আন্তন চেখফের ‘বিয়ের প্রস্তাব’
অনুবাদকের টিপ্পনী
আন্তন চেখফের রচনায় রাশার যে যুগের বর্ণনা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে আমাদের জমিদারি যুগের প্রচুর মিল দেখতে পাই। সেই কারণেই বোধহয় আমাদের শরৎচন্দ্র প্রচুর রাশান উপন্যাস, ছোটগল্প অতিশয় মনোযোগ সহকারে পড়েছিলেন। শরৎচন্দ্র অসাধারণ শিল্পী, তাই তার পরিণত বয়সের লেখাতে অন্যের প্রভাব খুঁজতে যাওয়া নিষ্ফল। তবে যদি কোনও সাহিত্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করে থাকে তবে সেটা রুশ সাহিত্য। তাঁর দত্তার সঙ্গে এ-নাটিকার কোনও মিল নেই, কিন্তু দুটিতেই আছে একই জমিদারির আবহাওয়া।
চেখফ যে যুগের বর্ণনা দিয়েছেন সে সময় একই লোককে ভিন্ন ভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ডাকত। যেমন এই নাটিকার নায়িকার নাম নাতালিয়া স্তেপানভনা চুবুকফ। অতি অল্প পরিচয়ে লোক তাকে ডাকবে মিস চুবুকফ বলে। যাদের পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হয়েছে, তারা ডাকবে নাতালিয়া স্তেপানভনা (স্তেপানভনা = স্তেপানের মেয়ে)। যাদের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় তারা ডাকবে শুধু নাতালিয়া, এবং যারা নিতান্ত আপনজন তারা ডাকবে নাতাশা। এখনও বোধহয় এই রীতিই প্রচলিত আছে, তবে যে স্থলে মিস চুবুকফ বলা হত আজ বোধহয় সেখানে কমরেড চুবুকফ যা চুবুকভা বলা হয়।
পাত্র-পাত্রীগণ :
স্তেপান স্তেপানভি চুবুকফ জমিদার।
নাতালিয়া (ডাকনাম নাতাশা) স্তেপানভনা চুবুকফ ওই জমিদারের কন্যা; বয়স ২৫।
ইভান ভাসিলিয়েভ লমফ– চুবুকফের প্রতিবেশী জমিদার, স্বাস্থ্যবান হৃষ্ট-পুষ্ট লোক, কিন্তু সমস্তক্ষণ ভাবেন তিনি বড্ডই অসুস্থ (হাইপোক্রাডিআক)।
ঘটনা চুবুকফের জমিদারিতে।
চুবুকফের ড্রইংরুম। চুবুকফ এবং লম; ইভনিং ড্রেস এবং সাদা দস্তানা পরে লমফের প্রবেশ
চুবুকফ : লিমফের দিকে এগিয়ে গিয়ে] এস, এস, বন্ধুবর। এ যে একেবারে অপ্রত্যাশিত, ইভান ভাসিলিয়েভি। কিন্তু বড় আনন্দ হল, বড়ই আনন্দ হল হ্যান্ডশেক। সত্যি একেবারে তাক লাগিয়ে দিলে, ভায়া। কী রকম আছ?
লমফ : ধন্যবাদ। আর আপনি কী রকম আছেন?
চুবুকফ : মোটামুটি আমাদের ভালোই যাচ্ছে, বাছা– তোমাদের প্রার্থনা আর-যা-সব-কী-সব তো রয়েছে। বস, বস। জানো, এরকম করে পুরনো দিনের প্রতিবেশীকে তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়? বড় খারাপ, বড়ই খারাপ। কিন্তু বল দিকিনি, এতসব ধড়াচুড়ো পরে কেন। পুরোপাক্কা ফুল ডিনার ড্রেস, হাতে দস্তানা আর-যা-সব-কী-সব? কারও সঙ্গে পোশাকি দেখা করতে যাচ্ছ নাকি, না অন্য কিছু ভায়া?
লমফ : আজ্ঞে না, শুধু আপনাদের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।
চুবু : তবে ফুল ডিনার ড্রেস কেন, ভায়া। মনে হচ্ছে তুমি যেন নববর্ষে পোশাকি মোলাকাত করতে এসেছ!
লমফ। : ব্যাপারটা হচ্ছে (চুবুকফের হাত ধরে)… আমি কি না, আমি এসেছি আপনার কাছ থেকে একটা অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে, স্যার শুধু আশা করছি আপনি বিরক্ত হবেন না। আপনার কাছ থেকে এর আগেও আমি সাহস করে কয়েকবার সাহায্য চেয়েছি এবং আপনিও, সবসময়েই, বলতে কী… কিন্তু মাফ করুন, আমার গোলমাল হয়ে যাচ্ছে… আমি একটুখানি জল খাই। [জলপান]
চুবু : নেপথ্যে টাকা ধার চাইতে এসেছে নিশ্চয়ই। দেব না। [লমফকে] কী হয়েছে, বল না ভায়া।
লমফ : দেখুন স্যার, … কিন্তু মাফ করুন, স্যার…. আমার সব ঘুলিয়ে যাচ্ছে .. দেখতেই পাচ্ছেন… মানে কী না, আপনি একমাত্র লোক যিনি আমায় সাহায্য করতে পারেন, যদিও সত্যি বলতে কী, আমি এ যাবৎ আপনার জন্য এমন কিছু করতে পারিনি যার জন্য আপনার কাছ থেকে সাহায্য প্রত্যাশা করতে পারি, সত্যি, আমার সে হক্ক আদপেই নেই…
চুবু : কী বিপদ! অত সুতো ছাড়ছ কেন ভায়া। বলেই ফেল না, কী হয়েছে বল।
লমফ : বলছি, বলছি, এখখুনি বলছি… ব্যাপারটা হচ্ছে এই, আমি আপনার মেয়ে। নাতালিয়া স্তেপানভনাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
চুবু : (সোল্লাসে) ইভান ভাসিয়েলিভিচ! প্রাণের বন্ধু আমার! ফের বল তো, কী বললে। আমি ঠিক ঠিক শুনতে পাইনি।
লমফ : অতিশয় সবিনয় নিবেদন জানাচ্ছি ..
চুবু : [বাধা দিয়ে সোনার চাঁদ ছেলে! আমি যে কী খুশি হয়েছি আর-যা-সব-কী সব। নিশ্চয় নিশ্চয় আর-যা-সব-কী-সব। লিমকে আলিঙ্গন ও চুম্বন] ঠিক এই জিনিসটিই আমি বহুকাল ধরে চাইছিলুম [একফোঁটা চোখের জল তোমাকে আমি চিরকালই আপন ছেলের মতো স্নেহ করেছি। ভগবান তোমাদের হৃদয়ে একে অন্যের জন্য প্রেম দিন, তোমাদের মনের মিল হোক, আর-যা-সব-কী সব। সত্যি বলতে কী, আমি সব সময়েই চেয়েছিলুম… কিন্তু আমি এখানে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করছি কী? আমাকে কেউ যেন আনন্দের ডাঙশ মেরেছে আমার মাথায় কিছু আসছে না। আহা, আমার সমস্ত হৃদয় ঢেলে– আমি গিয়ে নাতাশাকে ডাকছি, আর-যা-সব-কী-সব—
লমফ : স্যার, উনি কী বলবেন আপনার মনে হয়? তিনি সম্মতি দেবেন, আশা করতে পারি?
চুবু : কী বললে? নাতাশা যদি রাজি না-ও হতে পারে! অবাক করলে! আর তোমার চেহারাটাও চমৎকার নয়? ধরো বাজি, ও তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, আর-যা-সব-কী-সব। আমি এখুনি তাকে বলছি গে।
[নিষ্ক্রমণ]
লমফ : [একা] আমার শীত-শীত করছে… আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে, যেন পরীক্ষার হলে যাচ্ছি। আসল কথা হচ্ছে, মন স্থির করা। বেশিদিন ধরে শুধু যদি ভাবতেই থাকো, এর সঙ্গে ওর সঙ্গে শুধু আলোচনা করো, গড়িমসি গড়িমসি করতে থাকো, আর কোনও এক আদর্শ রমণীর জন্য, কিংবা খাঁটি সত্য প্রেমের জন্য পথ চেয়ে থাকে, তবে তোমার কখনও বিয়েই হবে না। উঁহুহুহু… কী শীত করছে আমার! নাতালিয়া স্তেপানভৃনা সংসার চালায় চমৎকার, লেখাপড়ি করেছে আর দেখতেও খারাপ নয়… এর বেশি আমার কীই-বা চাই? কিন্তু আমি ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। মাথাটা তাজ্জিম মাজ্জিম করছে। [জলপান] কিন্তু আমার আইবুড়ো হয়ে থাকা চলবে না। পয়লা কথা, আমার বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় : আমাকে মেপেজুকে ছকে কাটা জীবন চালাতে হবে… আমার বুকের ব্যামো রয়েছে, ভিতরটা সর্বক্ষণ ধড়ফড়… আমি কত সহজেই রেগে কাঁই হয়ে যাই আর কত সহজেই উত্তেজনার চরমে পৌঁছে যাই… এই তো, এই এখৃখুনি আমার ঠোঁট কাঁপছে আর ডান চোখের পাতাটা নাচছে… কিন্তু সবচেয়ে বিপদ হল আমার ঘুম নিয়ে। বিছানায় যেই শুয়েছি আর চোখদুটো জুড়ে আসছে অমনি কী যেন কী একটা আমার বাঁ পাশটায় ছোরা মারে। এক্কেবারে ছোরা মারার মতো। আর সেটা সরাসরি আমার কাঁধের ভিতর দিয়ে গিয়ে মাথা অবধি পৌঁছে যায়। আমি খ্যাপার মতো লাফ দিয়ে উঠি, খানিকটা পায়চারি করি, ফের শুয়ে পড়ি… কিন্তু যেই না আবার ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে এল আর অমনি আবার পাশের দিকটায় সেই ছোরার ঘা– আর ওই একই ব্যাপার নিদেন কুড়িটি বার…
[নাতালিয়ার প্রবেশ]
নাতালিয়া : ও, আপনি! অথচ বাবা বললেন : যাও, খদ্দের মাল নিতে এসেছে। কী রকম আছেন, ইভান ভাসিলিয়েভিচ?
লমফ : আপনি কী রকম, নাতালিয়া স্তেপানভনা?
নাতালিয়া : কিছু মনে করবেন না, আমার এপ্রন পরা রয়েছে, ভদ্রদুরুস্ত জামা-কাপড় পরিনি বলে। আমরা মটরশুটির খোসা ছাড়াচ্ছিলুম রোদ্দুরে শুকোবার জন্যে। এতদিন আমার সঙ্গে যে বড় দেখা করতে আসেননি? বসুন না …. দু জনেই বসলেন দুপুরবেলা এখানে খাবেন?
লমফ : না। অনেক ধন্যবাদ। আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে।
নাতালিয়া : সিগরেট খাবেন না? এই তো দেশলাই… আজকের দিনটা চমৎকার, কিন্তু কাল এমনি জোর বৃষ্টি হল যে মজুররা সমস্তদিন কিছুই করতে পারল না। জানেন, আমরা কাল ক-গাদা খড় তুলতে পেরেছি? বিশাস করবেন না, আমি সব খড় কাটিয়ে নিয়েছিলুম, আর এখন তো আমার প্রায় দুঃখ হচ্ছে ভয় হচ্ছে, সব খড় পচে না যায়। হয়তো অপেক্ষা করলে ভালো হত। কিন্তু এসব কী? আমার মনে হচ্ছে আপনি ধরাচুড়ো পরেছেন। এ তো নতুন দেখলুম। আপনি কি বনাচ কিংবা অন্য কিছু একটায় যাচ্ছেন? হ্যাঁ, কী বলছিলুম, আপনি বদলে গেছেন– ভালো দেখাচ্ছে আগের চেয়ে!… কিন্তু, সত্যি, আপনি ধড়াচুড়ো পরেছেন কেন? লমফ : [উত্তেজিত হয়ে ব্যাপারটা কী জানেন, নাতালিয়া স্তেপান… আসলে কী জানেন, আমি মনস্থির করেছি, আপনাকে… মন দিয়ে শুনুন … আপনি নিশ্চয়ই আশ্চর্য হবেন, হয়তো-বা রাগ করবেন, কিন্তু আমি… [নেপথ্যে) আমি শীতে জমে গেলুম।
নাতালিয়া; কী বলুন তো! [একটু থেমে] বলুন।
লমফ : সংক্ষেপেই বলি। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, শ্রীমতী নাতালিয়া স্তেপানভনা, যে, আমি বহুকাল ধরে আপনাদের পরিবারের সান্নিধ্য পেয়ে কৃতকৃতার্থ হয়েছি– ছেলেবয়েস থেকে, সত্যি বলতে কি। আমার যে পিসিমার কাছ থেকে তিনি গত হলে পর তার জমিদারি পেয়েছি, তিনি আর পিসেমশাই দু জনাই আপনার পিতা এবং স্বর্গত মাতাকে গভীর সম্মানের চক্ষে দেখতেন। লমফ আর চুবুকফ পরিবারের বরাবরই বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, এমনকি ঘনিষ্ঠতাও ছিল, বলা চলে। তা ছাড়া, আপনি জানেন, আমার জমিদারি আপনাদের জমিদারির একেবারে গা-ঘেঁষে। আপনার হয়তো মনে পড়বে আমার ভলোভি মাঠ আপনাদের বার্চবনের লাগাও।
নাতালিয়া : মাফ করবেন, কিন্তু এখানে আমাকে বাধ্য হয়ে আপনার কথা কাটতে হল। আপনি যে বলেছেন, আমার ভলোভি মাঠ… কিন্তু ওটা কি সত্যি আপনার?
লমফ : হ্যাঁ, আমার…
নাতালিয়া : তাই নাকি! এর পর আর কী চেয়ে বসবেন! ভলোভি মাঠ আমাদের, আপনার নয়।
লমফ : না। ওটা আমার, নাতালিয়া স্তেপান। নাতালিয়া : এটা আমার কাছে নতুন খবর বলে ঠেকছে। ওটা আপনার হল কী করে? লমফ : তার মানে? আমি তো সেই ভলোভি মাঠের কথা বলছি, যেটা আপনাদের বার্চবন এবং পোড়া-বনের মাঝখানটায়…
নাতালিয়া : হ্যাঁ, সেইটের কথাই তো হচ্ছে.. ওটা আমাদের।
লমফ : না, আপনি ভুল করেছেন নাতালিয়া স্তেপানভনা, ওটা আমার।
নাতালিয়া : পাগলামি ছাড়ুন ইভান ভাসিলিয়েভি। ওটা ক-দিন ধরে আপনাদের হয়েছে?
লমফ : ক-দিন ধরে মানে? যতদিন ধরে আমার মনে পড়ে– ওটা তো চিরকালই আমাদের।
নাতালিয়া : আমাকে মাফ করতে হচ্ছে, আমি একমত হতে পারছিনে।
লমফ : কিন্তু আপনি ইচ্ছে করলেই দলিলপত্রে জিনিসটা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। একথা অবশ্যি সত্য যে ভলোভি মাঠের স্বত্ব নিয়ে একসময় মতবিরোধ হয়েছিল কিন্তু এখন তো কুল্লে দুনিয়া জানে, ওটা আমার। তা নিয়ে তর্কাতর্কি করার এখন আর কোনও প্রয়োজন নেই। আপনাকে জিনিসটা বুঝিয়ে বলছি আমার পিসির ঠাকুরমা আপনার প্রপিতামহের রায়তদের ওই মাঠটা বিনা খাজনায়, অনির্দিষ্টকালের জন্য ভোগ করতে দেন; তার বদলে ওরা তার ইটের পাঁজা পোড়াবার ব্যবস্থা করে দেয়। আপনার প্রপিতামহের চাষারা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ওটা লাখেরাজ ভোগ করে করে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে মনে করে ওটার স্বত্ব ওদেরই। কিন্তু দাস-প্রথা উঠে যাওয়ার পর যখন নতুন বন্দোবস্ত হল….
নাতালিয়া : কিন্তু আপনি যা বলছেন সেটা আদপেই ওরকম ধারা নয়। আমার পিতামহ এবং প্রপিতামহ জানতেন যে তাদের জমিদারির হদ্দ পোড়া-বন অবধি কাজেই ভলোভি মাঠ আমাদের সম্পত্তির ভিতর পড়ল বইকি। তা হলে সেটা নিয়ে খামখা তর্ক করছেন কেন? আমি সত্যি আপনার কথার মাথা-মুণ্ডু বুঝতে পারছিনে। হক কথা বলতে কী, আমার বিরক্তি বোধ হচ্ছে।
লমফ : আপনাকে আমি দলিল-দস্তাবেজ দেখাব নাতালিয়া স্তেপানভনা।
নাতালিয়া : না। আমার মনে হচ্ছে, আপনি মস্করা করছেন কিংবা আমাকে চটিয়ে মজা দেখছেন… বাস্তবিক, এটা একটা তাজ্জব ব্যাপার। জমিটা প্রায় তিনশো বছর ধরে আমাদের স্বত্বে, আর আজ হঠাৎ একজন বলে উঠল, ওটা আমাদের নয়। মাফ করবেন, ইভান ভাসিলিয়েভিচ, আমি আমার আপন কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না… অবশ্য আমি ওই জমিটার কোনও মূল্যই দিইনে। কত আর হবে– পনেরো একরটাক, তিনশো রুবলের বেশি ওর দাম হবে না, কিন্তু ওটা নিয়ে এই নাহক অবিচার আমার পিত্তি চটিয়ে দেয়। আপনি যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু আমি অন্যায়-অবিচার বরদাস্ত করতে পারিনে।
লমফ : আপনাকে মিনতি করছি, আমার সব কথা শুনুন। আপনার প্রপিতামহের চাষারা আমার পিসির ঠাকুরমার ইট পোড়াবার ব্যবস্থা করে দেয়– একথা আমি পূর্বেই আপনাকে নিবেদন করেছি। আমার পিসির ঠাকুরমা তার বদলে ওদের অনুগ্রহ দেখাতে গিয়ে…
নাতালিয়া : ঠাকুদ্দা, ঠাকুমা, পিসি… আমার মাথায় ওসব কিছুই ঢুকছে না। মাঠটা আমাদের, ব্যস!
লমফ : ওটা আমার।
নাতালিয়া : ওটা আমাদের। আপনি ঝাড়া দু দিন ধরে তর্ক করুন, যদি সাধ যায় পনেরোটা ধড়াচুড়ো সর্বাঙ্গে চড়ান, কিন্তু তবু ওটা আমাদেরই, আমাদেরই, আমাদেরই।… আপনার জিনিস আমি চাইনে, কিন্তু যে জিনিস আমার সেটা আমি হারাতে চাইনে… আপনার যা ইচ্ছে তাই ভাবতে পারেন।
লমফ : ও মাঠ আমি চাইনে, নাতালিয়া স্তেপানভুনা, কিন্তু এটা হচ্ছে ন্যায়-অন্যায়ের কথা। আপনি যদি চান তবে এটা আমি আপনাকে উপহার দিতে পারি।
নাতালিয়া : কিন্তু ওটা যদি বিলিয়ে দিতে হয় তো সে হক্ক তো আমার কারণ ওটা তো আমার জিনিস। আপনাকে খোলাখুলি বলছি, ইভান ভাসিলিয়েভিচ, আমার কাছে সব-কিছু বড়ই আজগুবি মনে হচ্ছে। এতদিন অবধি আমরা আপনাকে ভালো প্রতিবেশী বলেই মনে করেছি, আমাদের বন্ধুরূপেই আপনাকে গণ্য করেছি। গেল বছরে আমরা আপনাকে আমাদের গম-মাড়াইয়ের কলটা দিলুম; ফলে আমাদের আপন গম তুলতে তুলতে নভেম্বর হয়ে গেল। আর এখন আপনি আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার আরম্ভ করলেন যেন আমরা রাস্তার বেদে। আমাকে উপহার দিচ্ছেন আমার নিজের জমি। কিছু মনে করবেন না, কিন্তু এটা কি প্রতিবেশীর আচরণ? আমি বলব, এটা রীতিমতো বেয়াদবি যদি শুনতেই চান…।
লফম : আপনি বলতে চান, আমি তছরুপ করি! আমি কখনও অন্যের জিনিস চুরি করিনি, ম্যাডাম, আর কেউ এ কথা বললে আমি কিছুতেই সেটা বরদাস্ত করব না… দ্রুতগতিতে জগের কাছে গমন ও জলপান] ভলোভি মাঠ আমার!
নাতালিয়া : কচু। ওটা আমাদের।
লমফ : ওটা আমার।
নাতালিয়া : ডাহা মিথ্যে। আপনাকে আমি প্রমাণ করে দিচ্ছি। আজই আমি আমার লোকজনকে ওই মাঠে ঘাস কাটতে পাঠাচ্ছি।
লমফ : কী বললেন?
নাতালিয়া : আমার লোকজন আজই ওখানে কাজ করবে।
লমফ : আমি ওদের লাথি মেরে খেদিয়ে দেব।
নাতালিয়া : আপনার সে মুরোদ নেই।
লমফ : [বুক আঁকড়ে ধরে] ভলোভি মাঠ আমার! এই সামান্য কথাটা বুঝতে পারছেন না? আমার!
নাতালিয়া : দয়া করে চাঁচাবেন না। আপন বাড়িতে বসে চাঁচাতে চাঁচাতে আপনার দম বন্ধ হয়ে যাক, কিন্তু এখানে বাড়াবাড়ি করবেন না।
লমফ : আমার বুকের ভিতর যদি ওরকম মারাত্মক ব্যথা আর ধড়ফড়ানি না থাকত, ম্যাডাম, আমার রগদুটো যদি দপদপ না করত, আমি তা হলে আপনার সঙ্গে অন্যভাবে কথা বলতুম। [চিৎকার করে) ভলোভি মাঠ আমার!
নাতালিয়া : আমাদের।
লমফ : আমার!
নাতালিয়া : আমাদের!
লমফ : আমার!
[চুবুকফের প্রবেশ]
চুবুকফ : ব্যাপার কী? তোমরা চ্যাঁচাচ্ছ কেন?
নাতালিয়া : বাবা, তুমি এই ভদ্রলোককে একটু বুঝিয়ে বল না, ভলোভি মাঠটা কার ওঁর, না আমাদের!
চুবু: [লমফকে] মাঠটা আমাদের, বাবা।
লমফ : মাফ করবেন, স্যার; ওটা আপনাদের হল কী করে? আপনি অন্তত হক্কের বিচার করবেন। আমার পিসির ঠাকুরমা আপনার ঠাকুরদার চাষাদের জমিটা কিছুদিনের জন্য লাখেরাজ ভোগ করতে দেন। চাষারা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সেটা ভোগ করে। ফলে আস্তে আস্তে ওদের বিশ্বাস হয়ে যায় ওটা ওদেরই। কিন্তু পরে যখন নতুন বন্দোবস্ত হল…। কিছু মনে করো না, বাবা… তুমি ভুলে যাচ্ছ যে, ওই জমিটার স্বত্ব আর-যা-সব-কী-সব নিয়ে ঝামেলা ছিল বলেই চাষারা তোমার ঠাকুরমাকে কোনও খাজনা দেয়নি, আর-যা-সব-কী-সব… আর এখন গাঁয়ের কুকুরটা পর্যন্ত জানে যে ওটা আমাদের হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই। তুমি নিশ্চয়ই জরিপের ম্যাপগুলো দেখনি।
লমফ : কিন্তু আমি আপনাকে প্রমাণ করে দেখাব, জমিটা আমার।
চুবু : সে, বাছা, তুমি পারবে না।
লমফ : নিশ্চয় পারব।
চুবু : কিন্তু চ্যাঁচাচ্ছ কেন, লক্ষ্মীটি। চাঁচালেই কি কোনও জিনিস প্রমাণ হয়? তোমার যা হক্কের মাল তা আমি চাইনে, কিন্তু যে জিনিস আমার সেটা ছাড়বার বাসনা আমার কণামাত্র নেই। ছাড়ব কেন? অবশ্য আখেরে যদি তাই দাঁড়ায়, অর্থাৎ তুমি যদি ওই জমি নিয়ে ঝগড়া-কাজিয়া আরম্ভ করতে চাও, আর যা-সব-কী-সব, তা হলে আমি বরঞ্চ আমার চাষাদের ওই জমিটা বিলিয়ে দেব, কিন্তু তোমাকে না। এই হল পাকা কথা। লমফ : আমি তো বুঝতে পারলুম না। পরের সম্পত্তি বিলিয়ে দেবার কী হক্ক আপনার?
চুবু : আমার কী হক আছে, না আছে সেটা স্থির করার ভার দয়া করে আমার হাতে ছেড়ে দাও। আর শোনো, ছোকরা, আমি এরকম ধরনের কথা বলা আর–সব-কী-সব শুনতে অভ্যস্ত নই… আমার বয়স তোমার ডবল, তবু তোমায় অনুরোধ করছি ওরকম মাথা গরম করে, আর-যা-সব-কী-সব ওরকম ধারা আমার সঙ্গে কথা কয়ো না…।
লমফ : না। আপনারা ভেবেছেন আমি একটা আস্ত গাড়ল আর আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছেন। আমার জমি বলছেন আপনাদের আর তার পর আশা করছেন আমি সুবোধ ছেলেটির মতো শান্ত কণ্ঠে আর পাঁচজনের মতো কথাবার্তা বলব। ভালো প্রতিবেশী এ-রকম কথা বলে না, স্তেপান স্তেপানভিচ মশাই! আপনি প্রতিবেশী নন, আপনি পরের জমির বেদখলকারী।
চুবু : মানে? কী বললে?
নাতালিয়া : বাবা, এখখুনি মজুরদের মাঠে ঘাস কাটতে পাঠাও।
চুবু : (লমফকে] আপনি আমাকে কী বলছিলেন, স্যার?
নাতালিয়া : ভলোভি মাঠ আমাদের আর ওটা আমি ছাড়ব না, ছাড়ব না, ছাড়ব না।
লমফ : সে আমরা দেখে নেব। আমি আদালতে সপ্রমাণ করে ছাড়ব ও মাঠ আমার।
চুবু : আদালতে? আপনি আদালতে যান না, স্যার, আর-যা-সব-কী-সব। যান না, যান। আমি আপনাকে বিলক্ষণ চিনি–এতদিন ধরে শুধু অপেক্ষা করেছিলেন আদালতে যাবার জন্য, একটা মোকা পাওয়ার আর-যা-সব-কী-সব। তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাতামাতি করা– ওই তো তোমাদের স্বভাব। তোমাদের পরিবারের সব ক-জনাই মামলাবাজিতে ওস্তাদ! সব কটা।
লমফ : দয়া করে আমার পরিবারের লোককে অপমান করবেন না। লমগুষ্টির সবাই সন্তান। আপনার কাকার মতো তহবিল তছরুপের দায়ে কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
চুবু : লমফ পরিবারের সব কটা বদ্ধ পাগল!
নাতালিয়া : সব কটা সাকুল্যে!
চুবু : তোমার ঠাকুরদা ছিলেন পাঁড় মাতাল, আর তোমার ছোট মাসি নাতাসিয়া মিহাইলভনা–-হ্যাঁ, হ্যাঁ, একদম খাঁটি কথা… এক রাজ-মিস্ত্রির সঙ্গে পালিয়ে যায়, আর-যা-সব-কী-সব।
লমফ : আর আপনার মা ছিলেন কুঁজো। হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে আমার বুকের সেই বেদনাটা চিলিক মারছে… সব রক্ত আমার মাথায় উঠে গেছে… হে ভগবান, জল, জল!
চুবু : তোমার বাবা ছিলেন জুয়াড়ি আর পেটুকের হদ্দ!
নাতালিয়া : তোমার পিসি ছিলেন একটি সাক্ষাৎ নারদ গাঁ উজাড় করলে ওঁর জুড়ি মেলা ছিল ভার!
লমফ : আমার বাঁ পা-টা অবশ হয়ে গিয়েছে… আর আপনার পেটে জিলিপির প্যাঁচ… ওঃ, আমার বুকটা গেল… আর সবাই জানে, নির্বাচনের আগে আপনি.. আমার চোখের সামনে বিজলি খেলে যাচ্ছে.. আমার টুপিটা গেল কোথায়?
নাতালিয়া : এসব ছোটলোকমি! ধাপ্পাবাজি। নোংরামির চূড়ান্ত।
চুবু : আর তুমি কুচুটে, ভণ্ড, ছোটলোক। হ্যাঁ, তা-ই।
লমফ : হ্যাটটা পেয়েছি…ও আমার বুকের ভিতরটা… কোন দিক দিয়ে বেরুব? দরজাটা কোথায়? ওহ্, আমি আর বাঁচব না… আমার পা যে আর নড়ছে না। (দরজা পর্যন্ত গমন)।
চুবু : লেমকে পিছন থেকে চেঁচিয়ে আমার বাড়িতে আর কখনও পা ফেলবে না।
নাতালিয়া : আদালতে যান। আমরাও দেখে নেব!
[টেলতে টলতে লমফের প্রস্থান]
চুবু : জাহান্নামে যাক। উত্তেজনার সঙ্গে পায়চারি)।
নাতালিয়া : এ রকম একটা ছোটলোক দেখেছ কখনও? এর পরও লোকে বলে প্রতিবেশীর ওপর ভরসা রাখতে!
চুবু : আস্ত একটা সঙ! বদমাইশ!
নাতালিয়া : পিচেশ! অন্যের জমি বেদখল করে উল্টো দেয় গালাগাল?
চুবু: সৃষ্টিছাড়া ব্যাটা চক্ষুশূল জানো, ব্যাটার বেয়াদপি কতখানি? এখানে এসেছিল প্রস্তাব পাড়তে, আর-যা-সব-কী-সব! বিশ্বাস হয় তোমার প্রস্তাব করতে?
নাতালিয়া : কিসের প্রস্তাব?
চুবু : হ্যাঁ, ভাবো দিকিনি, এসেছিল তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে।
নাতালিয়া : বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে? আমাকে আগে বললে না কেন?
চুবু : তাই তো ধড়াচুড়ো পরে এসেছিল! বাঁদর! খাটাশ!
নাতালিয়া : আমাকে বিয়ে করতে? বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে? ও! [চেয়ারে পতন শুঙরে শুঙরে] ওকে ডেকে নিয়ে এস। ওকে ডেকে নিয়ে এস। ও!–ডেকে নিয়ে এস।
চুবু : কাকে ডেকে নিয়ে আসব?
নাতালিয়া : শিগগির করো, জলদি যাও। আমি যে ভিরমি যাব। ওকে ডেকে নিয়ে এস। [ছন্নের মতো আর্তরব]
চুবু : কী বলছ! কী চাও তুমি? দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে] এ কী অভিসম্পাত! আমি বন্দুকের গুলিতে মরব। আমি নিজের হাতে ফাঁস পরব। সবাই মিলে আমার সর্বনাশ করেছে।
নাতালিয়া : আমি মরে যাচ্ছি। ওকে ডেকে নিয়ে এস।
চুবু : বাপস! যাচ্ছি, যাচ্ছি। ওরকম হাউমাউ করো না। [ধাবমান]
নাতালিয়া : [একা, গুঙরে গুঙরে] আমরা কী করে বসেছি! ওগো, ওকে ডেকে নিয়ে এস, ফিরিয়ে নিয়ে এস।
চুবু : (দ্রুতপদে প্রত্যাবর্তন) এখুনি আসছে ও আর-যা-সব-কী-সব। জাহান্নামে যাক ব্যাটা। আখ! তুমি ওর সঙ্গে নিজে কথা বল; আমার দ্বারা হবে না, পষ্ট বলে দিলুম।
নাতালিয়া : (গুঙরে গুঙরে] ওকে ডেকে নিয়ে এস!
চুবু : [চিৎকার করে] ও আসছে, আসছে, তোমায় বলছি তো। হে ভগবান, আইবুড়ো মেয়ের বাপ হওয়া কী গব্বযন্তনা! আমি আমার গলায় দা বসাব। হ্যাঁ, আলবৎ। আমি আমার গলাটা কেটে ফেলব। আমরা লোকটাকে গালাগাল দিয়েছি, অপমান করেছি, লাথি মেরে বাড়ি থেকে খেদিয়ে দিয়েছি– আর এসবের মূলে তুমি– তুমিই করেছ এসব।
নাতালিয়া : না, তুমি।
চুবু : ও! এখন সব দোষ আমার! আর কী শুনতে হবে তার পর? [চুবুকফের প্রস্থান
[লমফের প্রবেশ]
লমফ : [অবসন্না] আমার বুক ভীষণ ধড়ফড় করছে… আমার পা অবশ হয়ে গিয়েছে… বাঁ পাশটায় অসহ্য যন্ত্রণা…
নাতালিয়া : আমাদের মাফ করুন, ইভান ভাসিলিয়েভিচ, আমরা ঝোঁকের মাথায়,.. আমার এখন মনে পড়ছে, ভলোভি মাঠ সত্যিই আপনার।
লমফ : আমার বুকটায় যেন হাতুড়ি পিটোচ্ছে.. মাঠটা আমার… আমার দুটো চোখ করকর করছে…
নাতালিয়া : হ্যাঁ, মাঠটা আপনার, আপনারই… বসুন (উভয়েরই উপবেশন] আমাদেরই ভুল হয়েছিল।
লমফ : আমার কাছে এটা ন্যায়-অন্যায়ের কথা… জমিটার আমি কোনও মূল্য দিইনে, কিন্তু ন্যায়ের মূল্য আমি দিই…
নাতালিয়া : সত্যিই তো ন্যায়-অন্যায় বোধের কথা… ওসব বাদ দিন… অন্য কথা পাড়ুন।
লমফ : বিশেষত আমার কাছে যখন প্রমাণ রয়েছে। আমার পিসিমার ঠাকুরমা আপনার বাবার ঠাকুরদার চাষাদের…।
নাতালিয়া : হয়েছে, হয়েছে, ওসব কথা তো হয়ে গিয়েছে… (স্বগত) কী করে আরম্ভ করব, বুঝতে পারছিনে… লেমফকে) আপনি কি শিগগিরই শিকারে বেরুচ্ছেন?
লমফ : ভাবছি, নবান্নের পরই বন-মোরগ শিকারে বেরুব… মনে পড়ল; আপনি কি শুনেছেন, আমার কী মন্দ কপাল…আমার ট্রাইয়ার বেচারি– আপনি তো ওকে চেনেন– ওর পা খোঁড়া হয়ে গিয়েছে।
নাতালিয়া : আহা বেচারা! কী করে হল?
লমফ : আমি ঠিক জানিনে… বোধহয় পায়ের থাবা মচকে গিয়েছে, কিংবা হয়তো অন্য কুকুর তাকে কামড়ে দিয়েছে… দীর্ঘনিশ্বাস] আমার সবচেয়ে ভালো কুকুর, টাকার কথা না হয় বাদই দিলুম। জানেন, মিরনফকে একশো পঁচিশ রুবল দিয়ে ওকে কিনি।
নাতালিয়া : বড্ড বেশি দিয়েছিলেন, ইভান ভাসিলিয়েভিচ।
লমফ : আমার তো মনে হয়, সস্তাতেই পেয়েছি। ওর মতো কুকুর হয় না।
নাতালিয়া : বাবা তার ফ্লাইয়ারের জন্য পঁচাশি রুবল দিয়েছিলেন। আর ফ্লাইয়ার আপনার ট্রাইয়ারের চেয়ে ঢের ঢের ভালো।
লমফ : ফ্লাইয়ার ট্রাইয়ারের চেয়ে ভালো? কী যে বলছেন! (হাস্য] ফ্লাইয়ার ট্রাইয়ারের চেয়ে ভালো! নাতালিয়া : নিশ্চয়ই ভালো। অবশ্য স্বীকার করছি, ফ্লাইয়ার বাচ্চা এখনও পুরো বয়েস হয়নি কিন্তু যেমন বুদ্ধি তেমনি আর সবদিক দিয়ে। ভলচানিয়েৎস্কিরও এমন একটা কুকুর নেই।
লমফ : মাফ করতে হল, নাতালিয়া স্তেপানভুনা, কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন, ও থ্যাবড়া-মুখো, আর থ্যাবড়া-মুখো কুকুর কখনও ভালো করে কামড়ে ধরতে পারে না।
নাতালিয়া : থ্যাবড়া-মুখো? এই প্রথম শুনলুম।
লমফ : আপনাকে পাকা কথা বলছি, ওর নিচের চোয়াল উপরের চোয়ালের চেয়ে ছোট।
নাতালিয়া : বটে? আপনি মেপে দেখেছেন নাকি?
লমফ : হ্যাঁ। শিকার তাড়া করতে অবশ্য সে ভালো, কিন্তু কামড়ে ধরার বেলা ওটাকে দিয়ে বিশেষ কিছু হবে না।
নাতালিয়া : প্রথমত, আমাদের ফ্লাইয়ার খানদানি কুকুর। হার্নেস আর চিজল ওর বাপ-মা। আর আপনার ট্রাইয়ারের গায়ে এমনই পাঁচ-মেশালি রঙ যে বলাই যায় না, ওটা কোন জাতের কুকুর। বিশ্রী চেহারা, বুড়ো-হাবড়া হয়ে গিয়েছে…।
লমফ : ও বুড়ো হয়েছে বটে, কিন্তু ওর বদলে আমি আপনাদের পাঁচটা ফ্লাইয়ারও নেব না… স্বপ্নেও না। ট্রাইয়ার যাকে বলে সত্যিকার কুকুর, আর ফ্লাইয়ার… কিন্তু এ নিয়ে তর্ক করাটাই বেকুবি… আপনাদের ফ্লাইয়ারের মতো কুকুর প্রত্যেক শিকারিরই গণ্ডায় গণ্ডায় আছে। ওর জন্য পঁচিশ রুবল দিলেও বড্ড বেশি দেওয়া হয়।
নাতালিয়া : সব কথার প্রতিবাদ করার শয়তান আজ আপনার ঘাড়ে চেপেছে, ইভান ভাসিলিয়েভিচ। প্রথম আরম্ভ করলেন ভলোভি মাঠের ওপর খামকা হক বসিয়ে, আর এখন বলছেন, ট্রাইয়ার ফ্লাইয়ারের চেয়ে সরেস। কেউ কিছু বিশ্বাস করে না বললে আমার ভারি বিরক্তি বোধ হয়। যা বলেন, যা কন, আপনি খুব ভালো করেই জানেন, ফ্লাইয়ার আপনার কী যে ওর নাম ওই বোকা ট্রাইয়ারের চেয়ে শতগুণে ভালো। তা হলে খামকা উল্টোটা বলছেন কেন?
লমফ : আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, নাতালিয়া স্তেপানা, আপনি ভাবছেন আমি কানা কিংবা আহাম্মুখ। আপনি কি কিছুতেই বুঝবেন না যে আপনাদের ফ্লাইয়ার থ্যাবড়া-মুখো?
নাতালিয়া : মিথ্যে কথা।
লমফ : ওটা থ্যাবড়া-মুখো।
নাতালিয়া : [চিৎকার করে] মিথ্যে কথা!…
লমফ : আপনি চ্যাঁচাচ্ছেন কেন, ম্যাডাম?
নাতালিয়া : আপনি আবোল-তাবোল বকছেন কেন? পিত্তি একেবারে চটে যায়। ট্রাইয়ারকে গুলি করে মারার সময় হয়ে গিয়েছে আর আপনি ওটাকে ফ্লাইয়ারের সঙ্গে তুলনা করছেন!
লমফ : মাফ করবেন, আমি আর এ আলোচনা করতে পারব না। আমার বুক ধড়ফড় করছে।
নাতালিয়া : আমি লক্ষ করেছি, যে শিকার সম্বন্ধে যত কম বোঝে সে-ই শিকার নিয়ে তর্কাতর্কি করে বেশি।
লমফ : মাদাম, দয়া করে চুপ করুন… আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।… [চিৎকার করে) চুপ করুন।
নাতালিয়া : আমি চুপ করব না, যতক্ষণ না আপনি স্বীকার করছেন, ফ্লাইয়ার ট্রাইয়ারের চেয়ে শতগুণে সরেস।
লমফ : শতগুণে নিরেস। ওর এতদিনে মরে যাওয়া উচিত ছিল– ওই আপনাদের ফ্লাইয়ারের কথা বলছি। ওহ, আমার মাথাটা… আমার চোখ দুটো… আমার কাঁধটা…
নাতালিয়া : আর আপনাদের ওই হাবা ট্রাইয়ারটা আমাকে তার মৃত্যু-কামনা করতে হবে না; ওটা তো আধমরা হয়েই আছে।
লমফ : (কেঁদে কেঁদে] চুপ করুন। আমার বুকটা যে ফেটে যাচ্ছে। নাতালিয়া; আমি চুপ করব না।
[ চুবুকফের প্রবেশ]
চুবু : এখন আবার কী?
নাতালিয়া : আচ্ছা বাবা, তুমি খোলাখুলি বল তো, ধর্ম সাক্ষী করে বল তো কোনটা সরেস আমাদের ফ্লাইয়ার, না ওঁর ট্রাইয়ার?
লমফ : স্তেপান স্তেপানভি, স্যার, আপনার পায়ে পড়ছি, মাত্র একটি কথা আমাদের বলুন, ফ্লাইয়ার থ্যাবড়া-মুখো, কিংবা থ্যাবড়া-মুখো নয়? হ্যাঁ কি না?
চুবু : হলেই-বা? যেন তাতে কিছু এসে-যায়! যাই বল, যাই কও, ওর মতো কুকুর তামাম জেলাতেও একটা নেই, আর-যা-সব-কী-সব।
লমফ : কিন্তু আমার ট্রাইয়ার ওর চেয়ে সরেস। নয় কি? ধর্ম সাক্ষী করে বলুন।
চুবু : ওরকম মাথা গরম করো না, বাছা আমার… বুঝিয়ে বলছি আমি… তোমার ট্রাইয়ারের বিস্তর সদগুণ আছে, কেউ অস্বীকার করবে না– জাতে ভালো, পাগুলো জোরদার, গড়ন চমৎকার আর-যা-সব-কী-সব। কিন্তু হক্ কথা যদি শুনতে চাও, বাছা, তবে বলি ওর দুটো মারাত্মক খুঁত আছে– সে বুড়ো হয়ে গিয়েছে আর তার প্যাঁচা-নাক।
লমফ : মাফ করবেন, আমার বুক ধড়ফড় করছে … কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কী সেইটে দেখা যাক… আপনার হয়তো স্মরণ থাকতে পারে, আমরা যখন মারুসৃকিনের মাঠে শিকার করতে গিয়েছিলুম, আমার ট্রাইয়ার কাউন্টের স্পটারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানে সমানে ছুটেছিল, আর আপনাদের ফ্লাইয়ার নিদেনপক্ষে পাকি আধটি মাইল পিছনে পড়ে ছিল।
চুবু : কাউন্টের শিকারি তাকে চাবুক মেরেছিল বলে সে পিছিয়ে পড়ে।
লমফ : সেইটেই তার প্রাপ্য। আর সবকটা কুকুর খেঁকশিয়ালকে তাড়া লাগাচ্ছিল আর ট্রাইয়ার জ্বালাতন করতে লাগল ভেড়াগুলোকে।
চুবু : বাজে কথা। শোনো বাছা, আমি বড় সহজে চটে যাই, তাই তোমায় অনুরোধ করছি, এ আলোচনাটা থাক। লোকটা ফ্লাইয়ারকে চাবুক মেরেছিল, কারণ মানুষের স্বভাব অন্যের কুকুরের প্রতি হিংসুটে হওয়া… হ্যাঁ, পরের কুকুরকে কেউ দু চক্ষে দেখতে পারে না। আর আপনিও, স্যার, ওর ব্যত্যয় নন। হ্যাঁ, যেই দেখলে আর কারও কুকুর তোমার ট্রাইয়ারের চেয়ে সরেস, ব্যস, অমনি জুড়ে দিলে কিছু একটা… আর-যা-সব-কী-সব… দেখলে, আমার সব মনে থাকে।
লমফ : আমারও।
চুবু : [ভেংচিয়ে] আমারও!
লমফ : বুক ধড়ফড় করছে… আমার পা অবশ হয়ে গিয়েছে… আমি কিছুই…
নাতালিয়া : [ভেংচিয়ে বুক ধড়ফড় করছে! কী রকম শিকারি মশাই, আপনি? আপনার উচিত শিকারে না গিয়ে আগুনের পাশে শুয়ে শুয়ে আরশুলা মারা। বুক ধড়ফড় করছে, হুঁঃ।
চুবু : হ্যাঁ, হক কথা বলতে কী, শিকার-টিকারে বেরোনো আসলেই তোমার কম নয়। বুকের ধড়ফড়ানি আর-যা-সব-কী-সব দিয়ে ঘোড়ার পিঠে ঝাঁকুনি খাওয়ার চেয়ে তোমার পক্ষে বাড়িতে বসে থাকাই ভালো। অবশ্য তুমি যদি সত্যিই শিকার করতে যেতে তা হলে কোনও কথা ছিল না, কিন্তু তুমি তো যাও নিছক তর্কাতর্কি করার জন্য, আর অন্য পাঁচজনের কুকুরগুলোর সামনে পড়ে তাদের বাধা দেবার জন্য আর-যা-সব-কী-সব… আমি বড্ড সহজেই চটে যাই, কাজেই এ আলোচনা বন্ধ করাই ভালো। তুমি আদপেই শিকারি নও, ব্যস।
লমফ : আর আপনি আপনি বুঝি শিকারি? আপনি তো যান কাউন্টকে নিছক তেল মালিশ করার জন্য, আর পাঁচজনের বিরুদ্ধে ঘোটালা পাকাবার জন্য… ওহ! আমার বুকের ব্যথাটা! আসলে আপনি কুচুটে।
চুবু : কী? আমি–কুচুটে? [চিৎকার করে চুপ করো।
লমফ : কুচুটে।
চুবু : ভেড়ে, বখা ছোকরা!
লমফ : বুড়ো-হাবড়া! ভণ্ড!
চুবু : চুপ করো, না হলে আমি একটা নোংরা বন্দুক দিয়ে তোমাকে তিতির মারার মতো গুলি করে মারব। ফকিকার কোথাকার!
লমফ : দুনিয়াসুদ্ধ জানে– ওহ, ফের আমার হার্টটা! আপনাকে আপনার স্ত্রী ঠ্যাঙাতো! … আমার পা-টা… আমার মাথাটা!…চোখের সামনে বিদ্যুৎ খেলছে… আমি পড়ে যাব… আমি পড়ে যাচ্ছি ..
চুবু : আর যে মাগী তোমার বাড়ি চালায় সে তোমাকে চেপে রেখেছে বুড়ো আঙুলের তলায়।
লমফ। : ও, ও, ও! আমার হার্টটা ফেটে গিয়েছে। আমার কাঁধটা যে আর নেই… আমার কাঁধটা কোথায়?… আমি মরলুম। আিরাম-চেয়ারে পতন) ডাক্তার! (মূৰ্ছা।)
চুবু : ভেড়ে! বকা! ফক্কিকার! আমি জোর পাচ্ছিনে। (জলপান) ভিরমি যাচ্ছি নাকি।
নাতালিয়া : শিকারি, হুঁ! ঘোড়ার উপর কী রকম বসতে হয়, তাই জানেন না আপনি! [পিতাকে] বাবা, কী হল ওর? বাবা! দেখ বাবা, (চিৎকার করে) ইভান ভাসিলিয়েভি! ইনি মরে গেছেন।
চুবু : আমি মূৰ্ছা যাচ্ছি … আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে! বাতাস, আমাকে বাতাস দাও!
নাতালিয়া : ইনি মারা গেছেন। লিমফের আস্তিন ধরে টানাটানি] ইভান ভাসিলিয়েভিচ! ইভান ভাসিলিয়েভিচ! আমরা কী করে বসলুম! ইনি মারা গেছেন। (আর্ম চেয়ারে পতন ডাক্তার! ডাক্তার! [ছন্নের মতো কখনও ফোঁপানো, কখনও হাসি]
চুবু : ব্যাপার কী? কী হয়েছে? তুমি কী চাও?
নাতালিয়া : [গোঙরাতে গোঙরাতে মারা গেছেন… উনি মারা গেছেন।
চুবু : কে মারা গেছে? লিমফের দিকে তাকিয়ে সত্যি ও মারা গেছে। হে ভগবান, জল, জল! ডাক্তার! লিমফের ঠোঁটের কাছে একগ্লাস জল ধরে] জল খাও! না, ও জল খাচ্ছে না… তা হলে মারাই গেছে, আর-যা-সব-কী-সব… হায়, হায়, আমার কী পোড়া কপাল! আমি আমার মগজের ভিতর দিয়ে গুলি চালিয়ে দিলুম না কেন? এর অনেক আগেই আমার গলাটা কেটে ফেললুম না কেন? আমি কিসের জন্য অপেক্ষা করছি। আমাকে একখানা ছোরা দাও। বন্দুক দাও। (লমফ একটু নড়ল মনে হচ্ছে, সেরে উঠছে… একটু জল খাও তো, বাছা! হ্যাঁ, ঠিক…।
লমফ : আমার চোখের সামনে বিদ্যুৎ খেলছে… কুয়াশা না কি… আমি কোথায়!
চুবু : তুমি যত শিগগির পার বিয়ে করে ফেল আর জাহান্নামে যাও… ও রাজি আছে দু জনের হাত মিলিয়ে দিয়ে] ও রাজি আছে, আর-যা-সব-কী-সব, আমি তোমাদের আশীর্বাদ– আর-যা-সব– করছি। শুধু আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও।
লমফ : এ্যা? কী? [দাঁড়িয়ে উঠে] কে?
চুবু : ও রাজি আছে। আবার কী হল? চুমো খাও… আর জাহান্নামে যাও।
নাতালিয়া : [গোঙরাতে গোঙরাতে] উনি বেঁচে আছেন… হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি রাজি…
চুবু : এসো, চুমো খাও, একজন আরেকজনকে। লমফ : এ্যা, কাকে? নাতালিয়াকে চুম্বন] আমার কী আনন্দ! মাফ করবেন, ব্যাপারটা কী? ওহ্! হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি… আমার হার্ট… বিদ্যুৎ.. আমি কী সুখী, নাতালিয়া স্তেপানভনা… নাতালিয়ার হস্তচুম্বন আমার পা-টা যে অবশ হয়ে গেল…।
নাতালিয়া : আমি… আমিও বড় সুখী…।
চুবু : ওহ! পিঠের থেকে কী বোঝাটাই না নামল! আহ!
নাতালিয়া : কিন্তু… যাই বল, তোমাকে এখন স্বীকার করতেই হবে, ট্রাইয়ার ফ্লাইয়ারের মতো অত ভালো না।
লমফ : সে ভালো।
নাতালিয়া : সে খারাপ।
চুবু : এই লাও! পারিবারিক সুখ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। শ্যাম্পেন নিয়ে আয়।
লমফ : সে সরেস! নাতালিয়া : ওটা নিরেস, নিরেস, নিরেস!
চুবু : [চিৎকার করে দু জনার গলা চাপবার চেষ্টাতে) শ্যাম্পেন! শ্যাম্পেন। নিয়ে আয়!
যবনিকা