ভারতীয় সংহতি

ভারতীয় সংহতি

ভারতীয় সংহতি তবে কোথায়?

এস্থলে নিবেদন করে রাখি যে, আমার ধারণার সঙ্গে অল্প লোকেরই ধারণা মিলবে ও যাদের সঙ্গে মিলবে তারা এবং আমি এ দুরাশা পোষণ করি না যে, বিংশ শতাব্দীর লোক আজ অথবা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের বক্তব্য কান দিয়ে শুনবে।

বেদ-উপনিষদ নমস্য কিন্তু সমস্ত ভারতবর্ষেই এসবের চর্চা অতি কম। এমনকি পণ্ডিতদের মুখে শুনেছি, গীতা পর্যন্ত এদেশে উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে বিশেষ প্রচলিত ছিল না।

আপনি ভারতবর্ষের যে কোনও গ্রামে যান না কেন, তা সে মালাবারে আসামে পাঞ্জাবেই হোক– সেখানকার লোকনাট্য চারণ গানে সর্বত্রই মহাভারত-রামায়ণ বিরাজিত। জনপদবাসীর রসাস্বাদনের প্রধান উৎস রামায়ণ-মহাভারত। আমি একবার মালাবারের গ্রাম্য কথাকলি দেখতে এবং শুনতে গিয়ে তিন মিনিটেই বুঝে যাই, হনুমান সভাজনকে সালঙ্কার বর্ণনা করছেন, তিনি কী করে লঙ্কায় উপস্থিত হলেন, নগর পরিদর্শন করলেন, লঙ্কার কদলীবনে কী প্রকারে লঙ্কাকাণ্ড ঘটালেন, অবশেষে রাবণের অনুচর তাঁর পুচ্ছটিতে অগ্নিসংযোগ করলে তিনি কী প্রকারে গৃহ থেকে গৃহান্তরে লফপ্রদান করে নগরীতে ব্যাপকভাবে বহ্নি প্রজ্বলিত করলেন। মালায়ালমফ ভাষার এক বর্ণ না জেনেও আমি স্বচ্ছন্দে গল্পটি উপভোগ করলুম।

ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে যারাই পরিভ্রমণ করেছেন তারাই জানেন, রামায়ণ-মহাভারত ভারতীয় জীবনের কতখানি গভীর অতলে প্রবেশ করেছে।

এবং এই নাট্যনৃত্য উপভোগ করে শুধু হিন্দু না, মুসলমানও। কারণ ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের মাতৃভাষা এক। বাঙ্গলার মুসলমানের মাতৃভাষা যেমন বাঙলা, গুজরাতি মুসলমানের মাতৃভাষাও গুজরাতি। লক্ষ্ণৌয়ের মুসলমানের মাতৃভাষা যেমন উর্দু, হিন্দুরও তাই এখন অবশ্য হিন্দি ক্রমে ক্রমে উর্দুর জায়গা দখল করে নিচ্ছে। মাতৃভাষায় আমোদ-আহ্লাদ করাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা শুনেছি দেশবিভাগের পরও হর হর মহাদেব ফিল্ম ঢাকাতে সে বক্স আপিস ভরলে তাতে সিনেমার মালিকগণ বিস্মিত হন।

কিন্তু অমিলও আছে।

ধর্মজগতে হিন্দু ভীষ্ম-কর্ণকে আদর্শ বলে ধরে নেয়, মুসলমান নেয় না। গোব্রাহ্মণকে শ্রদ্ধা করবার কোনও কারণও মুসলমানের নেই। অবশ্য আউল-বাউল মুর্শিদীয়া মিস্টিকগণের গানে কিছুটা রামায়ণ-প্রীতি পাওয়া যায়, কিন্তু ভারতীয় মুসলমান ব্যাপকভাবে সেটা গ্রহণ করেনি।

***

রামায়ণ-মহাভারতের উৎস থেকে সঞ্জীবনী-সুধা আহরণ করে হিন্দু সংহতি পুনর্জীবিত করা যায় অবশ্য যদি সাহিত্যিক, সমাজপতি, রাজনৈতিক নেতাদের এ পন্থায় আস্থা থাকে এবং সে কর্মে নিজেদের নিয়োগ করেন, বিনোবাজি যেরকম করেছেন, কিন্তু যদি ভারতীয় সংহতির কথা তোলা যায় তবে সমস্যাটা কঠিন হয়, কারণ ভারতবর্ষে মুসলমান খ্রিস্টান পার্শি গারো নাগা আদিবাসীও আছেন। জৈনদের কথা তুলছিনে, কারণ একমাত্র উপাসনা পদ্ধতি বাদ দিলে তারা সর্বার্থে হিন্দু।

সর্বপ্রথম প্রশ্ন, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য কোন জায়গায়? রসের ক্ষেত্রে যে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ সেকথা পূর্বেই নিবেদন করেছি।

এখন যা বলতে যাচ্ছি, সেটি আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে।

ছেলেবেলা থেকেই আরব দেশাগত দু-একটি আরব মুসলিমের জীবনযাত্রা ও চিন্তাপদ্ধতির সঙ্গে আমার পরিচয়। পরবর্তী যুগে আরব দেশে থাকবার আমার সুযোগ হয়েছিল।

এদের ধর্মবিশ্বাস সরল। এরা বিশ্বাস করেন, আল্লাতালা এই বিশ্ব মানুষের আনন্দের জন্য সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু পাছে স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত লাগে তাই তিনি ধর্মের সৃষ্টি করেছেন। সেই ধর্মে কতকগুলি বস্তু ও আচরণ আল্লা বেআইনি বলে হুকুম দিয়েছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, আল্লাতালা হুকুম দিয়েছেন, তুমি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে পার, যদি সকলকে সমান সম্মান সমান প্রেমের চোখে দেখতে পার। না পারলে তোমার পক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করা অন্যায়!

আরব ভূমি তথা অন্যান্য মুসলিম ভূখণ্ডে তাই যদি কেউ বৃদ্ধ বয়সেও পুনরায় ভার‍্যা গ্রহণ করে তবে তাই নিয়ে লোকনিন্দা হয় না। সমাজ ভাবে, সে একাধিক স্ত্রীকে সমান চোখে দেখতে পারবে কি না, সে দায়িত্ব তার স্কন্ধে।

কিন্তু ভারতবর্ষের মুসলমান অর্থাগম হলেই দ্বিতীয় দারা গ্রহণ করে না। তার ভিতরে কেমন যেন একটা ত্যাগের আদর্শ আছে। তার বক্তব্য, আল্লাতালা আমাকে এটা-সেটা অনেক কিছুই উপভোগ করতে দিয়েছেন সত্য কিন্তু আমি চেষ্টা করে দেখি না, আমার এগুলো না হলে চলে কি না?

একথা বলা আমার আদৌ উদ্দেশ্য নয় যে, কোরানে ত্যাগের আদর্শ নেই। বিস্তর আছে। বস্তুত জাকাত (বাধ্যতামূলক দান-খয়রাত) ইসলাম সৌধের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এবং নিতান্ত দীন-দুঃখী ছাড়া সকলকেই কিছুটা দান করতে হয়। তদুপরি সুফি এবং সাধুসন্ত সম্প্রদায় তো চূড়ান্ত ত্যাগের আদর্শই বরণ করে নেন। উপস্থিত এদের কথা হচ্ছে না। আমার বক্তব্য ভারতীয় মুসলিম যতখানি ত্যাগের আদর্শ বরণ করেছে সে শুধু ধনদৌলতের বেলায়ই নয়, আমোদ-আহ্লাদ পারিতোষ-আনন্দের আভ্যন্তরীণ জগতেও অন্যান্য মুসলিম ততখানি করেনি।

এই ত্যাগের মন্ত্র ভারতবর্ষে বহুকাল ধরে প্রচলিত।

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা– অর্থাৎ তাকে ত্যাগের দ্বারা ভোগ করতে হবে।

***

এস্থলে ঈষৎ অবান্তর হলেও ত্যাগ সম্বন্ধে আমার কিঞ্চিৎ নিবেদন আছে।

 যার কিছু নেই, উপার্জন করার কোনও ক্ষমতা নেই, তার মুখে ত্যাগ ত্যাগ শোভা পায় না। বিশেষত এই বিংশ শতাব্দীতে। যখন অক্ষম জন সর্বদায়িত্ব এড়িয়ে ত্যাগের অছিলা ধরে সোশ্যাল সার্ভিসের নাম করে আশা করেন, সমাজ তাঁকে পুষবে, এবং ভালোভাবেই পুষবে, কারণ তিনি সর্বস্ব (!) ত্যাগ করেছেন, তখন আমার মন বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে (এরই অন্য উদাহরণ মহাত্মা গান্ধী বলেছেন– শক্তিহীনের ক্ষমা ক্ষমা নয়)। সোজা কথা বিড়লা-টাটার দৌলত তাঁরাই ত্যাগ করতে পারেন, আমি পারিনে, কারণ ও দৌলত আমার নয়।

ওদিকে আবার উপনিষদ বলেছেন, মা গৃধঃ কস্যসিদ্ধন! অন্যের ধনের ওপর লোভ করো না।

অর্থাৎ চাষা, মজুর, সাহিত্যিক, মাস্টার আপন আপন পরিশ্রম দ্বারা অর্থ উপার্জন করতে পারে, অন্যের ধনের প্রতি লোভ না করেও।

সেই ধন অর্জন করে ত্যাগের মাধ্যমে তাকে উপভোগ করতে হবে।

এই আদর্শ হিন্দু-মুসলমান দুয়েরই আছে, এবং বহু যুগ ধরে জীবনে উপলব্ধি করেছে বলে এই দৃঢ়ভূমির উপর জাতীয় ঐক্য গঠিত হতে পারে। তা হলে আর কোনও দ্বন্দ্ব থাকবে না।

শুধু তাই নয়, তা হলে ভারতবর্ষ যে শুধু শক্তিশালী রাষ্ট্র বলেই গণ্য হবে তা নয়, সে ভদ্রতম সম্ভ্রান্ততম রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃত হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *