জাতীয় সংহতি

জাতীয় সংহতি

মনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়।

এই যে ফারসি নামক ভাষা এটি সাতশো বছর ধরে ভারতের রাষ্ট্রভাষা ছিল। যদিও পাঠান ও মোগল কারওরই মাতৃভাষা ফারসি ছিল না। শেষ বাদশা বাহাদুর শা বাদশার অন্তঃপুরেও তুর্কি বলা হত। যদিও রাজদরবারে ফারসি চলত, কিন্তু কবিসম্মেলনে প্রধানত উর্দু।

ইংরেজও প্রথম একশো বছর এ দেশে ফারসি দিয়েই কাজ চালায়। ১৮৪০-এর কাছাকাছি একদিন তারা ফারসি নাকচ করে দিয়ে ইংরেজি চালাল। যে হিন্দু কায়স্থরা একদা অত্যুত্তম ফারসি শিখে পদস্থ রাজকর্মচারী হতেন, তারা ৫০/৬০ বছরের ভিতর ফারসি বেবাক ভুলে গিয়ে ইংরেজির মাধ্যমে রাজকর্ম চালিয়ে যেতে লাগলেন। অনেকের মুখে শুনি, কলকাতা হাইকোর্টে নাকি এখনও তাদের প্রাধান্য অতুলনীয়। বাদবাকি ভারতবর্ষে এখন ক-জন লোক ফারসি জানেন সেটা বের করতে হলে দিনের বেলাও লণ্ঠন নিয়ে বেরুতে হয়। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই কথা হচ্ছে। অবশ্য এই দুই সম্প্রদায়েরই যারা উর্দুর শক্ত গোড়াপত্তন করতে চান তারা ফারসি শেখেন– বাঙালি যেমন আপন বাঙলাকে জোরদার করতে হলে সংস্কৃত শেখে।

যে ফারসি প্রায় সাতশো বছর ধরে ভারতবর্ষে দাবড়ে বেড়াল, হাজার বছর ধরে তুর্কিস্তান থেকে তাইগ্রিস নদ অবধি রাজত্ব করল (লাতিনের মতোই ফারসিকে সে যুগের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বলা যেতে পারে) সেই ফারসিই পঞ্চাশ বছরের ভিতর ভারতবর্ষে লোপ পেল!

ইংরেজি মাত্র একশো বছর রাজত্ব করেছে। তার লোপ পেতে কত দিন লাগবে?  

শ্রদ্ধেয়া বিজয়লক্ষ্মী সেদিন বলেছেন, ইংরেজি আমাদের লিগেসি, ওটা আমরা ছাড়ব কেন? তাঁর পুণ্যশ্লোক স্বর্গীয় পিতা মোতিলাল ফারসিকে তার লিগেসি মনে করতেন। ইংরেজ আমলে একদা দিল্লির বিধানসভায় দুই ইংরেজ একে অন্যকে প্রচুর অহেতুক প্রশংসা করলে পর মোতিলালজি বললেন, ফারসিতে একটি সুন্দর প্রবাদ আছে : মন্ তোরা হাজী মীগোই, তো মরা কাজী বগো! অর্থাৎ আমি তোমাকে হাজী বলে সম্বোধন করব, আর তুমি আমাকে কাজী বলে সম্বোধন কর– অথচ ইনিও মক্কাতে গিয়ে হজ করেননি, উনিও কাজী বা ম্যাজিস্ট্রেট নন। সেই ফারসি ভাষার লিগেসি গেছে, ইংরেজির কবে যাবে?

পাঠক ভাববেন না, আমি ইংরেজি তাড়াবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছি। আদপেই না। নিজের স্বার্থেই আমি চাই, ইংরেজি থাকুক এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায়, মশাই হিন্দির গাড়ি আতি হৈ, জাহাজ জাতা হৈ লিঙ্গ মুখস্থ করে করে হিন্দি যাদের মাতৃভাষা তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে যাব! যে কটা দিন বেঁচে থাকব, ইংরেজি ভাঙিয়েই খাব। সে কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে, আমি-আপনি চাইলে না চাইলেও ইংরেজির ভাগ্যে যা আছে তা হবেই।

.

আরেকটি উদাহরণ নিন। এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ ওকিবহাল নই– যা শুনেছি তাই বলছি। ইংল্যান্ডে নাকি নরমান বিজয়ের ফলে ফরাসি রাষ্ট্রভাষা হয়ে যায়, এবং তামাম ইংল্যান্ডের লোক নাকি পড়িমড়ি হয়ে ফরাসি শেখে। কবি চসারের সামনে নাকি সমস্যার উদয় হয়, তিনি ফরাসি না ইংরেজিতে কাব্য রচনা করবেন? (ভাগ্যিস ইংরেজিতে করেছিলেন, কারণ ফরাসি লিখে কোনও ইংরেজ যশ অর্জন করেছেন বলে শুনিনি; এদেশে যেমন আটশো বছর ফারসি চর্চার পর এক আমির খুসরৌই কিছুটা নাম করতে পেরেছেন তা-ও তাঁর মাতৃভাষা ছিল ফারসি।)

নরমান বিজয় খতম হওয়ার পরও ইংরেজ আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তার ফরাসি লিগেসি যেন মকুব না হয়ে যায়। কোটি কোটি পৌন্ড খর্চা করে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে ফরাসি শিখিয়েছে, কাচ্চা-বাচ্চার জন্য ফরাসি গভর্নেস রেখেছে, ছুটিছাটা পেলেই প্যারিসপনে ধাওয়া করেছে। আর তার ভাষার ভাই মার্কিনও ফরাসি মত্ততায় কিছুমাত্র কম নয়। শুনেছি, মার্কিনি ইংরেজিতে নাকি প্রবাদ আছে, সাধু মার্কিনেরই মৃত্যুর পর প্যারিসপ্রাপ্তি হয়– সেই তার স্বর্গপুরী, মুসলমানের বেহেশত, হিন্দুর কৈলাস-বৈকুণ্ঠ-প্রাপ্তির মতো।

ফরাসি শেখানোর বাজে খর্চা যারা কমাতে চান তারা নাকি হালে হাতে-কলমে সপ্রমাণ করেছেন যে, লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে শিক্ষিত ইংরেজকে ফরাসিতে প্রশ্ন শুধালে শতেকে গোটেক ফরাসিতে উত্তর দিতে পারে, কি না পারে।

শুনেছি ব্রিজ দিয়ে নাকি ফ্রান্স-ইংল্যান্ডে যোগ করে দেওয়া হবে। হায় রে কপাল! যখন ভাষার সেতু ছিল, তখন লোহার সেতু ছিল না; এখন লোহার সেতু হচ্ছে তো ভাষার সেতু নেই!

আরেকটি উদাহরণ দিই। খ্রিস্টধর্ম ইয়োরোপে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হবার পর খ্রিস্টভক্তগণের বাসনা হল, খ্রিস্টধর্মের কল্যাণে সমস্ত ইয়োরোপে যে এক নবীন ঐক্য দেখা দিয়েছে সেটা যেন লোপ না পায়। তাই তারা আপ্রাণ লাতিন আঁকড়ে ধরে রইলেন। পাছে সেই ঐক্য লোপ পায়, তাই, দেশজ অনুন্নত ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ পর্যন্ত করতে দেওয়া হত না (মুসলমানরাও বহুকাল কোরানের ফারসি কিংবা উর্দু, বাঙলা অনুবাদ করতে দিতে চাননি, ওই একই কারণে)। লুথারের অন্যতম প্রধান সংস্কার ছিল জর্মন ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ প্রচার। ফলে শেষ পর্যন্ত ফরাসি লাতিনের স্থানটি কেড়ে নিল এই সেদিন পর্যন্ত জর্মনভাষী ফিড্ররিক দি গ্রেট ফরাসি কবি ভলতেয়ারকে নিমন্ত্রণ করে তার অতি-কাঁচা ফরাসি কবিতা মেরামত করিয়ে নিতেন এবং সর্বশেষে ইয়োরোপের সর্বভাষা আপন আপন দেশে মাথা খাড়া করে দাঁড়াল। ইস্তেক ডেনিশ, ফিনিশ পর্যন্ত। লাতিন-ফরাসি সংহতি গেল। অনেক পর্যটকের মুখে শুনতে পাবেন– সে আসন এখন ইংরেজি নিচ্ছে। শুনে হাসি পায়। হোটেলবয়রা কিছুটা ইংরেজি বলতে পারে বইকি, যেমন মাদুরার হোটেলবয়ও কিঞ্চিৎ হিন্দুস্থানি কপচায়, কিন্তু প্যারিস কিংবা ভিয়েনার রাস্তায় ওইসব দেশবাসীর সঙ্গে ইংরেজিতে দু দণ্ড রসালাপ করবার চেষ্টা দিন না, দেখুন না ফলটা কী হয়।

আমি যদি বলি, সমস্ত ইয়োরোপে যতখানি ইংরেজি বলা হয়, তার তুলনায় ভারত-পাকে বেশি হিন্দুস্থানি বলা হয়, তবে ভুল বলা হবে না অবশ্য বই পড়ার কথা হচ্ছে না, সেটা নির্ভর করে জনসাধারণে শিক্ষার বিস্তৃতির ওপর।

অর্থাৎ ইংরেজি ও লাতিন সংহতি এনে দিতে পারবে না।

কিন্তু সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ আরব-আফ্রিকা ভূখণ্ডে। ইরাক থেকে আরম্ভ করে সিরিয়া, লেবানন, মিশর, তুনিস, আলজেরিয়া, মরক্কো, এদিকে কুয়েইত, বাহরেন, মক্কা-মদিনা, ইয়েমেন, জর্ডন, সর্বত্রই আরবি প্রচলিত। লেবানন বাদ দিলে এদের প্রতিটি রাষ্ট্রে চৌদ্দ আনা পরিমাণ লোক মুসলমান এবং উত্তর আফ্রিকার কিছু বেরবের কপ্টিক ও নিগ্রো রক্ত বাদ দিলে সকলের ধমনীতেই প্রায় আভেজাল সেমিতি রক্ত।

কিন্তু কোথায় সেই আরব সংহতি?

প্রাচীন দিনের কাহিনীতে ফিরে যাব না। এই আপনার-আমার চোখের সামনেই দেখতে পেলুম, ইরাক সে সংহতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল, কুয়েইত জাতভাই কাসেমের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বিধর্মী (কারও কারও মতে কাফের) ইংরেজকে দাওয়াত করে খানা খাওয়াল, এবং পরশু না তরশু দিন সিরিয়াও নাসেরের মিশরিদের গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। এমনকি সিরিয়ার মসজিদে মসজিদে নাকি মোল্লারা নাসেরকে অভিসম্পাত দিচ্ছেন, নাসের নাস্তিক, টিটোর সঙ্গে কোলাকুলি করে, তারই আশকারায় মিশরের টেলিভিশন অশ্লীল ছবি, অর্ধনগ্না রমণী দেখায়।

এক ধর্ম, এক রক্ত, এক ভাষা। এক ভাষা, বিশেষ করে বললুম, কারণ সিরিয়া, ইরাক, মিশরের কথ্য ভাষাতে প্রচুর পার্থক্য থাকলেও ওসব জায়গায় কোনও উপভাষা সৃষ্টি হয়নি– সেই এক হাজার বছরের পুরনো ক্লাসিকাল আরবিই সর্বত্র চলে। তবু আর মিলন হয়ে উঠছে না।

***

কাজেই সংহতির সন্ধানে অন্যত্র যেতে হবে। গুজরাতি, বাঙালি, হিন্দু, মুসলমান, সবাই মিলে হিন্দি কপচালেই যে রাতারাতি আমাদের জাতীয় সংহতি গড়ে উঠবে, এ দুরাশা যেন না করি।

রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী বলেই বলছি তা নয়, আমার মনে হয়, তিনিই এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি পরিষ্কার চিন্তা করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *