হাসির অ-আ, ক-খ

হাসির অ-আ, ক-খ

০১.

হাসির অ-আ, ক-খ।

হাসির চুটকিলা (উইট, হিউমার এনেকডোট) নিয়ে যেসব সঙ্কলন বেরোয়, সেগুলো বেশিরভাগ আপনার-আমার মতো সাধারণ জনই করে থাকে। অবশ্য এদের নির্মাতারা, অর্থাৎ যারা সব উইট বা রসিকতা প্রথম পাঁচজনকে হাসিয়ে কিংবা একজনকে চটিয়ে আর পাঁচজনকে হাসিয়ে নির্মাণ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ওয়াইলডের মতো বিখ্যাত সাহিত্যিক, কিংবা হুইলারের মতো চিত্রকর নন। আবার এ কথাও অতি সত্য যে, বেশিরভাগ চুটকিলাই অতি সাধারণজনই করে থাকে– সাহিত্যে, কাব্যে, দর্শনে, এমনকি সমাজেও তারা বিখ্যাত নন। পাড়ার চায়ের দোকানে যে লোক রসিয়ে গল্প বলে, কারও কথার উত্তরে হাসির জবাব দিয়ে আর পাঁচজনকে হাসিয়ে মারে, সে লোকটি দোকানের বাইরে হয়তো কোনওকিছুতেই সার্থক হয়নি– হয়তো-বা পাড়ার মুরুব্বি তাকে বিশ্ব-বকাটে পদবি দিয়ে বসে আছেন, কারণ চায়ের দোকান থেকে ছেলের মারফত গ্রু গৃহিণী তার কয়েকটি রসিকতা তার কানে এসে পৌঁছেছে, এবং হয়তো-বা তারই মতো দু-একটি মুরুব্বিকে নিয়েই।

অথচ পৃথিবীর অধিকাংশ চুটকিলা নির্মাণ করেছে এরাই। লোকমুখে ঘুরেফিরে এ-দেশ ও-দেশ হয়ে হয়ে বিশ্বময় এরা ছড়িয়ে পড়ে। বরঞ্চ ওরই মতো যে লোকসঙ্গীত মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে, তাদেরও নির্মাতার সন্ধান কোনও কোনও স্থলে পাওয়া যায়, কিন্তু এদের বৃহৎ অংশের মূল অনুসন্ধান কেউ করে না, তবে কোনও লাভও নেই।

লোকসঙ্গীত, রূপকথার মতো এইসব হাসির চুটকিলার সৃষ্টিকর্তা প্রধানত জনগণ। অবশ্য গুণী, জ্ঞানী, রসিক সাহিত্যিকরাও এতে আপন আপন মৃদুহাস্য, অট্টহাস্য, বিদ্রূপব্যঙ্গ মিশিয়ে দিয়েছেন।

তা ছাড়া এমনসব ঘটনাও ঘটে, যা দেখে বা শুনে মনে হাস্যরসের উদ্রেক হয়। যারা ঘটনাটা দেখল বা শুনল, তাদের কারও একজনের সামান্যতম রসবোধ থাকলে এবং সে ঘটনাটি ব্রডকাস্ট করলেই হল। যেমন আইনস্টাইনের গৃহিণী ছিলেন অতিশয় সরলা নারী*। [*এঁর সরল হৃদয় সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথও আমাদের ছেলেবেলায় কিছু কিছু শুনিয়েছেন। বারান্তরে সেকথা হবে।] কী-এক পরব উপলক্ষে, স্বামী অসুস্থ বলে, তিনি নিমন্ত্রিত হয়ে একা গেছেন আমেরিকার বিশাল এক ল্যাবরেটরিতে। সেখানে দৈত্য-দানবের মতো ভীষণদর্শন বিরাট বিরাট যন্ত্রপাতি। বিমূঢ়ের মতো এটা-সেটা দেখতে দেখতে একজন কর্তাব্যক্তিকে তিনি শুধালেন, এগুলো এগুলো দিয়ে কী হয়? কর্তাব্যক্তি বিগলিত হয়ে সুমধুর মৃদুহাস্য হেসে মুরুব্বির সুরে বললেন, কেন ম্যাডাম, এইসব যন্ত্রপাতি দিয়েই তো আপনার স্বনামধন্য স্বামীর থিয়োরি সব সপ্রমাণ করা হয়। ম্যাডাম তো দশ হাত বরফপানিমে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, কিন্তু কিন্তু আমার স্বামী তো এসব টোকেন পুরনো খামের উল্টো দিকে।

এ গল্প বানানোর ভিতর কারও কোনও কেরানি নেই।

.

এইরকম দুনিয়ার যত রকমের হাস্যরসের উপাদান থাকতে পারে, তারই একটি সঙ্কলন প্রকাশ করেছেন জর্মনির এক উত্তম সাহিত্যিক। পূর্বেই বলেছি, সাধারণত এরকম সংকলন করে থাকেন আপনার-আমার মতো সাধারণ জন, তাই সঙ্কলনগুলো অসাধারণ হয় না। এটা অবশ্য একটা paradox. পূর্বে যখন বলেছি, পৃথিবীর বেশিরভাগ চুটকিলাই নির্মাণ করে সাধারণ জন, তখন তার সংকলন করবে সাধারণ জন– এ তো বাঙলা কথা। কিন্তু এইখানেই প্যারাডস্। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মধু তার নিজ মূল্য নাহি জানে। এক ইরানি কবিও বলেছেন, যে-শুক্তি মুক্তার জন্ম দিয়েছে আপন প্রাণরস দিয়ে, সে শুক্তিকে তো মুক্তার মূল্য বিচারের সময় ডাকা হয় না– ডাকা হয় জহুরিকে। কিংবা বলতে পারি, নেপোলিয়নের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনী যে তার জননীই লিখবেন, এমন কোনও কথা নয়।

বর্তমান পুস্তকের নাম, আ বে সে ডেস লাখেনসা, হাসির অ-আ ক-খ (এক্স ওয়াই জেড– যদি কখনও বেরোয়, তবে দেশের পাঠককে জানাব।) লেখকের নাম জিগিসমুন্ট ফন্ রাডেকি। ল্যাভিয়ার রাজধানী রিগা শহরে এঁর জন্ম ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে। পড়াশুনা করেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে, পরে এঞ্জিনিয়ারিং পাস করে জর্মনিতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়টা কাটান তুর্কিস্তানে এঞ্জিনিয়াররূপেই। সাহিত্য-রস কিন্তু বরাবর ছিল। ওদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বার্লিনে আসার পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে অভিনেতা চিত্রকর এবং সাহিত্যিকরূপে। উত্তম ইংরেজি জানেন। জি.কে. চেস্টারটনের ইনি পরম ভক্ত এবং হিলের বেলকের উক্তৃষ্ট জর্মন অনুবাদ তিনি করেছেন– যদিও জর্মনিতে অনুবাদকরূপে তার সর্বোত্তম খ্যাতি রুশ ঔপন্যাসিক গগলের বই জর্মনে তর্জমা করার ফলে।

এঁর জীবনীকার বলেন, রাডেকির বীণায় প্রচুর কোমল এবং অতিকোমল। তার প্রতিটি ধ্বনিতে তত্ত্ব-দার্শনিকের ক্ষীণ মধুর স্মিতহাস্য।

জর্মন, ফরাসি, রুশ, ইংরেজি তথা ইয়োরোপীয় ক্লাসিস নখাগ্রদর্পণে এবং বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন বলে বহু বছর ধরে সঞ্চিত এঁর সঙ্কলন হাসির অ-আ, ক-খ সত্যিই যেন হাস্যরসের কনসার্ট। ব্যালাকত্তাল থেকে আরম্ভ করে ডুগডুগি পিয়ানো কোনও যন্ত্রই বাদ যায়নি।

পাঠক হয়তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। ভাবখানা, দু-একটা গল্পই শোনাও না। তার থেকেই তো এঁর পরিচয় পাওয়া যাবে। সেখানেই তো মুশকিল। আমার বিশ্বাস গোটা সংকলনটি আপনি যদি পড়েন, তবে আপনি খুশি হবেন, যে কোনও লোক খুশি হবে। কিন্তু আমি যেগুলো বাছাই করে দেব, সেগুলো আপনার পছন্দ না-ও হতে পারে। আপনার সংকলন আমার পছন্দ না-ও হতে পারে। সংকলনের সংকলন বিপদসঙ্কুল। তবু চেষ্টা দিতে ক্ষতি নেই এবং গুণীরা যখন অরুন্ধতী ন্যায়ের অর্থাৎ চেনা জিনিস থেকে অচেনা জিনিসে যাবে বলে উপদেশ দিয়েছেন তখন আপনার-আমার পরিচিত শার্লক হোমস দিয়েই বিসমিল্লা করি :

মরুভূমিতে শার্লক হোমস্ (অবশ্য আমার জানামতে হোমস্ কখনও কোনও মরুভূমিতে যাননি বর্তমান লেখক)। ১৯১৭ সালের হেমন্তকাল। কয়েক মাস ধরে এক ইংরেজ রেজিমেন্ট প্যালেস্টাইনের দুরন্ত গরমে মরুভূমিতে থানা গেড়েছে। মদ্যাদি তো প্রায় নেই-ই, জলও কম, আর খাবার সময় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সেই এক কর্নড় বিফ! শেষটায় এমন হল যে, শব্দটা শুনলেই জোয়ানদের বমি আসে।

এলেন এক সন্ধ্যায় এক নতুন অফিসার। রান্নাঘরে ঢুকে তদারক তদন্ত করছেন, যাকে বলে ইন্সপেকশন-কলেন, চাখলেন এবং সর্বশেষে অতিশয় বিজ্ঞের মতো অভিমত প্রকাশ করে বললেন, হুম… আজ ডিনারে তা হলে কর্নড় বিফ!

জোয়ানদের সবাই চুপ–কেউ একটি রা-ও কাড়ল না। উঁচ পড়লেও শোনা যায়। শেষটায় এক কোণ থেকে কোন এক ককনির ব্যঙ্গের গলা শোনা গেল, আ মরি! ওয়াটসন!

একটু সূক্ষ্ম রসিকতা। এ যেন এ কথা বলার জন্যে তো ভূতের দরকার হয় না হুজুর। আস্ত না হলেও ওয়াটসন যে একটি হাফ-গবেট ছিলেন, সেটা হোমসৃপিয়াসীদের জানা। এটি প্রধানত তাঁদের জন্যই। আসছে বারে নিবেদন করব হরেকরকম্বা। পূর্বোক্ত আইনস্টাইন-গৃহিণীর গল্পটি রাডেকির সংকলন থেকেই নেওয়া।

.

০২.

জিগিসমুন্ট ফন রাডেকি তার হাস্যরস সংকলনের পুস্তিকায় একটি ক্ষুদ্র অবতরণিকা দিয়েছেন। সে অবতরণিকায় আর পাঁচজন মোকা-বেমোকা-উদাসীন জর্মনের মতো তিনি পাণ্ডিত্য ফলাতে যাননি। জর্মনদের যে পাণ্ডিত্য ফলাবার ব্যামোটা আছে সে বিষয়ে স্বয়ং জর্মনরাই সচেতন। ভিন্ন ভিন্ন জাতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা যেরকম হক্ক না-হক্ক গল্প বানাই– মারোয়াড়িদের পয়সার লোভ, পূর্ববঙ্গবাসীদের খামোখা চটে যাওয়া নিয়ে ইয়োরোপীয়রাও সেরকম করে থাকে। গ্যোরিঙ যখন নরনবের্গ মোকদ্দমার জন্য সেখানকার হাজতে, তখন তিনি মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ডা. কেলিকে নিম্নের চুটকিলাটি বলেন :

একজন ইংরেজ– একটা আস্ত ইডিয়ট। দুজন ইংরেজ একত্র হলে সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্লাবের পত্তন। তিনজন হলে নতুন এক সাম্রাজ্য জয়।

একজন ইতালিয়ান– উত্তম গাইয়ে। দুজন হলে ডুয়েট। তিনজন হলে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন। (এটা যে কী রকম খাঁটি কথা সেটা গত বিশ্বযুদ্ধে বার বার সপ্রমাণ হয়েছে।)

একজন জর্মন, পণ্ডিত। দুজন জর্মন একটা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে বসবে। তিনজন হলে যুদ্ধ ঘোষণা।

অন্যান্য জাতও গ্যোরিঙের গল্পে স্থান পেয়েছে কিন্তু সেগুলো নিয়ে উপস্থিত আমাদের প্রয়োজন নেই। তা সে যাই হোক, রাডেকি তার অবতরণিকায় অহেতুক পাণ্ডিত্য ফলাননি।

ইহ সংসারে আমাদের কত জিনিসেরই না অভাব, এবং তাই নিয়ে একমাত্র মানুষই রোদন করে কিন্তু ওই অভাবের ক্ষতিপূরণ হিসেবে একমাত্র মানুষই হাসতে জানে। মানুষের যে দেহাতীত সত্তা আছে সে-ই আমাদের দেহ থেকে অশ্রুজল ঝরায় এবং সে-ই আমাদের দেহের দু পাশ এবং ভুড়ি দুলিয়ে হাসায়। কিন্তু এই পৃথিবীতে সে জিনিস কী, যা হাস্যকৌতুক রসের সৃষ্টি করে?

প্রশ্ন শুধিয়ে উত্তরে রাডেকিই বলছেন, সব, সবকিছুই…। যেমন সবকিছুই কাঁদাতেও পারে। তারা, ফুল, পশুপক্ষী এদের নিজেদের সত্তা দিয়ে কৌতুকরস সৃষ্টি করে না, কিন্তু মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হওয়ামাত্রই এগুলো কৌতুকরসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে কারণ এই মানুষই বিশ্ব-সংসারের হাসি এবং কান্নার কেন্দ্র। কারণ এই মানুষ নির্মিত হয়েছে অর্ধেক পণ্ড থেকে এবং অর্ধেক চৈতন্য দিয়ে। এই যে কাদামাটি আর সৃষ্টিকর্তার মুখের ফুঁ দিয়ে তৈরি মানুষ তার হাসি এবং কান্না অতি সাধারণ সরল, আর গভীর মনোবেদনায় যখন মানুষ কাঁদে তখন তার সে রোদন সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ের। হাসির বেলাও তাই। মানুষ যখন ফুর্তিতে থাকে তখন সে হাসে কিন্তু কৌতুকরসের সৃষ্টি হওয়াতে মানুষ। অকস্মাৎ যে অট্টহাস্য করে ওঠে সে হাসি ভিন্ন। কিন্তু ফুর্তিতে থাকলেই যে কৌতুকের সৃষ্টি হয় এমন কোনও কথা নয়। সেখানে মানুষ হাসে সে ফুর্তিতে আছে বলে, আর এস্থলে তার উল্টোটা– এস্থলে মানুষ হেসে ফুর্তি পায়।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে রাডেকির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নন। কিন্তু বলছেন, সুখে (অর্থাৎ যখন ফুর্তিতে আনন্দে আরামে– লেখক) আমরা স্মিতহাস্য হাসি, কৌতুকে আমরা উচ্চহাস্য হাসিয়া উঠি। একটি আন্দোলনজনিত স্থায়ী, অপরটি সংঘর্ষজনিত আকস্মিক। এবং তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরেকটি তত্ত্বও যোগ দিয়েছেন– আমি বোধ করি, যে কারণ-ভেদে একই ঈথরে আলোক ও বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তাহা আবিষ্কৃত হইলে তাহার তুলনায় আমাদের সুখহাস্য ও কৌতুক-হাস্যের কারণ বাহির হইয়া পড়িবে। [পঞ্চভূত, রবীন্দ্র রচনাবলি, ২য় খণ্ড ৬১৭। পঞ্চভূত পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় ১৩০৪ সালে। তার পর ১৩২৮ এবং ১৩৩৩-এর মাঝামাঝি কোনও সময়ে আমরা হাসি কেন? এই নিয়ে বিশ্বভারতীর সাহিত্য সভায় আলোচনা করেন। তার অনুলেখন আমার কাছে ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অন্যান্য আরও বহু অনুলেখনের সঙ্গে এটিও কাবুল বিদ্রোহের সময় হারিয়ে যায়। সে সভায় ক্ষিতিমোহন সেন উপস্থিত ছিলেন। তার পাণ্ডুলিপিতে কিংবা হয়তো ওই সময়কার শান্তিনিকেতন পত্রিকায় এর অনুলেখন পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে জনৈক লেখক একটি অত্যুত্তম প্রবন্ধে প্রমাণ করেছেন, হাস্যের কারণ সম্বন্ধে আঁরি বের্গস ও রবীন্দ্রনাথ প্রায় একমত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখাটি বের্গসর পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল।]

আর বর্তমান লেখক শুধায় তা হলে বেদনাজনিত অট্টহাস্যও কি ওই একই পর্যায়ে পড়বে? কিংবা দেখব, আকাশের জল, চোখের জল আর গোলাপের জল একই কারণে ঝরছে?

মূল কথায় ফিরে যাই। রাডেকি বলেছেন, একদা সর্বপ্রকারের কাব্যই আবৃত্তি করা হত কিংবা গাওয়া হত। এর বহু পরে মানুষ এগুলো লিখে রাখার প্রয়োজন অনুভব করল। এবং এরও পরে ছাপাখানায় সে কৃষ্ণমৃত্যু প্রাপ্ত হল (আমরা বলব মা কালী কালির চরণাশ্রয় পেল) এবং আজ সে শুধু মানুষের চিত্তাকাশেই জাগরিত হতে পারে। একমাত্র কৌতুকরসই এখনও মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছাপাখানায় সে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয় না। এ যেন কলকল উচ্চহাস্যে এগিয়ে চলেছে পাহাড়ের ঝরনা– মাঝে মাঝে একপাশে গুটিকয়েক পাথরের মাঝখানে যে সে স্তব্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সেই হল তার ছাপায় প্রকাশিত রূপ, কিন্তু সে অতি সামান্য এবং তার উদ্দাম গতিবেগকে কণামাত্র ব্যাহত করে না। এবং অন্য সব কাব্যকলা যেমন যেমন ছাপার গোরস্তানে নীরব হতে লাগল সঙ্গে সঙ্গে কৌতুক-কথিকা এগুলো নিজের ভিতর সংহরণ করে তাদের পুনর্জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে লাগল। তাই কৌতুক-কথিকা চুটকিলা, কখনও-বা কথক ঠাকুরের রূপকথা, কখনও-বা বিষ্ণু শর্মার উপকথা, দশছত্রের উপন্যাস, কাহিনী, কবিতা এমনকি রোমাঞ্চকর নাট্য। সংবাদপত্রের শক্তি এ ধরে এবং কয়েকটি শব্দের সাহায্যে যত্রতত্র যখন তখন এক লহমায় নাট্যশালার বাতাবরণ সৃষ্টি করতে পারে। সে একাধারে রাজদূত, লোকদূত, চারণ এবং নাট্যকার। কৌতুক-কথিকা হাস্যগাথা রচনা পেশাদারের একচেটিয়া নয়, বরঞ্চ বলতে হবে এটি পাঞ্চজন্য রসসৃষ্টি। হাস্যরস-লেখক বলতে যা বোঝায় তাঁদের মতো একটি ছত্র না লিখেও মানুষ তার জীবনে হাস্যরস সঞ্চয় করতে পারে ও সৃষ্টি করতে পারে– জঁ পল বলেন।

লোকমুখে এই হাস্যরস সৃষ্টির ঐতিহ্য বেঁচে রইল কী করে?

রাডেকি বলেন, সমাজের বাজয় রূপ নিত্য প্রয়োজনীয়। স্কুট বাক্য দ্বারা মানুষ আপন মনের চিন্তা, হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশ করে, আপন অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়। তার লীলাভূমি– রাজনৈতিক সভা-সমিতি, থিয়েটার, বারোয়ারি পুজো ইত্যাদি। কিন্তু সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত আত্মচেতনা প্রকাশ পায় তখনই যখন রামাশ্যামা সবাই সমান অংশীদার হয়ে হাস্যকলার সৃষ্টি করে। এস্থলে বর্তমান লেখকের টীকা– শুধু তাই নয়, চুটকিলা-ভূমিতে গণতন্ত্রের এমনই কট্টর যে অতিসাধারণ জনও আকছারই ছোট্ট একটি টিপ্পনী কেটে গেরেমভারী মাতব্বরজনকে ডিগবাজি খাইয়ে দেয়)। তার পর রাডেকি এ অনুচ্ছেদ শেষ করেছেন এই বলে : হাস্যরস মানুষে মানুষে যোগসূত্র স্থাপন করে।

আমি সম্পূর্ণ একমত নই। হাসির চেয়ে কান্না, আনন্দের চেয়ে বেদনাই আমাদের একে অন্যকে কাছে টানে বেশি। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এস্থলে একটি সামান্য উদাহরণ দিলেই বোধহয় যথেষ্ট হবে। বৈঠকখানায় বসে শুনতে পেলুম, বাড়ির বউ-ঝিরা রান্নাঘরে কাজ করতে করতে হঠাৎ একসঙ্গে হেসে উঠল। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাসির হিস্যাদার হতে কিংবা কারণ অনুসন্ধান করতে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভিতর ছুটে যাইনে। কিন্তু সবাই যদি একসঙ্গে ডুকরে কেঁদে ওঠে তবে অবশ্যই যাই।

এ বড় অদ্ভুত সমস্যা। দুঃখ-বেদনা আমরা দেখতে চাইনে, কিন্তু কাব্যে ঠিক সেই জিনিসটেই আমরা খুঁজি।

কৌতুক-হাস্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথও পঞ্চভূতে লিখেছেন, রামায়ণের সীতা বিয়োগে রামের দুঃখে আমরা দুঃখিত হই, ওথেলোর অমূলক অসূয়া আমাদিগকে পীড়িত করে, দুহিতার কৃতঘ্নতাশরবিদ্ধ উন্মাদ লিয়রের মর্মর্যাতনায় আমরা ব্যথা বোধ করি কিন্তু সেই দুঃখ-পীড়া বেদনা উদ্রেক করিতে না পারিলে সে-সকল কাব্য আমাদের নিকট তুচ্ছ হইত। এতখানি বলার পর রবীন্দ্রনাথ সূত্র দিচ্ছেন, বরঞ্চ দুঃখের কাব্যকে আমরা সুখের কাব্য অপেক্ষা অধিক সমাদর করি। আমরা সম্পূর্ণ একমত। তবে তিনি যে কারণ দিয়েছেন– কারণ, দুঃখানুভব আমাদের চিত্তে অধিকতর আন্দোলন উপস্থিত করে–সেখানে সবাই একমত না-ও হতে পারেন।

আজ যে বাঙলা দেশে রাজশেখরের এত খ্যাতি তার কারণ গড্ডলিকা কজ্জলী নয়– তার কারণ তাঁর চলন্তিকা, রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ, হয়তো-বা তার প্রবন্ধাবলি। যদিও আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস তার হাস্যরস অতুলনীয়, কিন্তু তাঁর অন্যান্য সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করার মতো– তা সে শ্রেষ্ঠতর কিংবা নিকৃষ্টতরই হোক– লেখক বাঙলা দেশে আছে। চলন্তিকার চেয়ে ভালো অভিধান ইংরেজিতে আছে কিন্তু হাস্যরসিক রাজশেখর, জেরম কে জেরম, উডহাউসের বহু বহু ঊর্ধ্বে।

তা সে যাক। কিন্তু এই যে রবীন্দ্রনাথ বললেন, এবং আমরাও স্বীকার করলুম, দুঃখের কাব্য আমরা সুখের কাব্য অপেক্ষা অধিক সমাদর করি–তাই যদি হয় তবে ফিলিমওয়ালারা কেন বলেন ট্র্যাজেডি অচল, দর্শক কমেডি দেখতে চায় এবং শুধু এ দেশে নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই নাকি অল্পবিস্তর তাই।

তার কারণ বোধহয় এক হতে পারে যে, শিওর রূপকথা কখনও ট্র্যাজেডিতে সমাপ্ত হয় না, এবং যেহেতুক সিনেমা-দেখানেওয়ালারা ত্রিশ বছর বয়সেও শিশুমন ধরেন তাই তারা ট্র্যাজেডি পছন্দ করেন না। কিন্তু এস্থলে সে আলোচনা কিঞ্চিৎ অবান্তর।

***

রাডেকি তার অবতরণিকায় আরও অনেক মধুর এবং জ্ঞানগর্ভ কথা বলেছেন। এবং শেষ করেছেন এই বলে, হাস্যকথিকার (চুটকিলার) প্রাণরস কিন্তু ওই বস্তু শব্দের মাধ্যমে বলাতে ছাপাখানার মারফতে নয়। তুলনা দিয়ে বলেছেন, প্রথমটা যেন উচ্ছল প্রাণরসে সঞ্চারিত উড়ন্ত প্রজাপতি– ছাপাখানার মাল যেন পিন দিয়ে বেঁধা কাঁচের বাক্সের ভিতর মৃত প্রজাপতি।

রাডেকি অবতরণিকা শেষ করেছেন তাই এই বলে, আমি হালে একটি চমৎকার রসিকতার গল্প শুনতে পেলুম। তদ্দশ্যেই সেটি লিখে নিলুম। পরে সেটি ছাপায় প্রকাশিত হল! যিনি সেই গল্পটি বলেছিলেন সে কথক সেটি পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশ হয়েছে। কিন্তু স্বরলিপি কই?

অর্থাৎ এ যেন কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত না গেয়ে আবৃত্তি করে শোনাল। স্বামীজির জন্মশতবার্ষিকী। তিনি নাকি এরই কাছাকাছি অন্য একটি তুলনা দিয়েছেন। অনুবাদ যেন কাশ্মিরি শালের উল্টো পিঠ। ডিজাইনটা বোঝা যায় কিন্তু অন্য সবকিছু লোপ পায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *