মুসলিম শরণার্থীদের সাহায্য করছে অমুসলিম দেশগুলো
আমরা নাইন ইলেভেন ভুলিনি, মুসলিম মৌলবাদীরা কী করে আমেরিকার আকাশ ছোঁয়া গৌরবকে ভূলুণ্ঠিত করলো, মেরে ফেললো কয়েক হাজার নিরপরাধ মানুষ, ভুলিনি। ডেনমার্কের কার্টুনিস্টকে নিয়ে বিশ্বসুদ্ধ কী আগুন তারা জ্বালিয়েছে ভুলিনি। সুইডিশ কার্টুনিস্টকে নিয়েও তো কম জ্বালাও পোড়াও হয়নি। সেদিন ফ্রান্সের শার্লি হেবদোর অফিসের সবাইকে মুসলিম মৌলবাদীরা গুলি করে মেরে ফেললো, ভোলা তো সম্ভব নয়। এটা নিষিদ্ধ, ওটা নিষিদ্ধ– এ তো লেগেই আছে। কথা বলা যাবে না, ছবি আঁকা যাবে না, ভিন্ন মত প্রকাশ করা যাবে না। এসব বাক স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের জনকদের ঘরের মধ্যে তাদের নাকের ডগায় ঘটেছে। আর এই সময়ই কি না লক্ষ লক্ষ মুসলিমের জন্য ইউরোপ-আমেরিকার দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে।মুসলিমরা পঙ্গপালের মতো ধেয়ে যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার দিকে।তারা শরণার্থী, আশ্রয় ভিক্ষে চাইছে। চিরকাল শুনে এসেছি মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই। শুনে এসেছি মুসলিম ভ্রাতৃত্ব বড় ভ্রাতৃত্ব। ভাইয়ের দুঃসময়ে ভাইরা পাশে দাঁড়াচ্ছে কেন, এই প্রশ্নটি সবার মনেই জাগাটা স্বাভাবিক। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো আজ কোথায়! যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া এবং মৌলবাদ-আক্রান্ত অন্যান্য দেশের মুসলিম ভাইবোনদের পাশে আজ তারা নেই কেন। তারা অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, তারা আশ্রয় দেবে না। মুসলিম ভ্রাতৃত্ব তবে কি কেবল জেহাদ করার জন্যই প্রয়োজন?
যা খবর পেয়েছি তা হলো, প্রায় পাঁচ লক্ষ লোক সিরিয়া থেকে বেরিয়ে গেছে। আড়াই হাজারের ওপর মানুষ সমুদ্রে ডুবেছে, অথবা এখন অবধি নিখোঁজ। কিছুদিন আগে সমুদ্র তীরে একটি সিরীয় শিশুর উল্টে মরে থাকার ছবি বিশ্বকে কাঁদিয়েছে। ইউরোপের শহরগুলোয় লক্ষ লক্ষ মানুষ নেমেছে শরণার্থীদের সমর্থনে। মানুষ চিৎকার করে বলছে শরণার্থী এখানে এসো। এখনও মানবতা বেঁচে আছে। হ্যাঁ, মানবতা এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু কেন আরব দেশের সেই মুসলিম দেশগুলোয় মানবতা বেঁচে নেই যারা ইচ্ছে করলেই পারতো এই বিপদে প্রতিবেশীদের আশ্রয় দিতে। কী আশ্চর্য! মানবতা শুধু সেসব দেশেই বেঁচে আছে, যেসব দেশের মানুষ মুসলিম নয়, যে অমুসলিম বা বিধর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করার কথা মুসলিমদের পবিত্র কিতাবে লেখা আছে। কিছু আরব দেশ অবশ্য কিছু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু তা নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয়।
হিটলারও চ্যান্সেলর ছিলেন। এঙ্গেলা মেরকেলও চ্যান্সেলর। হিটলার সাদা জার্মান ছাড়া আর সবাইকে তুচ্ছ বলে মনে করেছেন, তাদের অত্যাচার করেছেন, খুন করেছেন। এঙ্গেলা মেরকেল তাদের বাঁচাচ্ছেন, যারা অন্য দেশে অত্যাচারিত হচ্ছে, খুন হচ্ছে, যারা জার্মান নয়, ইউরোপের লোক নয়, এমনকী খ্রিস্টানও নয়। তিনি মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন, যে মুসলমান যে কোনও দিনই হয়ে যেতে পারে মৌলবাদী, হয়ে যেতে পারে সন্ত্রাসী। এই ঝুঁকিটা জেনেশুনেই নিচ্ছেন এঙ্গেলা মেরকেল। তিনি জার্মানির দরজা খুলে দিয়েছেন, যে দরজা দিয়ে প্রতিদিন ১০০০ শরণার্থী ঢুকছে জার্মানিতে। সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে শরণার্থী শিবিরের কাজ করতে। স্বেচ্ছাসেবকদের একজন বলেছেন, আমরা ব্যাংক সেইভ করতে পেরেছি, মানুষও সেইভ করতে পারবো। এই জার্মানিই একদিন কুৎসিত নাৎসির দখলে ছিল। এই জার্মানিই আজ নাৎসি বিরোধী, বর্ণবাদ বিরোধী, মানবিক।
জার্মানিতে আড়াই লক্ষ আশ্রয়প্রার্থীর দরখাস্ত পড়ে আছে। এদের শুধু আশ্রয় দিলেই চলবে না, এদের ভাষা শেখানো, এদের খাওয়ানো পরানো, এদের বাসস্থান, স্বাস্থ্য আর শিক্ষার ব্যবস্থা, এদের নিরাপত্তা– সব সেবাই সরকার করবে। জার্মানিতে বুড়োর সংখ্যা বেশি, শিশুর সংখ্যা কম, কারণ জার্মান দম্পতি সন্তান জন্মাতে খুব উৎসাহী নয়। শিশুজন্মের হার শুধু জার্মানিতে কম নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশেও কম। সে কারণে অভিবাসীরা বাড়তি উপপ হিসেবে নয়, বরং দেশকে সচল রাখার দক্ষ মানবশক্তি হিসেবে একসময় কাজে লাগতে পারে। দূরদৃষ্টি যাদের আছে, তারা সীমান্তে কড়া পাহারা বসাবেন না। এঙ্গেলা মেরকেল সম্ভবত তেমনই দুষ্প্রাপ্য দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ! তাই হয়তো অভিবাসী শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি জোর দিচ্ছেন।ষাট সত্তরের দশকে তুরস্ক থেকে শ্রমিক এনেছিল জার্মানি। কাজের চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর শ্রমিকরা দেশে ফিরে না গিয়ে জার্মানিতেই রয়ে গিয়েছিল। ওদের শিক্ষিত করার ব্যাপারে নজর দেয়নি তখনকার জার্মানি। তুর্কী অভিবাসীদের অনেকেই জার্মান ভাষাটাই জানে না। ভালো কোনও কাজও তাই অনেকের জোটেনি।
আগস্টে জার্মানিতে ঢুকেছে এক লক্ষ ষাট হাজার শরণার্থী। অনুমান করা হচ্ছে। এ বছরের শেষে ঢুকবে অন্তত দশ লক্ষ শরণার্থী। যেখানে যত খালি জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, শরণার্থীর জন্য তাঁবু বসানো হচ্ছে। মানবতার সেবায় নিজেকে যেভাবে সঁপে দিয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর, এ থেকে কি অন্য দেশের রাজনীতিকরা শিক্ষা নেবেন? তাঁরাও কি সে পথে হাঁটবেন, যে পথে হেঁটেছেন এঙ্গেলা মেরকেল? পথটি বড় কণ্টকাকীণ বলে অনেকে হয়তো পিছিয়ে যাবেন!
কিছু কিছু শরণার্থী-বিরোধী মিছিল এদিক ওদিক হয়েছে। মূলত কট্টর ডানপন্থীরাই ওই মিছিলগুলো করেছে। মুসলিমদের প্রতি তাদের ঘৃণা এবং ভয় দুটোই প্রচণ্ড। তাদের ভাষ্য, এই মুসলিমরা শরিয়া আইনের দাবি করবে, রাস্তা বন্ধ করে নামাজ পড়বে, জার্মান সংস্কৃতির বিপরীত কোনও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেবে, একাধিক বিয়ে করবে, স্ত্রীদের পেটাবে, মেয়েদের বোরখা পরতে বা হিজাব পরতে বাধ্য করবে, সেকুলার শিক্ষার বদলে নিজেদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করবে, পাড়ায় পাড়ায়। মসজিদ মাদ্রাসা গড়বে, বিধর্মী জার্মানদের ঘৃণা করবে, ঘরে বসে বসে বেকার ভাতা খাবে। এবং সবচেয়ে ভয়ংকর, অনেকের মগজধোলাই হবে, অনেকে সন্ত্রাসী হবে। বোমা ছুড়বে, মানুষ হত্যা করবে। সৌদি আরব এর মধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, জার্মানিতে আশ্রয় নেওয়া সিরিয়ার শরণার্থীর জন্য ২০০ মসজিদ গড়ে দেবে। অনেক মসজিদেই কিন্তু নিরীহ মুসলমানদের সন্ত্রাসী বানানোর জন্য মগজধোলাই করা হয়। সৌদি আরব মুসলমান-শরণার্থীদের আশ্রয় দেবে না, তাদের খাদ্য বস্ত্র দেবে না, তাদের শিক্ষা দেবে না, স্বাস্থ্য দেবে না, কিন্তু ধর্ম দেবে। মুসলমানদের ধর্মান্ধ বানানো ছাড়া বা মনে হয় যেন আর কোনও উদ্দেশ্য নেই আর। বিভিন্ন গরিব মুসলিম দেশগুলোয় অঢেল টাকা ঢেলে যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করছে ওয়াহাবিবাদে বিশ্বাসীরা। এই ওয়াহাবিবাদে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন ওসামা বিন লাদেন। এক বিন লাদেন নেই তাতে কী, আরও বিন লাদেন তৈরি করতে অনেকই তৎপর।
জার্মানি আর সুইডেনই নেবে অধিকাংশ শরণার্থী। এ বছরে সুইডেন নিচ্ছে মোট ৯০,০০০ শরণার্থী। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো মুখে যত সহানুভূতি প্রকাশ করুক না কেন, শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রশ্ন এলেই পিছিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলে দিয়েছে দশ হাজার শরণার্থী নেবে। সংখ্যাটা আরও বাড়বে ভবিষ্যতে। শরণার্থীর জন্য জার্মানি দরজা খুলেছে, সুইডেন খুলেছে, ইউরোপের অনেক দেশই দরজা হয়তো খুলবে। আমেরিকাও আরও খুলবে। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশগুলোর সহায় এখন ইউরোপ আর আমেরিকাই। অমুসলামরাই। বিধর্মীরাই। পাশ্চাত্যে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে। একদিন হয়তো এমন দিন আসবে, মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে, পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গরা হয়ে উঠবে সংখ্যালঘু। একদিন হয়তো মুসলমানরাই শাসন করবে পৃথিবী। অমুসলমানরাই মুসলমানদের পেলে পুষে বড় করবে তাদের দেশে। অতঃপর আসবে সেই দিন, দারুল ইসলাম কায়েম করার দিন। শত্রুকে, বিধর্মীকে, অবিশ্বাসীকে কতল করে সুন্নি মুসলমানের তামাম দুনিয়ার খলিফা বনার দিন। এ কি শুধু কট্টর ডানপন্থীরাই ভাবছে? উদারপন্থীদের মনেও এমন আশংকা যে মাঝে মাঝে উঁকি দেয় না, তা হলফ করে বলা যাবে না।
অন্যরকমও হতে পারে। সেই অন্যরকমটিই যেন হয়। অন্যরকমটি এরকম– মুসলিম অভিবাসীরা সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, বিজ্ঞানমনস্ক হবে, যুক্তিবাদী হবে, নারী পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করবে। যে দেশে তারা বাস করবে যেন সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে বাস করতে পারে, যেন তাদের কোনও ঘেটোতে বা বস্তিতে বাস করতে বাধ্য করা না হয়, যেন তাদের শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়, চাকরি বাকরির সুযোগ দেওয়া হয়। তাদেরকে যত পৃথক করা হবে মূলধারা থেকে, তত তারা বিচ্ছিন্ন হবে, তত তারা ধর্ম আর কুসংস্কার আঁকড়ে ধরবে, তত তাদের জাপটে ধরবে ক্ষদ্রতা আর অন্ধতা। কেবল আশ্রয় দিলেই আর খাওয়া পরার নিশ্চয়তা দিলেই নিরাশ্রয়দের সব সমস্যার সমাধান হয় না, কী করে তারা বেঁচে থাকবে, কতখানি মর্যাদা নিয়ে, কী শিক্ষা আর কতটা সচেতনতা নিয়ে, সেটা একটা বড় বিষয়। তা না হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে, এইসব লোক দেখানো আশ্রয় কারও সত্যিকার কোনও উপকার করবে না।