সুখী হবার পন্থা
সুখী হবার পন্থা? সর্বনাশ! সে পন্থাটা এ অধমের যদি জানাই থাকত তবে– যাকগে। ইতোমধ্যে একটা গল্প মনে পড়ল। এক ছোকরার বিয়ে করার বড় শখ। কিন্তু কিছুতেই হয়ে উঠছে না। ওদের পরিবারে একমাত্র শ্রীহনুমানের পুজো হয় অন্য কোনও দেবতা সেখানে কল্কে পান না– তাই ত্রিসন্ধ্যা তাঁরই পুজো করে আর কাকুতি-মিনতি করে, হে ঠাকুর, আমার একটা বউ জুটিয়ে দাও। ওদিকে এরকম ঘ্যানর ঘ্যানর শুনে হনুমানের পিত্তি চটে গিয়েছে। শেষটায় একদিন স্বপ্নে দর্শন দিয়ে হুঙ্কার দিলেন, ওরে বুদ্বু, বউ যদি জোটাতে পারতুম, তবে আমি নিজে বিয়ে না করে confirmed bachelor হয়ে রইলুম কেন?
তাই বলছিলুম, সুখী হবার পন্থাটা যদি আমার জানাই থাকত তবে আমি এই টক্ দিতে যাব কেন? স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে আমি যে ট দিচ্ছি সেটা হয় আপনাদের আনন্দ দেবার জন্য, নয় অর্থাগমের জন্য, কিংবা উভয়ত। আপনাদের আনন্দ দেবার ইচ্ছাটা তৃষ্ণাবিশেষ এবং বুদ্ধদেব সেটাকে তনহা অর্থাৎ তৃষ্ণা বলেছেন, এবং এই তন্হা থেকেই সর্ব দুঃখের উৎপত্তি। এই তন্হাজনিত দুঃখ নিবারণই সুখ। আমাদের শাস্ত্রেও আছে, ভারাদ্যপগমে সুখীসংবৃতোহহমিতিবৎ, দুঃখভাবনে সুখিতৃপ্রত্যয়াৎ। বাংলা কথায়, আমার ঘাড়ে বোঝা ছিল, সেটা নেবে যেতেই বললুম, আহা কী আরাম, এসো ক্ষুদিরাম : আহা কী সুখ, ঘুচে গেছে দুখ। অর্থাৎ দুঃখের অভাবই সুখ বলে প্রতীয়মান হয়। তাই পরদুঃখকাতর ফরাসি গুণী ভলতের এক অন্ধ মহিলাকে সান্ত্বনা দিয়ে চিঠি লেখেন, Nous avons un grand sujet a traitor : it sagit de bonheur on du monis detre le moins malheureux quon peut dans ce monde.
আমাদের আলোচনার বস্তু বিপুলাকার এবং মহত্ত্বপূর্ণ : প্রশ্ন এই, সুখী হওয়া যায় কিসে, অন্ততপক্ষে এ সংসারে অল্পতর দুঃখী হওয়া যায় কী প্রকারে?
এটাকে আরও সোজা করে বলি। এক ক্ষ্যাপা ক্রমাগত মাথায় হাতুড়ি ঠুকছে। আমি শুধালুম, ওরে পাগল, মাথায় হাতুড়ি ঠুকছিস কেন? একগাল হেসে বলল, যখন টুকি না, তখন কী আরাম! সেই সংস্কৃত প্রবচনেই ফিরে এলুম, ঘাড়ের বোঝা নেবে যাওয়াতে কী আরাম! মহাকবি হাইনেকে আমি বড্ডই শ্রদ্ধা করি, কিন্তু এস্থলে তিনি যেটা বলেছেন, সেটা আমাদের পাগলের হাতুড়ি পেটার চেয়ে অনেক ফিকে। তিনি বলেছেন, কড়া ঠাণ্ডার রাতদুপুরে লেপের তলা থেকে পা বের করতে বেজায় শীত লাগল। ফের পা দুখানা ভিতরে টেনে নিয়ে বললুম, আহ্ কী সুখ!
কিন্তু এরকম নেতিবাচক সুখ– অর্থাৎ দুঃখের অভাবে সুখ– এটাতে সবাই সন্তুষ্ট নন্। তাই অনেকেই সুখ বলতে কী বোঝেন সেটা স্পষ্ট ভাষায় বলে গেছেন। সর্বপ্রথমই অবশ্য মনে পড়ে ওমর খৈয়াম। কান্তি ঘোষ অনুবাদ করেছেন
সেই নিরালা পাতায় ঘেরা
বনের ধারে শীতল ছায়া
খাদ্য কিছু পেয়ালা হাতে
ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়।
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে
গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর।
সেই তো সখী স্বর্গ আমার
সেই বনানী স্বর্গপুর।
শুনতে বেশ লাগে, কিন্তু অনুবাদটা আক্ষরিক নয়। বরঞ্চ সত্যেন দত্তের–
সে বিজনে মোর পার্শ্বে বসিয়া
গাহো গো মধুর গান
বিজন হইবে স্বর্গ, আমার
তৃপ্তি লভিবে প্রাণ।
ফিটজিরান্ডেও তাই আছে।
Beside me singing in the wilderness
And wilderness is paradise enow!
কান্তিবাবুর বিজন ছায়া নয়, উল্টো বলা হয়েছে, মরুপ্রান্তরেও তুমি, সখী, যদি থাকো তবে সেই স্বর্গ।
এইবারে মূল ফারসিটা শুনুন :
গর দ দহদ খগজ-ই গন্দুমে নানি
ওয়াজ ময় দোমনিজ গোসফন্দি রানি–
ওয়া আনাগেহ ম ওয়া তো নিশতে দর ওয়ারানি
এ্যায়শি বুঁদ আন না হদ্দ-ই-হর সুলতানি—
ফার্সি ফিরিস্তিতে খৈয়াম চেয়েছেন, ভালো গমের উত্তম রুটি; দুই মণ মদ ধরে এরকম একটি পাত্রভরা মদ্য– হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন, ফার্সিতেই আছে দো মণী এবং যে ফিটজিরাল্ড নিতান্ত গদ্যময় ভেবে অনুবাদ করেননি–আছে একখানা আস্ত দুম্বার ঠ্যাং। এবং সর্বশেষে বলেছেন, তখন যা সুখ, সেটা কদাচ কখনও কোনও সুলতানের ভাগ্যে জোটে কি না সন্দেহ।
এগুলো আমাদের জানা নয়। কারণ আমাদেরই মহর্ষি চার্বাক সুখী হওয়ার নির্ঘণ্ট আরও। সস্তায় সেরেছেন, তিনি বলেছেন,
যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ
ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ!
অর্থাৎ ঋণ করেও ঘি খাও। ফেরত তো দিতে হবে না, কারণ এ দেহ ভস্মীভূত হবে, পুনর্জন্ম তাই হতে পারে না, পুনরাগমনং কুতঃ? এখানে কিন্তু খৈয়ামের সঙ্গে তাঁর তফাৎ। খৈয়াম বার বার বলেছেন, পরের মনে কষ্ট দিয়ে সুখী হওয়া যায় না।
কিন্তু চিন্তাশীল ব্যক্তিই বলবেন–যদিও আমি আদপেই চিন্তাশীল নই এবং আমি খৈয়ামের ফিরিস্তিতেই সুখী–কিন্তু চিন্তাশীল ব্যক্তিই বলবেন, এ আবার কী সুখ? লোকব্যবহারেও দেখা যায়, আমি যে-সে সুখ চাইনে।
সামান্য একটি মেয়েছেলে। বহু যুগ পূর্বে তার স্বামী যখন তাঁকে বিস্তর ধন-দৌলত দিয়ে বনে যেতে চাইলেন তখন তিনি তাচ্ছিল্য করে বলেছেন, যেনা হং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম্! যা দিয়ে আমি অমৃত হব না, পাব না, সে দিয়ে আমার কী হবে?
দেখুন দিকি, মেয়েছেলের কী বায়নাক্কা! সুখ পেয়েও সুখী হতে চায় না অথচ দেখুন। চীনেরা কী সুবুদ্ধিমান। লিং যুটাঙ বলেছেন, রাত্রের অন্ধকারে ঘরের ভিতর ঘুমিয়ে আছি। চতুর্দিকে আমার মহামূল্যবান প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। হঠাৎ শুনি একটা ইঁদুর কুটকুট করে সেগুলো কাটছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন সময় শুনি, আমার বেড়ালটা হুঙ্কার দিয়ে ম্যাও করে উঠেছে– আহ কী সুখ।
কিন্তু না, ভারতবর্ষ অমৃত চেয়েছে। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, সুখের খেলায় বেলা গেছে, পাইনি তো আনন্দ! আনন্দটা তবে কী? অমৃত। চণ্ডীদাসও বলেছেন, সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল। এবং সুখের পরও শ্রীরাধা চেয়েছিলেন অমৃত, অমিয়া, তাই অমিয়া সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।
অমৃতের অত্যুত্তম বর্ণনা পেয়েছি আমি একটি শ্লোকে।
কেচিদ বদন্তি অমৃতোস্তি সুরালয়েষু,
কেচিদ বদন্তি বনিতাধরপল্লবেষু,
ব্রুমো বয়ং সকল শাস্ত্র বিচারদক্ষা,
জষীরনীরপূরিত মৎস্যখণ্ডে –
আহা-হা! কেউ কেউ বলেন অমৃত আছে সুরালয়ে মদের দোকানে। কেউ কেউ বলেন, না, অমৃত বনিতার অধর-পল্লবে। আর আমরা আসলে আমি এখানে সম্মানার্থে বহুবচন আমরা, কারণ আমি সকল শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি– সকল শাস্ত্র বিচারদক্ষা আমরা বলি জম্বীরনীর পূরিত– অর্থাৎ নেবু, জষীর, জামীর– সিলেটিতে– নেবু– নেবুর রসে পূরিত– ভর্তি– মৎস্যখণ্ডে! সোজা বাংলায় মাছের উপর কষে ঠেসে নেবুর রস– সেই অমৃত।
এ কবি শুধু কবি নন– মহর্ষি, দিব্যদ্রষ্টা– কী করে সেই যুগেই জানলেন, বাঙলা দেশে এমন দিন আসবে যেদিন শুধু লক্ষপতিরাই শ্বশুরবাড়ি এলে মাছ কিনবেন। আর ইতরজনা– আমরা মাছের কাঁটাটি পর্যন্ত পাব না, সব্বর একাদশী ভাঙবার জন্যে!
আরেকটি কথা। কালিদাস ভবভূতি পড়ে আমেজ করতে পারিনে, এঁরা কোন প্রদেশের লোক। কিন্তু যে গুণী অষীরনীরপূরিত মৎস্যখণ্ডকে অমৃত বলে সে নিশ্চয়ই বাঙালি। মাছের তত্ত্ব কি বিহারি, মারওয়াড়ি, গুজরাতি ব্রাদাররা জানেন?
সুখ বলুন, আনন্দ বলুন, অমৃত বলুন, সেটা পাব কোথায়? একটিমাত্র পথ নির্দেশ করি। মহাকবি গ্যেটে বলেছেন,
দূরে দূরে তুমি কেন খুঁজে মরো?
সুখ তো আছে হাতের কাছে,
শিখে নাও শুধু তারে ধরিবারে,
সুখ সে তো রয় সদা কাছে কাছে।
Willst du immer weiter schweifen
Sieh, das Gute lieght so nah,
Lerne nur das Gluck ergreifen,
Denn das Gluck ist immer da!
আর আমাদের প্রতিবেশী বাঙালি লালন ফকির বলেছেন হাতের কাছে পাইনে খবর
খুঁজতে গেলাম দিল্লি শহর!