2 of 4

২.৩৬ ছেলে অথবা মেয়ে

এ কাহিনী–পীর উমরআল হুমসির :

অতি প্রাচীন কালে বাগদাদ শহরে এক পরম বিদূষী রমণী বাস করতেন। সেই সময়ের সারা ইরাকে তাবৎ গুণী-জ্ঞানীরা তাকে জ্ঞান গরিমার সর্বোচ্চ আসনে বসিয়েছিলো। আজও সে এক কিংবদন্তী হয়ে আছে। তার অসাধারণ বিদ্যাবুদ্ধির বহু কাহিনী আজও গাথায় গল্পে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। লোকে তাকে গুরুর গুরু বলে ডাকতো। বহু দূর দেশ থেকে শত সহস্ব নরনারী আসতো তার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে। যখনই কোথাও কোনও কঠিন বিতর্ক উঠতো; মীমাংসার জন্য ছুটে আসতো তার কাছে। অনেক দুঃসাধ্য সমস্যার অতি সহজ সরল সমাধান করে দিতে পারতো সে। বিজ্ঞান, আইন, দর্শন, সাহিত্য তা যে কোনও বিষয়ের প্রশ্নই হোক না কেন, অত্যন্ত সাবলীল সহজ ভাবে উত্তর করে দিতে পারতে সে।

একদিন আমি আমার এক প্রবীণ বন্ধু অল সালিহানীকে সঙ্গে নিয়ে যথা নির্দিষ্ট এক সভাকক্ষে প্রবেশ করলাম। বিতর্ক শোনার জন্য বাগদাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সেদিন সেই সভাগৃহে সমবেত হয়েছিলো।

বিদুষী রমণীর নাম দাঁহিয়া। সে বসেছিলো একটা পর্দার আড়ালে।

আমি পূর্বাহ্নেই আমার নাম ধাম পাঠিয়েছিলাম তার কাছে। তার সঙ্গে আমি তর্কযুদ্ধে নামতে চাই। তাও তাকে জানিয়েছিলাম। বিষয়টা ধর্মের বিধান।

আমরা আসন গ্রহণ করলাম।

সালিহারী-ছেলেটিকে দেখামাত্র আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। চোখ আর ফেরাতে পারে না। ব্যাপারটা দহিয়ার নজর এড়ায় না। আমার বন্ধুর পরিচয় জিজ্ঞেস করলো সে। তারপর বললো, বৃদ্ধেরা ছোট ছোট মেয়েদের চাইতে বালকদের বেশি পছন্দ করে।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

তিনশো একানব্বইতম রজনীর মধ্য যামে আবার কাহিনী শুরু হয় :

আমার বন্ধু বললো, আপনি যথার্থই বলেছেন। কারণ আল্লাহ বালকদের দেহ-সৌষ্ঠব মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত এবং সুন্দর করে তৈরি করেন। আর আমার দৃষ্টি সব সময়ই সেরা সুন্দরের দিকে।

পর্দার আড়াল থেকে উচ্চকিত হাসির আওয়াজ আসে।

—চমৎকার। কিন্তু আপনি যদি আপনার গোঁ ধরে বসে থাকেন, আমি আপনাকে ছাড়বো না। আমার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামতে হবে। আমার বক্তব্য —মেয়েদের দেহই বেশি সুন্দর হয়।

তার এই প্রতিদ্বন্দিতার প্রস্তাব গ্রহণ করলে আমার সদাশয় বন্ধুটি। বললো, আমার প্রমাণের অর্ধেকটা যুক্তি দিয়ে বোঝাবো। বাকী অর্ধেকটা প্রমাণ করে দেবো পবিত্র গ্রন্থের বাণী এবং সুন্নী সূত্রাবলী থেকে।

কোরাণে আছে : পুরুষ নারী অপেক্ষা শ্রেয়, কারণ আল্লাহ তাদের শ্রেষ্ঠ উপাদানে সৃষ্টি করেছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে একজন পুরুষ একজন নারী অপেক্ষা সম্পত্তির দ্বিগুণ ভাগ পাবে। ভাই-এর অংশ বোনের দুই গুণ হবে। পবিত্ব বাণীর নির্দেশ একজন নারী একজন পুরুষের অর্ধেকের সমান।

সুন্নী পয়গম্বর বলেছেন। পুরুষের অবদান নারীর দ্বিগুণ।

তর্কের খাতিরেও বলবো, সমস্ত কাজে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পুরুষরাই প্রথমে এগিয়ে আসে। পুরুষরা সক্রিয় এবং নারীরা নিষ্ক্রিয়। সুতরাং অতীতের সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে বলা যায়, মেয়েরা সব সময়ই পুরুষের নিচে থেকেছে।

দাহিয়া বলে : আপনার যুক্তি যথার্থ, সন্দেহ নাই। আমি জানি আল্লাহ কোরাণে সাধারণ জ্ঞানে নারী অপেক্ষা পুরুষকেই বেশি পছন্দ করেছেন। কিন্তু তিনি কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেন নি। যদি আপনি সর্বাঙ্গ সুন্দরের কথাই তোলেন তবে শুধুমাত্র তা বালকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কেন? দাড়ি গোঁফওয়ালা বয়স্করা কী দোষ করলো? কিংবা কোনও সদাশয় প্রাজ্ঞ

সুতরাং নিখাদ–সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা ঐভাবে হতে পারে না।

আমার বন্ধু বলে?

একশোবার বলবো। আমি দাড়ি গোঁফওয়ালা, অথবা বুড়োদের চেয়ে সুকুমার কিশোর বালককেই বেশি ভালোবাসি। আপনি নিশ্চয়ই মানবেন, একটি নবযৌবনা, উদ্ভিন্ন তরুণী অপেক্ষা একটি সুন্দর সুঠামদেহী তরুণ বালকের আকর্ষণ অনেক বেশি। তার বিস্তৃত বক্ষটি তার শাল-প্রাংশু বাহুভূজ তার গানের লালিমা তার বিনয় নম্র স্মিত হাসি তার মোলায়েম কণ্ঠস্বর-সবই সুন্দরের প্রতীক। পয়গম্বর নিজেও বলেছেন, দাড়ি গোঁফবিহীন উঠতি বয়সের ছেলেদের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো না। ওদের চোখের লাস্য হুরীদের চোখের চাইতেও মারাত্মক।

কবি আবু নবাস বলেছেন :

আমার হৃদয়ের ভালোবাসায়
সে চির-যৌবনা হয়ে বেঁচে থাক।
তার প্রস্ফুটিত শতদল,
আর কিশোরের মতো জঙ্ঘা,
আমার রক্তে তুফান তোলে—

কিশোরের দেহ-সৌষ্ঠব যদি না যুবতীর চেয়ে সুন্দরই হবে তবে কবি তার সঙ্গে তুলনা করবেন কেন?

কিশোরের রূপ-লাবণ্যই শুধু আমাদের মুগ্ধ করে না, তাদের বিনম্র ব্যবহার, কণ্ঠের সুললিত ভাষায় আমাদের চিত্ত-বিভ্বম ঘটিয়ে দেয়।

দহিয়া এবার জবাব দেয় :

আপনার ঐ সব অদ্ভুত যুক্তি শুনে আমি হতভম্বী। যাই হোক, আল্লাহ। আপনার মঙ্গল করুন। আমার মনে হয়, তামাশা করার জন্যেই আপনি এই সব ছেদো যুক্তির অবতারণা করেছেন। কিন্তু এটা তো রঙ্গ তামাশার মজলিশ নয়। আমরা এখানে সমবেত হয়েছি কিছু সারগর্ভ আলোচনা করবো বলে। সত্যের অনুসন্ধান করাই এই বিতর্কের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই বলছি, কাঠ গোয়ারের মত নিজের ফালতু জিদ ধরে বসে থাকবেন না, আমি যা বলছি তা মেহেরবানী করে মগজে ঢোকাবার একটু কোসিস করবেন।

আল্লাহ নামে কসম খেয়ে বলুন তো, কোথায় কোন তরুণকে আপনি দেখেছেন যার অঙ্গ-সৌষ্ঠব এবং রূপলাবণ্য এক সুন্দরী তরুণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ? একটি তরুণীর ত্বক শুধু শুভ্র আর হালকাই নয় রেশমের মতো কোমলও। তার বক্ষপ্রদেশ এক মনোরম উপত্যক। তার মুখ প্রস্ফুটিত ফুলের কোরক। আর অধর শিশিরসিক্ত পাকা আঙুরের মতো। আপেল সদৃশ গাল। তার স্তনযুগল যেন ছোট দুটি কচি লাউ। তার কপালের চেকনাই আর চোখের বান পুরুষের বুকে আগুন ধরায়। যখন সে কথা বলে-যেন মুক্তো ঝরে। আর যখন সে খলখল করে হেসে ওঠে, মনে হয়। শান্ত স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে যেন কোন নদী গান গেয়ে বয়ে চলেছে। মধুর চেয়ে মধুময় এবং মাখনের মতো নরম তুল-তুলে সে হাসির বন্যা। কথা বলার সময় যখন তার গালে টোল খায়—সে সৌন্দর্যের তুলনা কোথায়? তার নাভিস্থল, জঙ্ঘা কী সুন্দর। তার উরু, পায়ের গোছা দেখে মনে হয় সন্দেশের ছাঁচে ঢালা। আপনি বয়সের ভারে ক্লান্ত, কী করে বুঝবেন এই সব যৌবনের জয়োল্লাস? তবে হয়তো খলিফাদের রোজনামচায় পড়ে থাকবেন, নারীর দেহরূপ বর্ণনায় তাঁরা কেমন পঞ্চমুখ ছিলেন। নারীর রূপ-লাবণ্যের গুণগান করতে করতে বহু জায়গায় তারা, তাদের অন্তরের শ্রদ্ধাভারে, অবনত হয়েছেন। যার প্রবল পরাক্রমে পৃথিবী পদানত সেই সিংহপুরুষরাও রূপবতী নারীর পায়ে মাথা কুটেছেন-সে কাহিনী কী আপনার অজ্ঞাত? শুধু একটি মাত্র নারীর জন্য কত শত সহস্ব মানুষ, সারা জীবনের সঞ্চিত ধনরত্ন, মা বাবা, আত্মীয় পরিজন পরিত্যাগ করে আত্ম-নির্বাসন নিয়েছেন।–তাও কী আপনাকে বলে দিতে হবে? শুধু তাদের মহিমাতেই দুনিয়া বেহেস্ত মনে হতে পারে। নারীর আকাঙ্ক্ষাতেই সূক্ষ্ম মসলিন আবিষ্কৃত হয়েছিলো। যত সূক্ষ্ম সূচীকর্ম দেখেন তা শুধুমাত্র নারীর মনোরঞ্জনের জন্যেই তৈরি হয়। শুধু তাদেরই কল্যাণে আমরা নানা সুগন্ধী আন্তর সংগ্রহ করে রাখি। কী, সত্যি কিনা বলুন? নারীর রূপ ঘর আলো করে রাখে। আবার তাদেরই কারণে কত। তখত হাত বদল হয়। কত দেশের নদীর জল রক্তে লাল হয়ে যায়।

আপনি পয়গম্বরের বাণী উদ্ধার করে বললেন, কচিকঁচা কিশোর তরুণদের চেখের পানে চেও না-ওদের চোখে একমন এক যাদু আছে যা বেহেস্তের পরীদের চোখেও নাই।

তবে দেখুন, তুলনা যখন তিনি করলেন, হুরীর সঙ্গেই করলেন। আর এই হুরী কোনও পুরুষ নয়—নারী।

আপনি সব সময়ই উঠতি বয়েসী কিশোর বালকের রূপ-লাবণ্যে পঞ্চমুখ হতে গিয়ে নারীর অঙ্গশোভার সঙ্গেই তুলনা করেছেন। বলিহারী যাই আপনার কদর্য রুচীর! এ জন্য আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত।

আপনি কী পবিত্র ধর্মগ্রন্থের সেই বিখ্যাত উপদেশের বাণী বিস্মৃত হয়েছেন? ভালোবাসা

করেন নি?’ আমি আপনার ঐ ছোকরা-শিকারী কবি মশাইকে খুব ভালো করেই জানি। আবু নবাস তো ছোকরা-খেকোর বাদশা। তারই একটা কবিতা থেকে শোনাচ্ছি :

এমন চাঁদপানা মুখ তোমার
কিন্তু পাছাখানা ভারি কই?
চুলগুলোও ছেটে ফেলেছে?
কিন্তু তোমার ঠোঁটের ঐ টসটসে আঙুর দুটো
চুষতে ভারি মিষ্টি লাগে।
শোন, খোকা, তোমার দেহে যে যাদু আছে,
তার দৌলতে, এই ধরায়
তুমি দু জাতেরই মহব্বৎ কুড়াবে।

রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

তিনশো বিরানব্বইতম রজনী :

আবার গল্প শুরু হয় :

খোদা মেহেরবান, তিনি নারী ও পুরুষকে পরস্পরের আনন্দ বিধানের জন্য দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তিনি যত পীর পয়গম্বর এবং ধর্মাত্মাদের ধরায় পাঠিয়েছেন তাদের সকলকেই আশ্বাস দিয়েছিলেন, তোমাদের যে কাজের জন্য পৃথিবীতে পাঠাচ্ছি তা যদি যথাযথ ভাবে সমাধা করে আসতে পারো। তবে ফিরে এসে এই বেহেস্তে সুন্দরী নারীর সুধাপান করতে পাবে। যদি সর্বমঙ্গলময় ভাবতেন, নারী সঙ্গ ছাড়াই পরমানন্দ পাওয়া যায়। তবে তিনি কী দুনিয়ায় নারী সৃষ্টি করে পাঠাতেন? আমাদের পয়গম্বর বলেছেন, এই তিনটি বস্তুর জন্য দুনিয়া আমার কাছে এত প্রিয়, নারী, সুগন্ধ এবং নামাজকালে আত্মার প্রশান্তি।

যাই হোক, আমি দেখছি। এই তর্ক-আলোচনা আমাকে ক্রমশ উত্তেজিত করে তুলছে। কিন্তু আমিও এক নারী। উত্তেজনা নারীর সহজাত শিষ্টতা নষ্ট করে। আপনি বয়সে প্রবীণ এবং প্রাজ্ঞ, আপনার সঙ্গে অশোভন তর্কযুদ্ধে আমি মাতামাতি করতে চাই না। সুতরাং এ আলোচনা এখানেই ইতি হোক, এই আমার ইচ্ছ। আমি এখানে যে-সব যুক্তির অবতারণা করেছি তা-যদি কারো অন্তরে আঘাত হেনে থাকে তার জন্য আমি বিশেষ দুঃখিত।

শাহরাজাদ তার গল্পের ইতি করে বললো, এই ছোট ছোট হাসি মজাকের কাহিনীগুলোর এখানেই ইতি করে দিচ্ছি, জাঁহাপনা। এরপর আবার অন্য জাতের কিসসা শোনাবো।

সুলতান শাহরিয়ার বললো, তোমার এই ক্ষুদে গল্পগুলো বড় মজার, বেশ ভালো লাগলো। এবার তোমার বড় কিসসা শোনাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *