তলস্তয়
কবিগুরু, তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই। রবীন্দ্রজীবনের সপ্ততি বছর পূর্ণ হলে শরৎচন্দ্র এ কথাটি বলেছিলেন। সমস্ত বাঙলা দেশ তখন জয়ধ্বনি করে এই বিস্ময়ে আপন বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।
কবিগুরু তলস্তয়ের(১) মৃত্যু-সংবাদ যখন রুশ সাহিত্যের তখনকার দিনের শরৎচন্দ্র গর্কির কাছে পৌঁছল, তখন তিনি তাঁর শোকলিপি শেষ করার সময় লিখেছিলেন, তার দিকে তাকিয়ে যে আমি ঈশ্বর বিশ্বাস করিনে– মনে মনে বলেছিলুম, এই লোকটি ঈশ্বরের মতো (গড লাইক)।
প্রতি ধর্মেই একটি প্রশ্ন বার বার উঠেছে। ভগবান যখন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনা করতে চান, তখন তা করেন কোন পদ্ধতিতে? ভারতীয় আর্যরা উত্তরে বলেছেন, স্বয়ং ভগবান তখন মানুষের মূর্তি ধরে অবতাররূপে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধ এবং মহাবীর হয়তো নিজেরা এই মতবাদকে স্বীকৃতি দিতেন না, কিন্তু বহু বৌদ্ধ এবং জৈন ওঁদের পূজা করেন অবতাররূপে এবং হিন্দুরাও বুদ্ধকে অবতারের আসনে বসাতে কুণ্ঠিত হননি।
সেমিতি জগতে বিশ্বাস, ভগবান তখন মানুষের মধ্যে একজনকে বেছে নিয়ে তাঁকে তাঁর প্রফেট, পয়গম্বর, রসুল, প্রেরিত পুরুষ নাম দিয়ে নবধর্ম প্রচার করতে আদেশ দেন। ইহুদি এবং মুসলমানদের বিশ্বাস, এঁরা কখনও কখনও অলৌকিক দৈবশক্তির আধার হন, কখনও হন না।
খ্রিস্টের আসন মাঝখানে। তিনি কখনও-বা ঈশ্বরের পুত্ররূপে, কখনও ঈশ্বররূপে, কখনও-বা সুদ্ধমাত্র প্রেরিত পুরুষ রূপে অর্ঘ্য পেয়ে থাকেন। ইসলাম তাকে অলৌকিক শক্তিধারী (মুআজিজা বা মিরাকল করার অধিকারী) পয়গম্বররূপে স্বীকার করে। খ্রিস্ট যে অবতাররূপে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তার পিছনে হয়তো প্রাচীন ভারতীয় আর্যধর্মের প্রভাব আছে।
এ তথ্য প্রমাণ করা সহজ নয়, কিন্তু হিটাইটদের আমল থেকেই পূর্ব ভূমধ্যসাগর তটাঞ্চলে আর্যপ্রভাব বিস্তৃত ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ভারতবর্ষে যে দুজন অবতার সর্বজননমস্য, তাঁরা শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ।
রামচন্দ্র রাবণকে শাসন করে দুস্কৃতির বিনাশ করেন ও পুণ্যাত্মা জনের মনে সাহস বাড়িয়ে দেন। এবং এই সত্য ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অস্ত্রধারণ করতে বিমুখ হননি। পরবর্তী যুগে বোধ করি প্রশ্ন উঠেছিল যে, সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রাণনাশ কি নিতান্তই অপরিহার্য? এ যুগে তাই দেখতে পাই মাইকেল যখন সীতাকে দিয়ে রামের বর্ণনা করাচ্ছেন তখন বলছেন, মৃগয়া করিতেন কভু প্রভু; কিন্তু জীবননাশে সতত বিরত।
কৃষ্ণ অবতীর্ণ হবার পূর্বে হয়তো প্রশ্নটা আরও সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্য বা আদর্শ (এন্ড) মহান হলেই কি যা খুশি সে পন্থা (মিন্স) অবলম্বন করা যায়? মহাভারতে তাই কি শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্রধারণ করছেন না, কিন্তু অবশ্য অর্জুনকে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন?
এর পর বুদ্ধদেব। তিনি সর্ব অবস্থাতেই জীবননাশ করতে মানা করেছেন। কিন্তু রামকে যে-রকম এক রাষ্ট্রের অধিপতিরূপে অন্য রাষ্ট্রের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কৃষ্ণকে যে-রকম অধর্মচারী রাষ্ট্ররাজ দুর্যোধনের মোকাবেলা করতে হয়েছিল, বুদ্ধদেবকে সেরকম কোনও রাষ্ট্রের বৈরভাবের বিরুদ্ধে সম্মুখীন হতে হয়নি। সমাজের ভিতর ব্যক্তিগত জীবনে প্রাণনাশ না করেও প্রাণধারণ করা অসম্ভব নয়, কিন্তু যদি বর্বর প্রতিবেশী রাষ্ট্র এসে লুণ্ঠন, নরহত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য পাপাচারে লিপ্ত হয়, তবে কি আক্রান্ত নৃপতি ক্ষমা ও মৈত্রী নীতি অবলম্বন করে নিষ্ক্রিয় তুষ্ণীম্ভাব দ্বারা রাজধর্ম প্রতিপালন করবেন?
বুদ্ধদেবের পর খ্রিস্ট যখন সে যুগের অধর্মাশ্রিত রাষ্ট্র গঠন প্রেম ও মৈত্রী দ্বারা পরিবর্তিত করতে চাইলেন, তখন দ্বন্দ্ব বাধল সে রাষ্ট্রের স্তদ্বয় ধনপতি ও ধর্মাধিকারীদের সঙ্গে। তিনি অস্ত্র ধারণ করতে অসম্মত হন। ক্রুশের উপর তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। (পাঠক কিন্তু ভাববেন না, তাই বলে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে বাধা পড়ে গেল– বস্তুত খ্রিস্টান মাত্রেরই বিশ্বাস প্রভু যিশু কুশে জীবন দেওয়াতেই তার বাণী জনগণের সম্মুখে জাজ্বল্যমান হল, তাঁর জীবনদানের ফলেই আমরা জীবনলাভ করলুম, কিন্তু এ প্রস্তাবনা আমাদের বর্তমান আলোচনায় অবান্তর।)
এর পর ওই সেমিতি জগতেই হজরত মুহম্মদ। মক্কাতে যতদিন ছিলেন, ততদিন তিনি অস্ত্রধারণ করেননি। মক্কার রাষ্ট্রপতিরা যখন তাকে মেরে ফেলা সাব্যস্ত করলেন, তখন তিনি মদিনার নাগরিকদের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে তাদের দলপতি হবেন তারা অস্ত্রধারণে পরাঙ্খুখ ছিল না।(২)
আপন ধর্মকে উচ্চতর আসনে বসানোর জন্য কোনও কোনও অমুসলমান ধর্মযাজক হজরত মুহম্মদকে রক্তলোলুপ উৎপীড়করূপে অঙ্কিত করেছেন (যেন অন্যের পিতার নিন্দাবাদ না করে আপন জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা যায় না) কিন্তু তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করেছে লুণ্ঠনকারী বর্বর নামে মুসলমানরা তুর্ক অভিযানকারীরা (এস্থলে ফিরোজ, আকবরের কথা হচ্ছে না)। বার্নার্ড শ মুহম্মদ-চরিত মন দিয়ে পড়েছিলেন বলে তাঁর কাল্পনিক কথোপকথনে এ সম্বন্ধে একটি মন্তব্য করেছেন। মুহম্মদকে দিয়ে বলাচ্ছেন, I have suffered & sinned all my life through an infirmity of spirit which renders me incapable of slaying.(৩)
বস্তুত নানাদিক দিয়ে দেখতে গেলে হজরত মুহম্মদ শ্রীরাম এবং শ্রীকৃষ্ণের মাঝখানে আসন নেন (এঁরা গীতা ও কুরান দিয়ে গিয়েছেন) এবং মোদ্দা কথা এই দাঁড়ায় যে, রাষ্ট্র যখন তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করল, তখন তিনি যুদ্ধ করতে পরাজুখ না হয়ে শর সংহরণে প্রস্তুত রইলেন। মহাপুরুষ মুহম্মদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পূর্ণতম বিকাশ দেখতে পাই বিরুদ্ধাচরণকারীর সমুখে সন্ধির প্রস্তাব উত্থাপন করার সময়।
এর পর তেরশো বছর ধরে কেউ আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তাবের উত্থাপন করেনি। পাণ্ডা পুরোহিতদের টীকা-টিপ্পনীর ভিতর খ্রিস্টের বাণী নানা বিকৃত রূপ ধারণ করল– পাদ্রি সায়েবরা প্রতি যুদ্ধে পরমোসাহে বন্দুক কামান মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা পূত-পবিত্র করে যুদ্ধে পাঠালেন।
এ যুগে তলস্তয়ই পুনরায় খ্রিস্টকে আবিষ্কার করলেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে সমাজে তথা সাহিত্যে(৪) সম্পূর্ণতম খ্যাতি অর্জন করার পর তিনি করলেন। উনবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত ইউরোপীয় সভ্যতা-বৈদগ্ধের মূলে কুঠারাঘাত। তার অর্থনীতি, সাহিত্য, সমাজ এবং বিশেষ করে ধর্ম– এগুলোর পিছনে যে কত বড় ভণ্ডামি লুকানো রয়েছে, সেটা দেখাতে গিয়ে তিনি যে দার্চ, মেধা ও কঠোর সত্যনিষ্ঠা দেখালেন, তার সামান্যতম বর্ণনা দেওয়াও আমার পক্ষে অসম্ভব। ওয়র এন্ড পিস তিনি লিখেছিলেন হীরার কলমফ নিয়ে সোনার কালি দিয়ে– আর তাঁর জীবনের এই চরম উপলব্ধি তিনি লিখলেন দধীচির অস্ত্র-নির্মিত দমশ কি তলওয়ার দিয়ে আপন বুকের রক্ত মাখিয়ে।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও অস্ত্রধারণ মহাপাপ তার এ বাণী দুখবর সম্প্রদায় মেনে নিয়েছিল এবং বহু দুখবরণ করার পর তলস্তয়েরই সাহায্যে নির্বাসন স্বীকার করে মাতৃভূমি ত্যাগ করে। শেষ পরীক্ষা সেখানে হয়নি।
রুশ রাষ্ট্র তলস্তয়কে কখনও সম্মুখযুদ্ধে আহ্বান করেনি বলে বলা অসম্ভব, তাঁকে শেষ পর্যন্ত ক্রুশবরণ করতে হত কি না। তবে একথাও ঠিক, আপন আদর্শের চরম মূল্য দেবার জন্য তিনি আত্মজন পরিত্যাগ করে পথপ্রান্তের অবহেলায় প্রাণত্যাগ করেন।
তলস্তয়-কাহিনী এখানেই হয়তো শেষ, কিন্তু সেই চিরন্তন কাহিনী আরও এগিয়ে গিয়েছে এবং কখনও শেষ হবে কি না জানিনে।
গাঁধীকে বহু অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন তলস্তয়। তিনি এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম, যিনি বিদেশি পাপী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র সংগ্রাম করে জয়লাভ করেন।
এবার এটম বোমা তৈরি হচ্ছে।
———–
১. লেয়ো নিকোলায়েভিচ তলস্তয়। জন্ম–ইয়ানায়া পলিয়ানা (তুলা) ৯.৯.১৮২৮; মৃত্যু আস্তাপভো (তামবভ) ২০.১১.১৯১০।
২. বার্নার্ড শ খ্রিস্ট-মুহম্মদের এক কাল্পনিক কথোপকথনের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর অতুলনীয় ভঙ্গিতে।
৩. Who is to be the judge of our fitness to live? said Christ. The highest authorities, the imperial governors, and the high priests find that I am unfit to live; Perhaps they are right. Precisely the same conclusion was reached concerning myself, said Muhammad. I had to run away and hide until I had convinced a sufficient number of athletic young men, that their elders were mistaken about me : that, in fact, the boot was on the other leg. Bernard Shaw, The Black Girl in Search of God, P. 57.
৪. যারা নোবেল প্রাইজের নাম শুনলেই চৈতন্য হারান তাদের বলে দেওয়া ভালো যে, ওই প্রাইজ যদিও ১৯০১ খ্রি. থেকে দেওয়া আরম্ভ হয়, ও তলস্তয় ১৯১০-এ গত হন, তিনি এটি পাননি।