প্রিন্স গ্রাবিয়েলে দা’ন্নুনদজিয়ো
গ্রিকের উত্তরাধিকারী লাতিন। লাতিন তার অনুপ্রেরণা, প্রাণরস, কলাসৃষ্টির আদর্শ ও তাকে মৃন্ময় করার পদ্ধতি সবকিছুই নিয়েছে গ্রিক থেকে। বাঙলা ভাষা এবং সাহিত্যও সংস্কৃতের এতখানি পদাঙ্ক অনুগমন করেনি। বরঞ্চ বলব উর্দুর সঙ্গে ফারসির যে সম্পর্ক, লাতিনের সঙ্গে গ্রিকের তাই। অহমিয়ারা যদি রাগ না করেন তবে বলব, বাঙলা ও অহমিয়ার মধ্যে ওই সম্পর্কই বিদ্যমান, যদিও বাঙলার মৃত্যু হওয়ার পর অহমিয়া তার উত্তরাধিকারী হয়নি বাঙলা তার উৎকর্ষের এক বিশেষ চরম স্তরে পৌঁছনোর পর অহমিয়া তার রস-সৃষ্টিতে বাঙলা সাহিত্যকে তার আদর্শরূপে ধরে নেয় (এখানে বুরুঞ্জী বা দলিলদস্তাবেজের গদ্যের কথা হচ্ছে না)।
বহুশত বছর ধরে লাতিন পাশ্চাত্যভূমির সর্ব চিন্তা সর্ব অনুভূতির মাধ্যম ছিল। এমনকি লাতিনের উত্তরাধিকারী ইতালীয়, ফরাসি, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষা পূর্ণ সমৃদ্ধি পাওয়ার পরও এমনকি এত শতাব্দীতেও, ইয়োরোপীয় পণ্ডিতেরা, যখনই চেয়েছেন যে তাবৎ ইয়োরোপ তাঁদের রচনার ফললাভ করুক তখনই তারা আপন আপন মাতৃভাষা– জর্মন, ফরাসি ইত্যাদি না লিখে লিখেছেন লাতিনে। ইবন খলদুনের (ইনি মার্কসের বহু পূর্বে ইতিহাসের অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধান করেছিলেন) আরবি পুস্তকের অনুবাদক মাতৃভাষা ব্যবহার না করে খলদুনের মোকদ্দমা– প্রলেগমেনন অনুবাদ করেছেন লাতিনে। এ শতাব্দীতেও জলালউদ্দীন রুমির ফারসি থেকে ইংরেজিতে তর্জমা করার সময় ইংরেজ তথাকথিত অশ্লীল অংশগুলো অনুবাদ করেছেন লাতিনে উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল অপ্রাপ্তবয়স্কের হাতে এ বই পড়লে তারা যেন বুঝতে না পারে।
খাস লাতিনের জন্মভূমি ও লীলাস্থল যদিও ইতালিতে এবং ইতালীয় সাহিত্যের অতি শৈশবাবস্থায়ই দান্তের মতো অতুলনীয় মহাকবির আবির্ভাব, তবু কার্যত দেখা গেল লাতিনের অন্য উত্তরাধিকারী ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য যেন তাকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। তার অন্যতম কারণ অবশ্য এই হতে পারে যে, ইতালীয়রা তখন শুধু সাহিত্য নয়, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারুশিল্পেও আপন সৃজনীশক্তির বিকাশ করছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্যারিস ক্রমে ইয়োরোপের কলাকারদের মক্কা হয়ে দাঁড়ায়। ওই সময় রুশের তুর্গেনিয়েফ, জর্মনির হাইনে, পোল্যান্ডের সঁপা, এমনকি ইতালির রসসিনি– এঁরা সকলেই প্যারিসে বসবাস করতেন।
এর পরই ফরাসিতে যাকে বলা হয় ফাঁ দ্য সিয়েক শতাব্দীর সূর্যাস্ত।
দানুনদজিয়ো খ্যাতিলাভ করেন ওই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে–কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকাররূপে এবং কর্মযোগী–ফিউমের রাজারূপে তিনি খ্যাতির চূড়ান্তে ওঠেন ১৯১৯-এ, অর্থাৎ আমাদের শতাব্দীতে। আরবি ভাষায় এঁদের বলা হয় জু অল করনেন–দুই শতাব্দীর অধিপতি।
বহু রাগরঙ্গে রঞ্জিত বৈচিত্র্যপূর্ণ এর জীবন। স্কুলে থাকাকালীন তিনি তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করে রসিকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে রোমে এসে ছোটগল্প, উপন্যাস, নাট্য তিন ক্ষেত্রেই তিনি অতুলনীয় বলে স্বীকৃত হলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি পদাতিক, নৌবাহিনী ও বিমানবহরে সর্বত্রই সমান খ্যাতি অর্জন করেন। বিশেষ করে বিমান পরিচালনায়। আজ যেটাকে স্ট্যান্ট ফ্লাইং বলা হয়, তার প্রধান পথপ্রদর্শক দানুনদজিয়ো। অমর খ্যাতির জন্য তাঁর এমনই অদম্য প্রলোভন ছিল যে, তার জন্য তিনি সর্বদাই প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তার পর মিত্রশক্তি যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিউমে বন্দরকে ইতালি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলেন, তখন কবি দানুনদজিয়ো তার রুদ্রতম রূপ ধারণ করলেন। ফিউমে বন্দর দখল করে তিনি সেখানে এক রাজ্য স্থাপন করে নিজেকে অধিপতি রূপে ঘোষণা করলেন। কবি, সৈনিক, নেতা তিন রূপেই তিনি স্বপ্রকাশ হলেন। মাত্র ১৫ মাস তিনি সেখানে রাজত্ব করেছিলেন বটে, কিন্তু ইতালির লোক আজও তাকে ফিউমের বীর, জাতির গর্বরূপে স্বীকার করে।
প্রেমের জগতেও দানুনদজিয়ো অভূতপূর্ব কীর্তি রেখে গেছেন। লোকে বলে, তিনি নাকি একসঙ্গে পাঁচটি রমণীর সঙ্গে প্রেম করতে পারতেন। একসঙ্গে পাঁচসেট প্রেমপত্র লিখেছেন (কু-লোকে বলে, সেক্রেটারিকে ডিটেট করতেন এবং প্রত্যেক সেটই একেবারে অরিজিনল, অন্যান্য সেট থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস লে ভেজিনি দেল্লে রক্কে গিরিকুমারীত্রয়-এ। সেখানে উপন্যাসের নায়ক কিছুতেই মনস্থির করতে পারলেন না, তিন নায়িকা, আনাতোলিয়া, ভিয়েলান্তে, মাসসিমিল্লা, কাকে তিনি বরণ করবেন। এ উপন্যাসটি পড়ে আমার মনে হয়েছিল, তার পক্ষে একই সময়ে এই তিনজনকে তিন ধরনের প্রেমপত্র লেখা মোটেই অসম্ভব নয়। কারণ এই তিন বোনের চরিত্র তিনি এমনই অদ্ভুত কৃতিত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন, দৃঢ় রেখায় অঙ্কন করেছেন যে, প্রত্যেকটি চরিত্র আপন মহিমায় স্বপ্রকাশ। তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে তিন ধরনের প্রেমপত্র লেখা চারুশিল্পী দানুনদজিয়োর পক্ষে অসম্ভব তো নয়ই, খুবই সহজ বলতে হবে।
দানুনদজিয়ো চরিত্র বুঝতে ভারতবাসীর খুব অসুবিধা হয় না। কিছুদিন পূর্বেও আমরা পরাধীন ছিলুম। আমরা যদি হটেনটট বা বন্টুর মতো ঐতিহ্য-সভ্যতা-সংস্কৃতিহীন জাত হতুম, তা হলে আমাদের অপমানবোধের বেদনা এতখানি নির্মম হত না। ফ্যা দ্য সিয়েলে ইতালি স্বাধীন বটে, কিন্তু সে তখন তার গৌরবময় নেতার আসন ছেড়ে দিয়েছে ফ্রান্স, জর্মনি, ইংল্যান্ডকে। এমনকি যে অন্নবস্ত্র সমস্যা তাকে তখনও (এখনও) কাতর করে রেখেছে সেটাকে ঐতিহ্যহীন সুইটজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে ততদিনে সমাধান করে ফেলেছে। জাত্যাভিমানী স্পর্শকাতর ইতালীয় মাত্রই যখন দেখত প্রতি বছর হাজার হাজার ইংরেজ, ফরাসি, জর্মন তার প্রাচীন কীর্তিকলা দেখবার জন্য রোম নেপলস্ ভেনিস পরিক্রমা করে, গ্যেটে-বায়রন কেউই বাদ যান না(১) এবং সঙ্গে সঙ্গে দেখে ছিন্নবস্ত্র, নগ্নপদ আপন ইতালীয় ভ্রাতা, এদের কাছে ভিক্ষা চাইছে, তখন ঐতিহ্যচেতন ইতালিয়ার মরমে মরাটা কি হৃদয়ঙ্গম করাটা আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন? দানুনদজিয়ো তার দেশকে ভালোবাসতেন শুধু তার পূর্ব গৌরব, প্রাচীন ঐতিহ্যের জন্যই নয়, তার সদাজাগ্রত পঞ্চেন্দ্রিয় অহরহ তাকে সচেতন রাখত দেশের অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে। ভেনিস দেখে বহু দেশের বহু কবি আপন মাতৃভাষায় তার প্রশস্তি গেয়েছেন, কিন্তু দানুনদজিয়োর উপন্যাস ইল ফুয়োকো অগ্নিশিখা, ফ্লেম অব লাইফে– তাঁর যে বর্ণনা এবং দরদবোধের পরিচয় পাওয়া যায়, সে জিনিস ইতালীয় সাহিত্যে অতুলনীয় তো বটেই, অন্য সাহিত্যেও আছে কি না সন্দেহ অন্তত আমার চোখে পড়েনি।
ইয়োরোপে রেনেসাঁস যারা আনয়ন করেন, তাঁদের শেষ প্রতিভূ দানুদৃজিয়ো, মাঝখানে কত শত বছরের ব্যবধান, তবু তাঁর লেখা পড়ে মনে হয় এবং যারা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন তারা বলেছেন, তার কথাবার্তা শুনে মনে হত– তিনি কী স্বচ্ছন্দে রেনেসাস সৃষ্টিকর্তা অতিমানবদের মধ্যে বিচরণ করেছেন। ওদিকে তিনি নিজেও মনে করতেন যে, তিনি প্রাচীন গ্রিক ক্লাসিসের পরবর্তী পুরুষমাত্র। একটি ফোয়ারার বর্ণনা দিতে গিয়ে দানুদৃজিয়ো সে ফোয়ারার পাথরে খোদাই কতকগুলো লাতিন প্রবাদ তুলে দিয়েছেন। লাতিন অনেকখানি পড়া না থাকলে এরকম একটি অনবদ্য সঙ্কলন অসম্ভব।
কর ত্বরা, ওগো
তোল ফুলগুলো
ভরা মধু গন্ধে।
পলাতকা ঐ
মুহূর্তগুলির
পরা নীবিবন্ধে ॥
PRAECIPITATE MORAS,
VOLUCRES CINGATIS,
UT HOBAS NECTITE FORMOSAS, MOLLIA SEATA, ROSAS
Hasten, hasten! Weave garland of fair roses to girdle the passing hours.
সেই ফোয়ারার জল নিচের আধারে জমেছে; সে বলছে :–
জীবন সলিল
পান করিবে কি?
এ যে বড় মধুভরা–
আঁখিজলে করো
লবণসিক্ত
তবে হবে তৃষা-হরা ॥
FLETE HIC OPTANTES NIMIS ESS ACQUA DULCIS AMANTES SAL SUS, UT APTA VEHAM, TEMPERE HUMOR EAM.
Weep here, ye lovers who come to slake your thirst. Too sweet is the water. Season it with the salt of your tears.
গ্রিক এবং লাতিন থেকে তিনি নিয়েছিলেন তার ভাষার অলঙ্কার। আজ যদি বাংলাতে কেউ পদে পদে কালিদাস-শূদ্রকের মতো উপমা ব্যবহার করতে পারেন এবং সে তুলনাগুলো হয় এ যুগের বাতাবরণেই– কারণ দানুদৃজিয়ো ক্লাসিসে নিমজ্জিত থাকা সত্ত্বেও নিশ্বাস নিতেন বর্তমান যুগের আবহাওয়া থেকে তা হলে তার সঙ্গে দানুনদজিয়োর তুলনা করা যাবে। এ যুগের লেখকদের মধ্যে প্রধানত নিৎশে, শোপেনহাওয়ার, দস্তেয়ফস্কি এবং সুরকারদের মধ্যে ভাগনার তার ওপর কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
তাই একদিক দিয়ে দেখতে গেলে অতিমানব, সুপারম্যান বা ঝুবারমেনশের যে ধারণা ফিষটে দিয়ে আরম্ভ হয় এবং কার্লাইল, মাজিনি হয়ে নিৎশেতে পৌঁছয়– যার সাহায্যকারী ছিলেন ট্রাইশকে, কিপলিং, হাউস্টন, চেম্বারলেন এবং বেৰ্গসো– দানুনদজিয়ো এদেরই একজন। এরা সকলেই যে সুপারম্যান চেয়েছেন তা নয়। কেউ কেউ চেয়েছেন সুপাররেস শ্রেষ্ঠ জাতি, যেমন হিটলার চেয়েছিলেন হেরেন-ফলক প্রভুর জাত– কেউ কেউ চেয়েছেন সুপারস্টেট।
রাসল বলেন, তবু ফিষটে, কার্লাইল, মাদৃজিনিতে মুখের মিষ্টি কথায় কিছুটা নীতির দোহাই আছে, কিন্তু নিৎশেতে এসে তা-ও নেই।(২) সেখানে উলঙ্গ রুদ্ররূপে সুপারম্যানের আপন শক্তিসঞ্চয়ই সর্বপ্রধান কর্তব্য, স্বধর্ম। হিটলারের গ্যাস চেম্বার তারই এক কদম পরে।
আমার মনে হয়, দানুনদজিয়ো এসব কউরের সমধর্মী নন। তাঁর ভিতরকার আর্টিস্টই বোধহয় তাঁকে সে বর্বরতা, নৃশংসতা থেকে বাঁচিয়েছে। পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে যে রসিক প্রতি মুহূর্তে পঞ্চভূতকে নিঃশেষে শোষণ করেছে, যার রচনার প্রতিটি ছত্রে প্রতিটি শব্দে রূপরসগন্ধস্পর্শ ধ্বনির সমাবেশ, তুলনাব্যঞ্জনা মধুরতম সামঞ্জস্য যার অব্ৰণ-নিটোল সুডৌল নির্মাণপদ্ধতিতে সে সৃষ্টিকর্তাকে কোনও বিশেষ পর্যায়ে ফেলা যায় না।
দানুনদজিয়োর সৃষ্টিতে আমি যদি কোনও ক্রটি লক্ষ করে থাকি তবে সেটা মাধুর্যের অতিরিক্ততায় কাদম্বরীতে যেরকম।(৩)
————
১. এবং এ যুগে–
ইটালিয়া
কহিলাম, ওগো রানি,
কত কবি এল চরণে তোমার উপহার দিল আনি।
এসেছি শুনিয়া তাই,
ঊষার দুয়ারে পাখির মতন গান গেয়ে চলে যাই।
—রবীন্দ্রনাথ, পূরবী।
পক্ষান্তরে ইতালীয় কবি ফিলিকাজা গেয়েছেন–
ইতালি, ইতালি! এত রূপ তুমি
কেন ধরেছিলে হায়!
অনন্ত ক্লেশ লেখা ও-ললাটে
নিরাশার কালিমায়।
—সত্যেন দত্তের অনুবাদ
(Italia, Italia, o tu cui feo la sorte)
২. বাট্রান্ড রাসল- দি এনসেস্ট্রি অব ফ্যাসিজম। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস দেবপ্রিয় বিধিদত্ত সকলের সেরা জাতের ধারণা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ইহুদিরাই সৃষ্টি করে। সে ধারণার দলিলে বাইবেল ভর্তি। খ্রিস্ট তার প্রতিবাদ করেন।
৩. প্রিন্স গ্রাবিয়েলে দানুদৃজিয়ো–১২ মার্চ, ১৮৬৩১ মার্চ, ১৯৩৮।