ভ্যাকিউয়াম
কবি এবং বৈজ্ঞানিকে প্রায়ই বিরোধ উপস্থিত সেকথা আমরা জানি। কবি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, অহে-হে! কী সুন্দর সূর্যোদয়। বৈজ্ঞানিক গম্ভীর কণ্ঠে টিপ্পনী কাটলেন, হস্তীমূর্খ। সূর্যের আবার উদয়-অস্ত কী? পৃথিবীটা ঘুরে যাওয়াতে মনে হল সূর্যোদয় হয়েছে।
কিন্তু কোনও কোনও স্থলে উভয়েই একমত পোষণ করেন।
কবি গাইছেন,
কে বলে সহজ, ফাঁকা যাহা তারে
সহজ কাঁধেতে সওয়া
জীবন যতই ফাঁকা হয়ে যায়
ততই কঠিন বওয়া ॥
বৈজ্ঞানিকও উচ্চকণ্ঠে বলেন, প্রকৃতি শূন্যতাকে ঘৃণা করে
নেচার এবরজ ভ্যাকিউয়াম।
ধর্মের উচ্ছেদ যারাই কামনা করেন তারাই এ তত্ত্বটি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন। প্রাচীন যুগের চার্বাকপন্থী বা তার পরবর্তী যুগের মক্কার কাফিরদের কথা হচ্ছে না। এ যুগের কথা বললেই এ যুগের লোক সাড়া দেয়। এ যুগে ধর্মের প্রধান শত্রু টোটেলিটেরিয়ান স্টেট, একচ্ছত্র রাষ্ট্র জগদ্দল রাষ্ট্র বললে জিনিসটা আরও পরিষ্কার হয়। তা সে রাষ্ট্র ফাঁসিস্টই হোক আর কমুনিস্টই হোক।
হিটলার বা স্তালিনের ভাবখানা অনেকটা এই : কী! আমার রাষ্ট্রে আমি ভিন্ন অন্য কার মুরদ যে আমার কথার ওপর কথা কইতে যাবে? আপন রাষ্ট্রের প্রতি, ভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতি অবশ্য আখেরে সেটাও আমি দখল করব– তোমার আচরণ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, কলা-দর্শনে তোমার আদর্শ ঠিক করে দেব আমি। এ যেন বাইবেল বর্ণিত যেহোভার তীব্র তীক্ষ্ণ আদেশ, আমা ভিন্ন তোর অন্য কোনও উপাস্য দেবতা থাকবে না।
এর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ উঠল সেটা প্রধানত ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠান থেকে। শিল্পী-দার্শনিকের সেরকম কোনও প্রতিষ্ঠান নেই। আর বৈজ্ঞানিক অর্থনৈতিক পণ্ডিতেরা জীবনদর্শন চিন্তা করেন কমই। গবেষণার ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা পেলেই তারা সন্তুষ্ট। আইন-আদালত নিয়ে যাদের কারবার তারা গোড়ার দিকে কিছুটা আপত্তি জানান বটে, কিন্তু দেশের ডিক্টেটর একবার জোর করে, ভয় দেখিয়ে, যে করেই হোক– যদি আইন পাস করিয়ে নিতে পারেন যে তিনিই সর্ব আইনের মূলাধার, তা হলে এদের আর আইনত কোনও আপত্তি থাকতে পারে না। মিলিটারির বেলায়ও হুবহু তাই। ডিক্টেটর যখন দেশের সর্বোচ্চ সামরিক উর্দি পরে তার সেনাবাহিনীর সামনে এসে দাঁড়ান তখনই সেনানায়করা শপথ নেন যে, তাঁর কোনও আদেশ তারা ভঙ্গ করবেন না। সকলেই জানেন, হিটলারকে নিধন করার জন্য বড় বড় সেনাপতিরা যখন ষড়যন্ত্র আরম্ভ করেন তখন তাঁদের প্রধান অন্তরায় ছিল এই শপথ।
শেষ পর্যন্ত যখন অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতনের ফলে ধর্ম ভূগর্ভে আশ্রয় নেয়, তখন ধৰ্মবৈরী ডিক্টেটররা সম্মুখীন হয় পূর্ববর্ণিত ওই ভ্যাকিউয়ামের সম্মুখে। এতদিন ধরে ধর্ম মানুষের জীবনে বৃহৎ এক অংশ জুড়ে বসে ছিল, এখন ধর্ম চলে যাওয়াতে সে জায়গাটা যে ফাঁকা হয়ে গেল সেটা পূর্ণ করা যায় কী প্রকারে?
হিন্দুর ধর্মজীবনে বাধ্যবাধকতা অত্যল্প (তা-ও ব্রাহ্মণের); তার বাধ্যবাধকতা সামাজিক জীবনে। মুসলমান এবং খ্রিস্টানের ঠিক তার উল্টোটা। তারা সমাজে স্বাধীন। কিন্তু ধর্মে প্রচুর বাধ্যবাধকতা*। [*স্বামী বিবেকানন্দ তাই আমেরিকা থেকে তাঁর শিষ্যদের একাধিক চিঠিতে লেখেন, হিন্দুর ধর্ম ও খ্রিস্টানদের সমাজ নিয়ে নতুন হিন্দু-জীবন গড়তে হবে। বঙ্কিমও এই ধরনের মন্তব্য করেছেন। তিনি বিদ্যাসাগরকে বহু-বিবাহনিরোধ ব্যাপারে বলেছেন, এ জিনিস খারাপ, ধর্ম দিয়ে প্রমাণ করেই-বা লাভ কী? হিন্দু চলে সামাজিক লোকাচার মেনে।] ডিক্টেটর বনাম ধর্মে যে দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয় এবং এখনও চলেছে, সেটা প্রধানত খ্রিস্টান দেশেই সীমাবদ্ধ বলে আমরা সেইটে নিয়ে আলোচনা করব। তবে এ দেশের হিন্দু পাঠকেরা খ্রিস্টধর্মের চেয়ে ইসলামের সঙ্গে বেশি পরিচিত বলে তার থেকেও কিছু কিছু দৃষ্টান্ত নেব।
খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের সর্বপ্রথম মূল সিদ্ধান্ত–ইমান। অর্থাৎ তোমার বিশ্বাস– faith কী? তুমি যদি বল, ঈশ্বর নেই– জৈন ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা যে-রকম বলে, কিংবা বল, ঈশ্বর আছেন বটে কিন্তু দেবদেবীও আছেন অসংখ্য কিংবা বল যিশুতে বিশ্বাস না করেও মোক্ষলাভ সম্ভবে– তা হলে তুমি শুধু পাপী না, তুমি অখ্রিস্টান (খ্রিস্টান দৃষ্টিবিন্দু থেকে কাফির) হয়ে গেলে। ডিক্টেটররা এ সবেতে যে খুব বেশি আপত্তি করেন তা নয়, তাদের আপত্তি, তুমি যখন বল, কর্তব্য নির্ধারণার্থে তুমি ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের ওপর নির্ভর কর, তখনই তাদের আপত্তি। হিটলার-স্তালিন বলেন, তোমার কর্তব্য নির্ধারণ করে দেব আমি। বাইবেল কুসংস্কারাচ্ছাদিত, বুর্জয়ানির্মিত, প্রলেতারিয়া-শোষক গ্রন্থ। আসল কেতাব মাইন কাম্পফ কিংবা ডাস ক্যাপিটাল। বিশ্বাসী খ্রিস্টান যেরকম স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না, যিশু কোনও ভুল করে থাকতে পারেন, বিশ্বাসী কম্যুনিস্ট ঠিক তেমনি কিছুতেই স্বীকার করবেন না, মার্ক্স-লেনিন প্রচারিত ডাইলেক্টিক্যাল মেটিরিয়ালিজমে কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে।
কিন্তু এই ইমান বা faith ভিতরকার জিনিস ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইমান চলে গিয়ে ভ্যাকিউয়াম সৃষ্টি হল কি না, হলফ করে কিছু বলা যায় না।
আসল শিরঃপীড়া ধর্মের ক্রিয়াকর্ম নিয়ে। সেখানে যে ভ্যাকিউয়াম তৈরি হয় সেটা ভরাট করা যাবে কী দিয়ে?
আবালবৃদ্ধ নরনারী যায় রবিবারে চার্চে। বুড়োরা যা–মরুক গে, কিন্তু জোয়ানদের নিয়ে করা যায় কী? ঠিক ওই সময়েই লাগিয়ে দাও– কুচকাওয়াজ, মার্চ। হিটলারপন্থীরা দাঁড়াও চক্রাকারে। নেতা মাঝখানে দাঁড়িয়ে তীব্রকণ্ঠে চিৎকার করবে, হাইল (জয়তু!) জোয়ানরা সমস্বরে তীব্রতর কণ্ঠে উত্তর দেবে– হিটলার! ফের হাইল! ফের হিটলার! ফের হাইল! ইত্যাদি। টকটকে লাল মুখ যতক্ষণ না নীল হয়ে যায়। গির্জাতেও তো ওই রকমই হয়। পাদ্রিসাহেব মন্ত্রোচ্চারণ করেন ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে, বিশ্বাসীরা উত্তর দেন দুই-চারিটি শব্দে কিংবা শুধু আমেন (তথাস্তু) বলে।
ক্রিসমাস, ইস্টারের উপাসনা জব্বর ভারি রকমের। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পার্টি-ডে নুরবের্গে। সপ্তাহব্যাপী মোচ্ছ। ঝাড়া চারটি ঘণ্টা হিটলার দক্ষিণ বাহু উত্তোলিত প্রসারিত করে দাঁড়ালেন বেদি থুড়ি প্ল্যাটফর্মের উপর। বিশ্বাসী দল ঝাঁকে ঝাঁকে তাঁর সামনে দিয়ে মার্চপাস্ট করলেন। কী উত্তেজনা, কী উৎসাহ! বিদেশাগত কাফির (অর্থাৎ এখনও যে নাৎসি-ধর্ম গ্রহণ করেনি) তো বে-এক্তেয়ার–ইস্তেক জর্মনির দুশমন ইংরেজের রাষ্ট্রদূত হেন্ডারসন। অবশ্য পাঁড় কাফির এসব পরবে আসে না– যেমন ফরাসি রাষ্ট্রদূত মঁসিয়ে ফ্রাঁসোয়া পঁসে! তিনি ফাড়া এড়াবার জন্য ওই সময় ছুটি নিয়ে চলে যেতেন স্বদেশে, জমিদারি তদারক করতে!… রুশ দেশেও এসব পরব হয়।
ধর্মের আরেক অঙ্গ কৃচ্ছসাধন- উপবাস। প্রবর্তিত হল আইন-টপৃ– গরিস্ট। সপ্তাহে একদিন খাবে শুধু এক পদের খানা। মাংস, আলু, ফুলকপি, চর্বি সবসুদ্ধ মিলিয়ে ঘাট। অর দ্যভর দিয়ে আরম্ভ করে সেভরি পর্যন্ত অষ্টাদশপদী খানা মানা। কিন্তু বিপদে পড়লে আমরা, ধর্মভীরুজনও, ডুবে ডুবে জল খাই, ঠিক তেমনি প্রচুর নাৎসি প্রেসার কুকারের মতো একটি পাত্রে তিন খোপে তিন রকমের খাদ্য রান্না করে খেল–কারণ বলা হয়েছে, আইন-টপৃ–অর্থাৎ এক হাঁড়িতে রান্না খাদ্য এক হাঁড়িতেই তো রান্না হয়েছে, আপত্তি আর কী? হিটলারের কর্তাভজা শিষ্য পার্টি সেক্রেটারি আরেক কাঠি সরেস। হিটলার মিটলেস্, তিনি কাটলেস্। অর্থাৎ নিরামিষাশী হিটলারের সঙ্গে নিরামিষ ঘাট খেয়ে হুজুরের সম্মুখে ধর্মরক্ষা করে আপন ঘরে গিয়ে খেতেন তিনখানা শুয়ারের কাটলেস্ (কটলেট)!
খ্রিস্টান যায় জেরুজালেমে যিশুর কবর দেখতে, মুসলমান যায় পীরের দর্গা জিয়ারত করতে, বৌদ্ধ যায় তথাগতের অস্থিদন্তের আধার দেখতে (হিন্দুর ওবিষয়ে কিঞ্চিৎ অসুবিধা, কারণ সে মৃতদেহ দাহ করে) এসব তীর্থযাত্রায় প্রচুর পুণ্য।
এদের সবাই হার মানে রুশের কাছে। হাজার হাজার নরনারী নাকি দুরন্ত শীতে রেড স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে, ঘণ্টার পর ঘন্টা লেনিন-স্তালিনের মামি দেখবে বলে। আর মামি যে কাস্কের্ট। বা গোরস্তানের চেয়ে হৃদয়-মনের ওপর বেশি দাগ কাটবে তাতে কী সন্দেহ
এ বিষয়ে কমুনিস্টরা আমাদের হারিয়েছেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু অন্তত আরেকটি রিচুয়ালে তারা সর্বাগ্রণী :
ক্যাথলিক যারা তারা পাদ্রির সামনে আপন পাপ স্বীকার করে (কনফেশন), জৈন-বৌদ্ধ বর্ষশেষের পর্যষণে আপন আপন দুষ্কৃতি স্বীকার করে, মুসলমান সর্বজনসমক্ষে আল্লার কাছে তওবা করে ক্ষমা চায়।
রুশদেশের দেশদ্রোহীরা ধরা পড়লে এই কনফেশনের ধুন্দুমার লেগে যায়। কে কত বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাই নিয়ে লেগে যায় কাড়াকাড়ি। সবাই সমস্বরে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে চিৎকার করে, না না, আমি সবচেয়ে পাপী, আমি সর্বনিকৃষ্ট।
এ সম্বন্ধে একটা চুটকিলও হালে শুনেছি, রুশ প্রত্যাগত জনৈক বাঙালির কাছ থেকে।
আর পাঁচটা দেশের মতো রুশও পণ্ডিতগোষ্ঠী পাঠাল মিশরে প্রত্নতত্ত্বের চর্চা করতে। খুঁড়তে খুঁড়তে তারা একটি মামি পেয়ে গেলেন। খুশ্চফ খুশি হয়ে শুধালেন, ওটা কত দিনের পুরনো? পণ্ডিতেরা নিরুত্তর। খ্রশ্চফ শাসালেন, চব্বিশ ঘণ্টা ম্যাদ। উত্তর না দিতে পারলে সাইবেরিয়া। পরদিন সব পণ্ডিত ম্যাদ-শেষের পূর্বেই হাজির। চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। খ্রশ্চফ বললেন, হু? পণ্ডিতেরা সমস্বরে : চার হাজার দু-শো বছর। বেশ, কী করে জানলে? পণ্ডিতেরা ঐক্যতানে, মামি স্বীকার করেছে (কনফেশন)।
***
এরকম প্রচুর উদাহরণ আমি টায়-টায়, দফে দফে, প্রোফর্মা দিতে পারি। কিন্তু রচনাটি ইতোমধ্যেই আমার সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় বেসামাল হয়ে গিয়েছে।
সর্বশেষে নিবেদন :
হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যেন মনে না করেন, আমি ওইসব ধর্মের কর্মকাণ্ড (রিচুয়ালের) এবং নাৎসি-কম্যুনিস্টদের কর্মকাণ্ড সব কটাকে একই মূল্য দিই। কম্যুনিস্টরাও যেন বিরক্ত না হন যে আমি তাদের বিজ্ঞানসম্মত ব্ল্যাশনাল কর্মকাণ্ড ধর্মের আফিঙে মাখানো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে তাদের প্রতি অবিচার করেছি। আমি শুধু প্যারালেল দেখিয়েছি।
এস্থলে সেই ফরাসি প্রবাদবাক্য স্মরণ করি : প্ল সা শাঁজ, পু সে লা মেম সোজ। যতই সে বদলায়, ততই তাকে আগের মতো দেখায়।
কিন্তু এহ বাহ্য।
ধর্ম তবে কী?