর্গাপূজার প্রধানতম অঙ্গ হলে যন্ত্র ও ঘট সর্বতোভজমণ্ডলের উপর ঘট প্রতিষ্ঠা করা হবে।

ghat

অনন্তর সর্বতোভদ্রমগুলোপরি ঘট স্থাপন করিবে। যথা—শুদ্ধ মৃত্তিকায় পঞ্চশস্য নিক্ষেপ করিবে, তদুপরি ধৌত সুলক্ষণ ঘট, তাহাতে দধ্যক্ষত (দধি মাখানো আতপ চাউল) দিয়া শুদ্ধ জলপূর্ণ করিয়া স্থাপন করিবে। তাহার কণ্ঠে আচারৎ লাল সুতা ও আলতা দেওয়া হয়। মধ্যে পঞ্চপল্লব (আম্র, অশ্বথ, বট, পাকুড়, যজ্ঞীয়ডুম্বুর শাখা), অলভে কেবল আম্রপল্লব দিবে। তদভাবে দুইটি পানও দিবার ব্যবস্থা আছে। এক সরা চাউলে একটি হরিতকী কিংবা সুপারী দিয়া তদুপরি স্থাপন করিবে। তদুপরি একটি নির্দোষ সশীর্ষ ফুল (নারিকেল অথবা কদলী) দিবে; ঐ ফলকে সিন্দুর রঞ্জিত করিবে। ঘটে একটি সিন্দুর পুত্তলিকা আঁকিবে, পুষ্পমাল্য দিয়া শোভিত করিবে…(৫৫২)

সর্বতোভজমগুলের অর্থ হলো নারী-জননাঙ্গ : সৰ্বতোভদ্রমণ্ডলের উপর ঘট, ঘটের গায়ে সিন্দুরপুত্তলিকা—মানবীয় প্রজননের প্রায় একটি পূর্ণাঙ্গ নকল তোলবার আয়োজন। এইভাবে মানবীয় প্রজননের নকল তুলে কোন কামনা সফল করবার কল্পনা করা হচ্ছে তার আভাস আমরা আগেই পেয়েছি : নারী-জননাঙ্গের তান্ত্রিক নাম লতা, তান্ত্রিক যন্ত্রে অষ্টদলপদ্মকে ঘিরে রয়েছে বীথিক। অর্থাৎ, নারী অঙ্গের জননশক্তির স্পর্শে প্রকৃতিকে ফলপ্রস্থ করবার কল্পনা। ঘট-স্থাপনার মধ্যে সেই চেষ্টাকেই আরো একটু এগিয়ে নিয়ে যাবার আয়োজন করা হলো। শুদ্ধ মৃত্তিকায় পঞ্চশস্য নিক্ষেপ করে ফসল ফলানোর মহড়া শুরু হলো। আর তারপর ঘটের উপরস্থ পল্লবকে স্পর্শ করে কামনা জানানো হবে :

ওঁ, অয়মূর্জাবতো বৃক্ষ উজ্জীব ফলিনী ভব। পর্ণং বনস্পতের্নুত্বে নুত্বা চ সুয়তাং রয়িঃ।(৫৫৩)
অর্থাৎ, হে শক্তিমতী বৃক্ষ, (তুমি) বাঁচিয়া ওঠো ও ফলবতী হও। বনস্পতির পাতাকে সেবা করে ধন প্রসব কর।

অনেক সময় ঘটের উপরের ডাবটির গায়েই সিন্দুরপুত্তলি এঁকে দিয়ে মানবীয় ফলপ্রসূতার সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার সাদৃশ্যে বিশ্বাসকে আরো স্পষ্ট ও অভ্রান্ত করবার আয়োজন দেখা যায়।

ওই যন্ত্র আর ঘটই হলো তুর্গাপূজার প্রধানতম অঙ্গ। তার মানে, কৃষি-আবিষ্কার পর্যায়ের এক আদিম বিশ্বাসই এ-পূজার প্রাণবস্তু। সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রদ্ধেয় রমাপ্রসাদ চন্দ নিশ্চয়ই আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। কিন্তু সেই প্রসঙ্গেই মনে করা দরকার, এই বিষয়টিকে আরো খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলে তিনি নিশ্চয়ই দেখতে পেতেন, আদিপর্বে দুর্গাপূজা আসলে পূজাই ছিলো না। পূজার বদলে ছিলো জাদুঅনুষ্ঠান। জাদুবিশ্বাসের মূল কথাও একটা কামনা সফল করবার চেষ্টাই। কিন্তু তা প্রার্থনা-উপাসনার সাহায্যে ঈশ্বরের করুণা উদ্রেক করে নয়। তার বদলে, কামনা সফল হওয়ার একটা নকল তুলে ওই নকলের সাহায্যেই বাস্তবভাবে কামনাটিকে সফল করবার কল্পনা। অষ্টদলপদ্মের ছবি এঁকে সিন্দুরপুত্তলীর ছবি এঁকে, মানবীয় ফলপ্রস্তার নকল তোলা হলো আর কল্পনা করা হলো প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার কামনাও এইভাবেই সফল হবে।

 

 

বলাই বাহুল্য, আমাদের আধুনিক চেতনার দিক থেকে এ বিশ্বাস একেবারে অর্থহীন। নারী-জননাঙ্গের সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার সম্পর্ক কোথায়? কিন্তু আধুনিক চেতনার মাপকাঠিতে তন্ত্রকে বোঝা যাবে না। তার বদলে, আমাদের পদ্ধতি অনুসারে, এই তান্ত্রিক বিশ্বাসটিকে ঠিকভাবে বুঝতে হলে পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের আচার-অনুষ্ঠানকে—বা পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের আচার-অনুষ্ঠানের স্মারকগুলিকে—বিচার করতে হবে।

অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন-এর(৫৫৪) একটি উদ্ধৃতি থেকে শুরু করা যাক :

In North America, when the corn is attacked by grubs, menstruating women go out at night and walk naked through the fields. Similar customs still survive among the European peasanty. Pliny recommended as an antidote to noxious insects that menstruating woman should walk through the fields with bare feet, loose hair, and skirts drawn up to the hips, Demokritos, according to Columella, held the same opinion : the women, he said, should run round the crop three times with bare feet and flowing hair. The idea was evidently to diffuse the fertile energy with which the female body was believed at such times to be charged. Elsewhere the energy is regarded as inherent in their sex. Among the Zulus, for example, the girls who perambulate must be naked but need not be actually menstruating at the time. This is the orgin of the well-known women’s rite of exposing the genitalia by drawing up the skirts—a rite which in Greece was especially associated with Demeter; and the custom common to many Greek cults of female votaries walking in procession without shoes, headbands or girdles belongs to the same circle of ideas.
অর্থাৎ (সংক্ষেপে), উত্তর আমেরিকায় ফসলে পোকা ধরলে ঋতুমতী মেয়েরা রাত্রে নগ্ন হয়ে ক্ষেতের উপর হাঁটে। ইয়োরোপের চাষীদের মধ্যে এ-প্রথা আজো টিকে আছে। খারাপ পোকার প্রতিষেধক হিসেবে প্লিনি . ব্যবস্থা দিয়েছেন, ঋতুমতী মেয়েরা খালিপায়ে এলোচুলে কোমরের ওপর পর্যন্ত কাপড় তুলে ক্ষেতের উপর হাঁটবে। কলিউমেল্লার মতে ডিমোক্রাইটসেরও সেই বিধান : তিনি বলেছেন, মেয়েরা খালিপায়ে আর এলোচুলে তিনবার দৌড়ে ক্ষেত প্রদক্ষিণ করবে। ধারণাটা স্পষ্টই এই যে, এ-অবস্থায় নারীদেহে যে-উর্বরাশক্তির আবির্ভাব হয় তাই এ-ভাবে ক্ষেতের মধ্যে সঞ্চারিত করা হবে। অন্যত্র দেখা যায়, ওই শক্তিকে নারীত্বের সহজাত শক্তি হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। জুলুদের মধ্যে প্রথা হলো, ক্ষেতে ঘোরবার সময় মেয়েরা নগ্ন হবে, কিন্তু তখন ঋতুমতী যে হতেই হবে তা নয়। মেয়েদের জননাঙ্গ প্রদর্শন-মূলক অম্লষ্ঠানাদিরও একই উৎস—এই অনুষ্ঠান গ্রীসে বিশেষ করে ডিমিটর-দেবীর সঙ্গে সংযুক্ত। নানান গ্রীক পূজাপদ্ধতিতে ব্যবস্থা দেখা যায়, পূজারিণীর খালিপায়ে আর এলোচুলে সার বেঁধে হাঁটবে—ওই পূজাপদ্ধতিগুলিও একই জাতীয় ধারণা থেকে এসেছে।

নারী জননাঙ্গকেই মানুষ এককালে উৎপাদন-শক্তির আধার মনে করেছে আর তাই প্রাকৃতিক উৎপাদনে সংকট দেখা গেলে মেয়েরা নগ্নতার সাহায্যে সে-সংকট দূর করতে চেয়েছে। এখানে শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র রায়ের(৫৫৫) রচনা থেকে কিছু দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করা যায় :

during the famine which took place in..the district of Gorakhpur…, parties of women, at night time, stripped themselves naked, went out of their houses, and taking the ploughs with them dragged the same across the field…
The performance of a similar nudity-spell on the occassion of a longstanding draught has been recorded from Chunar in the district of Mirzapur. There…three women from a cultivator’s family stripped themselves stark naked, all malefolk having been excluded from that place from beforehead. Then two of these nude women were yoked like oxen to a plough; while the third held the handle of the plough with her hands. Thereafter they began to imitate the action of ploughing
…whenever a draught occurs in Northern Bengal, the womenfolk of Rajbansis or Kochs,…strip themselves stark naked and in that state of nudity, dance before the image of their Rain-god, Hutum Deva…
সংক্ষেপে, গোরক্ষপুর, চুনার এবং উত্তর বাংলার নানান দৃষ্টান্তে দেখা যাচ্ছে, অনাবৃষ্টির সংকটকে অতিক্রম করবার কামনায় মেয়েরা নগ্নতার সাহায্য নিচ্ছে।

আমরা আগেই দেখেছি, বৃষ্টির সাহায্যে পিছিয়ে-পড়া মানুষেরা বন্ধ্যাত্ব-নিরসনের বা মানবীর প্রজননের কামনা সফল করতে চাইছে। উদ্ধৃত দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে সে-বিশ্বাসেরই বিপরীত বিকাশ : মানবীর জননাঙ্গের সাহায্যে ওরা বৃষ্টিকে,—প্রকৃতির ফলপ্রসূতাকে,—আয়ত্তে আনবার চেষ্টা করছে। এই বিশ্বাসেরই আর একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়,আমাদের দেশে কোনো কোনো অঞ্চলে লোকের ধারণা যে অতি-বৃষ্টির আসল কারণ হলো অতি বেশি সংখ্যায় নরনারীর মিলন(৫৫৬)। এ-জাতীয় বিশ্বাসাদির মধ্যে খুঁটিনাটির তারতম্য নিশ্চয়ই রয়েছে; কিন্তু সমস্তগুলিই এক মূল ধারণাচক্রের অন্তর্গত। সে-ধারণা অনুসারে, মানবীর প্রজনন ও প্রাকৃতির উৎপাদন—উভয়ই পরস্পরের প্রভাব-নির্ভর। দুঃখের বিষয় আধুনিক বিদ্বানের সবসময় ওই আদিম ধারণাটি সম্বন্ধে সম্যকভাবে সচেতন থাকেন না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, শ্ৰীযুক্ত শরৎচন্দ্র রায় এবং তার আগে ডক্টর উইলিয়াম ক্রুক, উল্লিখিত নগ্নতামুষ্ঠানের তাৎপর্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ডক্টর ক্রুক-এর(৫৫৭) মতে, বৃষ্টিদেবতার প্রাণে করুণা সঞ্চারের আশায় মেয়ের অমন দীনহীন নগ্ন ভঙ্গি গ্রহণ করে। জীযুক্ত শরৎচন্দ্র রায়(৫৫৮) কল্পনা করেছেন, নগ্নতার সাহায্যে মেয়েরা অনাবৃষ্টির দেবতাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে। বলাই বাহুল্য, উভয় ব্যাখ্যাই কৃত্রিম। দেবতার প্রাণে করুণা সঞ্চারের কৌশল হিসেবে আমাদের দেশের মেয়েরা বিবস্ত্রা হতে নিশ্চয়ই অভ্যস্ত নয়। মেয়েদের নগ্ন হতে দেখে দেবতারা—তা সে গোরক্ষপুরের অনাবৃষ্টির দেবতাই হোক আর উত্তর বাংলার বৃষ্টির দেবতাই হোক—কেন ভয় পাবে তাও বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তাছাড়া, নগ্নতামূলক এ-জাতীয় আচরণ আমাদের দেশের পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলে শুধুমাত্র বৃষ্টির কামনাতেই নয় এবং শুধুমাত্র আমাদের দেশেও নয়। এখানে দুটি উদ্ধৃতির সাহায্য নেওয়া যাক।

ডক্টর উইলিয়াম ক্রুক(৫৫৯) লিখছেন :

Among the Ramoshis of the Dakkhin, the bridegroom is stripped naked before the anointing ceremony commences and the same custom prevails very generally in Upper India, …Barren women worship a naked female figure at Bijapur. At Dayamava’s festival in the Karnatak, women walk naked to the temple where they make their vows; and the Mang, who carries the scraps of holy meat which he scatters in the fields to promote fertility, is also naked. (f. n. In the Katha-SaritSagara, I, 154, the queen Kavalayavali worships the god stark naked).

রবার্ট ব্রিফল্ট(৫৬০)লিখছেন :

Among the Hidatsas, the women, at the corn festival, carried at the end of sticks samples of all vegitables which they cultivated…They proceeded with them to the lodge. Here they stripped naked, and the elder men sprinkled both the fruits and the women with consecrated water. The men, in this instance, performed the fertilising function, but the festival was, we are told, ‘initiated by the women’.

এ-জাতীয় আরো অনেক দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই উদ্ধৃত করা যায়। এবং এ-জাতীয় দৃষ্টান্তকে নিশ্চয়ই আধুনিক নীতিবোধ বা ধর্মবোধের দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তার সহজ কারণ হলে, এ-রকম আচার-অনুষ্ঠান আধুনিক জীবনের অঙ্গ নয়। তার বদলে, প্রাচীন মানুষদের সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে-পারা তথ্যের দিক থেকে এগুলিকে বোঝার চেষ্টা করলে আমরা দেখতে পাই, এক আদিম জাদুবিশ্বাস থেকেই এ-জাতীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্ম। সেই জাদুবিশ্বাস অনুসারে মানবীর জননশক্তির—এবং অতএব ওই জননশক্তির কেন্দ্র মানবীর জননাঙ্গও,–প্রকৃতিতে জননশক্তি সঞ্চার করবে। আমাদের যুক্তি অনুসারে, এই আদিম জাদুবিশ্বাসটির দিক থেকেই ভগযাগ, লতাসাধনা, তান্ত্রিক যন্ত্র ইত্যাদির উপর আলোকপাত হওয়া সম্ভবপর।

ওই আদিম জাদুবিশ্বাস যে বস্তুনিষ্ঠ নয়, সে-বিষয়ে সুদীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন নিশ্চয়ই নেই : প্রকৃতিকে চেনবার প্রচেষ্টায় মানুষের দারিদ্র্য প্রকৃতিকে আয়ত্তে আনবার অক্ষমতারই অনুরূপ হতে বাধ্য। তার বদলে, এখানে যে-বিষয়ে সচেতন হবার প্রয়োজন আছে তা হলে, আধুনিক বিদ্বানের আধুনিক ধ্যানধারণার সাহায্যে এই আদিম বিশ্বাসের যে-ব্যাখ্যা খুঁজেছেন তাও বস্তুনিষ্ঠার দিক থেকে সমান অর্থহীন : আদিম মানুষদের পক্ষে মানবীর জননাঙ্গের সাহায্যে প্রকৃতির জননশক্তি আয়ত্তে আনবার প্রচেষ্টাটা যেমনই কাল্পনিক, তেমনিই কাল্পনিক হলো আধুনিক বিদ্বানদের পক্ষে ওই প্রচেষ্টাকে দেবতার প্রাণে করুণা জাগানো বা দেবতাকে ভয় দেখানোর আয়োজন বলে ব্যাখ্যা করা।

—————-
৫১৫. ERE 10:242. cf. G. Thomson SAGS 243,
৫১৬. Ibid.
৫১৭. Ibid.
৫১৮. ERE 5:129.
৫১৯. E. H. Blakeney SCD 79.
৫২০. M. J. Herskovits MHW 395. Aurignacian figurine in ivory, known as the Venus of Lespugue (Honte-Garonne, France): front, side and rear views.
৫২১. Ibid. 394. The Aurignacian Venus’ carved in low relief, from Lanssel, Dordogne.
৫২২. S. Corbian in Man-September 1935 No. 159 p 144.
৫২৩. J. Marshall op, cit. 1:Plate xiii, 7.
৫২৪. Ibid. 1:52.
৫২৫. J. Marshall ASI 1911-2 pl. xxiii, 40.
৫২৬. বিশ্বকোষ ১৩:২২১ ।
৫২৭. A. A. Macdonell VM 45. এই গ্রন্থের পৃ. ৫৬৯ দ্রষ্টব্য।
৫২৮. বিশ্বকোষ ৭:৫২৭ ৷
৫২৯. ঐ।
৫৩০. ঐ ৭:৫২৮।
৫৩১. ঐ।
৫৩২. ঐ ৭:৫২৯।
৫৩৩. ঐ ৭:৫৩০।
৫৩৪. ঐ ৭:৫০৪।
৫৩৫. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২:২৫১।
৫৩৬. বিশ্বকোষ ৭:৫৪৭ ৷
৫৩৭. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২:২১৯ ।
৫৩৮. ঐ ২:২৭৫।
৫৩৯. ঐ ২:২৭৭।
৫৪০. ঐ ২:২৮৩।
৫৪১. অনেকাংশেই মনোবিকলন-পদ্ধতির সঙ্গে তুলনীয়।
৫৪২. বিশ্বকোষ ১৫:৫৪৫।
৫৪৩. ঐ।
৫৪৪. বৃহৎতন্ত্রসারে বিভিন্ন যন্ত্রের চিত্র দ্রষ্টব্য।
৫৪৫. বৃহৎতন্ত্রসার দ্রষ্টব্য।
৫৪৬. R. G. Bhandarkar VS 146. cf. S. K. Dikshit MG 216-7.
৫৪৭. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২:২৬৫ ৷
৫৪৮. বৃহৎতন্ত্রসার (বসুমতী) ৭৪-৫।
৫৪৯. বিশ্বকোষ ৭:৫৪১ ৷
৫৫০. ERE 10:196.
৫৫.১. ERE 5:829,
৫৫২. ক্রিয়াকাণ্ড-বারিধি ( বসুমতী )১:২৩৯ ।
৫৫৩. ঐ ১:২৪০।
৫৫৪. G. Thomson SAGS 206.
৫৫৫. S. C. Roy ASB : xii, 920-1, cf. W. Crooke RFNI 71. “Nudity is essential in many magical rites and appears prominently in rain-magic.” ৫৫৬. কলকাতার দেহাতিদের মুখেও এই বিশ্বাসের পরিচয় শুনেছি।
৫৫৭. See S. C. Roy op. cit. 920, nte its GF (RFNI71) de NE পরিবর্তন করেছেন।
৫৫৮. S. C. Roy op. cit. 920.
৫৫৯. W. Crooke PRFNI (1896 Ed.) 68.
৫৬০. R. Briffault op. cit. 3:4.