ধর্ম ও কম্যুনিজম
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশে প্রলেতারিয়ারাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এক মহতী সভার অনুষ্ঠান হয়। সভার আলোচ্য বিষয়বস্তু কিংবা কর্মসূচি– এজেন্ডাও বলতে পারেন– ছিল মাত্র একটি। ভগবান আছেন কি নেই? বিস্তর তর্কাতর্কির পর স্থির হল, জনমত নেওয়া হোক, প্লেবিসিট করো।
আজকের দিনের ভাষায় আমরা যাকে বলি বিপুল ভোটাধিক্যে ভগবানের পরাজয় হল। বিপুল কেন, ভগবান অতিকষ্টে পেলেন শতকরা মাত্র একটি ভোট। ভগবান থাকলেও বোঝা গেল তাঁর পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্ট অতিশয় রদ্দি, তাঁর মাথুর সত্যসত্যই মথুরা চলে গিয়েছেন; জিপ, মাইক ইত্যাদির সুব্যবস্থা তার ছিল না : তার টাউটরা উভয় পক্ষের পয়সা খেয়ে শেষটায় ভোট দিয়েছে গণ্ডার আণ্ডা ফেলে দুশমন কাফিরদের সঙ্গে। তবুও হয়তো তিনি আরও দু-চারখানা বেশি ভোট পেতেন, যদি পোলিং বুথের একটু দূরে সামান্য কামুক্লাজ করে কিঞ্চিৎ ধান্যেশ্বরী গমরাজ ভদকার ব্যবস্থা রাখতেন। এসব কোনও তরিবত না করে আজকের দিনে ভোটের আশা!! তার ডিপজিটও মারা যায়। সে নিয়ে অবশ্য তাঁর কোনও মে নেই। কারণ তার ম্যানিফেস্টোতে ছিল তিনি ধর্মাচারীগণকে মৃত্যুর পর স্বর্গরাজ্যে নে অর্থাৎ পোস্ট-ডেটেড চেক অন এ নন-একজিটিং ব্যাংক তবে এস্থলে নিছক সত্যের আমাদের স্বীকার করতেই হবে : গডের দুশমনরাই যে শুধু এই জিগির তুলেছিল তা নয়, কম-সে-কম পঁচিশ বছর আগে প্রাতঃস্মরণীয় আস্তিক স্বামী বিবেকানন্দ নিউইয়র্কে ব শিষ্য আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লিখেছিলেন, ‘অন্ন! অন্ন! যে ভগবান এখানে আমাকে অন্ন দিতে পারেন না, তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখবেন–ইহা আমি বিশ্বাস করি না।’
তা সে যাই হোক, ভগবান দশচক্রে ভূত হয়ে রুশ থেকে বিদায় নিলেন।
উন্মাদ, উন্মাদ, বদ্ধ উন্মাদ! পড় আস্তিকেরা অবশ্য বলবেন, ভোট দিয়ে ভগবানের অস্তিত্ব অথবা তদ্বিপরীত প্রমাণ করার চেষ্টা বাতুলতা। এ সেই পুরনো লোকসঙ্গীত স্মরণ করিয়ে দেয়,
ফুলের বনে কে ঢুকেছে
সোনার জহুরি
নিকষে ঘষলে কমল
আ মরি আ মরি ॥
আত্মার উপলব্ধির চরম কাম্য ঈশ্বর। তিন কোটি গাধা-গরু-খচ্চর একজোট হয়ে ম্যাঁ, ম্যাঁ, না, না করলেই কি তিনি লোপ পেয়ে যাবেন!
আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে রুশের এই সশস্ত্র সংগ্রাম পছন্দ করি। সংগ্রামে পরাজিত, এমনকি নিহত হলে আপাতদৃষ্টিতে ধার্মিকজনের পরাজয় হয় বটে, কিন্তু তাতে করে ধর্ম লোপ পান না। তাই যখনই হিন্দুরা তারস্বরে চিৎকার করেন, ধর্ম গেল, ধর্ম গেল, কিংবা মুসলমানরা জিগির তোলেন ইসলাম ইন ডেনজার, তখন অধমের নিবেদন, পৃথিবীর তাবৎ হিন্দু লোপ পেলেও হিন্দুধর্মের এতটুকু সত্য বিনষ্ট হবে না, তাবৎ মুসলমান মারা গেলেও শব্দার্থে লুপ্ত হবেন না। ‘ইসলামে’র শব্দার্থ, ‘সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার সম্মুখে আত্মসমর্পণ করা।’ শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে সর্বধর্ম ত্যাগ করে তাঁরই শরণ নিতে আদেশ করছেন, তখন ওই অর্থেই করেছেন। সর্বধর্ম বলতে আজকের দিনে আমরা বুঝি different ideals, different values। আমাদের ভুল বিশ্বাস, ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ বুঝিবা একে অন্যকে contradict করে ও সবাই সত্য। তা নয়। সত্য এক। সত্যে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না। তাই বিদ্যাপতির ভাষায় কৃষ্ণলাভ করে শ্রীরাধা বললেন, দশদিশ ভেল নিরদ্বন্দ্ব।
তাই সত্য নিরূপণার্থে দ্বন্দ্বের প্রয়োজন হয়তো হয়। কিন্তু অবহেলা ভয়ঙ্কর জিনিস।
আমার মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, রোমকরা যদি প্রথম খ্রিস্টানদের অত্যাচার না করে অবহেলা করত, মক্কাবাসীগণ যদি মহাপুরুষ ও তাঁর সঙ্গীদের নির্যাতন না করত, তা হলে কী হত?
ঊনবিংশ শতাব্দীর স্কুল-কলেজে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মকে অবহেলা করা হল। গোড়ার দিকে যখন খ্রিস্টানরা হিন্দুধর্মকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন বস্তুত হিন্দুধর্মের পুনর্জীবন লাভ হয়। ওই চ্যালেঞ্জের ফলে হিন্দুদের ভিতর আরম্ভ হল আত্মজিজ্ঞাসা– যে সতীদাহ, বহুবিবাহ, অবরোধ-প্রথা নিয়ে হিন্দু শত শত বছর ধরে আপন মনে কোনও চিন্তাই করেননি, তাই নিয়ে আরম্ভ হল তীব্র আলোড়ন আন্দোলন। আজকের দিনের ছেলে-ছোকরারা যে রকম রাজনীতি, সাহিত্য ও ফুটবল নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করে, ঠিক সেইরকম প্রায় একশো বছর ধরে চলল ধর্ম এবং সমাজ নিয়ে আলোচনা। রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, সমাজে যেসব অনাচার প্রচলিত আছে, এর পিছনে ধর্মের সম্মতি নেই। তাই নিয়ে চলল কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে জোর আলোচনা, প্রচুর আন্দোলন।
পক্ষান্তরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়–যেখানে দেশের সর্বোৎকৃষ্ট হৃদয় এবং মন একত্র হয়, সেখানে যদি ধর্ম অবহেলিত হয়, সেখানে যদি ধর্ম নিয়ে তর্ক আলোচনা না হয়, তা হলে শহরের গলিতে গলিতে এবং গ্রামে গ্রামে পুরুত-মোল্লারা পেয়ে যান প্রায় অবারিত রাজত্ব–উর্দুতে বলে, তখন তাদের ‘দোনো হাত ঘি মে ঔর গর্দান ডেগ্মে’–ডেগচির ভিতর মাথা ঢুকিয়ে তারা তখন পোলাও খায়। ধর্মের নামে তখন সমাজে জমে ওঠে কুসংস্কারের স্তূপ। বিবেকহীন রাজনৈতিকরা নেয় তার চরম সুযোগ। বারোয়ারি পূজার নাম করে তহবিল তছরুপাৎ, মা-দুর্গা চেহারা নেন ফিল্ম স্টারের কিংবা পূজাকমিটি-সেক্রেটারির লেটেস্ট গার্ল ফ্রেন্ডের। আমার চোখের সামনে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে নামলেন এক মহিলা। পেটকাটা ব্লাউজ, শাড়িখানা যেন রবারের তৈরি, সর্বাঙ্গে সেঁটে আছে– তাকাতে লজ্জা করে, লিপস্টিক-রুজের কথা বাদ দিন– কী আপদ, আপনারা জানেন, আমি কোন টাইপ মিন করছি–ইনি বাড়ির মহিলাদের নিয়ে মিলাদ শরীফ পরব করতে এসেছেন! পরে বন্ধুর স্ত্রীর কাছে শুনলাম, দোয়াদরুদ পড়ার সময় মাথায় ঘোমটা টানার যে প্রয়োজন, সেটা নাকি ওই মহিলা করে উঠতে পারছিলেন না, শাড়ি ছোট, বার বার খসে পড়ছিল, বার বার হাত ওঠাচ্ছিলেন বেয়াড়া ঘোমটা দুরস্ত করতে। শেষটায় নাকি সক্কলের দৃষ্টি পড়ে রইল মোল্লানীর হাত-কসরৎ দেখার দিকে।
শুনেছি রুশের সংবিধানে নাকি আছে, ধর্মনিরপেক্ষ কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করার অধিকার সর্ব কম্যুনিস্টের আছে। ফলে ওই সময়কার একখানা রুশভাষায় লিখিত ইংরেজি শিক্ষার দ্বিতীয় সোপানের পাঠ্যপুস্তকে নিম্নলিখিত কথোপকথন :
প্রথম ছাত্র : ঈশ্বর নেই।
দ্বিতীয় ছাত্র : ওটা একটা বুর্জোয়া কুসংস্কার– ভূতেরই মতো। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কাবুলে থাকাকালীন সিয়েশকফ নামক একটি পরিবার বাপ, মা, ছেলে– তিনজনাই আমার কাছে ইংরেজি পড়ত। যখন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ওই জায়গাটি এল, তখন সিয়েশকফ একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, এটা থাক। ব্যাপারটা ১৯২৭ সালের। তখনও কম্যুনিস্ট রেভলুশন হার্ডবইলড এগ হয়নি। জোয়ানদের সকলেই ইকনের সামনে বিড়বিড় করে বড় হয়েছে। আমি বললাম, থাকবে কেন? আমি তো বৌদ্ধধর্মের বই পড়ি, সেখানেও ঈশ্বরকে অস্বীকার করা হয়।
তার পরে ১৯৪১-৪২ সালে রুশ যখন হিটলারের হামলায় যায়-যায়, তখন স্তালিন খুলে দিলেন বেবাক চার্চ, বিস্তর মঠ, নিমন্ত্রণ করলেন মিত্র ইংল্যান্ডের ডাঙর পাদ্রিকে। আবার গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা উঠল, হে ঈশ্বর, হোলি রাশাকে (হোলি?– তওবা, তওবা) বাঁচাও।
সেই অরণ্যের মতো জনসমাগম, ধর্মোচ্ছ্বাস দেখে স্তালিন খুশি হয়েছিলেন, না পাড় কম্যুনিস্টের যা হওয়া উচিত– ব্যাজার হয়েছিলেন, জানিনে। হয়তো-বা বিষাদে হরিষ, কিংবা হরিষে বিষাদ। কে জানে!
আমার মনে হয়, ১৭ থেকে ৪১ পর্যন্ত যদি ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা না করে তাকে অবহেলা করা হত, তবে বোধহয় ঠিক এতটা হত না।