মানুষ মানুষের জন্য?

মানুষ মানুষের জন্য?

কয়েক হাজার মানুষ সমুদ্রে ভাসছে। জল তাদের নিচ্ছে, কিন্তু স্থল তাদের নিচ্ছে না। আসলে স্থলের আপত্তি নেই, আপত্তি স্থলের প্রাণীদের। অবশ্য স্থলের অন্য প্রাণীদের কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু মানুষ নামক প্রাণীর। যারা সমুদ্রে ঠিকানাহীন ভাসছে, তারা কিন্তু মানুষই।

মানুষ ক্ষিধে তৃষ্ণায় কাতরাচ্ছে। কিন্তু কোনও দেশ তাদের নেবে না। বাংলাদেশ ফেরত নেবে না বাংলাদেশের লোকদের। মায়ানমারের লোকদের মায়ানমার নেবে না। মালোয়েশিয়ায় যেতে চেয়েছিলো ওরা। মালয়েশিয়া বলেছে ওদের নেবে না। ইন্দোনেশিয়া বলেছে নেবে না। থাইল্যাণ্ড বলেছে নেবে না। কেউ ওদের নিতে চায় না। কারণ ওরা গরিব। গরিবরা সোজা কথায় ব্রাত্য। অনাকাঙ্খিত। ওদের কেউ নেই, কিছু নেই। ধনীরা যদি ভাসতো সমুদ্রে। কোনও তীরে তাদের নাও ভেড়াতে কেউ কি বাধা দিতো! আমার তো মনে হয় না। দৌড়ে এসে তাদের লুফে নিত সবাই।

পাচারকারীরা তাদের নৌকো সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে। জল পথে মানুষের পাচার হওয়াকে তারা বলে কলম্বাস ভিসা। আর বন-জঙ্গল দিয়ে পাচার হওয়াকে বলে টারজান ভিসা। পাচারকারীদের রসবোধ বলতে কিছুই নেই, এ কথা শত্রুও বলবে না। মাথা পিছু কত টাকা নেয় পাচারকারীরা। দশ হাজার। অনেক লোক ভিটেমাটি বা শেষ সম্বল বিক্রি করে পাচারকারীদের হাতে টাকা দেয়। শুধু পাচারকারীদের হাতে নয়, গন্তব্যে পৌঁছানোর পর বড় নৌকোর মালিককে দিতে হয় মাথা পিছু পঁচিশ হাজার টাকা। ভাগ্যটা খানিকটা বদলানোর জন্যই দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়ার সিন্ধান্ত নেয় মানুষ। মুসলিম লোকরা মুসলিম দেশে যাবে। কত আশা করেই না ছিল লোকগুলো। ইন্দোনেশিয়া বলে দিয়েছে, ওদের ডুবে যেতে দেখলেও যেন কোনও জেলে ওদের তীরে না তোলে। মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই স্লোগান শুনেছি কত! সৌদি আরবে তো বাংলাদেশের মুসলিম মিসকিনদের এক কোপে কল্লা কেটে ফেলা হয়। মুসলিমরা, আসলে সবচেয়ে বেশি ভালো আছে অমুসলিমদের দেশে। ইওরোপে,যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডায়। গরিবদের অত দূর যাওয়ার ক্ষমতা নেই। তারা তাই আশেপাশের দেশের পানেই ধায়। কিন্তু এখানেও অনিশ্চিত ভাসতে হয় সমুদ্রে। অনেকের সলিল সমাধি হয়ে গেছে। ট্রলার ভর্তি মুসলিমদের যখন দুর দুর করে তাড়াচ্ছে মুসলিম দেশগুলো, তখন ফিলিপাইন নামের এক খ্রিস্টান প্রধান দেশ কথা দিয়েছে এদের আশ্রয় দেবে।

আচ্ছা আং সান সুচি তো বিশাল শান্তির নোবেল পেয়েছিলেন। কী করছেন তিনি মায়ানমারে বসে? রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে তাঁর মুখ থেকে কোনও শান্তির বাণী বেরোয় না কেন? ক্ষমতার লোভে তিনিও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। বড় হতাশ হই এইসব বিশাল নেতানেত্রীর কীর্তিকলাপ দেখে।

মানবপাচার বন্ধ করার কোনও উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকারের নেই। টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালি থেকে বেশি পাচার হয় মানুষ, সেখানকার পুলিশ পাচারকারীর কাছ থেকে শুনেছি ঘুষ খায়। পাচার রোধে মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার কোনও কথা বলছে না। সমুদ্র টহল দেওয়ার জন্য নৌকো টৌকো নেই বাংলাদেশের। কক্সবাজার আর টেকনাফে আশিটি পথ দিয়ে নাকি মানুষ পাচার হচ্ছে। এই আশিটি পথে যথেষ্ট পাহারানেই। পাচারকারীরাবাংলাদেশ থেকে ছোট ট্রলারেকরেমায়ানমারে মানুষ নিয়ে যায়, ওখান থেকে বড় ট্রলারে করে থাইল্যাণ্ড বা মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। শুধু রাতে সেই ট্রলার গুলো চলে। দিনে ট্রলার দাঁড়িয়ে থাকে নীল জালে গা ঢেকে। সমুদ্রের রঙের সঙ্গে মিশে। যেন কেউ বুঝতে না পারে মানুষবাহী কোনও ট্রলার ভাসছে সমুদ্রে। জীবনের কত ঝুঁকি নিয়ে মানুষ সমুদ্র পাড়ি দেয় শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য। ভাবলে গা শিউরে ওঠে। পাচারকারীরা নাকি বলে, মালয়েশিয়ায় গেলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে তোমাদের জেলে নিয়ে যেতে পারে, তবে ওখানকার জেলে ভালো খাবার দাবার পাবে। মালয়েশিয়ার জেল দেশের চেয়ে ভালো। দেশে কাজ নেই, কর্ম নেই। ভাত নেই, কাপড় নেই। অন্তত বিদেশি জেলে তো দুবেলা খেতে পাবে। দুবেলা খেতে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে, বিসমিল্লাহ বলে গরিবরা রাতের অন্ধকারে পা টিপে টিপে অচেনা সাগরের উত্তাল ঢেউএ ভাসতে থাকা অচেনা নৌকোয় চড়ে। জেলে স্বাধীনতা নেই। তবে দেশের অনেক মানুষের কাছে দুবেলা খাবার স্বাধীনতার চেয়ে বড় স্বাধীনতা আর কিছু নেই। জেলে বন্দি করে রাখুক। খেতে তো দেবে, পরতে তো দেবে।

দারিদ্রের এত বিভৎস চেহারা দেখলে আঁতকে উঠি।

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকরা চাইছেন বাংলাদেশ-মায়ানমার-থাইল্যাণ্ড এসব দেশের মধ্যে মানবপাচার রোধের চুক্তি হোক। আমার কিন্তু এই মানবপাচারকে মানবপাচার বলতে বাধছে। এক জায়গা থেকে তল্পিতল্পা নিয়ে আরেকটা ভালো জায়গায় বাস করতে যাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম কৌশল, যে কৌশল আমাদের আদি নারী-পুরুষরা অবলম্বন করেছিলো বলে আমরা হোমো সেপিয়ান নামের মানুষ প্রজাতি আজও এই পৃথিবীতে টিকে আছি। এই কৌশলটি অবলম্বন করেনি বলে। নিয়ানডার্থাল নামের মানুষরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেখানে ভালো খাবার আছে, যেখানে আবহাওয়া ভালো, জীবন যাপনের মান উন্নত, সেখানে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের রক্তে। শুধু আমাদের নয়, সব প্রাণীরই রক্তে। যারা যেতে পারে, তারা বেঁচে যায়, যারা পারে না, তারা মরে যায়। নতুন নতুন পরিবেশের সঙ্গে যত খাপ খাওয়াতে পারবো, তত আমাদের প্রজাতি বাঁচবে। বিবর্তন এভাবেই কোটি কোটি বছর ধরে হচ্ছে, হবে। আমরা আমাদের দুঃশাসন দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে ঠেকাতে চাইছি। এই ই আমাদের ভুল। যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাওয়ার এবং থাকার অধিকার অন্যতম মানবাধিকার। মানুষের পায়ে শেকল পরিয়ে দিয়ে মানবাধিকারের পক্ষে সওয়াল করা যায় না। বাংলাদেশ এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বরং এই চুক্তি হোক, যে, যে কোনও দেশের যে কেউ যে কোনও দেশে ঢুকতে পারবে, বাস করতে পারবে। পাসপোর্ট ভিসার পদ্ধতি উঠে যাক। মানুষের জন্য মানুষের আর ঘৃণা নয়, অবিশ্বাস নয়, সংশয় নয়, আশংকা নয়, মানুষের জন্য জন্ম নিক মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, সমমর্মিতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *