নানাপ্রশ্ন

নানাপ্রশ্ন

যতই বয়স বাড়ছে, কোথায় না মনের ভিতর যেসব প্রশ্ন জাগে তার সংখ্যা কমবে, উল্টো তার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এই তো কয়েকদিন পূর্বে বাঙলায় লেখা কয়েকখানি মুসলমানি কেতাব বা পুঁথি হাতে পড়ল। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর কাব্য। বিষয়বস্তু ফারসি, যদিও নায়ক-নায়িকা কোনও কোনও মূল কাব্যে আরবদেশের– ফারসির মাধ্যমে বাঙলা দেশে এসে পৌঁছেছেন। সঙ্গে এনেছেন ইরানি মেজাজ। সেটা মধুর,– আরবি কাব্যের মূল সুর দার্চ।

বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়, যেসব কবি বাঙলায় এসব কাব্য স্বাধীন অনুবাদ করেছেন এঁদের অনেকেই উত্তম ফারসি জানতেন। কেউ কেউ ভালো আরবি ও সংস্কৃত জানতেন, এবং প্রায় সকলেই তখনকার দিনের প্রচলিত বাঙলা কাব্যের ভাষা জানতেন। ছন্দও হয় পয়ার নয় ত্রিপদী। এমনকি কবিদের একজন পয়ার লিখতে লিখতে এমনই আনন্দে নিমগ্ন হয়ে গেছেন। যে, একঘেয়েমি কাটাবার জন্য যে মাঝে মাঝে ত্রিপদী ভি আমদানি করতে হয় সে বাৎ বেবাক ভুলে গেছেন এবং কাব্য সমাপ্তির পর যখন কানে জল গেল তখন কুছ কুছু ত্রিপদী-ভি* [*ইনি অবশ্য অনেক পরের কবি।– সুকুমার সেন, ইসলামি বাংলা সাহিত্য, পৃ. ১১০, ১১১ পশ্য।]-বগৃহার দিয়ে কবিধর্মের ইমান দুরস্ত রাখলেন।

তাই প্রশ্ন, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে যারা বাঙলা কাব্যে বিদেশি সুর আনলেন, তারা উত্তম ফারসি এবং আরবি শব্দ বাঙলাতে আমদানি করলেন না কেন?

দর্শনের অনুশাসনে, যে প্রশ্নের উত্তর সম্বন্ধে তোমার কণামাত্র ধারণা নেই, যে উত্তর কোন দিক দিয়ে আসতে পারে না আসতে পারে সে সম্বন্ধে তুমি কণামাত্র কল্পনা করতে পার না, সে প্রশ্ন প্রশ্নই নয়, সে প্রশ্ন বাতিল, ইনভ্যালিড। তাই আমার মনে যে কাল্পনিক উত্তর এসেছে সে দুটির ইঙ্গিত দিই।

প্রবন্ধান্তরে বলেছি, বাঙলা দেশ চিরকালই বিদ্রোহী। এ দেশ মুসলমান আগমনের পর থেকে সুভাষ বসু পর্যন্ত একমাত্র জাহাঙ্গীর থেকে আওরঙ্গজেবের আমলে কেন্দ্রের অর্থাৎ দিল্লি-আগ্রার হুকুম তামিল করেছে। বস্তৃত পাঠান-মোগল প্রায় সব বাদশাকেই এ দেশে আসতে হয়েছে বিদ্রোহ দমন করতে আমরা অবশ্য বলব, আমাদের স্বাধীনতা হরণ করতে। বিশেষত বাঙলার স্বাধীন পাঠান রাজাদের আমলের তো কথাই নেই। তখন বাঙলা দেশ চীনের সঙ্গে রাজদূত বিনিময় করছে, প্রতিবেশী জৌনপুরি রাজাদের সঙ্গে কখনও লড়াই করছে, কখনও আশ্রয় দিচ্ছে, এবং জনশ্রুতি যে, বাঙলা দেশে স্বাধীন রাজা ইরানের কবি হাফিজকে বিস্তর সওগাত পাঠিয়ে দাওয়াত করেছেন এদেশে। অবশ্য নৌপথে।

এখানেই হয়তো রহস্যদ্বারের গুপ্ত কুঞ্চিকা।

স্থলপথে ইরান যাবার কথাই ওঠে না। মাঝখানে জৌনপুর, দিল্লি, লাহোর, কান্দাহার, হিরাত কত না স্বাধীন রাজত্ব! একে অন্যের সঙ্গে লড়ছে হরবকৎ। নিরীহ কবি, চিত্রকর, গায়কের তো কথাই ওঠে না, ইরান-তুরানের ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধারা পর্যন্ত মেরে কেটে হয়তো দিল্লি অবধি দু-একজন এসে পৌঁছেছে, দিল্লি দূর অস্তৃ বরঞ্চ দিল্লি নজ্বদিক্‌ মিশওদ (দিল্লি কাছে এল), কিন্তু বাঙলা দূর অস্তৃ শুধুই নয় দূরান্তর অন্ত।

এদিকে বাঙলার স্বাধীন সুলতানদের মাতৃভাষা ফারসি নয়, ফারসি তাদের কোর্ট লেনগুইজ মাত্র এমনকি স্টেট লেনগুইজও নয়– যত দিন যাচ্ছে ততই তারা সে ভাষা ভুলে যাচ্ছেন, ওদিকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে বিদেশাগত নতুন কবি নতুন লেখক সে ভাণ্ডারের মাল নিয়ে আসছেন না, রাজদরবারেই যখন ফারসি দিনের পর দিন শুকিয়ে আসছে তখন জনসাধারণে সে ভাষা প্রচলিত ও প্রসারিত হবে কী করে?

দু-চারজন পণ্ডিতদের কথা সবসময়ই আলাদা। রামমোহন হিব্রু জানতেন, হরিনাথ দে না জানি কটা বিদেশি ভাষা সেসব দেশে না গিয়ে এমনকি সেসব ভাষার পণ্ডিতদের সংস্পর্শে না এসেও শিখতে পেরেছিলেন। অবশ্য স্বাধীন বাঙলায় তার চেয়ে অনেক বেশি আলিম-ফাজিল ছিলেন কিন্তু এদের প্রায় সকলেরই ছিল কাফিরদের ভাষা বাঙলার প্রতি গভীর অশ্রদ্ধা (ওই যুগের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদেরও বাঙলার প্রতি বিশেষ কোনও শ্রদ্ধা ছিল না)। এঁরা বাঙলায় কাব্য এমনকি ধর্মালোচনা করতেও কড়া বারণ করতেন। কিন্তু যেখানে স্টেটের খানিকটা উৎসাহ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে ওটাকে কিছুটা উপেক্ষা করা যায়। তাই দৌলত কাজী, আলাওল, সৈয়দ সুলতান ইত্যাদি কবিদের আবির্ভাব*। [সৈয়দরা নিজেদের মহাপুরুষ মুহম্মদের বংশধর বলে দাবি করেন। মুসলমান ধর্মে যদিও সৈয়দদের বিশেষ কোনও সম্মান দেখাবার নির্দেশ নেই তবু কার্যত এঁরা অনেকটা ব্রাহ্মণদের সম্মান পান। তার কারণ অবশ্য অংশত এই যে, এদের ভিতরই ইসলামি শাস্ত্রচর্চার প্রচলন ছিল বেশি। এবং ঠিক যেরকম ব্রাহ্মণরাই শাস্ত্র বানায়, এবং শাস্ত্র ভাঙে তারাই রামমোহন বিদ্যাসাগরের কথা স্মরণ করুন– ঠিক সেই রকম ধর্ম, সমাজসংস্কার, সাহিত্য-সৃষ্টিতেও সৈয়দের ভাঙা-গড়ার সাহস বেশি। হিন্দুর বৈষ্ণব পদাবলি রচনায় যে মুসলমান কবি সম্মানের সর্বোচ্চ আসন পেয়েছেন তাঁর নাম সৈয়দ মোর্তুজা।] পূর্বেই বলেছি এঁরা ফারসি জানতেন উত্তম কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ তত্ত্বটিও বিলক্ষণ অবগত ছিলেন যে তাদের পাঠকমণ্ডলী, কি মুসলমান কি হিন্দু কেউই বিদেশি আরবি-ফারসির সঙ্গে সুপরিচিত নন। কাজেই আসল উদ্দেশ্য সমাধান হবে না আদপেই।

(এর সঙ্গে আজকের দিনের একটি তুলনা দিতে পারি। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে দেখি, কোনও পশ্চিমবঙ্গবাসী ঢাকার কোনও উটকো খবরের কাগজ থেকে আরবি-ফারসি মিশ্রিত বাঙলা উদ্ধৃত করে আতাঁরব ছাড়ছেন, এত বেশি আরবি-ফারসি শব্দ যদি ঢাকার লেখকরা ব্যবহার করেন তবে এক নতুন ভাষার উদ্ভব হবে এবং বঙ্কিম-রবির বাঙলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে। এঁরা যদি অনুগ্রহ করে ঢাকার নিত্যকার খবরের কাগজ পড়েন, লেখকদের সাহিত্য রচনা পড়েন তবে দেখতে পাবেন ঢাকা সেই বাঙলাই লিখেছেন কলকাতা যে বাঙলা লেখে–দু-চারটি আব্বা, আম্মা, ফজরের নামাজের কথা হচ্ছে না, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি আরবি-ফারসি শব্দ আলাল হুতোমে আছে এবং তার কারণ দৌলত কাজী, আলাওলের বেলায় যা হয়েছিল তা-ই। ঢাকার উত্তম ফারসি জাননেওয়ালা লেখকও বোঝেন যে তিনি ফারসি জানলে কী, তাঁর পাঠকের অধিকাংশই যে ফারসি জানেন না। এস্থলে অবশ্য মডার্ন কবিদের মতো যারা মনে করেন, যত দুর্বোধ্য লেখা যায় ততই সুবোধ পাঠক প্রশংসা করবে বেশি, তাঁদের কথা হচ্ছে না।)।

আকবরের আমলেই প্রথম অবস্থার পরিবর্তন আরম্ভ হয়। কিন্তু তার আগে আমার আরেকটি প্রশ্ন আছে।

ইংরেজি শব্দ যখন প্রথম বাঙলাতে ঢুকতে আরম্ভ করে তখন লেখা হয়েছিল লভ, কালেজ ইত্যাদি; আজ আমরা লিখি লাভ কলেজ। আজ আবার দেখতে পাই, স্যুটিং শুটিং, হাসপাতাল, হাসপাতাল একই শব্দ দুই বা তিন রকম লেখা হচ্ছে। তার ওপর জুটেছে এসে আরেক আপদ। ছেলে-ছোকরারা ফরাসি, জর্মন, ভাষাতে ওকিব-হাল হয়ে উঠেছে, পারি পারী এমনকি দু-আঁসলা প্যারি পর্যন্ত দেখা দিচ্ছে, প্যাসনে, পশনে আরও কত কী?

দৌলত কাজী ইত্যাদি লেখকগণ মাত্রাধিক আরবি-ফারসি শব্দ বে-এক্তেয়ারভাবে গ্রহণ করেননি সত্য কিন্তু কিছু পরিমাণে তো করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখন তারা আমাদেরই মতো এলোপাতাড়ি যার যা খুশি করেছিলেন, না কতকগুলো সুস্পষ্ট আইন বেঁধে নিয়ে সেগুলো যতদূর সম্ভব মানাবার চেষ্টা করেছিলেন?

যেমন মনে করুন এ যুগের মরমিয়া কবি হাসন রাজা গাইলেন–

মম আঁখি হৈতে পয়দা আসমান জমিন,
কানেতে করিল পয়দা মুসলমানী দিন।

এখানে দিন-কে যদি বাঙলা দিবস অর্থে নেওয়া হয় তবে ছত্রটির কোনও ব্যাখ্যা করা যায় না। আসলে শব্দটি আরবি দীন অর্থাৎ ধর্ম! অর্থ দাঁড়াল আমার কানে এসে মুসলমানি ধর্মের খবর পৌঁছিল বলে সে ধর্ম তার অস্তিত্ব পেল, যেরকম আমি যখন আঁখি মেলে চাইলুম তখনই দ্যুলোক ভূলোকের সৃষ্টি হল। কট্টর আদর্শবাদীর (আইডিয়ালিস্ট স্কুল) মতো হাসান রাজা বলেছেন, ত্রিলোকের চিন্ময় মৃন্ময় জগৎ তাদের অস্তিত্বের জন্য আমার চিত্ত ও পঞ্চেন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করছে। আমি না থাকলে এসবের অস্তিত্ব নেই।

পুনরায় বলেছেন–

আমা হইতে আসমান জমিন, আমা হইতে সব
আমা হইতে ত্রিজগৎ, আমা হইতে রব।

এখানে রব আওয়াজ এই অর্থে নিলে সদর্থ হয় না। আরবি রব শব্দের অর্থ ভগবান। হাসন রাজা বলতে চান, আমার চৈতন্য যদি ভগবানের অস্তিত্বের কল্পনা না করত তবে তার স্বয়ম্ভু অস্তিত্বই হত না।

.

০২.

টকির কল্যাণে আমরা একটা জিনিস সম্বন্ধে সচেতন হয়েছি, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। টকি আসার পূর্বে আমরা ভাবতুম, আমরা রকে বসে বেহারি মুটের সঙ্গে যে উচ্চারণে হিন্দি কথা বলি, সেইটেই অতি বিশুদ্ধ হিন্দি উচ্চারণ, এবং ক্লাসে মাস্টারমশাই যে ইংরেজি উচ্চারণে টেনিসন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়েন সেই উচ্চারণই অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে চালু।

পৃথিবীর সর্ব আর্য ভাষা এমনকি সেমিতি ভাষাতেও একটি ধ্বনি কথায় কথায় আসে, কিন্তু বাঙলায় (এবং ওড়িয়া, আসামিতে) নেই। ইংরেজিতে the-র ই উচ্চারণ; ফরাসিতে le-র e; জর্মনের gegeben-এর তৃতীয় e উচ্চারণ; আরবি, ফারসি, হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠিতে কলমফ শব্দে ক এবং ল-এর মধ্যে ল এবং ম-এর মধ্যে যে উচ্চারণ আছে, সেটি বাঙলাতে নেই।

সোজা কথায় হিন্দির আমি বা আমরা বলতে যে হম শব্দটি আছে তার হ এবং ম-এর মাঝখানে যে ধ্বনিটি আছে সেটা আমাদের কেউ শুনেছেন অ এবং তাই লিখেছেন হ এবং অধিকাংশই শুনেছেন আ এবং তাই লিখেছেন হাম। এ যুগে সচেতন হয়ে আমাদের অনেকেই লিখতে আরম্ভ করেছেন হ্যম। (উপস্থিত আমরা এই ধ্বনিটির নাম দিলুম অস্পষ্ট স্বর)।

দৌলত কাজী, আলাওলের সামনে সর্বপ্রথম এই অস্পষ্ট ধ্বনি নিয়েই এল সমস্যা। কলমফ জবরদস্ত, মক্কা, মদিনা ধরনের অসংখ্য আরবি-ফারসি শব্দে আছে এই অস্পষ্ট ধ্বনিটি: এটাকে প্রকাশ করেন কোন চিহ্ন দিয়ে? কলম, না কালাম, না কল্যম (আজকে পূর্বোল্লিখিত হ্যম-এর মতো)?

আলাওলরা অনেকেই সংস্কৃত জানতেন, এবং এটিও জানতেন যে সংস্কৃতে এ ধ্বনিটি আছে বটে, কিন্তু বাঙালি উচ্চারণ করে অ রূপে। যেমন সংস্কৃতে কমল শব্দের ক এবং ম-এর মাঝখানে আছে সেই অস্পষ্ট স্বর, কিন্তু বাঙালি সেই অস্পষ্ট ধ্বনির পরিবর্তে কমল উচ্চারণ করে অ দিয়ে, অর্থাৎ বাঙলা শব্দ ঘর উচ্চারণ করতে যে অ উচ্চারণ করি সেই অ দিয়ে।

তাই তাঁরা মনে মনে আন্দেশা করলেন, সংস্কৃতের কমল এবং আরবি-ফারসির কলমে যখন একই উচ্চারণ এবং এই ধ্বনি প্রকাশের সময় বাঙলায় কোনও পরিবর্তন না করাই ভালো। অবশ্য তারা কলমফ না লিখে কালাম লিখতে পারতেন (আজকে যে রকম কেউ কেউ হদিস না লিখে হাদিস লেখেন, বরকৎ না লিখে বারাক লেখেন) কিন্তু তা হলে বিপদ হত যে, দীর্ঘ আ-কার-যুক্ত কালাম নামক যে ভিন্ন শব্দ আছে সেটার অর্থ বাণী– (আবুল কালাম আজাদ-এর অর্থ বাণীর পিতা, যিনি স্বাধীন) সেটাতে এবং লেখনীতে (অর্থাৎ কলম-এ) যে পার্থক্য আছে সেটা আর লেখাতে দেখানো যেত না।

অবশ্য তাঁরা কালাম (কলমের জন্য, এবং কালাম বাণীর জন্য) লিখতে পারতেন কিন্তু সেটা করতে গেলে অন্যান্য নানা বিপদের সম্মুখীন হতে হয় এবং সে দীর্ঘ আলোচনার জন্য এ স্থলে স্থানাভাব।

এই আইন তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু বাঙালি কীভাবে অ এবং আ উচ্চারণের ভিতর পার্থক্য করে সে সম্বন্ধেও বিলক্ষণ সচেতন ছিলেন বলে একটি ব্যত্যয় তারা করে দিয়েছিলেন। আরবি-ফারসি শব্দের আদ্যক্ষরে আলিফ, আয়েন, বা হে থাকলে সেখানে আ ব্যবহার করেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। তাই অল্লা অহমদ না লিখে লিখেছেন আল্লা, আহমদ; অব্দুলের বদলে আব্দুল এবং হমিদের হসেনের পরিবর্তে হামিদ হাসেন।

দ্বিতীয় সমস্যা ছিল দীর্ঘ-হ্রস্ব নিয়ে। সংস্কৃত দিন এবং দীন উচ্চারণে, কুল এবং কূল উচ্চারণে আমরা কোনও পার্থক্য করি না, এমনকি সংস্কৃত পড়ার সময়ও না। তাই তাঁরা স্থির করলেন যে, বাঙলাতে আরবি-ফারসি শব্দ লেখার সময় তারা সব শব্দই হ্রস্ববর্ণ দিয়ে লিখবেন। কাজেই আরবি ধর্ম অর্থে দীন শব্দ যদিও দীর্ঘ উচ্চারণে আছে তবু তারা বাঙলাতে দিন-ই লিখলেন, এবং ঠিক সেইমতো নূর রসূল না লিখে নুর রসুল লিখলেন।

তৃতীয় সমস্যা, সংস্কৃতে শ, ষ, স-এর তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ। আমরা বাঙলাতে তিনটিকেই এক উচ্চারণ শ অর্থাৎ sh-এর মতো করে থাকি। শুধু সংযুক্তের বেলা এবং অন্যান্য কোনও কোনও স্থলে ইংরেজি s-এর উচ্চারণ, অর্থাৎ খাঁটি সংস্কৃত স-এর উচ্চারণ করে থাকি। মস্তক, পুস্তক, আস্তে, শ্রাবণ, প্রশ্ন ইত্যাদিতে আমরা শ উচ্চারণ না করে স, অর্থাৎ sh না করে s করে থাকি। আরবি-ফারসিতে আছে চার রকমের ওই ধরনের উচ্চারণ। মুসলমান আদি-লেখকেরা বাঙলা উচ্চারণপদ্ধতি মেনে নিয়ে একটি স দিয়েই সব কারবার চালাবার চেষ্টা করেছেন। তবে পুব বাঙলায় ছ অক্ষর স-এর মতো উচ্চারিত হয় বলে মাঝে মাঝে (পরবর্তী যুগে এবং আধুনিককালে আকছারই) ছ এসে স-এর স্থান নিয়েছে।

এ আলোচনার সর্বশেষে কিন্তু নির্ভয়ে একটি কথা বলা যেতে পারে। মুসলমান আদি-লেখকেরা বাঙলা উচ্চারণকে পরিপূর্ণ সম্মান দিয়ে তারই রীতিনীতি মেনে নিয়েছিলেন। উদ্ভট বিদকুটে বানান লিখে নতুন নতুন ধ্বনি আমদানির বন্ধ্যাগমন করেননি। আরবি-ফারসি শব্দের বাঙলা বানানে প্রথম ভূতের নৃত্য আরম্ভ হল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন ১৯৩৬ সালে বাঙলা বানান নিয়ন্ত্রণ ও সরল করতে চাইলেন। কিন্তু সে আলোচনা অতিশয় দীর্ঘ হয়ে পড়বে, আমার জ্ঞানও অতিশয় সীমাবদ্ধ এবং তদুপরি আমার বিলক্ষণ জানা আছে, এ আলোচনায় অধিকাংশ পাঠকেরই কোনও উৎসাহ নেই। তবু যে আমি করছি, তার কারণ, বাঙলা বানানের অরাজকতার মাঝখানে একথাও সত্য যে বাঙলার একাধিক তরুণ নানা ভাষার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ফলে নানা শব্দ ও ধ্বনির প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। তাঁরা যদি এসব বিষয়ে গবেষণা করেন তবে আমার নানা প্রশ্নের কিছুটা উত্তর আমি হয়তো পাব।

এটা অবশ্য একেবারে সম্পূর্ণ নতুন নয়। গত শতাব্দীর শেষের দিকে বানানের অরাজকতা দূর করার জন্য সাহিত্য-পরিষদ(?) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে(?) অনুরোধ করেন, তিনি ওই সম্বন্ধে নির্দেশ দেন। আমার যতদূর জানা আছে, তিনি সে কার্য শেষ করে উঠতে পারেননি। আমার এ মন্তব্যে ভুল থাকতে পারে, কারণ সমস্ত জিনিসটা আমার আবছা-আবছা মনে আছে।

শেষ প্রশ্ন :

বাঙলা বাক্যগঠন, পদবিন্যাস অর্থাৎ সিনটেক এল কার অনুকরণে?

ফারসিতে বলি, চুন (যখন) পাদশা (বাদশা) মরা (আমাকে) দীদ (দেখলেন) উনহা (উনি) গুফত (বললেন) তু (তুই) কুজা (কোথায়) মীরওয়ী (যাচ্ছি)?

হুবহু একই সিনটেকস?

 ফারসি থেকে?

এবং সবশেষে প্রশ্ন :

আমরা যে গোটা গোটা বাঙলা লেখার সময় এবং সাইন-বোর্ডে বাঙলা অক্ষরের কোনও জায়গায় মোটা কোনও জায়গায় সরু করি সেটা এল কোথা থেকে? ফারসি লেখার কলমফ (আমাদের প্রাচীন লেখনী বা লোহার স্টিলো না–) ব্যবহার করেছিলুম বলে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *