ওয়ার এম
রাজা প্রজাগণকে কহিলেন,
দেখ, আমার রাজ্যে শত্রুভয় উপস্থিত হইয়াছে, কিন্তু ইহা ফলিত(১) বংশের(২) ন্যায় অচিরাৎ বিনষ্ট হইবে। শত্রুগণ আত্মবিনাশের নিমিত্তই আমার রাজ্যে আক্রমণ করিতে অভিলাষ করিতেছে। এক্ষণে এই ঘোরতর ভয়াবহ আপদ সমুপস্থিত হওয়াতে আমি তোমাদিগকে পরিত্রাণাৰ্থ অর্থ প্রার্থনা করিতেছি। উপস্থিত ভয় নিরাকৃত হইলে তোমাদিগকে পুনরায় প্রদান করিব।(৩) আর শত্রুগণ যদি বলপূর্বক তোমাদের ধন গ্রহণ করে, তাহা হইলে তোমরা কদাচ উহা পুনঃপ্রাপ্ত হইবে না। বিশেষত অরাতিগণ রাজ্য আক্রমণ করিলে তোমাদের পুত্রকলত্রাদিও বিনষ্ট হইবে। তাহা হইলে তোমাদের অর্থ আর কে ভোগ করিবে! তোমরা আমার পুত্রের ন্যায়, আমি তোমাদের সমৃদ্ধি দর্শনে যারপরনাই পরিতুষ্ট হইয়া এই আপকালে রাজ্যরক্ষার্থে তোমাদিগের নিকট অর্থ প্রার্থনা করিতেছি। তোমরা যথাশক্তি ধন উৎপাদনপূর্বক(৪) রাজ্যের উপদ্রব নিবারণ কর। বিপদকালে ধনকে প্রিয় বোধ করা অত্যন্ত অকর্তব্য।
রাজ্যপালন সম্পর্কে যুধিষ্ঠির কর্তৃক ভীষ্মকে প্রশ্ন করায় ভীষ্মের উত্তর। মহাভারত, শান্তিপর্ব, সপ্তাশীতিতম অধ্যায়। কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদে তৃতীয় খণ্ড, ৪৫০ পৃ.।
যুদ্ধ কাম্য নয়। একথা সত্য, যুদ্ধের সময় অনেকেই আপন শৌর্য, বীরত্ব দেখিয়ে আপন জাতকে গৌরবান্বিত করেন, কিন্তু শেষ বিচারে দেখা যায়, যুদ্ধে অমঙ্গলের অংশই বেশি।
তাই যখন কোনও জাতিকে বাধ্য হয়ে সংগ্রামে নামতে হয় আজ আমরা যে রকম নেমেছি– তখন তাকে খুব ভালো করে, অতিশয় সুস্থ মস্তিষ্কে আবেগ-উচ্ছ্বাসরহিত হৃদয়ে চিন্তা করে নিতে হয়, তার উদ্দেশ্য কী? সে কী চায়? একে বলা হয় ওয়ার এম্।
তার খানিকটা নির্ভর করে বিপক্ষের মতলবটা কী, সে কী চায় তার ওপর।
চীন প্রাচ্যদেশের জনবলে বলীয়ান মহারাষ্ট্র। কিন্তু জন থাকলেই ধন হয় না। চীন গরিব দেশ। তাই গত দশ-বারো বছর ধরে সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কী করে সে আপন ধনদৌলত বাড়াতে পারে। প্রধানত রুশের সাহায্যে।
ইতোমধ্যে এই নয়া কম্যুনিস্ট জাত অর্থাৎ চীন– খানদানি কম্যুনিস্ট জাত অর্থাৎ রুশকেও খানদানিত্বে এক কাঠি ছাড়িয়ে যেতে চাইল। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে আকছারই হয়েছে। পূর্ববাংলায় মুসলমানরা বলে, নয়া মুসলমান গরু খাওয়ার যম হয়। অর্থাৎ শুশানের চাড়াল যদি হঠাৎ দৈবযোগে পৈতে পেয়ে যায় তবে তার বাড়িতে যা সন্ধ্যা-আহ্নিকের ঘটা লাগে তা দেখে জাত ব্রাহ্মণ পরিত্রাহি রব ছাড়ে। চীন বেশ কড়া গলায় রাশাকে বলল, তুমি যেভাবে মার্কিনিংরেজের সঙ্গে দহরম-মহরম করছ সেটা মার্ক-লেনিনবাদের বিশ্ব-কম্যুনিজম আশু আনয়ন করার বিপক্ষে যায়। তুমি শান্তি চাইছ; এ করে এখনকার মতো শান্তি পাচ্ছ বটে, কিন্তু চিরন্তন শান্তি আসবে একমাত্র বিশ্বক্যুনিজমের ফলরূপে। তার জন্য দরকার আপন ধর্মে অর্থাৎ ক্যুনিজমে বিশ্বাস। তার অর্থ শান্তির মারফতে ইহসংসারে কোনও প্রকারের প্রগতি হয় না। সর্ব প্রগতি যুদ্ধের মাধ্যমে। অতএব মার্কিনিংরেজ যেখানে বলবে শান্তি চাই, তুমি সঙ্গে সঙ্গে বলবে যুদ্ধ চাই। এই করে আসবে বিশ্ব-কম্যুনিজম।
রুশ বলল, হক কথা। কিন্তু মার্কস-লেনিনের আমলে অ্যাটম বম্ ছিল না। এখন যদি যুদ্ধ চালাই তবে আখেরে যে সবকিছু লণ্ডভণ্ড ছারখার হয়ে যাবে। বেঁচে থাকবে কে?
এখানে এসে চীন কিছু বলে না। কারণ চীন জানে, রুশ ইংল্যান্ড আমেরিকার জনসংখ্যা ৯৯ পার্সেন্ট মরে গেলেও তার আপন দেশে থাকবে লক্ষ লক্ষ লোক। কারণ তার জনসংখ্যা সক্কলের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। তারাই তখন পৃথিবীর রাজত্ব করবে।
এটা কিছু নতুন তত্ত্ব নয়। ১৯৩৮-এ ইংরেজ-ফরাসি চেয়েছিল হিটলারে-স্তালিনে লড়াই লাগিয়ে দুই ব্যাটাই মরে; তারা পরমানন্দে বিশ্ব-সংসারটা চষে বেড়াবেন।
কট্টর কম্যুনিস্ট বিশ্বাস করে যে, যারা কমুনিজমে বিশ্বাস করে না তারা সবাই এক গোয়ালের গরু। তার কাছে মার্কিন যা ভারতবাসীও। ইংরেজিতে কথায় কথায় বলে, যে আমার সপক্ষে নয় সে আমার শত্রু–নিরপেক্ষ বলে কোনও জিনিস নেই। কাজেই আমরা যে ভারতীয়েরা চীনের শত্রু-মিত্র কিছুই নই, আমরাও তার শত্রু- আমাদের একমাত্র অপরাধ আমরা কম্যুনিস্ট নই– অথচ ধর্ম জানেন, আমরা কম্যুনিস্টদের প্রতি যতখানি সহনশীল, চেকোশ্লোভাকিয়া কিংবা পোল্যান্ড অতখানি হবে না। যদি আজ পূর্ণ স্বাধীনতা পায় তবে কম্যুনিস্টদের ঠেঙিয়ে ঠাণ্ডা করে দেবে। এই যে পশ্চিম জর্মনি গণতান্ত্রিক দেশ, সে-ও কমুনিস্টদের বরদাস্ত করে না।
খ্রশ্চভ এ তত্ত্বটি ভালো করেই জানেন। তাই তিনি ভারতকে শত্রুর চোখে দেখেন না। তাঁর বিশ্বাস, তিনি এবং অন্য কম্যুনিস্টরা যদি আমাদের দিকে চোখ রাঙায় আক্রমণ দূরে থাক তবে আমরা পুরো পাক্কা ক্যাপিটালিস্ট হয়ে গিয়ে মার্কিনকে আমাদের দেশে বিমানঘাঁটি বানাতে দেব, এবং শেষ হিসেবের দিন তার হয়ে রুশের বিরুদ্ধে লড়ব।
চীন যখন রাশাকে আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করতে পারল না, এবং শুধু তাই নয়, রুশ যখন চীনের বাড়াবাড়ি বরদাস্ত না করতে পেরে তার সর্ব সাহায্য বন্ধ করে দিল–শুনতে পাই রাশানরা চীন ত্যাগ করার ফলে তাদের তৈরি কারখানাগুলো চালকের অভাবে খা খা করছে তখন চীন বলল, এটার একটা ইপার-উস্পার করতে হবে। আমি ভারত আক্রমণ করে দেখি রুশ তখন কী করে? সে তো আর কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনিস্ট রাষ্ট্র– অর্থাৎ ভারতকে সাহায্য করতে পারবে না!
এইটে চীনের গৌণ ওয়ার এম– যুদ্ধের উদ্দেশ্য।
মুখ্য ওয়ার এম তবে কী?
পোল্যান্ড-রুশের বিরুদ্ধে হিটলারের ওয়ার এ ছিল, (১) ওদের সৈন্যবাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করা, (২) ওদের নেতৃস্থানীয় কমিসারদের নিধন করা– তারা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করুক আর না-ই করুক, অর্থাৎ কোলব্লাডেড মার্ডার। (৩) তাদের রাজত্বে জর্মনদের বসতি স্থাপনা করে তাদের দিয়ে দাসের কাজ করানো।
রুশভেল্ট ঠিক অতখানি চাননি। তবে তিনিও জর্মনদের কাছ থেকে শর্তহীন আত্মসমর্পণ চেয়েছিলেন আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার। অর্থাৎ তিনি নাৎসি গুণ্ডা ও জর্মন জনসাধারণের মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখেননি। চার্চিল এটা পছন্দ করেননি তিনি চেয়েছিলেন নাৎসি রাষ্ট্রের পতন ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা– এই ছিল তার ওয়ার এম্।
চীন আমাদের সমূলে ধ্বংস করে এ দেশে চীনা চাষাভূষোর বসত করতে চায়নি কিন্তু চীনের অন্যতম ওয়ার এ ছিল এদেশে কম্যুনিস্ট রাজ বসানো। চীন আশা করেছিল সে ভারতে হামলা দেওয়া মাত্রই এদেশের কম্যুনিস্টরা দেশের জনসাধারণকে তাতিয়ে কমুনিস্ট রাষ্ট্র বসাতে পারবে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, সেটা হল না। এমনকি অনেক খাঁটি কম্যুনিস্ট, চীনের এ আচরণে অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছেন এবং অনেকেই পণ্ডিতজির ঝাণ্ডার নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন আর খ্রশ্চভপন্থীরা তো রীতিমতো উন্মা প্রকাশ করেছেন।
স্মরণ রাখা উচিত, চীনাদের এ ওয়ার এম উপস্থিত মুলতবি থাকলেও সেটাকে সে কখনও বর্জন করবে না। আমাদের তার জন্য হুশিয়ার হয়ে থাকতে হবে–হয়তো-বা বহু বছর ধরে।
আমাদের মনে হয় চীন চায় আমাদের পঙ্গু করে রাখতে। প্রাচ্য দেশের দুই বিরাট ভূখণ্ড চীন এবং ভারত। ভারত কম্যুনিস্ট না হলেও দেশের ধনদৌলত বাড়াতে চেয়েছে, আর চীন কম্যুনিজমের মাধ্যমে। এবং চীন যে বিশেষ সফল হয়নি এ কথা বিশ্বসুদ্ধ সবাই জেনে গিয়েছে। পক্ষান্তরে আমরা যে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছি সে-ও জানা কথা। আখেরে তা হলে আমরাই প্রাচ্য দেশগুলোর নেতৃস্থানীয় হব। চীনের কর্তারা এটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছেন না।
তাই তাঁদের মতলব আমরা যেন আমাদের ধনদৌলত বাড়ানো বন্ধ করে বন্দুক-কামানের দিকে মন দিই। তাই নিয়ে চীনের কোনও আশঙ্কা নেই, কারণ চীন বিলক্ষণ জানে, আমাদের বন্দুক-কামান যতই বাড়ুক না কেন, আমরা কখনও চীন আক্রমণ করব না। মাঝের থেকে বন্ধ্যা বন্দুক-কামানের সেবা করে আমাদের ধনদৌলত বৃদ্ধি ক্ষান্ত হবে।
দুঃখের বিষয়, আমাদের বন্দুক-কামান বাড়াতে হবে।
কিন্তু আমাদের ওয়ার এ চীনার বিনাশ-সাধন নয়। আমাদের ওয়ার এম্ অত্যন্ত লিমিটেড সঙ্কটকালে আক্রমণকারীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা। এবং ভবিষ্যতে যেন সে দম্ভভরে পুনরায় আক্রমণ করার সাহস না পায়, তার জন্যে বেশ কয়েক বছর ধরে বন্দুক-কামান বানাতে হবে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গরিব-দুঃখীর মুখে অন্ন তুলে দেবার জন্য আমাদের ধনদৌলতও বাড়াতে হবে।
তাই বলছিলুম, রাধব এবং চুলও বাঁধব।
———-
১. ২. ফলবান্ বংশের–বাঁশের ফল হইলে বাঁশ মরিয়া যায়। অনুবাদকের টীকা। কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ। বসুমতী।
৩. আজকের দিনের উয়োর-বনড, ডিফেন্স সার্টিফিকেট।
৪. ধন উৎপাদনের একমাত্র পন্থা, প্রোডাকশন্ বাড়ানো। অর্থাৎ ইন্ডাসট্রিয়াল ও এগ্রিকালচরল তৈজসপত্র বাড়ানো। না হলে শুধুমাত্র ধনে সর্ব সমস্যার সমাধান হয় না। কথিত আছে, বর্বর মঙ্গলরা যখন প্রবল প্রতাপশালী আব্বাসী খলিফার রাজধানী বাগদাদ দখল করে খলিফাঁকেও বন্দি করতে সক্ষম হল, তখন মঙ্গল সেনাধ্যক্ষ খলিফাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন। ভোজনের জন্য খলিফার সামনে রাখলেন থালা থালা সোনা-জহরত। নিজের সামনে রাখলেন উত্তম উত্তম আহারাদি। খেতে খেতে খলিফাঁকে শুধালেন, হুজুর, খাচ্ছেন না কেন? হুজুর চুপ করে রইলেন। পুনরায় সেই প্রশ্ন। পুনরায় নো রিপ্লাই। তৃতীয় বারে নিরুপায় হয়ে খলিফা বললেন, এগুলো তো খাবার জিনিস নয়। মঙ্গল বললেন, সে কী হুজুর, আপনার রাজত্ব জয় করবার পর আপনার ধনাগার বোঝাই পেলুম এইসব সোনা-জহর। ভাবলুম এগুলো বুঝি আপনি খান। অন্য কোনও কাজে লাগাননি তাই।
অর্থাৎ, শুধু ধন দিয়ে সবকিছু হয় না।
তা হলে ধনী লোকের বাড়িতে ডাকাতি হত না।
হিটলার কী আদর্শ নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন সেটা জানবার আমাদের প্রয়োজন নেই, কিন্তু সম্পূর্ণ দেউলে রাষ্ট্রকে তিনি কী করে জোরদার করলেন সেটা জানা উচিত। তিনিও বলেছিলেন, আমার ব্যাংকে সোনা-জহর নেই। বয়ে গেল। আমি চাই জোয়ান মেয়েম। যারা উৎপাদন করতে পারে। আপন বাহুবলে। আমি রাজা, তখন সেগুলো কিনব। তাই ভীষ্মদেব ধন উৎপাদনের আদেশ দিয়েছিলেন।