হিটলার

হিটলার

এই গত রবিবারের আনন্দবাজারেই দেখি, আমাদের শিবুদা হিটলারকে নিয়ে একখানা পান ছেড়েছেন। হের হিটলার নাকি নিজের গোঁফ কামিয়ে ছদ্মবেশে বহাল তবিয়তে আর্জেন্টিনায় বিরাজ করছেন। এর ওপর বিশুদার পান–তার গোঁ গেছে, এখন গোঁফও গেল। [হিটলার গোঁফ কামালেই যে তাঁর পক্ষে সেইটেই সর্বশ্রেষ্ঠ ছদ্মবেশ এই নিয়ে ১৯৩৩-৩৪-এই একটি কাঁচা রসিকতা চালু ছিল। একদা হিটলার, গ্যোরিঙ, গ্যোবেলস্ ও রোম ছদ্মবেশে দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ার ঠাহর করার জন্য বেরোলেন। হিটলার গোঁফ কামালেন, গ্যোরিঙ সিভিল ড্রেস পরলেন, গ্যোবেলস কথা বন্ধ করে দিলেন এবং রোমে একটি প্রিয়দর্শন তরুণী সঙ্গে নিলেন। এস্থলে বলে দেওয়া প্রয়োজন গ্যোরিঙ বড্ড বেশি ইউনিফর্ম ভালোবাসতেন, গ্যোবেলস্ প্রপাগান্ডা চিফ বলে সমস্তক্ষণ বকর বকর করতেন আর রোম সমরতিগামী অর্থাৎ হোমোসেকসুয়েল ছিলেন।]

আমি কিন্তু পানটার দিকে নজর দিচ্ছি না। আমার নজর ওই তত্ত্বকথাটির দিকে যে, হিটলার এখনও বেঁচে আছেন।

সত্যি নাকি?

আমি এবার জর্মনিতে বেশি লোককে এ প্রশ্ন শুধোইনি। তার কারণ আমি নিজে যখন নিঃসংশয় যে হিটলার বেঁচে নেই তখন এ বিষয়ে প্রশ্ন জিগ্যেস করে আমার লাভ কী? যে দু-একজনকে শুধিয়েছিলাম তারাও নিঃসংশয় বেঁচে নেই।

তা হলে প্রশ্ন, তিনি যে বেঁচে আছেন এ গুজবের উৎপত্তি কোথায়?

হিটলার মারা যাওয়ার মাস তিনেক পর বার্লিনের কাছে শহর পসদামে মিত্রশক্তির এক বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নাকি স্তালিন বলেন, তাঁর বিশ্বাস, হিটলার মারা যায়নি, গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। এর কিছুদিন পর রাশান এনসাইক্লোপিডিয়ার নতুন সংস্করণের প্রকাশ হয় এবং তাতে বলা হয়, হিটলার অদৃশ্য হয়েছেন তিনি যে মারা গেছেন একথা রুশ কর্তৃপক্ষ সরকারিভাবে অস্বীকার করলেন। ইতোপূর্বে দুনিয়ার সর্বত্র কত রকমের যে গুজব রটল তার ইয়ত্তা নেই। আর্জেন্টাইন, সউদি আরব কোনও জায়গাই বাদ পড়ল না, যেখানে হিটলার নেই। এমনকি এক কাষ্ঠরসিক প্রকাশ করলেন, তিনি প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের মাঝখানে বিরাজ করছেন। সে যুগে শুটনিক-জাতীয় কোনও কিছু আবিষ্কৃত হয়নি। না হলে হয়তো বলা হত, তিনি চন্দ্রলোকে বাস করছেন। তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। চন্দ্রের লাতিন নাম লুনারিস– যা থেকে লুনাটিক–উন্মাদ–শব্দটা এসেছে এবং অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, পরাজয়ের চরম অবস্থায় হিটলার নাকি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন–তবে বদ্ধ উন্মাদ নয়, মুক্ত উন্মাদ। তাই আপন আদি বাসভূমে চলে গেছেন।

তা সে যাই হোক, ইংরেজ ভাবল, হিটলারকে নিয়ে পৃথিবীতে-না এক নতুন লিজেন্ড সৃষ্টি হয়–১৯১৮ সালে জর্মনিতে যে রকম এক লিজেন্ড চালু হয় যে জর্মন সেনাবাহিনী যুদ্ধে হারেনি, ঘরশত্রু বিভীষণ (অর্থাৎ ইহুদি, সোশ্যাল ডেমোক্রেট, কমুনিস্ট– যার যাকে অপছন্দ) যদি তার পিছনে থেকে পিঠে ছোরা না মারত। হিটলার স্বয়ং এ লিজেন্ডের প্রচুরতর সদ্ব্যবহার করেন। ইংরেজের তাই ভয় হল, হিটলারকে কেন্দ্র করে নয়া এক লিজেন্ড যেন সৃষ্টি না হয় যার জোরে এক নব-নাৎসি আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে খাড়া হয়ে ওঠে। অতএব উত্তমরূপে তদন্ত করা হোক, হিটলার বেঁচে আছে কি নেই।

এ কাজের ভার এক অতিশয় যোগ্য ব্যক্তির ওপর পড়ে। ট্রেভার রোপার সাহেব খুবসম্ভব অক্সফোর্ডের অধ্যাপক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সেনাবাহিনীর ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ বা গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করতেন।

দীর্ঘদিন ধরে অতি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি তার তদন্ত চালান। সেই তদন্তের রিপোর্ট পাঠক পাবেন তার লেখা লাস্ট ডেজ অব হিটলার পুস্তকে। অতি উপাদেয় সে পুস্তক। একদিক দিয়ে খাঁটি ঐতিহাসিকের মতো প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি সাক্ষীর বক্তব্য তিনি যাচাই করেছেন অতিশয় সন্তর্পণে, অন্যদিক দিয়ে তিনি সেসব তথ্য পরিবেশন করেছেন প্রকৃত ক্রিয়েটিভ আর্টিস্টের মতো সরল ভাষায়, মনোরম শৈলীতে। পাঠকের কৌতূহল বাড়িয়ে বাড়িয়ে তাকে কী করে উল্কণ্ঠিত উদগ্রীব অবস্থায় পৌঁছিয়ে সর্বশেষে সর্বাঙ্গসুন্দর সমাপ্তিতে রসসৃষ্টি করতে হয়, ঐতিহাসিক হয়েও ট্রেভার রোপার এই কৌশলটি সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে নিয়েছেন। বস্তুত এরকম রোমাঞ্চকর পুস্তক আমার জীবনে অল্পই পড়েছি।

কোনও কোনও অরসিক অবশ্য বলেছেন, বইখানা লুরিড, অর্থাৎ রগরগে, কিংবা বলতে পারেন, পুস্তকে বীভৎস রসের প্রাধান্য। এটা অবশ্য রুচির কথা; তবে আমার বিশ্বাস, বিষয়বস্তু নিজের থেকেই তার রসরূপ নির্ণয় করে। প্রকৃত ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট সে-স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। সে যেন নিতান্ত মিডিয়াম ভিন্ন অন্য কিছু নয়। রানী চন্দ যেভাবে ঘরোয়া লিখেছেন। এস্থলে অবশ্য অবন ঠাকুরের স্থলে ঘটনাপ্রবাহই তার রসরূপ নির্ণয় করে দিয়েছে।

তৎসত্ত্বেও বহুতর লোক বিশ্বাস করতে নারাজ হলেন যে, হিটলার গত হয়েছেন। এঁরা যেসব আপত্তি তুললেন, ট্রেভার রোপার তার বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে সেগুলোকে দফে দফে হালুয়া করে ছেড়েছেন। ভদ্রলোক ব্যঙ্গ করতেও জানেন। তাঁর বক্তব্য অনেকটা এই : শীতকালে যখন ইউরোপের লোক গরম জায়গায় যেতে চায় তখন দেখা গেল যারা– এদের অধিকাংশই খবরের কাগজের রিপোর্টার ট্রেভার রোপারের রায়ে সায় দিচ্ছেন না, তাঁরা বলছেন হিটলারের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে আর্জেন্টিনায়, এবং গ্রীষ্মকালে বলেন, তার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে (গ্রীষ্মে শীতল, মনোরম) সুইটজারল্যান্ডে। ট্রেভার রোপার বলেননি, কিন্তু ইঙ্গিত করেছেন, অতএব পত্রিকার পয়সায় শীতে গরম জায়গা এবং গরমে শীতল জায়গায় দিব্যি কয়েকটা দিন পরমানন্দে কেটে গেল।

তবে এ-কথা বলা যেতে পারে যে, বইখানাকে কেউ সিরিয়াসলি চ্যালেঞ্জ করেননি। এবং ট্রেভার রোপার তার সর্বশেষ শিরোপা পেলেন রাশার কাছ থেকে। হালে রাশান এনসাইক্লোপিডিয়ার যে নতুন সংস্করণ বেরিয়েছে তাতে বলা হয়েছে হিটলার মৃত।

শুধু এই বই নয়, হিটলারের সঙ্গে যারা তার বুঙ্কারে (বোমারু বিমানের বোমা থেকে আত্মরক্ষার্থে নির্মিত ভূগর্ভস্থ আশ্রয়গৃহ) শেষমুহর্ত পর্যন্ত ছিলেন তাদের জীবিতজন মাত্রই পরবর্তীকালে বই লিখেছেন, বিবৃতি দিয়েছেন অথবা খবরের কাগজে মাসিক প্রবন্ধাদি লিখেছেন। এদের সকলে মিলে একজোট হয়ে হিটলারের মৃত্যুর একটা মিথ্যা কাহিনী রচনা করে নানা ঘড়েল পুলিশ, রিপোর্টার ইত্যাদির ক্রস এগজামিনেশনে পাস করে এখনও সেটা আঁকড়ে ধরে আছেন– এটা অবিশ্বাস্য। আরও নানাবিধ কারণ আছে এবং ট্রেভার রোপার সেগুলো সবিস্তর আলোচনা করেছেন। হালে শাইরার (Shirer) নামক একজন মার্কিন কর্তৃক লিখিত হিটলারের রাজত্ব সম্বন্ধে বিরাট একখানা বই বেরিয়েছে এবং ইতোমধ্যে তার জর্মন অনুবাদও হয়ে গিয়েছে। বইখানা মোটের ওপর ভালোই। কিন্তু ওভার সিপ্লিফিকেশনের দোষে দুষ্ট। শাইরার ও হিটলারের অন্যান্য জীবনী-লেখকগণও ঐকনাদে স্বীকার করেন, হিটলার মৃত।

কিন্তু হিটলার জীবিত না মৃত সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা এই, জর্মন জনগণ হিটলার সম্বন্ধে কী ভাবে, আবার যদি অন্য রঙ ধরে আরেক হিটলার দেখা দেন তবে সে তার অধুনালব্ধ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা বর্জন করে পুনরায় গড্ডলিকা স্রোত বওয়াবে কি না? এবং ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত সে যে এক বিরাট অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেল সে সম্বন্ধে তার মতামত কী?

যাদের বয়স পঁচিশ-ত্রিশের চেয়ে কম তাদের জিগ্যেস করে কোনও লাভ নেই, কারণ যুদ্ধের বিভীষিকা তাদের কারও কারও কিছুটা মনে আছে বটে, কিন্তু হিটলারের চিন্তাধারা কর্মপদ্ধতি আপন বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করার মতো বয়স তাদের তখনও হয়নি। যাদের বয়স তাদের চেয়ে বেশি তারা একদম চুপ; কোনও কিছু বলতে চায় না। এরা যে ভয়ে মুখ খোলে না তা নয়, কারণ আমি যাদের চিনি তাদের অধিকাংশই ছিলেন সোশ্যাল ডেমোক্রেট, কিংবা ক্যাথলিক সেন্টার (আজ আডেনাওয়ার যার দলপতি) এবং হিটলার-বৈরী। ১৯৩৭-৩৮-এ বরঞ্চ এঁরা ফিসফিস করে আমার কানে কানে হিটলার-রাজ্যের তীব্রতম নিন্দা করেছেন। কিন্তু আজ আর কোনও জর্মনই অতীত নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। এ যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো কেটে গিয়েছে, এটাকে নিয়ে আর আলোচনা করে লাভ কী?

আমার কোনও পাঁড় নাৎসি বন্ধু ছিল না, একজন মোলায়েম নাৎসির সঙ্গে বেশ কিছুটা হৃদ্যতা হয়েছিল। তার সন্ধান পেলুম না। তার-আমার দুজনার অন্য এক বন্ধু বলল– খুব সম্ভব মারা গিয়েছে।

তবু আমি প্রাচীন পরিচয়ের একাধিক জর্মন মিলিত হলে কথার মোড় ওইদিকে ঘোরাতুম। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হত না। পাঁচ মিনিটের ভেতর সবাই যুদ্ধ বাবদে আপন আপন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে শুরু করত। তাতে আর যা হোক, হিটলার-দর্শনের ওপর নতুন কোনও আলোকপাত হত না।

একদা যারা কট্টর নাৎসি ছিল তাদের বৃহৎ অংশ নিশ্চয়ই নাৎসিবাদ ত্যাগ করেছে। কিন্তু বেশকিছু নাৎসি এখনও গোপনে ঘাপটি মেরে বসে আছে চিন্তার জগতে; বাইরে অবশ্য আর পাঁচজনের মতো তারাও দরকার হলে হিটলারের নিন্দা করে, কারণ নাৎসি-উইচ-হান্টিং, অর্থাৎ ডি-নাৎসিফিকেশন এখনও শেষ হয়নি (এই তো মাস তিনেক পূর্বে ইয়োরোপ-বিখ্যাত এক শহর-প্ল্যানার জর্মনকে ধরা হয়েছে সে নাকি ১৯৪৫ সালে প্রায় ত্রিশজন ইটালিয়ান মজুরকে গুলি করে মারার আদেশ দেয়)*। [*১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে জর্মনিতে একটি কেন্দ্রীয় বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। এর একমাত্র কাজ পাড় নাৎসিদের ধরে সাজা দেওয়া। এর পূর্বে জর্মনির ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে সেখানকার সাধারণ বিচারালয়ে এদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চলত। এদের প্রধান অসুবিধা : যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক মাস পূর্ব থেকে ঘড়েল নাৎসিরা খাঁটি, অকৃত্রিম সরকারি পাসপোর্ট জাল নামে তৈরি করিয়ে নেয়। এবং এখন আপন বাসভূমি থেকে– জর্মনিতেই গা-ঢাকা দিয়ে বসবাস করছে। দ্বিতীয় অসুবিধা : একাধিক পরদেশি রাষ্ট্র তাদের দেশে আশ্রয়প্রাপ্ত নাৎসিদের ধরে ধরে জর্মনিতে ফেরত দেয় না। হালে জর্মনির বেতার কেন্দ্রের প্রশ্নে এই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের চিফ জাস্টিস বলেন, এই প্রতিষ্ঠান কবে গুটনো হবে তার স্থিরতা নেই।] এরা পুনরায় এক নতুন হিটলারের পিছনে জড়ো হবে সে সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, গুরুবাদ জিনিসটা একবার শিকড় গাড়লে সমূলে সম্পূর্ণ বিনাশ পায় না– হিটলারকে জর্মনি যেভাবে পূজা করেছে আমাদের চরম কর্তাভজারাও এতখানি করেনি।

উপস্থিত এদের কথাও কেউ শুনবে না– অবশ্য সাহস তাদের এখনও হয়নি, হতে হতে বেশ কিছুদিন লাগবে। কারণ জর্মনি এখনও অবসন্ন। রাজনৈতিক উত্তেজনা তার যথেষ্ট হয়ে গিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *