প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৪. টোটেম বিশ্বাস ও আদিম সাম্যসমাজ

টোটেম বিশ্বাস ও আদিম সাম্যসমাজ

ভারতবর্ষের প্রাচীন পুঁথিপত্রে টোটেম-বিশ্বাসের চিহ্ন যে রয়েছে এ-কথা বলায় নিশ্চয়ই আজকের দিনে আর তেমন কোন অভিনবত্ব নেই। কেননা, বহু গবেষকই আজ এ-কথা স্বীকার করছেন। কিন্তু এ-জাতীয় চিহ্নের প্রকৃত তাৎপর্য কী? এই প্রশ্ন নিয়ে এখনো খুব স্পষ্ট আলোচনা হয় নি। তার কারণ, টোটেম-বিশ্বাস বলতে প্রায়ই একরকম আদিম ধর্মবিশ্বাস মনে করা হয়; অথচ টোটেম-চিহ্ন থেকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে যা প্রমাণিত হয় তা এক রকমের সমাজ-সংগঠন।

 Unfortunately, many writers have used the term totemism very loosely for any beliefs and practices dependent upon some supposed connection between animals and persons. The term should be restriction between animals and persons. The term should be restricted to those cases where a systematic association of groups of persons with species of animals (occasionally plants or inanimate objects) is connected with a certain element of social organizations.(৮৫)
দুঃখের বিষয় অনেক লেখকই টোটেম-বিশ্বাস বলে নামটি অসাবধান ভাবে ব্যবহার করেন। তাঁদের ধারণায় জন্তু-জাওয়ারের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক-সূচক যে-কোনো বিশ্বাস বা ক্রিয়াকর্মকেই এ-নাম দেওয়া যায়। শব্দটি শুধুমাত্র সেই সব দৃষ্টান্তের মধ্যে আবদ্ধ রাখা দরকার যেখানে মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট প্রজাতির জানোয়ারের সুপরিকল্পিত সম্পর্কের কথা একরকম সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত।

ওই সমাজ-সংগঠনের কথাটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। টোটেম-বিশ্বাস থেকে সেই সমাজ-সংগঠনকে অনুমান করা দরকার।

কোনো ধরনের সমাজ-সংগঠন? একমাত্র উত্তর হলো : আদিম সাম্য-সমাজ, যে-সমাজে ছোটো-বড়োয়তফাত দেখা দেয় নি—সামাজিক শক্তির দিক থেকে নয়, ঐশ্বর্যের দিক থেকেও নয়। সবাই সমান, সবাই স্বাধীন, মানুষে মানুষে সত্যিই ভাই-ভাব ভাব। মনে রাখতে হবে, এই আদিম সাম্য-সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপরই রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হয়েছে। অন্তত প্রাচীন মিশরের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তির এই অভ্যুত্থান-ইতিহাস স্পষ্ট ভাবে উদ্ধার করেছেন মরেট আর ডেভি(৮৬)। ছান্দোগ্য-বর্ণিত কুকুরদের সামগানটুকু বোঝবার জন্যে অবশ্যই ওই টোটেম-সমাজের ধ্বংসকাহিনী বা রাষ্ট্রশক্তির অভ্যুত্থান-কাহিনী নিয়ে আলোচনা তোলবার দরকার নেই। দরকার হলো, টোটেম-সমাজের স্বরূপটিকে চেনবার। এ-বিষয়ে মরেট এবং ডেভির সিদ্ধান্তই উদ্ধৃত করা যাক :

The true totemic society, remarks M. Moret, knows neither kings nor subjects. It is democratic or communistic; all the members of the clan live in it on a footing of equality with respect to their totem.(87)
অর্থাৎ, এম. মরেট বলছেন, প্রকৃত টোটেম-সমাজে না আছে রাজা না প্রজা। এ-সমাজ গনতান্ত্রিক, বা সাম্যবাদী; গোষ্ঠীর সমস্ত মানুষই টোটেমটির সম্পর্কে সমানে সমান।

কিংবা

The active and passive subjects of obligation are collective in the regime of the totemic clan. Power, like responsibility, still has therein in undivided character. We are in the presence of a communal and equalitarian society in the bosom of which participation in the same totem which constitutes the essence of each and the cohesion of all, places all members of the clan on the same footing.(৮৮)
অর্থাৎ, টোটেম-গোষ্ঠীর পর্যায়ে কর্তব্যের সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় দুটো দিকই সমষ্টিগত। দায়িত্বের মতোই শক্তিরও তখন পর্যন্ত অবিভক্ত অবস্থা। আমরা এক সাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী সমাজের সম্মুখীন হই যার মধ্যে একই টোটেমে অংশগ্রহণ করবার দরুন সকলেরই সমান অবস্থা। এবং এই টোটেমের উভয়ই নির্ভর করছে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সত্তা এবং পরস্পরের মধ্যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক।

এই আদিম সাম্যসমাজের বর্ণনায় পরবর্তী পরিচ্ছেদে ফেরা যাবে। কিন্তু এখানে একটি সমস্যার অবতারণা করে রাখা যায় : টোটেম-সমাজ যদি সত্যিই এরকম অবিভক্ত সাম্যসমাজ হয় তাহলে তারই আওতায় কোনো রকম ধর্মচেতনা সত্যিই কি সম্ভবপর? মনে রাখা দরকার, ধর্মচেতনার মূল কথা হলো উপাস্য-উপাসকে প্রভেদ। যাঁরা ভুল করে টোটেম-বিশ্বাসকে ধর্মবিশ্বাস মনে করছেন তাঁদের ধারণায় সমাজ-বিকাশের ওই আদিম পর্যায়ে এক এক দল মানুষ এক একটি জন্তু-জানোয়ার বা গাছপালাকেই ভগবানের সামিল মনে করেছিলো : দলের সকলের কাছে দলের টোটেমটিই উপাস্যের স্থান দখল করেছিলো। কিন্তু টোটেম-বিশ্বাসকে ভাল করে পরীক্ষা করলেই বোঝা যায়, এ মতবাদ ঠীক নয়। যে-দলের টোটেম হলো সূর্যমুখী ফুল সে-দলের প্রত্যেকেই নিজেকে সূর্যমুখী ফুল মনে করছে। উপাস্য-উপাসকের তফাতটা কোথায়? আর যদি তাই হয়, তাহলে টোটেম-বিশ্বাসকে ধর্ম-বিশ্বাসেরই কোনো আদিম পর্যায় মনে করবার সত্যিই অবকাশ নেই। মনে রাখতে হবে, টোটেম-সমাজ ভেঙে যখন রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হচ্ছে,—যখন আদিম সাম্যের বদলে সমাজের সবটুকু শক্তি ও ঐশ্বর্য কেন্দ্রীভূত হচ্ছে শাসকের হাতে,—তখনই প্রকৃত অর্থে ধর্মবিশ্বাসের জন্ম। অবশ্যই, সমাজ-বিকাশের ওই নবপর্যায়ে আদিমকালের টোটেমটি যে বিলুপ্ত হতে বাধ্য এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু অন্তত তার জাতবদল হতে বাধ্য। তাই নতুন পর্যায়েও প্রায়ই সেই পুরোনো জানোয়ারটিকে খুঁজে পাওয়া যায়—কিন্তু তখন আর সে আদিম টোটেম নয়, তার বদলে এক নবজাত দেবতা। তফাতটা কম নয় : টোটেম-সমাজে যে-জানোয়ারটির সঙ্গে প্রত্যেক মানুষেরই একান্ত একাত্মবোধ ছিলো রাষ্ট্রের উৎপত্তির পর দেখা গেলো তারই সামনে মানুষেরা হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা-উপাসনা শুরু করেছে!

প্রাচীন মিশরের ইতিহাসকে উদ্ধার করবার প্রচেষ্টায় এই টোটেম-চিহ্নের গুরুত্ব মরেট এবং ডেভির গবেষণায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছে। রাষ্ট্রশক্তির উৎপত্তি এবং ধর্মবিশ্বাসের উৎপত্তি নিয়ে আমরা যখন আলোচনা তুলবো তখন স্পষ্টই দেখা যাবে এঁদের গবেষণা আমাদের পক্ষে কতোখানি সহায়ক। প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে যা স্পষ্ট ভাবে জানা গিয়েছে, তারই সাহায্যে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে আজো যা অস্পষ্ট হয়ে রয়েছে তা বোঝবার পথ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আপাতত আমাদের চেষ্টা হলো, ছান্দোগ্যের ওই সামগানরত “কুকুরগুলি”কে সনাক্ত করা। আশা করি টোটেম-বিশ্বাস নিয়ে যেটুকু আলোচনা তোলা হয়েছে তার সাহায্যে ওই কুকুরগুলিকে চিনতে আর কোনো অসুবিধা হবে না।

————-
৮৫.  W. E. Armstrong in EB 22.315.