স্বপ্নগুলো
ভারত থেকে প্রায়ই আমি ইউরোপ অথবাআমেরিকায় যাই, সাধারণত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীর অধিকার বা মানবাধিকার নিয়ে বক্তৃতা করতে। ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন সরকার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন আমাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আজ বাইশ বছর। যেখানেই বাস করি না কেন, বক্ততার জন্য আমাকে যেতে হয় বিভিন্ন দেশে। ভারতীয় উপমহাদেশের কোনও পত্রিকায় আমার বক্তৃতা করা, আমার সম্মান অর্জন, মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট পাওয়া, এসব নিয়ে কিছু কখনও লেখেনি। লিখেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায়, কটা পুরুষের সঙ্গে আমি শুয়েছি, মোট কজনকে বিয়ে করেছি, এবং কত লোক আমাকে ঘৃণা করে, এবং মৌলবাদীরা কী করে আমাকে প্যাদানি দিচ্ছে, আমার দিকে লোহার চেয়ার ছুঁড়ে মারছে, রাজ্য কী করে আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, কী করে রাজ্য থেকে আমাকে তাড়িয়েছে, এসব। আমার নামের আগে জুড়ে দেয় একটি শব্দ- বিতর্কিত। এই শব্দটি জুড়তে জুড়তে এখন এটিকে তারা আমার নামের অংশ বলেই সম্ভবত ভাবে। এই বিতর্কিত বিশেষণটি তারাইতিবাচক নয়, ব্যবহার করে নেতিবাচক অর্থে। দুই বাংলা আমাকে শুধু তাড়িয়ে শান্ত হয়নি, আমাকে বানিয়েছে আস্ত একটা নিষিদ্ধ নাম, আপাদমস্তক নিষিদ্ধ লেখক। ভারত থেকে আমি এখন আমেরিকায় এসেছি, এর মানে কিন্তু এই নয় যে আমি জন্মের মতো ছেড়ে এসেছি ভারত। ভারতে এখনও আমার সবকিছু, সমস্ত জরুরি জিনিসপত্র। আমি শুধু ছোট একটা সুটকেসে নিয়ে আমেরিকায় এসেছি, সঙ্গে এনেছি আমার নিত্যসঙ্গী ল্যাপটপ আর আইপ্যাড়। আর আমার এক জোড়া রিডিং গ্লাস। দেশের বাইরে যেখানেই যাই, এগুলো নিয়েই যাই।
বাংলাদেশ আমাকে তাড়িয়েছে। আমার বই নিষিদ্ধ করেছে। নারীবিদ্বেষী মৌলবাদীর দল আর নারীবিদ্বেষী তথাকথিত প্রগতিশীলের দল দুদলই দুযুগ ধরে আমার পেছনে –আমাকে অপমান করতে, অপদস্থ করতে, অবাধে আমার কুৎসা রটাতে ব্যস্ত। ইউরোপ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছিলাম। বাংলাকে ভালোবেসে কী অসম্ভব অসম্ভব কাণ্ডই না করেছি। সেখানেও ওই একই ঘটনা ঘটলো, রাজনীতিক, নারীবিদ্বেষী মৌলবাদীর দল, আর এক দল সেকুলার নামধারী কাপুরুষ আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠলো। আমাকে গৃহবন্দি করেছিল ভারত সরকার। ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছিল দুহাজার আট সালে। তারপরও ফিরে ফিরে গেছি ভারতে। আশ্রয় ভিক্ষে চাইনি। আশ্রয়ের দাবি জানিয়েছি। গণতন্ত্রের কাছে দাবি। একটি সেকুলার রাষ্ট্রের কাছে দাবি। মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করা একজন লেখক হিসেবে দাবি। দিল্লি ছাড়া আর কোথাও যাওয়া নিষেধ, তারপরও ওই দিল্লিতেই থেকেছি। কেন দিল্লিতে পড়ে আছি, কেউ প্রশ্ন করলে বলতাম, যেহেতু এখানকার গাছগুলো চিনি। দিল্লি আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি শহর, নতুন চারদিক। তারপরও রয়েছি দিল্লিতে, কারণ গোটা ভারতবর্ষে ওই ছোট শহরটি ছাড়া আর কোনও শহর ছিল না আমার থাকার। ওই শহরটি ত্যাগ করা মানে গোটা একটি উপমহাদেশ ত্যাগ করা। আমার ভারত-বাসের অনুমতি আর না পাওয়া মানে আমার জন্য উপমহাদেশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। এবারই তো নতুন সরকার এসে ভারত বাসের অনুমতিকে এক বছর থেকে কমিয়ে দুমাসে এনেছিল। শুধু যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। নিজের আদর্শের জন্য যুদ্ধ। যেখানে বাস করতে ইচ্ছে করে, সেখানে বাস করার স্বাধীনতা চাই বা অধিকার চাই। পৃথিবীর সর্বত্র বাক স্বাধীনতা চাই। আমি স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করবো, সে কারণে আমাকে জেল খাটতে হবে না, আমার ফাঁসি হবে না, আমার পিঠে চাবুক চালানো হবে না, আমাকে দুররা মারা হবে না, আমাকে পাথর ছোঁড়া হবে না, আমাকে নির্বাসনে যেতে হবে না। এই নিশ্চয়তা চাই। শুধু আমার জন্য নয়। সবার জন্য।
আমার অধিকাংশ পাঠকের বাস উপমহাদেশে। সে কারণে পাঠকের কাছাকাছি রয়েছি, ভাষার কাছাকাছি রয়েছি, আমার পোষা বেড়ালের কাছাকাছি রয়েছি, যে মেয়েদের কথা লিখি, যে নির্যাতিত মানুষের কথা লিখি, তাদের কাছাকাছি রয়েছি। তাদের কাছাকাছি আমাকে তো থাকতেই হবে যতদিন বাঁচি। আমি তো ভাসমান এক মানুষ। আমার পায়ের তলায় মাটি নেই। আমার কোনও শহর নেই, গ্রাম নেই, দেশ নেই। এক শহর থেকে আরেক শহরে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে আজ একুশ বছর যাবৎ কেবল ভেসে যাচ্ছি। এই ভাসমান মানুষটিই মানুষের মত প্রকাশের অধিকারের জন্য, নারীর সমানাধিকারের জন্য, দেশে-দেশের কাঁটাতার উপড়ে ফেলার জন্য, মানুষের যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার এবং বসবাসের স্বাধীনতার জন্য, মানবতার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, লাথিঝাঁটা খেয়ে, গালি খেয়ে, ঘৃণা পেয়ে, ফতোয়া সয়ে, নির্যাতন সয়ে লড়াই করে যাচ্ছি।
আমেরিকায় আসার পেছনে এবার আমার মূল উদ্দেশ্য সেকুলার হিউম্যানিস্ট কনফারেন্সে নাস্তিক ব্লগাররা কী রকম মৃত্যুভয়ে গুটিয়ে আছে, সে সম্পর্কে বলা। তাদের প্রাণে বাঁচানোর জন্য ইউরোপ-আমেরিকার সরকার এবং সংগঠনের কাছে আবেদন করা। যে ফাণ্ড তৈরি করা হচ্ছে আমার জন্য, সেটি মূলত যাবে দেশের প্রতিভাবান নাস্তিক ব্লগারদের দেশ থেকে বিদেশে আসা এবং বিদেশে বসবাসের খরচে। আমার নিজের নিরাপত্তা? অনেক তো হলো বাঁচা। এবার মাথায় কোপ খেলে, বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে এমন কোনও সর্বনাশ হবে না কারও। গত একুশ বছর কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি আমি কোথায় আছি, কেমন আছি। আমি ভালো আছি কি না। আমি বেঁচে আছি কি না। আজ হঠাৎ আমি ভারত ছেড়ে কেন চলে গেলাম জানতে চাইছে সবাই। ভারতে থাকাকালীন মুখ ফুটে ভারতের রাজনীতি, ভারতের মেয়েদের অসহায়ত্ব, ভারতের গরিবদের দুরবস্থা, কোনও সামাজিক অব্যবস্থা, কোনও ধর্ম, কোনও পুরুষতন্ত্র, কোনও কুসংস্কার নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করলে জাতীয়তাবাদী, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পুরুষতান্ত্রিক লোকেরা আমাকে ধমক দিতো, গালি দিত, বলতো ভারত ছাড়তে, বাংলাদেশে চলে যেতে, কী জঘন্য অপমানই না করতো। বাংলাদেশ একটা গরিব দেশ বলে, বাংলাদেশে আমার জন্ম হয়েছে বলে তারা ভারতীয়রা তুই তোকারি করে কথা বলতো। পৃথিবীর সব দেশকে আপন ভাবলে, নিজের দেশ ভাবলে, দেশ আর দেশের মানুষের ভালো চাইলে, বিশেষ করে যেচে, আগ বাড়িয়ে ভালো করতে চাইলে অনেক কষ্ট পেতে হয়। বিদেশী, বাইরের লোক, আমাদের দেশের ব্যাপারে নাক গলাবে না, ইত্যাদি কটুক্তি শুনতে হয়। অনেক ধারণা করে আমার নিশ্চয়ই কোনও বদ অভিসন্ধি আছে। তা না হলে অন্য দেশের মেয়েরা ধর্ষিতা হলে আমার কী, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বাড়লে আমি উদ্বিগ্ন কেন, এ তো আর আমার দেশ নয়! আমি আপন ভাবলেও আমাকে আপন ভাবার লোক আমি খুব কমই পেয়েছি। আমার কথা পছন্দ না হলে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে, আমাকে লাথি মেরে ভারত থেকে তাড়াবে। প্রায় প্রতিদিন শুনেছি এমন হুমকি। একদিকে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণ। আরেকদিকে নারীবিদ্বেষী, কট্টর ডানপন্থী, হিন্দুত্ববাদীর আক্রমণ। আর যাদের থাকার কথা আমার পাশে, যে বামপন্থী সেকুলার দলের, তারা আমার বই নিষিদ্ধ করে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ায়, আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়। তারা মিথ্যে দোষ দেয়, তাদের সহজ সমীকরণ এই, আমি যেহেতু ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, আমি তবে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদীদের বন্ধু। ভারতের সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থীদের মধ্যে একটা বড় অংশই ভণ্ড।
এদের বাইরেও অনেক মানুষ আছে, যারা ভালোবাসে, যারা শ্রদ্ধা করে। হাটে, মাঠে, ঘাটে কত মানুষ দৌড়ে এসেছে অটোগ্রাফ নিতে, কত মানুষ ছবি তুলতে, জড়িয়ে ধরতে, একটু হাত স্পর্শ করতে, একটু কাঁদতে, একটুখানি পায়ের ধুলো নিতে। ওই ভালোবাসা আমাকে টানে। ওই ভালোবাসার কাছে আমি ফিরে যাবোই। ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই আমার কাছে বড় নয়। আমার সবজিওয়ালা জয়ন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আমার মাছওয়ালা গোবিন্দ আর বনমালী আমার জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে শাড়ির দোকানের মজুমদার। অপেক্ষা করে আছে মিনু বেড়াল, অসংখ্য চেনা অচেনা শুভাকাঙ্ক্ষী।
অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর ঘাড়ের কাছটায় চাপাতির একখানা কোপ আজ বসে কাল বসে এইরকম একটি বিচ্ছিরি কিছু অনুভূত হচ্ছিল। বার বার পেছন ফিরে দেখছিলাম কেউ অনুসরণ করছে কি না। ওটা আমেরিকায় এসে এ কদিনে খানিকটা গেছে। সম্পূর্ণ চলে যেতে খানিকটা সময় নেবে। নব্বইয়ের শুরুতে আমি লক্ষ লক্ষ মৌলবাদীদের মিছিল আর সভা দেখেছি, যেখানে আমার ফাঁসির দাবিতে দেশকে অনেকদিন পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল। ওই মৌলবাদীদের সুযোগ্য পুত্ররা আজ সন্ত্রাসী, আজ তারা চাপাতি চালানো খুনী। আমার দিকে নজর তাদের নতুন নয়।
পৃথিবীটাকে দেশ বলে আজও ভাবি। আমি ইউরোপের নাগরিক অনেককাল। আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা অনেককাল। এসব জায়গায় বাস না করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি বাংলায় বাস করতে চেয়েছি। এখনও চাই। যতদিন বাংলা শাসন করবে মুখ লোকেরা, জঙ্গীদের সঙ্গীরা, ততদিন আমার প্রবেশাধিকার নেই বাংলায়। এই প্রবেশাধিকার ফেরত চাই। পৃথিবীটায় যতদিন বাঁচি যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার, যেখানে ইচ্ছে করে সেখানে বাস করার অধিকার পেতে চাই। যেন চাইলে আমেরিকায়, যেন এস্কিমোদের দেশে গ্রীনল্যাণ্ডে, যেন আফ্রিকার যে কোনও দেশে, অস্ট্রেলিয়ায়, ইউরোপ বা এশিয়ার যেখানে খুশি সেখানে বাস করার অধিকার পেতে পারি। শুধু আমি নই। পৃথিবীর সবাই।
জানি আমার স্বপ্নগুলো মানুষ পায়ে মাড়িয়ে যাবে। সে যাক। আমার কিছু যায় আসে না। আমি স্বপ্ন রচনা করে যাবোই।