প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

২২. আর্যদের আদিপর্ব

আর্যদের আদিপর্ব

ছান্দোগ্যের ওই কুকুরগুলি সত্যিই বড়ো আশ্চর্য মানুষ! সমাজ-বিকাশের আদি-পর্যায় সম্বন্ধে ওরা আমাদের নানান তথ্য দিলো। শুধু তাই নয়। ওরাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, বৈদিক মানুষদেরও একটা আরো অতীত ইতিহাস আছে। সেই আদি-পর্যায়ের সঙ্গে উত্তর-পর্যায়ের আকাশ-পাতাল তফাত। কেননা, অন্নলাভার্থে তারা যে-গান জুড়ে দিলো তারই মধ্যে অতীতকালের স্মৃতিকে উদ্বুদ্ধ করবার আয়োজন রয়েছে আর সে আয়োজনের সাহায্যের আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে অতীতকালটা কতোই না অন্যরকম!

প্রাচীন ভারতের ঐতিহাসিক কান পেতে শুনুন :

দেবঃ বরুণঃ প্রজাপতিঃ সবিতা অন্নম্‌ ইহ আহরৎ
–দেবতা বরুণ, প্রজাপতি, সবিতা এইখানে অন্ন আহরণ করেছিলেন (বা, বৈদিক প্রয়োগ অনুসারে, আহরৎ=আহরতু, আহরণ করুন)।

উত্তরযুগে সংহিতায় প্রসিদ্ধ এই দেবতাগুলির মাহাত্ম্য যেভাবে বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে তার সঙ্গে এই দৃশ্যের কোনো মিল নেই। কেননা, বেদের দেবতাগুলিকে এখানে দেখছি অন্ন-আহরণে নিযুক্ত; অথচ উত্তরকালে এঁদের সম্বন্ধে যে-ধারণা প্রচারিত হয়েছে তার সঙ্গে আর যাই হোক অন্ন-আহরণ প্রচেষ্টার কোনো সংশ্রব নেই! কিন্তু কুকুরদের গান থেকেই প্রমাণ হয় যে, এককালে তা ছিলো। মানবশ্রম দিয়ে সৃষ্ট অন্নের অংশ গ্রহণ করবার বদলে দেবতারাই অন্ন-আহরণ কাজে অংশ গ্রহণ করতেন! তার মানে, উত্তরকালে শুধুই যজ্ঞ ছন্দ আর সামগানের অর্থই বদলায়নি, বদলে গিয়েছে শ্রমের প্রতি মনোভাব আর তারই অঙ্গ হিসেবে দেবতা নামের তাৎপর্যও। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে দীর্ঘতর আলোচনার অবকাশ পাবো, এবং তখনই আমরা দেখবো উক্ত পরিবর্তন অকারণ নয়। কেননা, এর মূলে রয়েছে মানবসমাজে শ্রেণীবিভাগের বিকাশ।

কিন্তু শ্রেণীবিভাগের আগে, কোনো এক আদিম যুগে, বৈদিক মানুষেরাই যে প্রাগ-বিভক্ত সমাজে জীবন-যাপন করতো তার স্মৃতি বৈদিক সাহিত্যের অনেক তথ্যই অর্থহীন হয়ে থাকবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ছান্দোগ্য-উপনিষদের একটি অংশের উল্লেখ করলাম।  আধুনিক কালের ধ্যানধারণাকে যদি একমাত্র সম্বল মনে করা যায় তাহলে এই অংশটির কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়াই সম্ভব নয়, কিংবা, বড় জোর এর উপর একটি কাল্পনিক অর্থ আরোপ করে পাণ্ডিত্যের নামে আত্মপ্রবঞ্চনা করা যায়। অথচ, সমাজ বিকাশের আদিম পর্যায়ের কথা মনে রেখে এবং সে-পর্যায়ের মানুষদের জীবন ধারণ প্রণালী ও ধ্যানধারণা সম্বন্ধে সাধারণভাবে যা জানা গিয়েছে তার উপর নির্ভর করে এই অংশটির অর্থ অনুসন্ধান করলে এর পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক ব্যাখায় খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। তাই, আমরা এই পরিচ্ছেদে সামগাননিরত কুকুরগুলির কথা দীর্ঘভাবে আলোচনা করলাম এবং দেখাবার চেষ্টা করলাম এমন এক পদ্ধতি সত্যিই পাওয়া যাচ্ছে যার সাহায্যে প্রাচীন পুঁথিপত্রের অনেক আপাত-অর্থহীন অংশেরও অর্থ নির্ণয় করা অসম্ভব নয়। এবং এই পদ্ধতির উপর নির্ভর করে অগ্রসর হয়েই আমরা মানতে বাধ্য হলাম, উত্তরকালে বেদপন্থী ও বেদনিন্দুকদের মধ্যে মতাদর্শগত প্রভেদ যতো প্রকটই হোক না কেন বৈদিক সাহিত্যের অনেক স্মারকের সাহায্যে লোকায়তিক ধ্যানধারণা বুঝতে পারা অসম্ভব নয়। কেননা, বৈদিকই হোক আর লোকায়তিকই হোক, কোনো ধ্যানধারণাই মানবনিরপেক্ষ নয়—মানুষের জীবনযাপন প্রণালীর উপরই ধ্যানধারণাগুলি নির্ভর করে। এবং বৈদিকই হোক, আর অবৈদিকই হোক, মানবজাতির সমস্ত শাখাই সভ্যতার দিকে অগ্রসর হবে পথে একের পর এক কয়েকটি নির্দিষ্ট পর্যায় পেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এই পর্যায়গুলির মধ্যে কোনো এক পিছিয়ে-পড়া পর্যায়েই হলো লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস—বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকেরা উত্তরযুগে সে-পর্যায়ের ধ্যানধারণাকে যতোই ঘৃণা করতে শিখুন না কেন তাঁদেরই পূর্বপুরুষেরা এককালে সেই পর্যায়েই জীবনধারণ করতেন আর তাই তাঁদের পরবর্তী কালের রচনাতেও সে-পর্যায়ের ধ্যানধারণার কিছুকিছু স্মারক থেকে গিয়েছে।

ছান্দোগ্য-উপনিষদের আলোচিত অংশটির কথাই ভেবে দেখুন। এর মধ্যে অধ্যাত্মবাদের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাবেন না। পরম পুরুষার্থ হিসেবে এখানে যেটুকুর উল্লেখ তা ভক্ষ্য অন্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই, এখানের ধ্যানধারণাটা লোকায়তিক। কিংবা, চর্বণ বা খাওয়াদাওয়ার উৎসাহ থেকেই যদি চার্বাক নাম এসে থাকে(১২৭) তাহলে যারা ‘ওম্‌ অদাম, ওম্‌ পিবাম’ বলে গান জুড়ে দিলো তাদেরও চার্বাক ছাড়া আর কী নাম দেওয়া যায়? এবং আরো বিস্ময়কর কথা হলো, এরা শুধু নিজেরাই চার্বাক নয়—সংহিতায় প্রসিদ্ধ দেবতাদেরও নিজেদের দলে টানছে। বরুণ। প্রজাপতি। সবিতা। তার মানে, এককালে ওই দেবতাগুলিও লোকায়তিক ছিলেন নাকি? কিংবা, ঘুরিয়ে বললে বলা যায়, সমাজ-বিকাশের এমন কোনো পর্যায়ের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিলো যে-পর্যায়ে অধ্যাত্মবাদের উৎপত্তি হয়নি। এই সূত্রেই মনে রাখা দরকার, বৈদিক দেবতাদের সঙ্গে প্রাগ্‌-অধ্যাত্মবাদী বা লোকায়তিক ধ্যানধারণার সম্পর্ক দেখে আজকের দিনে আমরা যতোই বিস্মিত হই না কেন, প্রাচীনদের কাছে ঘটনাটি সত্যিই তেমন বিস্ময়কর নয়। কেননা, দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে বৃহস্পতিই হলেন লোকায়ত-দর্শনের আদিগুরু।

———————-
১২৭. চার্বাক নামের গুণরত্ন প্রদত্ত ব্যাখায় এই গ্রন্থের ৪৩৬ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য।