এক পুরুষ

এক পুরুষ

০১.

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিক।

বিদ্রোহ শেষ হয়ে গিয়েছে। আজকের দিনের যুদ্ধে যাকে ইংরেজিতে বলে মপিং অপ, যেন স্পঞ্জ দিয়ে মেঝের এখান-ওখান থেকে জল শুষে নেওয়া– তাই চলেছে। আজ এখানে ধরা পড়ল জন দশেক সেপাই, কাল ওখানে জন বিশেক। কাছাকাছি কামান থাকলে পত্র-পাঠ বিদ্রোহীগুলোকে তাদের মুখের সঙ্গে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিংবা ফাঁসি। গাছে গাছে লাশ ঝুলছে, যেন বাবুইপাখির বাসা।

পাঁচশো দু-আসপা (দ্বি-অশ্বা) অর্থাৎ এক হাজার ঘোড়া রাখার অধিকারী বা মনসবদার গুল বাহাদুর খান বর্ধমানের কাছে এসে মনস্থির করলেন, এখন আর সোজা শাহি সরকারি রাস্তায় চলা নিরাপদ নয়। তিনি অবশ্য আপদ কাটাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেননি। তিনি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন গদর (মিউটিনি) শেষ হয়ে গিয়েছে তারা হেরে গিয়েছেন। তিনি কেন, তার সেপাইরা আশা ছেড়ে দিয়েছিল, তিনি নিজে নিরাশ হওয়ার বহু পূর্বেই। সলা-পরামর্শ করার জন্য তিন রাত্রি পূর্বে যে জলসা বসেছিল তাতে তারা অনুমতি চায়, অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে গরিবশুরবো, ফকির-ফুকরো সেজে যূথভঙ্গ হয়ে যে যার আপন শহরের দিকে রওনা হবে। এলাহাবাদ, কনৌজ, ফররুখাবাদ, লক্ষ্ণৌ, মলিহাবাদ, মিরাট– যার যেখানে ঘর।

গুল বাহাদুর খান বলেছিলেন, সেটা আত্মহত্যার শামিল। পথে ধরা পড়বে, আর না পড়লেও বাড়িতে পৌঁছানোর পর নিশ্চয়ই। তাঁর মনের কোণে, হয়তো তার অজান্তে, অবশ্য গোপন আশা ছিল বেঁচে থাকবার। সুদ্ধমাত্র বেঁচে থাকবার জন্য নয়, তার বয়স বেশি হয়নি, হয়তো আবার নতুন গদর করার সুযোগ তিনি এ জীবনে পাবেন। কিন্তু যখন দেখলেন, সেপাইদের শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়েছে আজকের দিনের ভাষায় যাকে বলে মরাল টুটে গিয়েছে তখন তিনি তাদের প্রস্তাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। শেষরাত্রে আধোঘুমে অনুভব করলেন, সেপাইরা একে একে তার পায়ে চুমো খেয়ে বিদায় নিল তিনি আগের দিন মাগরিবের নামাজের পর অনুরোধ করেছিলেন, বিদায় নেওয়া-নেওয়ির থেকে তাঁকে যেন রেহাই দেওয়া হয়।

শুনলেন, সেপাইরা চাপা গলায় একে অন্যকে শুধোচ্ছে, কাজটা কি ঠিক হল, বাড়ি পৌঁছানোর আশা কতখানি, সেখানে পৌঁছেই-বা কিস্মতে আছে কী, এ রকম সর তাজ (মাথার মুকুট) সর্দার পাব কোথায়?

গুল বাহাদুর খানের কিন্তু কোনও চিত্তবৈকল্য হয়নি। তাঁর কাছে এরা সব নিমিত্ত মাত্র। তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, তাঁর প্রাণের একমাত্র গভীর ক্ষুধা– জাহান্নামি শয়তান ইংরেজকে এ দেশ থেকে তাড়িয়ে শাহানশাহ বাদশা সরকার-ই-আলা বাহাদুর শাহের প্রাচীন মুঘলবংশগত শাশৌকৎ তখৃৎদৌলৎ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। আজ যদি এই সেপাইদের দিল দেউলে হয়ে গিয়ে থাকে তো গেছে। এরা তো আর কিছু কাপুরুষ নয়। কিন্তু এরা কাকের মতো একবারই বাচ্চা দিতে জানে। একবার তারা চেষ্টা দিয়েছিল। সফল হতে পারেনি। দু-বার চেষ্টা দেওয়া তো এদের কর্ম নয়। তাই নিয়ে আফসোস্ করে কী ফায়দা। খুদা যদি বাঁচিয়ে রাখেন, আল্লার যদি মেহেরবানি হয় তবে আবার নয়া সেপাই জুটবে, নয়া গদর দামামা পিটিয়ে জেগে উঠবে– তার আশা তিনিই করতে পারেন, এরা করবে কী করে?

গদর আরম্ভ হয়েছিল এলোপাতাড়ি কিন্তু পরে দিল্লিতে লালকেল্লার তসবিখানাতে যে মন্ত্রণাসভা বসেছিল সেখানে স্থির হয়, গুল বাহাদুরকে পাঠানো হবে বাঙলা দেশে। সেখানকার বাগদিরা এককালে ছিল বাদশাহের সেপাহি। ইংরেজ তাদের বিশ্বাস করত না বলে ইংরেজ ফৌজে তাদের স্থান হয়নি। শুধু তাই নয়, ইংরেজ তাদের অন্য কোনওরকম কাজ তো দিলই না, উল্টো হুকুম করল তারা যদি আপন জমি নিজে চাষ না করে তবে সে জমি কোম্পানি বাজেয়াপ্ত করবে। বাগদিদের আত্মসম্মানে লাগে জোর ঘা। যে তলোয়ার দিয়ে সে দুশমনের কলিজা দু টুকরো করে দেয়, তাই দিয়ে সে খুঁড়বে মাটি! তার চেয়ে সে তলোয়ার আপন গলায় বসিয়ে দিলেই হয়, কিংবা মওকা পেলে দুশমনের গলায়–

গুল বাহাদুরকে বাঙলা দেশে পাঠানো হয়, এই বাগদি ডোমদের জমায়েত করে এক ঝাণ্ডার নিচে খাড়া করবার জন্য।

আফসোস্, আফসোস্! হাজার আফসোস্! একটু, আর একটু আগে আরম্ভ করলেই তো– গুল বাহাদুর নিজের মনেই বললেন, থাক্ সে আফসোস্। এখন বর্তমানের চিন্তা করা যাক্।

বাগদিদের সাহায্যেই তিনি জোগাড় করলেন ধুতি নামাবলী। তিনি এখন বৃন্দাবনের বৈষ্ণব। বাঙলা জানেন না, জানেন হিন্দি। আসলে সেটাও ঠিক জানেন না। তিনি ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে বলেছেন দিল্লির উর্দু, মকতবে শিখেছেন ফারসি, আর বলতে পারতেন দিল্লির আশপাশের হিন্দির অপভ্রংশ হরিয়ান। কিন্তু তাই নিয়ে অত্যধিক শিরঃপীড়ায় কাতর হবার কোনও প্রয়োজন নেই। এই রাঢ় দেশে কে ফারাক করতে যাবে, দিল্লির হরিয়ানা থেকে বৃন্দাবনের ব্রজভাষা।

দাড়িগোঁফ কামাতে গিয়ে একটুখানি খটকা বেধেছিল, এক লহমার তরে! তার পর, মনে মনে কান্নার হাসি হেসে বলেছিলেন, তা কামাবো বইকি, নিশ্চয়ই কামাবো। লড়াই হেরেছি, তলওয়ার ফেলে দিয়েছি, পালাচ্ছি মেয়েছেলের মতো– এখন তো আমাকে মেয়েমানুষ সাজেই মানায় ভালো।

শেষটায় হঠাৎ অট্টকণ্ঠে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ইয়াল্লা, আমি কী গুনা করেছিলাম যে এ সাজা দিলে?

ক্রুশবিদ্ধ যিশুখ্রিস্টও মৃত্যুর পূর্বে চিৎকার করে বলেছিলেন, হে প্রভু, তুমি আমাকে বর্জন করলে কেন?

বাগদিরা তাঁর হাহাকার হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিল। তেঁতুলতলায় শুইয়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে সান্ত্বনা দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল।

দুপুররাতে চাঁদের আলো মুখে পড়াতে ঘুম ভাঙল। দেখলেন, ঘুমিয়েও ঘুমোননি। ঘুমন্ত মগজও তাঁর জাগ্রত অবস্থার শেষ হাহাকারের খেই ধরে মাথা চাপড়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার সান্ত্বনাও খুঁজে পেয়েছে। কী সান্ত্বনা? গুল বাহাদুর, এ কি তোমার ফাটা কিস্মাৎ, না তোমার বাপ-ঠাকুর্দার ভাঙা কপাল? মনে নেই, দেওয়ান-ই খাসের যেখানে লেখা–

অগর ফিরদৌস বররূয়ে জমিন অস্ত
 ওয়া হমিন অস্ত হমিন অস্ত হমিন অস্ত।
ভূস্বর্গ যেখানে খুশি বলো, মোর মন জানে।
এখানে, এখানে দেখো তারে, এই এখানে।

 তারই সামনে নাদির কর্তৃক হৃতসর্বস্ব, লাঞ্ছিত, পদদলিত বাদশা মুহম্মদ শাহ কপালে করাঘাত করে কেঁদে উঠেছিলেন,

শামাতে আমাল-ই-মা সুরুতে নাদির গিরিফৎ।
 কপাল ভেঙেছে, আমারই কর্মফল
নাদির মূর্তিতে দেখা দিল।

 তখন কি তোমার পিতামহ তার নুন-নিমকের মালিক শাহিনশার সে দুর্দৈব দাঁড়িয়ে দেখেননি? বাদশার খাস আমির সর-বুলন্দখান, হাজার দু-আম্পা মনসবের মালিক। তোমার পিতামহ তখন কী করতে পেরেছিলেন? আলবত্তা, হ্যাঁ, হাবেলিতে ফিরে এলে তাঁর জননী তাঁকে শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন, দাড়িগোঁফ কামিয়ে ফেল, আর তলওয়ারখানা শাহিনশাকে ফেরত দিয়ে এসো।

তার পর দীন-দুনিয়ার মালিক আকবর-ই-সানী (দ্বিতীয় আকবর) যখন ইনিয়ে-বিনিয়ে বিলাতের বাদশার কাছে দরখাস্ত পেশ করলেন তাঁর তনখাহ্ বাড়িয়ে দেবার জন্য মেথর যে-রকম জমাদারের কাছে তখা বাড়াবার জন্য আরজি পেশ করে–তখন সে বেইজ্জতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন তোমার বাপ। শোনোনি যে বাঙালিন বাবু* [*রাজা রামমোহন রায়] সে দরখাস্ত নিয়ে বিলায়েত গিয়েছিলেন তিনি পর্যন্ত নাকি তার জবান, ঢঙ আর শৈলী দেখে শরম বোধ করেছিলেন।

তাই বলি, তুমি এত বুক চাপড়াচ্ছ কেন?

তাদের তুলনায় তোমার মনসবই (পদমর্যাদা) বা কী, বাদশাহ তোমাকে চেনেনই-বা কতটুকু? নানাসায়েব, লছমীবাঈ এঁরা সব গায়েব হয়েছেন, আর তুমি তাঁতি এখন ফারসি পড়বে। হয়েছে, হয়েছে, বেহ হয়েছে। গিদড়ের গর্দানে লোম গজালেই সে শের-বাবর হয় না!

আল্লাহ জানেন, এসব তত্ত্বকথা চিন্তা করে গুল বাহাদুর খান কতখানি সান্ত্বনা পেয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনেও তার আচার-ব্যবহার থেকে অনুমান করা যেত না, তিনি তাঁর কপালের গর্দিশ কতখানি বরদাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বড় রাস্তা থেকে নেমে ডান দিকে মোড় নিয়ে, ফের বাঁ দিকে পুরো পাক খেয়ে তিনি পেরোলেন অজয় নদ। উঁচু পাড়ি বেয়ে উঠেই দেখলেন, সমুখে দিকদিগন্ত প্রসারিত খরদাহে দগ্ধ সবিতার অগ্নি-দৃষ্টিতে অভিশপ্ত চিতানল– ভস্মীভূত প্রান্তর।

অবাঙালির তো কথাই নেই, এ দেশের আপন সন্তানও এই তেপান্তরি মাঠের সামনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে। এর নাম বাঙলা রেখেছে কোন কাষ্ঠরসিক।

কিন্তু গুল বাহাদুর শিউরে ওঠেননি; তাঁর জীবন কেটেছে দিল্লি-আগ্রার চারদিকের খাকছার দেশ দেখে দেখে। সেরেফ উনিশ-বিশের ফারাক।

তাবৎ তেপান্তরের ওপারেও লোকালয় থাকে। সাহারার মতো মরুভূমি পেরিয়েও বেদুইন যখন ওপারে ডেরা পাততে পারে তখন এই তেপান্তরের পরেও নিশ্চয়ই বসতি আছে। কিন্তু সেখানে থাকে কি সর্বহারা লক্ষ্মীছাড়ারাই! যাদের প্রাণ ছাড়া আর কিছু দেবার নেই শুধু তারাই তো পারে এ রকম ডাক-ডাকিনীর মাঠে পা ফেলতে!

ভালোই। ভালোই হল। এই তেপান্তরই তাঁর ও ইংরেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইবে অচল অভেদ্য দুর্গবৎ। সেই হতভাগাদের সঙ্গেও তাঁর বনবে ভালো, hail fellow wellmet, এক বাথানের গরু।

গুল বাহাদুর বললেন, শুকর, আলহামদুলিল্লা।

মাঠে ফেললেন পা।

.

০২.

সংসারের অধিকাংশ লোক না গোলাম না বাদশাহ। বাদবাকির কেউ সরদার কেউ চেলা। ওদের কেউ কেউ জন্মায় হুকুম দেবার জন্য, আর কেউ কেউ সে হুকুম তামিল করার জন্য। ভাগ্যচক্রে অবশ্য কখনও হুকুম-দেনেওলাও জন্মায় হুকুম-লেনেওলা হয়ে। তখনও কিন্তু তার গোত্র বুঝতে অসুবিধে হয় না। সে তখন বাদশাহ হয়ে জন্মালে উজিরের হুকুমমতো ওঠ-বস করে, উজির হলে সর্বক্ষণ তাকিয়ে থাকে কোটালের দিকে তার আদেশ কী। আবার উল্টোটাও হয় ঠিক ওই রকমই। সে পাইক হয়ে জন্ম নিয়েও ফৌজদারকে হামেহাল বাৎলে দেয় তার কর্তব্য কোন্ পথে।

দুঁদে জমিদারের জেল হলে সে তিন দিনের মধ্যেই চোর-ডাকাত নিয়ে কয়েদিখানায় দল খাড়া করে, সপ্তাহের মধ্যেই জেল সুপারিনৃটেডেন্ট তার কথায় হাঁচে, তার হুকুমে কাশে। মওকা পাওয়া মাত্রই উপরওলাকে জানায়, অমুক কয়েদির কন্ডাক্ট ভেরি ভেরি গুড; অ্যামনেস্টির সময় একে অনায়াসে খালাস দেওয়া যেতে পারে। জমিদার বেরিয়ে গেলেই সে তখন খালাসি পায়।

গুল বাহাদুরের জন্ম হয়েছিল হুকুম দেবার জন্য। নামাবলী গায়ে দিয়েই আসুন আর রাইডিং বুট পরেই আসুন, ডোমের দল তাকে চট করে চিনে ফেলল। পিঠে থাবড়া খেয়েই ঘোড়া চিনতে পারে ভালো সোওয়ার কে?

তেপান্তরের মাঠের প্রত্যন্ত প্রদেশে, গ্রাম যেখানে শুরু, সেখানে এক পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নিলেন গুল বাহাদুর। চালের ভিতর দিয়ে আসমান দেখা যায়। রাতে আকাশের তারা তার দিকে মিটমিটিয়ে তাকায়, দিনে কাঠবিড়ালি। ঘরের কোণের গর্ত থেকে একটা সাপ মাথা তুলে তার দিকে জুল জুল করে তাকিয়েছিল। গুল বাহাদুর বলেছিলেন, তশরিফ নিকালিয়ে, আত্মপ্রকাশ করতে আজ্ঞা হোক। গদরের সময় তিনি নিমকহারামি দেখেছেন প্রচুর। সাপ তো তাঁর নুননিমক খায়নি যে তাকে কামড়াতে যাবে।

ডোমরা তার ঘর মেরামত না করে দিলে গুল বাহাদুর কদাচ এই গর্ত বন্ধ করতেন না।

চিকনকালা গ্রামে আসার পরদিন গুল বাহাদুর গিয়েছিলেন গ্রামের ভিতর একটা রোদ মারতে দিল্লির চাঁদনীচৌকে যাওয়ার মতো। এক জায়গায় দেখেন ভিড়। তিনি ভিতরে যাওয়ার উপক্রম করতেই ডোমরা তড়িঘড়ি পথ করে দিল। একটা ছেলে গাছ থেকে পড়ে পা মচকিয়েছে। তার মা হাউমাউ করে আসমান ফাটিয়ে টুকরো টুকরো করে জমিনের উপর ফেলছে।

গুল বাহাদুর বরিশাল গান ফাটিয়ে বললেন, চোপ!

মার কথা দূরে থাক সুবে ডোমিস্থান সে হুঙ্কারে কে কার ঘাড়ে পড়বে ঠিক নেই। এই যে খুদাতালার এত বড় দুনিয়া, তার আধেকখানাই তো ওই তেপান্তরি মাঠ, সেখানেও যেন তারা পালাবার পথ পাচ্ছে না। হুঙ্কার তারা বিস্তর শুনেছে, নামাবলীও বিস্তর দেখেছে, কিন্তু নামাবলীর তলা থেকে এ রকম অট্টরব! নিরীহ গোপীযন্ত্র থেকে গদরের কামান ফাটে নাকি!

চোপ বলে গুল বাহাদুরের হাত গোঁফের দিকে উঠেছিল। তখন মনে পড়ল তিনি গোঁফ কামিয়ে ফেলেছেন।

গুল বাহাদুর ছেলেটার পায়ে হাত বুলোতে লাগলেন।

কে এক ওলন্দাজ না অন্য জাতের অর্টিন্ট বলেছেন, যারা এচিং কিংবা অন্য কোনও প্রিন্টিঙের কাজ করে তাদের হাতের তেলো হবে রাজকুমারীর মতো কোমল, পেশি হবে কামারের মতো কট্টর। প্লেট থেকে ফালতো রঙ তোলার সময় রাজকুমারীর মখমলি তেলো দিয়ে আলতো আলতো করে তুলবে রঙ, আর প্রিন্ট করার সময় দেবে কামারে পেশির জোরে মোক্ষম দাবাওট!

গুল বাহাদুর তাঁর মোলায়েম তেলো দিয়ে ছোঁড়াটার গোড়ালি বুলোতে বুলোতে হঠাৎ পা-টা পাকড়ে ধরে কামারের পেশি দিয়ে দিলেন হ্যাঁচকা ঝাঁকুনি। ছেলেটা আঁৎকে উঠে রব ছাড়ল, কক্!

তিনি বললেন, ঠিক্ হৈ, বেটা, আরাম হো-জায়েগা। ফির বন্দর জৈসা কুদেগা।

এতক্ষণ ছেলেটার পা-টা উরু থেকে কাঠের মতো শক্ত হয়ে উপর-নিচ করছিল না, এবারে গুল বাহাদুর সেটাকে কজা-ওলা বাক্সের ডালার মতো উপর-নিচু করলেন। তার পর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তিন দন সোলাকে রাখবে।

রাখবে শব্দটা বর্ধমান অঞ্চলে তাঁর বাঙলা শেখার প্রচেষ্টার ফল। ডোমরা বুঝল। সোলাকেও বুঝল– শুইয়ে, তিন তো সোজা তিন কিন্তু দ-টা কী চি?

গুল বাহাদুরকে গদরের সময় জাত-বেজাতের সেপাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা কইতে হয়েছিল। তিনি তাই শিখে গিয়েছিলেন, বিদেশি কোনও শব্দ না বুঝতে পারলে তাকে শোনাতে হয় এই শব্দের সম্ভব-অসম্ভব যাবতীয় প্রতিশব্দ। যেমন ইনসান বললে যদি না বোঝে তবে বলতে হবে আদমি, তার পর মানস লোগ বেটা বাচ্চা ইত্যাদি। একটা না একটা বুঝে যাবেই।

 গুল বাহাদুর বললেন, তিন্ দন, তিন্ শাম, তিন্ রোজ।

এক ডোম চিৎকার করে বলল, বুঝেছি গো, বুঝেছি। তিন দিন, তে রাত্তির।

জীবনের দীর্ঘতম অংশ চিকনকালা গ্রামে কাটিয়ে গুল বাহাদুর বীরভূমি ডোমি ভাষা শিখেছিলেন কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত তার হিন্দুস্থানি হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বর থেকে তিনি নিষ্কৃতি পাননি। তার দিন শোনাতো দন, কিতাব কতব, হিন্দু হন্দু, বিলকুল বলকল –বাগদিদের কানে।

অঙ্গরখার দাম (চাপকানের নিম্নাঞ্চল) ওঠাতে গিয়ে গোঁফে তা দিতে যাবার মতো তার খেয়াল হল, তিনি ধুতি-উত্তরীয়ধারী।

সেদিন সন্ধ্যায় তিনি আঙ্গিনায় পলাশতলায় চ্যাটাইয়ের উপর শুয়ে। আসমানে দেখেছেন মিজান (দাড়িপাল্লা, মধ্যিখানে তিনটে তারা কাটার মতো, দু দিকে ভার আমাদের কালপুরুষ)। তখন খেয়াল গেল, অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, সবই আগের থেকে উদয় হয়েছেন। মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন, মিজান, অকরব, কওস, সঙ্কুলা, জদি, দলে, হুৎ–!

দিল্লিতেও তিনি ছাতের উপরই থাকতেন বেশিরভাগ।

ঠাকুরদা শখ করে বানিয়েছিলেন যমুনার উপর একখানি চক-মেলানো বাড়ি। বাড়িখানি ছোট কিন্তু উচ্চতায় সে বাড়ি ও-পাড়ার সব বাড়ি ছাড়িয়ে উঠেছিল। আজকের দিনের ভাষায় একেই বলে বাড়ি হাঁকানো। বৃদ্ধ বয়সেও ঠাকুরদার চোখের জ্যোতি ক্ষীণ হয়ে যায়নি। নাতিকে কোলে বসিয়ে বলতেন, ওই দেখো, ওই দেখো, ওই দূরে, যমুনার ওপারে শাহদারা, গজিয়াবাদ, নাতি দেখত ওপারে শুকনো মাঠ খাঁ খাঁ করছে, আর তার মাঝে মাঝে ঝোঁপ-ঝাড়। কুত্ত্বউদ্দীন আইবেক থেকে আরম্ভ করে বাবুর, হুমায়ুন, রফীউদ্দৌলা মুহম্মদ শাহ– সবাই গিয়েছেন ওপারে হরিণ শিকার করতে। বুড়ো বাদশাহের হরিণ-শিকারের বয়স গেছে–তিনি এখন লাল কেল্লার ছাতের উপর থেকে ওড়ান ঘুড়ি। শাহজাদারা এখনও যান, তিনিও বহুবার গিয়েছেন।

বাহাদুর শাহ ভালো কবিতা লিখতে পারতেন। অবশ্য সে যুগের শ্রেষ্ঠ কবি জওক ও গালিবের তুলনায় তাঁর রচনা নিম্নাঙ্গের। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার কবিতায় এমন একটা সরল সহৃদয়তার গুঞ্জন থাকত যেটা কারও কান এড়িয়ে যেত না। এবং তার মধ্যে ছিল এমন একটা সদ্গুণ যেটা জওক কিংবা গালিব কারওরই ছিল না। জওক-গালিবের মধ্যে হামেশাই হত লড়াই। তৎসত্ত্বেও একে অন্যের প্রশংসা করতেও তারা কুণ্ঠিত হতেন না। শোনা যায় শ্রেষ্ঠতর কবি গালিব নাকি এক মুশায়েরাতে (কবি সম্মেলনে) জওকের কোনও কবিতার দু ছত্র শুনে তাঁকে সর্বসমক্ষে বার বার কুর্নিশ করতে করতে বলেছিলেন, আপনার এ দুটি ছত্র আমাকে বখশিশ দিন; আমি তার বদলে আমার সমস্ত কাব্য আপনাকে দিয়ে দেব। কিন্তু এদের বাক্যের চিকন কাজ বাদশাহ বাহাদুর শাহ যতখানি অনুভব করতে পারতেন, এরা একে অন্যের ততখানি পারতেন না। বাহাদুর শাহ ছিলেন সে যুগের– সে যুগের কেন, তাবৎ উর্দু যুগের সবসে বঢ়িয়া সমজদার।

গদর আমলের ইংরেজরা তাঁর কাব্যপ্রেমকে নিয়ে কত যে ব্যঙ্গ-পি ঠাট্টামস্করা করেছে তার অন্ত নেই। তাদের রাজদরবারেও পোইট লরিয়েট নামক একটি প্রাণী পোষা হয়। তাদের কুরান-পুরাণে আছে, গ্রেট ন্যাশনাল অকেশনে তিনি টপ্পা-ফপ্লাভি লিখতে পারেন, ওইসব অকেশনে দর্জি-ওস্তাদরা যে রকম রাজা-রানির পাতলুন-বুসাৰ্জ বানায়, কিংবা বলতে পারেন হটেন্টটদের রাজদরবারে পালপরবে যে রকম পোষা বাদর দু চক্কর নাচভি লেচে ল্যায়।

আসলে তাদের রাজারা দেবসেনাপতি, অসুরমর্দন, রুদ্ৰাত্মজ কার্তিকের বংশ-অবতংস। তাঁরা তীব্রতম চিৎকারে আকাশ বাতাস সসাগরা পৃথিবী (যে রাজত্বে সূর্য অস্তমিত হন না) প্রকম্পিত করে শিকার করেন খ্যাকশ্যালী। দি লর্ড বি থ্যান্ট– তাঁদের কাণ্ডজ্ঞান আছে।

তাবৎ ইংরেজই অগা, ও-কথা বলা বোধহয় অন্যায় হবে। কারণ পরবর্তী যুগের এক ইংরেজই দুঃখ করে বলেছেন, যেসব গাড়লরা গদরের সময় ভারতবর্ষ শাসন করত তাদের সামনে শেলি কিংবা কিটস এলে যে সম্মান বা অসম্মান পেতেন কবি বাহাদুর শাহ সেই গবেটদের কাছে সেই মূল্যই পেয়েছেন। এবং সেসব সম্বন্ধীরা এই মামুলি খবরটুকুও জানত না যে, তাদের দুই নম্বরের মাথার মণি ওয়ারেন হেস্টিংসও কবিতা লিখতেন, এবং ইংরেজ লেখক জোর গলায় বলেছেন, সে কবিতা বাহাদুর শাহের কাব্যের তুলনায় অতিশয় নিকৃষ্ট এবং ওঁচা।

গুল বাহাদুরের মনে পড়ল, গদর শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে নওরোজের রাতে যে মুশায়েরা বসেছিল তাতে সভাপতির আসন নিয়েছিলেন বাদশা সালাম বাহাদুর শাহ। সেই শেষ মুশায়েরা।

থাক্ থাক, কী হবে ভেবে?

ভাববই না কেন? আমার অতীতকে আমি আঁকড়ে ধরে থাকব না, আর ভবিষ্যৎকেও আমি আলিঙ্গন করতে ভয় পাব না।

রাজত্ব বধূরে যেই করে আলিঙ্গন
তীক্ষ্ণধার অসি পরে সে দেয় চুম্বন।

কী ভয় তাতে? আমার রথ চলবে এগিয়ে, রথের পতাকা পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে কাপবে অতীতের স্মরণে। তাই বলে কি আমার এগিয়ে চলা বন্ধ হবে?

বরঞ্চ বলব, নবজন্ম লাভ, অবশ্য আমি জাতিস্মর।

এই তো সেই আকাশ। এ আকাশ আর দিল্লির আকাশে তো কণামাত্র তফাৎ নেই। এ আকাশ তো আমার। হেসে মনে পড়ল ফিরদৌসির একটি দোঁহা। সম্পত্তির ভাগাভাগির সময় একজন অন্য বখরাদারকে বলল

আজ ফর্শ-ই-খানা তা ব লব-ই বাম্ আজ আন্-ই-মন্
আজ বাম্-ই-খানা তা ব সুরইয়া আল্ আন্-ই-তো।
মেঝের থেকে ছাতটুকু তাই নিলেম কুল্লে আমি
ছাতের থেকে আকাশ তোমার সেইটে তো ভাই দামি।

প্রথম যখন দোঁহাটি পড়েছিলেন তখন তার মনে হয়েছিল এ কী কাষ্ঠ রসিকতা! আজ হৃদয়ঙ্গম হল, এ শ্লেষ নয়, বিদ্রূপ নয়– ছাত থেকে আকাশই মূল্যবান সেখানেই মুক্তি, সেখানেই নির্বাণ।

ওই তো আকাশের তারা। তাঁর পেয়ারা ঘোড়ার জিনের সামনের উঁচু দিকটা ঠিক এই রকমই পেতলের স্টাড দিয়ে তারার মতো সাজানো ছিল। এ তো কিছু অজানা সম্পদ নয়। দার্শনিক গজ্জালিও তার সৌভাগ্য স্পর্শমণি (কিমিয়া সাদৎ) গ্রন্থে বলেছেন, আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে দেখো, আর আপন অন্তরের দিকে তাকাও বুঝতে পারবে সৃষ্টির মাহাত্ম্য।

দুই-ই অলঙ্ঘ্য নিয়ম অনুসারে চলে। শুধু হৃদয়ের আইন বোঝা কঠিন। স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে ভাবি, স্বেচ্ছায় করছি- তারারাও হয়তো তাই ভাবে।

তরল অন্ধকার। এ অন্ধকার বুকের উপর দুঃস্বপ্নের মতো চেপে বসে। এর চেয়ে অনেক বেশি মসীকৃষ্ণ দেখাচ্ছে পলাশের ডালগুলো। তারা আঁকাবাঁকা শাখা দিয়ে অন্ধকারের গায়ে এঁকেছে বিচিত্র আলিম্পন। গাছের শক্ত ডাল, অশরীরী অন্ধকার, দূরদূরান্তের তারার দেয়ালি– সবাই একসঙ্গে মিলে গিয়ে পেলব মধুর স্পর্শ দিয়ে শান্তি এনে দিচ্ছে গুল বাহাদুরের দগ্ধ ভালে। এইটুকু তার চোখের মণিতে ধরা দিয়েছে সে সন্ধ্যার অনন্ত আকাশ থেকে পলাশের ডগাটুকু পর্যন্ত। যমুনার পারে প্রাসাদের উপরে এরা তাকে যেমন করে সোহাগ জানাত ঠিক তেমনি তারা এসে ধরা দিল ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর শায়িত ফকির গুল বাহাদুরের কাছে।

কৃতজ্ঞ গুল বাহাদুর তার দীর্ঘ দুই হাত তাদের দীর্ঘতম প্রসারণে উচ্চ বিস্তার করে আসমানের দিকে তুলে মোনাজাত করলেন,

তোমার আমার মাঝখানে, বিভু, নাই কোনও বাধা আর
তোমার আশিস বহিয়া আনিল তরল অন্ধকার।

.

০৩.

আরব্য রজনীর গল্পে আছে কোথায় যেন দমস্কস্ না বাগদাদ শহরে, এক ঝুড়ি আণ্ডা সামনে নিয়ে বসে অন-ন শার স্বপ্ন দেখছিল। হুবহু স্বপ্ন না, দিবা-স্বপ্ন। ওই ডিমগুলোই তার সাকুল্য সম্পত্তি। এক ডিম বিক্রি করে মুনাফা দিয়ে সে কিনবে আরও ডিম। তারই লাভে পুষবে মুরগি। তারই লাভে সে যাবে হিন্দুস্থান, সদাগরি করতে। তারই লাভে সে হয়ে যাবে শেষটায় শহরের সবচেয়ে মাতব্বর আমির। তখন প্রধানমন্ত্রী উজির-ই-আলা– যেচে-সেধে তাঁর মেয়েকে দেবেন তার সঙ্গে বিয়ে। তার পর আরও অনেক কিছু হবে। হয়ে হয়ে একদিন এই এমনি খামোখা তার রাগ হয়েছে বেগম সায়েবার ওপরে। তিনি অনেক সাধাসাধি করেছেন তার মান ভাঙাবার জন্য। অন-নশ শার মানিনী শ্রীরাধার মতো অচল অটল। বরঞ্চ হঠাৎ আরও বেশি ক্ষেপে গিয়ে মারলেন বেগম সায়েবাকে এক লাথ। হায়রে, হায়! এতক্ষণ ছিল সুদ্ধমাত্র খেয়ালের পোলাও খাওয়া, দিবা-স্বপ্ন এখন অন্-নশ শার মেরে দিয়েছে সত্যিকার লাথি। সেটা পড়ল সামনে-রাখা ডিমের ঝুড়ির উপর। কুল্লে আণ্ডা ভেঙে ঠাণ্ডা।

এ গল্প কখনও ফ্রক পরে ইংলন্ডে, কখনও দাড়ি রেখে আফগানিস্তানে সর্বত্রই প্রচলিত আছে। এবং সর্বযুগেই সর্বদেশের প্র্যাকটিকেল পাণ্ডারা বেচারি অনু-নশ শারকে নিয়ে কতই না ব্যঙ্গোক্তি করেছেন। সে-ও লজ্জায় রা-টি কাড়ে না।

কিন্তু এ কথাটা কেউ ভেবে দেখে না যে, এ সংসারে অহরহই প্রাত্যহিক জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি ছাড়িয়ে যারা বৃহত্তর ভুবনে চলে যেতে জানে তাদের সবাই অন্-নশ শার– ওই শেষ লাথিটুকু বাদ দিয়ে। যারা আপন নাকের ডগার বাইরে তাকাতে জানে না তারাই দৈনন্দিন দৈন্যে শেষদিন পর্যন্ত নাকানি-চুবানি খায়। দিবাস্বপ্ন আলবৎ দেখতে হয় কিন্তু শেষ লাথিটুকু বাদ দিয়ে। গুল বাহাদুর ঠেকে শিখেছেন। গদরের আণ্ডা বিক্রি হওয়ার পূর্বেই তারা স্বাধীনতার উজির-কুমারীকে লাথি মেরে বসিয়েছিলেন। তিনি সাবধান হয়ে গিয়েছেন। এখন আর কুঁড়েঘরে বসে বালাখানা-রাজপ্রাসাদের স্বপ্ন নয়, গদরের খেয়ালি পোলাও নয়। এখন দেখতে হবে নাকের ডগা ছাড়িয়ে ত্রিশ গজ দূরের স্বপ্ন মাত্র সাংসারিক সচ্ছলতার স্বপ্ন।

তাঁর প্রথম আণ্ডা এল অযাচিত, অপ্রত্যাশিতভাবে।

ডোমেরা এসে সভয়ে তাঁকে নিবেদন জানাল, শিবু মোড়ল যায় যায়। মরার আগে বাবাজির চরণধূলি চায়।

গুল বাহাদুর পড়লেন বিপদে। ওপারে যাওয়ার সময় মুসলমান যেসব তওবা-তিল্লা করে থাকে অনেক হিন্দুদের প্রায়শ্চিত্ত কিংবা জৈনদের পর্যসনের মতো সেগুলো তিনি কোনওমতে সামলে নিতে পারেন, কিন্তু হিন্দুধর্মের তিনি জানেনই-বা কতটুকু? তার আমলে দিল্লির হিন্দুরা তো শিক্ষা-দীক্ষায়, সংস্কৃতি-সভ্যতায় পুরো-পাক্কা মুসলমান বনে গিয়েছে। তারা পরে চোৎ চুড়িদার পাজামা, লম্বা শেরওয়ানি, মাথায় দুকল্পি কিস্তি টুপি আর মুশাইরায় হাঁটু গেড়ে বসে বয়েৎ আওড়ায়– মক্কা-মদিনার মালিক, ইয়া আল্লা, আমাকে ডেকে নাও নবীর নূর হজরত মুহম্মদের পদপ্রান্তে।

বরন্দাবন (বৃন্দাবন)-কে কুন্জ গলিয়ামে (কুঞ্জ গলিতে) কিসজি (শ্রীকৃষ্ণ) কভি কভি বাসরী (বাশরী) বৃজাওৎ (বাজান), এই তো হিন্দুধর্ম বাবদে তাঁর এলেম! ওইটুকু জ্ঞানের ন্যাজ তিনি শিবু মোড়লের হাতে তুলে দিয়ে তাকে নির্ভয়ে বৈতরণীতে নাবতে ভরসা দেবেন কী প্রকারে?

ধরা পড়ার ভয় আছে, অথচ না গিয়েও উপায় নেই। গুল বাহাদুর মনে মনে বললেন, চুলোয় যাক গে। এ রকম ভয়ে ভয়ে কাটাব আর কতদিন! মৃত্যু যে অহরহ মানুষের চুলের ঝুঁটি পাকড়ে ধরে আছে সেটা স্মরণ করে কটা লোক? কিংবা বলা যায়, গুল বাহাদুর ভাবলেন, গায়ে শু মেখে বসে থাকলেই কি আর যম ছেড়ে দেবে?

শিবু মোড়লের ইঙ্গিতে সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল–মায় তার ছ বচ্ছরের ছেলেটাও। অবাক ইশারায় গুল বাহাদুরকে তক্তপোশের একদম কাছে ডেকে নিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমার ছেলেটাকে তুমি মানুষ করো। সব তোমাকেই দিলুম।

গুল বাহাদুর ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছেন। ছেলেটার ভার কাঁধে তুলতে তার কণামাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি যে আসলে মুসলমান।

মোড়ল বলল, আমার অনেক শক্র; ছেলেটাকে মেরে ফেলবে।

দুশ্চিন্তার ভিতরও গুল বাহাদুরের মনে পড়ল, হজরত মুহম্মদের পূর্বেও আরবরা ছিল বর্বর। তারাও নির্ভয়ে অনাথকে মেরে ফেলে তার টাকাকড়ি উট তাম্বু কেড়ে নিত। তাই হজরতের নবধর্ম স্থাপনার অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল অনাথের রক্ষা। মনে পড়ল, স্বয়ং আল্লা হজরতকে মধ্যদিনের আলোর দোহাই, নিশির দোহাই, ওরে বলে তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে তিনিও অনাথরূপেই জন্ম নিয়েছিলেন,

অসহায় যবে আসিলি জগতে তিনি দিয়েছেন ঠাঁই,
তৃষ্ণা ও ক্ষুধা আছিল যা সব মুছায়ে দেছেন তাই।
পথ ভুলেছিলি, তিনিই সুপথ দেখায়ে দেছেন তোরে
সে-কৃপার কথা স্মরণ রাখি। অসহায় শিশু, ওরে,
 দলিনে কভু। ভিখারি-আতুর বিমুখ যেন না হয়।
তাঁর করুণার বারতা যেন রে ঘোষিস জগৎময়।

এ তো আল্লার হুকুম, রসুলের আদেশ। মানা-না-মানার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তোমার ঘাড় মানবে।

কিন্তু তিনি যে মুসলমান। ডোম হোক আর মেথরই হোক, মোড়লের ছাবালের মুখে তিনি জল তুলে দেবেন কী প্রকারে? গুল বাহাদুর চুপ।

শিবু তার লাল ঘোলাটে চোখ মেলে তাঁর দিকে তাকাল কিছুক্ষণ। তার পর ধীরে ধীরে বলল, গোসাই, তুমি গোসাই নও, সে কথা আমি জানি। তুমি কী, তা-ও আমি জানি। কিন্তু আর কেউ জানে না। জানার দরকারও নেই।

কী করে জানলে? এ প্রশ্ন গুল বাহাদুর শুধালেন না। তিনি পল্টনের লোক; বললেন, আমি মুসলমান, জানো?

শিবুর শুকনো মুখ খুশিতে তামাটে হয়ে উঠল। গুল বাহাদুরের হাতখানা আপন হাড্ডিসার দু হাতে তুলে নিয়ে বলল, বাঁচালে, গোসাঁই, তরালে আমাকে। তার পর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মুসলমানেরই এক দর্গায় মানত করে মা পেয়েছিল আমাকে। আমি পেয়েছি আনন্দীকে। পীর সৈয়দ মরতুজার ভৈরবীর নাম ছিল আনন্দী।

মুসলমান পীরের দরগায় যে হিন্দু বন্ধ্যা সন্তানের আশায় যায়, এ দৃশ্য গুল বাহাদুর বহুবার দেখেছেন দিল্লিতে নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার দরগায় কিন্তু পীরের আবার ভৈরবী হয় কী করে, আর ভৈরবীই-বা কী চিজ, আনন্দী শব্দটাও হিন্দু হিন্দু শোনায়, এসব গুল বাহাদুর কিছুই বুঝতে পারলেন না। কে জানে মুসলমান ধর্ম বাঙলা দেশে এসে কী রূপ নিয়েছে।

বাচ্চাকা ভালা বোলনা-চোলনা, বহুড়ীকা ভালা চুপ–বাচ্চার ভালো বকবকানো, কনের ভালো চুপ ভালো সেপাইও বহুড়ীর মতো চুপ করে শুনে যায়, গুল বাহাদুর চুপ করে শুনে যেতে লাগলেন।

মোড়লের দম ক্রমেই ফুরিয়ে আসছিল। তাই আশকথা-পাশকথা সম্পূর্ণ বর্জন করে শুধু তার ইচ্ছাগুলো বলে যাচ্ছিল, বিষয়-আশয় বোঝবার বয়স হলেই তাকে মামার বাড়ি বিষ্ণুপুরে পাঠিয়ে দিয়ো। সেখানে তার জমিজমা এখানকার চেয়ে ঢের বেশি।

গুল বাহাদুর পুরনো কথায় ফিরে গিয়ে শুধালেন, তোমার ছেলে আমার সঙ্গে থাকলে মুসলমান হয়ে যাবে না।?

মোড়ল বলল, না। আমরা জাতে ডোম। মুসলমানের হাতে খেলেও আমাদের জাত যায় না, আমরা মুসলমানও হইনে। থাক্‌ অতশত কথা। তুমি নিজেই জেনে যাবে। শোনো, আর যা করতে হয় করো, ছেলেটাকে কিন্তু লেখাপড়া শিখিয়ো না, ওকে ভদ্রলোক বানিয়ো না।

সে কী!

না, ভদ্রলোক বানিয়ো না। আর শোনো, জলের কলসির তলায় মাটির নিচে কিছু টাকা আছে। তোমাকে দিলুম।

গুল বাহাদুরের আবার মনে পড়ল, হজরত তার যৌবন আরম্ভ করেছিলেন, এক বিধবার ব্যবসায়ের কর্মচারীরূপে। বললেন, টাকা ব্যবসাতে খাটাব। তোমার ছেলে পাবে মুনাফার আট আনা।

মোড়ল বলল, যা খুশি কর, কিন্তু লগ্নির ব্যবসা কর না।

 গুল বাহাদুরের মুখ লাল হয়ে উঠল। ভদ্র মুসলমান সুদের ব্যবসা করে না।

মোড়ল বলল, আর শোন, খুশ বিরামপুরের ঘোষালদের মেজবাবুর সঙ্গে আলাপ কর। তোমারই মতো। কিন্তু সাবধানে। আর শোন, তোমারই মতো আরেকজন আশ্রয় নিয়েছে বর্ধমানের কাছে, দামোদরের ওপারে–

এবারে গুল বাহাদুর আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তবু উত্তেজনা চেপে রেখেই তাড়াতাড়ি শুধালেন, কোন গ্রামে?

মোড়ল তখন হঠাৎ চলে গিয়েছে ওপারে, যেখানে খুব সম্ভব গ্রামও নেই, শহরও নেই।

গুল বাহাদুর দু হাত দিয়ে ধীরে ধীরে মোড়লের চোখ দুটি বন্ধ করে দিলেন। মনে মনে আবৃত্তি করলেন,

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

আল্লার কাছ থেকে এসেছি, আর তার কাছে ফিরে যাব। কাফেরের মৃত্যুসংবাদ শুনলে কট্টর-মোল্লা কট্টর উল্লাসভরে এ মন্ত্র উচ্চারণ না করে বলে ওঠে ভিন্ন মন্ত্র–

ফি নারি জাহান্নামা।

একমাত্র ইংরেজদের মৃত্যুসংবাদ শুনলে গুল বাহাদুর দ্বিতীয় মন্ত্রটি একশোবার আবৃত্তি করতেন। আল্লার একশো নাম– মানুষ তার নিরানব্বই জানে– সেই নিরানব্বই নামের উদ্দেশে নিরানব্বই বার আর শয়তানের উদ্দেশে একবার।

দাহ-কর্ম শ্রাদ্ধ, তা-ও আবার ডোমের, এসব কোনওকিছুই গুল বাহাদুর জানতেন না, জানবার চেষ্টাও করলেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখলেন। তবে তাঁর গম্ভীর আঁটসাট মূর্তি আনন্দীর হাত ধরে না দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো ঝগড়াঝাটি হতে পারত। মোড়লের মরে যাওয়ার পর বাড়ির সামনে যে ভিড় জমেছিল তার দিকে একবার তাকিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন, শাহ্-ইন-শাহ্ বাহাদুর শার দরবারে যদি দৈবপাকে চিকনকালা গ্রামের মাতব্বরদের কুর্নিশ জানাবার অনুমতি লাভ হত তবে তাতে দুই নম্বর হত কে? পয়লা নম্বর তো চলে গিয়েছেন, দুই নম্বর হতেন ঝিঙে সরদার। ভিড়ের মধ্যে ঝিঙের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে ভারি গলায় হুকুম দিলেন, ইধর আও।

ঝিঙে ভয়ে ভয়ে, লোকলজ্জায় কিছুটা বুক ফুলিয়ে, এগিয়ে এল– ভিড় রাস্তা করে দিল। ঝিঙের সঙ্গে শিবুর সদ্ভাব ছিল না।

গুল বাহাদুর বললেন, সব-কিছু চালাও।

ঝিঙে গলে গেল। তার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না, শিবু গত হলেই সে হবে গাঁয়ের মোড়ল। মধ্যিখানে বাদ সাধল এই লক্ষ্মীছাড়া বাবাজি। শিবু নিশ্চয়ই মরার সময় এ-ব্যাটাকে বিষিয়ে গেছে। তা হলে এটা হল কী করে? থাক্ এখন, পরে জানা যাবে।

ঝিঙে ডবল উৎসাহে সবকিছু সামলাল। বেশিরভাগ ব্যবস্থা শিবু মরার আগেই করে গিয়েছিল।

শ্মশান থেকে ফিরে এসে ঝিঙে সরদার শিবু মোড়লের দাওয়ায় গুল বাহাদুরের কাছে এসে বসল। গাঁয়ের দু-চারজন তাদের কথার্বাতা শোনবার জন্য এগিয়ে এলে ঝিঙে দিল তাদের জোর ধমক। তারা গুল বাহাদুরের দিকে আপিল-নয়নে তাকাল কিন্তু তার কোনও ভাব-পরিবর্তন না দেখে আস্তে আস্তে সরে পড়ল।

তখন তিনি অতি শান্তকণ্ঠে, ধীরে ধীরে বললেন, মোড়ল, ধমক না দিয়েই যেখানে কাজ চলে সেখানে ধমকের কী দরকার! কিন্তু সে তুমি বোঝো। আমি বলবার কে? আমি তো এদের চিনিনে। এদের কী করে সামলাতে হয় তার খবর রাখো তুমি।

মোড়ল সম্বোধনে ঝিঙে একেবারে পানি হয়ে গেল– জল তো হয়ে গিয়েছিল আগেই। হাতজোড় করে বলল, দেবতা, অপরাধ হয়েছে। কিন্তু ওদের থাকতে বললে না কেন?

গুল বাহাদুর প্রথমেই লক্ষ করলেন ঝিঙে তোতলা। তোতলাকে মোড়ল বানানো কি ঠিক? তখন মনে পড়ল, একাধিক পয়গম্বরও ছিলেন তোতলা।

ঝিঙের কথার উত্তরে বললেন, তুমি মুরুব্বি, একটা হুকুম দিয়েছ। আমি উল্টো কথা বললে তোমার মুখ থাকত কি?

ঝিঙে কিন্তু শিবুর মতো বিচক্ষণ লোক নয়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুধাল, শিবু তোমাকে বলে যায়নি আমাকে মোড়ল না করতে?

গুল বাহাদুর বললেন, না।

 শিবুর মতো বিচক্ষণ নয় ঝিঙে, কিন্তু সে শিবুর চেয়ে অনেক বেশি ঘড়েল।

 ভাবখানা করল, ওহ! শিবু যদি বলত তবে তুমি আমায় ডাকতে না।

গুল বাহাদুর বললেন, শোন সরদার, শিবু সব কথা বলে যাবার ফুরসত পায়নি। পেলেও যে তোমার কথা বলত, তা-ও তো জানিনে। আর ওর বলাতে না-বলাতে কিছু আসে-যায় না। সে গেছে, এখন গাঁ চালাব আমরা। ওর ইচ্ছে বড়, না, গাঁ-চালানো বড়? ও যদি বলে যেত, আনন্দী গা চালাবে, তা হলে তোমরা কি সেটা মানতে?

গুল বাহাদুরের মনে পড়ল হজরত মুহম্মদও ইহলোক ত্যাগ করার সময় মুসলমানদের জন্য কোনও খলিফা নিয়োগ করে যাননি। গুল বাহাদুর আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, তবে কি অনুন্নত সম্প্রদায়ে এই ব্যবস্থাই বেশি কার্যকরী? তবে কি বংশগত রাজ্যাধিকার পরবর্তী যুগের সৃষ্টি? তার পর মনে পড়ল, ঐতিহাসিক ইবনে খলদুন তার পৃথিবীর ইতিহাসে এই নিয়ে কী যেন এক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। ভাবলেন, দেখতে হবে। তার পর মনে পড়ল, এখানে তো বইপত্র কিছুই নেই। যাক্ গে এসব কথা।

ঝিঙেকে বললেন, কানাবুড়ি বাতাসীকে বল সে এ ভিটেয় থাকবে। ঝিঙে অবাক। বাতাসীর মতো অথর্ব অচল ঝগড়াটে সাড়ে ষোল আনা অন্ধ এ তল্লাটে দুটি নেই। তার গলাবাজির চোটে পুঁদে মোড়ল শিবুও তার তল্লাট মাড়াত না।

ঝিঙে গুল বাহাদুরের মতলব আদপেই বুঝতে পারেনি। তিনি জানতেন, শিবুর যে কিছু লুকানো টাকা আছে সেটা সকলের অজানা না-ও হতে পারে। রাত্রে ভিটে খোঁড়ার জন্য চোর আসতে পারে। বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে না আসতে বুড়ি চিৎকার করে করে পাঁচখানা গাঁয়ের লোক জড়ো করে ফেলবে। অন্ধের শ্রবণশক্তি চক্ষুম্মানের চেয়ে বেশি। দিল্লির জামি মসজিদের দেউড়িতে এক অন্ধ শুধু গলা শুনে হাজার লোকের জুতো সামলায়। মাদ্রাসার ছোঁড়াদের কেউ মজা দেখবার জন্য অন্যের গলা নকল করলে অন্ধ দু-জোড়া জুতো বাড়িয়ে দিয়ে বলত, এই নাও তোমার জোড়া, আর এই নাও যার নকল করছিলে। লোকে বলত, আগ্রাতে শুকনো পাতা ঝরে পড়লে এ অন্ধ দিল্লির চাঁদনি চৌকে বসে শুনতে পায়। বাতাসী অতখানি কেরানি হয়তো দেখাতে পারবে না, কিন্তু দুটি বেগুন বাঁচাবার জন্য যে বেটি সমস্ত রাত দাওয়ায় বসে কাটায় তার চেয়ে ভালো পাহারাওলা পাওয়া যাবে কোথায়? এখন কয়েক রাত তো পাড়াপ্রতিবেশীরা কান খাড়া রেখে ঘুমুবে শিবুর ভিটেতে খোঁড়াখুঁড়ির শব্দ হচ্ছে কি না শোনবার জন্যে। কয়েকটা রাত যাক, তার পর তিনি সুবিধেমতো তার ব্যবস্থা করবেন।

কিছুক্ষণের ভিতরই শোনা গেল পাড়ার শেষপ্রান্ত থেকে বাতাসীর চিৎকার। চিকনকালা গ্রামটাকে সে বেতারকেন্দ্র বানিয়ে বিশ্বভুবনকে জানাচ্ছে, শিবু গেছে বেশ হয়েছে, আগে গেলেও কেউ মানা করত না, বাতাসী তো নয়ই, কিন্তু এ কী গেরো, সে কেন সামলাতে যাবে শিবুর গোয়াল-খামার, ওই দিকধিড়িঙে মিনসে বাবাজিটা আছে কী করতে, তাকেই তো শিবু ঘটিবাটি চুলো-হাঁড়ি সব-কিছু দিয়ে গিয়েছে, মরে যাই, আর লোক পেল না, কোথাকার হাড়হাভাতে শতেক খোয়ারি- আরও কত কী!

গলার শব্দ কিন্তু এগিয়ে আসছে শিবুর বাড়ির দিকেই।

মোগল শাসনেও চার্জ দেওয়া-নেওয়া নামক মস্করাটা চলত। গুল বাহাদুর সে-মস্করাটা বাতাসীর সঙ্গে করার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তাঁর ঘাড়েও তো মাথা মাত্র একটা। সেটা তো চায় ইংরেজ। বুড়িকে দিয়ে চলবে কেন?

আনন্দীকে হাতে ধরে নিয়ে বললেন, চলো।

যেতে যেতে আনন্দী বলল, দাদু, বাবা আমাকে বলেছিল, বাতাসী পিসিকে বাড়ি নিয়ে আসতে। সে তো বলছে, আসবে না।

গুল বাহাদুর ভারি খুশি হলেন। প্রথমত শিবু যে আহাম্মুখ ছিল না, তার শেষ প্রমাণ পাওয়া গেল বলে এবং তার চেয়েও বড় কথা, ছ বছরের আনন্দীর বুঝ-সমঝ আছে দেখে। বাপকা ব্যাটা না হলেও তার ঘোড়া তো নিশ্চয়ই। জোর গলায় হেসে বললেন, কুছ পরোয়া নহি, দাদু, ও বেটি সব-কুছ সম্হালেগি, তার পর বললেন, সমহালেগা। মনে মনে বললেন, দচ্ছাই ভাষা, স্ত্রীলিঙ্গ, পুংলিঙ্গে ফারাক নেই। তার পর বললেন, সেই তো ভালো। এরা তো আর দিল্লি দরবারে মুশায়েরা করতে যাবে না যে ভাষাতে পয়ষট্টি রকমের বয়নাক্কার প্রয়োজন। ওই করেই তো আমাদের সব গেল। তার পর মনে পড়ল, কই, তাই-বা কেন? মাহমুদ বাদশাহ তো তাঁর সভাপণ্ডিত ফিরদৌসির সঙ্গে বয়েৎ-বাজি করতেন। তাঁর রাজত্ব তো যায়নি। বাহাদুর শা গালিবের সঙ্গে করলেই-বা কী দোষ! ফারসির কথাতে তখন মনে পড়ল, সে ভাষাতেও তো পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গের তফাৎ নেই। বিরক্ত হয়ে তখন বললেন, কী আশ্চর্য! চলছি ডোমবস্তির মধ্যিখান দিয়ে, আর স্বপ্ন দেখছি গজনির। অন্-নশূ শারও এর চেয়ে ভালো। আমাকে এখন দেখতে হবে, ছেলেটার পেটে ক্রিমি।

গুল বাহাদুর পড়েছেন এ বাবদে বিপদে। ক্রিমির নুসখা (প্রেসক্রিপশন) তিনি দু মিনিটেই লিখে দিতে পারেন। কিন্তু সেটা লিখতে পারেন উর্দু কিংবা ফারসিতে। এবং তার জন্য যেতে হবে ইউনানি দাওয়াখানায়, হেকিমের কাছে। এ তল্লাটে তো এসব জিনিস থাকার কথা নয়। আর বোষ্টম বাবাজি লিখবেন ফারসি নুসখা! যদিও গুল বাহাদুর জানতেন, বৃন্দাবন অঞ্চলের বাবাজিরা ফারসিতে ইউনানি নুসখা বিলক্ষণ লিখতে জানেন।

গুল বাহাদুরের ভুল নয়। চৈতন্যদেব ইসলামি শাস্ত্রের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি একাধিকবার ইসলামি শাস্ত্র দিয়েই মোল্লাদের কাছে প্রমাণ করেন যে তার প্রচলিত ধর্ম ইসলামের মৌলিক সিদ্ধান্তের সম্মতি পায়।

আনন্দী বলল, দাদু, ওই দেখ হলদে পলাশ।

ততক্ষণে তারা গ্রামের বাইরে চলে এসেছেন। আর একটু দূরেই গুল বাহাদুরের রাজপ্রাসাদ।

দূরদূরান্তে চলে গেছে লাল খোয়াই। বাঁ দিকের উঁচু ডাঙা ভেঙে ভেঙে চলেছে খোয়াইয়ের অগ্রগতি। গুল বাহাদুরের আপন দেশ দোয়াবে প্রকৃতির হাত থেকে মানুষ অহরহ অনুর্বর জমি সওগাত পাচ্ছে চাষের জন্য, আর এখানে খোয়াইয়ের খাই আধা-বাঁজা আধা-ফসলের জমির উপর। খোয়াইটা চলে গিয়েছে কতদূরে প্রকাণ্ড একটা লাল সাপের মতো এঁকে-বেঁকে। মাঝে মাঝে ডাঙার ফালিটুকরো এসে যেন সাপের খানিকটে গতিরোধ করছে। ফের যেন অজগরের গ্রাসটা আরও বড় হয়ে আরও দূরে এগিয়ে গিয়েছে।

সূর্যাস্তের শেষ রশ্মিটুকুও যেন এ খোয়াই শুষে নিতে জানে। খোয়াইয়ের শুরু থেকে সূর্যাস্তের মোকাম পর্যন্ত গাছপালার কোনও বালাই নেই। পাতার আড়াল থেকে বিকেলের আলোটুকু এখানে এসে কোনও কালো কেশে পড়ে না। সাঁওতালিনীরাও সন্ধের পরে ভয়ে ঘর থেকে বেরোয় না।

কিন্তু মাধুর্য আছে– সে মাধুর্য রুদ্রের।

কিয়ামতের (মহাপ্রলয়ের) যে বর্ণনা কুরান শরীফে আছে সেটিও রুদ্র-মধুর, আশ্চর্য! আল্লাতালা মানুষের মনে ভয় জাগাবার জন্য কিয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন কুরানে, কিন্তু তার প্রকাশ দিয়েছেন কাব্যরসের মারফতে। কেন? সোজা কথা। ঐতিহাসিক যখন লড়াইয়ের খবর লিপিবদ্ধ করে কত হাজার লোক মরল তার বর্ণনা দেয়, তাতে তো মানুষ ভয় পায় না। কারণ তাতে কাব্যরস নেই। ভয় অনুভূতি-বিশেষ। সেটা জাগাতে হলে কাব্যরসের প্রয়োজন। ইতিহাসের শুকনো ফিরিস্তি থেকে মন করে জ্ঞানসঞ্চয়, তাতে ভয়সঞ্চার হয় না।

এই রুদ্র-রসই এখন গুল বাহাদুরের জন্য প্রশস্ত।

 ভাগ্যিস, তাঁকে পূর্ব-বাঙলার ঘনশ্যাম, কচিসবুজ, শিউলিভরা, শিশিরভেজা, পানাঢাকা বেতেসাজা পূর্ব-বাঙলার আশ্রয় নিতে হয়নি।

গাঁয়ের শেষ গাছ পেরিয়ে এসে তার খেয়াল গেল আনন্দী যেন কী একটা বলেছে। শুধালেন, কী বললে, দাদু?

পিছনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, ওই যে, হলদে পলাশ!

পলাশ হলদে হতে পারে, বেগুনি হতে পারে, সবুজও হতে পারে, এই হল গুল বাহাদুরের ধারণা। কিন্তু তাঁর মনে তবু ধোকা লাগল। গাঁয়ের ভিতর দিয়ে আসবার সময় দু-চারটে ফুলগাছ তারা পেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু আনন্দী কিছু বলেনি। এখনই-বা বলছে কেন? এ গাছটার তেমন তো কিছু জৌলুসও নয়। মাত্র গোটা পাঁচ গুচ্ছ ফুল ফুটেছে। গাছটাও বেঁটে। যেন থাবড়া মেরে চেপটে দেওয়া। এর তুলনায় গাঁয়ের ভিতরকার শিমুলে তো ডালে ডালে ফুল ছিল অনেক বেশি। বললেন, পলাশ– উয়ো তো ফুল। হলদে পিলা। তো ক্যা হল?।

আনন্দী কেমন যেন একটু ভয়ে ভয়ে বলল, সব পলাশ লাল, এটা হলদে। বলে সে আঙুল দিয়ে গাঁয়ের ভিতরকার উঁচু উঁচু গাছের লাল পলাশ দেখিয়ে দিল।

এতক্ষণে বীরভূমের বৃক্ষ-বৃত্তান্ত বাবদে আকাট অগা গুল বাহাদুরের খেয়াল হল, তাই তো, আর সব পলাশ লাল, এটা হলদে।

উদ্ভিদতত্ত্বে এই তাঁর প্রথম পাঠ। আনন্দীর কাছে। বললেন, চলো দুটি ফুল পেড়েই নিই।

ছ বছরের ছেলে আনন্দীর উল্লাসের অন্ত নেই। বাপ যদিও বলেছিল, বাবাজিকে ডরাসনি তবু তার মন থেকে ওঁর সম্বন্ধে ভয় কাটেনি। একে তো গম্ভীর লোক, তার ওপর ওই যে দুশমনের মতো বদমেজাজি ঝিঙেও যার পায়ের কাছে বসে ভয়ে কাঁচুমাচু তার সঙ্গে সাহস করে কথা কওয়া যায় কী প্রকারে। তবে তার শিশুবুদ্ধি শিশুযুক্তিতে একটা ভরসা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছিল। সেটা কী? বাবাজিও বাতাসী বুড়িকে ডরায়। দ্বিতীয় ভরসা পেল এখন। যখন বলল, চল, দুটো ফুল পাড়ি। তার বাপ তাকে ভালোবাসত। তার সম্বন্ধে আনন্দীর কোনও ভয় ছিল না, কিন্তু তাকেও ফুল কুড়োতে বললে ঘাড় বাঁকিয়ে বলত, যা যা, খেলা করগে যা।

ফুল পাড়তে পাড়তে গুল বাহাদুরের মনে পড়ল, গুল অর্থাৎ ফুল আর প্রাচীন ফারসিতে অগ অর্থ জল গোলাপ আর জোলাব একই শব্দ। আরবি ভাষায় গ আর প নেই বলে আরবিতে গোলাপ লেখা হয় জোলাব। বিরেচক অর্থে। ছেলেটাকে তাই খাওয়ালেই হবে। কিন্তু এই অজ জায়গায় গোলাপ পাওয়া যাবে কি?

আনন্দীকে শুধালে বহুদূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বোঝাল ওখানে পাওয়া যায়। কিন্তু যেভাবে ইশারা করল তাতে সে দূরের গ্রাম হতে পারে, বেহেশতের গুল-ই-স্তান, ফুলের বাগানও হতে পারে।

.

০৪.

এতক্ষণে গুল বাহাদুর আসলে ভাবনা নিয়ে চিন্তা করার ফুরসত পেলেন। ছেলেটা নিশ্চিন্ত চেহারায় ঘুমুচ্ছে দেখে তিনি ফিরে গেলেন সকালবেলাকার ঠেলে রাখা সমস্যাগুলোতে।

শিবু মোড়ল বুঝতে পেরেছে তিনি বৈরাগী নন, তিনি যে মুসলমান সেটা জানত না। কিন্তু আর কেউ বুঝতে পেরেছে কি? আর ওই ঘোষালই-বা কে? সেই বর্ধমানের ওপারের লোকটাই-বা ওখানে এল কোথা থেকে? তাকেই-বা খুঁজে পাওয়া যায় কী করে?

অনেক চিন্তা করেও তিনি কোনও হদিস পেলেন না। এমনকি ঘোষাল পদবি যে ডোমের হয় না, ওটা ব্রাহ্মণের পদবি এবং অতএব কাছেপিঠে ব্রাহ্মণ পরিবার আছে, অর্থাৎ শিক্ষা-সভ্যতার পত্তনও আছে, এইটুকু পর্যন্ত গুল বাহাদুর বিচার করে ধরতে পারলেন না।

তবে শিবু যখন বলেছে সাবধান, তখন তার অর্থ তাড়াহুড়ো করলে বিপদের সম্ভাবনা। আর এখন তো বর্ধমান যাওয়ার কোনও কথাই ওঠে না। এ দেশের আচার-ব্যবহার এ ক মাসে শিখেছেন কতটুকুই-বা? ডোমদের ভালো করে চিনে নিতে পারলে পরে ডোম সেজে চলাফেরা করা যাবে। তার আগে শিখতে হবে ওদের ভাষা। এ-যাবৎ তাতেও তো খুব বেশি উন্নতি হয়নি।

আর এই ডোমদের নিয়ে তিনি করবেন নতুন গদর। দেশ কী, রাজা কারে কয়, ইংরেজ যে শয়তান ভিন্ন অন্য কোনও প্রাণী নয়– এসব খবর তো এরা কিছুই রাখে না। পেটের ধান্দায় এদের কাটে সুবো-শাম। খুব যে তারা শান্ত এ কথা বলা চলে না, কিন্তু জীবন-মরণ পণ করে দিনের পর দিন লড়াই চালিয়ে যাবার মতো ধাতু কি এদের শরীরে আছে?

কিন্তু থাকবেই না কেন? গজনির মাহমুদ, ঘোরের মুহম্মদের আমলে গ্রামাঞ্চলের পাঠানরা কি এদের চেয়ে বেশি সঙ্গিন জঙ্গিলাট ছিল? কিংবা বাবুরের আমলে ফরগনা বদখশানের আশপাশের গামড়িয়ারা? কিংবা হাতের কাছের মারাঠারা? একবার কী একটা সামান্য গুজব রটাতে এই দিল্লিবিজয়ী বীরের দল দিল্লি থেকে যেন পালাবার পথ পায়নি। ঐতিহাসিক খাফি খান ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, তখন দিল্লির এক বুড়ি নাকি একাই তিনজন মারাঠাকে নিরস্ত্র করেছিল। ঐতিহাসিক খুশ হাল চন্দও বলেছেন, তারা নাকি তখন হাতিয়ার-তলোয়ার ফেলে দিয়ে ছোট বাচ্চার মতো মাগো, ওমা বলে শহর ছেড়ে পালাচ্ছিল। কিন্তু এসব কাহিনীর বিশ্বাস করা যায় কতটুকু? দিল্লি একদিন এদের হাতে খেয়েছিল মার। সেই বেইজ্জতি ঢাকবার জন্য পরবর্তী যুগে হয়তো তিলকে তাল বানিয়েছে।

তা বানাক, আর না-ই বানাক, এরাই তো একদিন সাহস করে আবদালির মুকাবেলা করেছিল। অবশ্য লড়াইয়ের আগের রাত্রে মারাঠা সেনাপতি ভাবসাহেব আপন রোজনামচায় লিখেছিলেন, আমাদের পেয়ালা পূর্ণ হয়েছে। কাল অবশ্য-মৃত্যুর মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। আমরা মারাঠারা তো কখনও সম্মুখযুদ্ধ লড়িনি; আমাদের রণকৌশল, শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করে তার যথাসম্ভব ক্ষতি করে পালিয়ে যাওয়া বার বার। সর্বশেষে তার সর্বস্ব লুঠ করা।

এ সব-কিছু ভাবসাহেব সত্যই লিখেছিলেন কি না, সে কথা গুল বাহাদুর জানতেন না। তবে এ কথা জানতেন, মারাঠারা সম্মুখসংগ্রাম সবসময়ই এড়িয়ে চলে।

কিন্তু একথাও অতি অবশ্য ঠিক, ভাবসাহেব অবশ্য-মৃত্যু জেনেও আবদালির সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধই লড়েছিলেন। কেন লড়েছিলেন? পেশওয়ার হুকুমে। তাঁর প্রতি আনুগত্য বশ্যতার দরুন। তাঁর নুন-নেমক খেয়েছি। সে নুনের শেষ কড়ি শোধ না করে দেশের লোকের সামনে মুখ বের করব কী করে? কিন্তু দিল্লির বাদশার প্রতি বাঙালি ডোমের কী আনুগত্য, কী বশ্যতা?

তবে কি এদের তাতাতে হবে বাবুর কিংবা মাহমুদের মতো লুঠতরাজের লোভ দেখিয়ে? তার সরল অর্থ দিল্লির বাদশাহর খেদমত করতে গিয়ে তারা করবে দিল্লি লুঠ! এ তো চমৎকার ব্যবস্থা!

তখন বড় দুঃখে তার মনে পড়ল, গদরের সিপাহিরাও বেপরোয়াভাবে যত্রতত্র লুঠতরাজ করেছে। যাদের জন্য স্বাধীনতার সংগ্রাম লড়েছে, লুঠ করেছে তাদেরই। কী মূল্য সে স্বাধীনতার।

গুল বাহাদুরের মাথা গরম হয়ে উঠল। সুরাহির জল ঢেলে মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবলেন, যারা গদর ইনকিলাব করে তারা অতশত ভাবনা-চিন্তা করে না। তিমুর- নাদির বিজয়-অভিযান আরম্ভ করার পূর্বে বু আলী সিনা কিংবা আবু রুশদের দর্শন আর তর্কশাস্ত্রের কেতাব-পুঁথি নিয়ে বিদ্রি যামিনী যাপন করেন না।

ইংরেজ এ দেশের দুশমন, এ দেশের বাদশার দুশমন। তাকে খেদাতে হবে। কীভাবে তাড়াতে হবে তার জন্য মোল্লা-মৌলবির কাছ থেকে ফতোয়া আনবার প্রয়োজন নেই। তা হলে পাড়ার পদী পিসির কাছেও যেতে হয়। তিনি ইতু ঘেঁচুর পুজো-পাটা করে দিন-ক্ষ্যাণ বাৎলে দেবেন– তবে হবে অভিযান শুরু! তওবা, তওবা!! শয়তানের খুন পিনেওলা তলোয়ারকে পয়মন্ত করতে হবে চড়ুইপাখির ন্যাজের পালক দিয়ে!

কিন্তু একটা জিনিস সর্বক্ষণ গুল বাহাদুরের মনে পীড়া দিচ্ছিল। এই যে ছদ্মবেশ পরে আত্মগোপন করে থাকাটা, এভাবে কাপুরুষের মতো কতদিন প্রাণ বাঁচিয়ে থাকতে হবে? দেশ স্বাধীন করার জন্য একটা বড় আদর্শ সামনে ধরেছি বলে এই নীচ আচরণ সর্বক্ষণ হজম করে চলতে হবে? ডোমকে তাতানোর জন্য লুঠতরাজের লোভ কেউ দেখালে সেটা না হয় বরদাস্ত করে নিলুম কিন্তু নিজে একটা নীচ আচরণ করব–এ চেঁকি ঢোঁক গিলে হজম করি কী করে? তা-ও একদিন নয়, দু দিন নয়–কত বছর ধরে কে জানে?

চুলোয় যাক্ গে অত ভয়। চুলোয় যাক গে শিবুর হুশিয়ারির পরামর্শ। আমি বেরুব ঘোষালের সন্ধানে।

কিন্তু ইতিমধ্যে একটা কাজে ডুব না মারলে চিন্তা করে করে পাগল হয়ে যাব যে।

কাজও এসে হুড়মুড়িয়ে পড়ল তার ঘাড়ে।

শিবুর খেতখামার ছিল সামান্যই কিন্তু গুল বাহাদুরের পক্ষে ওইটুকুই যথেষ্ট। সেসব সামলাতে গিয়ে তিনি প্রবেশ করলেন এক নতুন ভুবনে। এটা ধরলে ওটা হাতছাড়া হয়ে যায়, ছাগল দুটোকে সামলাতে গাইটা নাপাত্তা হয়ে যায়। মরাইয়ের ইঁদুর মারতে হলে বেড়াল পুষতে হয়, বেড়ালকে পেট ভরে খেতে দিলে সে আবার ইঁদুর মারার প্রয়োজন বোধ করে না। পচা গোবরের গন্ধে মাথা তাজ্জিম তাজ্জিম করে, অথচ সে গোবরের বরবাদ হবে তা-ও প্রাণ সইতে পারে না।

ইতিমধ্যে ঝিঙে এসে খবর দিল একপাল সাঁওতাল কোশখানেক দূর নদীপারে আস্তানা গেড়েছে। ওদের দিয়ে একটা নতুন আবাদ করানো যায় কি না।

গুল বাহাদুর লম্ফ দিয়ে উঠলেন। এ একটা কাজের মতো কাজ বটে। এ বিষয়ে তাঁর কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতাও আছে। ভাওলপুর না পাটিয়ালা কোথা থেকে একপাল মেয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল পালমে, যেখানে বাবুর শাহের পাথরের তৈরি সরাই– তারই পিছনে। তারই চাচা দানিশমন্দ খান তাদের দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটা সুন্দর আবাদ। চাচার সঙ্গে থেকে থেকে তিনি তখন শিখেছিলেন অনেক কিছু। আজ দেখা যাবে চাচাকা ভাতিজা সে এলেমের কিছুটা স্মরণ রেখেছে কি না।

কিঞ্চিৎ অর্থের প্রয়োজন। শিবুর কলসির তলায় পাওয়া গিয়েছে, শ-আড়াই টাকা। এত টাকা শিবু পেল কোথায়? তবে কি গুপ্তি ডাকাতি করত? তা আসুক সে টাকা জাহান্নাম থেকে। ওই দিয়ে আবাদ আরম্ভ করা যাবে অক্লেশে। তার পর বরাত। আল্লা ভরসা।

প্রথম দিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে গুল বাহাদুর আনন্দীকে সেলাম করে বললেন, হুজুর, আজ থেকে আপনি জমিদার। আপনাকে সমঝে চলতে হবে।

জমিদার হওয়ার রৌদ্ররস আনন্দী জানে না কিন্তু সে চালাক ছেলে। গুল বাহাদুরের মেজাজ আজ খুশ দেখে সে কোলের কাছে ঘেঁষে এসে বলল, দাদু, আমাকে কেঁদুলীর মেলায় নিয়ে যাবে?

গুল বাহাদুরের প্রাণ-যমুনায় তখন আনন্দের উজানতরঙ্গ লেগেছে। আনন্দী তখন শয়তানের জন্মভূমি বিলেত যেতে চাইলেও তিনি তখন ঘিনপিত বাদ দিয়ে সেখানে তাকে নিয়ে যেতেন। শুধালেন, সে কোথায়?

বলল, অনেক দূরে। ওই হোথা অজয় দিয়ে।

.

শীতের শেষে অজয়ের পারে কেঁদুলীর মেলা। বাঙলা দেশের হাজার হাজার বাউল সেখানে জমায়েত হয়ে তিন রাত ধরে আউল-বাউল-কেত্তন গান গায়। কেনা-কাটাও হয় প্রচুর।

সেখানে গুল বাহাদুরের আরেক অভিজ্ঞতা।

এই যে হাজার হাজার ষণ্ডামার্কা লোক দিনরাত্তির ধেই ধেই করে নৃত্য করছে খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুমুচ্ছে, কোনও কিছু করছে কম্মাচ্ছে না, সমাজের তোয়াক্কা করে না, ধর্মের নামে অকাতরে গরিব-দুঃখীদের অনে ভাগ বসাচ্ছে, দরকারে অদরকারে একে অন্যে কামড়াকামড়ি পর্যন্ত করছে– এ তামাশা তৈরি করল কোন মহাজন? কার আদেশে এরা এসব করে, কার হুকুমে গৃহী এদের সব-কিছু জোগায়? এর কী অর্থ, কী মূল্য?

অথচ গুল বাহাদুরের চট করে মনে পড়া উচিত ছিল যে, মুসলমান পীর দরবেশরাও ঠিক এই কর্মই করে থাকে, তারই হীরের টুকরো দিল্লি শহরে– নিজামউদ্দীনের দরগায়, মেহেরৌলীর কুত্ত্বসাহেব, নাসিরউদ্দীন চিরাগ-দিল্লির আস্তানায়। সেখানেও তো বাউণ্ডুলে খোদার খাসিরা ঠিক এদেরই মতো ধেই ধেই করে নৃত্য করে। যিশুখ্রিস্টের ভাষায়, তারাও সুতো কাটে না, মেহন্নতও করে না। এবং তাই শুধু নয়, এখানকার এই বাউলদের ভিতর আছে মুসলমানও।

ছেলেবেলা থেকে আপন ধর্মে যেসব জিনিস গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, সেগুলো একটু ভিন্ন বেশে দেখা দিলেই মানুষ চমকে ওঠে। তার পর হুঁশ হয়, দুটোই হুবহু এক বস্তু। এ-ও যা, ও-ও তা। কালীঘাটের পাঁঠা কাটাতে আর ঈদগার পাশে গরু জবায়ে তফাৎ কী? গুরুকে মাথায় তুলে তাকে অবতার বলা, আর পীরের পায়ে চুমো খেয়ে তাকে আল্লার নূর বলে আত্মতৃপ্তি পাওয়া একই, একই, সম্পূর্ণ একই জিনিস।

গুল বাহাদুরের মনে যখন এ চৈতন্যের উদয় হয় তখন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তাজ্জব মুলুক হিন্দুস্তান। এই এদের আমরা যুগ যুগ ধরে শিরতাজ, মাথার মুকুট করে পরে আসছি আর এদের মনের কোণে কণামাত্র উদ্বেগ নেই এদেশের লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ বর্তমান নিয়ে। এদের কাছে আমরা সব মায়াবদ্ধ জীব (ফানি দুনিয়ার ক্রিমি), আমরা মরলেই কী, বাঁচলেই কী! ইয়া আল্লা মেহেরবান। তোমার কেরামতি বুঝে ওঠা ভার। এ সংসার থেকে মুক্তি পাওয়াই যদি মানব-জীবনের চরম আদর্শ হয় তবে এ সংসারে তুমি তাকে পাঠালে কেন?

.

হঠাৎ খেয়াল গেল, আনন্দী বাউলদের অনুকরণে ধুতিটাকে লুঙ্গির মতো কোমরে বেঁধে এক হাত উপরের দিকে তুলে অদৃশ্য একতারা ধরে নাচছে। দিলেন এক ধমক। শিবুর কথামতো একে ভদ্রলোক না হয় না-ই বানালুম, কিন্তু একে কখনও বৈরাগী হতে দেব না।

কী রে আনন্দী, কী রকম আছিস?

গলা শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখেন–বাঙালি বাবু। লম্বা লিকলিকে চেহারা, গৌরবর্ণ, সরু বাঁকা নাক, বাদামি–প্রায় নীলরঙের দুটি হাসি-হাসি চোখ, উপরের ঠোঁটটি চাপা–নিচেরটি ডপকী হুঁড়িদের মতো একটু পুরুষ্টু এবং রস-ভরভর, পানের লাল না এমনিতেই লাল ঠিক বোঝা গেল না, একমাথা কোঁকড়া বাবরি চুল কিন্তু একেবারে রুক্ষ শুষ্ক, পরনে কটকি জুতো, ধুতি, মেরজাই আর কাঁধের উপর বীরভূমি কেটের চাদর।

বললেন, এই যে বাবাজি, ঝিঙের মুখে তোমার কথা শুনলুম।

গুল বাহাদুর অচেনার আগমনে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, বসুন। মনে মনে ভাবলেন, ঝিঙের মুখে? তবে কি শিবু কিছু বলেনি!

গদরের সেপাইদের মধ্যে একে অন্যকে পরিচয় দেবার জন্য গোপন সংকেত ছিল হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে শরীরের কোনও এক জায়গায় কেমন যেন আনমনে আস্তে আস্তে চক্কর কেটে যাওয়া– তারা যে গোল চাপাটি দিয়ে খবর পাঠাত তারই অনুকরণে। গুল বাহাদুর মাটিতে বসে তার আপন হাঁটুর উপর যেন বেখেয়ালে চক্কর আঁকতে লাগলেন।

বাবুটি চমকে উঠে আপনি হাঁটুতে একটা চক্কর একেই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চল।

 দু-জনা নদীপাড়ের বটগাছতলায় বসলেন।

পূর্ণিমা রাত্রি। সামনে, উঁচু পাড়ির অনেক নিচে অজয়ের ক্ষীণধারা। তার গতিবেগ প্রায় নেই। যেন মরা অজগর সাপ শুয়ে আছে। চাঁদের আলোতে তার আঁশ যেন চিচিক্ করছে। দু-একটি মেয়েছেলে সেই আঁশ যেন আঁজলা আঁজলা করে মাথায় মাখছে। তাদের কালো চুল থেকে ছোট ছোট ঝরনা চিক্ চিক্ করে পড়ছে। জলের ওপারে বিরাট বালুচরের আরম্ভ। তার পর কাশের ঝোঁপ, নিচু পাড়, যাত্রীদের আস্তানা সবকিছু চাঁদের আলোতে স্নান কুয়াশার হিমিকার গ্লানিতে মিশে গিয়েছে। মেলার কোলাহলকে শান্ত নদীর নৈস্তব্ধ্য এখানে গ্রাস করে ফেলেছে।

গুল বাহাদুর বললেন, জিন্দাবাদ বাহাদুর শাহ।

 জিন্দাবাদ বাহাদুর শাহ। জিন্দাবাদ কুমার সিং।

কুমার সিং?

.

০৫.

অনেকক্ষণ ধরে দু-জনাই চুপ। একে অন্যের সঙ্গে এই তাঁদের প্রথম পরিচয়, কিন্তু বাহাদুর শাহ আর কুমার সিং যেন তাদের হাতে হাত, বুকে বুক মিলিয়ে দিলেন, যেন কত দিনকার পরিচয়। দীর্ঘ বিরহের পর মিলন হলে মানুষ যেমন একে অন্যের নিঃশব্দ সঙ্গসুখ প্রথমটায় শুষে নেয়, এদের বেলা তাই হল।

একবার কথা আরম্ভ হলে সে সুখ যেন ক্ষীণ হয়ে আসে।

 গুল বাহাদুর বললেন, সব খতম!

সব খতম। কিন্তু আবার সব শুরু।

 দু-জনায় আবার চুপ।

গুল বাহাদুর বললেন, আমি দিল্লি থেকে এসেছি। আমার নাম—

থাক। নামের প্রয়োজন হলে পরে শুধিয়ে নেব। আমি ঘোষাল।

গুল বাহাদুর বললেন, বুঝেছি।

 আশ্চর্য হয়ে ঘোষাল শুধাল, কী করে?

শিবু বলেছিল। আমার কথা আপনাকে বলেনি?

না। বোধহয় সময় পায়নি।

 গুল বাহাদুর আফসোস করে মনে মনে ভাবলেন, এরকম একটা বিচক্ষণ লোক চলে গেল। বেঁচে থাকে শুধু গাধা-খচ্চরগুলো।

ঘোষাল বললেন, শোন, আমার কথা সব বলি।

এবার ঘোষাল অতি বিশুদ্ধ উর্দুতে আপন বক্তব্য আরম্ভ করলেন।

আমি ছেলেবেলায় পালিয়ে যাই বেহারে। সেখানে অনেক জায়গায় কাজকর্ম করি– এমনকি ইংরেজের সঙ্গেও। শিউরে উঠ না। পরে বুঝবে। ওদের সঙ্গে কাজ না করলে আমি কখনও এরকম গভীরভাবে বুঝতে পারতুম না, এরা কী বজ্জাৎ, কী ধড়িবাজ। কিন্তু সেকথা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করার দরকার এখন নেই। তুমি ফারসিতে যেসব বই পড়েছ, আমিও পড়েছি সেগুলোই। আমরা ব্রাহ্মণ কিন্তু আমাদের বংশে বহুকাল ধরে চলে আসছে ফারসির চর্চা। কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েলুম ইতিহাস চর্চার ফলে নয়। আমার পূর্বপুরুষরা পাঠানদের হয়ে মোগলের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন পূর্ব-বাঙলায়। হেরে গিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নেন, বীরভূমে। জাহাঙ্গীর, শাজাহান, ঔরঙ্গজেব ব্যস্– মাত্র এই তিন বাদশাহর আমলে বাঙলা পরাধীন ছিল, অর্থাৎ দিল্লির হুকুমমাফিক চলেছে। তার পর আমরা আবার সরকারি কাজ করেছি। তার পর এল ইংরেজ। পলাশী থেকে এই একশো বছর আবার আমরা বাড়ি থেকে বেরোইনি।

গুল বাহাদুর অনেক কিছুই জানতেন না। এই ন মাস ধরে তিনি চিনেছেন শুধু ডোম আর সাঁওতালদের। এদেশেও ব্রাহ্মণ আছে, এ কথা তিনি মোটামুটি জানতেন। কিন্তু তারা যে গদরে লড়ে এ খবর তার জানা ছিল না। দিল্লির ব্রাহ্মণেরা পরে চুড়িদার পাজামা, লম্বা শেরওয়ানি, আর মাথায় কিস্তিটুপি। তারা করে পুরুতের কাজ। বিয়ে-শাদিতে এসে মন্ত্রফ পড়ায়– তা-ও সে-মন্ত্র কাগজে লিখে আনে ফারসি হরফে। তারা আবার লড়াই করে কী করে? লড়াই তো করে রাজপুতরা, মারাঠারা, ক্ষত্রিয়রা। তা সে যাক গে। তাঁর মনে তখন লেগেছে আর এক ধোকা। শুধালেন, তোমরা কি শুধু বাঙলার স্বাধীনতা চাও? বাহাদুর শাহকে শাহ-ইন-শাহ বলে মানো না?

ঘোষাল বললেন, ওই তো আরম্ভ হয়ে গেল, হিন্দুস্থানবাসীদের ঝগড়া-কাজিয়া। এসব কথা পরে হবে। উপস্থিত দেখতে পাচ্ছ না, আমাদের ভিতর মিল বেশি, অমিল কম। যদি খুশি হও, তবে না হয় মেনেই নিলুম তোমার বাহাদুর শাহকে। কুমার সিংকে তো মেনেছিলুম। তোমাকেও মানছি। সবাইকে মেনে নেব– দরকার হলে এবং হবেও। তুমি কি মনে কর, আমরা জিতলে সেই পুরনো মোগলাই রাজত্ব আসবে– বাহাদুর শাহকে বাদশা করতে পারলেও? না বাবাজি, দেশের হাওয়া বদলাচ্ছে। বাবুর বাদশাহর মতো রাজত্ব বাহাদুর কখনও করেননি, আর কখনও কেউ পারবে না।

গুল বাহাদুর শুধালেন, আপনারা হেরে গেলেন কেন?

 ঘোষাল হাতজোড় করে বললেন, ওই একটি প্রশ্ন শুধিয়ো না। এর উত্তর দিতে গেলে আবার নতুন করে সেই মর্মন্তুদ পীড়ার ভিতর দিয়ে যেতে হয়, যা ভুলতে পারা একটা জীবনের কর্ম নয়। কোন কোন ভুল না করলে আমরা জিতে যেতুম সে প্রশ্নও তুলো না। আমি নিশ্চয়ই জানি, সে ভুলগুলো না করলে পরে অন্য ভুল করতুম। না বাবাজি, গলদের মূল উৎস কোথায় ছিল তখনও বুঝতে পারিনি, এখনও পারিনি। আমরা এখানে পাথরচাপা দিয়েছি তো ওদিক দিয়ে জল বেরিয়েছে, সেখানে পাথরচাপা দিয়েছি তো অন্য দিক দিয়ে বেরিয়েছে। সর্বাঙ্গে ঘা, মলমফ লাগাই কোথায়?

এখন তবে কর্তব্য কী?

ঘোষাল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, বিলকুল কোনও ধারণা নেই। এখনও মনে মনে জমা-খরচ মিলাচ্ছি। তুমি এসেছ, ভালোই হয়েছে। দিল্লি ফিরে যাচ্ছ না তো?

প্রশ্নটা যেন নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে জিগ্যেস করা হল। ঘোষালই জানতেন এর উত্তর। গুল বাহাদুরও কোনওকিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না।

ঘোষাল বললেন, ছদ্মবেশটা মন্দ ধরনি। বাঙলাটাও খুব যে মন্দ শিখছ তা-ও নয় কিন্তু ডাহা ডোম-ডুমে। এই বেলা ওটাতে লেখা-পড়াও আরম্ভ করে দাও। নিজেই করে নিতে পারবে। কোনও ভাবনা নেই। ওতে সাহিত্য বলে কোনও বালাই নেই। আশ্চর্য, সাতশো না আটশো বছর ধরে বাঙলাতে বই লেখা আরম্ভ হয়েছে অথচ একগণ্ডা কবি বেরোয়নি যাদের ইরানি কবিদের সামনে দাঁড় করানো যায়। ফারসিতে তিনশো বছর যেতে-না-যেতেই ফিরদৌসি, হাফিজ, সাদি, রুমি, আত্তার, নিজামি, আরও কত কে?

গুল বাহাদুর মৃদু আপত্তি জানিয়ে বললেন, বাঙালিরা হয়তো মনে করে, তাদের কবি হাফিজ-সাদির চেয়ে বড়।

ঘোষাল তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, তা করতে পারে। সাঁওতালরা হয়তো মনে করে, তাদের তীর-ধনুক নিয়ে বন্দুক-কামানের সঙ্গে লড়া যায়।

তুলনাটার ঢপ দেখে গুল বাহাদুর একটু হাসলেন।

ঘোষাল বললেন, হাসলে? তা হাস। আমারও বলার বিশেষ হক্ক নেই। আমিও তেমন কোনও চর্চাও করিনি। কিন্তু জানো, সাতশো বছর বাঙলা চর্চা করার পর তারা গদ্য লিখতে আরম্ভ করেছে এই মাত্র সেদিন। পঞ্চাশ বছরও হয়নি। ওই যে রাজা রামমোহন রায়

গুল বাহাদুর চমকে উঠে বললেন, কে?

রাজা রামমোহন রায়। চেন না কি?

গুল বাহাদুর বললেন, হ্যাঁ, আমার পিতার কাছে শুনেছি, বাদশাহ দুসরা আকবরের চিঠি নিয়ে তিনি বিলেত গিয়েছিলেন। আমি তো শুনেছি, উনি জানতেন অতি উত্তম ফারসি এবং আরবি।

ঘোষাল বললেন, তা তিনি জানতেন। এদেশের মুসলমান পণ্ডিতরা তাঁকে নাম দিয়েছেন জবরদস্ত মৌলবি। তার পর একটু অবজ্ঞার সুরে বললেন, লোকটা মৌলবিই বটে। ধর্ম সম্বন্ধে বই লেখে। ফারসিতে একটা লিখেছে। আমার কাছে বোধহয় এখনও আছে। কিন্তু ধর্মে আমার রুচি নেই। তাতে কিছু এসে-যায় না। কিন্তু তাজ্জব কি বাৎ, লোকটা দেশের সবাইকে ইংরেজি শেখাতে চায়।

সে কী?

আশ্চর্য! আরবি-ফারসির রস চেখেছে, শুনেছি ইবরানি সুরয়ানি ইস্তেক (হিব্রু, সিরিয়া) জানে– তার পর এই রুচি! ইংরেজ ব্যাটারা তো পায়খানা ফিরে জল পর্যন্ত থাক্ গে। জানো বাবাজি, এক ব্যাটা ইংরেজের সঙ্গে আমাকে একদিন নিতান্ত বাধ্য হয়ে হাত-নাড়ানাড়ি করতে হয়েছিল। হাতে যেন এখনও গন্ধ লেগে আছে। বেসন দিয়ে কত মেজেছি, ঝামা দিয়ে তার চেয়েও বেশি ঘসেছি।

বলে ডান হাতখানা অতি সন্তর্পণে নাকের ইঞ্চি তিনেক সামনে ধরে দু বার কে বলে উঠলেন, তৌবা তৌবা! এখনও গন্ধ বেরুচ্ছে।

গুল বাহাদুর সহানুভূতির সুরে বললেন, আমিও পাচ্ছি। তা ওই অপকর্ম করতে গেলেন কেন?

সাধে? ওই করে তো সম্বন্ধীকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আর পাঁচজনের চোখের আড়াল করলুম। ঘোষাল চুপ করে গেলেন।

গুল বাহাদুর শোধালেন, তার পর?

ঘোষাল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উদাস সুরে বললেন, তার পর কে কোথায় যায় সে তো আল্লাই জানেন। কেউ যায় বেহেস্তে, কেউ যায় দোজখে, কেউ যায় বৈকুণ্ঠে, কেউ যায় কৈলাসে।

সে আবার কোথায়?

বাবাজি, ধরা পড়ে যাবে। বৈকুণ্ঠটা কোথায় সেটা অন্তত তোমার জানা উচিত। বাবাজিরা মরে গেলে বৈকুণ্ঠে যায়– নামাবলীর কার্পেট পেতে তারই উপরে বসে। আরব্য রজনীতে যেরকম আছে। কিন্তু থাক ওসব। ধর্মে আমার রুচি নেই– তোমাকে তো বলেছি।

অনেকক্ষণ পর গুল বাহাদুর শুধালেন, ইংরেজ মেরেছেন; ইংরেজ আপনাকে তালাশ করছে না?

তা করছে, কিন্তু আমি ইংরেজ মারলুম কখন?

গুল বাহাদুর আশ্চর্য হয়ে বললেন, এই যে বললেন।

তাজ্জব বাৎ শোনালে! অমি বেটাকে নিয়ে গেলুম যেখানে তার বরাতে লেখা ছিল যাবার। তার পর আমাদের সেপাইরা তাদের কাজ করল। আমি কি জল্লাদ?

আপনি তবে কী করতেন?

আমি? আমার কাজ ছিল তাপ্পা, রিপুকর্ম। আজ বন্দুক নেই, জোগাড় কর। কাল বারুদ নেই, ঠ্যালা সামলাও। পরশু খোরাক নেই, আমার নাভিশ্বাস। আরও কত কী? লুঠের মাল বখরা করা, গায়ের লোককে মিথ্যে দিব্যি-দিলাশা দিয়ে তাতানো, চিঠি জাল করা

সে আবার কী?

ইংরেজের গুপ্তচর আমাদের সেপাইদের ভিতর জাল চিঠি পাচার করল, যেন সে চিঠি কুমার সিং ইংরেজকে লিখেছেন আত্মসমর্পণ করে, অবশ্য তার ধনপ্রাণ যেন রক্ষা হয় এই শর্তে। আমি তখন পাল্টা চিঠি জাল করাতুম, ইংরেজ আত্মসমর্পণ করেছে এই মর্মে। সেটা চালিয়ে দিতুম আমাদের সেপাইদের ভিতর। কিন্তু ইংরেজ সেপাইদের ভিতর ভিতর এরকম জালিয়াতি আমরা করতে পারিনি। অতখানি বাঢ়িয়া ইংরেজি লেখা জাল করনেওলা আমাদের ভিতর কেউ ছিল না।

গুল বাহাদুর বললেন, তাই বোধহয় রাজা রামমোহন আমাদের ইংরেজি শেখাতে চান।

ঘোষাল গোসসাভরে বললেন, কচু হবে ইংরেজি শিখে। যেন ইংরেজি চিঠি জাল করতে পারলেই আমরা গদর জিতে যেতুম। যেন কাঠবিড়ালির ধুলো না হলে থাক্ গে– ওসব কেচ্ছা তুমি জান না।

চাঁদ অনেকখানি ঢলে পড়েছে। বাউলদের গীতও ঝিমিয়ে এসেছে।

নদীর জলের রুপোলি ঝিকিমিকি লোপ পেয়েছে, কিংবা সরে গিয়েছে। ওপার থেকে পাড়ি দিয়ে একটা দমকা হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস দু-জনার ভিতর দিয়ে চলে গেল। কিংবা হয়তো গদরেরই দীর্ঘশ্বাস, হায় হায় আফসোস্।

গুল বাহাদুর বললেন, যাক্। তবু ভালো। আমি তো শুনেছিলুম, কুমার সিং সত্যি আত্মসমর্পণ করে ইংরেজকে চিঠি লিখেছিলেন। সেগুলো তা হলে জাল!

ঘোষাল হেসে বললেন, সবকটা জাল হতে যাবে কেন? কিছু সত্যিও ছিল।

 গুল বাহাদুর আশ্চর্য হয়ে বললেন, সে কী?

নিশ্চয়। যখন দেখলুম, ইংরেজ চিঠি চালাচ্ছেই, তখন আমরাও ইংরেজকে দু-চারখানা লিখে পাঠালুম। নানারকম ভুল খবর দিয়ে। নিছক ধাপ্পা মারার জন্য। ঝাসিও তাই করেছিলেন।

কিন্তু এতে করে যে পরে দেশের লোকের মনে ভুল ধারণা হল, কুমার সিং সত্যি সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন। সে ভুল ধারণা সরাবে কে?

দেখ বাবাজি, গদর জিতলে এ ভুল ধারণা থাকত না। আর হারলে তো গাল খাবই। তখন কাজ ছিল লড়াই জেতা। তার জন্য যা প্রয়োজন তাই করেছি। হেরে গিয়েছি সেইটে হল সবচেয়ে বড় গাল। তার ওপর এ-বদনাম তো বোঝার উপর শাকের আঁটি। এবং তার চেয়েও বড় কথা, পকড়ে তলওয়ার দামনকো সম্হালে কোঈ? তলোয়ার নিয়ে হামলা করার সময় রক্তের ছিটে পড়ার ভয়ে কেউ তো কুর্তার অঞ্চল সামলায় না– অর্থাৎ একবার মনস্থির করবার পর ছোটখাটো চিন্তা করতে নেই।

গুল বাহাদুর বললেন, সে তো বিলকুল ঠিক। কিন্তু, ইংরেজ আপনার সন্ধান পাবে কি না, সে-ও কি ওই পর্যায়ের?

ঘোষাল বললেন, প্রায় তাই। কিন্তু আসলে কী জানো, বাবাজি, বেঁচে থাকার ওপর আমি খুব বেশি দাম দিইনে। এই গদরে চলে গেল মানুষগুলো, আর বেঁচে রইল যারা, তাদের আমি দোষ দিইনে, কিন্তু তাদের নিয়ে আমি করব কী? ঝড়ে মোটা আমগুলো ঝরে পড়ে সে তো জানা কথা। আমি নিজে অত্যন্ত সামান্য প্রাণী কিন্তু ওই মহাজনদের সম্পর্কে এসে আমি কয়েক দিনের জন্য কী যে হয়ে গিয়েছিলুম তোমাকে বোঝাই কী প্রকারে? আমি যেন রোগা-পটকা হাড্ডিসার গঙ্গাযাত্রায় জ্যান্ত মড়া হয়ে যাচ্ছিলুম উদ্ধারণপুরের ঘাটে। আমার ঘাড়ে এসে করল ভর এক উড়োনচণ্ডী দানো। আমি উঠলুম লম্ফ দিয়ে, মড়ার খাঁটিয়া ছেড়ে, আর তার পর সে কী তিড়িংবিড়িং ভূতের নৃত্য করলুম কদিন। তখন আমি সব জানি, সব পারি। ওই আনন্দী ছেঁড়াটা তখন যদি আমাকে আব্দার করত, দাদু বেহেস্ত থেকে এনে দাও না আমাকে খুদাতালার কুর্সিখানা, আমি তা হলে একগাল হেসে বলতুম, রঃ। উঁড়া! এনে দিচ্ছি, এ আর এমন কী চাইলি? তার পর দিতুম এক আকাশ-ছোঁয়া লক্ষ। স্বপ্নে যেরকম মানুষ মিন-পাখনায় পায়ের কড়ে আঙ্গুলে অল্প একটু ভর দিলেই হুশ করে উড়ে গিয়ে ঠুকে যায় তার মাথা চাঁদের বুড়ির চরকাতে।

জানো বাবাজি, এ যেন স্বপ্নের মাঝে সম্ভব-অসম্ভবের সীমানা পেরিয়ে আল্লার পায়ের কাছে ফেরেশতা বনে যাওয়া। আর আমার চতুর্দিকে কুমার সিং আর তার সঙ্গী-সাথী। কী সব বাঘ, কী সব সিংহ। আমরা যেন সবাই, অন্ধ-প্রদীপ। আপন আপন সেজে পলতের মতো পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছিলুম। এল কুমার সিংয়ের দীপ্ত দীক্ষা। তার আলো আমাদের এক-একজনকে স্পর্শ করে, আর আমরা প্রদীপশিখার মতো জ্বলে উঠি। আবার আমাদের শিখা জ্বালিয়ে দেয় অন্য প্রদীপ। তাই বলছিলুম, এ তো দীপ্ত-দীক্ষা— এ তো স্পর্শদীক্ষা নয়, সে তো সামান্য জিনিস। পরশপাথরের স্পর্শ লেগে লোহা হয় সোনা, কিন্তু সে সোনা তার পরশ দিয়ে অন্য লোহাকে সোনা করতে পারে না, তাই তার নাম স্পর্শ-দীক্ষা, তার মূল্য আর কী?

সে কী দেয়ালি জালিয়েছিলুম আমরা।

আর আজ, অন্ধকার, অন্ধকার– সব অন্ধকার।

হঠাৎ বলা-নেই, কওয়া নেই, ঘোষাল দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁটুতে মাথা খুঁজে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলেন।

গুল বাহাদুর স্তম্ভিত। বয়স্ক লোক, বিশেষ করে ঘোষালের মতো কট্টর গদর-প্রাণ লোক যে এরকম বে-এক্তেয়ার হয়ে যেতে পারে, তিনি তার জন্য তৈরি ছিলেন না। গুল বাহাদুর তখনও জানতেন না, বাঙালি কতখানি দরদী, ভাবালু, অনুভূতিপ্রবণ।

তিনি চুপ।

ঠিক যে রকম হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন সেই রকমই হঠাৎ মাথা তুলে হেসে বললেন, কিন্তু আমাকে ধরিয়ে দেবে সেই ইংরেজেরই ভূত। বলে ডান হাতখানা নাকের কাছে এনে বার দুই কে বললেন, তৌবা, তৌবা, এখনও গন্ধ বেরুচ্ছে।

পূর্বের মতো গুল বাহাদুর মমতামাখা সুরে বললেন, আমিও পাচ্ছি।

ঘোষাল উৎসাহিত হয়ে বললেন, তবেই বোঝ ঠ্যালা। ওই ইংরেজ ব্যাটার ভূত এসে ভর করেছে আমার পাঁচ আঙুলে। তারই বোটকা গন্ধ ডেকে আনবে আর পাঁচটা ইংরেজকে, ধরিয়ে দেবে আমাকে। না হলে কে জানবে বীরভূমের ঘোষাল আরা জেলার মহব্বত খান! ভূতই শুধু সব-কিছু জানতে পারে।

গুল বাহাদুর বললেন, ইংরেজ মাত্রই জ্যান্ত ভূত। মরে গিয়ে তার আর হের-ফের হয় না।

ঘোষাল একেবারে ছেলেমানুষের মতো আরও যেন উৎসাহ পেয়ে বললেন, যা বলেছ গোসাই। হিন্দু মরে গিয়ে হয় ভূত, মুসলমান মরে গিয়ে হয় মামদো। কথায় কয়, ভূতের। ওপর মামদোবাজি। অর্থাৎ হিন্দুর ওপর মুসলমানের কেরানি। কিন্তু মামদোর ওপর অন্য ভূত কই? সেরকম কোনও প্রবাদ তো এখনও হল না। তা হলে বাহাদুর শা-র ওপর শেষ পর্যন্ত উপর-চাল মারতে পারবে না তো ইংরেজ। বাবাজি, তোমারই জিৎ। জিন্দাবাদ বাহাদুর শাহ।

গুল বাহাদুর বললেন, তুমি যে বলেছিলে বাঙলাতে কিছুই নেই। কিন্তু ভূতের ওপর মামদোবাজি তত খাসা প্রবাদ।

ঘোষাল গম্ভীর হয়ে বললেন, একেবারে কিছু নেই সে-কথা বলবে কে? একটা জিনিস আছে সেটি মহা মোক্ষম। বাঙলার কেত্তন। হরিবোল, হরিবোল বলে নাচন-কুদন নয়। পদকীর্তন। ওর মতো জিনিস হয় না। ঝাড়া পাঁচশো বছর ধরে হাজার হাজার বাঙালি তার প্রেমের গীত আপন গলায় গায়নি– গেয়েছে রাধার গলা দিয়ে, কিংবা কৃষ্ণের বাঁশির ভিতর দিয়ে। ফারসিতে প্রেমের গান গাওয়া হয়েছে লায়লী-মজনু, শীরীন-ফরহাদ, ইউসুফ-জোলেখার ভিতর দিয়ে দেখতেই পাচ্ছ, বিস্তর বখরাদার, ভাগের মা গঙ্গা পায় না, প্রেমটা তেমন জমজমাট ভরভরাট হয়নি। তাই কীর্তনে পাবে ঠাসবুনোট। তার গোড়াপত্তন হয় এইখানেই, এই কেঁদুলীতেই– তবে সংস্কৃতে। জয়দেবের গীতগোবিন্দে। আমি শুনেছি। বিশেষ ভালো লেগেছে, বলতে পারব না। বড় কথার ঝলমলানি। আমি সংস্কৃত বুঝিও না। কিন্তু বাঙলায় পেয়েছে ওই বস্তুই তার আসল খোলতাই। হ্যাঁ, মনে পড়ল, মুসলমান কীর্তনীয়াও বিস্তর আছে। তারই একজন আমাদেরই পাশের সৈয়দ মরতুজা।

গুল বাহাদুর এ নামটি ভালো করে মনে রেখেছিলেন, শিবু মরার সময় তাকে বলে গিয়েছিল বলে। বললেন, এর নাম শুনেছি শিবুর কাছে। তারই কে যেন কী– আনন্দী তাঁর নাম, তার মেহেরবানিতে পেয়েছিল বলে শিবুর ছেলের নাম আনন্দী।

ঘোষাল বললেন, তাই বল। আনন্দ নাম হয়, কিন্তু ডোমপাড়াতে আনন্দী নামের হদিস আমি এতক্ষণ পাইনি। তা সে-কথা পরে হবে। এখন শোন, এই কেত্তন গান বোষ্টমদের জান-প্রাণ। আমাদের চণ্ডীমণ্ডপে প্রায়ই হয়। তুমি এলে কেউ কিছু ভাববেই তো না, উল্টো তোমার গোসাইগিরি আরও ফলাও হয়ে ফুটে উঠবে।

গুল বাহাদুর একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন, আমি তো ওসবের কিছুই জানিনে।

জানবে আবার কী? বসে বসে মাথা নাড়বে, আর মাঝে মাঝে আহা-হা করে উঠবে। তোমাকে তো আর গাইতে হবে না। মুসলমানদের কাওয়ালিতে যখন হিন্দু হমূদ্ ও নাৎ (আল্লা রসুলের প্রশস্তি) শুনতে যায়, তখন তারা সে গীতে পো ধরে নাকি? বেন্দাবনের বাবাজি বসে আছেন, ওই তো ব্যস্। আর হজরত মুহম্মদই তো বলেছেন, মূখের উপাসনা অপেক্ষা গুণীর নিদ্রা শ্রেয়ঃ। কেত্তন চলে অনেক রাত অবধি। ভালো কেত্তনীয়া হলে তো কথাই নেই- ভোর অবধি। কথাবার্তা তখন হবে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ঘোষাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আর কীই-বা আছে কথাবার্তা বলার।

এ রকম নৈরাশ্য গুল বাহাদুরের সয় না। বললেন, অত কাতর হয়ো না বাবুজি। আল্লার ওপর একটু বিশ্বাস রাখতে শেখ।

ঘোষাল হেসে বললেন, আমি তো বিশ্বাস রাখি গোসাই, কিন্তু আল্লা যে আমাকে বিশ্বাস করলেন না। গদরের মেওয়া তো আমার কোঁচড়ে ফেললেন না। আচ্ছা এখন তবে আসি।

গুল বাহাদুর ফার্সিতে চাপান বললেন,

দুঃখ করো না, হারানো ইউসুফ
কিনানে আবার আসিবে ফিরে।

 ঘোষাল ওতর হাঁকলেন,

দলিত শুষ্ক এ মরু পুনঃ
হয়ে গুলিস্তা হাসিবে ধীরে ॥

কেঁদুলী থেকে ডুবসাঁতারে চিকনকালা গায়ে পৌঁছানো যায়। সন্ধ্যার সময় গরুর গাড়িতে উঠে দোলানি-ঝাঁকুনির ভিতর নিদ্রা– সকালবেলা চিকনকালা। সন্ধ্যার সময় চাঁদ থাকবে পায়ের দিকে, ঘুম ভাঙলে দেখবে, তিনিও ডুবসাঁতার মেরে চিকনকালা গাঁ পেরিয়ে পশ্চিমাকাশে ডুবুডুবু।

গুল বাহাদুর ভেবেছিলেন, সন্ধ্যার সময় রওনা দেবেন, কিন্তু ঘোষালের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে যখন রওনা হলেন তখন রাত প্রায় কাবার। দিনের বেলা গরমে গরু দুটোর কষ্ট হবে, কিন্তু গাড়োয়ান গণি মিয়া বলল, বরঞ্চ দুপুরে গরমটা গাছতলায় কাটানো যাবে, কিন্তু এখানে থাকা নয়, ওলা বিবির দয়া হয়েছে, অর্থাৎ কলেরা আরম্ভ হয়েছে।

ওলা বিবি! সে আবার কী! গণি মিয়া পণ্ডিত নয়, তাই ঘোষালের মতো এককথায় সবকিছু বলে দিতে পারল না। অনেক সওয়াল করার পর বেরুল, শেতলা-মনসার মতো ইনি ওলাওঠার দেবী কিংবা বিবি। কিন্তু আর সব দেবী যখন হিন্দুর মৌরশি পাট্টা, তখন ইনিই-বা মুসলমানী হয়ে বিবি খেতাব নিলেন কেন?

গুল বাহাদুর জানতেন না, বাঙলা দেশ তাজ্জব দেশ! ভাগ্যিস তিনি তখনও দখিন বাঙলায় যাননি। সেখানে তা হলে আলাপ-পরিচয় হত জলের দেবতা বদর পীরের সঙ্গে, বড়মো ওরফে বাঘের দেবতা গাজী পীরের সঙ্গে।

এই ঘোষালের সঙ্গেই আলাপ করে তিনি যত না শিখলেন তথ্য, তার চেয়েও বেশি প্রশ্ন। যথা,

এ দেশের খানদানিরাও কিছু কিছু তা হলে গদরে যোগ দিয়েছিল, কিন্তু প্রশ্ন, সে কি শুধু বাঙলা দেশের বাইরে? দেশের ভিতর অন্য খানদানিদের মতিগতি তা হলে কী? তারা যদি ইংরেজকে এদেশ থেকে খেদাতে না চায় তবে তো কোনওকিছু করা অসম্ভব, কারণ তারা যদি নেতৃত্ব না নেয় তবে ডোম-চাড়ালেরা কি আপন হিম্মতে নয়া গদরের তাজা ঝাণ্ডা উঁচু করতে পারবে? তারপরের প্রশ্ন, এই খানদানি অর্থাৎ বামুন এবং চাড়ালদের ভিতর কি অন্য কোনও সম্প্রদায় নেই? দিল্লিতে যে রকম ব্রাহ্মণ আর বেনের মাঝখানে আছে ক্ষত্রিয়রা? দিল্লির ব্রাহ্মণ আর এখানকার ঘোষাল ব্রাহ্মণেই-বা মিল কোথায়? দিল্লির বামুনরা তো করে স্রেফ পুরুতগিরি, এ বামুন তো একদম আগখুর অর্থাৎ আগুন-গিলনেওলা। কিন্তু মারাঠি ব্রাহ্মণ পেশওয়ারাও তো পুরুতগিরি করে না। তবে কি তারা হাতিয়ার নেয়, না শুধু আড়ালে বসে কল-কাঠি নাড়ে?

আনন্দীর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে গুল বাহাদুর ভাবলেন, এসব জাত-বেজাত আর তাদের ফ্যাচাঙ-ফেউ শিখতেই তো যাবে একটা আস্ত জীবন। তা আর কী করা যায়, অন্য কোনও পন্থা যখন আর নেই। আরব্য উপন্যাসের জিনও তো বোতলের ভিতর বন্ধ হয়ে কাটিয়েছিল তিনশো না চারশো বছর। পরমাত্মার কৃপায় তবু তো তিনি মুক্ত অন্তত বোতলের জিন্নির তুলনায়।

দূরের শালবনের ফাঁকে কে যেন ছোট্ট একটি আগুন জ্বালিয়েছে। না, সূর্যঠাকুর ঘুম ভেঙে চোখ কচলে কচলে লাল করে ফেলেছেন। আকাশে চাঁদের আলো কখন মিলল, সূর্যের আলো দেখা দিল তিনি লক্ষই করেননি। পূর্ব থেকে একটুখানি ঠাণ্ডা বাতাস এগিয়ে চলেছে পশ্চিমপানে দেবতার পায়ে পেন্নাম করতে। কিন্তু এ দেবতা বড়ই জাগ্রত বদমেজাজি পীর। ভক্তকে অভ্যর্থনা জানান ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে। পুব-বাঙলা থেকে বেরিয়ে আসা এই তীর্থযাত্রী পূরবিয়া হাওয়াকে তিনি আদর করে গায়ে মাখেন না, উল্টো ছেড়ে দেন পচছিমিয়া গরম বাতাস। আল্লাওয়ার্দী খানের আমলের মারাঠা দস্যুর মতো তারা পশ্চিম দিগন্ত থেকে আসে ঝড়ের মতো হু হু করে, ঘোড়ার খুরে বালি পাথর শুকনো পাতার হাজারো দ জাগিয়ে দিয়ে। একেবারে আকাশজোড়া নিরন্ধ্র, তমসাঘন, সূর্যাচ্ছাদিত একচ্ছত্রাধিপত্য।

দানিশপুর গাঁ ডাইনে রেখে চিকনকালা যেতে হয়। সে গাঁয়ের বাইরে আসতে-না-আসতেই গাড়ির উপর হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল চৌষট্টি পবন মারাঠাদের চৌষট্টি হাজার হর্সপাওয়ার নিয়ে।

সামাল সামাল বলতে-না-বলতেই, গরু, গাড়োয়ান, গুল বাহাদুর খান কারও কোনও খবরদারি হুশিয়ারির তোয়াক্কা না করে গাড়ি ঢুকল দানিশপুর গাঁয়ের ভিতর। তার পর বাঁ দিকে চক্কর খেয়ে শিমুল পলাশ মহুয়ার আড়ালে এক আঙ্গিনায় গিয়ে ছিটকে ফেলে দিল আনন্দী, গুল বাহাদুর, গণি মিয়া মায় দুটো গরুকে একে অন্যের ঘাড়ে। মায়ের সুপুতুর যে রকম বস্তা বস্তা চাল ডাল নুন চিনি আঙ্গিনায় আছাড় মেরে হুঙ্কার দিয়ে কয়, দেখ মা, তোমার জন্যে কী এনেছি। কোথায় লাগে এর কাছে পঞ্চ-পাণ্ডবের দ্রৌপদীকে বাড়ি এনে মাতা কুন্তীকে আনন্দসংবাদ জানানো!

চতুর্দিকে আকাশ-বাতাসে তখন লাল ধুলো-বালির ভূতের নৃত্য। ঝড়টা এমনি অসময়ে এবং অতর্কিতে এসে আক্রমণ করেছে যে ধূর্ত বায়সকুল পর্যন্ত আশ্রয় নেবার ফুরসত পায়নি। সেই ঝড়ের তীব্র সিটির শব্দের ভিতরও ক্ষণে ক্ষণে ভেসে উঠছে তাদের তীক্ষ্ণ মরণাহত আৰ্তরব।

গুল বাহাদুর সবকিছু ভুলে উল্লসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, শাবাস, শাবাস! একেই বলে আক্রমণ; একেই বলে হামলা। বিলকুল বে-খবর এসে বে-এক্তেয়ার করে দিল দুশমনকে।

গুরুদুটো গাড়ি থেকে খালাস করে আনন্দীকে কোলে করে আঙ্গিনায় অন্য প্রান্তরে কুঁড়েঘরের দাওয়াতে উঠতেই গুল বাহাদুরের চোখে পড়ল আরেক ঝড়। ঝড়েরই বেগে ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গিনায় এল এক রমণী। শাড়ির এক অংশ কোমরে বাঁধা, দীর্ঘতর অংশ সোজা উঠে গেছে আকাশের শূন্যে, মাথার চুলও উঠেছে আকাশের দিকে তালগাছের সক্কলের উঁচু পাতাটার মতো ঢপ নিয়ে। তার বগলে একটি ছোট্ট ছাগলের বাচ্চা। এই লালচে অন্ধকারের ভিতরও গুল বাহাদুরের নজরে পড়ল ছাগলবাচ্চাটার দুটো ভয়ার্ত চোখ। আর, আর তার পাশে, একে অন্য থেকে বেশ দূরে আরও দুটি লাল-কালো চোখ। মেয়েটি আসমান থেকে শাড়ি নামিয়ে বুক ঢাকার চেষ্টা না করে সোজা উঠল ঘরের দাওয়ায়। ঝটাৎ করে শিকলি খুলে ঘরের ভিতর ঢুকে এক লহমার তরে দরজা ফাঁক করে ধরল। এহেন প্রলয়নৃত্যের ওক্তে আপ যাইয়ে, আপ বৈঠিয়ে বলে কে? পেছন থেকে গণির বেধড়ক ধাক্কা খেয়ে গুল বাহাদুর পড়লেন মেয়েটার উপর। সে চোট না সামলাতে পেরে পড়ে যাচ্ছে দেখে তাকে জাবড়ে ধরলেন দু হাত দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে। মেয়েটা আ মর মিনষে ওই ধরনের কী যেন একটা বলল। ইতিমধ্যে গণি মিয়া কোনও গতিকে দরজাতে হুড়কো দিয়ে ফেলেছে।

ভিতরে ঘোরঘুট্টি অন্ধকার। শুধু চালের সঙ্গে যেখানে মাটির দেয়াল লেগেছে তারই ফাঁক দিয়ে কেমন যেন একটা লাল আভা দেখা যাচ্ছে গায়ে আগুন লাগলে রাতের বেলা অন্ধকার ঘরে যে রকম বাইরের আগুনের আভাস পাওয়া যায়, বিদ্যুৎ ঝলমল করে উঠলে সক্কলের মুখের উপর সোনালি আবীর মাখিয়ে দেয়।

একটা মোড়া ঠেলে দিয়ে রমণী বলল, বস গোসাঁই। গণি এক কোণে চ্যাটাইয়ের উপর বসেছে। আনন্দী গুল বাহাদুরের হাঁটু জড়িয়ে ধরে ভীত নয়নে এ-দিক ওদিক তাকাচ্ছে।

গুল বাহাদুর দিল্লি শহরে বিস্তর খাপসুরৎ রমণী দেখেছেন। খাঁটি তুর্কি মেয়ের ড্যাবডেবে চোখ, খানদানি পাঠান মেয়ের ধনুকের মতো জোড়া ভুরু, নিকষ্যি কুলীন ইরানি তম্বঙ্গীর দোলায়িত দেহসৌষ্ঠব, এমনকি প্রায় অমিশ্র আর্যকন্যা ব্রাহ্মণকুমারীর সরল বুদ্ধিদীপ্তশান্তসৌন্দর্য তিনি বহুবার দেখেছেন, কিন্তু আজ যে রমণী তাঁর সামনে আধা আলো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তার লাবণ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সৌন্দর্য ছ শো বছরের মিশ্রণের সওগাত। এর গায়ের রঙ এদেশের কচি বাঁশপাতার সবুজ দিয়ে আরম্ভ, তাতে মিশে গিয়েছে পাঠান-মোগলের কিঞ্চিৎ তাঁবা-হলুদের রঙ। চুল ইরানিদের মতো কালো হয়ে গিয়ে যেন নীলের ঝিলিক পড়েছে। কিন্তু তার আসল সৌন্দর্য তার আঁটসাঁট গড়নে সাঁওতাল মেয়ে দেখে যেমন মনে হয় এর দেহ তৈরি হয়েছে গয়ার কালো পাথর দিয়ে। পেটে-পিঠে কোনও জায়গায় একচিমটি ফালতো চর্বি নেই। আলগোছে কোমরে জড়ানো এর শাড়ির আঁচল কোমরটিকে যা ক্ষীণ করে দিয়েছে দিল্লির তৰঙ্গী তার ইজের-বন্ধ কষে বাঁধলেও এ ক্ষীণ কটি পেত না।

প্রথম তরুণ বয়সে গুল বাহাদুর যখন সবে বুঝতে আরম্ভ করেছেন যুবতীর দেহে কী রহস্য লুক্কায়িত রয়েছে, তখন তাঁর এক ইয়ার তাঁকে একখানা চিত্রিত ইউসুফ-জোলেখার বই দিয়েছিল। পাতার পর পাতা উল্টে সে বইয়ে তিনি দেখেছিলেন শিল্পী কীভাবে প্রতি পাতায় জোলেখার সৌন্দর্য ধীরে ধীরে উদঘাটন করেছেন। প্রতি ছত্র, প্রতি রঙ তাঁর অঙ্গে অঙ্গে তখন কী অপূর্ব শিহরণ এনে দিয়েছিল। রোমাঞ্চ কলেবরে কাটিয়েছিলেন অর্ধেক যামিনী।

আজ ঠিক সেইরকম বিদ্যুতের প্রতি ঝলক যেন মেয়েটির সৌন্দর্য পাতার পর পাতা খুলে তাঁর মুগ্ধ আঁখির সামনে তুলে ধরছিল। আর চতুর্দিকে তখন ঝঞ্ঝাবাত্যার প্রলয়নৰ্তন। তারই মাঝখানে এই কমলিনীর ক্ষণে ক্ষণে আত্মবিকাশের মন্দমধুর প্রস্ফুরণ।

কিন্তু আজ আর প্রথমতারুণ্যের সেই রোমাঞ্চ শিহরণ গুল বাহাদুরের দেহে-মনে হিল্লোলিত হল না। আজ এই সৌন্দর্যের পটপরিবর্তন তিনি গভীর তৃপ্তির সঙ্গে গ্রহণ করলেন–শান্ত মনে সমাহিত চিত্তে।

বিদ্যুতালোকে গুল বাহাদুরের চোখে চোখ পড়তে রমণী শুধাল, কী দেখছ, গোসই?

অতিশয় অনাবশ্যক প্রশ্ন। কণ্ঠে লজ্জা দেবার কিংবা পাওয়ারও কোনও রেশ নেই। এমন সময় আকাশ থেকে কক্কড় করে নামল শুকনো দেশের ভরাট অকাল বৃষ্টি। গুল বাহাদুরকে কোনও উত্তর দিতে হল না।

মেয়েটি মাটিতে বসে দু হাতে হাঁটু জড়িয়ে গুল বাহাদুরের মুখের দিকে আবার তাকাল। চিবুক যে জোড় হাঁটুর উপর রাখবে তার যেন উপায় নেই। মাঝখানে সুবিপুল মৃন্ময় মর্ম-বিগ্রহ যুগল।

হঠাৎ রমণী দু বাহু তুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে গুল বাহাদুরকে শুধাল, গোসাই, তোমার বয়স কত?

যেন প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলেন। কিন্তু উত্তর না দিয়ে পাল্টে শুধালেন, কোন বয়স?

রমণী হেসে উঠল। বলল, সে আবার কী? বয়স আবার কত রকমের হয়?

গুল বাহাদুর বললেন, অনেক রকমের হয়। আমার বয়স তেইশ। গদরের নৈরাশ্য এই নাতিদীর্ঘ তেইশকে যেন কত দীর্ঘ তেইশে সম্প্রসারিত করে দিয়েছে।

এবারে রমণী খল খল করে হেসে উঠল। ইয়া আল্লা, ইয়া রসুল, তোমার বয়স তেইশ! আমার-ই তো এক কুড়ি হয়!

গুল বাহাদুর চমকে উঠলেন। এ মেয়ে কি মুসলমান? শুধালেন, তোমার নাম কী?

হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, তোমার যেমন অনেক রকমের বয়স, আমার তেমনি অনেক নাম। লোকে বলে মিছার মা।

সে আবার কী?

বুঝলে না? আমি সাচ্চা মা নই, তাই আমি মিছার মা।

বৃষ্টি নেমেছে দেখে গণি মিয়া গাড়ি-গরুর খবর নিতে বাইরে যাচ্ছিল। এতক্ষণ সে কোনওকিছুতে কান দেয়নি। এবারে একটুখানি দাঁড়িয়ে গুল বাহাদুরের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে যা-তা বলছে, বাবাজি। ওর নাম আসলে মিঠার মা।

মিঠার মা গণির দিকে তাকিয়ে রাগত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁরে গণ্যা, আমি যা-তা বলি? আমি মিছার মা না তো কী? আল্লার কিরে কেটে ক তো?

গণি বাইরে যেতে যেতে বলল, তা তুই নিকে করে বাচ্চা বিয়োলেই পারিস। গুল বাহাদুরকে বলল, আসলে ওর নাম মোতী।

গুল বাহাদুর ভাবলেন, এ-নাম যে দিয়েছে সে আর যাই হোক, মিছের বাপ নয়– সত্যি নামই দিয়েছে। কিন্তু এর জাত কী তার হদিস গুল বাহাদুর তখনও পেলেন না।

কিন্তু এক মুহূর্তেই পাওয়া গেল। তা-ও অনায়াসে।

 আনন্দী বলল, দাদু, জল খাব।

 মোতী শুনতে পেয়েছে। ভাবখানা যেন শুনতে পায়নি।

গুল বাহাদুর বললেন, মোতী, একে একটু পানি খেতে দাও।

 মোতীর মুখ শুকিয়ে গেল। একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, আমি যে মুসলমান।

গুল বাহাদুর বললেন, তুমি পানি দাও।

মোতী চীনেমাটির বাটিতে করে আনন্দীকে জল দিল। সঙ্গে দুটি বাতাসা। গুল বাহাদুরের কাছে এসে এ তো তোমার ছেলে নয়, ঠাকুর। কার ছেলের জাত মারছ?

এই জাত মারামারিতে গুল বাহাদুর একটু বিরক্ত হয়েছিলেন। বললেন, শিবু মোড়লের ছেলে। ও জাত–

আনন্দের চোটে আনন্দীকে জড়িয়ে ধরে মোতী বলল, কোজ্জাব মা, তুই শিবুর ব্যাটা। তাই ক। কী খাবি বল।

মোতী ভারি খুশি। অচেনাজন চেনা লোককে যখন চেনে তখন আর সে অচেনা নয়। আসলে তা-ও নয়– চেনা-অচেনার পার্থক্য মোতী কখনও করেনি। মোতী খুশি হয়েছে, কথা কইবার মতো দু-জনারই একজন চেনা লোক পাওয়া গেল বলে। গুল বাহাদুরকে বলল, ওর কথা আর তুলো না, গোসাই, ওর মতো হতচ্ছাড়া হাড়হাভাতে এ মুলুকে দুটো ছিল না। ক বছরের কথা? আমার সোয়ামী রেখেছে রোজা, জষ্ঠি মাসের গরমে। ইফতারের জন্য আমি করেছি শরবত। র র, থাম্ থাম্ বলতে না বলতে শিবু মেরে দিল-বেবাক ঘটি। ওর আবার জাত। ওর জাত মারে কে?

তার পর গুল বাহাদুরের প্রায় গা ঘেঁষে বসে ফিসফিস করে বলতে আরম্ভ করল, যেন কতই না লুকানো কথা, ওর জাত ছিল সোনা বাঁধানো। একঘটি তেঁতুলের শরবত ঢাললে তার জেল্লাই বাড়ে বই কমে না। আর আসলে ছিল, আমারই মতো বদ্ধ পাগল। জানো, আমার বিয়ের দিনে একজালা তাড়ি খেয়ে এসে জুড়ে দিল কান্না। আমার বাবা নাকি তাকে বলেছিল আমার সঙ্গে তার বিয়ে দেবে। সবাই হেসে গড়াগড়ি। শেষটায় আমার মামা বলল, তা মোড়ল, বিয়ে করবে তো তোমার পাটরানিকে খবর দাও, তিনি এসে বাদীবরণ করে নিয়ে যাবেন। যেই না শোনা অমনি শিবু জল। নেশা কেটে পানি হয়ে গেল। শিবুর বউ ছিল এ তল্লাটের খাণ্ডার। মারমুখী বঁটিদা। তার পর শিবু গলায় ঢোল ঝুলিয়ে শুরু করল নাচতে। পাঁচখানা গায়ের লোককে সেদিন যা হাসিয়েছিল। বিয়ের পর আকছারই আসত আমাদের বাড়িতে। কই গো নাগর বলে আমার সোয়ামীর হাত থেকে হুঁকো কেড়ে নিয়ে একদমে দিত ছিলিম ফাটিয়ে। আসলে ও খেত বড়তামাক।

গুল বাহাদুরের দুঃখ আরও বেড়ে গেল। এরকম একটা গুণরাজ খান চলে গেল। আর কেউ যেতে পারল না?

মোতী আরও গলা নামিয়ে বলল, কিন্তু জানো ঠাকুর, আমার সোয়ামী চলে যাওয়ার পর একদিনও এ বাড়িতে আসেনি। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত। একদিন বাঁধের কাছে ধরা পড়ে গেল। তখন আমায় মনের কথা বলল। ওরা দু-জনে নাকি কোম্পানির সঙ্গে লড়তে যাবার মতলব করেছিল। তার পর শিবু কোথায় উধাও হয়ে গেল। ফিরে এসে বেশিদিন বাঁচল না। কিন্তু ওসব কথা আর কেউ জানে না।

বাইরে আসমান-ফাটা বরষাত নেমেছে, হাওয়ার মাতামাতি বন্ধ হয়ে গিয়ে চাল দিয়ে জলের ধারা ঝালরের মতো ঝুলে পড়ছে। গণি মিয়া দাওয়ায় বসে আছে গালে হাত দিয়ে। বাইরে জলের ধারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মিঠার মা তার বড় বড় ডাগর চোখে শুকনো চোখে।

হঠাৎ হেসে উঠে বলল, লোকে যে আমায় পাগলী বলে, ভুল বলে না। তুমি পায়ের ধুলো দিয়েছ এ বাড়িতে, আর আমি একবার জিগ্যাসাবাদও করছিনে, তোমার সেবার কী হবে?

গুল বাহাদুর তাড়াতাড়ি বললেন, তার জন্যে তুমি চিন্তে কর না, মিঠের মা। গাড়িতে চিড়ে-মুড়ি আছে। না হয় তুমিও কিছু দেবে।

অবাক হয়ে মোতী শুধাল, তুমি জাত মানো না? একটুখানি ভেবে নিয়ে গুল বাহাদুর বললেন, আমার ধর্মে জাত মানামানি বারণ।

মোতী প্রথম একটু অবাক হয়ে তাকাল। তার পর বলল, বুঝেছি। খুব যারা উঁচুতে উঠে যায়, তারা বোধকরি ওসব আর মানে না। আমার বাপের বাড়ির পাশের গায়ে বামুনরা থাকত। ভয়ঙ্কর জাত-বামুন। আমার বাবা বলত, তাদের কেউ কেউ নাকি জাত মানত না। বাবার হাতে তামাক খেত।

গুল বাহাদুরের জানবার ইচ্ছে হল, এই ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা মোতী কোন চোখে দেখে। শুধালেন, এ জিনিসটে কি ভালো?

মোতী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, কী জানি ভালো, না মন্দ। যার যেমন খুশি। আমাদের পীর সাহেবও তাঁর বিবির হাতে ছাড়া খান না। ভালোই করেন নিশ্চয়। তিনি যা জায়গা-বেজায়গায় নিত্যি নিত্যি আড়াই কুড়ি দাওয়াত পান, ওসবের সিকিটাক খেলেও দেখতে হত না। ওই হোথায় বাসা বাঁধতে হত। সেখানে আবার বাবুর্চিখানা নেই। বলে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগল।

গুল বাহাদুর বুঝতে না পেরে বললেন, কোথায়?

ডান হাতে আঁচল দিয়ে মুখ চেপে বাঁ হাতে খোলা দরজা দিয়ে কোথায় যেন দেখিয়ে দিল। গুল বাহাদুর তবু বুঝলেন না।

গোরস্তান গো, গোরস্তান। ওই যেখানে মিছার বাপও ঘুমুচ্ছে।

গুল বাহাদুর মরমী, দরদী লোক নন অন্তত এই তাঁর বিশ্বাস। তবু শুকনো মুখে বললেন, কেন তুমি এ দুঃখের কথা বার বার তুলছ মিঠার মা?

মোতী যেন আশ্চর্য হয়ে গেল। দু হাত জুড়ে বললে, মাফ কর গোসাই, কিন্তু দুঃখের কথা বলল কে? ও তো ওখানে বেশ আরামে ঘুমুচ্ছে। আর যাবার সময় ও তো ভারি হাসিমুখে গিয়েছে। চোখ বুজল, কিন্তু মুখের হাসিটুকু মিলাল না। জিগ্যেস কর না, এই গাঁয়ের পাঁচজনকে, যারা তাকে গোসল করাল, কাফন পরাল।

থাক।

হ্যাঁ, থাক্। দাঁড়াও, আনন্দীর গায়ে একটা কাঁথাচাপা দিয়ে আসি।

তার পর দুজনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ।

গুল বাহাদুর মাঝে মাঝে খোলা দরজা দিয়ে দেখছিলেন, জল ধরার কোনও চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে কি না। মোতী লক্ষ করে বলল, সে আশা ছেড়ে দাও আজ। জল ধরলেও বেরুতে পারবে না। এ গাঁ ও গা-র মাঝখানে যে খোয়াই তার ভিতর বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও জল যা তোড়ে বয় তাতে হাতি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আর কত শো দ। একবার একটাতে মজে গেলে বিনা মেহন্নতে বেরিয়ে যাবে এক ঝটকায় ওই দূরের অজয়ে, তবে জানটা আর সঙ্গে যাবে না। না, থাক। ওসব কথা তুমি ভালোবাস না। আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়। সামলে-সুমলে কথা বলতে হয়।

গুল বাহাদুর বললেন, তুমি তো কিছু খেলে না।

আমি তো দিনের বেলা খাইনে।

সে কী? তামাম বছর রোজা রাখ নাকি?

ওই দুই ঈদের ছটা দিন বাদ দিয়ে। তবু দেখ তো গতরখানা।

ছাড়পত্র পাওয়ার পূর্বেও গুল বাহাদুর অনেকবার সীমা লঙ্ন করেছেন, তবু নতুন করে গতরখানা দেখে খুশিই হলেন। কোনও প্রকারের সহানুভূতি জানাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। বললেন, কার ওজন কতখানি তাই মাপবার জন্য ভগবান দাঁড়িপাল্লা নিয়ে স্বর্গে বসে থাকেন না।

মোতী বলল, হক কথা। কিন্তু আমাদের একটা মুর্শিদীয়া গীত আছে ওই নিয়ে। শুনবে? বলেই গুন গুন করে ধরল– মিষ্টি গলায় কিন্তু কেমন যেন কান্না ভর-র সুরে

দীপ নাই শলিতা নাই,
জ্বলে শখের বাতি
কইয়ো গিয়া মুরশীদের ঠাই।
জ্বলে দিবা জ্বলে রাতি
কইয়ো গিয়া ও ভাই—

ঘুরে ফিরে, এখানে ধরে, ওখানে ছেড়ে, আবার নতুন করে ধরে মোত অনেকক্ষণ ধরে গানটি গাইল। সমস্ত প্রাণ দিয়ে। ঝরঝর বারিধারা যে রকম সহজ পথে আকাশ থেকে নেমে আসে, এর গানও হৃদয়ের উৎস থেকে নেমে এসে ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। রসকষহীন গণি মিয়া পর্যন্ত সরে এসে চৌকাঠের কাছে বসেছে।

গুল বাহাদুর গানের পুরো অর্থ বুঝতে পারলেন না, কিন্তু রস পেতে খুব যে অসুবিধে হল তা নয়। বাচ্চারা যেরকম গল্প শোনার সময় ভাষার দৈন্য কল্পনা দিয়ে পুষিয়ে নিয়ে পুরো রসই পায়, নতুন ভাষা শেখার সময় বয়স্ক লোকও তাই করতে পারে, যদি সে ইতিমধ্যে কল্পনাশক্তি হারিয়ে না ফেলে থাকে। জ্বলে শখের বাতি বলার সময় মোতীর দেহ যেন আরও সুন্দর হয়ে দেখা দিচ্ছিল, আর দীপ নাই শলিতা নাই গাইবার সময় মোতীর চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, গুল বাহাদুরও সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন।

তবু বললেন, বুঝিয়ে বল।

এতে আবার বোঝাবার কী আছে। গুরুকে খবর পাঠাচ্ছি, মহব্বত দরদের তেল শলতে নেই ভিতরে, তবু দেহের বাতি জ্বলছে। তা আবার খামোখা দিনের বেলাও জ্বলে। তাই তো তোমাকে বলছিলুম, গতরটার পানে চেয়ে দেখ।

গুল বাহাদুর মনে মনে বললেন, দেশের প্রতি ভালোবাসা, অত্মোৎসর্গ করার তেল শলতে তৈরি করেই আমরা জ্বালিয়েছিলুম গদরের প্রদীপ। সে মিথ্যা মায়া, ফানি।

কিন্তু মোতীর এই সুন্দর দেহ। এর ভিতরে সুন্দর হিয়ার প্রদীপ নেই- অসম্ভব, সম্পূর্ণ অসম্ভব।

বললেন, মোতী, সবই ভগবানের দান। তাচ্ছিল্য করতে নেই। রোজা ভালো জিনিস, কিন্তু তারও বাড়াবাড়ি করতে নেই। মীরাবাঈয়ের ভজন তুমি শুনেছ,

নিত্য নাহিলে হরি যদি মিলে
জল-জন্তু আছে ঢের
কামিনী ত্যাজিলে হরি যদি মিলে
তবে হরি খোঁজাদের।

 মোতী গদগদ কণ্ঠে বলল, এ তো ভারি মধুর, গোসই। আমি কখনও শুনিনি।

যমুনার পারে রাজপুতানার এক বৈরাগী মীরার ভজন গাইত। গুল বাহাদুর আনমনে তার গান শুনেছেন, মাঝে-মধ্যে, কিন্তু সে গান যে তার মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে, তা তিনি নিজেই জানতেন না। ভক্তিরস, ভাবালুতা গুল বাহাদুর কখনও খুব নেকনজরে দেখেননি। বাড়াবাড়ির ভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আজ তবে চলি, মিঠার মা। খোয়াইয়ের জলটা আমার দেখবার ইচ্ছে আছে। গণি আর আনন্দী রইল। কাল সকালে গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিয়ো।

মোতী বাধা দিল না। গোঁয়ারদের নিয়ে তার জীবনের কেটেছে অনেকখানি তার বাপ-ভাইরা ছিল এক একটি পুঁদে গোঁয়ার।

শিমুলতলায় এসে শুধু গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আচ্ছা গোসই, একটা কথার উত্তর দেবে? এই গণির স্বভাব-চরিত্র কী তা তুমি জানো না। সে আমার বাড়িতে থাকলে তোমার কোনও আপত্তি নেই। সে আমাকে নিয়ে যা খুশি করুক। কিন্তু তুমি থাকলেই আসমান মাথার উপর ভেঙে পড়ে। কেন বল তো? ছোটজাতে ছোটজাতে যা খুশি করুক– নয় কি?

সত্যি বলতে কী, গুল বাহাদুর পরিস্থিতিটা এভাবে চিন্তা করে দেখেননি। কিন্তু মোতীর কথাগুলো এমনি সোজাসুজি তার কানের ভিতর দিয়ে মগজের উপর ঠনঠন হাতুড়ি পিটিয়ে দিল যে তাঁকে চিন্তা করে কথাগুলো বুঝতে হল না। প্রথমটায় থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার পর ধীরে ধীরে বললেন, তোমায় সত্যি বলছি, আমাকে বিশ্বাস কর, আমি অতখানি চিন্তা করে এ ব্যবস্থা করিনি। বোধহয়, এ ব্যবস্থা আমাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর তুমি যে কারণটা দেখালে সেটাও হয়তো ঠিক, কিন্তু আমাকে যদি জিগ্যেস কর তবে বলব, আমি ভদ্রলোক-সাধারণ লোক সকলের সঙ্গেই মিশেছি এবং এ বাবদে আমি গণি মিয়াদের ঢের ঢের বেশি বিশ্বাস করি। এদের হ্যাংলামো অনেক কম। গরিবের সুন্দরী মেয়েকে মোকায় পেলে দ্রলোক-এর মাথায় বদ-খেয়াল চাপবেই। ভদ্রলোকের মেয়ে হলেও তাই তবে সেখানে একটু লাইয়ের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। তাই দেখ, ভদ্রলোকের মেয়েকেও আমরা চাকর-বাকরের হেফাজতিতে রাখা পছন্দ করি। আর

থামলে কেন? বল। কঠিন গলা একটু মোলায়েম হয়েছে বলে মনে হল।

আর গণি ভালো-মন্দ কিছু একটা করতে গেলে তাকে যে রকম ঠাস করে তুমি চড় মারতে পারবে, আমাকে কি–

ধমক দিয়ে বলল, থাক থাক্। কে কাকে চড় মারত কে জানে। বিকেলবেলার বৃষ্টিশেষের কনে-দেখার আলো সবটুকু মুখে মেখে এতক্ষণ-গোপন-রাখা তার সবচেয়ে মিষ্টি গলায় বলল, তবে এসো ঠাকুর।

***

জলের তোড় গুল বাহাদুর অতি উত্তমরূপেই দেখলেন। বাদশাহ মুহম্মদ তুগলুক যে রকম দিল্লির জাহানপানা শহরে সাততলা মঞ্চের উপরে বসে তার হাজার হাজার সৈন্যস্রোত বয়ে যেতে দেখতেন অর্থাৎ একটা উঁচু ঢিবির উপর বসে জলের তোড়, স্রোতের দু উঁচু উঁচু টিবির উপর রাগী ঢেউয়ের ছোবল তাবৎ বস্তুই দেখলেন এবং তার চেয়েও উত্তমরূপে হৃদয়ঙ্গম করলেন, মোতীর– মিছার মার কথা গল্প নয়। এর যেখানে হাঁটুজল সেখানেও দাঁড়ায় কার সাধ্য?

সন্ধের সময় আবার বৃষ্টি নামল। ষোড়শীর রাত কিন্তু মেঘে মেঘে সব অন্ধকার। সমস্ত রাতটা কাটাতে হল ঢিবির উপর।

অভিসম্পাত দিতে দিতে বললেন, মহাজনগণ বলেছেন, মেয়েদের বুদ্ধিতে চলো না। হক কথা। কিন্তু না চললে কী হয় তা-ও বেশ টেরটি পেলুম। ওদের কথা শুনলে বিপদ, না শুনলে আরও বিপদ। এ জাতটাই বজ্জাৎ!

.

০৬.

কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে পান্ডোরা খুলে ফেলল কৌটাটি, আর অমনি তার থেকে পিল পিল করে বেরুতে লাগল দুঃখ, দৈন্য, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, আরও কত কী– আর তারই চোখের সামনে ছড়িয়ে পড়ল ভুবনময়। পান্ডোরা ভয়ে ভয়ে যখন ভিরমি যাব যাব করছে তখন সর্বশেষে বেরুল– আশা। তারই জোরে মানুষ সব দুঃখদৈন্য সয়। আত্মহত্যার দৃঢ় দড়িতে নিজেকে না ঝুলিয়ে দিয়ে ঝুলতে থাকে সেই আশার ক্ষীণ সুতোটিতে।

সুলেমান যখন তার স্বাধিকার-প্রমত্ত জিকে শাস্তি দিয়ে বোতলে পুরে সমুদ্রে ফেলে দেন তখন তাকে পান্ডোরার শেষ দৌলতটি নিতে বাধা দেননি। সেই তার চরম করুণা। জিনি যদি বোতলের ভিতর বন্দিদশার প্রথম প্রহরেই জানতে পেত তাকে ক-শো বছর ধরে বোতলের ভিতর প্রহর নয়– শতাব্দী গুনতে হবে, সে নিশ্চয়ই থ্রম্বসিসে মারা যেত।

গুল বাহাদুর যদি চিকনকালাতে আশ্রয় নেবার দিন জানতে পেতেন, তাঁকে ক-যুগ ওখানে কাটাতে হবে, তা হলে তিনি নামাবলীতে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়তেন। পাভোরার যে ক্ষীণ আশাটি নিয়ে তিনি নামাবলী গায়ে দিয়েছিলেন, সেটি ওরই মতো এত জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছে যে, ওটিকে আর পরা চলে না।

কিন্তু
কেশের আড়ালে জৈছে
পর্বত লুকাইয়া রৈছে।

 ঠিক তেমনি তার দিন-আনি-দিন-খাই-এর আড়ালে আশা-নিরাশা সবকিছুই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বলে সেটা দিব্যি যেন ক্লোরফর্ম কিংবা আফিঙের কাজ করে যাচ্ছিল। পরম ধার্মিকজনও যখন দিনযামিনী এটা-সেটার চিন্তায় মশগুল থেকে শেষের দিনের কথা সম্বন্ধে অচেতন হয়ে যেতে পারে, তখন সামান্য প্রাণী গুল বাহাদুর যে পলাশতলায় খাঁটিয়ার উপর শুয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেবেন তার আর বিচিত্র কী?

কালটাও ছিল ধীরমন্থর। কারও সঙ্গে দেখা করতে হলে তোড়জোড় করতেই লেগে যেত তিন মাস। বিয়ের আলাপ পাকাপাকি করতে নিদেন তিন বছর। এমনকি মরার সময় গঙ্গাযাত্রায় বেরিয়ে সেখানে দিনসাতেক না কাটালে মুরুব্বিরা রীতিমতো বেজার হতেন। অত তাড়া কিসের রে বাপু? দু-পাঁচ দিন হরিনাম শুনবি, চন্দন বেটে ধীরেসুস্থে সর্বাঙ্গে হরিনাম ছাপা হবে, ইষ্টিকুটুম খবর পেয়ে ঘরসংসার গুছিয়ে-গাছিয়ে দেখা করতে আসবে, শুনতে পাবি কবে যাবি, ক দিন আর আছিস তাই নিয়ে চাপা গলায় আলোচনা হচ্ছে, বাজি ধরা হচ্ছে; তা না, চললি হুট করে যেন ডাক পড়ার পূর্বেই হাড়-হাবাতে আপন হাতে আসন পেতে বসে গেল যজ্ঞির দাওয়াতে। কিংবা যেন বাসরঘরে পাঁচজনের সামনে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে ফেললি কনে-বউয়ের ঘোমটাখানি। কিংবা তারও বেশি।

হিসাব কর দিকিনি গুল বাহাদুর, শান্ত মনে– শুদ্ধ-বুদ্ধ চিত্তে। ক বছর হল? দশ, বিশ, ত্রিশ? পিছনের দিকে না সামনের দিকে? তুমি বসে, আর তারা সামনে দিয়ে চলে গেল, না তুমি তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলেছ, না তাদের পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছ? না তুমি কাজের মাঝখানে এমনি যোগসাধনায় তুরীয় ভাব অবলম্বন করেছিলে যে কাল, না কাল কেন, হেন স্বয়ং মহাকালই ধূর্জটির জটার ভিতর প্রথম উর্বশীর মতো বেশ খানিকটা নেচে কুঁদে, তার পর গঙ্গার মতন এদিক-ওদিক পথ না পেয়ে বিষ্ণুর মতন উত্তম ডানলোপিলোর বিছানাতে অনন্ত শয়নে নেতিয়ে পড়েছেন?

কে জানে কী হয়? যেখানে বছরে একদিনও স্মরণ করতে হয় না আজ কোন তারিখ, সেখানে একটা বছরই এক দিন। আর যেখানে দিনে বত্রিশবার স্মরণ করতে হয় আজ অমুক তারিখ, সেখানে একটা দিনই এক বছর। কে জানে সময় কোন্ দিক দিয়ে যায়? দশ, বিশ, ত্রিশ বছর।

এই মোতীর সঙ্গেই আবার দেখা হতে লেগে গেল দেড় মাস।

সকাল থেকেই পুবের আকাশে মেঘ জমে উঠেছে সাঁওতাল দেশের সাঁওতালি মেয়ের গায়ের রঙ মেখে। মেঘের পর মেঘ জমেই উঠছে। যেন আকাশের ভরা গেলাসে পর্জন্য এক-এক ফোঁটা করে জল ঢালছেন আর দেখছেন, এইবারে উছলে পড়ল কি না। ক্ষণে ক্ষণে কালো মেঘের উপর দিয়ে খেলে যাচ্ছে বিদ্যুতের ঝলমলানি। যেন ওই সাঁওতালনীরই শ্যামবদনে টগরফুলের সফেদ হাসি। কিংবা যদি ইন্দ্রপুরীতেই ফিরে যাই তবে মনে হবে, মেঘের কালো টানার উপর উর্বশী বিদ্যুতের রুপোর পোড়েন টানছেন, বাসররাতের কাঁচুলির কিংখাপ বুনতে। নাহ্! এসব তুলনাই অতি কাঁচা। মোক্ষম তুলনাটির চড় বিশ্বসাহিত্যের গালের উপর মেরে দিয়ে গিয়েছেন রাজা শূদ্রক। বিদ্যুৎ যেন শ্যামাস্তু নীলকণ্ঠের গলা জড়িয়ে গৌরীর শুভ্রধবল বাহুলতা।

গৌরী ভুজলতা যত্র বিদ্যুল্লেখেব রাজতে হায় রে শূদ্রক! একটু টেনে-সামলে উপমাগুলো ছাড়লে কেন হে পৃথ্বীরাজ, কাব্যম্রাট? এ যুগের মধ্যমজনকেও যে একদিন রসসৃষ্টি করে নিষ্ক সঞ্চয় করতে হবে সেটা কি তিনি খেয়ালই করলেন না? রাজা হলেই কি এরকম দান করতে হয়? তাই দেশের রাজা হাতিম তাই অন্ন-দান করে হয়েছিলেন অন্নরাজ, কিন্তু তিনিও তো বীচির ধান খাইয়ে ভবিষ্যত্বংশীয়দের নিরন্ন করে যাননি। উপমার বেলা শূদ্রক শেষে নবান্নের বীচিও যে খতম করে গেলেন।

তা যাক। কিন্তু দয়াদাক্ষিণ্য, স্নেহ-প্রেম, বিশেষ করে আসঙ্গলি– এ জগৎ থেকে এখনও লোপ পায়নি।

গুল বাহাদুর দেখলেন, তেপান্তরি মাঠ যেখানে ফালি হয়ে বাঁ দিকে ঢুকেছে, তারই অপর প্রান্তে, মেঘের আড়াল থেকে কে যেন বেরিয়ে এসে একটা উঁচু ঢিবির উপর ক্ষণিকের তরে দাঁড়াল। মাঠ-ঘাট জনহীন। বৃষ্টি নামি-নামছি, নামি-নামছি করছে। এ অবেলায় লোকটার আহামুখি দেখে গুল বাহাদুর ভুরু কোঁচকালেন।

আধ আলো-অন্ধকারে বেলা কতখানি গড়িয়েছে ঠাহর হচ্ছে না। ঘরে ঢুকে গুল বাহাদুর আনন্দীকে শুধালেন, কী খাবে আনন্দী? দিল্লিতে তুই তু শব্দটা প্রায় উঠে গিয়েছে।

আনন্দীর আটপৌরে পোশকি একই মেনু। বলল, খিচুড়ি আর আলুর দম। ওই একটিমাত্র রান্না যার সঙ্গে দিল্লির রান্নার কিঞ্চিৎ ঐক্যসখ্য আছে– গরমমশলার কৃপাতে– অবশ্য আনন্দীর অজান্তে। গুল বাহাদুর সাজসরঞ্জামের চতুরঙ্গ বাহিনী তোড়জোড় করে জোগাড় করতে লাগলেন। আনন্দী কখনও মায়ের আদর পায়নি। পাওয়ার মধ্যে পেয়েছে বাপের ধাতানি। সে-ও এটা-সেটা যোগান দিতে লাগল।

বৃষ্টি নামবার আগে আরও কিছুটা জল এনে রাখলে ভালো হয় ভেবে গুল বাহাদুর ঘর থেকে বেরিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। দাওয়ার এক প্রান্তে খুঁটিতে হেলান দিয়ে মোতী বসে।

তুমি!

নিরুত্তর।

কখন এসেছ? ডাকলে না কেন?

দেয়ালের থেকে চোখ না ফিরিয়েই বললে, তুমি আমাকে ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিতরে চলে গেলে কেন?

গুল বাহাদুর হেসে বললেন, তাজ্জব কি বাৎ! অতদূর থেকে আমি তোমাকে চিনব কী করে? আমি ভাবলুম,–

দত্যি, দানো, মামদো! তোমাদের কাছে সব মুসলমানই মামদো, না?

গুল বাহাদুর বিরক্ত হয়ে ভাবলেন, এ কী জ্বালা! হিন্দু নই, তবু হিন্দু অপরাধের হিস্যে আমাতেও অর্শায়?

গম্ভীর মুখে বললেন, তোমাকে আমি বলিনি, আমার ধর্মে জাত-মানামানি বারণ। চল ভিতরে, ওই দেখ বৃষ্টি আসছে।

এবারে মারাঠা সৈন্যের অতর্কিতে আক্রমণ নয়। দূরদিগন্ত থেকে হেলে-দুলে বিলম্বিত তালে এগিয়ে আসছে আকাশ-জোড়া পাতাল-ছোঁয়া শ্যামসুন্দর মেঘ-বৃষ্টি। এই রকম অগণিত করীযূথ সমাবৃত গাঙ্গেয় চমূ অগ্রসর হচ্ছে শুনেই আলেক্ষান্দর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সমীচীন গণনা করেছিলেন।

এবারে মোতী খিলখিল করে হেসে উঠল। কিছুতেই থামতে চায় না। যেন পেটের ভিতর হামানদিস্তে দিয়ে কেউ পাথর কুটছে। সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গে দুলে দুলে ফুলে ফুলে কাঁপন। গায়ের বসন যেন সে কাঁপন সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে চায়। কার যেন বিরহ-বেদনায় কনকবলয়-ভ্রংশ, অর্থাৎ বাজুবন্দ খোল খোল যাউত হয়েছিল, আজ হাসির হররায় এ রমণীর বসনাঞ্চলপ্রান্ত বিস্রস্ত। এবং স্মরণ রাখা কর্তব্য, গ্রামাঞ্চলে অঞ্চল প্রায়শ উপকণ্ঠিত থাকে না।

চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ঠাকুর, তুমি মস্করা-ফিস্কিরি এক্কেবারে বুঝতে পার না। ওদিকে কথা কও পাকা পাকা। তুমি একটি আস্ত মেড়া। তার পর গম্ভীর হয়ে বলল, আল্লা করুন, তুমি ওই রকম মেড়াই থাকো। আল্লার স্মরণে ডান-বাহু উঁচুতে তুলে আঁচল দিয়ে ঘোমটা টানল। আজান শুনলে বাঙালি মুসলমান মেয়ে যে-রকম করে থাকে।

ওদিকে তখন বৃষ্টির মোটা মোটা ফোঁটা গুল বাহাদুরের ধুলো-ভরা আঙ্গিনায় হরিটের বাতাসা ছড়াতে আরম্ভ করেছে।

গুল বাহাদুর নিজের অপ্রতিভ ভাব কাটাবার জন্য গলা একটু শক্ত করে বললেন, ভিতরে চলো।

মিঠার মা মিশ্রির মিঠা। শক্ত। বললে, জোর করে টেনে নিয়ে যাবে নাকি? সঙ্গে সঙ্গে হাত দুখানি এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও। এবং তারি সঙ্গে সঙ্গে উঠি-উঠি ভাব। টান দিলেই সুড়সুড় করে ভিতরে চলে যাবে।

গুল বাহাদুর দ্বিধায় পড়লেন। কী আর করেন? সুরটি যতদূর পারেন মমতাময় করে বললেন, মেহেরবানি কর। মেহেরবানি কথাটার আমেজ উর্দু এবং বাঙলাতে এক নয়। সেকথা না জেনেও আশা করলেন, মুসলমানের মেয়ে সুরটি ধরতে পারবে।

মোতী গুনগুন করে গান ধরে ভিতরে গেল। বুঝল গুল বাহাদুরের হার হয়েছে, কিন্তু এ লোকটা নিজে যখন বুঝতে পারেনি যে তার হার হয়েছে, তখন সে জেতাতে কী আনন্দ? আর হেরে যাওয়ার দুঃখের ছাপ যদি তার মুখের ওপর পড়ত তা হলেই কি মোতী আনন্দ পেত?

এবারে গুল বাহাদুরকে শুনিয়ে একটু উঁচু গলায় গাইল–

ও মুর্শিদ তোমার লগে নাই তো অভিমান
আইলে আও, যাইলে যাও, ঠেলে মারো টান
ও মুর্শিদ নাই তো অভিমান।
বাচ্চারে যে ঠ্যালা মারলে কান্দ্যা পড়ে মায়ের কোলে
 যতো মারো বাচ্যা উঠে তত পরাণখান।
ও গুরু নাই তো অভিমান।
 তুলাধুনা করা, মৌলা, ফেলাও না ফের জান।
করো না খান খান।
জানুক না জাহান।
মস্তান ফকিরে কয় হেন আমার মনে লয়
শুরুর মনে হৈল ভয়, পায়ে দিল স্থান।
ও মুর্শিদ গেল অভিমান।

এবারে শুল বাহাদুরের গীতটি বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না। কিন্তু খটকা লাগল অভিমান শব্দটি নিয়ে।

মোতী বলল, এতে আবার মুশকিল কোথায়? এই মনে কর আনন্দী যদি তোমার ওপর রাগ করে খিচুড়ি আলুর দম না খেয়ে শুতে যায় তবে সে তোমার ওপর অভিমান করল।

গুল বাহাদুর বললেন, সে তো হল রাগ।

মোতী বলল, তা নয়। যদি সে তখন তোমার ভাতে ছাই মিশিয়ে দেয় তবে হবে রাগ।

এবারে গুল বাহাদুর অনেকখানি বুঝতে পেরে বললেন, ওহ, তাই তুমি আমার ওপর অভিমান করে বাইরে বসে ছিলে?

মোতী উত্তর দিল না।

গুল বাহাদুর শুধালেন, এ গীত তুমি কাকে শোনালে?

মোতী নির্ভয়ে উত্তর দিল, তোমাকে, মুর্শিদকে, আর কাকে?

তোমার মুর্শিদ কে?

মোতী হেসে উঠল। বলল, আজ দেখি, তুমি অনেক কথাই শুধাচ্ছ। কেন, হিংসে হচ্ছে নাকি? হ্যাঁ, আছে একজন। কিন্তু সে বড় বুড়ো। সব রসকষ শুকিয়ে গিয়েছে। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।

গুল বাহাদুর বললেন, ছিঃ, গুরুকে নিয়ে কি এ ধরনের মস্করা করতে আছে?

মোতী বলল, মস্করা কিসের? এই তো আমার সব। আমার জান ভরে দেবে মহব্বত দিয়ে সে তো সব গীতেই আছে। আর আমার শরীরটা? সে বুঝি কিছু নয়? শুরু আমার সব আশা পূর্ণ করবে না?

গুল বাহাদুর নিরাশ হয়ে বললেন, তুমি সবসময় কেমন যেন হেঁয়ালিতে কথা কও। তোমার আশা যদি পাপে ভরা হয় তবে সেটাও গুরু পূর্ণ করবেন নাকি?

মোতী চিন্তা না করেই বলল, নিজেই জানিনে কী চাই। কখনও ইচ্ছে করে মা হয়ে ছেলে কোলে নিতে, কখনও-বা স্বামী পেতে ইচ্ছে করে, আর কখনও মনে হয় দুই, এসব দিয়ে কী হবে? তার চেয়ে একটি নাগর পেলে হয়। ওই যে-রকম তোমাদের রাধা ঠাকুরাণী কেষ্ট-মুরারিকে পেয়েছিলেন। রসের সায়রে সুবো-শাম ডুবে থাকব। আমার শরীর ওর শরীরে মিশে যাবে।

গুল বাহাদুর হাসিমুখে বললেন, যাক, বাঁচালে। মনের কেষ্টকে দিলের হরি বানিয়ে পড়ে থাকো। কোনও বদনাম হবে না।

অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মোতী বলল, ছোঃ! বদনাম! ডবকী ব্লাড়ি। নিকে করিনে। একলা পড়ে আছি। আমার বদনাম তো লেগেই আছে। নাগর নিলে তার আর বাড়বে কী? মড়ার গোরের উপর এক মণও মাটি শ মণও মাটি। আমি তাকে সাজ-সকাল কোলে নিয়ে দাওয়ায় বসব– হাটে যাবার পথের পাশে।

গুল বাহাদুর ভাবলেন, মেয়েটা বদ্ধ পাগল। তার পর ভাবলেন, কিন্তু এরকম সাদা যার দিল তার আর ভাবনা কী? এর ভিতর-বাহির দুই-ই সাফ। বললেন, এসব খেয়ালি পোলাও খেয়ে তুমি খুব সুখ পাও, না? কিন্তু যত্রতত্র বলে বেড়িয়ো না।

মোতী সেদিকে খেয়াল না দিয়ে শুধাল, তোমার সম্বন্ধে বেবাক বাৎ আমার শুনতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বাবাজিদের তো ঘর-গেরস্তির কথা শুধানো বারণ। তবে যদি অভয় দাও তবে একটি কথা শুধাই।

গুল বাহাদুর হেসে বললেন, নির্ভয়ে জিগ্যেস কর। আমার কিচ্ছুটি লুকোবার নেই। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল গোঁফে চাড়া দেবার। কিন্তু গোঁফ তো আর নেই।

তোমার বিয়ে-শাদি হয়নি?

না।

কারোতে মজোনি?

না। তবে লক্ষ্ণৌ থেকে একবার একটি বাঈজি এসেছিল। যেমন নাচতে পারত, তেমনি গান জানত, তেমনি ছিল চেহারাটি। তাকে বড় ভালো লেগেছিল।

তার পর কী হল?

 কিছুই হল না। আমি অন্য কাজে জড়িয়ে পড়লুম। তার পর এখানে চলে এলুম।

ও। কোনও কেলেঙ্কারি করে ভেক নাওনি?

বোষ্টমদের প্রতি গুল বাহাদুরের কোনও অহেতুক প্রেম ছিল না, কিন্তু তারা কেলেঙ্কারি করলেই শুধু ভেক নেয়, এ ইঙ্গিতটা তার ভালো লাগল না।

বললেন, কুল্লে বোষ্টমরা পাষণ্ড?

অত রাগো কেন? আমাদের মুসলমান পীরসায়েবদের দেখনি? তারা যে তাদের চতুর্দিকে আগুন জ্বালিয়ে রাখেন?

সে আবার কী?

ওই, আমার মতো গোটা দশেক খাপসুরৎ ডবকী হুঁড়ির মধ্যিখানে বসে ভাবখানা করেন, হেরো, হেরো, আগুন আমারে ছোঁয় না।

তার পর?

তার পর আবার কী, তার পর বিস্তর ঘি গলে যায়।

গুল বাহাদুর খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আচ্ছা, তুমি অতশত বলছ-কইছ, শুনছ শোনাচ্ছ কেন বল তো? আসলে তোমার মতলবটা কী খুলে বল তো?

মোতী গালে হাত দিয়ে বসে বসে ভাবছিল। বলল, মতলব কিছুই নয় গোঁসাই। আমি ভেবেছিলুম, তুমি নষ্টামি করে বেরিয়ে এসেছ। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। তোমার সঙ্গে নষ্টামি করে আমি নষ্ট হব। এই আমার শরীর, এই আমার দিল। ওগুলো যখন কোনও কাজেই লাগল না, তখন না হয় ভেঙেই দেখি, কী হয়। তা আর হল না। তুমি বড় সরল, বড় সাদা। তোমার সঙ্গে বনলো না।

গুল বাহাদুর আপত্তি জানিয়ে বললেন, এটা মিথ্যে কথা। তোমার সবই ভালো। আমি অনেক দেখেছি, আমি ঠিক ঠিক বলতে পারি। অবশ্য আমার সঙ্গে বনলো কি না সে অন্য কথা।

মোতী আপত্তি জানিয়ে বলল, আমার যদি সবই ভালো তবে তাই হোক ঠাকুর। এবাবে তোমাকে শেষ প্রশ্ন শুধাই। তোমার সংসারে মন বসল না কেন, সেইটে আমায় বল।

গুল বাহাদুর বললেন, সংসারে আমার রত্তিভর অরুচি হয়নি, মোতী। আসলে আমি শিবুর মতো গদরের সেপাই। তোমার স্বামীর যা হওয়ার কথা ছিল। লড়াইয়ে হেরে গা-ঢাকা দিয়েছি। ভেক নিয়েছি যাতে করে দুশমন চিনতে না পারে– আমি মুসলমান।

***

লেখকের নিবেদন :

 এখানেই ‘এক পুরুষ’ শেষ।

বইখানা ‘তিন পুরুষ’-এ সমাপ্ত করার বাসনা ছিল; কিন্তু আমার গুরুই যখন ‘তিন পুরুষ’ লিখতে গিয়ে এক পুরুষে সমাপ্ত করে সেটিকে ‘যোগাযোগ’ নাম দিলেন তখন যাঁর কৃপায় ‘মূক বাচাল হয়’ তাঁরই কৃপায় এস্থলে ‘বাচাল মূক’ হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *