প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

২০. জাতিভেদ : ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ

২০. ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ : জাতিভেদ

সাবেকী ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থার আর একটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো জাতিভেদ। এই প্রথার ব্যাখ্যা হিসেবে বহু মতবাদ(২২৬) দাঁড় করাবার চেষ্টা হয়েছে। এবং এ-বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, জাতিভেদ সম্বন্ধে এখনো অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে। আমরা বলতে চাই, ট্রাইব্যাল সমাজের অম্পূর্ণ বিলোপ সংক্রান্ত আমাদের প্রকল্প এই বৈশিষ্ট্যটির উপরও আলোকপাত করতে পারে।

একটি সময়ে জাতিভেদ-প্রথার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করা হয়েছিলো, হিন্দুদের শ্রুতি-স্মৃতির লিখিত স্বাক্ষ্যগুলিকে বিশ্লেষণ করেই(২২৭)। কিন্তু সে-চেষ্টা সফল হয়নি। কেননা, স্মৃতিশাস্ত্রে জাতিভেদ প্রথার যে পরিচয় পাওয়া যায় তার সঙ্গে বাস্তবে প্রতলিত প্রথাটির বড়ো একটা মিল নেই(২২৮)। স্মৃতিশাস্ত্র চতুর্বর্ণের কথাই বলে। কিন্তি বাস্তবভাবে দেখা যায় জাতি প্রায় অসংখ্য। কথার কথা হিসেবে আমরা বলি ছত্রিশ জাত—এও কিন্তু খুবই কমিয়ে বলা।

বাস্তবভাবে সমাজে এই যে প্রায় অসংখ্য জাতের অস্তিত্ব,—একে শুধুমাত্র একালের ব্যাপার মনে করলে ভুল হবে। অতি প্রাচীন কাল থেকেই এই রকম। এবং সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রিস্‌ ডেভিডস্‌, রিচার্ড ফিক্‌ প্রমুখ বৌদ্ধশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ বিদ্বানেরা(২২৯)।

এঁদের রচনায় ঐতিহাসিক তথ্যের উৎস হিসেবে বৌদ্ধ পুঁথিপত্রগুলির প্রতি নতুন উৎসাহ দেখা গেলো। এবং এঁরা বললেন, বৌদ্ধ গ্রন্থাবলী থেকে জাতিভেদ সংক্রান্ত ও সাধারণভাবে প্রাচীন ভারতের সমাজ-ইতিহাস সংক্রান্ত যে-সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তার সঙ্গে ব্রাহ্মণদের রচনায় উল্লেখিত মতামতগুলির মিল হয় না। ব্রাহ্মণ-সাহিত্য, পুরাণ ও বিশেষ করে স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে, ব্রাহ্মণেরা নিজেদের চাহিদা ও আকাঙ্খাকেই বাস্তবের বর্ণনা বলে প্রচার করবার চেষ্টা করেছেন। অবশ্যই, ফিক্‌(২৩০) মানছেন, ব্রাহ্মণ মতাবলীর মধ্যে যদিও বাস্তবের প্রতিচ্ছবি নেই তবুও সেগুলি যে সামাজিক বাস্তবের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। তবুও, তিনি(২৩১) বলছেন, ব্রাহ্মণদের রচনায় মূল চেষ্টাটা ছিলো, সমাজ-বাস্তবে যে সব অজস্র জাতের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে সেগুলির কথা কোনো মতে চতুর্বর্ণ-মূলক থিয়োরিটির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া, এবং অতএব, এই অন্যান্য জাতিগুলির একটা কাল্পনিক ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করা। ফিক্‌ দেখাবার চেষ্টা করছেন,(২৩২) ব্রাহ্মণ-মতবাদ অনুসারে যে-জাতিগুলিকে বর্ণশঙ্কর আখ্যা দেওয়া হচ্ছে এবং যেগুলির উৎস সম্বন্ধে নানা রকম কল্পিত কাহিনী প্রচার করা হচ্ছে সেগুলির নাম থেকেই বোঝা যায় যে, এগুলি স্থান-বাচক বা ট্রাইব-বাচক : অর্থাৎ, নামগুলি এসেছে হয় কোনো জায়গার নাম থেকে আর না হয়তো কোনো ট্রাইবের নাম থেকে। এ রকম নামের অনেক দৃষ্টান্তই তিনি উল্লেখ করেছেন : মাগধ, নিষাদ, বিদেহ, অম্বষ্ট, মল্ল, লিচ্ছবি, চণ্ডাল। আবার ফিক্‌ বলছেন, কোনো কোনো জাতের নাম এসেছে মানুষদের পেশার দিক থেকে। যেমন : সূত (রথকারক), বেন (যারা বেতের কাজ করে), নট, কৈবর্ত, (জেলে), ইত্যাদি(২৩৩)।

তাহলে, এই ধরনের জাতগুলির ব্যাখ্যা হিসেবে ফিক্‌-এর সিদ্ধান্তটা কী? তিনি বলছেন, এ-দেশে আর্য-সমাজের বহির্ভূত নানান মানবদল বর্তমান ছিলো। তাদের এবং তাদের পেশা সম্বন্ধে আর্যদের মনে ঘৃণা যতোই থাকুক না কেন, একেবারে সরাসরি তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। আবার চতুর্বর্ণের কোনো একটি বর্ণের অন্তর্গত বলে স্বাভাবিকভাবে তাদের স্বীকার করে নেওয়াও যায়নি। অতএব, চতুর্বর্ণ-মূলক আর্যদের ওই মতবাদটিকেই আরো একটু ব্যাপক করে নেবার চেষ্টা হলো এবং তথাকথিত শঙ্কর-জাতগুলির কথা চতুর্বর্ণের কোনো এক বর্ণের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে এগুলি পরিবার-গত ও পেশা-গত নামের একটি করে কাল্পনিক ব্যাখ্যাও উদ্ভাবণ করা হলো(২৩৪)।

বৌদ্ধযুগের ভারতীয়-সমাজ সম্বন্ধে রিচার্ড ফিক্‌-এর এই গবেষণা যতোই মূল্যবান হোক না কেন, জাতিভেদ-প্রথার ব্যাখ্যা হিসেবে তাঁর সিদ্ধান্তগুলিকে অসম্পূর্ণ না বলে উপায় নেই। তার নানান কারণ আছে। একটি কারণ হলো, তিনি ওই ব্রাহ্মণ-সাহিত্যের তথ্যকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে জাতিভেদ-প্রথার একটা ব্যাখ্যা খোঁজ করবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই ব্রাহ্মণ-সাহিত্যের কথাগুলিকে তিনি আর্যজাতির মনগড়া কথা বলে প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করলেও, জাতিভেদ-প্রথা ওই তথাকথিত আর্যদের মধ্যেও অত্যন্ত প্রকটভাবেই ফুটে উঠেছিলো। অতএব, বৌদ্ধশাস্ত্র থেকে শুধুমাত্র শঙ্কর-জাতিগুলির কথা বিশ্লেষণ করেই জাতিভেদ সমস্যার একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান দেওয়া যায় না—সমাধানটিকে স্বীকারযোগ্য, অতএব পূর্ণাঙ্গ, করতে হলে ‘আর্য’দের চতুর্বর্ণ-ব্যবস্থারও একটা ব্যাখ্যা তারই মধ্যে থাকা দরকার।

দ্বিতীয়ত, ফিক্‌ তাঁর তথ্য সংগ্রহ করেছেন প্রধাণতই জাতকের গল্পগুলি থেকে। অবশ্যই, এবিষয়্যে কোনো সন্দেহ নেই যে, সে-যুগের ভারতবর্ষের একটি বিশেষ অঞ্চল সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্যের যোগান জাতকের গল্পগুলির মধ্যেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সঙ্গেই একথাও মনে রাখা দরকার যে, জাতিভেদ-প্রথা শুধুমাত্র সেকালের ব্যাপার নয়, একালের ব্যাপারও। তাই, একালের বাস্তব পরিস্থিতিকে ঠিক মতো বিশ্লেষণ করতে পারলে সেকালের সাহিত্যের উপর আলোকপাত হবার সম্ভাবনাও থেকে যায়। বস্তুত, এই সম্ভাবনা সম্বন্ধে ফিক্‌ নিজেও অচেতন নন। তিনি বলেছেন(২৩৫) :

We do not hesitate to make use of the conditions of modern India which, on account of the stability of most Oriental cultures, have preserved so much of the past for comparison with, and for the explanation of, the earlier periods.
অর্থাৎ, প্রাচ্য সংস্কৃতির স্থবিরতার দরুন ভারতের আধুনিক পরিস্থিতিতেও প্রাচীন অবস্থার অনেক কিছুই টিকে থেকেছে; তাই প্রাচীন অবস্থার সঙ্গে তুলনা করবার জন্যে ও প্রাচীন অবস্থাকে ব্যাখ্যা করবার জন্যে ভারতবর্ষের আধুনিক অবস্থার কথা ব্যবহার করতেও আমাদের দ্বিধা হয় না।

বলাই বাহুল্য, ফিক্‌-এর এই ইংগিতটি অত্যন্ত দুর্মূল্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ-ইংগিতের সম্ভাবনা তিনি নিজের গবেষণাক্ষেত্রে বাস্তবে পরিণত করেননি।

আমাদের যুক্তি হলো, জাতিভেদ-প্রথার মূল ব্যাখ্যা খুঁজতে হলে বৌদ্ধসাহিত্য ছাড়াও দুটি দিকে নজর রাখা দরকার। এক, ব্রাহ্মণাদি উচ্চ-বর্ণের কথা। দুই, সাম্প্রতিক ভারতবর্ষের বাস্তব পরিস্থিতির কথা। তাই এখানে আমাদের আকছে প্রধান প্রশ্ন হবে, জাতিভেদ-প্রথার মধ্যে এমন কোনো মূল লক্ষণ কি সত্যিই চোখে পড়ে যা একাধারে ব্রাহ্মণাদি উচ্চ-বগুলি এবং সাম্প্রতিক ভারতীয় পরিস্থিতি,—উভয়ের মধ্যেই বর্তমান? যদি সত্যিই সে-রকম কোনো লক্ষণের সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে সেইটির সূত্র ধরে অগ্রসর হয়েই এই জটিল সমস্যার সমাধান পাবার আশা আছে।

প্রথমত, বর্তমান ভারতের বাস্তব পরিস্থিতির কথাই বিচার করে দেখা যাক।

পুঁথিপত্রের গণ্ডি ছেড়ে আমরা যদি দেশের মানুষগুলির দিকে চেয়ে দেখতে রাজি হই আহলে প্রথমেই আমাদের চোখে পড়ে এক অতি বিস্ময়কর ঘটনা : আমাদের দেশের বিশেষ করে পিছিয়ে-পড়া অবস্থায় আটকে-থাকা মানুষদের মধ্যে ট্রাইব্যাল-ব্যবস্থা (Tribal organisation) এবং জাত-ব্যবস্থা (caste-organisation)—এই দুয়ের মধ্যে সীমারেখে সব সময় স্পষ্ট নয়। যাঁরা এই পিছিয়ে-পড়া মানুষদের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁদের অধিকাংশের বেলাতে গ্রন্থের নামকরণ ব্যাপারের মধ্যেই এই স্বীকৃতি থেকে গিয়েছে : বই-এর নামকরণ করবার সময় তাঁরা শুধুমাত্র Tribe বা শুধুমাত্র Caste শব্দ ব্যবহার করতে দ্বিধা বোধ করছেন—অতএব শিরোনামায় ট্রাইব এবং কাস্ট উভয় শব্দই সংরক্ষণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সেন্সাস্‌ কর্তৃপক্ষরা(২৩৬) এই পিছিয়ে-পড়া মানুষগুলির বর্ণনা দেবার জন্যে সাধারণত তাঁদের রিপোর্টের একটি স্বতন্ত্র খণ্ড প্রকাশ করে থাকেন এবং সেটির নাম দেওয়া হয় “ট্রাইবস্‌ এবং কাস্টস্‌” : ওই পিছিয়ে-পড়া মানুষদের ভিতর ট্রাইব এবং কাস্ট-এর মধ্যে সীমারেখাটা অস্পষ্ট বলেই এ ধরনের নামকরণ প্রয়োজন হয়েছে। একই কারণে, অনন্তকৃষ্ণ আয়ার, থার্স্টন, রাসেল প্রমুখ সকলেই ওই ধরনের মানুষদের সম্বন্ধে বই লেখবার সময় ট্রাইব এবং কাস্ট উভয় শব্দই প্রায় সমানার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। কোনো একটি নির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠীকে ট্রাইব আখ্যা দেওয়া হবে, না, কাস্ট আখ্যা দেওয়া হবে—এ-বিষয়ে লেখকরা সব সময় খুব সুনিশ্চিত নন। এর থেকেই কি অনুমান করবার অবকাশ থাকে না যে, কাস্ট-সংগঠন ও ট্রাইব-সংগঠন খুবই ঘনিষ্ট সম্বন্ধে সংযুক্ত? আর যদি তাই হয়, তাহলে ট্রাইব-সংগঠন সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে পারা তথ্যকে অবলম্বন করেই কাস্ট-সংগঠনের সমস্যা সমাধান করবার আশা থাকে না কি? অবশ্যই, তাই বলে ট্রাইব আর কাস্টকে এক মনে করবার কারণ নেই; ট্রাইব্যাল-সমাজ বহু দেশেই টিকে আছে, কিন্তু জাতিভেদ-প্রথ সর্বত্র নেই। ভারতবর্ষেই যে-সব জায়গায় ট্রাইব্যাল-সমাজের বিশুদ্ধরূপ সেখানেও জাতিভেদ-প্রথার পরিচয় নেই। আমরা তাই অনুমান করতে চাইছি, জাতিভেদ-প্রথা আসলে ট্রাইব্যাল -সমাজের অসমাপ্ত বিলোপের পরিমাণ—ট্রাইব্যাল-সমাজেরই ধ্বংসাবশেষ এর মধ্যে টিকে রয়েছে, কিন্তু ট্রাইব্যাল-সমাজের মূল প্রাণশক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধ্বংসাবশেষটির আদি-তাৎপর্য বিপরীতে পরিণত হয়েছে। এবং ট্রাইব্যাল-সমাজের ওই অসমাপ্ত বিলোপের কারণ হলো, উৎপাদন-কৌশলের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলো—উৎপাদন-পদ্ধতির সাধারণ বা স্বাভাবিক উন্নতির ফলে ট্রাইব্যাল-সমাজ যদি ভিতর থেকে ধ্বংস পেতো আহলে তার বিলোপ অম্পূর্ণ হতো না। সেদিক থেকে কৌটিল্যের উদ্ধৃতি নীতিটি ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থাকে বোঝবার কাজে একটি মূল্যবান মূলসূত্র।

জাতিভেদের কথায় ফিরে আসা যাক। প্রথমে দেখা যাক, পিছিয়ে-পড়া মানুষদের মধ্যে জাতিভেদ-প্রথার যে-রূপটি চোখে পড়ে তাতে ট্রাইব ও কাস্ট-এর মধ্যবর্তী সীমারেখা কী রকম অস্পষ্ট। এখানে এলোমেলো ভাবে কয়েকটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করলেই চলবে, কেননা প্রকৃতপক্ষে এ-জাতীয় দৃষ্টান্ত প্রায় অসংখ্য।

আমরা রাসেল ও হীরালাল(২৩৭) রচিত “মধ্যভারতের ট্রাইব এবং কাস্ট” বলে বই থেকে এখানে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করবো :

1. The Ahir caste has sub-castes, which again are divided into exogamous sections. The names of these sections ar often titular and totemic animals.
2. The Andh caste : The caste is divided into two groups : the Vartati or pure and the Khaltati or illegitimate, which take food together but do not intermarry. These again are divided into a large number of exogamous sects a few of which names are totemic, e.g., Majiria (cat), Ruigni (a kind of tree), Dumare (from Dumarm an ant-hill), Dukare (from Dukar, a pig), Titawe (from Titwa, a bird), and so on.
3. The Baita, a primitive Dravadian tribe, is divided into seven sub-tribes, which again are divided into a number of exogamous septs, the names of which are identical with those of the Gonds, as Markm, Maravi, Netam, Tekam. Prohibition of marriage into these septs are based on the number of gods that they worship. No sept can marry into another sect which also worship the same gods.

আগেই বলেছি, এই দৃষ্টান্তগুলি খুব কিছু বাছাই করে উদ্ধৃত করিনি। তার বদলে, প্রায় এলোমেলোভাবেই গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলির মধ্যেই যে-বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা বিচার করলে চিত্তাকর্ষক তথ্য নিশ্চয়ই পাওয়া যায়।

প্রথমত দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় দৃষ্টান্তের বেলায় লেখকরা Tribe শব্দ ব্যবহার করছেন কিন্তু আগের দুটি দৃষ্টান্তে caste শব্দ। অথচ তিনটি ক্ষেত্রেই মনবদলের যে-ধরনের বর্ণনা তার মধ্যে এমন কোনো ইংগিত নেই যার দরুন এই দু’রকম পৃথক শব্দ-ব্যবহার সমর্থিত হতে পারে। ট্রাইব আর কাস্ট অবশ্যই এক নয়; কিন্তু লেখকরা দেখছেন, তা সত্ত্বেও যেন একই রকম। সেই কারণেই আমরা বলছিলাম, এই ধরনের পিছিয়ে-পড়া মানুষদের পরীক্ষা করলে দেখা যায় ট্রাইব এবং কাস্ট-এর সীমারেখাটা অস্পষ্ট। তার মানে, ট্রাইব্যাল সমাজের অসমাপ্ত ধ্বংসাবশেষই জাতি-ভেদ প্রথার মূল উপাদান।

দ্বিতীয়ত দেখা যাচ্ছে, প্রথম নমুনাটির বেলায় যদিও লেখকরা exogamous sections বলে শব্দ ব্যবহার করছেন তবুও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় নমুনার বেলায় তাঁরা exogamous septs বলে পরিভাষা ব্যবহার না করে পারছেন না। নৃতত্ত্বের ছাত্রের আকছে exogamous septs নামের পরিভাষা অপরিচিত নয়; কিন্তু এই পরিভাষা শুধুমাত্র ট্রাইব্যাল-সংগঠন সম্বন্ধেই প্রাসঙ্গিক। তার মানে কি এই নয় যে, লেখকরা এখানে caste বা জাতের বর্ণনায় এমন পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন যা শুধুমাত্র ট্রাইব-প্রসঙ্গেই প্রযোজ্য? কিন্তু আসল সমস্যাটা শুধুমাত্র পারিভাষিক শব্দ ব্যবহারের সমস্যাই নয়, তার চেয়ে ঢের মৌলিক এক সমস্যা। কেননা, তাঁরা একম একরকম সামাজিক প্রথার সম্মুখীন হয়েছেন যাকে একদিক থেকে কাস্ট বা জাত না বলে পারছেন না; আবার অপরদিকে তারি আভ্যন্তরীণ অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ট্রাইব্যাল-সংগঠনের পক্ষে প্রাসঙ্গিক পরিভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে। জাত বা কাস্ট বলে ব্যবস্থাটি কোথা থেকে এলো।

বিষয়টির আলোচনা ভালো করে করতে হলে এখানে ট্রাইব্যাল-সংগঠনের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উল্লেখ করা দরকার।

আমেরিকা আদিবাসীদের মধ্যে মর্গান ট্রাইব্যাল-সমাজের যে-রূপটি দেখেছিলেন তাকেই আমরা এ-সংগঠনের টিপিক্যাল রূপ বা আদি-অকৃত্রিম রূপ মনে করতে পারি।

মর্গান দেখাচ্ছেন, প্রতিটি ট্রাইব সাধারণত বড়ো বড়ো দুটি ভাগে বিভক্ত। এই দুটি ভাগবে বলা হয় ফ্রাত্রি বা phartry। প্রতিটি ফ্রাত্রি আবার কয়েকটি করে আরো ছোটোছোটো মানবগোষ্ঠীতে বিভক্ত। এই ছোটো ছোটো গোষ্ঠীর মধ্যে প্রত্যেকটি মানুষই প্রত্যেকের সঙ্গে নিজেকে সজ্ঞাতি মনে করে, তাদের ধারণায় একই পূর্বপুরুষ থেকে তাদের সকলের উৎপত্তি। মর্গান এই ছোটোছোটো গোষ্ঠীগুলিকে বলছেন গেন্‌স্‌ বা gens; কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক আধুনিক নৃতত্ত্ববিদ্‌দের মধ্যে মর্গানের ওই পরিভাষাটি জনপ্রিয় হয়নি। গেন্‌স্‌-এর বদলে তাঁরা অন্যান্য শব্দ ব্যবহার করে থাকেন,—সাধারণত ক্লান (clan), কখনো বা সেপ্ট (sept), কখনো বা সিব্‌ (sib)। অবশ্যই, ট্রাইব্যাল-সমাজের উচ্চতম পর্যায়ে একাধিক ট্রাইব একটি বৃহত্তর সংগঠনের মধ্যে মিলিত হয়—তাকে বলা হয়েছে কন্‌ফেডারেসি অব্‌ ট্রাইব্‌স্‌ বা confederacy of tribes। এবং প্রত্যেক ট্রাইবের ক্ষেত্রেই দুটি করে ফ্রাত্রি চোখে পড়তে বাধ্য নয়; কোনো কোনো দৃষ্টান্তে ফ্রাত্রি চোখে পড়েই না, কোনো কোনো দৃষ্টান্তে ফ্রাত্রির সংখ্যা দুই-এর বেশি। কিন্তু এ-জাতীয় দৃষ্টান্তকে মোটের উপর ব্যতিক্রম মনে করা যেতে পারে।

গেন্‌স্‌ বা ক্লান সম্বন্ধে মর্গানের একটি মন্তব্য আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি। তিনি বলছেন, আমেরিকার আদিবাদসীদের মধ্যে সর্বত্রই চোখে পড়ে, কোনো-না-কোনো জন্তু-জানোয়ারের নাম থেকেই এগুলির নামরকণ করা হয়েছে(২৩৮)। এই নামরকণ পদ্ধতি অবশ্যই টোটেম্‌-বিশ্বাসের পরিচায়ক।

এবার মর্হানের গ্রন্থ(২৩৯) থেকে একটি মূর্ত দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাক।

‘ইরোকোয়া’দের কন্‌ফেডারেসি অব্‌ ট্রাইবস্‌

কন্‌ফেডারেসির অন্তর্গত ছ’টি ট্রাইবের নাম প্রতি ট্রাইবের অন্তর্গত ফ্রাত্রি ফ্রাত্রির অন্তর্গত গেন্‌স্‌ বা ক্লান (পঞ্চম ও ষষ্ঠ ট্রাইবের বেলায় ফ্রাত্রি নেই)
১ : সেনেকা (Seneca) ১ : ভালুক, ২ : নেকড়ে, ৩ : বীবর, ৪ : কাছিম।
১ : হরিণ, ২ : কাদাখোঁচা পাখি, ৩ : বক, ৪ : বাজপাখি।
২ : কেউগা (Cayuga) ১ : ভালুক, ২ : নেকড়ে, ৩ : কাছিম, ৪ : কাদাখোঁচা, ৫ : ঈল্‌মাছ।
১ : হরিণ, ২ : বাজপাখি, ৩ : বীবর।
৩ : ওননডগা (Onondaga) ১ : নেকড়ে, ২ : বীবর, ৩ : কাছিম, ৪ : কাদাখোঁচা, ৫ : বল্‌।
১ : হরিণ, ২ : ভালুক, ৩ : ঈল্‌মাছ।
৪ : টুসকারোরা (Tuscarora) ১ : ভালুক, ২ : বীবর, ৩ : বড়ো কাছিম, ৪ : ঈল্‌মাছ।
১ : ধূসর নেকড়ে, ২ : হলদে নেকড়ে, ৩ : ছোটো কাছিম, ৪ : কাদাখোঁচা।
৫ : মোহক (Mohawk) ১ : ভালুক, ২ : নেকড়ে, 3 : কাছিম।
৬ : ওনেইডা (Onelda) ১ : ভালুক, ২ : নেকড়ে, ৩ : কাছিম।

এই দৃষ্টান্তটিকে সামনে রেখে ট্রাইব্যাল-সমাজের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা যাক। আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে প্রধানত দুটি বিষয়ের কথাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হবে। ১ : বিবাহ-পদ্ধতি। ২ : শাসন-পদ্ধতি।

ট্রাইব্যাল-সমাজে বিবাহ-পদ্ধতি সংক্রান্ত আইন-কানুনই সবচেয়ে অমোঘ(২৪০)। বিবাহ-সংক্রান্ত আইন বলতে প্রধানত হলো : ক্লানের ভিতর কাউকে বিয়া করা চলবে না। বিয়ে করতে হবে ক্লানের বাইরে। ভালুক-ক্লানের কেউই ভালুক-ক্লানের কাউরে বিয়ে করতে পারবে না—বিয়ে করতে হবে ভালুক-ক্লানের বাইরে (clan-exogamy)(২৪১).

ট্রাইব্যাল-সমাজের শাসন-পদ্ধতির মূল কথা হলো, পঞ্চায়েৎ বা council। ক্লানের পঞ্চায়েৎ-এ ক্লানের বয়ঃপ্রাপ্ত সকলে একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্তে আসবে, প্রত্যেক ক্লানের নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে (ফ্রাত্রি-পঞ্চায়েৎ এবং) ট্রাইবের পঞ্চায়েৎ বসবে, প্রতিনিধিদের কাজকর্ম সন্তোষজনক না হলে তাদের প্রতিনিধিত্ব খারিজ করে নতুন প্রতিনিধি নির্বাচন করা হবে(২৪২)। এই ব্যবস্থার দরুনই ট্রাইব্যাল-সমাজে গণতন্ত্রের অমন চূড়ান্ত নিদর্শন এবং, আমরা আগেই আলোচনা করেছি, আমাদের দেশের পুরোনো পুঁথিপত্রে উল্লেখিত গণসমাজের ওই চূড়ান্ত গণতান্ত্রিক আয়োজন দেখেই আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এগুলিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে ভুল করেছেন।

এবার দেখা যাক, জাতিভেদ-প্রথার মধ্যে ট্রাইব্যাল-সমাজের এই দুটি বৈশিষ্ট্য কী রকম স্পষ্টভাবে টিকে রয়েছে। প্রথমে আমাদের দেশের পিছিয়ে-পড়া মানুষগুলির মধ্যে জাত-প্রথা বা caste-system-এর কথা তোলা যাক, তারপর উচ্চ-বর্ণের প্রসঙ্গে ফেরা যাবে।

পিছিয়ে-পড়া মানুষদের ব্যাপারের রাসেল ও হীরালালের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দৃষ্টান্তগুলিরই বিশ্লেষণ করা যাক। অহীর এবং অন্ধ্‌ নামের য-দুটি জাতের (caste-এর) উল্লেখ করা হয়েছে সে-দুটির মধ্যে প্রথমটির সংগঠন হুবহু মর্গান-বর্ণিত মোহক আর ওনেইডা ট্রাইবের মতোই—এগুলির ক্ষেত্রে ফ্রাত্রি বলে অন্তর্বর্তী বিভাগের পরিচয় নেই, তার বদলে ট্রাইবটি কয়েকটা জন্তু-জানোয়ারের নামধারী ও বহির্বিহাব-মূলক বা exogamous গোষ্ঠীতে বিভক্ত। রাসেল ও হীরালাল-বর্ণিত অন্ধ্‌ বলে জাতটির সংগঠন হুবহু মর্গান-বর্ণিত সেনেকা বা কেউগা ট্রাইবেরই মতো—ট্রাইবটি প্রথমত দুটি বড়ো ভাগে (ফ্রাত্রি) বিভক্ত এবং প্রত্যেকটি বড়ো ভাগের অন্তর্গত রয়েছে জানোয়ারের-নামধারী বহির্বিবাহ-ভিত্তিক কয়েকটি ছোটোছোটো গোষ্ঠী :

সেনেকা

    • ভালুক
    • নেকড়ে
    • বীবর
    • কাছিম
    • হরিণ
    • কাদাখোঁচা
    • বক
    • বাজ

(ভালুক-গোষ্ঠীর কারুর সঙ্গে ভালুক গোষ্ঠীর কারুর বিয়ে হবে না।)

অন্ধ্‌

    • বেড়াল
    • শুয়োর
    • তিরির
    • ইত্যাদি

(বেড়াল গোষ্ঠীর কারুর সঙ্গে বেড়াল-গোষ্ঠির কারুর বিয়ে হবে না।)

জাতভেদ-প্রথার উৎপত্তিতে যে ঠিক কী তা এই তুলনা থেকেই আন্দাজ করা যায় এবং এই থেকেই বুঝতে পারা যায় ভারতবর্ষের পিছিয়ে-পড়া মানুষগুলির মধ্যে জাতিভেদ-প্রথার (caste-system-এর) বর্ণনা দেবার সময় বর্ণনাদাতারা কেন অমন সরাসরি ট্রাইব্যাল-সমাজ-বর্ণনার পরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন।

ওই পিছিয়ে-পড়া মানুষগুলির মধ্যে জাতিভেদ-প্রথায় শুধুই যে ট্রাইব্যাল-সমাজের বিবাহ পদ্ধতির পরিচয় টিকে রয়েছে তাই নয়; অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এমনকি ট্রাইব্যাল-সমাজের শাসন-ব্যবস্থার বা পঞ্চায়েৎ প্রথারও প্রায় পূর্ণাঙ্গ স্বাক্ষর থেকে গিয়েছে(২৪৩) :

Caste discipline is maintained by the members of the community through their recognized leaders…Sometimes they hold offices with well-defined duties, but usually among the functional castes, they form a standing committee, or panchayat which deals with all branched of caste-discipline and other matters affecting the community. The decisions of the panchayat are final and their authority is unquestioned. Minor breaches of caste-rules and restrictions can be expiated by a ceremony of purification and a feast to the fraternity : but for more serious offenses, or for contumacy, the penalty is excommunications. A man against whom this sentence has been pronounced is cut off from all intercourse with his caste-fellows, who will neither eat nor smoke nor associate with him; he is shunned as a leper, and his life is made so miserable that be soon becomes eager to accept any conditions that may be imposed upon him. Should his offence be too heinous to permit of atonement, he is driven to seek admission o some lower caste, or to become a Mohammedan, or to hide himself in the towns, there the trammels of the caste system are weaker and less irksome than in the villages.
অর্থাৎ সংক্ষেপে, সাধারণত জাত-এর আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও শাসনের দায়িত্ব থাকে একটি করে স্থায়ী পঞ্চায়েৎ-এর উপর। এই পঞ্চায়েৎ-এর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং অলঙ্ঘনীয়। ছোটোখাটো দোষত্রুটির প্রতিকার হিসেবে হয়তো প্রায়শ্চিত্ত ও জ্ঞাতিভোজনই পর্যাপ্ত; কিন্তু যদি মারাত্মক হয় তাহলে পঞ্চায়েৎ বহিস্কারের নির্দেশ দেয়। এইভাবে কেউ জ্ঞাতিচ্যুত বা জাতি-বহিষ্কৃত হলে তার সঙ্গে জাতের বাকি কেউ আর কোনো রকম সম্পর্ক রাখে না এবং ব্যক্তিটির ত্রুটি যদি একেবারেই অমার্জনীয় হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত অন্য কোনো নীচ জাতের মধ্যে স্থান নিতে সে বাধ্য হয়,—বা হয়তো, সে ধর্মান্তর গ্রহণ করতে বাধ্য হয়; বা গ্রাম ছেড়ে শহরে—যেখানে জাতের শাসন অপেক্ষাকৃত কম কঠোর,—পালাতে বাধ্য হয়।

আমাদের যুক্তি হলো, এই শাসন-ব্যবস্থা ও শাস্তি-ব্যবস্থা উভয়ের মধ্যেই ট্রাইব্যাল-সমাজের শাসন-ব্যবস্থা ও শাস্তি-ব্যবস্থার অভ্রান্ত ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়(২৪৪)। তাই, এদিক থেকেও জাত-ব্যবস্থাকে (caste-system-কে) ট্রাইব্যাল-সমাজের অসমাপ্ত বিলোপের পরিচায়ক বলে অনুমান করবার সুযোগ রয়েছে।

অবশ্যই, কোনো-কোনো লেখক স্বীকার করছেন, দেশের পিছিয়ে-পড়া মানুষগুলির মধ্যে জাতিভেদ-প্রথার যে পরিচয় তা ট্রাইব্যাল-সংগঠনেরই রূপান্তর মাত্র। এমনকি caste of the tribal type
(!) বা ট্রাইব্যাল-ধরনের জাত বলে শব্দ ব্যবহারও চোখে পড়ে(২৪৫) :

…there are totemistic clans which are found amongst the castes of the tribal type. The totem is some animal or vegitable formerly held in reverence by the members of the clan and associated with some taboo; but by the time a tribe has developed into a caste, the origin of the name has generally been forgotton, and the same itself transformed.
অর্থাত, ট্রাইব-ধরনের জাতগুলির মধ্যে টোটেম্‌-বিশ্বাসমূলক ক্লান রয়েছে। ক্লানের সভ্যরা যে-জন্তু বা গাছগাছড়াকে আগে শ্রদ্ধা করতো এবং যেগুলির সঙ্গে কিছু কিছু নিষেধের সম্পর্ক ছিলো সেইগুলিই হলো টোটেম্‌। কিন্তু একটি ট্রাইব উন্নত হতে হতে জাত-এ পরিণত হবার পর এই টোটেম্‌-মূলক নামটির উৎস সাধারণত বিস্মৃত হয় এবং নামটি বদলে যায়।

এই ধরনের মতবাদের বিরুদ্ধে নানান আপত্তি ওঠে।

প্রথমত, এখানে caste of the tribal type বা ট্রাইব্যাল-ধরনের জাত বলে এক রকম বিশিষ্ট জাতের কথা বলা হচ্ছে। আর ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে, যে-কথা বা যে-বৈশিষ্ট্য এই নির্দিষ্ট জাতগুলি সম্বন্ধে প্রযোজ্য তা থেকে সাধারণভাবে জাতিভেদ-প্রথার রহস্য বোঝবার চেষ্টাটা সঙ্গত হবে না। এবং এই ইঙ্গিতটিই হলো আলোচ্য মন্তব্যের প্রধান দুর্বলতা। কেননা, দেশের ওই পিছিয়ে-পড়া মানুষগুলির মধ্যে ট্রাইব্যাল-সংগঠন ও জাত-সংগঠনের সীমারেখা অস্পষ্ট বলেই বা জাতিভেদ-প্রথাটি অন্যান্য ক্ষেত্রে যে-রকম কঠিনভাবে দানা বেঁধেছে ও একেবারে স্বতন্ত্র একটি প্রথার রূপ পেয়েছে তার অভাব বলেই,—এইখান থেকে মূলসূত্র পেয়ে জাতিভেদ-প্রথার অন্যান্য দৃষ্টান্তগুলিকে বোঝবার সম্ভাবনা সত্যিই রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, লেখন বলছেন by the time a tribe has developed into a caste, ইত্যাদি। এ-কথার তাৎপর্য ঠিক কী? লেখক কি সাধারণ নিয়ম হিসেবে ট্রাইবের পক্ষে কাস্ট-এ পরিণত হবার কথা বলেছেন? কিন্তু যদি এটা সমাজ-বিকাশের কোনো সাধারণ নিয়মই হয় তাহলে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও জাত-প্রথা দেখা দেয়নি কেন?

এই তথাকথিত ট্রাইব্যাল ধরনের জাত-গুলির বৈশিষ্ট্য বিচার করেই যে উচ্চ-বর্ণগুলির রহস্য অনুসন্ধান করবার অবকাশ আছে তার নমুনা উল্লেখ করা যায়। উক্তি জাতগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে কয়েকটি বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়ার দরকার : ১) প্রত্যেকটি জাতের মধ্যে ছোটোছোটো কয়েকটি করে গোষ্ঠী রয়েছে। ২) এই গোষ্ঠীগুলি বহির্বিবাহমূলক বা exogamous : গোষ্ঠীর অন্তর্গত কেউই অপর কাউরে বিয়ে করতে পারবে না। ৩) গোষ্ঠীগুলির নামকরনের মধ্যে টোটেম্‌-বিশ্বাসের চিহ্ন থেকে গিয়েছে।

ব্রাহ্মণাদি উচ্চ-বর্ণের মধ্যেও ছোটো ছোটো গোষ্ঠী রয়েছে। এগুলিকে বলা হয় গোত্র। গোত্র মানে ঠিক কী, তা নির্ণয় করবার জন্য আধুনিক বিদ্বানেরা বহু গবেষণা করেছেন(২৪৬) এবং এ-বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, এখনো অনেক গবেষণা বাকি আছে। কিন্তু গবেষক যদি ট্রাইব্যাল-সমাজ সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে-পারা জ্ঞানের উপর নির্ভর করে এগোতে রাজি না হন তাহলে তাঁর পক্ষে অজস্র উক্তির জটিলতায় দিক্‌ভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। কেননা, “বৌধায়ন, আপস্তন্ব, সত্যাষাঢ়, কুটিল, ভরদ্বাজ, লৌগাক্ষি, কাত্যায়ন ও আশ্বলায়ন প্রভৃতি রচিত শৌতসূত্রে, মৎস্যপুরাণে, ভারতাদি ইতিহাসে ও মনু প্রভৃতি প্রণীত স্মৃতিসমূহে অল্পবিস্তর গোত্রের বিবরণ আছে, কিন্তু ইহার অনেক স্থলেই এক গ্রন্থের সহিত অপর গ্রন্থের বিরোধ বা মতভেদ দেখিতে পাওয়া যায়, সাধারণে সহজে তাহার প্রকৃত অর্থ গ্রহণ করতে পারে না”(২৪৭)। এবং, পুরুষোত্তমের গোত্রপ্রবরমঞ্জরী, ধনঞ্জয়ের ধর্মপ্রদীপ, বালম্ভট্ট ও মহাদেবদৈবজ্ঞের গোত্রপ্রবর, বিষ্ণুপণ্ডিতের গোত্রপ্রবরদীপ, অনন্তদেব, আপদেব, কেশব, জীবদেব, নারায়ণভট্ট, ভট্টোজি, মাধবাচার্য ও বিশ্বনাথদেব রচিত গোত্রপ্রবর নির্ণয়, লক্ষনণভট্টের প্রবররত্ন, গোত্রপ্রবরভাস্কর এবং কমলাকরের গোত্রপ্রবরদর্পণ প্রভৃতি গ্রন্থও(২৪৮) গবেষকের জটিলতা-বোধ দূর করতে পারবে না; কেননা, অনেক পরের যুগে রচিত বলেই এই গ্রন্থগুলির মূল চেষ্টা হলো পরের যুগের সমাজব্যবস্থাকে ও শাসনব্যবস্থাকে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতিপন্ন করা(২৪৯)।

অতএব ভেবে দেখা যাক, ট্রাইব্যাল-সংগঠন সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে-পারা তথ্যের দিক থেকে গোত্র-র মূল লক্ষণগুলি বিচার করে গোত্র-ব্যবস্থার উৎস সম্বন্ধে কোনো কথা অনুমান করা যায় কি না।

১। সগোত্র বিবাহ নিষেধ : “মনু প্রভৃতি স্মৃতি-প্রণেতাগণ, বৌধায়ণ, আপস্তম্ব প্রভৃতি সূত্রকারগণ ও মৎস্য প্রভৃতি পুরাণকার সকলেই সগোত্র-বিবাহ নিষেধ করিয়াছেন। ভ্রান্তি অথবা অপর কোনো কারণে সগোত্রে বিবাহ করিলে যথানিয়মে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়, প্রায়শ্চিত্তের পরে সেই স্ত্রীর সহিত মাতার ন্যায় ব্যবহার করিবে। কখনও তাহাকে গ্রহণ করিবে না, এবং সেই স্ত্রীও তাহাকে আপন সন্তানের ন্যায় দেখিবে।”(২৫০)

২। গোত্রান্তর্গত সকলেরই পূর্বপুরুষ এক। পাণিনি(২৫১) বলছেন, “অপত্যং পৌত্রপ্রভৃতি গোত্রম্‌”। কথাটাকে আর একটু সরল করবার জন্যে ব্যাখ্যাকার(২৫২) বলছেন, “জনস্য পৌত্র-প্রপৌত্র-বৃদ্ধপ্রপৌত্রাদি অন্তরাপত্যং গোত্রম্‌ উচ্যতে। গোরাপত্যম্‌ অন্তরাপত্যম্‌ ব্যবহিতাপত্যম্‌ পৌত্র-প্রপৌত্র-বৃদ্ধপ্রপৌত্র-প্রভৃতিকম্‌ ইতি যাবৎ।…অনন্তরাপত্যম্‌ অব্যবহিতাপত্যং পুত্রঃ কন্যা চ উচ্যতে”। গোত্রান্তর্গত সকলে একই পূর্বপুরুষের বংশধর।

৩। গোত্রনামগুলির মূলে টোটেম্‌-বিশ্বাসের পরিচয়। পুরোনো পুঁথিপত্রে বহু গোত্রের নাম পাওয়া যায় এবং বৌধায়ন-এর রচনা(২৫৩) থেকেই বোঝা যায় এককালে সত্যিই প্রায় অসংখ্য গোত্র ছিলো। এই নামগুলি প্রায়ই জন্তু-জানোয়ার বা গাছগাছড়ার নাম থেকে এসেছে, তাই এগুলি যে আদিতে টোটেম-বিশ্বাসের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলো সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। ব্রাহ্মণাদি উচ্চ-বর্ণেরই অন্তর্গত কয়েকটি বিখ্যাত গোত্রনামের নমুনা দেখা যাক : ভরদ্বাজ (ভরত পাখি থেকে), গোতম (গোরু থেকে), কাশ্যপ (কাছিম থেকে), শুনক (কুকুর থেকে), মৌদ্গল্য (মাগুর মাছ থেকে), কৌশিক (পেঁচা থেকে), শাণ্ডিল্য (পাখি থেকে), বাৎস (বাছুর থেকে), মাণ্ডুকেয় (ব্যাঙ থেকে), দার্ভায়ন (দূর্বাঘাস থেকে), তৈত্তিরীয় (তিতির পাখি থেকে),—ইত্যাদি ইত্যাদি(২৫৪)। অবশ্যই, পরবর্তী যুগে রচিত মতবাদের দরুন গোত্রগুলির এই টোটেমিক উৎসের কথাটা অনেকাংশেই ঢাকা পড়ে গিয়েছে—তখন থেকে কশ্যপ প্রমুখকে কল্পনা করা হয়েছে কোনো-এক আদি-ঋষি হিসেবেই,—কাশ্যপ গোত্রের সকলেই যেন সেই ঋষিটির বংশধর। কিন্তু এ-কল্পনা যে কৃত্রিম ও অর্বাচীন তা দেখতে পাওয়া কঠিন নয় : ওই ধরনের নাম শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের মধ্যে চোখে পড়ে না, আজো আমাদের দেশের ট্রাইব্যাল ও আধা-ট্রাইব্যাল সমাজের মধ্যে ক্লান-নাম ও গোত্রনাম হিসেবেই টিকে আছে(২৫৫)। রিজলি তাঁর ভারতবর্ষের মানুষ সম্বন্ধে বিখ্যাত বইটিতে ফর্দ করে দিয়েছেন, আমাদের দেশের পিছিয়ে-পড়ে-থাকা মানুষদের মধ্যে কতো গোত্রনামের উৎস জন্তু-জানোয়ার বা গাছগাছড়ার নাম থেকে। বৌধায়ন প্রমুখের গ্রন্থেও সেকালের অজস্র গোত্রনামের পরিচয় পাওয়া যায়(২৫৬)। এই দুটি ফর্দকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করে দেখলে গোত্র-ব্যবস্থার উৎপত্তি-সংক্রান্ত সমস্যার উপর আলোকপাত হতে পারে।

গোত্র প্রসঙ্গে প্রধানত তিনটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা গেলো। এই বৈশিষ্ট্যগুলির দিকে লক্ষ্য রাখলে এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকে না যে, এমন কি উচ্চ-জাতি বা উচ্চ-বর্ণের বেলাতেও ট্রাইব্যাল-সমাজের ক্লান বা গেন্‌স্‌ নামের ছোটোছোটো মানবগোষ্ঠীগুলি থেকেই এই গোত্রগুলির উৎপত্তি হয়েছিলো। আধুনিক লেখকদের মধ্যে অনেকেই প্রায় বাধ্য হয়ে ‘গোত্র’ কথাটির প্রতিশব্দ হিসেবে ক্লান শব্দই ব্যবহার করে থাকেন(২৫৭)। কিন্তু ঠিক এই কারণেই ট্রাইব্যাল-ধরনের-জাত (caste of the tribal type) নাম দিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকারের কোনো জাতের কথা কল্পনা না করে বরং অনুমান করা উচিত যে, দেশের ওই পিছিয়ে-পড়া মানুষগুলির মধ্যে জাত-সংগঠন সংক্রান্ত যে-কথা অমন স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেই কথাটিকেই মূলসূত্র হিসেবে ব্যবহার করে উচ্চ-বর্ণগুলির মধ্যে জাতিভেদ-প্রথা সংক্রান্ত যে-কথা জটিল, অস্পষ্ট ও আব্‌ছা হয়ে রয়েছে তা বোঝবার অবকাশ সত্যিই আছে। অথচ, সমাজের নিচু-মহলের মানুষগুলির কাছ থেকে মূলসূত্র পেয়ে উঁচু-মহলের মানুষগুলির মধ্যে একই প্রথার রহস্য বোধবার চেষ্টা সাধারণত করা হয় না। তাই, বৌদ্ধ-যুগের ভারতবর্ষে জাতিভেদ-প্রথার রূপটিকে বিশ্লেষণ করবার সময় রিচার্ড ফিক্‌-এর(২৫৮) মতো বিদ্বানও যদিও স্পষ্টই দেখছেন, নিচু-মহলের মানুষ-গুলির বেলায়—জাতকের গল্পে যাদের হীনজাতীয় বা হীন-সিপ্পনি বলা হয়েছে—জাতিব্যবস্থাটা ট্রাইব্যাল ব্যবস্থামাত্রই, তবুও তিনি উচ্চ-বর্ণগুলির বেলায় স্বতন্ত্র ধরনের মূলসূত্র অনুসরণ করে জাতিভেদপ্রথার রহস্য-উদ্ঘাটন করবার চেষ্টা করেছেন।

অবশ্যই আপত্তি উঠবে, জাতিভেদ-প্রথার আলোচনায় শুধুমাত্র এই বিবাহ-ব্যবস্থার উপর দৃষ্টি রাখলে সে-আলোচনা একপেশে এবং অসম্পূর্ণ হবে। কেননা, বিবাহ-ব্যবস্থা যদিও জাতিভেদ-প্রথার একটি মূল-বৈশিষ্ট্য তবুও তার আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো বৃত্তি বা পেশার অপরিবর্তনীয়তা। এরই দরুন, কথার কাজ হিসেবে জাত-ব্যবসায় কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। অর্থাৎ, জাতিভেদ-প্রথার আর একটি মূল লক্ষণ হলো, কেউই জন্মগত পেশা ছেড়ে অন্য পেশা গ্রহণ করতে পারবে না।

উত্তরে বলা যায়, প্রথমত, বৃত্তির অপরিবর্তনীয়তা জাতিভেদ-প্রথার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলেও বিবাহ-প্রথার মতো মৌলিক লক্ষণ নয়। ফিক্‌(২৫৯) প্রমুখ পণ্ডিতেরাই দেখাচ্ছেন, বৃত্তির অপরিবর্তনীয়তা সেকালের সম্পূর্ণ অলঙ্ঘনীয় ছিলো না, একালেও নয়। তাছাড়া, জৈনদের মধ্যেও জাতিভেদ-প্রথা আছে, কিন্তু তার বৈশিষ্ট্য হিসেবে বৃত্তির অলঙ্ঘনীয়তা চোখে পড়ে না(২৬০); তার বদলে প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে ওই বিবাহ-ব্যবস্থাই দেখা যায়। তাই উভয়-বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিবাহ-বিধিকেই তুলনায় বেশি মৌলিক মনে করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, বৃত্তির অপরিবর্তনীয়তা বলে লক্ষণটির ব্যাখ্যাও একই দিক থেকে পাওয়া অসম্ভব নয়। কেননা, ট্রাইব্যাল সমাজের উচ্চতর পর্যায়ে দেখতে পাওয়া যায় এক-একটি ক্লানের মধ্যে এক-একটি বৃত্তি স্থিরনিশ্চয় হয়ে আসবার লক্ষণ(২৬১)। বস্তুত, মধ্যযুগের ইয়োরোপের গিল্ড প্রথার উৎপত্তিতে ট্রাইব্যাল-সমাজের এই বৈশিষ্ট্যটিই ছিলো। অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন(২৬২) লিখছেন,

. . as Gronbech has shown, the guild is descended from the clan. The only structural difference between them is that membership of ihe guild is not determined by birth, except m so far as the son becomes eligible by following his father’s vocation; and even the primitive clan commonly admits strangers by adoption Since the craft clan is a widespread feature of the higher stages of tribal society, there is no difficulty in supposing that it existed in primitive Attica; and even if it did not, at least there existed the primitive clans out of which the craft clans subsequently developed.
অর্থাৎ, গ্রন্‌বেক্‌ দেখিয়েছেন, ক্লান থেকেই গিল্ড-এর জন্ম। মধ্যযুগের গিল্ড কারিকর-ক্লানেরই উচ্চতর পর্যায়মাত্র। দু’-এর গড়নে একমাত্র তফাত হলো, গিল্ড-এর অন্তর্ভূক্ত হওয়ার ব্যাপারটা জন্মগত নয়; তবে পিতার বৃত্তি অনুসরণ করে অবশ্য পুত্রও গিল্ডের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। আদিম ক্লানগুলিও বাইরের লোককে প্রায়ই ক্লানের মধ্যে গ্রহণ করে। যেহেতু ট্রাইব্যাল-সমাজের উচ্চতর পর্যায়ে কারিকর-ক্লান বহুলভাবেই চোখে পড়ে সেইহেতু প্রাচীনকালের এ্যাট্টিকাতেও যে তা ছিলো সে-কথা কল্পনা করতে বাধা নেই; আর তা যদি নাও থেকে থাকে তাহলে অন্তত আদিম ক্লান নিশ্চয়ই ছিলো, যা থেকে পরবর্তী সময়ে কারিকর-ক্লানের উৎপত্তি হয়েছে।

কারিকর-ক্লানের বেলায় বৃত্তিটা জন্মগত, মধ্যযুগের ইয়োরোপীয় সামন্ত-সমাজে তা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে উৎপাদন পদ্ধতির অগ্রগতি ট্রাইব্যাল-সমাজকে স্বাভাবিকভাবে ধ্বংস করে সামন্ত-সমাজের নতুন ভিত্তি স্থাপন করেনি। ইয়োরোপীয় অর্থে সামন্ত-সমাজ আমাদের দেশে খুব সম্ভব সত্যিই দেখা দেয়নি। তাই ইয়োরোপীয় অর্থে গিল্ডও বোধহয় নয়। আমাদের দেশের সমাজে উচ্চতর পর্যায়ের বৃত্তি-ব্যবস্থাটা ট্রাইব্যাল-সমাজের উচ্চতর পর্যায়ের কারিকর-ক্লানের মতোই প্রধানত জন্মগত ও অলঙ্ঘনীয় হয়ে থেকেছিলো। একেও ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপের পরিণাম মনে করবার অবকাশ আছে।

জাতিভেদ-প্রথার অন্যান্য নানা বৈশিষ্ট্যেরও এই দিক থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া অসম্ভব নয়। যেমন ধরা যায়, একত্রে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বাছ-বিচারের কথা। এর মধ্যেও ট্রাইব্যাল-সমাজেরই ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। কেননা, ট্রাইব্যাল-সমাজেও পংক্তিভোজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বস্তুত, রিস্‌ ডেভিড্‌স্‌(২৬৩) স্বীকার করছেন, জাতিভেদ-প্রথার বিবাহভিত্তিমূলক লক্ষণটির মতোই পংক্তিভোজন সংক্রান্ত এই লক্ষণটিতেও প্রাচীন সমাজেরই স্বাক্ষর রয়েছে।

আগেই বলেছি, আধুনিক অনেক লেখকদের রচনাতেই এ-কথা স্বীকৃত হতে দেখা যায় যে, ট্রাইব্যাল-সংগঠন-এর বৈশিষ্ট্য থেকেই জাতিভেদ-প্রথার বৈশিষ্ট্যগুলির উৎপত্তি হয়েছে। এদিক থেকে, এমিএল সেনা-র(২৬৪) রচনাই বোধহয় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য—বিশেষ করে এই কারণে যে জাতিভেদ-প্রথার বৈশিষ্ট্য-ব্যাখ্যায় তিনিও ওই বিবাহ-বিধিমূলক লক্ষণটির উপরই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন। কিন্তু ট্রাইব্যাল-সংগঠন থেকে ঠিক কীভাবে জাতিভেদ-প্রথার উৎপত্তি হয়েছে এ-প্রশ্নের মীমাংসা এখনো হয়নি। অথচ, এই প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, আদিতে ট্রাইব্যাল-সমাজ শুধু আমাদের দেশেই ছিলো না; সবদেশেই এবং অনিবার্যভাবেই ছিলো। কিন্তু জাতিভেদ-প্রথা অন্যান্য দেশে দেখা যায় না। তাই একে ট্রাইব্যাল-সমাজের স্বাভাবিক পরিণাম বলে মনে করবার সুযোগও সত্যিই নেই।

এখানে বিশেষ করে আর একটি বিষয়ের দিকে নজর রাখতে হবে। ট্রাইব্যাল-সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যাল-সমাজের ব্যবস্থাগুলি ছিলো উদ্দেশ্যমূলক—এগুলি মানুষকে বাঁচাতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এই ব্যবস্থাগুলিই জাতিভেদ-প্রথার বৈশিষ্ট্য হিসেবে রূপান্তরিত হবার পর হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবনের পরিপন্থী,—বাচবার পথে সবচেয়ে বড়ো বাধা। জাতিভেদ-প্রথাটি আমাদের জাতীয়-জীবনের পথে যে কী প্রচণ্ড বাধার রূপ ধারণ করেছিলো তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন নেই; এ-বিষয়ে দেশপ্রেমিকদের সহস্র উক্তি এবং আমাদের মতো সাধারণ দেশবাসীদের তিক্ততম অভিজ্ঞতা রয়েছে(২৬৫)। মার্ক্‌স্‌(২৬৬) বলেছিলেন, ভারতবর্ষের উন্নতি ও শক্তিলাভের পথে সবচেয়ে বড়ো বাধা হলো এই জাতিভেদ-প্রথা এবং দেশে উৎপাদন-পদ্ধতির উন্নততর পর্যায়ের প্রচলনই এই চূড়ান্ত বাধাটিকে ভাঙতে পারবে :

Modern industry, resulting from the railway system, will dissolve he hereditary division of labour, upon which rest the Indian castes, those decisive impediments to Indian progress and Indian power.
অর্থাৎ, রেল-ব্যবস্থা প্রসূত আধুনিক শ্রমশিল্প জন্মগত শ্রমবিভাগকে বিনষ্ট করবে; এই শ্রমবিভাগের উপরই প্রতিষ্ঠিত হলো ভারতবর্ষের উন্নতির ও শক্তিলাভের পথে চূড়ান্ত বাধাস্বরূপ জাতিভেদ-প্রথা।

আমাদের যুকি হলো, ট্রাইব্যাল-সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলি ট্রাইব্যাল-সমাজের প্রাণশক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিরুদ্ধে পরিবেশে গ্রথিত হলে পর আদি-তাৎপর্যের দিক থেকে সেগুলি বিপরীতে পর্যবসিত হতে বাধ্য হয়। এককালে যা-ছিলো উদ্দেশ্যমূলক, তাই হয়ে দাঁড়ায় উদ্দেশ্য-বিরোধী। এবং এই কারণেই আমরা বলতে চাই, জাতিভেদ-প্রথা নিয়ে যাঁরা গবেষনা করছেন তাদের পক্ষে ট্রাইব্যাল-সমাজ, সে-সমাজের বৈশিষ্ট্য, এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলির আদি-তাৎপর্য সংক্রান্ত স্পষ্ট জ্ঞান থাকা দরকার।

———————————
২২৬ P. V. Kane HD 2:19 “The number of works dealing with the origin and characteristics of the caste system in India is legion.”
২২৭ P. V. Kane op. cit. 2:19ff. দ্রষ্টব্য।
২২৮ R. Fick SONIBT 1-2. cf T. W. R. Rhys Davids BI preface.
২২৯ T. W. Rhys Davids BI and R. Fick SONIBT.
২৩০ Fick op. cit. 10.
২৩১ Ibid.
২৩২ Ibid.
২৩৩ Ibid.
২৩৪ Ibid. 4-7.
২৩৫ Ibid. 2-3.
২৩৬ কিন্তু ট্রাইব ও কাস্ট-এর মধ্যে সাদৃশ্য কোথায় এবং প্রভেদই বা কী সে-বিষয়ে আলোচনা তাঁরা তোলেন না।
২৩৭ R. V. Russel and Hirala TCCPI 2:29, 39, 80.
২৩৮ H. L. Morgan AS 86.
২৩৯ Ibid. 124ff.
২৪০ G. Thomson AA ch. 2.
২৪১ Ibid.
২৪২ H. L. Morgan AS 84-5, 73.
২৪৩ ERE 3:232.
২৪৪ অবশ্যই মহামহোপাধ্যায় পি. ভি. কানে (HD 2:24) এই পঞ্চায়েতকে জাতি-ব্যবস্থার অপরিহার্য লক্ষণ মনে করেননি; তার কারণ বোধ হয় এই যে, তিনি প্রধানতই ব্যবস্থাটির স্মৃতিশাস্ত্র-বর্ণিত রূপের প্রতিই দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেছেন। E. Senart (Cl 66-73) পঞ্চায়েতকে জাতি-ব্যবস্থার অপরিহার্য লক্ষণ মনে করেন।
২৪৫ ERE 3:233. অন্যান্য লেখকও caste-এর আলোচনা-প্রসঙ্গে বিনা-দ্বিধায় tribe শব্দ ব্যবহার করে থাকেন।
২৪৬ R. Fick in ERE 6:353-88; P. V. Kane HD 2:479-501.
২৪৭ বিশ্বকোষ ৫:৫০০।
২৪৮ ঐ।
২৪৯ স্মৃতিশাস্ত্র-বর্ণিত জাতি-ব্যবস্থা প্রসঙ্গে রিস্‌-ডেভিড্‌স্‌ বা ফিক্‌-এর মন্তব্য স্বভাবতই স্মৃতিশাস্ত্র-বর্ণিত গোত্র-ব্যবস্থা প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য।
২৫০ বিশ্বকোষ ৫:৫০০।
২৫১ পাণিনি ৪.১.১৬২।
২৫২ প্রভাখ্য-টীকা।
২৫৩ বিশ্বকোষ ৫:৫০৩।
২৫৪ বিশ্বকোষ ৫:৫০৩-৪। ক্ষিতিমোহন সেন-এর জাতিভেদ এবং M. Monier-Williams SED দ্রষ্টব্য।
২৫৫ যথা মাহিলীদের মধ্যে (ক্ষিতিমোহন সেন : জাতিভেদ ১০২) একটি গোত্রের নাম হস্তোয়ার—সংস্কৃত তর্জমায় আমরা তাকেই বলবো কাশ্যপ। বস্তুত, এই কাছিমের নাম থেকেই ক্লানের নামকরণ করবার দৃষ্টান্ত অ-ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যেও দুর্লভ নয়—H. L. Morgan AS দ্রষ্টব্য।
২৫৬ বিশ্বকোষ ৫:৫০৩-৪।
২৫৭ রাসেল প্রমুখের রচনা দ্রষ্টব্য। cf. ERE 3:233 “castes are divided not only into sub-castes or endogamous groups, within whose limits marriage must take place, but also into exogamous sections—septs, gotras or class—the members of which are regarded as so closely related that they ar not allowed to intermarry.”
২৫৮ R. Fick SONIBT ch. 12.
২৫৯ এই প্রসঙ্গে ফিক্‌-উদ্ধৃত দশব্রাহ্মণ-জাতক (SONIBT 217ff) বিশেষ চিত্তাকর্ষক। cf. ERE 3:231. “In most parts the dom is a scavenger and basket-maker, but in Kashmir he is a cultibatorm in Kumaon a stone-mason, in Assam a fisherman and in the Orissa states a hewer and splitter wood.”
২৬০ ERE 8:238.
২৬১ G. Thomson AA 44.
২৬২ Ibid. 45.
২৬৩ T. W. Rhys Davids BI 38f.
২৬৪ E. Senart CI cf. Ibbotson PC.
২৬৫ যদিও বিদ্বান-বিশেষ এই প্রথারই ভূয়সি প্রশংসা করছেন। যথা : S. Low VI 262-3; Abbe Dubois—see Kane HD 2:20.
২৬৬ K. Marx FRBRI.