2 of 3

ভূমিকম্প, গরুর মাংস

ভূমিকম্প, গরুর মাংস

আমরা কী ভীষণ অসহায়, তাই না? মাটি একটু নড়ে ওঠে আর আমরা হাজার হাজার মানুষ মরে যাই। সমুদ্রে জল একটু উথলে ওঠে আর আমরা ভেসে যাই হাজার হাজার মানুষ। প্রকৃতির সামনে এতই অসহায় আমরা অথচ ভাব দেখাচ্ছি আমাদের মতো শক্তিমান আর কেউ নেই। আমরা অন্য সব প্রজাতিকে বন্দি করি, নির্যাতন করি, আমাদের ক্রীতদাস বানাই। আমরা এই নিষ্ঠুর প্রজাতির নাম দিয়েছি সৃষ্টির সেরা জীব। আমরা কবিতা আওড়াই, সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই। আসলে আমরা খুব নির্লজ্জ প্রজাতি। প্রাণীজগতে হায়েনা ছাড়া মানুষের মতো আর কেউ এত নির্লজ্জ নয়।

ভূমিকম্পে নেপালের কত হাজার মানুষ পিঁপড়ের মতো মরে গেলো। জানিনা আর কী দুর্যোগ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এক দুর্যোগে তো পৃথিবীর সমস্ত ডায়নোসোর মরে গিয়েছিলো। মানুষ এখন ডায়নোসারের মতো পৃথিবী শাসন করে। ডায়নোসোরকে ভয় পেয়ে চলতো অন্যান্য প্রজাতি। মানুষকেও ভয় পেলে চলে এখনকার বেশির ভাগ প্রজাতিই। অত শক্তিমান ডায়নোসোরকে যদি বিলুপ্ত হতে হয়, তবে মানুষকে কেন হবে না? নতুন নতুন রোগ আসছে। নতুন নতুন উপদ্রব। আর বিরুদ্ধ প্রকৃতি তো আছেই।

অন্যান্য প্রজাতি আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য লোকে বলবে, অনেক। বলবে, মানুষের মস্তিষ্ক অন্য প্রজাতির মস্তিষ্কের চেয়ে উন্নতমানের। তা মানি। কিন্তু মানুষ যেভাবে ধর্ম আর কুসংস্কারগুলো বানিয়েছে এবং হাজার বছর ধরে তার চর্চা করে যাচ্ছে, তা দেখে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় অন্যান্য প্রাণীই বরং মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান। তারা কোনও আজগুবি গল্প তৈরি করে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করছে না। নিজেদের তুলোর মতো উড়িয়ে দেওয়ার মতো পারমাণবিক অস্ত্রও কিছু বানাচ্ছে না।

আমরা ভালোবাসতে জানি। পশুরাও ভালোবাসতে জানে। ওদের ভালোবাসাটা বরং অকৃত্রিম। মানুষ তো অভিনয়ে দক্ষ। পশুর এই জিনিসটা ভালো লাগে আমার, অভিনয় জানে না। কোনও হাতি মারা গেলে তার আত্মীয় বন্ধুরা যেভাবে কাঁদে, মানুষের জন্যও বোধহয় কোনও মানুষ অমন কাঁদে না। পশুদের শুধু নিজের বাচ্চার প্রতিই যে মমতা তা নয়। ভালোবাসা আর সহমর্মিতা বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত জরুরি, শুধু নিজের প্রজাতির জন্য নয়, অন্য প্রজাতির জন্যও। কত পাখি জেনে শুনে অন্য পাখির বাচ্চাকে লালন পালন করে! কত পশু বন্ধু হয়ে ওঠে অন্য পশুর!

কী ভেবেছি আমরা নিজেদের? আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, যেহেতু কিছু মেশিন টেশিন অস্ত্র উস্ত্র বানিয়েছি। এগুলো আমরা আমাদের হিংসে বিদ্বেষের কাজে ব্যবহার করি, মানুষ ধ্বংস করি, সভ্যতা নষ্ট করি। ভূমিকম্পে আমরা টের পাই নিজেদের যত শক্তিমান বলে ভাবি, তত শক্তিমান আমরা নই। মানুষ নিষ্ঠুর জানি, কিন্তু মানুষ সমমর্মীও হতে পারে প্রচণ্ড। ভূমিকম্পেও এর প্রমাণ আমরা দেখি। পৃথিবীর গরিব ধনী সব দেশই এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। মানুষকে বাঁচাতে মানুষ দৌড়ে আসে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবনের ঝাঁকি নিয়ে অসহায়কে উদ্ধার করা, খাবার দাবার, পানীয় জল, ওষুধ পত্র যা কিছুরই প্রয়োজন উদার হাতে দুর্গতদের দান করা–তুলনা হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের এক করে। আমরা মানুষরা সুখে এক হই না। দুঃখে এক হই। কিন্তু তা কি ঠিক? লক্ষ লক্ষ গরিবের দুঃখের পাশে ধনীরা তো দাঁড়ায়। না। দাঁড়ালে সারা পৃথিবী জুড়ে ধনী দরিদ্রর ফারাকটা এত বিশাল হতো না।

ভারত প্রচুর সাহায্য করছে নেপালকে। আশে পাশের অনেক দেশই সাহায্য করছে। পাকিস্তান পাঠিয়ে দিয়েছে খাবার। কিন্তু সে খাবারে নাকি ছিল গরুর মাংস। গরুর মাংস, আমি বিশ্বাস করি, সবচেয়ে সুস্বাদু মাংস। কিন্তু মুশকিল হলো নেপালের অধিকাংশ লোক হিন্দু, তারা পুজো পার্বণে মোষ মেরে সর্বনাশ করলেও গরুর মাংস মুখে দেবে না। গরুকে দেবতা ভাবে বলে গরুর মাংস খায় না। ভারতেও তাই। এখানে তো প্রায়ই আমি চেঁচাই, দেবতা ভাবো তো এদের এভাবে কষ্ট দিচ্ছ কেন! তোমরা দেবতাদের পেচ্ছাব পান করছো, অথচ এই দিল্লিতে দেখছি গরুরা রাস্তায় ক্ষুধার্ত হাঁটে, কোথাও কোনও খাবার নেই, ফুটপাতের আবর্জনা ঘেঁটে প্লাস্টিকের ব্যাগ খেয়ে বাঁচে। দিল্লির সবুজ ঘাসে ছাওয়া পার্কগুলোয় কোনও দেবতার ঢোকার কোনও অনুমতি নেই। ভারতেও তো গরু জবাই নিষিদ্ধ। ভারতের গরুগুলো কোথাও কোথাও জবাই হতে চলে যায়। মাংস না খেলেই যে লোক পশুর অধিকারে বিশ্বাস করে, এ কথা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। পশুর অধিকারকে বেশির ভাগই দুপয়সার মূল্য দেয় না। পশুর মাংস খায় না কারণ ধর্ম বলেছে খেও না, অথবা জন্ম থেকে খেয়ে অভ্যেস নেই বলেই খায় না। পশুর অধিকার নিয়ে যারা আন্দোলন করে তারা বেশির ভাগই আমিষ খেয়ে অভ্যস্ত। গরুর মাংস না খাওয়ার পেছনে। ভালো কোনও যুক্তি হয়তো নেই, কিন্তু যখন কেউ খাচ্ছে না, তার সেই না খাওয়ার অধিকারকে সম্মান জানানো উচিত। অন্তত আমি জানাই।

একবার আমার কলকাতার বাড়িতে আমি গরুর মাংস বেঁধেছিলাম। আমার এক হিন্দু বন্ধুর খুব শখ ছিল গরুর মাংস খাবে। ওই নিয়ে এসেছিলো মাংস। আমি সুজাতাকে, যে মেয়েটা আমার বাড়িতে কাজ করতো, বলিনি যে আমি গরুর মাংস রাঁধছি। ও ভেবেছিল আমি পাঁঠার মাংস রান্না করছি। গরুর মাংসের কথা জানলে ও হয়তো তল্পিতল্পা নিয়ে চলে যেতো, এবং কোথাও না খেয়ে কষ্ট করতো। এত ভালো মাইনের চাকরি তো ওর কোথাও জুটবে না। সে কারণে ওকে আমি বলিনি যে আমি গরুর মাংস রাঁধছি। কিন্তু ওকে সে মাংস স্পর্শও করতে দিইনি, সে মাংস রান্না হলে ওকে খেতেও দিইনি। ওকে রান্না ঘরের বাইরেই রেখেছি। ওর জন্য সেদিন আলাদা করে মাছ রান্না হয়েছিল। আমি বলেছি, আজ এই মাংস তোমাকে দিচ্ছি না, কারণ এ আমি আর আমার বন্ধু দুজনই খেয়ে শেষ করবো পণ করেছি। সুজাতাকে বলতে পারতাম, এ পাঁঠার মাংস, দিতেও পারতাম কিছু টুকরো ওর পাতে। কিন্তু মিথ্যে বলা আর অসততা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই করিনি।

কোনও মুসলমান আত্মীয় বা বন্ধু পাশে থাকলে আমি শুয়োরের মাংসটা একটু আড়াল করেই খাই, শুয়োর খাওয়ার জন্য ওদের অনুরোধ আবদার করি না। কী রকম হতো যদি ভুমিকম্পে বাংলাদেশ ধ্বংস হতো, আর কোনও দেশ বাংলাদেশকে সাহায্য পাঠাতে ট্রাক বোঝাই শুয়োরের মাংস! বাংলাদেশ কী করতো! ধর্ম এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান জানাতে আমি শুয়োরের মাংস মুসলমান থেকে, বা গরুর মাংস হিন্দু থেকে আড়াল করি না। আমি অধিকারকে সম্মান জানাই। ওই মাংস তারা খেতে চায় না, তাদের না খাওয়ার অধিকারকে আমি সম্মান জানাই। আমি যেমন সাপ খাই না, কুকুর বেড়ালের মাংস খাই না। আমাকে যারা সম্মান করে, তারা নিশ্চয়ই আমাকে ওই মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করবে না।

নেপালে খাদ্য পাঠানোর জন্য নিশ্চয়ই পাকিস্তানের দুটে তিনটে লোক জড়িত ছিল না, নিশ্চয়ই অনেক লোক ছিল। ওই অনেকের মধ্যে কি কারও জানা ছিল না যে নেপাল একটা হিন্দু প্রধান দেশ এবং নেপালের লোকরা গরুর মাংস খায় না? এই তথ্যটা কেউ একবারও জানায়নি কাউকে, ভেবে অবাক হয়ে যাই। সে কারণে সংশয়, কাজটা কি ইচ্ছে করে করা হয়েছে, নাকি অন্যান্য ভুলের মতো এটিও একটি ভুল!

মনে আছে সেই গল্পটা, এক দুষ্ট শেয়াল একবার এক বককে নেমন্তন্ন করলো। খেতে দিলো চ্যাপ্টা থালায়। বকও নেমন্তন্ন করেছিল প্রতিশোধ নিতে। খেতে দিয়েছিল লম্বা গলাওয়ালা বোতলে। অতিথিরা প্রায় কিছুই খেতে পারেনি। কী লাভ এই নেমন্তন্নে, যদি ক্ষিধেই না মেটে, যদি তৃপ্তিই না হয়!

পাকিস্তানের উচিত গরুর মাংস ফিরিয়ে নেওয়া। বরং গরুর পরিবর্তে ভেড়া বা খাসি বা মুরগির মাংস দেবার ব্যবস্থা করা। অথবা কিছুই না দেওয়া। খাবার জন্য অখাদ্য কিছু দেওয়ার চেয়ে কিছু না দেওয়া অনেক ভালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *