খৈয়ামের নবীন ইরানি সংস্করণ

খৈয়ামের নবীন ইরানি সংস্করণ

গিয়াস্-উদ্-দীন আবুল ফহ্ ওমর ইবন্ ইব্রাহিম অল খৈয়াম প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে সুপরিচিত। তাকে নিয়ে ইরানের ভিতরে-বাইরে সর্বত্র আজও পূর্ণোদ্যমে নানাপ্রকারে গবেষণা চলছে। এবং অত্যধিক গবেষণার মন্থনে যে বিষ ওঠে, তা-ও দেখা দিয়েছে। কোনও কোনও জর্মন গবেষক বলেন, খৈয়াম নামক জনৈক বৈজ্ঞানিক ছিলেন, কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সে খৈয়াম কোনও কবিতা রচনা করেননি। জনৈক রুশ গবেষক বলেন, কিন্তু খৈয়ামের ঠিক পরবর্তী যুগের ইতিহাসে যে এই বাক্যটি পাচ্ছি– তিনি খুরাসানের কবিদের অন্যতম– এটার অর্থ কী? তাই বোধহয় জনৈক ভারতীয় পণ্ডিত– তাঁর যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বললেও অত্যুক্তি হয় না– মাত্র নয়টি রুবাইয়াৎ(১) (চতুষ্পদী) ওমরের বলে নিঃসন্দেহে স্বীকার করেছেন। অথচ পার্টিশনের পূর্বেও কলকাতার তালতলায় যে বটতলা সংস্করণ খৈয়ামের রুবাইয়াৎ পাওয়া যেত তাতে থাকত প্রায় বারশোটি।(২) তবে অতিশয় এক-নজর ফেললেও ধরা পড়ে, এর শত শত রুবাইয়াৎ ইরানের একাধিক কবির কাব্যসঙ্কলনে বিশেষত হাফিজের ওদেরই নামে চলেছে। কোনও কোনও রুবাঈ (রুবাইয়াতের একবচন) তো পাওয়া যায় দু-তিন-চার কিংবা ততোধিক কবির কাব্যে। এক জর্মন পণ্ডিত তাই এক বিরাট নিঘন্টু (কনকরডেন্স, ক্ৰসূরেফরেন্স সম্বলিত কার্ড ইনডেক্স যা খুশি বলুন) নির্মাণ করেছেন। খৈয়ামের নামে প্রচলিত প্রত্যেকটি রুবাঈ কোন কোন কবির কাব্যে আছে তারই পরিপূর্ণ ফিরিস্তি। টাইমটেবিলের মতো কলামের পর কলাম গেঁথে গেঁথে পাতার পর পাতা।

আমাদের মতো সাধারণ পাঠক ভীত হয়ে সে রণাঙ্গন পরিত্যাগ করে।

কিন্তু আমাদের দলটি নিতান্ত ছোট নয়। এমনকি, আশ্চর্যের বিষয়, খুদ খৈয়ামের দেশে ইরানেও আমাদের মতো বিস্তর নিরীহ পাঠক আছেন, যারা কোন রুবাঈটি খাঁটি আর কোনটা মেকি তাই নিয়ে কালক্ষেপ করতে চান না।

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, ফিটজেরাল্ড যে কটি রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেছেন তার কতগুলো ওমরের নয়। তৎসত্ত্বেও ইরানে তারই ওপর নির্ভর একটি খৈয়াম সংস্করণ বেরিয়েছে।

কিন্তু এই সংস্করণের আরও বৈশিষ্ট্য আছে।

এদেশে ফরাসি-জর্মন শেখার প্রতি অনেকের উৎসাহ দেখা দিয়েছে। খৈয়ামের এই ইরানি সংস্করণে আছে : ১. ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি অনুবাদ, ২. সেই অনুবাদের যতটা কাছাকাছি পাওয়া যায় তারই ফারসি মূল (ফিটজেরাল্ড অনেক সময় ভাবানুবাদ করেছেন বলে বলা কঠিন, ঠিক কোন ফারসি রুবাঈটি অনুবাদ করেছেন, আবার এমনও দেখা যায়, একাধিক রুবাইয়াৎ থেকে তিন-চারটি ছত্র জোগাড় করে ইংরেজি একটি কোয়াট্রেন সৃষ্টি করেছেন), ৩. ফরাসি অনুবাদ– কখনও মূল ফারসির অনুবাদ অর্থাৎ ফিটজেরাল্ড যে স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদক তা নেননি, আর কখনও-বা ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি থেকে ফরাসি অনুবাদ, ৪. জর্মন অনুবাদ– একাধিক জর্মন অনুবাদ থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে, এবং ফিটজেরান্ডের অনুকরণ এরা প্রায়ই করেননি, ৫. আরবি অনুবাদ সরাসরি ফারসি থেকে, তবে অনেক স্থলেই স্বাধীন। অনুবাদ করেছেন এক আরব কবি যদিও তিনি জাতে ইরানি।

এছাড়া সংকলনে কয়েকটি মূল্যবান অবতরণিকাও একাধিক ভাষায় সংযোজিত হয়েছে। বিখ্যাত জর্মন ফারসিবিদ রোজেন, ফিটজেরাল্ড, আরব পণ্ডিত আদিব অলতুগা, ইরানি পণ্ডিত হিদায়ৎ ও সঈদ নফিসি (ইনি কয়েক বছর ভারতে বাস করে গেছেন) এঁদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পড়ে খৈয়ামপ্রেমী পাঠক মাত্রই মুগ্ধ হবেন। অবশ্য ফিটজেরান্ডের অবতরণিকা পড়া হয় পুরাতত্ত্ব হিসেবে।

আমরা যখন ফরাসি বা জর্মন কোনও নতুন ভাষা শিখতে যাই তখন আমাদের হাতে দেওয়া হয় যে পাঠ্যপুস্তক তাতে থাকে ঘরের আসবাবপত্রের নাম, পিতা-মাতা-ভ্রাতার প্রতিশব্দ, স্টেশন, টিকিট, প্ল্যাটফর্ম, খাদ্যাদি, বাগানের সাজসরঞ্জামের যাবতীয় জিনিসপত্র এদের নাম, লিঙ্গ ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে বয়স্ক পড়ুয়ারা এবং আমরা সচরাচর একটু বয়েস হওয়ার পরেই এসব ভাষা আরম্ভ করি– পায় অল্পই মনের খোরাক। লাগে একঘেয়ে– শিখে যাই গতানুগতিকভাবে। আমি জানি একেবারে গোড়ার থেকে মন এবং হৃদয়েরই খাদ্য দেওয়া যায় না কিন্তু কিছুটা শেখার পরেই তো মৃন্ময় বিষয়বস্তু থেকে চিন্ময়ে চলে যাওয়া অসম্ভব নয়। বয়স্কদের জন্য এরকম পাঠ্যপুস্তক বিদেশে আমি দু-একখানা দেখেছি। এস্থলে আমার মূল বক্তব্য এই, আট বছরের বাঙালি ছেলে ফরাসি শিখতে চাইলে তার পাঠ্যপুস্তক হবে একরকম, আঠারো বছরের কিশোর শিখতে চাইলে হবে অন্যরকম।

যাদের কিছুটা ফরাসি বা জর্মন, অথবা উভয়েরই কিছুটা শেখা হয়ে গিয়েছে আর খৈয়ামে আসক্তি থাকলে তো কথাই নেই তারা এই সংকলনটি পড়ে আনন্দ তো পাবেনই, ভাষা-শিক্ষার কাজও অনেকখানি দ্রুত এগিয়ে যাবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা ওমরের সবচেয়ে পরিচিত চতুষ্পদীটি নিচ্ছি …

ফারসিতে আছে–

গর দস্ত দহদ জ মগজে গন্দুমে নানি
 ওজু মৈ দোমনি জ গুসফন্দি রানি
ও আনগে মন ও তো নিশসস্তে দর ওয়রানি
এয়েশি বুদ ওয়া আন নৃহদ-হর সুলতানি

 Here with a Loaf of Bread beneath the Bough
 A Flask of wine, a Book of Verse and Thou
 Beside me singing in the Wilderness
 And Wilderness is Paradise enow.

Pour celui qui possede un morceau de bon pain
 Un gigot de mouton. un grand flacon de vin.
Vivre avec une belle au milieu des ruines,
Vaut mieux qu dun Empire etre le souverain

Wein, Brot, ein gutes Buch der Lieder :
 Liess ich damit selbst unter Truemmern mich nieder,
Den Menschen fern, bei Dir allein,
 Wuerdich gluecklicher als ein koenig sein. (৩)

মূল ফারসিতে আছে :

হাতে (দস্ত) যদি থাকে

গমের মগজের (মগ) রুটি (নান)
 দুই মনী (দো মনী) মদ ও
ভেড়ার একখানা ঠ্যাঙ (রান),
 তোমাতে আমাতে যেখানে বসেছি
সেটি যদি ধ্বংসাবশেষে পরিপূর্ণও হয়
(তবুও) আনন্দ (আয়েস) যা হবে
সে সুলতানের রাজত্বের (হদ) চেয়েও বেশি।

 ইংরেজিতে দেখা যাচ্ছে, ভেড়ার ঠ্যাঙ বাদ পড়েছে (বোধহয় অনুবাদক এটাকে বড় গদ্যময় মনে করেছেন), কবিতার বই যোগ করা হয়েছে, প্রিয়ার সঙ্গীতও বাড়ানো হয়েছে; সুলতানের রাজত্বের বদলে স্বর্গপুরী। কিন্তু একটা জিনিস আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। প্রথম ছত্রে আছে, বিনিৎ দ্য বাও– পরে আবার সেটাই উইলডারনিস হয় কী করে? সত্যেন দত্ত বুদ্ধিমানের মতো বিজন ব্যবহার করেছেন, উইলডারনিস ও বনচ্ছায়া দুই-ই বিজন। কান্তি ঘোষ উইলডারনিস বর্জন করে দ্বন্দ্বমুক্ত হয়েছেন।)।

ফরাসিতে আছে ভালো রুটি, ভেড়ার ঠ্যাঙ ও তবে মদের পাত্রকে গ্র (grand ফরাসিতে বিরাট অর্থে) বলা হয়েছে, দু মনী বাদ পড়েছে এবং ফারসিতে যেখানে সুদ্ধ তুমি আছে, সেটা ফরাসিতে সুন্দরী তরুণী (belle) হয়ে গিয়েছে। অনুবাদ মোটামুটি আক্ষরিক।

জর্মনে মদ (Wein), রুটি (Brot) আর কবিতার বই (Buch)। দুম্বা বাদ পড়েছে, তবে বাও নেই– আছে ফারসির সরল অনুবাদ ভগ্নাবশেষ মধ্যে (Truemmerm)।

ইরানি চিত্রকর চতুষ্পদীটি বর্ণে অলংকৃত (ইলট্রেট) করার সময় যুবক-যুবতীকে বসিয়েছেন ভাঙাচোরার মাঝখানে বিধ্বস্ত প্রাসাদের অবশিষ্ট একটি দেউড়ির কাছে। দূরের পটভূমিতে আবৃছা-আবৃছা দেখা যাচ্ছে, সপারিষদ সুলতান বসেছেন সিংহাসনে, সম্মুখে গায়িকা– কিন্তু সমস্তটাই যেন কোনও প্রেতলোকের আবহাওয়াতে ভাসছে।

চিত্রকর ফিটসজেরাল্ডের প্রভাবে পড়েছেন– কিঞ্চিৎ। যুবক-যুবতীর সম্মুখে দুম্বার ঠ্যাঙ আছে, মদের পাত্রও আছে, তবে সেটা বিরাট নয়, দু মনী তো নয়ই এবং সেটি ইটালিয়ান পদ্ধতিতে খড় দিয়ে প্যাচানো–ইরানে সে রেওয়াজ আছে বলে জানতুম না–কিন্তু যুবকের হাতে দিয়েছেন একখানি পুস্তিকা– ফিটজেরান্ডের ফিরিস্তিমাফিক–তবে তরুণী সে মাফিক গান গাইছেন না। পায়ের কাছে আমাদের খোয়াই-ডাঙার বুনো ফুল। তেরঙা ছবি, রেজিস্ট্রেশন খারাপ।

আমাদের কৈশোর-যৌবনে বহু তরুণ-তরুণী ফিটজেরাল্ডের ওমর প্রায় কণ্ঠস্থ করে রাখতেন। সে রেওয়াজ এ যুগেও হয়তো সম্পূর্ণ লোপ পায়নি। যেটুকু স্মরণে রয়েছে তারই ওপর নির্ভর করে ফরাসি-জর্মন অনুবাদ পড়লে ভাষাশিক্ষা দ্রুততর হবে, পাঠক আনন্দও পাবেন। হয়তো-বা তারই ফলে আমরা আরেকখানা খৈয়ামের বাঙলা অনুবাদ পাব।

পুস্তকে পঁচাত্তরটি চতুষ্পদীর জন্য পঁচাত্তরখানা তিনরঙা ছবি তো আছেই, তার ওপর এদিক-ওদিক সর্বত্র ছড়িয়ে আছে কারুকার্য, আবছা তুলিতে আঁকা নানা প্রকারের অর্ধসুপ্ত চৈতন্যের স্বল্প প্রকাশ– কাব্য পড়ে চিত্রকরের প্রতিক্রিয়ার রূপ। ছবিগুলো রবি বর্মা স্টাইলে আঁকা– তবে তার চেয়ে ঢের কাঁচা। একটি ব্যাপারে কিন্তু সর্বচিন্তাশীল দর্শকই সন্তুষ্ট হবেন– জামাকাপড়, বাড়িঘর, গাছপালা, আসবাবপত্র প্রায় সবই খাঁটি ইরানি। অবশ্য বিদেশি প্রভাব কিছুটা যে পড়েনি তা নয়, তবে সে সামান্য। বিদেশি বিশেষ করে ইয়োরোপীয় চিত্রকর– যেরকম নিছক কল্পনার ওপর নির্ভর করে কিম্ভূত বদখৎ হাঁসজারু তৈরি করেন, তিনি তার থেকে স্বভাবতই মুক্ত। এবং তাঁর ছবিতে যে এক নতুন পরীক্ষার প্রচেষ্টা রয়েছে সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েই চিত্রকর ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে উপক্রমণিকায় লিখেছেন :

At the end, I hope the Patrons of art find this gift amusing and this could be an Ideal Ideas (sic) for the young artists, and the old and experience (sic) artists could forgive some of the scenes which lacking the Proper Techniques (sic). I wish they call them to my attention, Ill be most greatful (sic) …Akbar Tajvidi.

এ পুস্তক সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু মনোরম আলোচনা করা যেত, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল, এটির সঙ্গে শুধু আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।(৪)

The quatrains of Abolfath Ghiat-e-Din Ebrahim KHAYYAM of Nishabur, Published by Tahir Iran Co, Kashani Bros Teheran, Lalezar Istanbul Sq.

———–

১. তাপসী রাবেয়া নাম এদেশে অজানা নয়। তার অর্থ চতুর্থ কন্যা। রুবাইয়াৎ, রাবেয়া ইত্যাদি শব্দ আরবি, আরবাৎ অর্থাৎ চার থেকে এসেছে।

২. ইরানে ১৪০১ পর্যন্ত পাওয়া যায়। ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ খৈয়ামের মৃত্যুর প্রায় ৮৮ বছর পরে লিখিত এক পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায় ২৫১টি– এটি এখন অক্সফোর্ডে।

৩. বাঙলায় :

বনচ্ছায়ায় কবিতার পুঁথি পাই যদি একখানি,
পাই যদি এক পাত্র মদিরা আর যদি তুমি রানি,
সে বিজনে মোর পার্শ্বে বসিয়া গাহো গো মধুর গান
 বিজন হইবে স্বর্গ আমার তৃপ্তি লভিবে প্রাণ ॥
—সত্যেন দত্ত

 সে নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়া
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়।
মৌন ভাঙি মোর পাশেতে গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর
সেই তো সখী স্বর্গ আমার, সেই বনানী স্বর্গপুর।
—কান্তি ঘোষ

৪. খৈয়াম ও নজরুল ইসলাম কৃত তার অনুবাদ নিয়ে আমরা অন্যত্র আলোচনা করেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *