রাজহংসের মরণগীতি

রাজহংসের মরণগীতি

০১.

জর্মনির চরম শত্রু ফ্রান্সের একাধিক লেখক সবিস্ময়ে স্বীকার করেছেন যে, এমন দিন আসবে, যেদিন রণবিদ্যার চর্চাশীল ব্যক্তি মাত্রেই যে রকম ফ্রিডরিক দি গ্রেট ও নেপোলিয়নের রণকলা অক্ষরে অক্ষরে অধ্যয়ন করে থাকেন, ঠিক তেমনি হিটলারের রণকলাও অধ্যয়ন করবেন।

আমরা রণচর্চা করি না; তৎসত্ত্বেও আমাদের মনেও এ সম্বন্ধে কতকগুলি প্রশ্নের উদয় হয়। যেমন, যে হিটলার দু বছরের ভেতর ইংলিশ চ্যানেল থেকে প্রায় মস্কো অবধি রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি যখন তিন বছরের ভেতর তার মাটির তলার আশ্রয় (বুঙ্কার) থেকে খবর পেলেন যে, বিজয়ী রুশ-সেনা সে আশ্রয় থেকে পাঁচশো গজ দূরে আর চব্বিশ ঘণ্টার ভেতরই, রক্তলোলুপ কেশরীর মতো তাঁর বুঙ্কারে এসে প্রবেশ করবে, তখন তাঁর মনে কী চিন্তার উদয় হয়েছিল? সঞ্জয় যখন বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে খবর দিলেন যে দুর্যোধনের পরাজয় ঘটেছে, তখন কি তাঁর ব্যালাডের (আমার বিশ্বাস, চারণদের মুখে গীত এই ব্যালাডকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে বিরাট মহাভারত রচিত হয়) ধুয়ো ছিল, যখন অমুকটা ঘটল, তখন আমরা জয়াশা করিনি, যখন অমুকটা ঘটল, তখনও আমরা জয়াশা করিনি, এবং মূল ধুয়ে ছিল, আমরা জয়াশা করিনি তখনও আমরা জয়াশা করিনি। হিটলারের বেলাও কি তাই ঘটেছিল? কারণ তাঁর পরাজয়ও তো একদিনে হয়নি– তিনি কি দিনে দিনে বুঝতে পেরেছিলেন, এখন আর জয়াশা নেই, এখন আর জয়াশা নেই, তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দুরাশা পোষণ করে কোনও অলৌকিক পরিবর্তনের আশা করেছিলেন– দুর্যোধন যেরকম ঊরুভঙ্গের পরও জয়াশা করে অশ্বত্থামাকে পঞ্চপাণ্ডবের গোপন নিধনের জন্য পাঠিয়েছিলেন?

আরও ছোটখাটো কত প্রশ্নই-না মনে উদয় হয়।

যেমন মনে করুন, হিটলার যখন পোল্যান্ড থেকে ফ্রান্স, ওদিকে নরওয়ে, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, বেলজিয়াম জয় করে ফেলেছেন, বাংলা কথায় একমাত্র রুশ ছাড়া এমন কোনও শক্তি ইউরোপে আর নেই যে, তার মোকাবেলা করতে পারে এবং পরাজিত ইংল্যান্ড আপন দ্বীপে ফিরে গিয়ে এমনি ক্লান্ত যে, জখমগুলো পর্যন্ত চাটতে পারছে না, তখন হিটলার ইংল্যান্ড অভিযানে বেরোলেন না কেন? স্বয়ং চার্চিল স্বীকার করেছেন, তখন হিটলার সে অভিযান করলে ইংল্যান্ড অনায়াসে জয় করতে পারতেন।

এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন বহু ঐতিহাসিক, বহু জঙ্গিলাট, বহু কূটনীতিবিদ, এমনকি, হিটলারের বহু সাঙ্গোপাঙ্গ। তাঁর সেনাপতিরা পর্যন্ত এ সম্বন্ধে হাজার হাজার না হোক, শত শত পুস্তক লিখেছেন।

কিন্তু আমাদের মনে তবু কৌতূহল জাগে, স্বয়ং হিটলার কী ভেবেছিলেন? অবশ্য তাঁর উত্তরই যে শুদ্ধ হবে, এমন কোনও কথা নেই। আমাদের বন্ধু-বান্ধব যখন পরীক্ষায় ফেল করবার পর দফে দফে ফেল মারার কারণ দর্শায়, তখন আমাদেরও দু-একজনা তার অনুপস্থিতিতে আমাদের প্রকৃত কারণ দর্শিয়ে দেয়, আর তখন আমরা অনেক স্থলেই এদেরই বিশ্বাস করি বেশি– সর্বস্থলে না হোক, অনেক স্থলেই স্পেকটেটর সিজ মোর অব দি গেম্‌।

তবু মনে বড়ই কৌতূহল হয়, নেপোলিয়ান কী ভেবেছিলেন, হিটলার কী ভেবেছিলেন?

অধুনা তারই খানিকটে উত্তর মিলেছে।

 ১৯৪১-৪২-এর শীতে হিটলার গৌরবের মধ্যগগনে। ফ্রান্স পদানত তিনি মস্কো-লেনিনগ্রাদের দরজায় সদম্ভে ধাক্কা দিচ্ছেন। আত্মপ্রসাদে পরিপূর্ণ হিটলার তখন লাঞ্চ ডিনার খাওয়ার পর সমবেত ইয়ারবক্সিদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন– জর্মন মনের ওপর বহিরাগত খ্রিস্টধর্মের প্রভাব, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে নেহেরু না সুভাষ, বর্ণসঙ্করের কুফল, কুকুর মনিবের খাটের নিচে শোবে না অন্য কোথাও, বস্তুত আকাশ-পাতালে হেন বস্তু নেই, যা নিয়ে তিনি তখন আলোচনা করেননি। আলোচনা বলে ভুল করলুম– আসলে ইয়ার-দোস্ত দু-একটি প্রশ্ন জিগ্যেস আরম্ভ করতে না করতেই হিটলারের পঞ্চমুখ পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী শোনাতে আরম্ভ করত। এ যেন নবগীতা শুধু আমাদের গীতাতে প্রশ্ন করেন একা অর্জুন, এখানে অর্জুন একাধিক।

হিটলারের সেক্রেটারি মার্টিন বরমান তখন হিটলারের অনুমতি নিয়ে ঘরের এক কোণে স্টেনো রাখতে আরম্ভ করলেন। তার টাইপ করা কাগজের উপর তখন বরমান তাঁর মন্তব্য ও মেরামতি করে দিলে পর শেষ সরকারি কপি তৈরি হত।

হিটলার যুদ্ধে জয়ী হলে পর এগুলো কীভাবে প্রকাশিত হত, আদৌ প্রকাশিত হত কি না, সে কথা বলা কঠিন। যুদ্ধের পর যখন চতুর্দিকে লুটতরাজ, তখন এ হাত সে হাত ঘুরে শেষটায় সে পাণ্ডুলিপি প্রথম জৰ্মনে ও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদে হিটলারজ টেবিল ট নামে প্রকাশিত হয়। প্রায় সাতশো পাতার বই।

হিটলার মাইন কামফ কিংবা বক্তৃতায় তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন বিশ্বজনের সম্মুখে সরকারিভাবে, কিন্তু এই টেবিল-ট ঘরোয়া। এতে হিটলার-মনের অন্য একটা দিক দেখতে পাওয়া যায়।

হিটলারের অনুচরবর্গ বলেন, যখন পরাজয় আরম্ভ হল, তখন হিটলার যে-কোনও কারণেই হোক, তার জেনারেল, কর্নেল, ইয়ার-বক্সিদের সঙ্গে খানা-খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে খেতে লাগলেন, নিরামিষ রান্নায় সিদ্ধহস্তা তাঁর পাচিকা এবং তার মহিলা টাইপিস্টদের সঙ্গে। তাই ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত টেবিল-ট প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল।

১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারি মাসেই হিটলারের কাছে না থোক, তার শক্ৰমিত্র বহুজনের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আর জয়াশা নেই। তার সেক্রেটারি বরমান অন্তত সে সম্ভাবনাটার আতঙ্ক ভালোভাবেই অনুভব করেছিলেন। খুব সম্ভব, তাঁরই অনুরোধে হিটলার ফের টেবিল-ট দিলেন। কিন্তু এগুলোকে আর ট বলা চলে না। তার শেষ বাণী, তার শেষ টেস্টামেন্ট বললেই ভালো বলা হয়।

এগুলোও এ-হাত সে-হাত ঘুরে ঘুরে প্রথম প্রকাশিত হয় ফ্রান্সে ১৯৫৯-এ; ইংরেজিতে ১৯৬১-তে। এ-দেশে এসে পৌচেছে দিন কয়েক হল।

চটি বই, কিন্তু তা হলেও এর ভেতর মানব-মনের অদ্ভুত দ্বন্দ্ব, জয়াশা-নিরাশা এবং সর্বশেষে আর্তকণ্ঠে বিশ্বজনের প্রতি অভিসম্পাতসহ ভবিষ্যদ্বাণী– এসবই রয়েছে কর্কশ হতে কর্কশতর ভাষায়।

তবে একথা ঠিক, আর কিছু না হোক, তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো প্রায় অক্ষরে অক্ষরে ফলছে!* [The Testament of Adolf Hitler, (February-April 1945). The Hitler-Borman Documents, Cassell, London, pp. 115.]

.

০২.

প্রথম প্রশ্ন ফ্রান্সের পরাজয়ের পর হিটলার সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ড আক্রমণ করলেন না কেন? পূর্বেই বলেছি, এ বিষয়ে নানা মুনি নানা মত দিয়েছেন : এবার হিটলারের মুখে শুনুন :

জুলাইয়ের (১৯৪০) শেষের দিকে, অর্থাৎ ফ্রান্সের পরাজয়ের এক মাস পরে আমি হৃদয়ঙ্গম করলুম, শান্তি আবার আমাদের মুঠোর বাইরে চলে গেল। তার কয়েক সপ্তাহ পরেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম যে, শরৎ-হেমন্তের ঝড়-ঝঞ্ঝার পূর্বে আমরা ব্রিটেন অভিযান করতে পারব না, কারণ আকাশ-যুদ্ধে আমরা সম্পূর্ণ বিজয়ী হতে পারিনি। তার সরল অর্থ, আমরা ভবিষ্যতেও আর কখনও ব্রিটেন অভিযানে সক্ষম হব না।

(টীকা : হিটলার এবং গ্যোরিঙের চাল ছিল, ইংল্যান্ডের উপর বেধড়ক বোমাবর্ষণ করলে ইংলিশ জঙ্গিবিমান আকাশে উঠবে জর্মন বোমারু বিমান নিধন করার জন্য। তখন সেগুলোকে বিনাশ করা হবে। ফলে আকাশে ইংল্যান্ডের আর কোনও আধিপত্য থাকবে না বলে তখন সহজেই সমুদ্রপথে ব্রিটেন অভিযান সম্ভবপর হবে। ইংরেজ এই চালটি বুঝতে পারে, বরঞ্চ বেধড়ক বোমার মার খেল, কিন্তু জঙ্গিবিমান আকাশে তুলল অত্যল্পই বাকিগুলো বাঁচিয়ে রাখল হিটলারের সমুদ্র অভিযানের জাহাজগুলোকে ঘায়েল করার জন্য।)

হিটলার পুনরায় অন্যত্র বলেছেন :

ইংল্যান্ড-অভিযান ও ফলে যুদ্ধ শেষ করে শান্তি স্থাপনের আশা ত্যাগ করেছিলুম। কারণ ইংল্যান্ডের মূর্খ নেতারা কিছুতেই ইউরোপে আমাদের একচ্ছত্রাধিপত্য স্বীকার করে নিত না যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে আমাদের সঙ্গে বৈরীভাবাপন্ন শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রও (অর্থাৎ রুশ) বেঁচে থাকত। যুদ্ধের তা হলে শেষই হত না– চলতেই থাকত। এবং ইংরেজের পিছনে মার্কিন এসে জুটে তার কর্মতৎপরতা বাড়িয়ে তুলত। মার্কিনের আবার যুদ্ধ করার জন্য সব বলই প্রচুর, যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণে তারাও আমাদেরই মতো প্রচুর এগিয়ে যেত; ইংল্যান্ড থেকে কন্টিনেন্ট দূরে নয় (অর্থাৎ মার্কিন-ইংরেজ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তারাও কন্টিনেন্টে নেমে আমাদের আক্রমণ করতে পারবে)- এ সমস্ত কারণে আমাদের পক্ষে ইংল্যান্ড অভিযান করে এক সুদীর্ঘকালব্যাপী লড়াইয়ের দয়ে মজে যাওয়া মোটেই সমীচীন হত না। কারণ স্পষ্ট দেখতে পারছ, সময়কাল, ক্রমেই আমাদের বিরুদ্ধপক্ষের সাহায্য করে যেত বেশি। ইংল্যান্ডের শেষ আশা ছিল রুশ– কারণ রুশ আমাদের মতো শক্তিশালী এবং তাকে খাড়া করানো আমাদের বিরুদ্ধে! এই রুশকে ঘায়েল করতে পারলেই ইংরেজ বুঝত যে তার আর আশা নেই, এবার সন্ধি করতেই হবে।

হিটলার এস্থলে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন, কেন ইংল্যান্ড আক্রমণ না করে তিনি রুশ আক্রমণ করলেন।

এ যুক্তিগুলো কতখানি বাস্তব তার বিচার রণ-পণ্ডিতেরা করবেন। ঈষৎ অবান্তর হলেও অন্য একটি যুক্তির কথা এস্থলে উল্লেখ করি, কারণ সেটি জানা থাকলে ইতিহাস বুঝতে অনেকখানি সুবিধা হয়।

একাধিক রণ-পণ্ডিত বলেছেন, হিটলার এমন দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যার সঙ্গে সমুদ্রাভিযানের যোগসূত্র বা ঐতিহ্য ছিল না। অস্ট্রিয়াকে ইংরেজ, স্প্যানীয় বা আরবের মতো ম্যারিটিম নেশন বলা চলে না। তাই ইংল্যান্ড অভিযানের সবকিছু তৈরি করেও* [*যারা হিটলার-সখা ফটোগ্রাফার হমানের বই হিটলার উয়োজ মাই ফ্রেন্ড পড়েছেন তাঁরাই জানেন, ইংল্যান্ড অভিযানে প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হওয়ার পর কথা ছিল, এক বিশেষ সন্ধ্যায় রাত দশটায় হিটলার অভিযান আরম্ভের ফাইনাল অর্ডার দেবেন। হিটলার, হফমান ও অন্যান্য সাঙ্গোপাঙ্গের সঙ্গে রাত বারোটা অবধি গাল-গল্প করে শুতে গেলেন। কোনও অর্ডারই দিলেন না। অভিযান নাকচ হল।] হিটলার শেষ মুহূর্তে কিন্তু কিন্তু করে থেমে গেলেন।

অর্থাৎ জলাতঙ্ক না থাকলেও হিটলারের সমুদ্ৰাতঙ্ক ছিল– অন্তত সমুদ্রপ্রীতি যে ছিল না সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অবশ্য মানতে হবে এইটেই সর্বপ্রধান কারণ নয়।

পাঠান-মোগল বংশের রাজাদেরও হিটলারের অবস্থা ছিল। এরা এসেছিলেন ল্যান্ড-লকড় দেশ থেকে। সমুদ্রের সঙ্গে তাদের কণামাত্র সম্পর্ক ছিল না। আমার যতদূর জানা আছে, মোগলদের ভেতর প্রথম আকবরই গুজরাত জয় করে চাক্ষুষ সমুদ্রদর্শন করেন। আকবরনামার ইংরেজি অনুবাদক সেই সম্পর্কে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে, সমুদ্র আকবরের মনে কোনও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারেনি। তা-ও আকবর প্রভৃতি বাদশারা যদি সমুদ্রপারে কিংবা অদূরে রাজধানী করতেন তা হলেও না হয় কিছুটা হত। তারা থাকতেন আগ্রা-দিল্লিতে যেখানে সমুদ্রের লোনা হাওয়া পর্যন্ত পৌঁছায় না।

ফলে এঁদের বিপুল ঐশ্বর্য জনবল থাকা সত্ত্বেও আমাদের নৌবহর তৈরি হল না।

হোয়াট এ ট্র্যাজেডি! এঁরা যদি নৌবহর তৈরি করতেন, তবে পর্তুগিজ-ইংরেজ এদেশে যে একরত্তি পাত্তা পেত না তাই নয়, আমাদের পণ্যসম্ভার আমাদের জাহাজে করে দুনিয়ার বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়াত। আজ আমরা মার্কিন-ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দিতুম। এবং পরম পরিতাপের বিষয়, আজও আমাদের মন সমুদ্র-সচেতন নয়– রাজধানী সেই দিল্লিতে যে।

অথচ আমরা সবাই জানি, সমুদ্রযাত্রায় ভারতের খ্যাতি একদা ছিল।

সে দীর্ঘ কাহিনী তুলব না। মহাভারতের মাত্র সামান্য একটি কথার উল্লেখ করি। শান্তিপর্বে ভীষ্ম রাজ্যচর্চা সম্বন্ধে যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দেবার জন্য প্রজাপতিকৃত লক্ষ অধ্যায়যুক্ত এক বিরাট শাস্ত্রের উল্লেখ করে বলেছেন, ওই বিরাট শাস্ত্রে… নৌকা নিমজ্জনাদি দ্বারা নৌকার পথরোধ… সবিশেষ কীর্তিত হইয়াছে (শান্তিপর্ব)। অর্থাৎ কয়েক বছর পরে অ্যান্টনি ইডন সুয়েজ ক্যানালের মধ্যে জাহাজ ডুবিয়ে যেভাবে খালের মুখ বন্ধ করলেন। এ সংসারে নতুন কিছুই নয়।

নৌবহর বাবদে ভারতের তখনই সর্বশক্তি গেছে যখনই কেন্দ্রীয় সরকার নৌশক্তি সম্বন্ধে অজ্ঞ, কারণ তখন তারা বাঙলা এবং গুজরাত প্রদেশকে নৌবহর তৈরি করার জন্য অর্থ দিতেন না– এর মূল্য জানেন না বলে, সেকথা পূর্বেই বলেছি। অথচ ওই সময়ে, যেমন মনে পড়ে তিমুর অভিযানের পর আকবর-জাহাঙ্গীর পর্যন্ত বাঙলা-গুজরাত স্বাধীন। নৌবহরের মূল্য জানেন বলে গুজরাতের স্বাধীন সুলতান মাহমুদ বেগুড়া থেকে আরম্ভ করে শেষ সুলতান বাহাদুর শাহ্ পর্যন্ত সকলেই নৌবহর রেখেছেন এবং একাধিকবার নৌসংগ্রামে পর্তুগিজদের বেধড়ক মার মেরেছেন। গুজরাতের শেষ স্বাধীন বাদশা বাহাদুর শাহ্ মারা যান, তিনি যখন হুমায়ুন ও শের শা-র ভয়ে পর্তুগিজদের সঙ্গে সন্ধি করতে তাদের জাহাজে যান। পর্তুগিজদের দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে তিনি সমুদ্রে ঝাঁপ দেন– পর্তুগিজরা বৈঠার ঘায়ে তাঁকে খুন করে।

বাঙলাও যখন স্বাধীন তখন পর্তুগিজদের সঙ্গে লড়েছে। যদিও তারা সুন্দরবন অঞ্চল ছারখার করেছে, তবু বাঙলায় গোয়া দমন দিউ-র মতো রাজ্য স্থাপন করতে পারেনি।

আকবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত বাঙলা-গুজরাত আর্তকণ্ঠে বার বার চিৎকার করে কেন্দ্রের হুজুরদের জানিয়েছে, পর্তুগিজরা সর্বনাশ করছে। আমাদের পণ্যসম্ভার হারমাদদের ভয়ে বিদেশে রপ্তানি হতে পারছে না। বাধ্য হয়ে জলের দরে পর্তুগিজদের বেচে দিতে হচ্ছে। আমরা যখন স্বাধীন ছিলুম তখন আমাদের আপন টাকা দিয়ে আমরা নৌবহর গড়েছি। এখন কুল্লে টাকা চলে যায় কেন্দ্রে। দয়া করে টাকা দিন; নৌবহর গড়ি।

কিন্তু কে-বা শোনে কার কথা! হুজুররা হিটলারের চেয়ে অধম ল্যান্ড ল দেশের লোক, এবং এখন থাকেন দিল্লিতে। নৌবহরের মূল্য কী বুঝবেন?

ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষালাভ করি। আজও যদি কেন্দ্র বাঙলা দেশকে বাণিজ্য-নৌবহর তৈরি করবার জন্য বিশেষ মোটা টাকা না দেয়, তবে বুঝব ইতিহাস বৃথাই পড়ছি।

১৯৪১।

.

০৩.

হিটলার আত্মহত্যা করার একমাস পূর্ব পর্যন্ত বার বার করুণ আর্তনাদ করে বলেছেন, এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমি চাইনি, আমি চাইনি, আমি চাইনি। আমি চেয়েছিলুম জর্মনির জন্য তার বেঁচে থাকার মতো (লেবনুসরাউম) দুই বিঘে জমি। জমিটা আসবে চেকোশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড ও উক্রানিয়া থেকে। তাতে ইংল্যান্ডের কী, ফ্রান্সেরই-বা কী? আমি তো ফ্রান্স কিংবা তার উপনিবেশে হাত দিতে চাইনি। ইংরেজকেও শতবার বলেছি, তার বিশ্বজোড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিও কণামাত্র লোভ আমার নেই। রুশরা বর্বর, তারা বিশ্বশান্তির শত্রু। তার পশ্চিমাঞ্চল দখল করে নিতে পারলে তার শক্তিক্ষয় হয়ে যাওয়ায় সে বিশ্বশান্তি নষ্ট করতে পারবে না; জর্মনরাও খেয়ে-পরে বাঁচবে, ফ্রান্সের উপনিবেশ বা ব্রিটেনের বিশ্বরাজ্যের দিকে হ্যাংলার মতো তাকাবে না।

কিন্তু ফরাসি-ইংরেজ চায় না, আমরা খেয়ে-পরে বাঁচি। তারা বোঝে না, রুশ বিশ্বশান্তির কত বড় দুশমন। তাই যুদ্ধ করল তারা। আমি যুদ্ধ করিনি।

এবং এই ফ্রান্স, ব্রিটেন ও মার্কিনের পিছনে রয়েছে বিশ্ব ইহুদিসম্প্রদায়। আমি যেদিন (জানুয়ারি ১৯৩৩) জর্মনির কর্ণধার হলুম সেইদিন থেকেই ইহুদিরা আমার ও জর্মানির বিনাশ চেষ্টায় তৎপর হয়ে উঠল। আমিও তাদের একাধিকবার স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলুম, তারা যদি জর্মনিকে নিধন করার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আহ্বান করে তবে আমি তাদের সমূলে নির্মূল করব। বেদরদ হৃদয়ের মানুষ যে-রকম ছারপোকা মারার সময় দয়া-মৈত্রীর কথা ভাবে না।

(ন্যুরনরবের্গ মকদ্দমায় গ্যোরিঙ, কাইটেল, রিবেট্রপ ও অধুনা আইষম্যান যখন বলেন ইহুদি-নিধন ইত্যাদি ব্যাপারে স্বয়ং হিটলার সম্পূর্ণ স্বাধীন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, তখন তারা কণামাত্র অতিরঞ্জন করেননি)।

যুদ্ধের কারণ সম্বন্ধে হিটলারের এইটেই মোটামুটি বক্তব্য।

দুনিয়ার কুল্লে অশান্তি, বিশ্ব-জোড়া লড়াই এ সবকিছুর জন্য একমাত্র ইহুদি সম্প্রদায়ই দায়ী–একথা একমাত্র অত্যন্ত গোঁড়া নাৎসি ভিন্ন কেউ স্বীকার করবে না, (অবশ্য আরবরা প্যালেস্টাইন হারিয়ে যাওয়ার ফলে করতে পারে, কিন্তু তাদের সরকারও ইহুদিদের আপন ভিন্ন ভিন্ন আরব রাষ্ট্র থেকে ব্যাপকভাবে তাড়াবার চেষ্টা করেনি– নিধন করার তো কথাই ওঠে না) কিন্তু আমাদের মনে তবু প্রশ্ন জাগে, সত্যই ইহুদিরা কতখানি শক্তি ধরে, বিশ্বযুদ্ধের জন্য তারা কতখানি দায়ী? আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস এর সদুত্তর কেউ কখনও পাবে না– উপস্থিত শুধু এইটুকু বলতে পারি সুদ্ধমাত্র টাকার জোরে প্যালেস্টাইনের মতো একটা রাজ্যস্থাপনা করা ইহুদি ভিন্ন আর কেউ কখনও করতে পারেনি।

এখানে আরেকটি অপেক্ষাকৃত সামান্য ব্যাপারের উল্লেখ করি।

সকলেরই বিশ্বাস ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুনিকে ফরাসি-ইংরেজ যখন অকাতর চিত্তে চেকোশ্লোভাকিয়ার অংশবিশেষ হিটলারের হাতে দেন, তখন এদের মানমর্যাদা উচ্ছন্ন যায়, এবং হিটলারের পরিপূর্ণ বিজয় ও বিশ্বজোড়া আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ হয়। এই জয়ে গোটা জর্মনির জনসাধারণ তখন এমনি উল্লসিত, হিটলারের জয়গানে এমনি মুখরিত যে জর্মনির ভিতরে যেসব জর্মন হিটলারের পতনের গোপন ষড়যন্ত্র করছিলেন তারা পর্যন্ত নিরাশ হয়ে তাদের চক্রান্ত কিছুদিনের জন্য মুলতবি রাখেন।

এই ম্যুনিক-ব্যাপারে হিটলারের মত কী?

 তিনি খাপ্পা হয়ে বলেছেন :

 সেই কট্টর ক্যাপিটালিস্ট বুর্জুয়া চেম্বারলিন যখন তার ভণ্ডামির ছাতাখানা নিয়ে সর্ব তকলিফ বরদাস্ত করে সেই সুদূর বের্গহফে (হিটলারের নিবাস) হিটলারের মতো হঠাৎ-নবাবের (আপস্টার্ট) সঙ্গে পরামর্শ করতে এল, তখন সে বিলক্ষণ জানত যে তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বিরুদ্ধে নির্মম যুদ্ধ চালানো। আমার সন্দেহ মোচনের জন্য সে তখন যা খুশি তাই বলবার জন্য তৈরি। বের্গহফে আসার তখন তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, কোনও গতিকে সময় পাওয়া (অর্থাৎ যুদ্ধটা মুলতবি করা)। আমাদের তখন উচিত ছিল ১৯৩৮-এই যুদ্ধ আরম্ভ করে দেওয়া। কিন্তু তারা (চেম্বারলেন সম্প্রদায়)– সেই নিবীর্য কাপুরুষের দল– আমরা তখন যা চাইলুম তাই দিতে লাগল। এ অবস্থায় গায়ে পড়ে যুদ্ধ আরম্ভ করা যায় কী প্রকারে (অর্থাৎ জর্মনির জনসাধারণ বলত ইংরেজ-ফরাসি যখন আমাদের সর্ব খাই-ই মিটিয়ে দিচ্ছে তখন আমরা খামকা লড়াই করতে যাব কেন?)? তাই আমরা মুনিকে অতি সহজ ও দ্রুত লড়াই জেতার সুযোগ হারালুম। যদিও আমরা তখন যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলুম না, তবু শক্রর চেয়ে বেশি প্রতি আমাদের ছিল। ১৯৩৮-এর সেপ্টেম্বরই আমাদের পক্ষে প্রশস্ততম সময় ছিল।

মুসসোলিনির মধ্যস্থতায় যে মনিক পর্ব সমাধান হয়েছিল সে-কথার উল্লেখ হিটলার করেননি। এস্থলে আরেকটি কথা স্মরণ রাখা কর্তব্য–১৯৩৯-এ হিটলার পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধারম্ভের পূর্বে বলেন, আশা করি এবার আবার হঠাৎ কোনও বদমায়েশ (শুয়াইনহু) মুনিকের মতো শেষ মুহূর্তে এসে সবকিছু-না ভণ্ডুল করে দেয়।

এবারে শেষ প্রশ্ন।

যুদ্ধ হারার জন্য তিনি কাকে দায়ী করলেন?

ইতোপূর্বেই আমাদের জানা ছিল, রবের্গের মকদ্দমার সময় যে-সব দলিল-পত্র পেশ করা হয় তাতে হিটলারের উইলটিও ছিল। এ উইলের সত্যতা সম্বন্ধে শত্রু-মিত্র কেউই কোনও প্রকারের সন্দেহ প্রকাশ করেননি। এটি তিনি তৈরি করেন আত্মহত্যা করার কয়েক ঘন্টা পূর্বে। জর্মনির জনসাধারণের উদ্দেশে এটি লিখিত।

এ উইলে হিটলার নৌসেনার প্রশংসা করেছেন (বস্তুত তিনি মৃত্যুর পূর্বে নৌবহরের বড়কর্তাকেই তাঁর পদে বসিয়ে যাবার জন্য অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, এবং সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন নাকি বড়কর্তা স্বয়ং), যে বিমানবহরের অকৃতকার্যতার জন্য অন্তত অংশত তাঁকে পরাজয় মানতে হল তারও প্রশংসা করেছেন এবং স্পষ্ট ভাষায় নিন্দা করেছেন তার ব্লিৎসক্রিগ করনেওলা ল্যান্ড-আর্মির জেনারেল ফিল্ড-মার্শালদের। সাধারণ-সৈনিকের উচ্চপ্রশংসা তিনি করেছেন, কিন্তু তাঁর সর্বক্রোধ আর্মি অফিসারদের ওপর।

তারাই তার সর্বনাশ করেছে। তারা তার হুকুম অমান্য করেছে। তারা প্রতিক্ষণে পরাজয় মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়েছে। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পদে পদে সপ্রমাণ করেছে, তারা যেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়ছে। অর্থাৎ নতুন যুগে নতুন লড়াইয়ে যে নতুন কায়দায় লড়তে হবে সেটা তারা আদপেই বুঝতে পারেনি।

হিটলারের যদি সুকুমার রায় পড়া থাকত তবে নিশ্চয়ই বলতেন, এ যেন ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা। সোজা বাংলায়, জাদরেলরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছায়ার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছেন!

তা হলে প্রশ্ন : পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে সম্পূর্ণ জয় করে মস্কোর চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল কারা? ওই জেনারেলরাই তো?

তবে?

১৯৫১।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *