প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১২. গণ মানে কী? মহাভারতের বর্ণনা

গণ মানে কী? মহাভারতের বর্ণনা

একরকম সঙ্ঘের বিশেষণ হিসেবে পাণিনি ‘আয়ুধজীবী’ শব্দ ব্যবহার করছেন। এ-শব্দের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা একটু পরেই তোলা যাবে। এই প্রসঙ্গেই পাণিনি(১২৭) খবর দিচ্ছেন যে, উক্ত সঙ্ঘগুলি বাহীক দেশস্থিত। এই বাহীক দেশস্থিত সঙ্ঘের বর্ণনা মহাভারতে বিস্তারিতভাবেই পাওয়া যায়। মহাভারতের বর্ণনায় এই মানুষগুলি সম্বন্ধে যে তীব্র ঘৃণার মনোভাব ফুটে উঠেছে তার কারণ নিয়ে আলোচনা অবশ্যই স্বতন্ত্র। আপাতত আমাদের প্রশ্ন হলো, এই বর্ণনার মধ্যে সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ছবি পাওয়া যায় না, আদিম সমাজের কোনো এক পর্যায়ের ছবি পাওয়া যায়? কালিপ্রসন্ন সিংহের(১২৮) তর্জমা থেকে এই বর্ণনা উদ্ধৃত করা যাক। কর্ণ বলছেন,

হে মদ্ররাজ! আমি ধৃতরাষ্ট্র সমীপে ব্রাহ্মণ মুখে যাহা শ্রবণ করিয়াছি, তুমি অবহিত হইয়া তাহা শ্রবণ কর। ব্রাহ্মণগণ ধৃতরাষ্ট্রমন্দিরে বিবিধ বিচিত্র দেশ ও পূর্বতন ভূপতিগণের বৃত্তান্ত কহিতেন। তথায় একদা এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বাহীক ও মদ্রদেশোদ্ভব ব্যক্তিদিগকে নিন্দা করত কহিতে লাগিলেন, হে রাজন্‌! যাহারা হিমালয়, গঙ্গ, সরস্বতী, যমুনা ও কুরুক্ষেত্রের বহির্ভাগে এবং যাহারা সিন্ধুনদী ও তাহার পাঁচ শাখা হইতে দূর প্রদেশে অবস্থিত, সেই সমস্ত ধর্মবর্জিত অশুচি বাহীকগণকে পরিত্যাগ করা কর্তব্য।…আমি নিতান্ত নিগূড় কার্যানুরোধ বশতঃ বাহীকগণের সহিত বাস করিয়াছিলাম। তন্নিবন্ধন তাহাদের ব্যবহার বিদিত হইয়াছে।…তথায় আচারভ্রষ্ট ব্যক্তিরা গৌড়ীসুরা পান এবং লণ্ডনের সহিত ভৃষ্ট যব, অপুপ ও গোমাংস ভোজন করিয়া থাকে। কামিনীগণ মত্ত, বিবস্ত্র ও মাল্যচন্দন রহিত হইয়া নগরের গৃহ-প্রাচীর সমীপে নৃত্য এবং গর্দভ ও উষ্ট্রের ন্যায় চিৎকার করিয়া অশ্লীল সঙ্গীত করিয়া থাকে। তাহারা স্বপরপুরুষ বিবেক-বিহীন হইয়া স্বেচ্ছাক্রমে বিহার করত উচ্চৈস্বরে পুরুষগণের প্রতি আহ্লাদজনক বাক্য প্রয়োগ করে। একদা একজন বাহীক কুরুজাঙ্গলে অবস্থান পূর্বক অপ্রফুল্ল মনে করিয়াছিল, আহা! সেই সূক্ষ্মকম্বলবাসিনী গৌরী আমাকে স্মরণ করিয়া শয়ন করতেছে। হায়! আমি কতদিনে রম্যা, শতদ্রু ও ইরাবতী উর্ত্তীর্ণ হইয়া স্বদেশে গমনপূর্বক সেই কম্বলাজীর্ণসংবীত স্থূল ললাটাস্থিসম্পন্ন গৌরীগণের মনঃশিলার ন্যায় উজ্জ্বল অপাঙ্গদেশ, ললাট, কপাল ও চিকুরে অঞ্জনচিহ্ন এবং গর্দভ, উষ্ট্র ও অশ্বতরের শব্দতুল্য মৃদঙ্গ, আনক, শঙ্খ ও মর্দলের নিস্বন সহকারে কেলিপ্রসঙ্গ অবলোকন করিব। হায়! কত দিনে শমী, পীলু ও করবীরের অরণ্যে চক্রসমবেত অপুপ ও শক্তুপিণ্ড ভোজন করত সুখী হইব…

সেই ব্রাহ্মণ পুনরায় যাহা কহিলেন, তাহাও শ্রবণ কর। বাহীক দেশে শাকল নামে এক নগর আছে। তথায় এক রাক্ষসী প্রতি কৃষ্ণা চতুর্দশীর রজনীতে দুন্দুভিধ্বনি করত এইরূপ সঙ্গীত করিয়া থাকে যে, আহা! আমি কতদিনে পুনরায় এই শাকল নগরে সুসজ্জিত হইয়া গৌরীগণের সহিত গৌড়ীসুরা পান এবং গোমাংস ও পলাণ্ডুযুক্ত মেষমাংস ভোজন করিয়া বাহেয়িক সঙ্গীত করিব। যাহারা, বরাহ, কুক্কুট, গো, গর্দভ, উষ্ট্র ও মেষের মাংস ভোজন না করে, তাহাদের জন্ম নিরর্থক! হে শল্য! শাকলদেশের আবালবৃদ্ধ সকলেই সুরাপানে মত্ত হইয়া এইরূপ সঙ্গীত করিয়া থাকে; এতএব তাহাদিগের ধর্মজ্ঞান কিরূপে সম্ভাবিত হইতে পারে?

হে মদ্ররাজ, আর এক ব্রাহ্মণ কুরুসভার যাহা কহিয়াছিলেন, তাহাও শ্রবণ কর। হিমাচলের বহির্ভাগে, যে স্থানে পীলু বন বিদ্যমান আছে এবং সিন্ধু ও তাহার শাখা শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তা নদী প্রবাহিত হইতেছে, সেই অরট্টদেশ নিতান্ত ধর্মহীন; তথায় গমন করা অবিধেয়। ব্রাহ্মণ, দেবতা ও পিতৃলোক ধর্মভ্রষ্ট সংস্কারহীন অরট্টদেশীয় বাহিকদিগের পূজা গ্রহণ করেন না…

হে শল্য! কুরুসভায় বিপ্র আরো যাহা করিয়াছিলেন, আমি তাহা তোমার নিকট কীর্তন করিতেছি। যে ব্যক্তি যুগন্ধরে উষ্ট্রাদির দুগ্ধ পান, অচ্যুত স্থলে বাস বা ভূতিলয়ে স্নান করে তাহার কিরূপে স্বর্গলাভ হইবে? পঞ্চনদী পর্বত হইতে নিঃসৃত হইয়া যে স্থলে প্রবাহিত হইতেছে, সেই স্থলের নাম অরট্ট; সাধুলোক তথায় কদাচ দুইদিন অবস্থান করিবেন না। বিপাশা নদীতে বাহ ও বাহীক নামে দুইটি পিশাচ আছে। বাহকেরা তাহাদেরই অপত্য। উহারা প্রজাপতির সৃষ্ট নহেল সুতরাং হীনযোনি হইয়া কিরূপে শাস্ত্রবিহিত ধর্ম পরিজ্ঞাত হইবে। ধর্মবিবর্জিত কারস্কর মাহিষক, কালিঙ্গ, কেরল, কর্কোটক ও বীরকগণকে পরিত্যাগ করা কর্তব্য। হে মহারাজ! সেই ব্রাহ্মণ তীর্থগমনানুরোধে সেই অরট্টদেশে এক রাত্র অবস্থান করিয়াছিলেন। ঐ রজনীতে এক উলুখলমেখলা রাক্ষসী তাঁহাকে এই সকল বৃত্তান্ত কহিয়াছিল। সেই অরট্টদেশে এক রাত্র অবস্থান করিয়াছিলেন। ঐ রজনীতে এক উলুখলমেখলা রাক্ষসী তাঁহাকে এই সকল বৃত্তান্ত কহিয়াছিল। সেই অরট্টদেশ বাহীকগণের বাসস্থান, তথায় যে সকল হতভাগ্য ব্রাহ্মণ বাস করে, তাহাদের বেদাধ্যয়ন বা যজ্ঞানুষ্ঠান কিছুই নাই। দেবগণ সেই ব্রতবিহীন দুরাচারদিগের অন্ন ভোজন করেন না। অরট্টদেশের ন্যায় প্রস্থল, মদ্র, গান্ধার, খস, বসাতি, সিন্ধু ও সৌবীর দেশে এই কুৎসিত ব্যবহার প্রচলিত আছে।

হে শল্য! আমি পুনরায় তোমাকে এক উপাখ্যান কহিতেছি…কিছুদিন হইল, এক ব্রাহ্মণ আমাদের ভবনে অতিথি হইয়াছিলেন…(তিনি কহিলেন)…গান্ধার মদ্রক ও বাহীকেরা সকলেই কামাচারী, লঘুচেতা ও সংকীর্ণ।…হে মদ্রাধিপ! আমি আর একজনের নিকট বাহীকদিগের যে কুৎসিত কথা শ্রবণ করিয়াছিলাম, তাহাও কহিতেছি…। পূর্বে অরট্টদেশীয় দস্যুরা এক পরিব্রতা সীমন্তিনীকে অপহরণ পূর্বক তাঁহার সতীত্ব ভঙ্গ করিলে তিনি শাপ প্রদান করিয়াছিলেন যে, হে নরাধমগণ! তোমরা অধর্মাচরণপূর্বক আমার সতীত্ব ভঙ্গ করিলে; অতএব তোমাদিগের কুলকামিনীগণ সকলেই ব্যাভিচারিণী হইবে । আর তোমরা কখনই এই ঘোরতর শাপ হইতে বিমুক্ত হইবে না। হে শল্য! এই নিমিত্তই অরট্টদিগের পুত্রেরা ধনাধিকারী না হইয়া ভাগিনেয়গণই ধনাধিকারী হইয়া থাকে।…

পাণিনি যদি স্পষ্টভাষায় বলে থাকেন এ-হেন বাহীকরাই আয়ুধজীবী সঙ্ঘের বা গণের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত(১২৯) তাহলে নিশ্চয়ই মহাভারতে পাওয়া তাদের এই বর্ণনা গণসমাজের অর্থ-নির্ণয় কাজে বিশেষভাবে সহায়ক হবে। অধ্যাপক জয়সওয়াল অবশ্যই মহাভারতের এই অংশকে অগ্রাহ্য করেননি। কিন্তু এই দীর্ঘ বর্ণনা থেকে তিনি শুধুমাত্র একটি তথ্য উদ্ধার করবার চেষ্টা করছেন : সেকালের ভারতবর্ষের ঠিক কোন অংশে বাহীকদের বাস ছিলো(১৩০)! বলাই বাহুল্য, সে-তথ্য তুচ্ছ নয়; কিন্তু তাই বলে এ-বর্ণনায় বাহীকদের সমাজ-জীবন সংক্রান্ত যে সাধারণ ছবিটি পাওয়া গেলো তাকেও অবজ্ঞা করা উচিত নয়। অথচ, অধ্যাপক জয়সওয়াল তা অবজ্ঞা করছেন। তার কারণ কি এই যে, সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামোয় এ-বর্ণনায় পুরতে গেলে কাঠামোটিই ভেঙে চৌচির হবার ভয়?

অবশ্যই, মহাভারতের সংবাদদাতাদের বর্ণনায় বাহীকদের প্রতি একটা তীব্র ঘৃণার ভাব রয়েছে। সেই ঘৃণার প্রভাবে তাঁরা কিছুকিছু কাল্পনিক কথা এই বর্ণনায় জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে বাহীকদের সমাজ-জীবন সংক্রান্ত কিছু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলির দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখলে আমরা দেখতে পাবো, এ-বর্ণনা প্রাগ-রাষ্ট্র ট্রাইব-সমাজেরই ইঙ্গিত দেয়।

বাহীকদের সম্বন্ধে মহাভারতের সংবাদদাতাদের মনে যা নিয়ে সবচেয়ে তীব্র ঘৃণা প্রথমে তারই আলোচনা করা যাক : বাহীকদের মধ্যে যৌন-নিষ্ঠার অভাব। এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, সভ্য-সমাজের কাছে পরিবার জীবন বা দাম্পত্য-ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় বাহীকদের মধ্যে মহাভারতের সংবাদদাতা তা দেখতে পাননি। কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে রাখতে হবে, সভ্য-সমাজের এই দাম্পত্য-জীবন চিরন্তন নয় : প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক মানবজাতিই সভ্যতার দিকে এগোবার পথে যে-পর্যায়গুলি উর্ত্তীর্ণ হয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে সেগুলির মধ্যে আধুনিক বিবাহ-সম্পর্ক অনুপস্থিত। আমরা আগেই দেখেছি, মর্গানের পরিভাষা অনুসারে মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছে বন্য-দশার নিম্ন স্তর থেকে; তারপর বন্য-দশার মধ্য ও উচ্চ স্তর পেরিয়ে মানুষ বর্বর-দশায় উঠে এলো এবং এই বর্বর-দশারও নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ এই তিনটি স্তর পেরোলে পরই মানুষের পক্ষে সভ্যতার আওতায় পৌঁছোনো সম্ভব। এবং মর্গান দেখালেন, বন্য-দশার আগাগোড়া এবং বর্বর-দশার নিম্ন ও মধ্য স্তর পর্যন্ত কোথাও আধুনিক দাম্পত্য-সম্পর্কের বা এক-বিবাহের পরিচয় নেই(১৩১) :

…it (অর্থাৎ, আধুনিক বিবাহ-সম্পর্ক) was preceded by more ancient which prevailed universal throughout the period of savagery through the Older and into the Middle Period of barbarism; and that neither the monogamian nor the patriarchal can be traced back to the Later Period of barbarism. They were essentially modern.
অর্থাৎ, বন্য-দশার আগাগোড়াই, এবং বর্বর-দশার আদ্য ও মধ্য স্তর পর্যন্ত সর্বত্রই, আধুনিক দাম্পত্য-সম্পর্কের তুলনায় প্রাচীনতর নরনারী-সম্পর্ক বর্তমান ছিলো। উচ্চ-বর্বর স্তরের আগে পর্যন্ত কোথাও এ-বিবাহ বা পিতৃ-প্রধান পরিবারের চিহ্ন পাওয়া যায় না। এগুলি একান্তই আধুনিক।

মর্গাএর এই সিদ্ধান্তের পক্ষে প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে। কেননা, যদিও বন্য-দশার নিম্ন স্তরে আজ আর কোনো মানবদলকে স্বচক্ষে দেখবার উপায় নেই তবুও বন্য-দশার মধ্য-স্তর থেকে শুরু করে বর্বর দশার মধ্য-স্তর পর্যন্ত প্রতিটা অবস্থায় আটকে-পড়ে-থাকা বিভিন্ন মানবদলকে প্রত্যক্ষভাবেই জানতে পারা গিয়েছে এবং দেখা গিয়েছে এই অবস্থাগুলির কোথাও আধুনিক দাম্পত্য-সম্পর্কের পরিচয় নেই। মনে রাখতে হবে, মানবজাতির যে-কোনো শাখাই সভ্যতার স্তরে পৌঁছুক না কেন তার পক্ষে বন্য-দশার নিম্ন-স্তর থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়েছে এবং তারপর ধাপে ধাপে বন্য-দশার মধ্য ও উচ্চ স্তরে উঠে ও তারপর বর্বর-দশার নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ স্তর পার হয়ে সভ্যতার পর্যায়ে পৌঁছুনো সম্ভব হয়েছে।

আমাদের যুক্তি হলো, ভূয়োদর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত মর্গানের এই সিদ্ধান্তগুলিকে প্রাচীন সমাজ সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে পারা বৈজ্ঞানিক মূলসূত্র হিসেবে গ্রহণ করেই প্রাচীন পুঁথিতে বর্ণিত সেকালের মানুষদের সমাজ-জীবনকে সনাক্ত করবার চেষ্টা করতে হবে। তাই এ-জাতীয় কোনো বর্ণনায় যদি আধুনিক দাম্পত্য-সম্পর্কের অভাব দেখা যায় তাহলে অনুমান করবার সুযোগ থাকে যে, বর্ণিত মানবদল বর্বর-দশার উচ্চ স্তরের আগেকার  কোনো পর্যায়ে জীবন যাপন করতো। আলোচ্য ক্ষেত্রে, বাহীকদের মধ্যে আধুনিক সাম্পত্য-সম্পর্কের অভাব চোখে পড়ে। তাই তাদের সমাজ-জীবন বর্বর-দশার উচ্চ-স্তরের আগেকার কোনো এক পর্যায়ের বলেই অনুমান করা স্বাভাবিক। এই অনুমান গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, বর্বর-দশার মধ্য-স্তরের পর থেকেই ট্রাইব্যাল-সমাজে,–বা আদিম সাম্যসমাজে,–ভাঙন শুরু হয়েছে(১৩২)। অতএব, পাণিনিত মতে এই বাহীকদের সমাজই যদি গণ-সমাজের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয় তাহলে স্বীকার করা দরকার যে, গণ বলতে প্রাগ-বিভক্ত ট্রাইব্যাল-সমাজই হওয়া স্বাভাবিক।

মর্গানের গবেষণা থেকেই সাধারণ বৈজ্ঞানিক মূলসূত্র হিসেবে আমরা আরো জেনেছি যে, মানব-ইতিহাসে এক-বিবাহমূলক সাম্পত্য-সম্পর্কের আবির্ভাব ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার আবির্ভাব সম্পর্কহীন ঘটনা নয়(১৩৩)। বর্বর-দশার উচ্চ-স্তরে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত শুধুই এক-বিবাহ নয়, রাষ্ট্র-ব্যবস্থারও পরিচয় নেই। আর যদি তাই হয় তাহলে বাহীকদের ওই গণ-সংগঠনকে কোনো রকম রাষ্ট্র-সংগঠন বলে অনুমান করারও সুযোগ নেই। গণ বলতে প্রাগ-রাষ্ট্র ট্রাইব্যাল সমাজই বুঝিয়েছে। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে যাঁরা ‘গণ’কে সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা বলে মনে করেছেন তাঁদের কাছে প্রাক-রাষ্ট্র ট্রাইব্যাল সমাজের ধারণাটিই সুস্পষ্ট নয়(১৩৪)। তাই, গণের মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ষোলো-আনা আয়োজন দেখে তাঁরা অনুমান করেছেন যে, সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া গণ আর কিছুই নয়। কিন্তু, গণতন্ত্র অতএব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র—এ-অনুমান বিজ্ঞানসম্পত নয়। কেননা, অধ্যাপক জর্জ টমসন(১৩৫) দেখাচ্ছেন, এমনকি গ্রীক নগররাষ্ট্রগুলিতেও ট্রাইব্যাল সমাজের মতো আদি ও অকৃত্রিম-গণতন্ত্রের আয়োজন ছিলো না।

অবশ্যই, মহাভারতের সংবাদদাতারা যদি বাহীকদের মধ্যে প্রচলিত নরনারী-সম্পর্ককে আরো খুঁটিয়ে বর্ণনা করতেন তাহলে আমাদের পক্ষে তাদের সমাজ-জীবনকে আরো সুনিশ্চিতভাবে সনাক্ত করবার সুযোগ বাড়তো। কেননা, আদিম সাম্যসমাজেরও একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে—বন্য-দশার মধ্য-স্তর থেকে শুরু করে বর্বর-দশার মধ্য-স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত সেই ইতিহাস। তেমনি, আধুনিক দাম্পত্য-জীবনের আগে পর্যন্ত যে-নরনারীসম্পর্ক তার মধ্যেও রূপান্তর ঘটেছে(১৩৬)। তাই প্রাচীনকালের কোনো মানবদলের মধ্যে প্রচলিত নরনারী-সম্পর্কের স্পষ্টতর বর্ণনা পাওয়া গেলে তারই উপর নির্ভর করে অনুমান করবার সুযোগ থাকে, বর্ণিত মানবদল আদিম-সমাজের কোন পর্যায়ে বাস কতো(১৩৭)। কিন্তু আমাদের দেশের প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে অতোখানি খুঁটিয়ে অনুমান করবার সুযোগ সত্যিই পাওয়া যায় না। তার কারণ, এই পুঁথিগুলির সংবাদদাতাদের উদ্দেশ্য প্রাচীন সমাজ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সরবরাহ করা নয়, তার বদলে ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রচার। ফলে, তথ্যের দিক থেকে প্রায়ই তাঁদের বর্ণনা অস্পষ্ট ও পর্যাপ্ত—মোটের উপর শুধু এইটুকুই বোঝা যায় যে, বর্ণিত মানুষগুলির মধ্যে এক-বিবাহ বা আধুনিক দাম্পত্য-সম্পর্কের পরিচয় নেই। আমাদের মূল যুক্তির পক্ষে অবশ্য আপাতত এই তথ্যটুকুই পর্যাপ্ত বলে স্বীকৃত হতে পারে। কেননা, এর থেকে যদিও অনুমান করা যায় না যে, বর্ণিত মানবদল প্রাগ-বিভক্ত সমাজের ঠিক কোন পর্যায়ে বাস করতো তবুও একথা অনুমান করবার সুযোগ থাকে যে, তারা প্রাগ-বিভক্ত সমাজের কোনো-এক স্তরে জীবন যাপন করতো। সুখের বিষয়, এ-ক্ষেত্রে মহাভারতের ওই বর্ণনার মধ্যেই আরো একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত থেকে গিয়েছে। ইঙ্গিতটি হলো, বাহীকদের মধ্যে প্রচলিত উত্তরাধিকার-সূত্র : তস্মাত্তেষাং ভাগহরা ভাগিনেয়া ন সূনবঃ—তাদের মধ্যে পুত্রেরা ধনাধিকারী না হয়ে ভাগিনেয়রাই ধনাধিকারী হয়। এই উত্তরাধিকার-সূত্রকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টীকাকার নীলকণ্ঠ কী রকম কাল্পনিক কথা বলছেন তার নমুনা আমরা আগেই দেখেছি (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, উপসংহার অধ্যায়)। এ-জাতীয় উদ্ভট কথা তিনি কল্পনা করেছেন, তার কারণ প্রাচীন সমাজ-সংক্রান্ত সাধারণ তথ্যের উপর নির্ভর না করেই তিনি এই উত্তরাধিকার সূত্রটিকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন। অথচ, প্রাচীন সমাজ-সংক্রান্ত তথ্যের দিক থেকে এই উত্তরাধিকার-সূত্রে মাতৃ-প্রধান সমাজের চিহ্ন থেকে গিয়েছে। আজো আমাদের দেশের মাতৃপ্রধান অঞ্চলগুলিতে(১৩৮) এ-জাতীয় উত্তরাধিকার ব্যবস্থা টিকে থাকতে দেখা যায়। পূর্ণাঙ্গ মাতৃ-প্রধান-সমাজে উত্তরাধিকারসূত্র ছিলো মায়ের দিক থেকে মেয়ের দিকে। এই ব্যবস্থারই কিছুটা রদবদল হয়ে মামার দিক(১৩৯) থেকে ভাগনের দিকে উত্তরাধিকারসূত্র প্রবর্তিত হলো। তারপর, শেষ পর্যন্ত মাতৃ-প্রধান সমাজ সম্পূর্ণভাবে ভেঙে যাবার পর, যখন পূর্ণ পিতৃ-প্রধানসমাজ দেখা দিলো তখন উত্তরাধিকারসূত্র হলো পিতা থেকে পুত্রের দিকে। মাতুল থেকে ভাগিনেয়র দিকে উত্তরাধিকারসূত্র যতোদিন বর্তমান ততোদিক পর্যন্ত সমাজ-সংগঠনে মাতৃ-প্রাধ্যান্যের লক্ষণ রয়েছে বলে অনুমান করা যায়। মাতৃ-প্রধান সমাজ ঠিক কী ও কেন—এ-প্রশ্ন নিয়ে একটু পরেই দীর্ঘতর আলোচনা তোলা যাবে। আপাতত এ-বিষয়ে অধ্যাপক জর্জ টমসনের(১৪০) নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত আমাদের মূল যুক্তির পক্ষে প্রাসঙ্গিক হবে :

…the social dominance of the  female sex tend to go with the survival of common ownership.
অর্থাৎ, নারীজাতির সামাজিক প্রতিপত্তির সঙ্গে যৌথ-সম্পত্তিত যোগাযোগ আছে।

মহাভারত-বর্ণিত ওই উত্তরাধিকার-সূত্রে যদি নারীজাতির সামাজিক প্রতিপত্তির স্বাক্ষর,–বা অন্তত স্পষ্ট স্বারক,–থাকে তাহলে তারই মধ্যে যৌথজীবনের ইঙ্গিত থেকে গিয়েছে একথা অনুমান করবার অবকাশ আছে না কি?

আমাদের মূল যুক্তির পক্ষে এই যৌথ-জীবনের ইঙ্গিতটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, গণ-সংক্রান্ত আরো কয়েকটি শব্দের মধ্যে যেখানে ওই যৌথ-জীবনের ইঙ্গিতটি স্পষ্ট সেই শব্দগুলির উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। গণদ্রব্য(১৪১) বলতে বোঝায়, সাধারণের দ্রব্য—যে দ্রব্যের স্বামী অনেকে এবং একত্রিতভাবে। গণচক্রক(১৪২) বলতে বোঝায় একত্র ভোজন। গণান্ন(১৪৩) বলতে বোঝায় বহুস্বামীক অন্ন—যাতে অনেকের সত্ত্ব আছে। অবশ্যই, মনু যে-হেতু গণজীবনকে সুনজরে দেখেননি সেই হেতুই তাঁর কাছে এই গণান্ন নিন্দনীয়(১৪৪) : গণান্নং গণিকান্নঞ্চ লোকেভ্যঃ পরিকৃন্ততি—গণান্ন ও গণিকান্ন ভোজন করলে তপস্যাসিদ্ধ স্বর্গাদিলোক থেকে বিচ্যুত হতে হয়। ভ্রাতৃবর্গ অথবা বন্ধুবর্গের অনুষ্ঠেয় মরুৎস্তোম নামের যজ্ঞকে কাত্যায়নের শৌতসূত্রে গণযজ্ঞ(১৪৫) বলা হয়েছে। গণবন্ধন শব্দের তাৎপর্য ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই জাতীয় শব্দগুলির মধ্যে থেকে গণ-এর যৌথজীবনবাচকতাই ফুটে ওঠে।

—————————
১২৭. পাণিনি ৫.৫.১১৪।
১২৮. মহাভারত (কালীপ্রসন্ন সিংহ) ১১১৫-৭।
১২৯. K. P. Jayaswal op. cit 1:36.
১৩০. Ibid. 1:38.
১৩১. H. L. Morgan AS 393.
১৩২. F. Engels OFPPS 257ff.
১৩৩. H. L. Morgan AS 393ff.
১৩৪. এই কারণে অধিকাংশ লেখকই ‘tribe’ শব্দটিকে প্রায় নির্বিচারে ব্যবহার করে থাকেন।
১৩৫. G. Thomson SAGS ch. Iii.
১৩৬. H. L. Morgan AS Part III.
১৩৭. যদিও অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন যে বিবাহ-সম্পর্ক পরিবর্তিত হতে তুলনায় বেশি সময় লাগতে পারে; তাই এ-অনুমান যন্ত্রচালিতের মতো করা সঙ্গত নয়।
১৩৮. উত্তরে খাসি এবং দক্ষিণে নায়ারদের দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য। O. R. Ehrenfels MI দ্রষ্টব্য।
১৩৯. G. Thomson SAGS 155.
১৪০. Ibid. 71-2.
১৪১. বিশ্বকোষ ৫:১৯৮।
১৪২. ঐ।
১৪৩. ঐ ৫:২০০।
১৪৪. মনু ৪.২১৯।
১৪৫. কাত্যায়ন ২২.১১.২ cf. বিশ্বকোষ ৫:২০০।